গবেষকের মন

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই গবেষণা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথম ঠিক কী কী জানা প্রয়োজন? যেমন, এই গবেষণায় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফান্ড কেমন? এআইয়ের চাকরির বাজার কতোটা প্রশস্ত? বা এগুলো কি আদৌ সঠিক প্রশ্ন? নিশ্চিন্ত জীবনের জন্যে এগুলো জানাটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তা বলে নেয়া ভালো, এআইয়ের উপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফান্ডের পরিস্থিতি খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ফান্ড আছে, কিন্তু প্রাপ্যতার হিসেবে এআই মোটেই সেরা বিষয় নয়। আশেপাশেও নয়। চাকরির বাজারেও এটা রমরমা না। কোনোকালে তেমনটা ছিলো বলেও মনে হয় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, এআইতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা করার জন্য এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই না। কোনো গবেষণার জন্যেই না। বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ গবেষণাক্ষেত্র আর্থিকভাবে তুলনামূলক বেশি স্বস্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু কোন গবেষণাটা নিকট ভবিষ্যতে সবচেয়ে লাভজনক হবে সেটা আগে থেকে বলাটা অধিকাংশ সময়েই দুঃসাধ্য। আর তেমন লাভজনক অবস্থাটা থাকেও সামান্য সময় ধরে। এরপর ভিন্ন বিষয় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটা গবেষণা-জীবনের পুরোটা জুড়ে একটা বিশেষ গবেষণার বিষয় আর্থিকভাবে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকবে, এমনটা ভাবাই অকল্পনীয়। তাই, কোন গবেষণার ফান্ড কেমন, চাকরির বাজার কেমন, সেটা একটা গবেষণার জীবনের জন্যে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ থাকে না, অন্তত গবেষকের মন যে প্রাপ্ত হয়েছেন, তার জন্যে তো নয়েই!

যারা গবেষণার জীবনযাপনে বদ্ধ পরিকর হন, তাদের জন্যে এআই সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের বিষয় জানা জরুরি। যেমন এই গবেষণার আকার প্রকার কীরূপ? কী সমস্যা নিয়ে এই গবেষণায় কাজ হয়? এআই মানুষের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। এআই গবেষণার ভিত্তিমূল প্রশ্ন হচ্ছে – বুদ্ধিমত্তার প্রকৃতি কী। অনেকটা মহাবিশ্বের প্রকৃতি কী জানার মতো। গভীর ও মৌলিক প্রশ্ন। মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা বরং সে তুলনায় অনেক উন্নত হয়ে গেছে। এ আইয়ের সমস্যা সে তুলনায় অনেক নবীন। বুদ্ধিমত্তার প্রকৃতি কী, কীরূপে একটি অস্তিত্ব – সে একটি পাখি, একজন মানুষ বা একটি যন্ত্রই হোক – নির্বোধ থেকে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমান হয়ে উঠে বা উঠতে পারে, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তার প্রকৃতি জানাটাই এআই গবেষণার মূল প্রশ্ন। এর সাথে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মস্তিষ্কের প্রকৃতি জানার প্রশ্নও জড়িত। সেটা যদিও মূলত নিউরোবিজ্ঞান, কগনিটিভ বিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য, এআইয়ের গবেষণা সেই প্রশ্নের উত্তরেরও আরেকটি উপায়। অনেকক্ষেত্রে তারা সম্পূরক।

