পৃথিবীর প্রতিটা অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সেই অঞ্চলের সামগ্রিক ইতিহাস, আবহাওয়া, প্রকৃতি, মানুষের রুচিকে ধারণ করে এবং বহন করে নিয়ে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। আজ থেকে বহু বছর পরে বাঙালির আত্মপরিচয় নিয়ে যখন গবেষণা হবে, তখন আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি থেকে বহিরাগত আগ্রাসী আধিপত্যবাদী অংশগুলোকে বাদ দিয়েই বিবেচনা করতে হবে, অথবা নানাধরণের সাংস্কৃতিক মিশ্রণের মধ্যে বাঙালির নিজস্বতা কতটুকু তা দিয়েই পরিমাপ হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাঙালি মুসলমান আজও নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে নি। আজও তারা মুসলমান বাঙালি, বাঙালি মুসলমান, বাঙলাদেশি মুসলিম, মুসলিম বাঙলাদেশি ইত্যাদি নানাবিধ আত্মপরিচয় সংকটে আবর্তিত, নাকি তারা দেশকাল হীন বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অংশ তা নিয়েই দ্বিধাগ্রস্থ। ইসলামি ভ্রাতৃত্ত্ববোধ পৃথিবীর তামাম মুসলমানকে যেমন সামগ্রিক ইসলামি ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ করে, ঠিক তেমনি এর প্রভাব তার দেশকালহীন এমন এক মানসিক অবস্থান তৈরি করে, যাতে ধীরে ধীরে তারা নিজ ভূমিতেই পরবাসি হয়ে পরে। যেই মাটি-আলো- বাতাস-রং-রূপ গ্রহণ করে সে এতদূর এসেছে, তাকে সে মোটেও আপন ভাবতে পারে না। বস্তুতপক্ষে এই ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক জীবনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে সর্বদাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিজ ভাষা, নিজ সাহিত্য, নিজ সংস্কৃতি, নিজ মনন। এই অঞ্চলে আর্যদের আবির্ভাবের পরে, মুসলমানদের আবির্ভাবের পরে, তাদের ক্ষমতাদখলের পালাবদলে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ভেতরে শুরু হয়ে যায় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কেউ কেউ নিজেদের আর্য রক্ত ভেবে গর্ববোধ করতে শুরু করেন, আবার কেউ কেউ নিজেদের আরব ইরানের বাসিন্দা বলে গর্বিত হন। একপক্ষ এই অঞ্চলের বাসিন্দাদেরকেই নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করেন, কঠোর বর্ণবাদ প্রথার সমর্থক বনে যান, আরেকপক্ষ বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি ভেবে বর্জন করেন। শিক্ষিত হবার পরেও তাদের এই আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসে নি, হিন্দু মুসলিম দুই পক্ষের ভেতরেই বর্ণবাদ, আশারাফ আতরাফ ইত্যাদি রয়ে গেছে। শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু আর্যত্বের দাবীদার হয়ে নিজেদের ভিনদেশী প্রমাণে ব্যস্ত থেকেছে, অন্যদিকে মুসলমান হয়ে উঠেছে আরব ইরানের। তাই নিজেদের শেকড়, নিজেদের অর্জন তাদের কাছে হয়ে উঠেছে বিদেশি, আর বিদেশি আধিপত্য তার কাছে হয়ে উঠেছে একান্ত আপন। মনস্তাত্বিকভাবে নিজদেশে পরবাসি এই মানসিকতা ভারতবর্ষের অন্যতম মূল সমস্যা। এই সমস্যার মূলে সর্বপ্রথম আঘাত করেছিলেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ একজন দার্শনিক, যার নাম গৌতম বুদ্ধ। সে সময়ে বেদের ভাষা ছিল শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর মানুষদের জন্য, নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য সেই ভাষা ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি, বেদের কথা যেন তারা শুনতে না পায়, সেজন্য তাদের কানে সীসা ঢেলে কান বন্ধ করে দেয়ার রেওয়াজও চালু ছিল। এরপরে সেই ভাষাকে সংস্কার করে সংস্কৃত ভাষা তৈরি হয়, সেটাও ছিল উচ্চবর্ণের মানুষের জন্য নির্ধারিত, নিম্নবর্ণের মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। গৌতমবুদ্ধই সর্বপ্রথম সাধারণ মানুষের ভাষায় গভীর কথাগুলো বলেন, ত্রিপিটক রচিত হয় একদম সাধারণ মানুষের ভাষাতেই। তাই বুঝতে সমস্যা হয় না, গৌতম বুদ্ধ এই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বুঝতে পেরেছিলেন, ভাষার প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের ভালবাসার খোঁজ পেয়েছিলেন।
মার্কিন কবি Ralph Waldo Emerson (1803-1882) বলেছিলেন, “Language is the archives of history.” মূলত ভাষা হচ্ছে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ সময়ের জীবনযাপন প্রণালী এবং অভিজ্ঞতার নির্যাস। একটি ভাষার মৃত্যু মানে হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের মৃত্যু, একটি সভ্যতার মৃত্যু, মানব সভ্যতার একটি অংশের মৃত্যু। নিঃসন্দেহে মানব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার অবশ্যই তার ভাষা। নিজেকে প্রকাশের জন্য প্রয়োজন নিজের ভাষার, অর্থাৎ ভাষাই হল আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। ভাষা হল মানুষের চিন্তাধারার সুশৃংকল প্রকাশ, যার মাধ্যমে মানুষে মানুষের যোগাযোগের এবং মনোভাব প্রকাশের মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। ভাষাকে ইংরেজিতে বলে ‘Expression of Human thoughts’। মানুষের প্রকাশ প্রয়োজন, মূলত ভাষাই মানুষের একমাত্র সৃষ্টি যা অন্য মানুষের সাথে তাকে আত্মিকভাবে সম্পর্কিত করে। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, চিন্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়, তার নিজের অভিজ্ঞতা সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে যায়। ভাষা কোন ব্যক্তিগত অর্জন নয়, একটি সামাজিক নির্মাণ। ভাষা হচ্ছে একটি জাতির জ্ঞানকাণ্ডের বাহন। প্রতিটা অঞ্চলের ভাষা সেই অঞ্চলের জন্যে এবং তার মানুষদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে আমাদের মনে যে আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়, একজন আরব বা ইংরেজের অন্তরে সেই আবেগ কখনই সৃষ্টি হবে না। তাদের কাছে ঐ বিশেষ শব্দটা সাদামাটা একটি ধ্বনি মাত্র, যা একেবারেই ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। আর তাই হৃদয় আন্দোলিত করা এই ছোট ছোট শব্দ, অক্ষর, বর্ণ এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এই শব্দ, অক্ষরগুলো সাধারণের কাছে শুধুই কয়েকটা প্রাণহীন অক্ষর হলেও এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের আবহাওয়া, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সভ্যতার মূল সুর, মানুষের হাজার হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস এবং মানুষের নিজস্ব ঐতিহ্য। তাই এই শব্দগুলোর উপরে আধিপত্যবাদী আক্রমণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, গুপ্ত আগ্রাসনও আসে সবার আগে। পৃথিবীর আগ্রাসী আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো যখন ভিন্ন একটি সভ্যতার উপরে আক্রমণ করে, তখন সর্বপ্রথম সামরিক আগ্রাসন হলেও সেই আগ্রাসন তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে চায় । মিশেল ফুঁকো বলেছিলেন, “’ভাষা যার দখলে, সত্য তার দখলে”। আবার মেকলে বলেছিলেনঃ It is impossible for us, with our limited means, to attempt to educate the body of the people. We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect. To that class we may leave it to refine the vernacular dialects of the country, to enrich those dialects with terms of science borrowed from the Western nomenclature, and to render them by degrees fit vehicles for conveying knowledge to the great mass of the population.] (^ Percival Spear, “Bentinck and Education,” Cambridge Historical Journal(1938) 6#1 pp. 78-101 in JSTOR)
(Thomas Babington Macaulay, 1st Baron Macaulay From Wikipedia, the free encyclopedia)
তার শিক্ষা এবং ভাষা সংস্কার বিষয়ক কার্যক্রম থেকে জানা যায়ঃ He introduced English education in India through his famous minute of February 1835. He called an educational system that would create a class of anglicised Indians who would serve as cultural intermediaries between the British and the Indians. Macaulay succeeded in implementing ideas previously put forward by Lord William Bentinck, the governor general since 1829. Bentinck favored the replacement of Persian by English as the official language, the use of English as the medium of instruction, and the training of English-speaking Indians as teachers. He was inspired by utilitarian ideas and called for “useful learning.” Macaulay convinced the Governor-General to adopt English as the medium of instruction in higher education, from the sixth year of schooling onwards, rather than Sanskrit or Persian then used in the institutions supported by the East India Company. By doing so, Macaulay wanted to “educate a people who cannot at present be educated by means of their mother tongue” and thus, by incorporating English, he sought to “enrich” the Indian languages so “that they could become vehicles for European scientific, historical, and literary expression”. Macaualay’s preference for the English language was based on his view of the local languages as “poor and rude” and on his belief that the body of writing available in Sanskrit and Arabic was no match for the scholarship available in English. He famously stated in his “Minute on Indian Education” (1835): “all the historical information which has been collected from all the books written in Sanskrit language is less valuable than what may be found in the most paltry abridgments used at preparatory schools in England.

