স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম ‘স্ববিরোধী বিবেকানন্দ’ নামে, আমার এতোদিনকার বিবেকানন্দ-পঠনের একটা সামগ্রিক রূপকে  সন্নিবদ্ধ করে।  মূলতঃ স্তবের আলো থেকে সরে এসে নির্মোহ ভাবে বিবেকানন্দকে দেখবার প্রচেষ্টা ছিলো তাতে।  ভক্তগণের নিরন্তর স্তব-স্তুতির মাধ্যমে  বিবেকানন্দকে ঘিরে এতদিন যে স্বর্গীয় জ্যোতির্বলয় তৈরি করা হয়েছিল,  সেই বলয় থেকে বিবেকানন্দকে বের করে নিয়ে এসে মানুষ হিসেবে তুলে ধরাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো আমার। বিবেকানন্দের ভাল ভাল বানী কিংবা কাজের ব্যাপারগুলো আমাদের কারোরই অজানা নয়, সেগুলো মেনে নিয়েও তাই আমি তার বিভিন্ন লেখায় কিংবা কাজে যে স্ববিরোধিতার  পরিচয় পেয়েছি,  সেটুকু সততার সাথে এবং যথাসম্ভব নির্মোহ ভাবে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছি। সেজন্যই তার ভোগ বিলাস,  মা এবং পরিবারের প্রতি অন্ধ অনুরাগ, ক্ষমতার মোহ, উচ্চাশা, স্বজাত্য-বোধ, হিন্দু জাতির প্রতি উদগ্র মোহ, নারীদের প্রতি সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি সহ অনেক ব্যাপার স্যাপারই উঠে এসেছে লেখাটিতে।   অধিকাংশ লেখকই লেখাটির প্রশংসা করেছেন। কিন্তু দুই একজন পাঠক দ্বিমত করেছেন, আমার এ লেখাটি তাঁদের যুক্তিগুলোকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়াস।

বিবেকানন্দ খুবই আলোচিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার অনুরাগী এবং স্তাবকও ভূ-ভারতে অজস্র। তার মূর্তিভাঙ্গা কোন সহজ কাজ নয়! তাই আমার লেখাটা নিয়ে আমি একটু সংশয়েই ছিলাম। ভেবেছিলাম বিবেকানন্দ-ভক্তদের কাছ থেকে তার চেয়েও জোরালো কোন লেখা বা প্রতিবাদ এসে আমার লেখাটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তা হয়নি।  ইরতিশাদ ভাই (ড. ইরতিশাদ আহমদ)  লেখাটির মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘বিবেকানন্দ-ভক্তদের কাছ থেকে কিছু শুনতে পারলে ভাল হতো’।  আমিও ভক্তদের কাছ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশী ছিলাম। কিন্তু ভক্তদের কাছ থেকে যৌক্তিক  সমালোচনার বদলে যে হাঁটু-কাঁপানো  প্রত্যুত্তর (knee jerk reaction) –এর স্বাদ পেলাম তাতে বুঝলাম সঠিক জায়গাতেই আঘাত করা হয়েছে। স্বামীজির-ভক্তদের শ্রীহীন থলিতে যুক্তির সংকট দেখে আরো বুঝলাম, আমার লেখাটির মুল পয়েন্টগুলো  খণ্ডন করার চেয়ে অহেতুক চ্যাঁচামেচি আর সারবত্তাহীন উক্তি করারতেই তারা পারদর্শী বেশি। যেমন,  হিমাদ্রী শেখর দত্ত নামের এক বিবেকানন্দ-ভক্ত এসে লেখাটিতে মন্তব্য করেছেন

আপনি কি ধরনের মানসিকতায় বিরাজ করেন তার একটা সুচারু আবহাওয়া পেয়ে গেলাম। আপনার বিরুদ্ধে আমার কোন মন্তব্য নেই একমাত্র ‘ছিঃ’ শব্দটুকু ছাড়া। আশা করি আপনার নিজের অর্জিত জ্ঞানের আলোকে আপনার ভবিষ্যত পথ উজ্জ্বল হবে। … আর নামের আগে পিছে কিছু নেই,নাকি এই লেখা লেখার সময় ভয় পেয়েছেন ?

এ ধরনের মন্তব্যের কি জবাব হতে পারে তা বুঝতে আমি অক্ষম। আমি বিবেকানন্দকে নিয়ে আমার লেখায় যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছি, যে অভিযোগগুলো  করেছি, সেগুলো  খণ্ডন না করে ‘আপনি কি ধরনের মানসিকতায় বিরাজ করেন’ কিংবা ‘কোন মন্তব্য নেই একমাত্র ‘ছিঃ’ শব্দটুকু ছাড়া’ – এগুলো আদপেই কি কোন জবাব হল? আমার লেখাটি নিয়ে মন্তব্য না করে আমার  ‘নামের আগে পিছে কিছু নেই’ কেন, সেটা নিয়েই তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফরিদ ভাই (ফরিদ আহমেদ) অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করেছেন, ‘নামের আগে কিছু নেই, তবে পিছনে রায় ছিল। আপনার মত জঙ্গি হিন্দুত্ব-বাদীর ভয়ে সেটা হায় হায় করে পালিয়েছে।’

