এই ক্ষুদ্র জীবণে চলার পথে পথে সজ্ঞানে অজ্ঞানে, সচেতন অসচেনভাবে ঘটনার আকস্মিকতায় সঞ্চিত হয় বিচিত্র সব ঘটনার স্মৃতিকাব্য। সেই সঞ্চয় থেকাই কিছু খুব মধুর আর খুব দুঃখের কিছু ঘটনার রেশ আমাদের মনে দাগ কেটে দিয়ে যায় জীবণের শেষ ষ্টেশন কেওড়া তলায় পৌঁছা অব্দি। অবসরে কোন জম্পেস আড্ডায় কোন ঘটনার কথোপকথনের উছিলায় আমরা মাঝেসাঝে বেশ হাস্যরসে উচ্ছ্বলিত হয়ে করি সেইসব ফেলে আসা মজার ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন। হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা ফিরে যাই সুবর্ণ অতীতের ধুসর হয়ে যাওয়া রঙিন সেই ছায়ায়।

মুক্তমনায় অনেক সদস্য তাঁদের জীবণে ঘটে যাওয়া নানান আনন্দ বেদনার ঘটনা স্মৃতিচারণ করে আমাদেরকে করে চলেছেন তাঁদের জীবণে ফেলে আসা সেই সব ঘটনার নীরব সাক্ষী। এদের মধ্যে ব্যতিক্রমি ভাবে ম্যারাথন রেসে আছেন গীতা দাস তাঁর “কালের অনুধ্যান” আর মঈনুল রাজু তাঁর “রঙ্গ ভরা অঙ্গনে” সিরিজ লিখে।

তাঁদের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে অতীতের স্মৃতিচারণ মূলক দু’একটি কৈশোর জীবণের বদ হাস্যরস উদ্দীপক ঘটনার(অন্তত আমার কাছে) শ্রুত সাক্ষি বানিয়ে পাঠকদের কিছুক্ষণ ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটানোর সংকল্প নিয়ে কঠিন মিশনে প্রবিষ্ট হলাম।

চলুন, কথা না বাড়িয়ে প্রবেশ করি ঘটনার অন্তরালে।

একঃ

আমি সম্ভবত তখন ৮ম বা ৯বম শ্রেণীর ছাত্র। শারদীয় দুর্গা উৎসব সবে শুরু হয়েছে। আমার বন্ধু ভাস্করের বাসার সামনে দিয়ে ছিল দুর্গা দর্শনার্থীদের অবিরাম যাওয়া আসা। ওর বাসাটা ছিল দুইতলার উপর। মাটির দুর্গা দেখার চেয়ে ওর বাসার বারান্দার রেলিংয়ে হাত বেষ্টন করে উবু হয়ে দাঁড়িয়ে জীবন্ত দুর্গা দর্শন করাই ছিল পূজা চলাকালীন আমাদের প্রত্যাহিক গোধুলি লঘ্নের পুণ্য কাজ। প্রতিবারের মত আমি ভাস্কর, শান্তনু, তিন জনে মিলে নিবিষ্ট মনে অবলোকন করছি দূর্গাদর্শনার্থী। আর ফাঁকে ফাঁকে চলছিল জীবন্ত দূর্গাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এর মধ্যে বাবু নামের এক বন্ধু দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির।
আমরা ওর দিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ না করে আমাদের স্বভাবিক জীবন্ত দূর্গা দেখার কাজে মত্ত ছিলাম।
আমাদের এহেন উপেক্ষা বাবু হয়তো অপমানিত বোধ করেছিল, হঠাৎ বাবুর মাথায় কি জানি খেলে গেল, আচমকা ওর মধ্যমা আঙ্গুল দৃঢ় করে অনেকটা সজোরে শান্তনুর পেছন দিকে গুথিয়ে মারল খোঁচা।

সেদিন শান্তনুর পেন্টের পেছন দিকের জোড়ার সেলাইটা আগেই খানিকটা আলগা হয়ে ঢিলা হয়ে পড়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে তা কারো নজরে আসেনি।
আর যায় কই! বাবুর অব্যর্থ নিশানা আর ব্যর্থ হওয়ার সামান্য সুযোগ অবশিষ্ট রইল না আর।
মধ্যমা পেন্টের সেলাই দু’ভাগ করে সোজা হড়হড়িয়ে পৌঁছে গেল শান্তনুর পেছ্ন দিকের অন্ধ্রপ্রদেশের চিপা গলির মাঝ বরাবর।

ঘটনার আকস্মিকতায় শান্তনু লাফ দিয়ে উবু থেকে সোজা হয়ে গেল। আমরাও নড়েচড়ে সোজা হয়ে নিজেদের আবস্থানের দিক পরিবর্তন করে বাবুর মুখোমুখি ঘুড়ে দাঁড়ালাম।

দেখি, বেচারা বাবু নিজের করা অনাকাঙ্খিত ঘটনায় নিজেই হতবুদ্ধি!