স্থানীয় ভাষা ধ্বংস করে তার উপর বিজয়ীর ভাষা চাপিয়ে দেয়া গেলে স্থানীয়ের পক্ষে জাতিসত্তা তথা স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার উপর দমন-নিপীড়ণ চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। বহিরাগত আর্যরা এই অঞ্চলে যত জাতি-গোষ্ঠী ছিল, তাদের সকল ভাষাকে ভাষাকে ধ্বংস করতে সর্বাত্মক নৃশংস ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এই আগ্রাসনের সাথে তারা যুক্ত করেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণবাদী ধর্মকে, তারা এমনভাবে উপস্থাপন করেছিল যেন আর্যরাই জাতিগতভাবে, জ্ঞানে এবং ধর্মে শ্রেষ্ঠ, আর অনার্যরা তুচ্ছ এবং অশিক্ষিত। সেই একই আগ্রাসী মনস্তত্ব লক্ষ্য করা যায় ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের চরিত্রও ছিল এক, যারা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে হিন্দু সংস্কৃতির নাম দিয়ে এই অঞ্চলকে “পাক সাফ” করতে, ভাষাকে তাদের দৃষ্টিতে পূতপবিত্র এবং মুসলমানি করাতে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। বিজিত কোনও জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে চির পদাবনত রাখার এই নোংরা কৌশল আজও সারা পৃথিবীর বিজয়ী আগ্রাসী শক্তির মানসিকতায় বিদ্যমান। এখনও আমাদের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতির উপরে আগ্রাসন চালানো হচ্ছে, ক্রমশ আমাদের ভাষার ভেতরে ভিন্ন ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে চলছে, জোর করে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ভিন্ন আবেগ, ভিন্ন সংস্কৃতি, যা জাতি হিসেবে আমাদের আরও বেশি দুর্বল করে তুলবে, আরও বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু করে তুলবো, বিভক্ত হবো এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আগ্রাসী শক্তিগুলোকে শোষণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবো। সাংস্কৃতিক লেনদেন এবং সংস্কৃতির মিশ্রণ অবশ্যই হবে, কিন্তু সেটা যখন একপাক্ষিক হয়ে ওঠে, তা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলেই পরিগণিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা বাঙলাভাষা কখনই আগ্রাসী ছিল না, বরঞ্চ বাঙলাভাষা সর্বদাই অন্যান্য ভাষা থেকে গ্রহণ করতে উৎসাহী ছিল। নতুনকে গ্রহণ করার, আধুনিকতাকে আত্বস্থ করার প্রবণতা বাঙলাভাষাকে সমৃদ্ধই করেছে, তার শেকড় আরও শক্তিশালী করেছে।
ব্রিটিশ শাসনামলেই সর্বপ্রথম বাঙলাকে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবী তোলেন খোদ এক ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী। বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এই প্রস্তাবটি দেন ব্রিটিশ লেখক ব্রাসি হেলহ্যাড ব্রাসি হেলহ্যাড (25 May 1751 – 18 February 1830)

তিনি বাঙলা ভাষায় অনেকগুলো বই লেখেন এবং ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের শাসনে সহযোগিতার জন্য ১৭৭৮ সালে লেখা ‘গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ’ নামক বইয়ে তিনি এ প্রস্তাব দেন। তখনকার রাষ্ট্রভাষা ফার্সির বদলে বাঙলা ব্যবহার করলে ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের সুবিধা হবে বলে তিনি ঐ বইতে উল্লেখ করেন। এ পর্যন্ত পাওয়া ইতিহাসে বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এটাই সর্বপ্রথম প্রস্তাব। এরপরে ১৯১১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী, ১৯১৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৯৩৭ সালে মওলানা আকরম খাঁ ভারতবর্ষের সাধারণ ভাষা হিসেবে বাঙলাকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি পেশ করেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, তিনিই সর্বপ্রথম ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা আল-ইসলামে প্রকাশ্যে নির্ভীকচিত্তে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা দেন যে, ‘বাঙলা বাঙালি মুসলিমের কেবল মাতৃভাষাই নয়, জাতীয় ভাষাও’।