শেষাদ্রী শেখর বাগচী নামের আরেক ভদ্রলোক (যিনি  হিমাদ্রী শেখর দত্তের ‘অল্টার ইগো’ হলেও আশ্চর্য হব না)  রামকৃষ্ণকে মানসিক বিকারগ্রস্ত বলায়  দারুণ গোস্বা করেছেন।  সমালোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে আমাকেই উলটো মানসিক-রোগী বানিয়ে দিয়ে গেছেন।  কিছু করার নেই, রামকৃষ্ণের অসুস্থ ধ্যান ধারণাকে অসুস্থই তো বলতে হবে। যিনি মা কালির সাথে এক্কা দোক্কা খেলেন, নিজের স্ত্রীকেও মা বলে ডাকেন, যিনি স্বামী স্ত্রীকে ভাই বোনের মত থাকতে পরামর্শ দেন, বলেন যে, ‘মেয়ে মানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাঁদের হাওয়া গায় লাগে’ তাকে শেষাদ্রী শেখর বাগচীর খুব  সুস্থ মনে  হচ্ছে।  আর তার সমালোচনাকারীদের মনে হচ্ছে অসুস্থ!  রামকৃষ্ণ শুধু মা-কালির সাথে এক্কা দোক্কাই খেলেনি, ফুল চন্দন সাজিয়ে ফষ্টি-নষ্টিও করেছে এই আপ্রাণভাবে কামদমনকারী বিকৃতকামী এই লোকটা। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বই থেকে তুলে  দিয়েছেন ফরিদ আহমেদ তার মন্তব্যে

কোনো দিন বা মন্দিরে মাকে শয়ন দিচ্ছে, হঠাৎ শূন্যরূপকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল গদাধর: আমাকে তোর কাছে শুতে বলছিস? আচ্ছা, শুচ্ছি তোর বুকের কাছে। মার সর্ব অঙ্গে বাতসল্য, দু চোখে স্নেহসিঞ্চিত লাবনী। হাত-পা গুটিয়ে ছোট্টটি হয়ে মার রূপোর খাটে শুয়ে পরল গদাধর। নীল নিবিড় মেঘমণ্ডলের কোলে ক্ষীণ শশিকলা। (পরমপুরুষ শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)

আমি আমার লেখায় দেখিয়েছি যে, রামকৃষ্ণের স্বাভাবিক যৌন-জীবন সম্বন্ধে কোন পরিষ্কার ধারনাই ছিলো না। তিনি ভাবতেন ‘বীর্যপাতে বলক্ষয় হয়’ (শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ৩১৪) , এবং ভাবতেন ‘ঈশ্বরকে পেতে বীর্য ধারন করতে হয়’ (প্রগুক্ত, পৃঃ ৩১৪)। রামকৃষ্ণের যৌন-ভীতি আসলে তার যৌন-বিকারেরই ফল। ঈশ্বর-লাভের সংস্কার থেকে আসা কামজয়ের প্রবল ইচ্ছা এবং একই সঙ্গে বিবাহিত স্ত্রীর সাথে সঙ্গ-লিপ্সা একত্রে তার মনে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল, সেই দ্বন্দ্ব থেকেই মানসিক-বিকারগ্রস্থতার জন্ম নিয়েছিল, সূচিত হয়েছিল শারীরিক অক্ষমতাও। সেজন্যই নিজের স্ত্রীর অঙ্গ স্পর্শ করামাত্রই তার মন কুণ্ঠিত হয়েছিল, তাই ‘সহসা সমাধি-পথে এমন বিলীন হইয়া গেল’। এটা বুঝতে পাঠকদের অসুবিধা না হলেও বাগচী মহাশয়ের দারুণ সমস্যা।

রামকৃষ্ণের অনেক কিছুই যে ছোটবেলা থেকেই স্বাভাবিক ছিল না, সেটা তার অনেক উক্তিতেই মেলে। বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন ঘটনায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। সে সময় তিনি গ্রামের পুকুরে মেয়েদের ঘাটে নেমে স্নান করতে চাইতেন। গ্রামের মেয়েরা তার মার কাছে নালিশ জানালে মা তাকে বকাবকিও করেন। মেয়েদের ঘাটে নামা ছাড়াও তিনি আড়াল থেকে স্নানরতা নগ্ন মেয়েদের দিকে আড়ালে আবডালে উঁকি দিতে শুরু করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। যৌন-সুড়সুড়ি পাওয়ার আশায় গোপনে যৌনাঙ্গ দেখার অভিলাষ এবং অভ্যাসকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ভোয়ুরিজম বা স্কোপোফিলিয়া’। এটা এক ধরণের  মানসিকবিকারগ্রস্ততাই।

এ ধরণের আরো উদাহরণই দেয়া যায়।  মেয়েদের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ঢাকতে তিনি একসময় মেয়েদের কাপড় গয়না পরা শুরু করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এতে জিতেন্দ্রিয় হওয়া যাবে। দেখুন তার কথাতেই – ‘জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় কেমন করে? আপনাতে মেয়ের ভাব আরোপ করতে হয়। আমি অনেকদিন সখীভাবে ছিলাম। মেয়েমানুষের কাপড়, গয়না পরতুম, ওড়না গায়ে দিতুম’ (শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, অখণ্ড সংস্করণ, পৃঃ ১৫০)। এগুলো কি সুস্থ স্বাভাবিক পরিচয়? অন্ততঃ এক্ষেত্রে আমি বিবেকানন্দকে আমি ক্রেডিট দিব তিনি বিয়েই করেননি, কিন্তু বিয়ে করে অনর্থক স্ত্রীকে মা ডাকা, কখনো স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করে কামরিপু নষ্ট করার চেষ্টা কোন স্বাভাবিক কার্যকলাপ নয়।

