আমি কি একটা বাঁদর?
মূল : ফ্রান্সিসকো জে. আয়ালা
অনুবাদ : অনন্ত বিজয় দাশ

জীবজগতে আমি (মানুষ) হচ্ছি প্রাইমেট বর্গের। বানরও হচ্ছে প্রাইমেট বর্গের। তবে আমি কিন্তু মোটেও ‘বানর’ নই। প্রাইমেট বর্গের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মানুষ, বানর ও এপ (গরিলা, ওরাঙওটাং, শিম্পাঞ্জি)। জীববিবর্তনের দৃষ্টিতে মানুষ বানর থেকে এপদের সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ট আত্মীয়। বলা যায়, জীবজগতে এপরা হচ্ছে মানুষের প্রথম-কাজিন, আর বানর হচ্ছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কাজিন। আবার এপদের মধ্যে শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ট, তারপর গরিলা এবং শেষে ওরাঙওটাং। মানুষের বংশধারা ও শিম্পাঞ্জির বংশধারা আজ থেকে প্রায় ষাট থেকে সত্তর লক্ষ বছর আগে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জীববিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন তিনটি পদ্ধতিতে পরীক্ষার মাধ্যমে। একটা হচ্ছে বর্তমানকালের জীবিত প্রাইমেটদের সাথে মানুষের এনাটমির তুলনামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে, দ্বিতীয় হচ্ছে অতীতকালের প্রাইমেটদের ফসিল পরীক্ষার মাধ্যমে এবং তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে মানুষের সাথে এসব প্রাইমেটদের ডিএনএ, প্রোটিন ও অন্যান্য জৈবঅণুর তুলনামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। আধুনিককালে ডিএনএ ও প্রোটিন গবেষণার মাধ্যমে প্রাইমেটের বিবর্তন ধারা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত জানা সম্ভব হচ্ছে এবং এখান থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে কোন কোন প্রাইমেটদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন। পাশাপাশি আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ের সাথে সাথে মানব-সদৃশ বিবর্তনের গতি সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীদের অবশ্যই ফসিল নিয়ে গবেষণা করতে হয়।

চার্লস ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থে মানব-বিবর্তন সম্পর্কে কিছু না বললেও ১৮৭১ সালে প্রকাশিত আরেকটি বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’-এ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন মানুষ ও এপরা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং ঐ সাধারণ পুরুষরা মোটেও ‘মানুষ’ ছিল না। ডারউইনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেক প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিয়েছিল ধর্মবাদী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী বিজ্ঞানীরা। মানুষ ও এপের ‘মিসিং লিংক’ কোথায়? কোথায় সেই মধ্যবর্তী জীব যাদের মধ্যে এপ এবং মানুষের বৈশিষ্ট্য রয়েছে? ইত্যাদি। ডারউইন তাঁর ডিসেন্ট অব ম্যান গ্রন্থে প্রাকৃতিক নির্বাচনের আলোকে মানুষের বিবর্তন ব্যাখ্যা করেছিলেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাইমেটের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষের বংশানুক্রম (লিনিজ) ও শিম্পাঞ্জির বংশানুক্রম আলাদা হয়ে গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছয় বা সাত মিলিয়ন বছর আগে। মানুষের লিনিজের সেই পূর্বপুরুষদের জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘হোমিনিড’ বা ‘হোমিনিন’। ডারউইন মারা যান ১৮৮২ সালে। তাঁর মৃত্যুর সময়ও কোনো হোমিনিড ফসিল সম্পর্কে প্রত্নজীবিজ্ঞানীদের কাছে তথ্য ছিল না। যদিও ডারউইন ডিসেন্ট অব ম্যান গ্রন্থে অনুমান করেছিলেন এ ধরনের হোমিনিড ফসিল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।