সাহিত্যিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুণ এই অঞ্চলের মুসলমানরা যখন স্বদেশে প্রবাসি হয়ে আরবের খেজুর এবং মরুভূমির স্বপ্নে বিভোর ছিল, বাঙালি সংস্কৃতি ও সভ্যতায় নিজেদের কোন অবদান নেই বলে প্রায় স্বীকার করেই নিয়েছিল, হিন্দু সাহিত্যিকরা যখন বাঙালি মুসলমানকে উপদ্রব এবং এই অঞ্চলের মানুষ, ভাষা এবং সাহিত্যের সাথে সম্পর্কবিহীন বলে প্রচার করে মুসলিমদের ক্রমশঃ বাঙালিত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদই তখন সর্বপ্রথম অমূল্য কিছু মধ্যযুগীয় পুঁথি সাহিত্য সকলের সামনে তুলে ধরে বাঙালি মুসলিমের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল। এই অঞ্চলের মুসলিমদের স্বদেশ যে শুধুই এই বাঙলা, বাঙলার ভাষা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে যে মুসলিমদের অতি মূল্যবান অবদান রয়েছে, তা তুলে ধরে বাঙলার মুসলিম মানস আবার এই বাঙলায় ফিরিয়ে এনেছিল। এক প্রবন্ধে আবদুল হক বলেন, “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পেছনে সমাজের সর্বাত্মক এবং অনমনীয় সমর্থনকে অন্যতম উপাদান হিসেবে প্রেরণা দিয়েছে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের উত্তরাধিকার-সত্ত্বের চেতনা। এই চেতনা সমাজে যাঁরা সঞ্চারিত করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ”।

এর বিপরীতে শান্তিনিকেতনে বিশ্ব-ভারতীতে এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বাঙালি হয়েও হিন্দীর পক্ষে মত দেন। রবীন্দ্রনাথের এ মতের বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাধারণ ভাষা হিসেবে বাঙলা ভাষার দাবি পেশ করেন। ওই বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পত্রে মহাত্মা গান্ধীকে লিখেছিলেন, ‘The only possible national language for intercourse is Hindi in India’. (তারিখঃ January 28, 1918 সূত্র : রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী—প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃঃ ৭৮); এরপরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আমলেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক এক নিবন্ধ লিখেন এবং বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব দেন। মূলত পাকিস্তান আন্দোলনের শুরুতেই পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদীরা, ধর্মান্ধ মুসলিমরা এবং একই সাথে প্রগতিশীল ইসলামি পুনর্জাগরণবাদী, বুদ্ধিজীবী সমাজের কিছু অংশ পাকিস্তানের আদর্শে সোচ্চার হয়ে বাঙলা এবং বাঙালিকে হিন্দু সংস্কৃতির অংশ বলে ঘোষণা করে। সে সময়ে পাকিস্তান এবং ইসলাম ছিল প্রায় সমার্থক শব্দ, এবং বাঙালির ভাষা প্রীতিকে বিভিন্নভাবে আখ্যায়িত করা শুরু হয় ভারত প্রীতি এবং হিন্দু -প্রীতিতে। হিন্দু- বিদ্বেষ সে সময়ে রাষ্ট্রীয় ভাবেই প্রচার করা শুরু হয়, রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে শুরু করে নজরুলের অনেক লেখাই সুকৌশলে কার্যত নিষিদ্ধ করে দেয়া হতে থাকে। এই চেতনাই সৃষ্টি করে জল-পানি, গাড়ু লোটা-বদনা, ধুতি-লুঙ্গি, কুর্তা-কামিজ-জামাকাপর প্রভৃতি বিভক্তি। বাঙালির অকৃত্রিম ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার পরিপন্থী এই সকল মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী বুদ্ধিজীবী (বিশিষ্ট সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, কবি গোলাম মোস্তফা, সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, অধ্যক্ষ শাইখ শরফুদ্দীন, সাংবাদিক মুজিবুর রহমান খাঁ, অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, ডঃ সৈয়দা ফাতেমা সাদেক সহ অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী) ক্রমাগত প্রচার করতে শুরু করে যে, বাঙলা হিন্দুর ভাষা, পৌত্তলিক হিন্দুদের সংস্কৃতি, দর্শন এবং জীবন বোধের ধারক এবং বাহক, তাই বাঙলা ভাষাকে ব্যাপকভাবে ইসলামিকরণ ছাড়া বাঙালি মুসলিমানের মুসলমানিত্ব রক্ষার আর কোন উপায় নেই। তাই বাঙালিকে মুসলিম