তাড়াতাড়ি আঙ্গুলটা চিপাগলি থেকে টেনে বের করে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে কিনা নিশ্চিত হতে ফ্যাকাসে বদনে কয়েকবার সেই মধ্যমাটি সোজা নিজের নাক বরাবর চালান করে শোঁকাশুকিতে ব্যস্ত।

সম্ভবত আঙ্গুলের ডগায় কিছু একটা বিকট গন্ধের উপস্থিতি টের পেয়ে আঙ্গুলটা শূন্যপানে উঁচিয়ে “ওয়াক থু ওয়াক থু” করতে করতে গৃহ অভিমুখে মারল ভোঁ দৌড়”।

আর আমরা হেসে কুটিকুটি হতে হতে পেটে খিল।

দুইঃ

সবে এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হল। হাতে অফুরন্ত সময়। বন্ধুরা সব আছি যা ইচ্ছে তাই কর মুডে। চট্টগ্রামের ডিসি হিলে নিয়নিত আড্ডা আর তাস খেলেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম বেশ।

একদিন একবন্ধু প্রস্তাব করল- “এভাবে আর কত, চল না কোথাও গিয়ে কিছুদিন ঘুরে আসি”।
সেই সূত্র ধরে আমি প্রস্তাব রাখলাম- “চল কয়েকটা দিন না হয় আমাদের গ্রামে বেড়িয়ে আসি”।
শুধু বাস ভাড়া যোগাড় করলেই হবে। স্বল্প খরচের আমার এই প্রস্তাবে একবাক্যে সবাই সানন্দে রাজী।

দিনক্ষণ ঠিক করে আমি সহ পলাশ, জাফর, ভাস্কর ও শান্তনু সহ মোট পাঁচ বন্ধু এক বিকেলে পৌঁছে যাই আমাদের গ্রামের বাড়ি। রাতে লন্ঠনের আলোয় যথারীতি চলল তাস পেটানো। এরপর ভুরি ভোজ সেরে এল ঘুমানোর পালা। প্রতি রুমেই ছিল একটা করে ডাবল খাট। কিন্তু বন্ধুরা কেউ আলাদা ভাবে শুতে রাজী নয়, রাতের মুখরোচক গ্রুপ গল্প মিস করে কেউ আনন্দ বঞ্চিত হতে চাইছিল না একদম।

সিদ্ধান্ত হল খাটে তিন জন আর মাটিতে পাটি বিছিয়ে দু’জন ঘুমাবে। আমি জাফর, ভাস্কর শুলাম খাটে পলাশ আর শান্তনু শুলো নীচে মাটিতে।

বিশেষত লুঙ্গি পড়ে ঘুমাতে আমারা কয়েকজন স্বাচ্ছন্দবোধ করতাম, তার মধ্যে শান্তনু ছিল।
ভ্রমণ ক্লান্তি জনিত কারণে গ্রুপ গল্পের ফোয়ারা বেশি রাত অব্দি স্থায়ী না হয়ে সহসাই যবনিকা ঘটল।

আমরা খাটের উপর শোয়াতে নীচে পলাশ আর শান্তনুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখি পলাশ শান্তনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।
শান্তনু হঠাৎ ঠাট্টাচ্ছলে উচ্চঃস্বরে খিলখিলিয়ে বলে উঠল- “ওই পলাশ দে……দেখিস মাল টাল আ……আবার যেন ফেলে ভরিয়ে দি……দিস না”।(শান্তনু একটু তোথলা ছিল)।
পলাশ প্রতিউত্তরে বলে উঠল- “আরে ধূর! আমি কি হোমো! তুই আমাকে এত খারাপ ভাবলি”!

ওর কথায় আমরা সবাই হেসে উঠলাম।

দেখি পলাশ আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। হাতে ঈশারা করছে সি………শ। বুঝে গেলাম ও মনে মনে কোন দুষ্ট বুদ্ধি আঁটছে।
আমরা চুপ হয়ে ঘাপটি মেরে রইলাম পরবর্তী ঘটনা কতটুকু অগ্রসর হয় তা দেখার অপেক্ষায়।

দু’এক মিনিট বিরতি দেয়ার পর হঠাৎ আমরা দেখি পলাশ মাথার কাছে রাখা পানির জগ থেকে কিছু পানি হাতের তালুতে ঢেলে নিয়ে শান্তনুর পেছন দিকে লুঙ্গিতে পরম যত্ন সহকারে আলতো ভাবে লাগিয়ে দিচ্ছে।

পলাশের পানি প্রদান শিল্প শেষ হওয়ার পর শান্তনু অনুভব করল ওর লুঙ্গির পেছন দিকটা ক্রমশ ভেজা ভেজা লাগছে।

শান্তনু তৎক্ষনাত লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠল- “তো……তোকে আজ আমি মেরে ফে……ফে…লব, তো…তো……কে না ব……বলেছি মা……মাল টাল না ফে……ফেলতে”!