প্রথম হোমিনিড আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৮৮৯ সালে। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে এ ফসিলটি আবিষ্কার করেন ডাচ শারীরবিদ ইয়োজিন ডিবোয়া (১৮৫৮-১৯৪০)। ফসিল হিসেবে তিনি শুধুমাত্র একটি ফিমার বা ঊর্বাস্থি (ঊরুর হাড়) এবং ছোট্ট একটি মাথার খুলি উদ্ধার করেন। ইয়োজিন ডিবোয়া সেইসময় মানব-এনাটমি’র একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ঊর্বাস্থি ফসিল পরীক্ষায় তিনি বুঝতে পারলেন এগুলো হাঁটতে পারে এমন দ্বিপদী ব্যক্তির হাড়গোড়। আধুনিক মানুষের ফিমারের সাথে উদ্ধারকৃত ফিমারের লক্ষণীয় মিল দেখতে পেলেন। কিন্তু ছোট্ট সেই মাথার খুলিটির আয়তন মাত্র ৮৫০ সি.সি. (কিউবিক সেন্টিমিটার) প্রায়। সে হিসেবে খুলিটিতে মগজ বা ঘিলুর (ব্রেন) ওজন হবে কমবেশি দুই পাউন্ড। এক পাউন্ডে ৪৫৪ গ্রাম। যেখানে আমাদের মানে আধুনিক মানুষের মাথার খুলির আয়তন ১৩০০ সি.সি. ও ব্রেনের ওজন তিন পাউন্ড। ডিবোয়া ফসিলটির বয়স পরীক্ষা করে দেখলেন এটি প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছরের পুরানো। মানে ওই ফসিলের ব্যক্তিটি আজ থেকে প্রায় ১৮ লক্ষ বছর আগে এ পৃথিবীতে বসবাস করতো। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে ফসিলটি পাওয়া গিয়েছে বলে ফসিল-বিজ্ঞানীরা এক সময় একে ‘জাভা-মানব’ বলে ডাকতেন। বর্তমানে শ্রেণীবিন্যাসবিদরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে একে ‘হোমো’ জিনাসের অন্তর্ভুক্ত স্বতন্ত্র আরেক প্রজাতি হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন Homo erectus। আর আমরা মানে আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম Homo sapiens

ডারউইনের সময়কালের সেই ‘মিসিং লিঙ্ক’ এখন আর ‘মিসিং’ নেই। জাভা দ্বীপ থেকে পাওয়া সেই প্রথম হোমিনিড ফসিল থেকে শুরু করে গত একশত বাইশ বছর ধরে প্রত্নজীববিজ্ঞানীরা আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে শতাধিক হোমিনিডের ফসিল আবিষ্কার করেছেন। ফসিলগুলো প্রত্নজীববিজ্ঞানী থেকে শুরু করে তুলনামূলক এনাটমি বিশেষজ্ঞ, আণবিক জীববিজ্ঞানীরা প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করেছেন। প্রজাতি নির্ধারণ করেছেন। রেডিওমেট্রিক ডেটিং-এর মাধ্যমে ফসিলগুলোর বয়স চিহ্নিত করেছেন। আবিষ্কৃত কিছু হোমিনিডের ফসিলের গঠন আবার অন্য হোমিনিডের ফসিল থেকে বেশ পৃথক এবং অবশ্যই আমাদের থেকেও। হোমিনিডের এই ফসিল রেকর্ড থেকে খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বাস করা হোমিনিডগুলো থেকে বর্তমান মানবকুলের (প্রজাতি) উদ্ভব পর্যন্ত সময়ের সাথে সাথে অঙ্গসংস্থানগত বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন শরীরের আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে, খুলির ধারণক্ষমতা ও মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির এই শতাধিক হোমিনিডগুলোর নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। কখনো যে স্থানে ফসিল পাওয়া গেছে সেই স্থানের নামের সাথে মিলিয়ে, কখনোবা ফসিল-আবিষ্কারকের নামের সাথে মিলিয়ে, আবার কখনোবা ফসিলটির অঙ্গসংস্থানগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য রেখে।