হয়ে ওঠার পরামর্শ দেয়া ছাড়াও উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষাকরণ এবং বাঙলা ভাষার ভেতরে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামি করণের প্রয়াস শুরু হয়ে যায়, যেই একই কর্ম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে করেছিলেন কিছু ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী। শুধু তাই নয়, মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী সাহিত্যিকগণ এই সময়ে পত্রিকা এবং সাহিত্যে আরবি ফারসী উর্দু শব্দের বহুল প্রয়োগ ঘটানো শুরু করেন। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী আমাদের নিজেদের ভাষা বিষয়ক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়ে আমাদের ভেতরেই এই সংশয় সৃষ্টির মাধ্যমেই নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। এবং সরকারি অর্থায়নে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীকেও তারা দলে ঢোকাতে পেরেছিল।
অপরদিকে শিখা গোষ্ঠীর কর্ণধার কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ এবং আবুল হোসাইনরা সেইসময়ে বাঙালি মুসলমানের কূপমণ্ডূকতা, শাস্ত্রে মুখ থুবরে পড়ার বিপরীতে নতুন প্রেরণা সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকেন। তারা প্রচার করেন, ‘ জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ , বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট , মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ একই সাথে তারা বহু হাদিসকে বাতিল বলে ঘোষণা করেন, কোরআনের নতুন এবং যুগোপযোগী আধুনিক ব্যাখ্যা দাবী করেন। সেই সময়ে এই আন্দোলন অত্যন্ত প্রগতিশীল ছিল যা বলাই বাহুল্য, এবং বাঙালি মুসলমানের অন্ধত্ব ও অজ্ঞানতার মর্মমূলে আঘাত করার মত এটি একটি শক্তিশালী আন্দোলন ছিল।
এরপরে শুরু হয়েছিল বাঙলাভাষা সংস্কার আন্দোলন, যাতে বলা হচ্ছিল বাঙলাভাষাকে পরিপূর্ণভাবে ইসলা্মিকরণ করার মাধ্যমেই এই অঞ্চলের মানুষের মুসলিম জাতিসত্তা বিকশিত হবে। এ সময়ে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেন, “প্রয়োজনমত আরবি ফারসি শব্দ আমরা আমাদের রচনায় ব্যবহার করবোই। ধর্মীয় সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক কারণে আমাদের তরুণদের কিছু উর্দু শেখা উচিত।” আরবি হরফে বাঙলা লেখার কাজে কীভাবে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগানো হয়েছিল তার নমুনা দেখতে পাওয়া যায় মাওলানা জুলফিকার আলীর কথায়,”স্বপ্নে আমাকে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) দর্শন দান করিয়া এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য ভার প্রদান করেন”।
এছাড়াও ‘হরফ সমস্যা’ নামক একটি বইতে বলা হয়, “যদি বলা যায় যে কোন বিদেশি ইহার অনুপ্রেরণা যোগাইয়াছিলো, তবে সে আর কেউ নন, স্বয়ং মানব-শ্রেষ্ঠ রসুলে করিম (দঃ); এই পথ ধরেই , অর্থাৎ আরবি হরফ গ্রহণের মাধ্যমেই বাঙ্গালি মুসলমানের ইহকাল ও পরকালের মুক্তি মিলিবে এবং আরবি হরফ প্রবর্তিত হলে মনে করা হবে রসুলে কারীমের ইচ্ছা পূর্ণ হইলো!” এই ধরণের প্রচারের বিরোধিতায় আবদুল হক তাঁর ‘ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব’ গ্রন্থে বলেন,”আসলে আরবি অক্ষরের প্রতি মুসলমানের দুর্বলতার সুযোগের খিড়কি পথে তাদের উর্দুতে দীক্ষিত করে নেয়াই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য বলে মনে হয়।” সে সময়ে বাঙলাকে রাষ্ট্র ভাষা না করার এবং বাঙলাভাষা সংস্কারের পক্ষে পিছনে যে সমস্ত যুক্তি দেয়া হচ্ছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিলঃ
১) বাঙলা ভাষায় হিন্দুয়ানী শব্দের ব্যাপক ব্যবহার। যেমন ব্রহ্মাণ্ড, লক্ষ্মীছেলে/মেয়ে। এই সকল শব্দের ইসলা্মিকরণ করা করতে হবে। তাই “দাতাকর্ণ” হয়ে উঠেছিল “দাতা হাতেম”, বিদ্যাদিগগজ” হয়ে ঊঠেছিল “এলেমের জাহাজ”, “অধিক সন্ন্যাসিতে গাজন নষ্ট” হয়ে গিয়েছিল “অনেক পীরে মোজেজা নষ্ট”, মাংস হয়ে উঠেছিল গোশত, ডিম হয়ে উঠেছিল আণ্ডা।