এআই গভীর ও মৌলিক গবেষণার বিষয়গুলোর মধ্যে নবীনতম। এর জন্যে তাই প্রয়োজন যোদ্ধা গবেষকের। যারা প্রথম যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো ঘটাবে। পথপ্রদর্শক হবে। তার মানে কি এই গবেষণায় কোনো অগ্রগতি হয় নি? নিশ্চয়ই হয়েছে, এবং অসংখ্য নিবেদিত গবেষকের অবদানের কারণে আমরা এখন এআইয়ের সমস্যাটাকে আরেকটু পরিষ্কারভাবে বুঝি। পঞ্চাশ ষাট বছরের বেশি পুরনো নয় এআইয়ের গবেষণা। মানব সভ্যতায় এর অবদানগুলোও ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আধুনিক অনেক যন্ত্র – ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, বিমান, অজস্র ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন, সার্চ ইঞ্জিন, রিকমেন্ডেশন সিস্টেম, বিজ্ঞাপন, ট্রান্সলেশন, ইত্যাদি, এখন বিভিন্ন এআই ও মেশিন লার্নিং (এআইয়ের অন্যতম উপশাখা) অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। ফলে এই গবেষণা উন্নয়নশূন্য নয়, বরং এর ফলাফল উত্তোরত্তর আমরা আমাদের চারপাশে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মূল প্রশ্নে, অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তার প্রকৃতির প্রশ্নে, একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে আসা দরকার, অন্তত মহাবিশ্ব সম্পর্কে যেমন অবস্থায় আমরা পৌঁছতে পেরেছি। তাই, এই গবেষণার জন্যে প্রয়োজন নিবেদিত যোদ্ধার। এর জন্যে গবেষণা জীবনকে আরাধ্য মনে করা মানুষের প্রয়োজন, গবেষণা যার ধ্যান-জ্ঞান। গবেষণা যার কাছে আর্থিক-সামাজিক সৌভাগ্য লাভের চেয়ে বড়। এবং শুধু তাই নয়, তারা এমন হবে যে এআইয়ের মূল জিজ্ঞাস্যটাকে সারা জীবন ধরে জানতে চাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারবে।

তা কীভাবে এআইয়ের সমস্যা নিয়ে আগ্রহী গবেষক হয়ে ওঠা যায়? বা কীভাবে যেকোনো মৌলিক, দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা নিয়েই আগ্রহী হয়ে ওঠা যায়? প্রথমে সম্ভবত এই বিষয়ে আমাদের একমত হওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে যে গবেষণার জীবন গবেষকের কাছে আর্থিক-সামাজিক সৌভাগ্য ও নিরাপত্তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি আরাধ্য। এ ধরনের গবেষণার সাথে একাগ্রতার প্রশ্ন বেশি জড়িত। বহুমুখিতার অতোটা না। টিউরিং অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত এআই গবেষক অ্যালেন নিউয়েল একটি সেমিনারে বলেছিলেন – গবেষক গবেষণার বিষয় বেছে নেয় না, গবেষণার বিষয়ই গবেষককে বেছে নেয়। আমিও তেমনটাই মনে করি। এবং তেমনটাই মানুষের গবেষক হয়ে ওঠার পেছনেও খাটে। মানুষ গবেষণার জীবন বেছে নেয় না। গবেষণাই বরং সঠিক মানুষটার জীবনকে বেছে নেয়। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার এআই গবেষক প্রফেসর রিচার্ড সাটন একবার আমাকে বলেছিলেন – গবেষণা হচ্ছে আরাধনা। সেই আরাধনার ঐশী ডাক সঠিক মানুষটার কাছেই ঠিক ঠিক পৌঁছে যায়। মানুষকে কেবল সেই ডাকে সাড়া দিতে হয়।

ফলে যারা গবেষণার জীবনকে বেছে নেয় না, তারা আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জীবনযুদ্ধে যে অনেক অগ্রসর হয়ে গেছে এমন কিছু নয়। বা অনেক পিছিয়ে পড়েছে, তাও নয়। এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় নয়। এটা ভিন্ন জীবনধারা। তাদের পছন্দের যে জীবনযাপন, সেটাই তারা বেছে নিয়েছে। গবেষণার ডাক তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছায় নি। হয়তো জীবনের অন্যকোনো বার্তা তারা পেয়েছে। নিজের কাঙ্ক্ষিক জীবনটাকে উদ্ধার করতে পারা আর সেটা নিয়ে নিশ্চিত এমন কি গর্বিত থাকাটাই দরকার। বিশেষ করে গবেষকদের জন্যে বেশি দরকার। কারণ তারা সংখ্যায় অত্যল্প। এবং তাদেরকে একটি কঠিন জীবনধারা বেছে নিতে হয়। গবেষণা গবেষকের জীবনের সবটা সময়কেই দাবী করে। তারপরেও গবেষণার পথে কোনো নিশ্চয়তা নেই – পিএইচডি করে ভালো চাকরি লাভের নিশ্চয়তা নেই। পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলো হয়ে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হবার নিশ্চয়তা নেই। টেনুর্ড হলে একাডেমিয়াতে চাকরির নিশ্চয়তা হয়তো আছে, কিন্তু তাতেও প্রতিনিয়ত ফান্ড পাবার নিশ্চয়তা নেই। ভালো ছাত্র পাওয়া যাবে কিনা জানা নেই। আর এই প্রতিটি ধাপেই থাকে সম্ভাব্য অর্থকষ্ট। রয়েছে মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গীর প্রতি কম সময় দেওয়ার কষ্ট। একজন গবেষক গবেষণার পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিকভাবে সফল বলতে যেটা বোঝায়, সেটা হবেন ভাবাটাই কঠিন। আর্থিক, সামাজিক সৌভাগ্যে নিবেদিত জীবন আর গবেষণায় নিবেদিত জীবনকে দুটো ভিন্ন পথ মনে করাটাই শ্রেয়। তাই গবেষকের জীবন যারা বেছে নেবেন, তারা তাদের সেই গবেষণার জীবনের প্রাপ্তির সাথে আর্থিক সামাজিক বা ইত্যাদি অন্যান্য সৌভাগ্যের তুলনা করলে চলে না। এই প্রাপ্তিগুলো গুণগতভাবে ভিন্ন। গবেষণার এই গুণগতভাবে ভিন্ন প্রাপ্তিতে যার রুচি, তিনিই গবেষণার জীবন বেছে নেন।

