কোরানে বাইবেলের অনেক কাহিনীর উল্লেখ দেখা যায়।সেটাই স্বাভাবিক কারন ইসলাম দাবী করে ধারাবাহিকতার সূত্রে সে সর্বশেষ ধর্ম।আর তাই ইসলাম ধর্মের মধ্যে পূর্বোক্ত ধর্ম যেমন ইহুদি ও খৃষ্টান এগুলোর নানান কাহিনীর উল্লেখ থাকবে। তবে উল্লেখিত কাহিনীর মধ্যে বহু গরমিলও লক্ষ্যনীয়। দেখা যায়, বাইবেলে যেভাবে কাহিনীটা আছে কোরানে আছে ভিন্নরকম ভাবে।এমতাবস্থায় কার কাহিনী সঠিক? বাইবেলেরটা নাকি কোরানের টা ? এসব বিষয় জানতে গেলে উভয় কিতাব ভালমতো পাঠ করা দরকার। শুধুমাত্র বাইবেল বা কোরান পড়ে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না।এবারে যীশুর মাতা মরিয়ম কে ছিল সে বিষয়ে বাইবেল ও কোরান কি বলে সে সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই দেখা যাক নিচের আয়াতটি-

অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মারইয়াম, তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ।হে হারূণ-ভগিনী, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিনী। সূরা- মারিয়াম, কোরান, ১৯:২৭-২৮

মুসলমানরা যখন কোরানের এ বক্তব্য নিয়ে খৃষ্টানদের কাছে গেল, তারা তো শুনে তাজ্জব বনে গেল, কারন যীশু খৃষ্টেরও প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মূসা ও তার ভাই হারুন দুনিয়াতে ছিলেন। সেই হারুন তথা মূসার বোন মরিয়ম কিভাবে যীশুর জন্ম দেয়? কারও বোনকে বংশধারা হিসাবে উল্লেখ করার রেওয়াজ তখন ছিল না, তারা সেটা জানতও না। এমন কি আজকের দিনেও কেউ সেটা করে না। তাই তারা মুসলমানদের কাছে জিজ্ঞেস করল- মূসা বা হারুন নবীর বোন মরিয়ম যীশু খৃষ্টের জন্ম দিয়েছে, এটা কিভাবে সম্ভব? যে মুসলমানরা খৃষ্টানদের কাছে এ বানী নিয়ে গেছিল তারাও বিষয়টা জানত না, কারন তারা মোহাম্মদ যা বলতেন তাই চোখ বুজে বিশ্বাস করত কোন রকম প্রশ্ন করা ছাড়াই।তারা ইব্রাহিম, মূসা , ঈশা এসব নবীর অত ধার ধারত না, মোহাম্মদ যা বলতেন সেটাই তাদের কাছে ছিল চুড়ান্ত।তাছাড়া তাদের পূর্ব ধর্ম পৌত্তলিক হওয়ায় তারা অত সব নবীদের কাহিনী জানতও না।যীশু মরিয়মের ছেলে নাকি মরিয়ম যীশুর মেয়ে এতসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ও তাদের ছিল না। তাই তারা মোহাম্মদের কাছে গিয়ে ব্যপারটা জানতে চাইল, প্রত্যুত্তরে মোহাম্মদ যা বললেন তা দেয়া আছে নিম্ন হাদিসে-

মুগিরা বিন শুবা বর্ণিত, যখন আমি খৃষ্টান অধ্যূষিত নাজরানে আসলাম, খৃষ্টানরা আমাকে জিজ্ঞেস করল-“ তোমরা কোরানে ‘ হারুনের ভগিনী’ পড় কিভাবে যেখানে মুসা যীশু খৃষ্টের চেয়ে বহু পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন?” যখন আমি আল্লার রসুলের নিকট ফিরে গেলাম এবং এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি উত্তর দিলেন-অতীতে মানুষদেরকে তাদের বংশের নবী বা পরহেজগার মানুষ, যারা অনেক আগেই মারা গেছেন, তাদের নামের সাথে এভাবে ডাকা হতো। সহি মুসলিম, বই-২৫, হাদিস-৫৩২৬ বুখারী, মুসলিম হাদিস, আবু দাউদ হাদিস।