ছবি-১ : উপরের ছবিটি জার্মানির ব্যাভারিয়া থেকে আবিষ্কৃত ১৫০ মিলিয়ন বছর পুরাতন আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল। ভূতাত্ত্বিক কালপঞ্জি অনুসারে এটি জুরাসিক যুগের শেষের দিককার। বাস করতো মধ্য ইউরোপে। ব্যাভারিয়া অঞ্চলের সলেনহোফেন চুনাপাথরের খনি থেকে বেশ কয়েকটি (ভালোভাবে সংরক্ষিত) আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল উদ্ধার করা গেছে। প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ১৮৬০ সালে এবং সর্বশেষ পাওয়া গেছে ২০০৫ সালে। আর্কিওপটেরিক্স কাকের সমান ছোট্ট প্রাণী। আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলে একই সাথে ডায়নোসর (সরীসৃপ) ও পাখির বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আর্কিওপটেরিক্সের খুলি, ঠোঁট, পালক খুব চমৎকারভাবেই পাখি-সদৃশ বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলে আবার এর কঙ্কালতন্ত্রে দ্বিপদী ডায়নোসরের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরানো (ছয় থেকে সাত মিলিয়ন বছর আগের) হোমিনিড ফসিলগুলো আফ্রিকা থেকে পাওয়া গেছে। এদের নাম Sahelanthropus ও Orrorin। ফসিলগুলোর এনাটমি পরীক্ষা থেকে জানা যায়, এরাই দ্বিপদীদের মধ্যে সবার আগে ভূমিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক অনেক ছোট ছিল। আজ থেকে ৫৫ লক্ষ (৫.৫ মিলিয়ন) বছর আগে আফ্রিকাতে বাস করতো আর্ডিপিথেকাস (Ardipithecus) হোমিনিডরা। অস্ট্রেলোপিথেকাসের প্রচুর ফসিল পাওয়া গেছে আফ্রিকা মহাদেশে। এসব ফসিল থেকে জানা যায়, প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রেলোপিথেকাসরা বাস করতো। এরা যদিও আধুনিক মানুষের মত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো তবু তাদের করোটির ধারণ মতা ছিল প্রায় এক পাউন্ড। অর্থাৎ এটি গরিলা ও শিম্পাঞ্জির করোটির আয়তনের প্রায় সমান এবং আধুনিক মানুষের করোটির তুলনায় মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ। অস্ট্রেলোপিথেকাসদের খুলিতে একই সাথে এপ ও আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন নিচু কপাল, এপ-সদৃশ মুখমণ্ডল, আবার দাঁতের অবস্থান আধুনিক মানুষের দাঁতের অবস্থানের মত। অস্ট্রেলোপিথেকাসের সময়কালের অন্যান্য হোমিনিডরা হচ্ছে Kenyanthropus ও Paranthropus। এই উভয় হোমিনিডদের মস্তিষ্কের আকার তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল, যদিও Paranthropus-এর কিছু প্রজাতির দীর্ঘ আকৃতির শরীর ছিল। Paranthropus-রা হোমিনিডকুলের এক পার্শ্বশাখা হিসেবে প্রকাশ করে, যারা পরবর্তীতে অন্যান্য হোমিনিডদের মতোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ দুনিয়া থেকে।

আমাদের হোমো (Homo) জিনাসের অন্তর্ভুক্ত আদি প্রজাতি হচ্ছে Homo habilis। হোমো হেবিলিসের ফসিল ও ফসিলের উদ্ধারকৃত স্থানের আশপাশের আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নৃবিজ্ঞানী, প্রত্নজীববিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন হোমো হেবিলিসরা প্রথম হোমোনিড যারা পাথরে তৈরি খুব সাধারণ হাতিয়ার ও ব্যবহার্য বস্তু তৈরি করতে পারতো। এদেরকে habilis নাম দেয়ার কারণও তাই। habilis শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ যে ব্যক্তি হাতের কাজে দক্ষ। Homo habilis-এর মাথার খুলির আয়তন ৬০০ সি.সি., যা পূর্বের সব হোমিনিড থেকে বেশি কিন্তু আধুনিক মানুষের তুলনায় অর্ধেক। আজ থেকে প্রায় ২৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ বছর আগে Homo habilis-রা আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় বসবাস করতো। Homo habilis-দের মধ্যেই আমরা প্রথম সামান্য পরিমাণে হলেও মানব প্রযুক্তির সূচনা দেখতে পাই।