তবু কতো সম্ভাবনাময়কেই ভুল লক্ষ্য বাছাই করতে দেখা যায়। এমন কি অনেকে গবেষণার জীবনের মধ্যে থেকেও গবেষণার ফান্ডের নিশ্চয়তা প্রাপ্তির জন্যে জনপ্রিয় বিষয়ে গবেষণা করাতেই বেশি ব্রতী হন। এতে মৌলিক ও দীর্ঘমেয়াদী গবেষণাগুলো তাদের অবদান থেকে বঞ্চিত হয়। অ্যালান নিউয়েলের মতে, এদের গবেষণা জীবন হচ্ছে সকল প্রকাশনাযোগ্য বিষয়ের স্পেসে একটা র্্যান্ডম ওয়াকের মতো। কিন্তু না, এআইয়ের দরকার নিবেদিত যোদ্ধার, যারা একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আর শপথ নিয়েই এগুবে, ক্ষণমেয়াদী লাভের আশায় ভাড়াখাটা সৈনিকের মতো নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করে বেড়াবে না। এমন এআই গবেষক হাতেগোনা অল্প কয়জন হলেও আছেন। আরও দরকার। আর সেটা কোনো বিশেষ নৃতাত্ত্বিক কারণে বাঙালি হতে পারবে না, তেমনটা আমি ভাবতে পারি না।

গবেষণার পূর্বপ্রস্তুতি

এআই গবেষণার পূর্বপ্রস্তুতির জন্যে দরকারি দক্ষতাগুলো কী? আমার পিএইচডি সুপারভাইজারের সাথে একদিন কথা হচ্ছিল সদ্য প্রয়াত ডেনিস রিচিকে নিয়ে। একই ল্যাবে কাজ করতেন তারা। তবে আমার সুপারভাইজার তাকে একজন কলিগ হিসেবে দেখার চেয়ে ইউনিক্স ও সি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের স্রষ্টা এবং সিয়ের উপরে গুরুতর ও পূর্ণাঙ্গভাবে শেখার মতো একটা বইয়ের লেখক হিসেবেই দেখতেন। ঠিক আমার কাছে ডেনিস রিচি যেমন। অর্থাৎ একজন গুরুজন ও শিক্ষক হিসেবে। তা কথা প্রসঙ্গে আমার সুপারভাইজার তার বহুদিনের একটি স্বপ্নের প্রজেক্ট – একটি নতুন প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ তৈরির কথা আমাকে বললেন। যেটা অনেকটা লিস্পের মতো। কিন্তু লিখতে সহজ, নিয়ম স্বল্প, ব্যবহারে সর্বজনীন। তিনি বললেন, সঠিক ছাত্রটিকে পেলে একদিন এই প্রজেক্টটা সত্যিই বাস্তবায়ন করবেন। আমি তাকে বললাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টে কম্পাইলারে দক্ষ ও আগ্রহী অনেক ছাত্রই আছে। অন্তত তাদেরই এ বিষয়ে আগ্রহী হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। প্রফেসর সাটন বললেন – কম্পাইলারে দক্ষতা বা আগ্রহ নয়, এই প্রজেক্টের জন্য একমাত্র আবশ্যক গুণ হলো (ভাষা ও নিয়মের) ইউনিফর্মিটির প্রতি অবসেশান।

