লিখেছেন: নজরুল ইসলাম খোকন

কোনো বস্তুর উদ্ভব ও তার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বস্তুটি বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের পথে তার গতিপথ উম্মুক্ত রয়েছে। প্রকৃতি ও জীবনের ক্রমবিকাশের মতই সাহিত্যের ক্রমবিকাশ একই সমান্তরাল ধারায় প্রবাহিত হওয়ার কারণে সাহিত্য মানব জীবনের ও বস্তুজগতের যুগ বা সময়ের প্রতিচ্ছবি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ও মানুষের উৎপাদনশীলতার প্রভাবে যেভাবে জীব ও জগতের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে তেমনই সাহিত্যেরও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষনীয়। গ্রীক, জার্মানী, ফরাসী, ইংরেজী সহ পৃথিবীর সকল ভাষা ও সাহিত্যের মতই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও যুগে যুগে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে পরিবর্তন ও সমৃদ্ধ হয়েছে । সাহিত্যের উৎপত্তির সময় ঘড়ির কাঁটা মেপে নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও এটা বলা যায় ঐতিহাসিক যুগেরও বহু পূর্বে প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের সামাজিক বন্ধনের নির্ভরতা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম ও কঠিন সংহতি ও সমন্বয়ের মাধ্যমে মনের বা ভাবের ক্রমবর্ধমান উদ্ভাবন, বিপর্যয়, দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রকাশের অনুসন্ধি সাহিত্য উদ্ভবের ঊষাকাল বলা যেতে পারে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষে মানুষে কথিত ও শ্রুত এবং গুহাচিত্রে অংকিত মানব সংগ্রমের আদিম ইতিহাসকে ইতিহাসবিদগণ সাহিত্যের আদিম যুগ বলে মনে করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে লিপি উদ্ভাবনের সাথে সাথেই মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথিত ও শ্রুত সাহিত্যকে সামান্য পরিমানে হলেও লিখিত আকারে সংরক্ষিত করে যুগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, পাশাপাশি ঐতিহাসিক যুগের সাহিত্যও সংরক্ষিত, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর সাহিত্য বর্জিত এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারা অব্যহত রেখেছে। হোমো ইরেকটাসের বহুর্বহু বিবর্তনের একটা পর্যায়ে হোমো সাপিয়েন্স বা বর্তমান মানুষের উদ্ভব হয়। এই হোমো সাপিয়েন্স বা বর্তমান মানুষের বহু ধারা উপধারা পার করে আর্যপূর্ব বাংলায় আগত ভেড্ডিড ও দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, আলপাইন উপাদান সংকরায়িত বাঙ্গালি জাতির উদ্ভব হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য জাতি নৃগোষ্ঠির মতই বাঙ্গালি জাতি ও বাংলা ভাষা বহু দ্বন্দ্ব সংঘাত ও রক্তপাতের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব প্রকৃতির মাথে মানুষের, এক জাতির সাথে অন্য জাতির, এক সাহিত্য সংষ্কৃতির সাথে অন্য সাহিত্য সংষ্কৃতির দ্বন্দ্ব ।

দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে আমরা কাহ্নপাদ, লুইপাদ, সরহপাদ, চাটিল্লপাদ, ডোম্বিপাদ, শবরপাদ প্রমূখ চর্যাপদের কবিদের প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত পদ বা সাহিত্যের সন্ধান পাই। চর্যাপদের কবিদের রচনায় আমরা তৎকালীন সময়ের মানুষের জীবন ও জীবনধারার দ্বন্দ্ব সংঘাতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। গুরুপূজা ও শিষ্যপোষ্য সামন্ত সাংস্কৃতিক আভরনে চর্যাপদের কবিদের লেখায় শাণিত হয়েছে হৃদয় মর্মর গীতিপদ আবহ সহ সাধারন মানুষের কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং জ্বলে উঠেছে সমাজের ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে মানুষের বিপর্যস্ত ভাবের ও দ্রোহের বহ্নি শিখা । চর্যাপদের কবিদের এই উৎকর্ষতা বৌদ্ধ বাঙ্গালী ও হিন্দু বাঙ্গালী লেখকদের সংস্কৃতে রচিত ও অবহট্ঠে রচিত সাহিত্যের ধারাবাহিকতার পথ ধরে এসেছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের কবিদের এমন আচরণ বাংলা সাহিত্যে প্রগতিশীলতার সুপ্তবীজ বপন করতে পেরেছে এবং যার আলোয় আলোকিত হয়েছে পরবর্তী যুগের প্রগতিশীল বাংলা সাহিত্য।