তারপরেও বাগচী মহাশয়ের স্থির ধারণা, রামকৃষ্ণ নন, মানসিক রোগী নাকি আমি নিজে!   আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি যে, হ্যাঁ আমি মানসিক রোগী কেননা আমি আমি তো রামকৃষ্ণের মতো  পারি না মা কালির সাথে এক্কা দোক্কা খেলতে, নেংটু পুটু হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে, লুকিয়ে লুকিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে স্নানরত নগ্ন মেয়েদের যৌনাঙ্গ দেখতে, কিংবা মন্দিরে মা কালির বুকের উপর চরে বসে কামকেলি করতে (তিনি যে উপরের সবগুলোই করতেন তার রেফারেন্স আমার লেখায় আছে)।   জীবনানন্দ দাস কী আর সাধে বলেছিলেন, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা!

এই দুইজনের বাইরে সুমন চৌধুরী নামে আরেক ভদ্রলোক আমার লেখাটির একটি সমালোচনা করেছেন, এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিযোগ করেছেন। তিনি তার ব্লগে এনিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ লেখাও লিখেছেন ইংরেজিতে। লেখাটি দেখা যাবে এখানে

সুমন চৌধুরী আমার লেখাটি সম্বন্ধে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সারমর্ম হল –

১) আমি বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি হিসেবে যে উদ্ধৃতি গুলো ব্যবহার করেছি সেগুলো নাকি বিবেকানন্দের ইংরেজি রচনাবলীতে নেই।

২)  আমি বিবেকানন্দের জীব-প্রেম, নারী ভাবনা, বিধবা-বিয়ে বিরোধিতা এবং বাল্য বিবাহ আর সহমরণ সমর্থনে যে উদ্ধৃতি আর ব্যাখ্যা হাজির করেছি তা ভুল।

৩)  ব্রিটিশ বিরোধিতা নিয়ে আমার ব্যাখ্যা আর উদ্ধৃতি সঠিক নয়।

৪) বিবেকানন্দের ভোগবিলাস প্রভৃতি নিয়ে আমি যে মন্তব্য করেছই সেটাও নাকি ভুল।

৫) মুক্তমনা নাকি তার মন্তব্য ডিলিট করে দিয়েছে।

আমার আজকের লেখাটি মূলত চৌধুরী সাহেবের  অভিযোগগুলোর প্রত্যুত্তর। দেখা যাক আমার লেখাটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে কিনা, আর সুমন  চৌধুরীর অভিযোগগুলো আদপেই সত্য কিনা।

একটা কথা বলে আমি শুরু করি। আমি বিবেকানন্দের উপরে যে লেখাটি লিখেছিলাম তার জন্য নির্ভর করেছিলাম স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা (উদ্বোধন কার্যালয়),  পত্রাবলী (উদ্বোধন) সহ বাংলায় প্রকাশিত বিবেকানন্দের রচনার উপর। পাশাপাশি নিবেদিতার লেখা ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ প্রভৃতি বইগুলোর সাহায্য নিয়েছি  উদ্ধৃতিগুলোর ক্রসচেক করা জন্য।  এছাড়া বিবেকানন্দের বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী উক্তি আর কাজ নিয়ে ১৯৯৪ সালে ভারতের দৈনিক আজকাল পত্রিকায় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত তুমুল বিতর্ক হয়েছিল, সেখানে বিবেকানন্দের বাংলা রচনাবলী থেকে যে উদ্ধৃতিগুলো সমালোচকরা ব্যবহার করেছিলেন কেউই বলেননি যে সেগুলো বিবেকানন্দের বক্তব্য নয়। কাজেই উদ্ধৃতিগুলো নিয়ে কোন সংশয় আমার ছিলো না। আর আমার লেখাটি যেহেতু ছিলো বাংলায়, তাই অনলাইনে ইংরেজীতে যে বিবেকানন্দ রচনাবলী পাওয়া যায় (Complete Works of Swami Vivekananda)  সেটা আমি দেখার সময় পাইনি এবং ততটা প্রয়োজনও বোধ করিনি।

আমার লেখাটা যে  বিবেকানন্দের Complete Works of Swami Vivekananda (ইংরেজি) ভার্শনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়নি সেটা উনাকে আমি ফেসবুকে বলেছিলাম। এ নিয়ে ফেসবুকেই ভদ্রলোকের সাথে  দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। সেটা উনিও ভাল জানেন। আমি বলেছিলাম, আমার লেখায় বিবেকানন্দের যে উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করেছি সেগুলোর প্রকাশনীর নাম পৃষ্ঠা-নম্বর সবই দেয়া হয়েছে। উনাকে মিলিয়ে দেখবার অনুরোধ করেছিলাম। উনি দেখেননি, তা না করে ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে বিতর্ক করতে বলেছেন আমাকে।  তখন আমি বলেছিলাম যে, ‘ ইংরেজি অনুবাদের কোথায় কি আছে সেটা আমি জানি না, এমনকি সেই অনুবাদ কতটা নির্ভরযোগ্য সেটাও নিশ্চিত নই। যেমন আপনাকে আমি বলেছিলাম ‘জীব-প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’ সেটার ইংরেজি ট্র্যান্সলেশন আপনার দেওয়া পিডিএফ থেকে দেখাতে, কিন্তু আপনি সেটা না দেখিয়ে ব্লগপোস্টের লিঙ্ক দিয়েছেন। আপনার ইংরেজি অনুবাদে যদি ‘জীবপ্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’ না থাকে তবে কি ধরে নেব যে, বিবেকানন্দ সে কথা বলেননি?’