ওনার সাথে এই কথোপকথন আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমি উপলব্ধি করতে উঠতে পারলাম যে গবেষণার জন্যে সাধারণভাবেই প্রায় একমাত্র আবশ্যক গুণ হলো অবসেশান। গবেষণার বিষয়টা যখন নির্দিষ্ট হয়ে যাবে, তখন তার প্রতি অবসেশানই একমাত্র সেটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

তা এখন যারা সেই ভাগ্যবান – গবেষণা যাদেরকে বেছে নিয়েছে – কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের অবসেশানও যাদেরকে পেয়ে বসেছে, তাদের আর কী কী জানা প্রয়োজন পড়তে পারে গবেষণার পূর্ব প্রস্তুতির জন্য? এআই গবেষণার জন্যে এমন কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সত্যিই আছে কিনা সন্দেহ। বুয়েটের সিএসই বিভাগে প্রয়োজনীয় প্রায় অনেক বিষয়ই পড়ানো হয়। অন্যান্য অনেক বিশ্বাবিদ্যালয়তেই আশা করি কাছাকাছি অবস্থা। বুয়েটের সিএসই বিভাগে এআই কোর্স ছাড়াও মেশিন লার্নিংয়ের উপরও আলাদা কোর্স অফার করা হয়, যেটা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনুসরণ করতে পারে। গবেষণার বিষয়ে কেউ পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইলে লিনিয়ার অ্যালজেব্রা, প্রোবাবিলিিট, স্টোকাস্টিক প্রসেস, মার্কভ ডিসিশান প্রসেসের উপর ভালো দখল নিয়ে রাখতে পারে। এগুলোর সবটা অতোটা করে বুয়েট সহ বিভিন্ন সিএসই বিভাগে পড়ানো হয় না। সত্যি বলতে, পৃথিবীর অনেক সিএস বিভাগেই গণিতের অনেক ভিন্ন ভিন্ন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয় না। কারণ, সবগুলো বিষয় একটা সাধারণ সিএস ডিগ্রির জন্য হয়তো অতোটা জরুরি নয়। তবে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোত সাধারণত কেউ এআই বা মেশিন লার্নিংয়ের মতো একটা বিশেষ শাখায় দক্ষ হতে চাইলে গণিত বিভাগে গিয়ে প্রয়োজনীয় কোর্সগুলো করে আসার সুযোগটা পায়। এই সুযোগটা আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকাটাও খুবই প্রয়োজন।

বাস্তবতা

মানুষ ছোটবেলায় সবচেয়ে সাহসী থাকে। তার থাকে প্রায় যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলার মানসিক সামর্থ্য। বড় হবার সাথে সাথে আমরা সমাজের কাছে জানতে শিখি যে আমরা আসলে অনেককিছুই পারি না। এটা সত্য যে আমরা আসলে অনেককিছুই পারি না। কিন্তু সেটা যতোটা না বাস্তবিক সীমাবদ্ধতার জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি হলো মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে। আমরা বড় হয়ে হই অধৈর্য্য, ভীতু ও অদূরদর্শী। আমাদের সমাজও এ কারণে একইরকম হয়। ফলে আমাদের সমাজ তাৎক্ষণিক লোভের প্রতি বরং আমাদের যত্নবান হতেই শেখায়। অন্যদিকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে, কোন মহৎ লক্ষ্য গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করে। কারণ অনেক মহৎ লক্ষ্যই দীর্ঘকালীন সাধনা আর মনোযোগ দাবী করে। এগুলোর প্রতি আমাদের অনীহা দেখা যায়, কারণ সমাজ আমাদেরকে এগুলোর প্রতি অনীহ হতে শেখায়। এমন না যে আমরা সাধনাপূর্ণ, সঠিক কাজটা করতে নিজে থেকেই অনীহ। সুযোগ পেলেই আমরা জানতে চাই – দেশেটাকে কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর করা সম্ভব? দেশে থেকে কি সৎ থাকা সম্ভব? বা একজন বাঙালি হয়ে আমার পক্ষে কি সারাজীবন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বা গণিত নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া সম্ভব? অর্থাৎ আমরা মূলত দূরদর্শীই হতে চাই। সঠিক কাজটা উপলব্ধি করতে আমরা অপারগ নই। কিন্তু আমরা অনেক সময়েই সমাজ থেকে উত্তর পাই, এগুলো করা বাস্তব নয়। এগুলো করা কঠিন। দেশটা কখনো বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর দেশ হতে পারবে না। দুর্নীতি দূর করা সম্ভব না। একজন বাঙালির পক্ষে মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব না। অমুক বিষয় পড়ো, কারণ ওতে চাকরি আছে। অমুক বিষয়ে গবেষণা করো, কারণ ওতে ফান্ড আছে। যারা গবেষণার বিষয়ের চেয়ে ফান্ডের প্রাপ্যতা, বিষয়ের আগ্রহের চেয়ে চাকরির নিশ্চয়তাকে নিজে থেকেই বেশি কদর করে, তাদের ব্যাপারে আমার কোনো অনুতাপ নেই, কারণ তারা তা-ই করে, যা তারা করতে চায়। কিন্তু অনুতাপ তাদের জন্যে, যাদের মনন গঠিত হয়েছে গবেষণার জন্যে, শুধু প্রেরণা আর আশ্বাসের অভাবে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনহীন কোনো জীবন বেছে নিয়েছে।

