লিখেছেনঃ মেহেদী তুহিন

আশীফ এন্তাজ রবি। পরিচয় দেয়ার মতো তেমন কোন পরিচয় আমি তার জানি না। তবে আমি কেন তার নাম দিয়ে শুরু করলাম। বলছি। গত ১৮ জানুয়ারি ২০১২ আমি তার একটি লেখা পড়েছিলাম। “আমি হুমায়ূন আহমেদ হতে চেয়েছিলাম” শিরোনামের লেখা। লেখাটি থেকে একটা অংশ তুলে দিচ্ছি। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে হতে পারে তারপরেও দিচ্ছি।

সাহিত্যসভায় কালজয়ী সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব, কবি সম্মেলনে নিভৃতিচারী কবি হওয়া সম্ভব, সাহিত্যপত্রিকার জীবনঘনিষ্ট লেখক হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু পাঠকের হুমায়ূন আহমেদ, বইমেলার হুমায়ূন আহমেদ হওয়া সম্ভব নয়। এটিই তিতকুটে সত্য, নির্জলা বাস্তবতা।

এখন আসে মূল প্রসঙ্গে। গত বেশ কিছু দিন ধরে ভার্চুয়াল জগতে হুমায়ূন আহমেদের তীব্র সমালোচনা হয়েছে, যার শুরুটা হয় মূলত দৈনিক “প্রথম আলো” তে ৩০ জানুয়ারি ২০১২ তে প্রকাশিত “সুপার হিরো” শিরোনামের একটি লেখার মাধ্যমে। একজন লেখকের সমালোচনা হতেই পারে। এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনার তীব্রতার মাত্রা বিস্ময়কর ভাবে সহজ স্বাভাবিক শালীনতাকে ও ছাড়িয়ে গেছে; সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ভ্রান্ত কিছু তথ্যাদি । আমি এ বিষয়ে একটু বলার চেষ্টা করব।

“পৃথিবীর কোথাও আমি ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল করতে দেখিনি। এই অর্থহীন মূর্খামি বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। এই মূর্খদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ড. আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অতি শ্রদ্ধেয় দুজন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাদা দলে ইলেকশন করেছি। এখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। মূর্খ মনে হয়।”

– তার এই বক্তব্যতে অনেকে আপত্তিকর একটি বিষয় খুঁজে পেয়েছে তা হল উনি ড. আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কে তার এই লেখার মাধ্যমে মূর্খ বলতে চেয়েছেন। এই বেপারটি অবশ্যই নিন্দনীয় কারণ হুমায়ূনের ভাষাতেই বলবো, ড. আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অতি শ্রদ্ধেয় দুজন, শুধু তাই নয় তারা যথেষ্ট জ্ঞানী ও বটে; এদেশের শিক্ষিত মানুষ মাত্রই এটা জানে।

এখন আসি “জোছনা ও জননীর গল্প” প্রসঙ্গে। আমার পড়া মুক্তিযুদ্ধের উপর সবচেয়ে সুখপাঠ্য বই এটি। মূলত এটি একটা উপন্যাস। কথাটায় জোর দিচ্ছি আমি “জোছনা ও জননীর গল্প” একটি উপন্যাস। অনেকে তার সমালোচনা করতে গিয়ে “জোছনা ও জননীর গল্প” কে ইতিহাস বই মনে করে তার সমালোচনা করে ফেলেছেন (যদি ও আমার মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে এই বইটি কে ইতিহাস গ্রন্থ বললে খুব একটা ভুল হবে না কারণ হুমায়ূন তার বইটিতে যথেষ্ট তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন।), যেমন, সুপরিচিত ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন তার হুমায়ুন আহমেদঃ একজন পুস্তক ব্যাবসায়ী পতিত বুদ্ধিজীবী! লেখায় সমালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,

“জোছনা এবং জননীর গল্পে তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের সেই ভাষণটা শেষ করেছিলেন “জয় বাংলা, জিয়ে পাকিস্তান” বলে। অথচ ৭ মার্চের ভাষণকে আমরা জানি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষিত সনদ হিসেবে। অন্যান্য আরো কয়েকটা জায়গায় এই কথাটা বলা আছে(শামসুর রাহমান, নির্মল সেনের জীবনীতে), তবে এটা কতটা অথেন্টিক, তা জানা যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণটির সাথে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ কোনভাবেই উচ্চারিত হতে পারে বলে মনে হয় না।”

এরকম কোনভাবেই উচ্চারিত হতে পারে বলে মনে হয় না না বলে আসুন দেখি হুমায়ূন আসলে কি বলেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ বইটির পূর্বকথা অংশে বলেছেন,

“জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ বাংলাদেশের তারিখ প্রথম সংস্করণে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘জয় বাংলা। জিয়ে পাকিস্তান।’ দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি ‘জিয়ে পাকিস্তান’ অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রাহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকণ্ঠে ‘কালের ধুলোয় লেখা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল ‘জিয়ে পাকিস্তান’।.আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাব ধারার মানুষ। সমস্যা হলো আমি নিজে ৮ এবং ৯ মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোনো তথ্য পাইনি। তাহলে একটি ভুল ধারণা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?