মোহাম্মদের কথা কিন্তু ঠিক, কিন্তু সেটা কোন ক্ষেত্রে ঠিক? মোহাম্মদের বক্তব্য হলো- এটা হলো একটা উপমা, যেমন, গোটা মানব জাতিকে বলা হয়- আদমের সন্তান,ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানদেরকে বলা হয়- ইব্রাহীমের সন্তান, শুধুমাত্র ইহুদীদেরকে বলা হয়- ইয়াকুবের সন্তান ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, ইংরেজীতে এটা হলো- sons of Abraham , sons of Adam, Sons of Jacob –এরকম। এটা ধর্মীয় কিতাবগুলিতে প্রচলিত একটা উপমা, যা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। মোহাম্মদের যুক্তি- মরিয়ম ঠিক তেমনিভাবে মূসা বা হারুনের বংশীয় ভগিনী, আপন ভগিনী নয়। আর ঠিক এই শেষেরটাই হলো মোহাম্মদের নিজের তৈরী তত্ত্ব।অথচ উক্ত ১৯: ২৭-২৮ আয়াত পড়লে কিন্তু বোঝাও যায় না যে এটা বংশগতির বোন বুঝায়। ভাল করে খেয়াল করতে হবে কি বলছে-

হে হারূণ-ভগিনী, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিনী।

এখানে হারুন ভগিনী বলতে যদি হারুন বা মূসার বংশগতির বোন বুঝায়, তোমার পিতা বা তোমার মাতা বলতে কাকে বুঝাবে ? নিজের পিতা/মাতা নাকি পূর্বপিতা/পূর্বমাতা ? এ ধরণের বাক্যে কোন অংশ বংশগতির সম্পর্ক বুঝাবে আর কোন অংশ তা বুঝাবে না, তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? উক্ত আয়াত পড়লে বংশগতির বোন না বুঝিয়ে বরং হারুনের আপন বোনই বেশী করে বুঝায়।কিন্তু আসলে এভাবে কারও ভগিনীকে উল্লেখ করে কোন বংশধারা প্রকাশের রীতি সেসময় ছিল না বা আজকেও নেই।যাহোক, ওল্ড টেষ্টামেন্ট থেকে জানা যায়, হারুণের মরিয়ম নামের একটা বোন ছিল, যেমন-

তারপর হারুনের বোন মরিয়ম, মহিলা ভাববাদিনী, হাতে একটা খঞ্জনী তুলে নিল। মরিয়ম ও তার সঙ্গিনী নারীরা নাচতে ও গাইতে শুরু করল।ওল্ড টেষ্টামেন্ট, এক্সোডাস, অধ্যায়-১৫, বাক্য-২০

উক্ত হাদিসের সূত্র ধরে ইসলামি পন্ডিতদের বক্তব্য, হারুনের বোনকে কোরানে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কিতাবগুলোকে কখনো এভাবে কারও বোন উল্লেখ করে বংশধারার পরিচয় দেয়ার রেওয়াজ নেই আর সেটা যুক্তি সঙ্গতও নয়।এ ধরনের আর কোন নজীরও কোরান বা বাইবেলে নেই। এটা সম্পূর্নই মোহাম্মদের নিজস্ব আবিষ্কার, বা অন্য কথায়, বর্তমানকার ইসলামি পন্ডিতদের আবিষ্কার। বংশ ধারার পরিচয় তুলে ধরা হয়, আগে যেমন বলা হয়েছে- আদমের সন্তান/বংশধর/কন্যারা, ইব্রাহিমের সন্তান/বংশধর/কন্যারা, দাউদের সন্তান/বংশধর/কন্যারা এভাবে, ইব্রাহিমের বোন, মূসার বোন, দাউদের বোন এরকম ভাবে নয়, আর এ ভাবে বংশধারা পরিচয়ের রীতি সেখানে ছিলও না।যেমন কোরানেই তা বলা হয়েছে-

নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম (আঃ) নূহ (আঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর এবং এমরানের খান্দানকে নির্বাচিত করেছেন। কোরান, ৩:৩৩
আর তাঁর কওমের লোকেরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তার (গৃহ) পানে ছুটে আসতে লাগল। পূর্ব থেকেই তারা কু-কর্মে তৎপর ছিল। লূত (আঃ) বললেন-হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছে, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি কোন ভাল মানুষ নেই।কোরান, ৭:৬৫

তেমনি ভাবে মরিয়মকে যদি এভাবে সম্বোধন করা হতো- হে এমরানের কন্যা,তাহলেও কিন্তু এ প্রশ্ন উঠত না।ধরে নেয়া হতো,মরিয়ম এমরানের সরাসরি কন্যা নয় বরং তার বংশজাত কন্যা। সুতরাং যীশুর মাতা মরিয়মকে হারুন ভগিনী বলে সম্বোধন করাতে মনে হচ্ছে- মোহাম্মদ মূসা নবী বা হারুনের সরাসরি বোনকেই যীশুর জন্মদাত্রী মনে করেছেন। এতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে তিনি পূর্বেকার নবীদের সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন কি না।নাকি খৃষ্টান ও ইহুদিদের কাছ থেকে তাদের বাইবেলের কাহিনী শুনে তার উপর ভিত্তি করে পরে নিজের মনের মত করে একটা কাহিনী রচনা করে তা আল্লাহর বানী হিসাবে চালিয়ে দিয়েছেন? কারন দেখা যাচ্ছে-বাইবেলে যে সব চরিত্র আছে, সেই চরিত্রগুলো উল্লেখ করতে যেয়ে ধারাবাহিকতা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।এই মরিয়মকেই কোরানে অন্য একটা আয়াতে এমরান কন্যা বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, যেমন-

আর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন এমরান-তনয়া মরিয়মের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে জীবন ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বানী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছিল। সে ছিল বিনয় প্রকাশকারীনীদের একজন। সূরা আত-তাহরীম,৬৬:১২

এখানে মরিয়মকে এমরান কন্যা বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এ ধরণের বর্ননায় বংশজাত বিষয়টি সঠিক অর্থ প্রকাশ করে না।উক্ত আয়াত পড়লে বোঝা যায়, এমরানের বাস্তব কন্যাই হলো মরিয়ম যার গর্ভে যীশু জন্মগ্রহণ করেছিল।কুমারী মাতার গর্ভে বাচ্চা এসেছে বলে মরিয়ম অসতী হয়ে যায় নি, এটারই সত্যায়ন করা হচ্ছে উক্ত আয়াতে। বলা বাহুল্য, মূসা, হারুন ও মরিয়মের পিতার নাম ছিল এমরান। অথচ হারুন বা মূসার বোন মরিয়ম যীশুর মাতা হতে পারে না।এ মরিয়মকে আমরা আরও পাই নিচের আয়াতগুলোতেও-

নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম (আঃ) নূহ (আঃ) ও ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর এবং এমরানের খান্দানকে নির্বাচিত করেছেন। কোরান, ৩:৩৩
যারা বংশধর ছিলেন পরস্পরের। আল্লাহ শ্রবণকারী ও মহাজ্ঞানী। কোরান, ৩:৩৪
এমরানের স্ত্রী যখন বললো-হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত। কোরান, ৩:৩৫
অতঃপর যখন তাকে প্রসব করলো বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি একে কন্যা প্রসব করেছি। বস্তুতঃ কি সে প্রসব করেছে আল্লাহ তা ভালই জানেন। সেই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম। আর আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অভিশপ্ত শয়তানের কবল থেকে। কোরান, ৩:৩৬
অতঃপর তাঁর পালনকর্তা তাঁকে উত্তম ভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাঁকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন-অত্যন্ত সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তাঁকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পন করলেন। যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কছে আসতেন তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন। জিজ্ঞেস করতেন “মারইয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এলো?” তিনি বলতেন, “এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।” কোরান, ৩:৩৭