Homo habilis-এর পরবর্তী উত্তরসূরি হচ্ছে Homo erectus। আজ থেকে প্রায় ১৮ লাখ বছর আগে তারা আফ্রিকাতে বাস করতো। হোমো ইরেকটাসদের মস্তিষ্কের আয়তন ৮০০ থেকে ১১০০ সি.সি. (২ থেকে ২.৫ পাউন্ড)। হোমো ইরেকটাসরা হোমো হেবিলিস থেকে আরেকটু উন্নতমানের হাতিয়ার এবং ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি তৈরি করতে পারতো। হোমো ইরেকটাস প্রজাতির দুটি বৈশিষ্ট্য অবশ্যই লক্ষণীয়। প্রথমটি হচ্ছে, এই প্রজাতিটির দীর্ঘ সময় ধরে (১৮ লাখ থেকে ৪ লাখ বছরের কাছাকাছি) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করার পরও তাদের মধ্যে খুবই সামান্য অঙ্গসংস্থানগত পরিবর্তন ঘটেছে। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে হোমো ইরেকটাস-ই প্রথম হোমিনিড প্রজাতি যারা প্রথম আফ্রিকা মহাদেশ ছেড়ে অন্য মহাদেশে (ইউরোপ এবং এশিয়া) উদ্দেশ্যহীনভাবে পাড়ি দিয়েছিল। আফ্রিকাতে উদ্ভবের পর কিছু সময় পর হোমো ইরেকটাসের বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী (১৬ লক্ষ থেকে ১৮ লক্ষ বছর আগে) ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, এশিয়াতে এবং খুব সম্ভবত আড়াই লাখ বছর পর্যন্ত তারা সেখানে ছিল। এমন কী, চীনের উত্তাঞ্চল ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত তারা পৌঁছে গিয়েছিল। ইয়োজিন ডিবোয়া ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে হোমো ইরেকটাসের প্রথম ফসিল আবিষ্কার করেন।


ছবি-২ : আধুনিক মানুষের কঙ্কালের সাথে প্রায় ৩৫ লাখ বছর পুরাতন ‘লুসি’র (Australopithecus afarensis) ফসিলের তুলামূলক চিত্র। আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ লুসি দ্বিপদী হলে এর ছিল খর্বাকৃতি দেহ ও ছোট মস্তিষ্ক। ১৯৭২ সালে ইথিওপিয়া থেকে লুসির কঙ্কালতন্ত্রের শতকরা ৪০ ভাগ উদ্ধার করা হয়েছে। উপরের চিত্রে তা কালো দাগ দিয়ে বুঝানো হয়েছে।

হোমো ইরেকটাসের পর আরো দুটো হোমিনিড প্রজাতির বিবর্তন ঘটেছে, Homo neanderthalensisHomo sapiens, মানে আমরা নিজেরা। Homo neanderthalensis-এর এর প্রচুর ফসিল আবিষ্কার হয়েছে ইউরোপ থেকে। নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির ফসিল বিশ্লেষণ করে প্রত্নজীববিজ্ঞানী ও আণবিক জীববিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এদের প্রথম উদ্ভব ঘটে আজ থেকে দুই লাখ বছর আগে এবং এদের বিলুপ্তি ঘটেছে আজ থেকে ত্রিশ হাজার বছর আগে। সর্বশেষ নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে স্পেন থেকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এখানেই তাদের শেষ বাসস্থান ছিল। নিয়ান্ডার্থালদের মস্তিষ্ক বড় ছিল, অনেকটা আমাদের মত এবং শরীরও আমাদের মতই তবে কিছুটা বেটে ও মোটাসোটা।