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ ভাগ পর্যন্ত প্রায় দেড়শত বছর বাংলা সাহিত্যের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি, এই যুগকে আখ্যায়িত করা হয়েছে বাংলা সাহিতের অন্ধকার যুগ হিসেবে। ইতিহাসবিদদের ধারনা তখনকার জঘন্য ধরনের স্বৈরশাসকগণ যারা বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা সাহিত্যের কাজকর্ম প্রচন্ঠভাবে ঘৃণা করতেন এবং তাদের অত্যাচারের কারণে অন্ধকার যুগ তৈরী হয়েছিল কিন্তু কোনো কোনো ইতিহাসবিদগণ স্বৈরশাসকজনিত এই ধ্রানা বিশ্বাস করেন না। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বাংলা সাহিত্য পুনরায় যাত্রা শুরু করে। শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ তথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও মঙ্গলকাব্যের যুগ,নবাবী আমলের যুগ। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়। উল্লেখযোগ্য মঙ্গলকাব্য যেমন-চন্ডীমঙ্গলকাব্য, মনসামঙ্গলকাব্য, শিবমঙ্গলকাব্য, অন্নদামঙ্গলকাব্য, ধর্মমঙ্গলকাব্য, কালিকামঙ্গলকাব্য,শীতলামঙ্গলকাব্য প্রভৃতি। একই বিষয় বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্যের বহু কবি কাব্য রচনা করেছেন,সেগুলো কাব্য নয়, সঠিক অর্থে বললে বলতে হয় ছন্দে ছন্দে গদ্য বা গল্প রিখেছেন। চন্ডী দেবীর চক্রান্তে নীলাম্বর ও তার স্ত্রী ছায়া শিবের অভিশাপে দেবত্ব হারিয়ে স্বর্গচ্যুত হয়ে কষ্টভরা পৃথিবীতে নেমে আসেন। পৃথিবীতে চন্ডী দেবীর পূজা অর্চনা প্রচলিত করে কালকেতু ওরফে নীলাম্বর ফল্লুরা ওরফে ছায়া পুনরায় স্বর্গে ফিরে যান; মনসা দেবীর চাঁদ সওদাগরের নিকট থেকে জোরপূর্বক পূজা আদায় প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু কবি চন্ডীমঙ্গলকাব্য ও মনসামঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। দেবকীর্তনের মধ্যেই মঙ্গলকাব্যে মানুষের চিন্তা চেতনা, ভাব আবেগের পরিধি বন্দী ছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে স্বর্গবাসী দেবতার পরিবর্তে পৃথিবীবাসী মানব দেবতা বা দাসপ্রভু ও সামন্তপ্রভ ুমানুষই হদয় মানবতা জনতার প্রেম পূজা আরাধনার বিশ্বপাত্র হয়েছেন। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্মের পাশাপাশি মুসলমান কবিরা সামন্তপ্রভুদের পরিবারের সদস্যদের মনের গভীরের সুখ দুখ প্রেম বিরহ নিয়ে অনুবাদ কাব্য রচনা করেন। কবি শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেন ইউসুফ জুলেখার প্রেমকাহিনী কাব্য, বাহরাম খান রচিত অমর প্রেম কাব্য লাইলী মজনু, কবি আলাওলের প্রেমশোকগাঁথা বিখ্যাত পদ্মাবতী ইত্যাদী। দেবকীর্তন, রাজাকীর্তন, নেতাকীর্তন অর্থাৎ দাস ও সামন্ত সাহিত্যের ধারাবাহিকতা ও পরিশীলিত উৎসমুখ বলে পরিগণিত এই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। রাধা কৃষ্ণ, ইউসুফ জুলেখা, লাইলী মজনুর মহাহৃদয়ের গীতিকাব্যের গতিধারা বাংলা গীতিকবিদের হাত ধরে সামন্তবাদী নান্দনিকতার ক্রমবিকাশের ধারায় বিকশিত ও মাধুর্য্যমন্ডিত বাংলা ভাষায় রবীন্দ্র নজরুলের গীতিকাব্য পর্যন্ত পল্লবিত হয়েছে।