উপরের ৩:৩৫-৩৬ আয়াতে বলছে এমরানের স্ত্রীর গর্ভে যে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল তার নাম মরিয়ম। অর্থাৎ এ আয়াতও বলছে মরিয়ম এমরানের কন্যা। আর বলা বাহুল্য, উক্ত ৩:৩৫ আয়াতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত যে- এ মরিয়ম বাস্তবিকই ইমরানের কন্যা, বংশগত কন্যা নয়।আবার এ মরিয়মই যীশুর মাতা কারন এর পরেই ৩:৩৬-৩৭ আয়াতে বলা হচ্ছে এ মরিয়মকে ইহুদীদের উপাসনালয়ে উৎসর্গ করা হয়েছে যা যীশুর মাতা মরিয়মকে করা হয়েছিল।এ মরিয়মই যে যীশুর মাতা তা পরের আয়াতগুলোতেই বোঝা যাচ্ছে-

যখন ফেরেশতাগণ বললো, হে মারইয়াম আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বানীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ-মারইয়াম-তনয় ঈসা, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভূক্ত। কোরান, সূরা ইমরান, ০৩: ৪৫
যখন তিনি মায়ের কোলে থাকবেন এবং পূর্ণ বয়স্ক হবেন তখন তিনি মানুষের সাথে কথা বলবেন। আর তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। কোরান, সূরা ইমরান, ০৩: ৪৬
তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোন মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন এ ভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন কোন কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হয়ে যাও’ অমনি তা হয়ে যায়। কোরান, সূরা ইমরান, ০৩: ৪৭

দেখা যাচ্ছে-১৯:২৭-২৮ আয়াত মরিয়মকে হারুন-ভগিনী,৬৬:১২ আয়াত মরিয়মকে এমরান কন্যা, ৩:৩৬ এমরান কন্যা বলছে বার বার , অন্যদিকে মূসা, হারুন ও মরিয়মের পিতার নাম ছিল এমরান যা জানা যাচ্ছে ওল্ড টেষ্টামেন্ট থেকে-

আম্রাম ১৩৭ বছর বেঁচে ছিল। আম্রম তার আপন পিসি জোকেবদকে বিয়ে করেছিল।আম্রম ও জোকেবদের দুই সন্তান হলো যথাক্রমে- হারোন ও মোশি।ওল্ড টেষ্টামেন্ট, এক্সোডাস, ৬:২০

এবং উক্ত মরিয়মই যীশুর জন্মদাতা যা জানা যাচ্ছে ৩:৩৫-৩৬ ও ৪৫ থেকে। এখন প্রশ্ন হলো যে মরিয়ম যীশুরও প্রায় ১৫০০ বছর আগে দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছিল সে কিভাবে যীশুর মাতা হতে পারে ?নাকি অন্য এক মরিয়ম ছিল যে যীশুকে জন্ম দিয়েছিল? কিন্তু কিছুই তো কোরান থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। পরিষ্কার করে বোঝার উপায় কি ?