কিন্তু উনি আমার দেওয়া বাংলা বইয়ের রেফারেন্সগুলো সঠিক না ভুল তা যাচাই না করে উলটো আমাকেই মিথ্যাবাদী, জোচ্চোর প্রভৃতি সম্ভাষণে ভূষিত করেছেন।  বলেছেন,

Mr. Avijit roy has not read a single page from ‘complete works of Swami Vivekananda’ and tried to analyze vivekananda.

আরো বলেছেন,

If you see all the volumes like that you will be astonished how he misquoted, faked and lied. The final point is that, the English version is the original version and the Bengali version is the translation of that English version. If anyone wants to check in Bengali Version, please buy a copy from your nearest Ramakrishna Mission or Vedantic Society at Bengal. Even, you will be astonished to know how Avijit misquoted and mis-justified Vivekananda’s great works.

অর্থাৎ, সুমন চৌধুরী বলছেন ইংরেজি ভার্শনে উদ্ধৃতিগুলো  তো নেই-ই, এমনকি  রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ‘বাংলা ভার্শন’ চেক করার পরামর্শ দিয়েছেন, বলেছেন সেগুলোও নাকি আমি ‘মিস কোট’ করেছি।  উনি রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিবেকানন্দের রচনাবলী কেনার পরামর্শ দিয়েছেন অথচ উনি জানেন না যে, আমি ঠিক তাই করেছি, যেটা উনি দাবী করেছেন।   রামকৃষ্ণ মিশনের বাংলা মাসিক মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকা তথা মিশনের বাংলা প্রকাশনা উদ্বোধন কার্যালয়ের প্রধান অফিস। বাংলা বিবেকানন্দ রচনাবলী- মানে ‘বানী ও রচনা’ কিংবা পত্রাবলী –  তাঁদের কার্যালয় থেকেই প্রকাশিত।  সুমন চৌধুরী বলেই খালাস যে, আমি নাকি মিসকোট করেছি, কিন্তু একটি দৃষ্টান্তও হাজির করেননি। উপরন্তু আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করছি যে, আমার উদ্ধৃতিগুলো শুধু রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্রকাশিত বিবেকানন্দ রচনাবলীতেই কেবল নেই, সেগুলো আরো অনেক বইয়েই পাওয়া যাবে। যেমন – ‘বিবেকানন্দ : অন্য চোখে’ (উৎস মানুষ সংকলন) বইটি কিংবা রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ : মুক্তমনের আলোয়’ (র‍্যাডিকাল প্রকাশনী, কলকাতা), ভারতীয় নারী (উদ্বোধন), বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ (শঙ্করীপ্রসাদ বসু), বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ (গোলাম আহমাদ মোর্তজা), শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির ঘটনাবলী (মহেন্দ্রনাথ দত্ত) প্রভৃতি। উদ্ধৃতিগুলো যে বিবেকানন্দেরই সেটাতে কোনই সন্দেহ নেই। আমি স্বামী বিবেকানন্দ  রচনাবলী থেকে ছাড়া ছাড়া অজস্র স্ক্যান্ড পৃষ্ঠা হাজির না করে (কেউ যদি চান সেটাও দেয়া যাবে), আমি রাজেশ দত্ত সম্পাদিত ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ :  মুক্তমনের আলোয়’ বইটি থেকে একটি স্ক্যাণ্ড পৃষ্ঠা জাহির করছি পাঠকদের জন্য, পাঠকেরা দেখবেন, আমি যেভাবে উদ্ধৃতিগুলো আমার প্রবন্ধে ব্যবহার করেছি, সেই স্ববিরোধী উদ্ধৃতিগুলোর অনেকগুলো সেখানেও আছে ঠিক একই ভাবে –

এই উদ্ধৃতিগুলো এভাবেই  ভারতের বইপত্রে, পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, এবং এখনো হচ্ছে। কাজেই আমি কোন উদ্ধৃতি বিকৃত করিনি এটাতে আমি নিশ্চিত। এতো গেল বাংলায় উদ্ধৃতি ব্যবহারের কথা। আমরা আজ দেখব ইংরেজি ভার্শন নিয়েই সুমন চৌধুরীর অভিযোগগুলো ধোপে টেকে কিনা। উনি যে বলছেন বিবেকানন্দের উদ্ধৃতিগুলো সেখানে নেই, আসুন আমরা দেখি এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু। আমি আগেই বলেছিলাম, আমি যখন আমার মূল লেখাটি লিখেছিলাম, তখন ইংরেজি ভার্শন দেখার সময় পাইনি। আজ সপ্তাহান্তে একটু অবসর  মিলায়  ইংরেজি রচনাবলী নিয়ে বসলাম। ইংরেজি রচনাবলী অনলাইনে পাওয়া যাবে  এখানে। তবে সুমন চৌধুরী সাহেব holybooks.com  নামের একটি সাইটে নয় পর্বে পিডিএফ করে রাখা লিঙ্কগুলো সম্ভবতঃ বেশি পছন্দ করেন (তার লেখায় লিঙ্কগুলো তিনি দিয়ে রেখেছিলেন), আমি সেগুলোও দিয়ে দিচ্ছি –