জীবের উৎসমূলে রয়েছে প্রেম। জীব বা জীবনের অপর নাম প্রেম। প্রেম শ্রেনী, জাতি, গোষ্ঠী, সাম্প্রাদায়িকতার সীমারেখা মানে না। উৎপাদনক্ষম প্রানী মানুষই যুগে যুগে সম্পদ লুন্ঠনের পাশাপাশি মানুষের মনকে তথা মানুষের প্রেমকে লুন্ঠন করে প্রেমের শ্রেনীনিরপেক্ষতার অর্থাৎ সাম্যের গতিশীল পথকে জোরপূর্বক অবরূদ্ধ করেছে। সমাজের নিপীড়ক শ্রেনী মানুষের ভাব আবেগ চিন্তা চেতনাকে ক্ষত-বিক্ষত ও শৃঙ্খলিত করে কঠিন কারাগারে বন্দী করে তৈরী করেছে কারারূদ্ধ শ্রেনীভিত্তিক সংস্কৃতি। শ্রেনীভিত্তিক সংস্কৃতির বন্দী কারাগারে প্রেমের করুন কান্না বিশ্বের বহু সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও তার বলিষ্ঠ পদচারনা দেখি লালন ফকিরের সুন্নত দিলে হয় মুসলমান ; নারীর তরে কি হয় বিধান, অতুলপ্রসাদের চাই না মাগো রাজা হতে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধাব বিবাহ প্রবর্তনে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবী উপন্যাসে প্রভৃতি সাহিত্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারে, বাংলার সমাজবিক্ষুদ্ধ লোকসাহিত্য বা লোকগীতিকাব্যে, লালনদ্রোহে, শরৎদ্রোহে প্রগতিশীলতার রোপিত বীজ মাটি গর্ভ ভেদ করে সূর্যালোক দেখার তীব্র ব্যথাতুর আকাঙ্খা পোষণ করেলেও প্রগতিশীল বিদ্রোহের সুসংগঠিত রাজনৈতিক রূপে উন্নীত হয়নি।

লুন্ঠনকারী, নিপীড়ক গোষ্ঠীর তোষামোদকারী সাহিত্যিকেরা সাহিত্যিকে বন্দী সংস্কৃতির এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করার কাজে ব্যস্ত থেকেছেন, স্থানান্তর সম্ভব না হলে আপোষ করেছেন এবং এই আপোষের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল বিদেশী বিভাষী সাহিত্য সংস্কৃতিকে স্বমৃত্তিকাজাত উপাদানে আস্বাদিত করে ভিন্ন প্রকৃতির স্বভাষী স্বদেশী প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করেছেন; ভারতবর্ষে মুসলিম ও ইংরেজ সাহিত্য সংস্কৃতির আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাক্রমে শংকর আচার্য্য ও রাজা রাম মোহন রায় এমন আপোষের প্রক্রিয়ায় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে স্বমৃত্তিকাজাত উপাদান সংবলিত একটি ভিন্ন প্রকৃতির একেশ্বরবাদী নিরাকার ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতি তৈরী করেছেন। অনড় অচল ভারতীয় তথা বাংলার সামন্ত পল্লীসমাজের বিপর্যয় বা ভাঙন হঠাৎ করে ঘটেনি, ঘটেছে ক্রমান্বয়ে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শোষন লুন্ঠনের প্রয়োজনের তাগিদে, সেজন্য পল্লীসমাজের এই বিপর্যয় বা ভাঙন প্রগতিমূখী না হয়ে হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতার আধূনিকায়ন অর্থাৎ সামন্ত স্বত্বাধিকার পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে শিল্পের ঔপনিবেশিক স্বত্বাধিকার, জাতীয় স্বত্বাধিকার নয়। ইউরোপে এই স্বত্বাধিকার পরিবর্তিনের সময় অর্থাৎ ইউরোপে সামন্ত সমাজ ভেঙে পুঁজিবাদী সমাজে উত্তরণ পর্বে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও জাতীয় জাগরনের মাধ্যমে প্রগতির মুখ দেখেছিল কিন্তু এই পরিবর্তন ভারতবর্ষ বা বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শোষন লুন্ঠনের ইচ্ছার ছকবন্দী ফ্রেমে সংঘটিত ও পরচিালিত হওয়ার কারনে ঐ স্বল্প মাত্রার প্রগতির মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। আর্থসামাজিক এই দূর্ঘটনার পরিপূরকে বাংলা সাহিত্যেও দেখা দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতা, বিজ্ঞানমনস্কহীনতা, ভাববাদিতা। ঘুরে ফিরে বাংলা সাহিত্যের বহু বিখ্যাতজনেরা পৌরণিক ও পৌরণিক বহির্ভূত উভয় প্রকারের স্বদেশী সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক ফরমায়েশী সংস্কৃতিভিত্তিক সাহিত্য রচনা করেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের সংস্কৃতিতে অভ্যাস্ত মোহগ্রস্থ্য শাসিত ও শোসিত জনসাধারনের হৃদয় মননে সহজে ও সস্তায় ঠাঁই পাওয়ার লোভে রবীন্দ্র নজরুলের সমাজদ্রোহিতার মত শুভকর্মের পাশাপাশি এমন প্রতিক্রিয়াশীলতায় সংক্রমিত হতে দেখা যায় এবং এই প্রতিক্রিয়াশীলতার কারনেই বর্তমান কর্পোরেট পুঁজির যুগে রবীন্দ্র নজরুলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের কালের প্রগতির আলোয় উদ্ভাসিত বর্ণিল উম্মদনায় বাংলা সাহিত্যে প্রগতিশীলতার দীপ্তপথ তৈরী করেছেন এবং এই প্রগতিশীলতার দ্বার ঊম্মোচন করতে তিনি বাংলা শব্দভান্ডার বৃদ্ধির পাশাপাশি অমিতাক্ষর ছন্দ তৈরী করে বাংলা সাহিত্যে ছন্দবিপ্লব ঘটিয়েছেন। স্বভাষী স্বদেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিদেশী বিভাষী প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন ও আক্রমন থেকে মুক্ত করার জন্য স্বদেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্য সংস্কৃতিকেই জাতীয় মুক্তির সোপান বলে চিহ্নিত করেছেন যে সাহিত্যিকেরা তারা জাতিকে বিভ্রান্ত করে প্রতিক্রিয়াশীলতার পংকিল আবর্তে ডুবিয়ে দিয়েছেন; বাংলা সাহিত্যের এমন প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিকদের অন্যতম হচ্ছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

শোষণ লুন্ঠন তীব্র ও তরান্বিত করার প্রয়াসে বৃটিশ শাসক বাংলা তথা ভারতবর্ষে রেল লাইন স্থাপন করেছিল, ঠিক একই কারনে অর্থাৎ শোষণ লুন্ঠন তীব্র থেকে তীব্রতর করার প্রয়াসেই ইংরেজরাই ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করে বৃটিশ অনুগ্রহজীবি শিক্ষিত কেরানী তৈরীর প্রকল্প হাতে নেন এবং এই কলেজ থেকেই উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে রাম রাম বসু, গোলকনাথ শর্মা, মৃত্যজ্ঞয় বিদ্যালঙ্কার, তারিনীচরণ মিত্র, রাজিবলোচন মুখোপাধ্যায়, চন্ডীচরণ মুনসী, হরপ্রসাদ রায় বাংলা গদ্য রচনার শুভ সূচনা করেন। সাহিত্যে সামন্ত শ্রেনীর জীবন উপাদান সংবলিত প্রতিবেশে ঔপনিবেশিক শিল্পপুঁজির বিকাশের লক্ষ্যে তৎকালীন বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষের সকল মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মের এক ছাতার নীচে এনে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মের পরিবর্তে শুধুমাত্র খ্রীষ্ট ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সামন্ত ঐক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কেরির নেতৃতে বাংলা সামন্ত সাহিত্যের বিস্তৃতি ঘটানোর উদ্দ্যেগ গ্রহন করেন, যাতে সকল স্তরের মানুষের কাছে সহজেই পৌছানো যায়। ত’র্কী মুসলমানদের ভারত বিজয়ের ফলে সহনপটু ও গ্রহনপটু ভারতবাসী প্রতিরোধের ও আপোষের সাহিত্য রচনা করেন, এই প্রতিরোধ ও আপোষের মাধ্যমে প্রায় দুই তৃতীয়াংশরেও বেশী ভারতবাসীকে মুসলমান হওয়া থেকে বিরত রাখতে সমর্থ হয়, পরবর্তীতে ১৯৪৭ ভারত ও পাকিস্তান রাষ্টের অভ’দ্ধয়ে দুই রাষ্টের ভৌগলিক সীমারেখায় তার সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষনীয়। এখানে উল্লেখ্য যে মুসলমানগণ যে দেশগুলোই জয় করেছেন তার অধিকাংশ দেশের প্রায় সবাইকে ধর্মান্তরিত করে মুসলমানে রূপান্তরিত করেছেন, শুধু ভারতই এর ব্যতিক্রম। মোগল ও নবাবী আমলে আরবী ফারসী উর্দু ভাষা শাসকের ভাষায় আসীন হওয়ার কারনে বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী উর্দু ঢুকে গিয়ে বিকৃতির বিপদজনক পর্যায়ে নিমজ্জিত হয়, এই বিপদজনক পথে নজরুলও হেটেছেন অবিভক্ত ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের সস্তা জনপ্রিয়তা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরীর প্রয়াসে। ১৯৪৭ এর পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মহম্মদ আলী জিন্নাহর বাংলাকে মুছে ফেলে উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ হুঙ্কারের পরে কবি গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে ঐ বিপদজনক পদ্ধতি অনুসরনে পাকিস্তানী মার্কা বাংলা সাহিত্য তৈরীর মহাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয় কিন্তু সেই মহাপ্রকল্পের ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্ধয়ের মাধ্যমে কবর রচিত হয়। পরিতাপের বিষয স্বাধীনতার ৪০ বৎসর পরেও কবর থেকে প্রেতাত্মা এসে পাকিস্তানী মার্কা বাংলা সাহিত্যের প্রকল্প প্রকরণ তৈরী করতে সচেষ্ট। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী সামন্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে বুর্জোয়া মানবতাবাদী বিবর্তনের ধারাবাহিকতার অভিমুখে সাহিত্যকে প্রগতিশীল ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবুজাফর, আহসান হাবিব, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক, আব্দুল গনি হাজারী, আশরাফ সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী প্রমূখ। স্বদেশী ও বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যের দখলদারিত্বের কারনে উনবিংশ শতাব্দীতে অর্থাৎ আধুনিক যুগে এসেও বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগ অতিক্রম করলেও আধুনিক হতে পারলো না, মধ্যযুগের ভাব চেতনায় আধুনিক যুগের নান্দনিকতা ও শিল্প আরোপ করা হলো। আধুনিক কালের বাসে ইজ্ঞিনের পরিবর্তে ঘোড়া লাগিয়ে টেনে নিয়ে যেতে বলা হলো। বিংশ শতাব্দীতে কল্লোল যুগে বা তিরিশের কবিদের মেধার বিশলতা ও প্রগতিশীলতার উৎকর্ষতা থাকলেও তারা বাসের সংগে লাগালেন বিমানের ইজ্ঞিন অর্থাৎ স্বদেশের ত’লনায় অত্যাধূনিক। সমকালের পথে হেটে হেটে আগামীর পথে উঠতে হয় এই বাস্তব বিবর্জিত সাহিত্য যতই উন্নত ও প্রগতিশীল হোক না কেন তা হয় গণবিচ্ছিন্ন এবং সমাজবিচ্ছিন্ন কারন সাহিত্যিক ও অশিক্ষিত কুশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাঠকের সুবিস্তর ব্যবধান আর্থসামাজিক তথা আর্থরাজনৈতিক গতি প্রগতিতে বিভেদ বাড়িয়ে দেয়। লেখক পাঠকের এই ব্যবধানের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরো বেশী করে জেঁকে বসে। সমর সেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য্য,সত্যেন সেন প্রমূখ সাহিত্যিক ঔপনিবেশিক সমাজের ভন্ডামীর মুখোশ উম্মোচন করে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে গণমানসে সাম্যবাদী আকাঙ্খার নান্দনিক উম্মাদনার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টার সাথে তৎকালীন আর্থরাজিৈতক বিবর্তনীয় অবস্থান ছিল অসংগতিপূর্ন, সাম্যবাদী দলগুলোর সা¤্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের বিরোধীতায়ও ছিল বিভ্রান্তি । সনাতন পল্লীসমাজ ভাঙলেও ঔপনিবেশিক, নয়া ঔপনিবেশিক বা একচেটিয়া পুঁজিবাদী বিশ্বায়নজনিত সামন্ততান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কারনে নাগরিক মানসিকতার ঊম্মেষ ঘটেনি, কাজেই নাগরিক যন্ত্রনা বোধের সাহিত্য প্রগতিশীল গুনে গুনান্বিত হওয়া সত্বেও অধিকাংশ মানুষের হৃদয় আলোড়িত ও আন্দোলিত করতে পারেনি, সে কারনেই বাংলার মানুষ প্রগতির সিঁড়িতে এখনও পা রাখতে পারছে না। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতায় এরকমের সমস্যা আজও প্রবাহমান। এই সমস্যা অতিক্রম করতে হলে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা গবেষনা অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা প্রগতিশীল আর্থরাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবহনে উঠতে না পারার কারনে এ দেশে প্রগতির ক্ষমতায়ন সম্ভব হয়নি। প্রগতির ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল সাহিত্যের সাথে প্রগতিশীল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের যুগপৎ অবিচ্ছেদ্দ্য অব্যহত ধারায় বীরদর্পে এগিয়ে যাওয়া।

তথ্যসূত্রঃ
লাল নীল দীপাবলী – ডঃ হুমায়ূন আজাদ
বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা – গোপাল হালদার
বাংলা সাহিত্যে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারা – ডঃ আহমদ শরীফ
বিশ্ব সভ্যতা – এ কে এম শাহনাওয়াজ
পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা – সাঈদ-উর রহমান