২) সরকারি কাজে টাইপ বা মুদ্রণের ক্ষেত্রে যুক্তাক্ষর এবং স, ষ, ণ, ক্ষ, ব প্রভৃতি বর্ণ বর্জন করতে হবে। যুক্তাক্ষর বর্জন করে বিশশ(বিশ্ব), বিগ্যান(বিজ্ঞান), শামী(স্বামী), শরণ(স্মরণ) ইত্যাদি লিখতে হবে। নতুবা বাঙলা ভাষা সরকারি কাজে ব্যবহারের অনুপযুক্ত।
৩)স্বরচিহ্ন তথা ‘কার’ বর্ণের ডানে বসাতে হবে।
৪) ব্যাঞ্জনচিহ্ন তথা ফলা বর্জন করতে হবে।
৫) বর্ণের উপরের মাত্রা বর্জন করতে হবে।
৬) আরবি বা রোমান হরফে বাঙলা লিখতে হবে।
৭) হিন্দু পুরাণের সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল শব্দ, উপমা, প্রবাদ, বাগধারা বর্জন করে সেখানে ইসলামি শব্দ, উপমা, প্রবাদ, বাগধারা নিয়ে আসতে হবে।
এমনকি স্বয়ং ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও বাঙলা বানান সংস্কারের পক্ষে ছিলেন। অথচ আরবীয় জিম, জে, জোয়াই, জাল, দোয়াত ইংরেজি J, Z এর উচ্চারণ প্রায় একই। আরবি ভাষার ক্ষেত্রে এই ধরণের কোন যুক্তি আনা হয় নি। একই ভাবে ইংরেজি ভাষাতেও প্রচুর পরিমাণে সমস্যা ছিল, উচ্চারণ এবং লেখনে তারতম্য ছিল(যেমন C কখনও চ কখনও ক), সেখানেও এই সব পরিবর্তনের কথা বলা হয় নি।
আবুল মনসুর আহমেদ এইসময়ে দাবি করেন, ‘মুসলমানের মুখের ভাষা বাঙলা, হিন্দুর মুখের বাঙলার থেকে শ্রেষ্ঠ’, তিনি একটি উদাহরণ হিসেবে দেখানঃ
(মুসলমানের বাঙলা)
“ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজীকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়খানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।”
(হিন্দুর বাঙলা)
“অতি ভোরবেলা উঠিয়া পিসিমা খুড়া মশায়কে বলিলেন, আমাকে শিগগির এক গাড়ু জল দাও। আমি প্রাতঃক্রিয়া সারিয়া চান করার পর সন্ধ্যা করিয়া মাধান্নি খাইব।” (১)
শুধু তাই নয়, এই সময়ে আরও এক শ্রেণীর প্রচার শুরু হয়েছিল, যাতে বলা হচ্ছিল, বাঙলা হচ্ছে নিম্নজাতের মানুষের মুখের ভাষা, আর উর্দু তথা উর্দু ফারসি আরবি শব্দের বহুল প্রয়োগে বলা বাঙলা হচ্ছে অভিজাত শ্রেণীর ভাষা। এই সময়ে মুসলমানের অভিজাত ভাষার রূপরেখাও তুলে ধরা হয় উদাহরণের মাধ্যমেঃ
“কলেমা-নমাজ, রোজা, হজ্জ জাকাতই মাশরেকা ও মাগরেবী বাঙলার বাশেন্দা মুসলমানেরও মাযহাবী আরকানা কোরাণ হাদীস ফেকাহ উছুলের জন্য বাঙলা ভাষাভাষী মুসলমানের দরদ ও গরজ কম নয়। পাক পানিতে অজু করে মুয়াজ্জিনের আজান শুনেই তারা মসজিদে গিয়ে ঈমামের পেছনে মোকতাদী হয়ে নিয়ত তাহরীমা রুকু, সিজদা, সালাম, তাকবীরের সহিত বাকায়দা নমাজ আদায় করেন।”
আরবি হরফে বাঙলা লেখা প্রবর্তনের দার্শনিক কাঠামো সৃষ্টি করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান, এর সাথে আরও যুক্ত ছিলেন মওলানা জুলফিকার আলী, পূর্ব বঙ্গশিক্ষা দফতরের সচিব ফজলে আহমদ করিম ফজলী, অধ্যাপক ওসমান গনি, মাওলানা আব্দুর রহমান বেখুদ সহ অনেকেই।
আরবি হরফে বাঙলা লেখা বিষয়ে আদিবাসী নেতা স্বামী কালযুগানন্দ ৭ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে করাচীতে বলে আসেন, “বাঙলা বর্ণমালাকে আরবি হরফে রূপান্তরিত করলে তার সম্পদ ও সৌষ্ঠব বৃদ্ধি পেয়ে তা পুনরুজ্জীবিত হবে এবং ইসলামি রেনেসাঁর সঙ্গে তার বলিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে।”
সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসন শোষণে আরব ইরানের স্বপ্নে বিভোর হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতা ভীরু বাঙালি মুসলমানের এই নিজদেশে প্রবাসি চরিত্র, এই দেশে বড় হয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে আপন না ভেবে ইসলামি তমুদ্দীন তাহজীবের অংশ মনে করা, ধর্ম বলতেই হাটু মুড়ে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যাওয়ার দ্বিধান্বিত চরিত্রের সুযোগ নিয়েই সে সময়ে বাঙলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের পৃষ্টপোষকতায় একটি দার্শনিক, আগ্রাসি, বাঙালি চেতনা বিরোধি দার্শনিক রাজনৈতিক চিন্তা শক্তিশালী করা হচ্ছিল। তার বিপক্ষে শুধুমাত্র একটি বিধ্বংসি যুক্তিই যথেষ্ট ছিল, তাদের সমস্ত প্রচার প্রোপাগান্ডাকে ধ্বসিয়ে দিতে