Complete Works of Swami Vivekananda (holybooks.com  ) ১ম পর্ব,  ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব, ৫ম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, ৭ম পর্ব, ৮ম পর্ব , ৯ম পর্ব

আমি আমার লেখায় দেওয়া উদ্ধৃতিগুলো ধরে ধরে এগুবো, আর ইংরেজি রচনাবলীতে কি আছে সেটা খুঁজে দেখব। পাঠকেরা চাইলে মিলিয়ে দেখতে পারবেন, আমি সত্য বলছি নাকি মিথ্যা।

প্রথমেই শুরু করা যাক, বিবেকানন্দের ‘গ্রন্থপ্রিয়তা’ নিয়ে অসামান্য উদ্ধৃতিগুলোর কথা। এই উদ্ধৃতিগুলো আমার এতোই প্রিয় যে, এগুলো দিয়েই অনুসন্ধান করলাম প্রথমে।

আমি বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি হিসেবে লিখেছিলাম,

বই পড়িয়া আমরা তোতাপাখি হই, বই পড়িয়া কেহ পণ্ডিত হয় না

উদ্ধৃতিটি রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, ৮৫ নং পৃষ্ঠায়।

কি মনে হয় পাঠক, আমি উক্তিটি বিকৃত করেছি নাকি বানিয়ে বলেছি? না প্রিয় পাঠক কোনটাই নয়।  ইংরেজি ভার্শনের চতুর্থ খণ্ডের (উপরে দেয়া লিঙ্কের)  পিডিএফ খুলে সেই ফাইল ধরে ১৭ নং পৃষ্ঠায় যান , দেখবেন লেখা আছে –

By reading books we become parrots; no one becomes learned by reading books. (vol 4, page 17)

হয়তো ভাবতে পারেন, আমি বানিয়ে লিখেছি, তাই ইংরেজি স্ক্যানও  এখানে দিয়ে দিলাম –

কেউ যদি বলেন, By reading books we become parrots; এর বাংলা হবে টিয়া পাখি, তোতাপাখি নয়, তবে এই অর্থহীন বিতর্কে আমি যাব না।  কিন্তু টিয়া হোক, তোতা হোক, উক্তির সারবত্তা খুব পরিষ্কার। বই কোন কাজে আসে না ।

গ্রন্থ নিয়ে আরো যে উদ্ধৃতিগুলো আমি ব্যবহার করেছি এর সবগুলোই আছে ইংরেজি রচনাবলীতে (আমার পক্ষে পাতা পাতা ধরে স্ক্যান কপি দেয়া সম্ভব নয়। কেউ চাইলে পিডিএফ ফাইল খুলে মিলিয়ে দেখতে পারেন)।  যেমন,

To be religious, you have first to throw books overboard. The less you read of books, the better for you (page 30)

আমার দেওয়া বাংলা উদ্ধৃতি ছিলো –

ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থাদি ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন ততই ভাল

কিংবা –

… books have produced more evil than good. They are accountable for many mischievous doctrines. Creeds all come from books, and books are alone responsible for the persecution and fanaticism in the world (page 38)

আমার লেখায় দেওয়া বাংলা উদ্ধৃতি –

গ্রন্থ দ্বারা জগতে ভাল অপেক্ষা মন্দ অধিক হইয়াছে। এই যে নানা ক্ষতিকর মতবাদ দেখা যায়, সেগুলোর জন্য এই সকল গ্রন্থই দায়ী

পাঠকেরা কি উদ্বোধনের অনুবাদের কোন সমস্যা পাচ্ছেন? আপনারা না পেলেও সুমন চৌধুরী পাবেন নিঃসন্দেহে। বলবেন আমি  ‘মিস কোট’ করেছি, নয়ত বিকৃতভাবে উত্থাপন করেছি।

আরো কিছু উদ্ধৃতি দেখি।

স্বামীজির  অমিতব্যয়িতার দৃষ্টান্ত স্বরূপ আমি ব্যবহার করেছিলাম , আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠির খণ্ডিতাংশ , যেখানে তিনি আলাসিঙ্গাকে আদেশ করেছেন মাদ্রাজে তার জন্য একটি বাড়ি বানাতে । উক্তিটি পাওয়া যাবে  ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডের ৭৬ পৃষ্ঠায়-

Where shall I come to if you cannot make a home for me in Madras? ( vol 5, page 76)

আমার লেখায় দেওয়া বাংলা উদ্ধৃতি –

কিছু একটা করে দেখাও। মাদ্রাজে আমার জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করতে না পার তো আমি থাকবো কোথায়?

 

অনুবাদে কোন সমস্যা?  আপনারা না পেলেও সুমন পাবেন।

উনি যে আমেরিকায় গিয়ে ১৩ ডলার দিয়ে একটা মীরশ্যাম পাইপ কিনেছিলেন, আর সেটা আবার ফাদারকে বলতে নিষেধ করেছিলেন সেটাও আছে ইংরেজি রচনাবলীর ৭ম খণ্ডের ২৬৩ পৃষ্ঠায়-

Volume 7:

DEAR SISTER (Miss Isabelle McKindley.),…

Yesterday I bought a pipe for $13 — meerschaum do not tell it to father Pope. The coat will cost $30. I am all right getting food . . . and money enough. Hope very soon to put something in the bank after the coming lecture. (NEW YORK, 2nd [actually 1st] May, 1894. (vol 7, Page 263)

একই অর্থাৎ ৭ম ভলিয়ুমের ৩০১ পৃষ্ঠায় আছে –

But it is to Amerique — there where the heart is. I love the Yankee land (Page 301).