খুব সম্ভবত আফ্রিকাতেই হোমো ইরেকটাস থেকে হোমো সেপিয়েন্স (Homo sapiens) প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল এবং তা আজ থেকে প্রায় চার লাখ বছর আগে। যখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে এদের (হোমো ইরেকটাস) ফসিল পাওয়া যেতে লাগলো তখন অবশ্য ধারণা করা হতো এরা বোধহয় হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির ‘পূর্বতন রূপ’। আধুনিক মানুষের বিবর্তন ঘটেছে আফ্রিকাতে, দুই ল থেকে দেড় লক্ষ বছর আগে; এবং শেষমেশ তারাই সমগ্র পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করে অন্য হোমিনিডদের জায়গা দখল করে নেয়। হোমিনিড বিবর্তন নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন হোমো ইরেকটাস-এর যেসব সদস্য সর্বপ্রথম এশিয়া ও ইউরোপে কলোনি স্থাপন করেছিল তারা সেখানে কোনো সরাসরি উত্তরসূরি (নতুন প্রজাতি) রেখে যায়নি। তবে এই ধারণার বাইরেও নতুন আরেকটি মত প্রচলিত রয়েছে। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোর্স দ্বীপ থেকে পাওয়া নতুন প্রজাতির (Homo florensiensis) হোমিনিড ফসিল গবেষণা করে জানা গেছে এরা সেখানে আজ থেকে ১২ থেকে ১৮ হাজার বছর বাস করতো। ধারণা করা হয়, এই Homo florensiensis-রা সম্ভবত এশিয়ায় বসতিস্থাপনকারী হোমো ইরেকটাসের উত্তরসূরি। যদিও এ বিষয়টি নিয়ে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, গবেষণা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

পৃথিবীর মহাদেশগুলোতে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সদের কলোনি (বসতি) স্থাপন তুলনামূলকভাবে অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনে বসতি স্থাপন হয়েছে আজ থেকে মাত্র ৬০ হাজার বছর আগে, অস্ট্রেলিয়াতে এর কিছু পরেই। ইউরোপে হোমো সেপিয়েন্সদের আগমন ৩৫ হাজার বছর আগে। আমেরিকাতে ১৫ হাজার বছর আগে সাইবেরিয়া থেকে এসে কলোনি স্থাপন হয়। মানব জাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বা নৃতাত্ত্বিক (এথনিক) পার্থক্য সূচিত হয়েছে খুব বেশিকাল আগে নয়। হোমো সেপিয়েন্স জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় মাত্র ষাট হাজার বছর আগে।


ছবি-৩ : আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা থেকে আমাদের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির উপনিবেশ স্থাপনের ছিত্র। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট হাজার বছর পূর্বে হোমো সেপিয়েন্সরা উত্তর ও দক্ষিণ এশিয়াতে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তবে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে গিয়েছিল মাত্র পয়ত্রিশ হাজার বছর আগে। এটা একটা ধাঁধা! ইউরোপে পৌঁছাতে কেন এতো দেরি হল? একটা ব্যাখ্যা হচ্ছে এরকম ইউরোপে প্রায় দুই লাখ বছর পূর্ব থেকেই নিয়ানডার্থালরা বসতি গেড়ে ছিল। ত্রিশ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থালদের বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত হোমো সেপিয়েন্সরা ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে নি।

গত শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জীববৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রম ‘মানব জিনোম প্রকল্প’ শুরু হয় আমেরিকাতে ১৯৮৯ সালে। এই প্রকল্পের অর্থায়নে ছিল আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ও ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি। সরকারি উদ্যোগে মানব জিনোম প্রকল্প শুরু হওয়ার কিছু সময় পর আমেরিকার বেসরকারি একটি জিনোম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘Celera Genomics’ স্বাধীনভাবে একই ধরনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। তারাও সরকারি অনুদান জুটিয়ে নেয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে শুরু হওয়া এই গবেষণা কার্যক্রমের লক্ষ ঠিক করা হয় আগামী ১৫ বছরের মধ্যে মানব-জিনোমের সম্পূর্ণ সিকুয়েন্স উদ্ঘাটন করা। এবং এই প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; অর্থাৎ কাকতালীয়ভাবে প্রতিটি ডিএনএ অক্ষরের (A, T, C, G) জন্য ১ ডলার বাজেট বরাদ্দ করা হয়। ২০০১ সালে মানব জিনোমের সিকুয়েন্সের একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। ২০০৩ সালে এই প্রকল্পের একটা পর্ব সমাপ্ত হয়েছে।