এখানে খেয়াল করতে হবে এর ঠিক আগের আয়াত ৩:৩৩-৩৪ বলছে আল্লাহ কতিপয় ব্যক্তিকে তার মনোনীত নির্বাচন করেছেন, তারা হলো- আদম, নূহ, ইব্রাহীম ও এমরান।দেখা যাচ্ছে-এ তালিকা থেকে অদ্ভুত ও বিস্ময়করভাবে বাদ পড়েছে-কোরানে সবচেয়ে বেশী বার উচ্চারিত ও বিপুল সম্মানের অধিকারী মূসার কথা, ঠিক একই ভাবে বাদ পড়েছে যীশুর কথা।অথচ ঢুকে পড়েছে এমরান নামের কোন এক অজানা অচেনা লোকের কথা যে আসলে নবীও না। বস্তুত ইব্রাহিম, মূসা ও যীশুর পূর্বপিতা হলেও মর্যাদা, সম্মান ও প্রভাবের দিক দিয়ে এরা আদম ও নূহ নবী তো বটেই, ইব্রাহিমের চাইতেও অনেক বেশী।এছাড়াও দেখা যাচ্ছে- ইসরাইল জাতির পত্তনকারী নবী ইয়াকুবের নামও এখানে নেয়া হয়নি।এখন কোরানে আল্লাহ তার মনোনীত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করছে অথচ তার সবচাইতে বেশী সম্মানিত ও প্রভাবশালী মনোনীত ব্যক্তিদের নাম নিচ্ছে না, এটা বেশ বিস্ময়কর ও কৌতুহলোদ্দীপক।এর সমাধান একটাই হতে পারে, তা হলো যেহেতু এমরানের নাম উল্লেখ করে আল্লাহ বলছে- এমরানের খান্দানকে নির্বাচিত করেছেন-তার মানে মূসা,হারুন ও যীশুর মাতা মরিয়ম এদের সরাসরি বাস্তব পিতা হলো এমরান, ঠিক একারনে মূসা ও যীশুর নাম উল্লেখ না করে এমরানের খান্দান শব্দটা উল্লেখ করা হয়েছে। নইলে এমরান তেমন কোন সুপরিচিত, প্রভাবশালী ব্যক্তি নয় বা নয় কোন নবী যে তার নাম আদম, ইব্রাহিম ও নুহ নবীর সাথে এক কাতারে উচ্চারণ করতে হবে।তার নাম উল্লেখের একমাত্র কারন হতে পারে যে তার সন্তানরা সুবিখ্যাত হয়েছিল। খেয়াল করতে হবে, ইব্রাহিম, নূহ এদের নাম উল্লেখ না করে তাদের পিতাদের নামও এখানে উল্লেখ করতে পারত। যেমন, আল্লাহ বলতে পারত- আমি আজরের বংশকে মনোনিত করেছি।কারন আজরের পূত্র ইব্রাহীম থেকেই শুরু হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। কিন্তু সেটা করা হয় নি।

মরিয়ম সম্পর্কিত সম্পূর্ন রহস্য ভেদ করতে চাইলে – দেখুন ও পড়ুন।http://

এসব সমস্যাকে কয়েক ভাবে ব্যখ্যা করা যেতে পারে-

এক. পুরো বাইবেল কিতাবই বিকৃত ও ভুয়া, তাই কোরানের সাথে এর মিল নেই, কারন কোরান একমাত্র সত্য গ্রন্থ।
দুই.বাইবেলের কাহিনী মোহাম্মদ শুধু শুনে তার ওপর ভিত্তি করে কোরান রচনা করেছেন, পুরো কাহিনীর মর্মার্থ তিনি মুখস্ত বা অনুধাবণ করে কোরান রচনা করেন নি।যে কারনে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে বা আন্ত: সম্পর্কের ক্ষেত্রে তালগোল পাকিয়ে গেছে।
তিন. কোরান এমন এক গ্রন্থ যা পড়ে বোঝা যায় না।

এক নম্বর পয়েন্টটা নিয়ে আলোচনা করলে প্রশ্ন উঠবে- ইহুদী বা খৃষ্টানরা যীশুর মাতা মরিয়মের পিতা কে ছিল বা হারুনের বোন মরিয়ম কে ছিল সেটা নিয়ে কেন বিভ্রান্তি ছড়াবে, তাতে তো তাদের কোন লাভ আছে বলে তো মনে হয় না।একমাত্র সেই তথ্যই তারা বিকৃত করতে পারে যাতে ভবিষ্যদ্বানী করা আছে এই বলে যে – মোহাম্মদ বলে এক লোক সর্বশেষ নবী হিসাবে দুনিয়াতে আগমন করবে। এছাড়া অন্য আর তেমন কোন তথ্য বিকৃত করার কোন দরকার আছে বলে তো মনে হয় না, যুক্তি সঙ্গতও না।তাছাড়া যা দেখা যায়, মোহাম্মদেরও জন্মের বহু বছর আগেই বাইবেল আজকের আকারে সংকলিত হয়। তাই কিভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব সুদুর অতীতকালে সেই সেই পয়েন্টগুলো মুছে দিয়ে নতুন বিকৃত তথ্য লিখে রাখা যে পয়েন্টগুলো নিয়ে বহু বছর পর ভবিষ্যতে মোহাম্মদ নামক এক লোক ঝামেলা পাকাবে?