যার বাংলা উদ্ধৃতি হিসেবে আমি দিয়েছিলাম –

আমার হৃদয় রয়েছে আমেরিকায়। আমি ভালবাসি ইয়াঙ্কি দেশকে

এখানেও কোন ভুল নেই,  যদি না কেউ সুমন চৌধুরীর মত অন্ধ বিবেকানন্দ ভক্ত না হন।

আমার রচনায় আমি বলেছিলাম, শিকাগো মহাসভার পরের দিনগুলোতে পাশ্চাত্যের মহনীয় বিলাস ব্যসনে এতটাই আপ্লুত হয়ে যান যে, তিনি ভারতে ফিরতেও দ্বিধান্বিত ছিলেন। ১৮৯৩ সালে আলা-সিঙ্গাকে লেখেন –

ভারতে গিয়ে ফল কি? ভারত আমার আইডিয়া শক্তিশালী করতে পারবে না। আমার আইডিয়ার প্রতি এদেশের (আমেরিকার) মানুষ সহৃদয়।

ঠিক এই কথাগুলোই ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খন্ডে (পৃঃ ৯৫)  আছে  এভাবে –

What is the use of going back to India? India cannot further my ideas. This country takes kindly to my ideas (Page 95).

আমেরিকার লোকজনেরা যে তাকে গুরু হিসেবে কত সম্মান করছেন, তার সব ব্যয় নির্বাহ করেছেন,  তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন আরো অনেক জায়গাতেই, যেমন, ইংরেজি রচনাবলীর ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে –

American nation loves and respects me, pays my expenses, and reveres me as a Guru (vol 6, page 267)

এখানেও পাঠকেরা লক্ষ্য করেছেন – ‘যাহা লাউ তাহা কদুই’।

এবারে দেখা যাক বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে কি বলেছেন। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে স্পষ্ট উক্তি পাওয়া যাবে ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডের ৩৫০ পৃষ্ঠাতে –

It is owing to caste that three hundred millions of people can find a piece of bread to eat yet (vol 5, Page 350).

বাংলা উদ্ধৃতি হিসেবে আমি দিয়েছিলাম –

জাতিভেদ আছে বলেই ত্রিশ কোটি মানুষ এখনো খাবার জন্য এক টুকরো রুটি পাচ্ছে

কাজেই ইংরেজি রচনাবলীতে নাই, মিস কোট করা হয়েছে কিংবা বিকৃতি ঘটেছে সেটা পাগলেও বলবেন না, অথচ সুমন চৌধুরী বলছেন।

তার পর  আরো সামনে এগোই। জাতিপ্রথায় উচ্চতা অর্থ দ্বারা নিরূপিত হয় না কিংবা জাতির মধ্যে প্রত্যেকেই সমান – জাতিভেদের সমর্থনে যে উক্তিগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, সেই উক্তিগুলোর সমর্থনে বহু উদ্ধৃতিই ইংরেজি রচনাবলী থেকে হাজির করা যায়। যেমন, রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে একনজর চোখ  বুলিয়েই আমি পেলাম এই উক্তিগুলো –

Quality and birth make caste, not money (Vol 2, Page 397)

In caste the poorest is as good as the richest, and that is one of the most beautiful things about it (Vol 2, Page 397)

Jealousy, hatred and avariciousness are born of moneygetters.Here it is all work, hustle and bustle. Caste saves a man from all this. (Vol 2, Page 397)

Caste has kept us alive as a nation, and while it has many defects, it has many more advantages (Vol 2, page 398).

That money had nothing to do with social standing in the caste. All were equal. (Vol 2, p 424)

ব্রাহ্মন্যবাদের সমর্থনে বিবেকানন্দের পরিষ্কার উদ্ধৃতি আছে অনেকই। যেমন ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডের ২৬৫ পৃষ্ঠায় আছে –

…the Brahmin being the ideal of humanity. (vol 5, P 265)

অর্থাৎ,

ভারতে ব্রাহ্মণই মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ

ঠিক এই উক্তিটাই আমি ব্যবহার করেছিলাম আমার মূল রচনায়। আমার দুর্ভাগ্য যে, বিবেকানন্দ রচনাবলীর সুবিশাল ভাণ্ডারে জাতিভেদের সমর্থনে এত উক্তি আছে, অথচ সুমন চৌধুরী কিছুই খুঁজে পেলেন না, কেবল অভিজিৎ রায়কে গালাগালি করা ছাড়া। গালাগালি যদি করতেই হয় সুমনের উচিৎ প্রথমেই তার গুরু বিবেকানন্দকে গাল দেয়া যিনি দাবী করেছেন, ‘জাতিভেদ আছে বলেই ত্রিশ কোটি মানুষ এখনো খাবার জন্য এক টুকরো রুটি পাচ্ছে’, কিংবা বক্তৃতা দেয়ার সময় বলে বেড়াতেন, ‘ভারতে ব্রাহ্মণই মনুষ্যত্বের চরম আদর্শ’ ।

বিবেকানন্দের স্বজাত্য-বোধের মূলে ভারতীয় জাতীয়তা যত না ছিলো তার চেয়ে  ঢের বেশি ছিলো অন্ধ হিন্দুত্ব। সেজন্যই আমি আমার মূল লেখায় বলেছিলাম- বিবেকানন্দ মূলত বেদান্ত দর্শনকেই মহাসত্য মনে করতেন। তিনি সেজন্যই বলতেন, বেদান্ত কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোন ধর্মই নয়