আসিফ মহিউদ্দিন আরো লিখেছেন,

“একজন সেক্টর কমান্ডারের নাম এসেছে তার “জোছনা এবং জননীর গল্পে”; অবাক হয়ে দেখতে হচ্ছে, শুধুমাত্র মেজর জিয়া এবং তার স্ত্রীর নাম। অন্য আরো অনেক জন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, তাদেরও স্ত্রী পুত্র ছিল। অথচ তারা হুমায়ুনের বইতে স্থান পাওয়ার মত যোগ্য হয়ে ওঠেন নি, কারণ মেজর জিয়ার নাম দেয়া হলে একটা রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকের সহানুভূতি পাওয়া যাবে, সেই দলের সমর্থকদের কাছে বইটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।”

এই অংশটুকু পড়ে আমার খুব অবাক লেগেছে আসিফ মহিউদ্দিন এর মতো একজন প্রগতিশীল ব্লগার কিভাবে একজন সাহিত্যিকের সমালোচনা করতে বসে এধরনের তথ্য ব্যবহার করতে পারেন। সকলের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি বইটিতে আরো সেক্টর কমান্ডারদের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু লেখা অতিরিক্ত পরিমাণে বড় হয়ে যাবে দেখে বিস্তারিত লিখছি না। আরেকটু যোগ করে দেই হুমায়ূন আহমেদ বইয়ের “পরিশিষ্ট” অংশে খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকাও সংযোজন করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয় আসিফ মহিউদ্দিন এও লিখেছেন,

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশদ্রোহিতার মামলা নিয়ে দিনের পর দিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের অমৃতবচন,
“ওনাকে কেউ তো খুন করেনি। উনিতো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহী কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা হয়নি। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটিই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, পুরোটাই ছিল একটা সাজানো খেলা।… বাংলাদেশে মৌলবাদের সমস্যা- বড় কোনো সমস্যা এখনো হয়নি। জনগণ যদি ভোট দিয়ে মৌলবাদীদের নির্বাচন করে, তাহলে গণতান্ত্রিকভাবে কি তাদের বাদ দেওয়া যায়? হোক না তারা মৌলবাদী।”

এ অংশটুকু পড়ে আমার একটা জিনিস মনে পরে গেলো। গতবার চার দলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় থাকা কালিন সময় বিটিভি তে একটা ভিডিও ক্লিপ প্রায় প্রচার করা হত; যেখানে দেখানো হতো শেখ হাসিনা বলছেন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ বিরোধীদলে গেলেও কোনদিন হরতাল করবে না। কিন্তু এ ভাষণের আগে পরে ও যে কিছু অংশ ছিল তা স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পরে বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা ঐ রকম। আসুন মূল ঘটনাটি দেখি। ১৮ জুলাই, ২০০৮ সালে “দৈনিক সমকাল” কে দেয়া সাক্ষাৎকারে হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,

“ওনাকে তো কেউ খুন করেনি। উনি তো ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। ওনাকে দেশদ্রোহী কখনোই বলা হয়নি। দেশদ্রোহী কথাটা ভুল ইনফরমেশন। তার বিরুদ্ধে কখনোই দেশদ্রোহীর মামলা করা হয়নি। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটাই ছিল এত তুচ্ছ, আমরা জানি যে, পুরোটাই ছিল একটা সাজানো খেলা। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মৌলবাদীরা তো কতবার আমাকে মুরতাদ বলেছে, তাতে কি আমি মাথা ঘামিয়েছি কখনো? কখনো না।

.

আসিফ মহিউদ্দিন লিখেছেন,

“মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হুমায়ুন আহমেদ সাহেব শর্ষিনার রাজাকার পীর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন”

এই মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হুমায়ুন আহমেদ সাহেব শর্ষিনার রাজাকার পীর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তথ্যটা কোথায় পেয়েছে আমার জানা নেই। আমার জানা মতে হুমায়ূনের পুলিশ অফিসার বাবাকে মেরে ফেলার পর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাইকে যখন মিলিটারিরা খুঁজছে এমন অবস্থায় একদিন তাদের এক শুভাকাঙ্ক্ষী দুই ভাইকে শর্ষিনার রাজাকার পীর সাহেবের মাদ্রাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু পীর সাহেব তাদের আশ্রয় দেন নি।

.

আরো দেখুন আসিফ মহিউদ্দিন লিখেছেন,

“মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তার সাহিত্য বা চলচিত্র একটু বুদ্ধিমান পাঠক বা দর্শক অনেকের মনেই দ্বিধা দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। খুবই আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করতে হয়, তার উপন্যাস বা চলচিত্রে ‘রাজাকার’ বলে কোন চরিত্র নেই।”

.

আবার আসিফ মহিউদ্দিনই তার লেখাটির প্রথম প্যারায় লিখেছেন,

“তার ‘তুই রাজাকার’ গালিটাতে বাঙালী শিখেছিল রাজাকার আলবদরদের ঘৃণা করার কথা, যে সময়ে রাজাকার আলবদরদের কথা বলতেও মানুষ ভয় শিউরে উঠতো।”

এই বিষয়টা আমার কাছে স্ববিরোধী মনে হয়েছে।

এরকম অনেক জায়গায় দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনার নামে তাকে নিয়ে রঙ তামাশা করা হচ্ছে। গালি গালাজ ব্যবহার করা হচ্ছে দেদারছে যাদের অনেকেরই আবার ব্লগার এবং লেখক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম আছে। এটা ঠিক কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। বিশেষ করে হুমায়ূন আজাদ সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্যের সমালোচনা করা হচ্ছে সব চেয়ে বেশি, সেখানে বলা হচ্ছে একজন লেখক হয়ে আরেকজন লেখক সম্পর্কে এরকম মন্তব্য খুবই আপত্তিকর। বিষয়টা যৌক্তিক। কিন্তু কথা হল আমিই আবার লেখক হয়ে যখন লেখন হুমায়ূন আহমেদের নগ্ন সমালোচনা এবং মিথ্যাচারিতা করছি তা কি আপত্তিকর নয়? একবার ভেবে দেখা দরকার। তাই আসুন আসিফ মহিউদ্দিন এর ঐ লেখা থেকেই বলি, “লেখার বিরুদ্ধে লেখনীকেই শক্তিশালী করতে হবে। যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি আর কথার বিরুদ্ধে কথা।”