মানব-জিনোমের ডিএনএ সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ করা আমাদের জন্য প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে একটি বিশাল অর্জন। মানুষের জিনোমে তিন বিলিয়ন নিউক্লিওটাইডের (A, T, C, G) ডিএনএ সিকুয়েন্স রয়েছে। এগুলি যদি ছাপানো যায় তবে এর পরিমাণ হবে ১০০০ পৃষ্ঠার প্রতিটি এক হাজার ভলিউমের সমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে এই ধরনের জটিল গবেষণা কার্যক্রমের সফল সম্পাত্তি সম্ভব হয়েছে। গত কয়েক বছরে জীববিজ্ঞানে প্রযুক্তিগত এতই উন্নতি সাধিত হয়েছে যে, ‘মানব জিনোম প্রকল্প’-এর পরবর্তীতে কয়েকজন স্বতন্ত্র ব্যক্তির জিনোম অনুক্রম বিশ্লেষণ করা হয়েছে আর এতে ব্যয় হয়েছে এক লক্ষ মার্কিন ডলার (তিন বিলিয়ন আর ব্যয় হয় নি) এবং সময় লেগেছে মাত্র এক মাস (চৌদ্দ বছর নয়)।

মানুষ ছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রজাতির জিনোম সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ করা হয়েছে ইতোমধ্যে। বিশেষ করে শিম্পাঞ্জির (Pan troglodytes) জিনোম সিকুয়েন্স সংক্রান্ত তথ্যাবলি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির জিনোম সিকুয়েন্সের তুলনামূলক বিশ্লেষণও করা হয়েছে। জিনেটিক লেভেলে মানুষের স্বতন্ত্র অবস্থানটি কোথায়, কোন জিনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের ফিনোটাইপে পরিবর্তন ঘটেছে তা বোঝার জন্য এই ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা। মানুষ ও শিম্পাঞ্জির এই তুলনামূলনক জিনোম সিকুয়েন্সের ফলাফলও সমপরিমাণ চমকপ্রদ। দেখা গেছে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোম সিকুয়েন্স প্রায় ৯৯% হুবহু একই রকম। পার্থক্য মাত্র ১ ভাগে। তবে এই পার্থক্যটি কারো কাছে খুবই কম মনে হতে পারে আবার কারো কাছে অনেক বড়-ও মনে হতে পারে, বিষয় হচ্ছে–কে কিভাবে বিষয়টি দেখবে। মানুষের এই ৩ বিলিয়ন ডিএনএ অক্ষরের মধ্যে শতকরা ১ ভাগ পার্থক্য রয়েছে শিম্পাঞ্জির সাথে, এর অর্থ দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ন ডিএনএ অক্ষরে পার্থক্য রয়েছে শিম্পাঞ্জির সাথে।

মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির উভয় প্রজাতি শতকরা ২৯ ভাগ এনজাইম এবং অন্যান্য প্রোটিন একই রকমের জিন দ্বারা গঠিত। একশত থেকে কয়েকশত অ্যামিনো অ্যাসিডের মাধ্যমে জীবদেহের প্রোটিন গঠিত, এর মধ্যে শতকরা ৭১ ভাগ প্রোটিনে পার্থক্য রয়েছে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যে। আর এই পার্থক্য সূচিত হয়েছে গড়ে মাত্র দুটি অ্যামিনো অ্যাসিডের কারণে। এখন কেউ যদি হিসেব করতে চায় এইভাবে, ডিএনএ সেগমেন্ট একটি প্রজাতিতে পাওয়া গেল কিন্তু অন্যটিতে না, তাহলে উভয় প্রজাতিতে ডিএনএ সিকুয়েন্স শেয়ার করেছে এই দৃষ্টিতে দুই প্রজাতির জিনোম শতকরা ৯৬ ভাগ হুবহু এক রকম। আর জিনেটিক উপাদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ মানে ৯০ মিলিয়ন ডিএনএ অক্ষর, গত ছয় থেকে সাত মিলিয়ন বছর পূর্বে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির বিবর্তনক্রম শুরু হওয়ার পর উভয় প্রজাতির জিনোমে সন্নিবেশিত ও বিলুপ্তি ঘটেছে। অবশ্য অনেক ডিএনএ-ই রয়েছে প্রোটিন তৈরি জন্য জিন ধারণ করে না। এদেরকে ‘জাংক ডিএনএ’ বলে।