এর সমর্থনে অনেক উক্তিই হাজির করা যাবে। যেমন, ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডের ২৬৩  পৃষ্ঠায় আছে –

The Vedanta is the rationale of all religions. Without the Vedanta every religion is superstition; with it everything becomes religion. (vol 5, page 263)

বিবেকানন্দ আরো ভাবতেন,

হিন্দু জাতি সমগ্র জগত জয় করিবে।

সুমন চৌধুরী যদি আমাকে  গালাগালি করার সময়টুকু  বিবেকানন্দ রচনাবলী পড়ার জন্য ব্যয় করতেন,  তাহলেই এই নস্ট্রাডামুসীয় ভবিষ্যদ্বাণীর সমর্থনে অসংখ্য লাইন বিবেকানন্দ রচনাবলীতে খুঁজে পেতেন । যেমন,

… the Guru-Bhakta will conquer the world — this is the one evidence of history. (vol 5, page 123)

Half the United States can be conquered in ten Years  (vol 5, Page 142)

মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি নেতিবাচক অনেক উক্তিই আছে তার রচনাবলীতে। তার কিছু কিছু আমি মূল লেখায় উল্লেখ করেছিলাম।  অবশ্যই বাংলায়। সুমন চৌধুরী  আমাকে চ্যালেঞ্জ করায় ইংরেজি রচনাবলীতেও চোখ বোলাতে হল।  আর সমুদ্রমন্থনে উঠে আসলো এইসব মনি মাণিক্য –

And then every man going out of the Hindu pale is not only a man less, but an enemy the more (vol 5, P 282)

কোন লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়। একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়

[ তথ্যসূত্র হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪  দেওয়া আছে। কিন্তু ইংরেজি ভার্শনে এটি পাওয়া যাবে ৫ম খণ্ডে, পৃষ্ঠা ২৮২]

When the lifeblood is strong and pure, no disease germ can live in that body (Vol: 3, Page 239)

পাপ দুষিত খাদ্য ও নানাবিধ অনিয়মের দ্বারা দেহ পূর্ব হইতেই যদি দুর্বল না হইয়া থাকে, তবে কোন প্রকার জীবাণু মনুষ্যদেহ আক্রমণ করিতে পারে না

When the Mohammedans first came into India, what a great number of Hindus were here; but mark, how today they have dwindled down! (Vol 5, Page 351)

এইটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিও যে, মুসলমানগণ যখন ভারতে প্রথম আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল, আজ তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে।

এই অংশটি শেষ করব বিবেকানন্দের নারী ভাবনা সংক্রান্ত উদ্ধৃতিগুলো বিশ্লেষণ করে। এগুলো নিয়েই সুমন চৌধুরী মশাই সবচেয়ে বেশি সোরগোল তুলেছেন। সুমন চৌধুরীর মতে বিবেকানন্দ কখনোই বাল্য বিবাহ ও সতীদাহের  সমর্থনে কিংবা বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে কখনো নাকি কিছু বলেননি। ইংরেজি রচনাবলীর কোথাও নাকি এধরণের কিচ্ছু নাই, সব নাকি অভিজিৎ রায়ের  উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। সত্যই কী তাই? দেখা যাক ।

আমার মুল লেখায় আমি বিবেকানন্দের কিছু বাণী উদ্ধৃত করেছিলাম, যেগুলো বিধবা বিবাহের বিপরীতে যায়।  যেমন বিবেকানন্দ বলেছিলেন,

বিধবাগনের স্বামী সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না

যথারীতি  সুমন চৌধুরী  এটি ইংরেজি রচনাবলীতে খুঁজে পাননি। কিন্তু উনি না পেলেও আমি পেয়েছি। উদ্ধৃতিটি আছে ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় –

I have yet to see a nation whose fate is determined by the number of husbands their widows get (vol 5, Page 274).

এত পরিষ্কার বাক্যে এটি লেখা থাকা সত্ত্বেও চৌধুরী সাহেবের শকুন-চোখে তা ধরা পড়লো না কেন, তা এক বিরাট রহস্য।

বিধবা বিবাহের বিরোধিতা  করে আরো অনেক স্পষ্ট উক্তিই আছে বিবেকানন্দের রচনাবলীতে। যেমন,

The question of widow marriage would not touch seventy per cent of the Indian women (vol 3, P184)

এর বাংলা হিসেবে দিয়েছিলাম –

বিধবাবিবাহ আন্দোলনে শতকরা সত্তর জন ভারতীয় নারীর কোন স্বার্থই নাই

যথারীতি সুমন চৌধুরী বিশাল বিবেকানন্দ রচনাবলীর ভাণ্ডারে পথ হারিয়ে ফেলেছেন, সেটাও খুঁজে পাননি।

আমি লিখেছিলাম, ১৯০০ সালের ১৮ই জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ায় ভারতের নারীদের নিয়ে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, যেহেতু পুরুষের চেয়ে নারীরা সংখ্যায় বেশি, সেহেতু বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হলে নাকি ‘কুমারী মেয়েদের স্বামী মিলবে না’।

আমার এই অংশটির প্রমাণ স্বরূপ উদ্ধৃত করছি ইংরেজি রচনাবলীর পঞ্চম খণ্ড থেকে –

Therefore has society put one party under disadvantage, i.e. it does not let her have a second husband, who has had one; if it did, one maid would have to go without a husband. On the other hand, widow-marriage obtains in communities having a greater number of men than women,…( vol 5, p 183)