পলাশ হাত জোড় করে বলে উঠল- “মাফ কর, আর আটকে রাখতে যে পারলাম না বন্ধু”।

আমরা সবাই হো হো করে গলা ছেড়ে হেসে উঠলাম।

তিনঃ

এস.এস.সি. পাস করার পর বন্ধুর কৃপায় একটা ৬/৭ বছরের বয়সি বাচ্চা মেয়ে পড়ানোর দায়িত্ব পেলাম। ১ম দিন গিয়েই উপলব্ধি করলাম বাচ্চাটি খুবি ফুটফুটে, বাকপটু আর প্রাণবন্ত। পড়ানোর সময় ধার্য হল সকাল ৮ টায়। সুখের ঘুমটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে পড়িমরি করে ছুটে হাজির হতাম টিউশনিতে।

ঘরে নাস্তা করার সময় মিলত না। সেই কাঙ্খিত পবিত্র কাজটুকু সেরে নিতাম ছাত্রী পড়ানোর সৌজন্যে। বলা বাহুল্য নাস্তার মানটা মোটামুটি জুতসই ছিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্রীটি বেশ ভাব জমিয়ে তুলল আমার সাথে। আমি নাস্তা খেতে শুরু করলে লক্ষ্য করি ছাত্রীটি আমার দিকে তাকিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এটা সেটা বলে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন নাস্তা মুখে তুলতেই পিচ্চি ছাত্রীটি নিজেই এই রহস্য ভেদ করে ভারী মুখে বলে- “স্যা…র আপনি সব খাবেন না, আমার জন্য রাখবেন”।
কি আর করা, ছাত্রী যখন আবদার করেই বসল তখন পেটে তুফান ছুটলেও কাচুমাচু মুখে অস্ফুট শব্দে বলি- আচ্ছা।

বাচ্চা পড়ানোর সব থেকে ঝামেলার কাজ মুখে মুখে পড়া শিখিয়ে দেয়া।
একদিন ওকে ট্রান্সলেশন শিখানোর কসরত করছি, বল- আমি আমার দেশকে ভালোবাসি।
ছাত্রীটি তৎক্ষনাত দাঁত কেলিয়ে আমাকে বলে বসে- “স্যা…র আপনি কাকে ভালোবাসেন”!

চারঃ

বাংলাদেশ থেকে যতই আই.এল.টি.এস বা টোফেল করে ছাত্ররা ইংল্যান্ড আসুক না কেন ইংরেজীর উচ্চারণ, কথন ভঙ্গি ও শব্দ গত প্রায়োগিক ভিন্নতার কারণে তাদের প্রথম প্রথম বেশ ভাষাগত ঝামেলার সন্মুখিন হতে হয় চিরাচরিত ভাবেই।

দেশ থেকে সদ্যাগত এক ছাত্র এসে কাজে যোগদিল আমার সাথে। আমার পূর্ব পরিচিত ক্রিকেট পাগল এক ইংরেজ ভদ্রলোক নতুন ছাত্রটিকে পেয়ে জুড়ে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট সহ ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গে তুমুল বকবকানি। বলাবাহুল্য সাহেবটি একাই বক্তা, আর আমার সেই নতুন কলিগটি বিনীতভাবে- ইয়েস, ওইয়েস, বলে কোনমতে মানে মানে কেটে পড়ার ফাঁকতালের অপেক্ষায় ছিল।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমি তাদের সমস্ত আলাপ শুনছিলাম।

কিছুক্ষণ একাই বকবক করার পর ইংরেজ সাহেবের একটু যেন হুঁশ হল, আরে, যার সঙ্গে এতক্ষণ বকর বকর করছেন তার নামটি তো জানা হলো না!

কথার ফাঁকে ভদ্রলোক এবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে বসলেন- তোমার নাম কিহে বৎস?

কালবিলম্ব না করেই ছেলেটি যথারীতি উত্তর দিল- ওইয়েস!

উত্তর শুনে ইংরেজ ভদ্রলোকের টাস্কি খাওয়ার যোগাড় , কিছুটা তাজ্জব সুরে বলে উঠেন- “হোয়াট! তোমার নাম ওইয়েস”!