আমিও অন্য অনেক সাধারণ ছাত্রের মতোই তেমন বিশেষ কোনো টেকনিক্যাল বিষয়ে অসাধারণ কেনো দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও কোনো মৌলিক বিষয়ে – যে বিষয়ে আমার ঝোঁকটা সবচেয়ে বেশি – গবেষণা করার স্বপ্ন দেখতাম। বুয়েটে ঢোকার শুরুটা থেকেই এআই নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী ছিলাম। আমার কাছে সবসময় মনে হতো, পদার্থবিজ্ঞান এতোটা এগিয়ে গেছে। তা গেছে অনেক আগে থেকে মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখতো বলে। আধুনিক মানুষের অন্যতম স্বপ্ন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বুদ্ধিমত্তা বলতে কী বোঝায়? মন কী? কীভাবে অনুভূতি তৈরি হয়? এসব প্রশ্ন দিনের পর দিন আমাকে ভাবতো। অন্য অনেকের মতো আমাকেও সমাজ থেকে শুনতে হয়েছে হতাশার বাণী। ফান্ড নেই। বিষয়টা আমাদের জন্যে কঠিন। এআই সম্ভব নয়। কিন্তু সাহস ধরে রাখতে হয়েছে। তার সাথে অনেক মানুষের থেকে, অনেক লেখার থেকে প্রেরণা পেয়েছি। লেভেল ১, টার্ম ২-তে থাকতে ডিস্ক্রিট ম্যাথেমেটিক্স কোর্সের শিক্ষক শাহ আসাদুজ্জামান আমাদের বলেছিলেন – বুয়েটেই এআই নিয়ে গবেষণার অনেক সুযোগ আছে, অনেকেই এখানে এআই নিয়ে গবেষণা করেন। সেই কথাগুলো আমার আগ্রহের পেছনে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছিলো। এআই নিয়ে গবেষণা বুয়েটে থেকে করা সম্ভব না, এমন কিছু বললে সেটাও হয়তো আমাকে প্রভাবিতই করতে পারতো। অথবা হয়তো অন্য অনেকের অনেক কথার মতো সেই কথাগুলোও তখন ভুলে যেতাম। তাই আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে – সঠিক কথাগুলোর প্রতি সব সময় মনোযোগ দেবার সুযোগ হয়েছে।

পরবর্তীতে প্যাটার্ন রিকগনিশান কোর্সে নিউরাল নেটকওয়ার্ক সম্পর্কে পড়াশোনা করে আর সেটা নিয়ে প্রোগ্রামিং করে ক্ষুদ্র পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (যেমন, রিকগনিশান) তৈরির উদাহরণ দেখে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়েই এআইতে ব্যাচেলার থিসিস করেছিলাম বুয়েটের সিএসই বিভাগের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর এআই গবেষক ডঃ মোঃ মনিরুল ইসলামের অধীনে। আমার দেখা অন্যতম একনিষ্ঠ ও একাগ্র গবেষক। এআইতে গবেষণার জন্য সবসময় প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। গবেষণার প্রতি আমার যে সাধনাসুলভ মানসিকতা, সেটাকে তিনি সবসময় মূল্যায়ন করতেন। কোনো জনপ্রিয় ঝোঁকের দিকে আমাকে কখনো চালিত করেন নি।