দুই প্রজাতির জিনোম সিকুয়েন্সের এই তুলনা থেকে সুনির্দিষ্ট জিনগুলির বিবর্তনীয় হার খুব সহজেই বোঝা যায়। একটা গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, যেসব জিনগুলি মস্তিষ্কে সক্রিয় বা ক্রিয়াশীল, শিম্পাঞ্জিকুলের তুলনায় সেগুলির বেশি পরিবর্তন ঘটেছে মানবকুলে। মোটের উপর, ৫৮৫টি জিন, এর মধ্যে কিছু জিন যেমন ম্যালেরিয়া এবং যারোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে, এদের বিবর্তন খুব দ্রত হয়েছে মানবকুলে। (এটা স্মরণযোগ্য, শিম্পাঞ্জির তুলনায় মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগটির প্রকোপ অত্যন্ত তীব্র।) মানব-জিনোমের অনেক জায়গায় দেখা গেছে, মানবকুলের জন্য উপকারী জিনগুলির দ্রুত বিবর্তন ঘটেছে গত আড়াই ল বছরে। যেমন ভাষার উদ্ভবের পিছনে যে জিনের ভূমিকা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন FOXP2, এই জিনের বিবর্তন ঘটেছে মানবকুলে দ্রুতগতিতে।

জীবজগতে মানুষের এই স্বতন্ত্র অবস্থান সম্পর্কে বর্তমানে আমরা কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা জানি, যেমন বড় মস্তিষ্ক এবং কিছু জিনের দ্রুতগতির বিবর্তনীয় হার (এর মধ্যে ভাষার উদ্ভবের জিন জড়িত রয়েছে)। এই জ্ঞান আমাদের জন্য খুব আকর্ষণীয় মনে হলেও কোন কোন জিনেটিক পরিবর্তন আমাদের মানুষ বানিয়েছে সে-সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের এখনও ক্ষীণ।

মানুষ ও শিম্পাঞ্জি জিনোম নিয়ে আগামী দুই-এক দশকের মধ্যে হয়তো আরো বর্ধিত গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারবো কিভাবে আমরা ‘স্বতন্ত্র’ মানুষ হলাম। যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের ‘মানুষ’ বানায়, তার যাত্রা শুরু হয় ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বে ভ্রূণ অবস্থায়। ‘রৈখিক তথ্যাবলি’ (linear information) জিনোমে সংযুক্ত হয় ক্রমশ, এবং প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির মধ্যে। সময়ের সাথে ঐ ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, মানুষের যে সবচেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যাবলি তার বিকাশ ঘটে মস্তিষ্কে, ভূমিকা রাখে মানুষের চিন্তায় ও আত্মিক পরিচয়ে।