সমর্থ। আর তা হচ্ছে, আরবি ভাষাও ইসলাম পূর্বকালের আরবের ভাষা, যা সমৃদ্ধ করেছে পৌত্তলিক আরব, পৌত্তলিক কবি সাহিত্যক, ইহুদি এবং খ্রিষ্টানরা সকলে মিলে। আরবি ভাষার ভেতরেও প্রথিত রয়েছে পৌত্তলিকতার বীজ, পৌত্তলিক সংস্কৃতি এবং আচার অনুষ্ঠানের ছায়া। যেমন শুধুমাত্র আল্লাহ(আল-ইলাহ) শব্দটি বা হজ্জ (যা মূর্তি দর্শন নামে পরিচিত ছিল- কাবার ৩৬০ টা মূর্তি দর্শনের জন্য বহু পূর্ব হতেই কাবায় হজ্জ অনুষ্ঠিত হত) বা কোরবানি অনুষ্ঠান। কিন্তু ইসলাম কখনই সেই সব শব্দ, সেই ভাষা বা সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বা ব্যাপক সংশোধন করে নতুন ভাষা, নতুন সংস্কৃতি প্রচলন করেনি, বরঞ্চ সেই ভাষা-সংস্কৃতির সাথে নিজেকে অভিযোজিত করেছে।
বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করবার মত যোগ্য বাঙলা ভাষা কিনা তা নিয়েই দ্বিধান্বিত বাঙালিকে সেই সময়ে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে। ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ, যৌক্তিক উপায়ে বিভিন্ন ধরণের নেতিবাচক প্রস্তাব খণ্ডন এবং আগ্রাসী সিদ্ধান্তের সমুচিত জবাব দেয়ার মাধ্যমেই বাঙালি তাদের ভাষাকে সম্মানের সাথে নিজেদের বুকে স্থান দিয়েছে, প্রয়োজনে বুকের রক্তও দিয়েছে। আর সকল আধিপত্যবাদি আগ্রাসি চক্রান্তকে ধ্বংস করে একুশের চেতনা হয়ে উঠেছিল একেবারেই বাঙালি জাতিসত্তার পূণনির্মাণ এবং নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়া। তাই বাহান্নো এবং বাঙালির ভাষা আন্দোলনই বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অর্জন, যা আমাদের স্বাধীন আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সৃষ্টি করার মাধ্যমে আমাদের এক নতুন পথ দেখিয়েছিল, পরবর্তীতে যা বাঙলাদেশ সৃষ্টি করেছিল। একুশের চেতনা ছিল মাথা নত না করার চেতনা, একুশের চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙলাদেশ গঠনের চেতনা, একুশের চেতনা ছিল ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যেই নিরন্তর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলে মানুষের মননে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনা। সেই চেতনার মহান স্রষ্টা সেই সকল ভাষা সৈনিক এবং বাঙলা ভাষার পক্ষে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে লড়াই করা হাজারো যোদ্ধাকে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
ড. মিজান রহমান কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার ভবিষ্যত’ নামক চটি গ্রন্থে আবুল কাসেম ফজলুল হকের বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন বিষয়ে একটি আশংকার কথা প্রকাশিত হয়েছে, যা উদ্ধৃত করা হলঃ
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হেরি কে. টমাস এক বক্তৃতায় বলেছেন, বাংলাদেশে গরিবদের ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায়, মধ্যবিত্তদের ছেলেমেয়েরা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে, আর ধনীদের ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়বে। গত পনের বছরে বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দ্রুত বাড়ানো হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে, আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকে দ্রুতগতিতে মাদ্রাসা বাড়ানো হয়েছে। এ দ্বারা জাতিকে স্কুলপন্থী ও মাদ্রাসাপন্থী- এই দুই ধারায় বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। সেই সঙ্গে সুকৌশলে ‘মৌলবাদী’ ও ‘মৌলবাদবিরোধী’ রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করে তাদের মধ্যে সংঘাত লাগিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুই ধারাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য হেরি কে. টমাসদের তথা ইউরো-মার্কিন কূটনৈতিক মহলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। হেরি কে. টমাসরা বাংলাদেশে এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে দিতে চাইছেন যাতে মাদ্রাসাওয়ালা ও বাংলাওয়ালাদের উপর কর্তৃত্ব করবে ইংলিশওয়ালারা; দেশের নেতৃত্ব নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা থাকবে না, ক্ষমতার লড়াই থাকবে, যারা দেশ চালাবেন তারা কেবল সুশাসনের (Good governance) তালিম নেবেন, আর উপর থেকে কর্তৃত্ব করবেন হেরি কে. টমাসরা। সিভিল সোসাইটিসমূহ আর বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল সুশাসনের জন্য প্রশাসনকে বাইরে থেকে চাপ দেবে। সরকারি সংস্থা (Government Organizations, GO) এবং বেসরকারি সংস্থার (NGO) সমান্তরাল কার্যক্রম দ্বারা জনজীবন পরিচালিত হবে-রাষ্ট্রের সত্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিসন্ধি অনুযায়ী বিশ্বায়নে বিলীন হবে। রাষ্ট্র বিলুপ্ত করার আগেই জাতীয় ভাষা ও জাতীয় সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা হচ্ছে। প্রশ্ন হল, জাতীয় ভাষা, জাতীয় সংস্কৃতি আর নিজেদের রাষ্ট্র না থাকলে জনগণের থাকবেটা কী?
মূলত বাহান্নর পরে বাঙালি মুসলমান সত্যিকার অর্থেই বাঙালি হয়ে ওঠার প্রেরণা এবং চাপ অনুভব করতে শুরু করে। কিন্তু তারপরেও সত্য হচ্ছে, একুশের চেতনা সেসময়ে এই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় নি। একুশ হয়ে উঠেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের, যার সাথে যারা উচ্চবিত্ত তারা একাত্মবোধ করতে পারে নি, এই অঞ্চলে যারা নিম্নবিত্ত তারা সেটা ধারণ করতে পারে নি। তাই প্রগতিশীলতা পরিণত হয়েছে একশ্রেণীর শিক্ষিত বাঙালির ড্রয়িংরুম আড্ডার উপকরণ হিসেবে, যার সাথে অর্থনীতি এবং রাজনীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। যারা বাঙলাভাষা নিয়ে সে সময়ে সংগ্রাম করেছেন, তারাও খুব আধুনিক এবং প্রগতিশীল হয়ে ওঠেন নি। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের সাথেই প্রতারণা করে গেছেন। একুশের চেতনার সাথে আধুনিকতা এবং প্রগতির পরিবর্তনশীলতার ঐক্য গড়ে ওঠে নি, সেটা পরিণত হয়েছে একশ্রেণীর শিক্ষিত বাঙালির নতুন ধর্মের, নতুন প্রথার।
ইতিহাস সবসময় বিজয়ী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব আরোপ করে, “যেসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে সে নিজে লড়াই করে জয়লাভ করেছে, সে যেন অন্য কোনও ক্ষুদ্র জন/জাতিগোষ্ঠীর ওপর সেসব নিপীড়ন না চালায়।” সেই দিক থেকে, বিজয়ি বাঙালি শাসক শ্রেণী এবং বর্তমান বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, বাঙলাদেশের সীমানার ভেতরে শত শত বছর ধরে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিসত্তাভুক্ত নানান জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের যথাযথ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা, আদিবাসী পাহাড়িদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের অধিকার বাস্তবায়ন, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করা এবং বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতর, ক্ষেত্রবিশেষে, তাদের স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাদের নিজ নিজ সভ্যতা সংস্কৃতি ঐতিহ্য রক্ষা। বস্তুতপক্ষে সেভাবেই আমরা একটু আধুনিক, মননশীল, ভাষাপ্রেমী, বৈচিত্রময় সভ্য জাতিসত্তা হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বসভায় সম্মানের সাথে দাঁড়াতে পারবো।

তথ্যসুত্রঃ
১) বাঙলাভাষা-সংস্কার আন্দোলন
-আহমদ শরীফ
২) ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল
-বদরুদ্দীন উমর
৩) ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
-বশীর আলহেলাল
৪) ভাষা আন্দোলনের দলিল
-আবুল আহসান চৌধুরী।
5.(Thomas Babington Macaulay, 1st Baron Macaulay
From Wikipedia, the free encyclopedia)
6.^ Stephen Evans, “Macaulay’s minute revisited: Colonial language policy in nineteenth-century India,” Journal of Multilingual and Multicultural Development(2002) 23#4 pp 260-281 DOI: 10.1080/01434630208666469