তাই বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্যেও কেবল এআইয়ের বিষয়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাপ্লাই করলাম। গবেষণার বিষয় নিয়ে কোনো আপোষ করবো না ঠিক করলাম। কিন্তু বাইরে অ্যাপ্লাই করার সংস্কৃতিটা দেখলাম – গবেষণার বিষয়ের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ, শহর, এগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া। ভর্তি হবার অফার পেলাম ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া আর ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া হলো কানাডার ‘আইভি লিগ’। সমুদ্রের পাশে অবস্থিত ভ্যানকুভার শহর হলো বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত থাকার জায়গা, কানাডার মধ্যে সবচেয়ে কম তুষারপাতের শহরগুলোর সম্ভবত একটা। অন্যদিকে আলবার্টা হলো এডমন্টনে, যেখানে ছয় মাস বরফ ঢাকা থাকে, তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু জানতাম এআই ও মেশিন লার্নিং গবেষণায় আলবার্টার তুলনা মেলা ভার। সানন্দে চলে এলাম ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টায়। সেখানে গেম রিসার্চ বেশ এগিয়ে, যেটা ক্ল্যাসিকাল এআইয়ের অন্যতম বিষয়। প্রফেসর জনাথন শেফার এখানে চেকার্স খেলাটিকে সমাধান করেছেন। বর্তমানে এখানের গেম রিসার্চ গ্রুপের টেক্সাস হোল্ডে’ম পোকার প্রোগ্রামটি বিশ্বসেরা এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের সম পর্যায়ের।

ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার প্রফেসর রিচার্ড সাটন হচ্ছেন এআই ও মেশিন লার্নিং গবেষণার অন্যতম নতুন শাখা রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের অন্যতম স্রষ্টা ও প্রধান গবেষক। তিনি তার পিএইচডি সুপারভাইজার অ্যান্ড্রু বার্টোর সাথে রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের প্রধান বইটি লিখেছেন ১৯৯৮ সালে। বইটি সম্পূর্ণ মুক্তভাবে পাওয়া যায় ওনার ওয়েবসাইটে। ওনার অধীনে মাস্টার্স থিসিস করেছি। এখন পিএইচডি করছি রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের উপরেই। রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং এআইয়ের নবীন শাখা। এখানে একটা সত্তা কীভাবে তার পরিবেশের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমান হয়ে উঠতে পারে, যেমন কোনো প্রদত্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, কোনো বিষয়ে ধীরে ধীরে জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়। এখানে ধরা হয়, বুদ্ধিমান সত্তার মন হচ্ছে আনন্দবাদী। প্রতি মুহূর্তে সত্তা হয় আনন্দ অথবা ব্যথা অনুভব করে। ভবিষ্যতের সার্বিক আনন্দ বর্ধনই তার উদ্দেশ্য। নিউরোবিজ্ঞানে ও মনোবিজ্ঞানেও প্রাণীর অনেক কর্মকাণ্ডকে এরকম আনন্দবর্ধনমূলক বলে ধারণা করা হয়। মস্তিষ্কের ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের সাথে ইতোমধ্যে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর আনন্দবর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। আনন্দবর্ধনের উপর ভিত্তি করে ডোপামিন নিঃসরণকে ব্যবহার করে মস্তিষ্ক যেভাবে নতুন বিষয় শেখে, সেটার মিল পাওয়া গেছে টেম্পোরাল ডিফারেন্স লার্নিং নামক অ্যালগরিদমের সাথে, যেটা আগেই তৈরি হয়েছিলো রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের মৌলিক গবেষণায়।