দুই নম্বর পয়েন্ট নিয়ে বলা যায়- খৃষ্টান ও ইহুদিরা মোহাম্মদের ভবিষ্যত আগমনের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে অতীতকালে বাইবেলের সবকিছু যদি পাল্টে না ফেলে থাকে, তাহলে কি বলা যায় না মোহাম্মদ সত্যি সত্যি বাইবেলের মত অত বড় একটা কিতাবের গল্প বা কাহিনীগুলো শুধুমাত্র শুনে মনে রাখতে পারেন নি? যে কারনে তিনি তার কোরানে সঠিকভাবে সেসব কাহিনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন?

তিন নম্বর পয়েন্ট হতে পারে সবচাইতে সঠিক উত্তর। হয়ত আমরা কোরান পড়ে বুঝতে পারছি না। কিন্তু তাহলে তো গুরুতর একটা সমস্যার উদয় ঘটে। যা পড়ে আমরা বুঝতে পারি না, আল্লাহ কেন তা আমাদের জন্য পাঠাবেন? আবার একই সাথে বলবে- এটা অনুযায়ী চলতে না পারলে জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে মারবে, এটা কেমন কথা ?

এখানে আরও একটা দারুন স্ববিরোধীতার আভাস পাওয়া যায়। নিচের আয়াত –

আমার প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব। কোরান, ১৯:৩৩
এই মারইয়ামের পুত্র ঈসা। সত্যকথা, যে সম্পর্কে লোকেরা বিতর্ক করে।কোরান, ১৯:৩৪

এখানে কোরানে যীশু নিজেই বলছে- সে জন্ম গ্রহণ করেছে, একদিন মৃত্যূ বরণ করবে ও আর একদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হবে।কিন্তু ইসলামী বিশ্বাস হলো- যীশু মৃত্যুবরণ করে নি, তাকে আল্লাহ জীবন্ত বেহেস্তে তুলে নিয়ে গেছে, বর্তমানে সেখানেই আছে, কেয়ামতের আগে পূনরায় দুনিয়ায় আসবে(এটাকেই পুনরুজ্জীবন বলে)। আল্লাহ আসলে যীশুকে কি করেছে তা জানা যাবে এ আয়াতে-

আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।কোরান, ৪: ১৫৭
বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।কোরান, ৪: ১৫৮

এখানে দেখা যাচ্ছে, কোরানে আল্লাহ নিজেই বলছে যীশুকে সে নিজের কাছে বেহেস্তে তুলে নিয়ে গেছে।যীশুকে যে কেউ হত্যা করেনি তারও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেয়া হচ্ছে এখানে। যীশুকে যদি জ্যন্ত বেহেস্তে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, যখন পূনরায় দুনিয়াতে ফেরত আসবে সেটা তো তার পুনরুজ্জীবন হবে না, তাকে বড়জোর পূনরাগমন বলা যেতে পারে।পূনরুজ্জীবন ও পূনরাগমন দুই এর মধ্যে আকাশ ও পাতাল তফাৎ। প্রশ্ন হলো কোনটা সত্য?-১৯:৩৩ অনুযায়ী,যীশু মারা গেছে নাকি ৪:১৫৮ অনুযায়ী মারা যায় নাই?
এসব থেকে কি বোঝা যায় না যে- বাইবেল ও যীশু সম্পর্কে পরিপূর্ন তথ্য না জানার কারনে এসব ভ্রান্তি ঘটেছে?

মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-8
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-7
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-6
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-5
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-4
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-3
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-2
মোহাম্মদ ও ইসলাম, পর্ব-1