অন্যান্য প্রাইমেট থেকে মানুষের এই স্বতন্ত্র অবস্থান বুঝতে হলে খেয়াল রাখতে হবে মানুষের মস্তিষ্কের অসামান্য অগ্রগতি, উন্মোচিত হয়েছে নতুন ধরনের বিবর্তন, যা ছাড়িয়ে গেছে জীববিবর্তনের সব সীমাকে; প্রযুক্তির সাহায্যে পরিবেশকে নিজ উদ্দেশ্যে সুনিপুণভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অভিযোজন। প্রকৃতিতে জীবসমূহের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবেশের সাথে অভিযোজন ঘটে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জিনেটিক গঠনের পরিবর্তন ঘটে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে। কিন্তু মানুষ (যে কোনো দিক দিয়েই স্বতন্ত্র স্থানে অবস্থান করছে) তার নিজেদের চাহিদানুযায়ী পরিবেশকে পরিবর্তনের, নিয়ন্ত্রণের সমতা অর্জন করেছে বিপুলভাবে। আগুনের ব্যবহার, পোষাকের ব্যবহার, নিজস্ব বাসস্থান ইত্যাদি মানুষকে পুরাতন পৃথিবীর উষ্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা থেকে ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে, জৈবিকভাবে গোটা পৃথিবীতে অভিযোজনে ভূমিকা রেখেছে, ব্যতিক্রম শুধু তীব্র শীতপ্রধান এলাকা অ্যান্টার্টিকা বাদে। জিনগত পরিবর্তনের ফলে তীব্র ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে রক্ষার জন্য মানুষের শারীরিক সক্ষমতা (চুল এবং লোম বৃদ্ধি পাবে) তৈরি হবে, এমন সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। ফুলকা বা পাখা গঠনের জন্যও কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই, আমরা প্রযুক্তির উন্নতির ফলে জাহাজ বা বিমানে করে এমনিতেই সাগরে কিংবা আকাশে পাড়ি দিতে পারি অনায়সে। এটা মানুষের মস্তিষ্কের (অথবা বলা যায়, মানুষের চিন্তা) বিকাশের ফলেই মানবজাতি আজকে এত সফল, সকল জীবিত প্রজাতির থেকে অর্থবহ অবস্থানে রয়েছে।

গত দুই দশকে জীববিজ্ঞানের আরেক শাখা ‘নিউরোবায়োলজি’তে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। অসামান্য সব আবিষ্কার ঘটেছে এখানে। আলো, তাপ, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো কিভাবে ট্রিগারের ভূমিকা পালন করে, স্নায়ুর মাধ্যমে তথ্য পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কে এবং সেখান থেকে সারা শরীরে, তা খুব ভালোভাবে জানা গেছে। এমন কী, শরীরের ভিতরে নিউরাল চ্যানেলগুলো কিভাবে তথ্য প্রেরণ করে শারীরিক কাজকর্মে ভূমিকা রাখার জন্য কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর পুনর্গঠনের জন্য অথবা কোন নিউরন বা নিউরনগুচ্ছ শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গগুলোতে তথ্য গ্রহণ-প্রেরণ করে থাকে। এরপরও বলতে হয়, এত উন্নতির পরও, নিউরোবায়োলজি এখনও শৈশবকালীন পর্যায়ে রয়েছে। যেমন জিনেটিক্সের যে অবস্থা ছিল, তত্ত্বগত উন্নতি ঘটেছিল, বিংশ শতাব্দীতে ম্যান্ডেলের সূত্রাবলি যখন পুনর্আবিষ্কার ঘটেছিল। আবার অনেক বিষয়ই তখন অজানা ছিল, যেমন শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা ঘটনাবলি কিভাবে মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় [যেমন আবেগ, অনুভূতির মিলিত ফল সচেতনতা, যাকে দার্শনিক পরিভাষায় বলা হয় ‘কুয়েলিয়া’ (qualia)] এবং এসব বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার উদ্ভব ঘটে চিন্তার ক্ষেত্রে, বাস্তবতার সাথে ইউনিটারি গুণাবলী, যেমন স্বাধীন ইচ্ছা এবং নিজস্ব সচেতনতা বহন করে ব্যক্তির নিজস্ব জীবনে।

আমি বিশ্বাস করি না, চিন্তাজগতের এই রহস্যময়তা দীর্ঘদিন অনুদ্ঘাটিত থাকবে। বরং এই ধাঁধার উত্তর মানবজাতি তার দার্শনিক বিশ্লেষণ আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই উদ্ঘাটন করতে পারবে এবং আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আগামী অর্ধশতাব্দীর ভিতরেই এ ধরনের প্রচুর সংখ্যক ধাঁধার উত্তর সমাধান হয়ে যাবে। তখন আমরা ‘নিজেকে জানা’র মধ্য দিয়েই ভালো থাকবো।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : প্রবন্ধটি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ ও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো জে. আয়ালা’র বই ‘Am I a Monkey?: Six Big Questions about Evolution’ বইয়ের (২০১০) প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ। প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ ও তিনটি চিত্র ব্যবহারে অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো আয়ালা এবং জোন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রদান করায় বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।