বুদ্ধিমত্তার প্রকৃতিকে জানার এমন অভাবনীয় সব ধারণা নিয়ে এআইতে কাজ করতে ভালো না লাগার কোনো কারণ ভেবে পাই না। অবশ্যই, গবেষণা করে সবসময় স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবো, স্বচ্ছল থাকবো, বা নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করারই যে সুযোগ পাবো, সেটার নিশ্চয়তা নেই। কারোই নেই। অনিশ্চিত পথ এটা। আশেপাশেই যেখানে অনেক আর্থিক নিশ্চয়তার হাতছানি। কিন্তু তাদের উপেক্ষা করাটাই হয়তো ভাগ্য। সত্যানুসন্ধানের যে স্বাদ, তা গ্রহণের জন্যে অনিশ্চয়তাকে বরণ করাও চলে। আগামিতে কী হবে জানা নেই। আগামির নিশ্চয়তা অর্জন করা কঠিন। কিন্তু একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা আর অধ্যাবসায়ের নিশ্চয়তা অর্জন করা সম্ভব। তার জন্যে তাই কঠোর সাধনা করে যেতে হয়। তার জন্যে প্রতিনিয়ত নিজের লক্ষ্যের কথা স্মরণ করতে হয়। আমি মনে করি, আরো অনেকেই এভাবে ভাবেন। তাদের সাথে ধারণাগুলোা ভাগ করে নেয়ার জন্যেই এই লেখা। প্রেরণা দরকারি। একবার প্রফেসর সাটনকে জিজ্ঞেস করি, কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার জীবন নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন – যাবে না। কিন্তু যে বিষয়টার প্রতি মন আবিষ্ট, সেটার পাণে লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে। হয়তো ভিন্ন কোনো কাজও করতে হতে পারে জীবিকার জন্যে। কিন্তু গ্যারেজে একটা ল্যাব খুলে বসে ছুটির দিনে কাজ করতে বাধা কোথায়? বিশেষ করে গবেষণাই যদি সত্যিকারের ভালোবাসার বিষয় হয়। তা এআই নিয়ে কীভাবে ব্যক্তিগত-পর্যায়ে গবেষণা করা সম্ভব, যার পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কিনা রোবট ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়তে পারে? আশার বিষয় হচ্ছে, গবেষণা করার রোবট ক্রমশই মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই চলে আসছে। আমাদের গবেষণাগারের রোবটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃতটি হচ্ছে আইরোবটের ক্রিয়েট রোবট। এটা এখন বিশ্বের অনেক রোবট ল্যাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর দাম কিন্তু মাত্র তিনশ মার্কিন ডলার। এই রোবটেরই কমার্শিয়াল ভার্শনটা রুম্বা নামে স্বয়ংক্রিয় ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। রুম্বাও প্রোগ্রামেবল। সাধারণ লাগেজ ব্যাগে এই রোবটগুলো এঁটে যায়। তাই গ্যারেজে বসেই এআই রিসার্চ এখন সম্ভব। (ফলে বাংলাদেশেও এখন এআইয়ের এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চ খুবই সম্ভব!)

কেউ যদি ভেবে থাকেন, এসব কেবলই আদর্শবাদী কথাবার্তা, আমি বলবো আদর্শের উপর থেকে কখনোই বরং আস্থা না হারাতে। প্রফেসর সাটন একবার আমাকে বলেছিলেন – একবার একটা রিসার্চ ল্যাবের সাথে গবেষণার বিষয় নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন। তখন কয়েকটা বছর বেকার থেকেই ওনার রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিংয়ের উপর বইটা লিখেছিলেন, যেটা এখন কম্পিউটার সায়েন্সের গবেষণায় অন্যতম সর্বাধিক উদ্ধৃত বই। আমি তাকে বললাম, এমন করার জন্যে একটা মানুষকে নিশ্চয়ই অত্যন্ত আদর্শবাদী হওয়া প্রয়োজন। তিনি তখন বললেন – “এমনিতেও আদর্শবাদী হওয়া প্রয়োজন। কারণ, আদর্শবাদই সত্যিকারের বাস্তবতাবাদ।”

বুয়েটের সিএসই ফেস্টিভ্যাল’২০১১ এর সুভেনিরের জন্যে সৈয়দ মাহবুব হাফিজ অলির অনুরোধে লেখাটা লিখেছিলাম। আফসোস, যাদের জন্যে লিখলাম, যাদেরকে ধীর স্থির ও সংহত হবার পরামর্শ দিতে চাইলাম, তাদেরকে সেটা বজায় রাখার পরিবেশ আমরা দিতে পারলাম না। বিনা কারণে তারা আক্রমণের শিকার হলো, হাত পা ভাঙার ভাগ্য বরণ করলো। এখন তাদের পরীক্ষা চলার কথা। আশা করি ঈশান পরীক্ষা দিতে পারছে। লেখাটা অতীব কিঞ্চিৎ সম্পাদনা ও সংশোধন করে এখানে দিলাম। গবেষকের মন যার, গবেষণা তার ব্রতী হোক।