এখানে, ভারতীয় সমাজে পুরুষের চেয়ে নারীরা যে সংখ্যায় বেশি সেটা বিবেকানন্দ তুলে ধরেছেন এই বাক্যে –‘widow-marriage obtains in communities having a greater number of men than women’ আর  বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হলে নাকি কুমারী মেয়েদের স্বামী মিলবে না সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় উপরে বর্ণিত উদ্ধৃতিটার ‘if it did, one maid would have to go without a husband’ -এই অংশেই । সহজ ভাষাতেই লেখা,  না বোঝার কোন কারণ নেই।

বিধবাদের বিয়ে যে প্রত্যাশিত নয়, সেটার প্রতিফলন আমরা ইংরেজি রচনাবলীর নবম খণ্ডের ৬৭৬ পৃষ্ঠাতেও দেখি-

A widow is not expected to ever marry again(vol 9, page 676)

‘নারীদের অধিকার সচেতন’ বিবেকানন্দ যেমন বিধবা বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে বলেছেন, একই ধারায় আবার বাল্যবিবাহ সমর্থন করে গেছেন অনেক সময়ই। যেমন, ইংরেজি রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে আছে –

The Hindus, to keep up a high standard of chastity in the race, have sanctioned child-marriage, which in the long run has degraded the race. At the same time, I cannot deny that this child-marriage makes the race more chaste. (vol2, page 89)

উদ্ধৃতিটি নিয়ে কিছু মন্তব্য করা দরকার। to keep up a high standard of chastity in the race, have sanctioned child-marriage এর বাংলা হিসেবে আমি উদ্ধৃত করেছিলাম ‘বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে’

কারো কাছে হতো মনে হতে পারে, বাক্যটিকে আমি আংশিকভাবে উদ্ধৃত করেছি। কারণ,  ‘বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে’ এর পরের বাক্যেই আছে –‘ which in the long run has degraded the race’। সেটা সঠিকই, কিন্তু সেখানেই না থেমে গিয়ে এর পরের লাইনে তাকালেই আমরা দেখি, এটাও বিবেকানন্দ বলে দিচ্ছেন –‘ I cannot deny that this child-marriage makes the race more chaste’।    অর্থাৎ, বাল্য-বিবাহ জাতিকে শুদ্ধতা বা পবিত্রতা দিয়েছে সেটা তিনি অস্বীকার করতে পারেননা।  তাহলে মূল সত্য কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো যে, পুরো প্যারাগ্রাফই আসলে বাল্যবিবাহের সাফাই, উল্টোটা নয়। কাজেই তথ্যের বিকৃতি যদি কেউ করেন, তবে সেটা সুমন চৌধুরীই, অভিজিৎ রায় নন।

বিবেকানন্দ বাল্যবিবাহের পক্ষে আরো অনেক মন্তব্যই করেছেন, যার একটি আমি পেয়েছিলাম রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘ভারতীয় নারী’ পুস্তিকায়। বিবেকানন্দ বলেছেন,

কখনো কখনো শিশু বয়সেই আমাদিগকে বিবাহ দেওয়া হয়, কেননা বর্ণের নির্দেশ। মতামতের অপেক্ষা না রাখিয়াই যদি বিবাহের ব্যবস্থা করিতে, তবে প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেয়া ভাল। যদি অল্প বয়সে বিবাহ না দিয়া ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে বাড়িতে দেয়া হয়, তবে তাহার এমন কাহারো প্রতি আসক্ত হইতে পারে, যাহাদের সহিত বিবাহ বর্ণ অনুমোদন করিবেন না। সুতরাং তাহাতে অনর্থের সৃষ্টি হইতে পারে। সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ হইলে, বালক-বালিকার ভালবাসা রূপ-গুণের উপর নির্ভর না করিয়া স্বাভাবিক হইবে

উক্তির ব্যাপারটা যে মিথ্যাচার ছিলো না,  সেটা ‘ভারতীয় নারী’ পুস্তিকাটি খুললেই সুমন চৌধুরী প্রমাণ পেতেন। আরেকটি  প্রমাণ হিসেবে আমি দৈনিক আজকাল পত্রিকায় ১৯৯৪ সালের ১০ ই এপ্রিল  প্রকাশিত  শুভঙ্কর চন্দের একটি চিঠির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেখানে পত্র-প্রেরক আমার করা উক্তিটিকেই উদ্ধৃত করেছেন একই বই থেকে –

উক্তিটির স্বপক্ষে আরো একটি প্রমাণ আছে অনলাইনে অপার্থিবের ‘An Irreverent Look at Some of India’s Most Revered Figures’ নামের লেখাটিতে।  অপার্থিব লিখেছেন,

On child marriage Vivekananda had contradictory views. He said “I hate child marriage very much” (In Bharotio Nari, published by Udbodhon Karjyaloy, p-90), while on page-15 he is quoted as saying “Sometimes children are married at early age, because that is mandated by the Varna. If one has to be married off without their opinion, they better be married in childhood before they develop any romantic feelings”

আমি যদি মিথ্যাচার করে থাকি তাহলে আমার আগে যে লেখকেরা উদ্ধৃতিটি খুঁজে পেয়েছেন সেটা কী তবে সাইঁবাবার মত ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ কোন  লাড্ডু ছিলো?

সহমরণের সমর্থনেও বিবেকানন্দের উক্তি আছে। যেমন, বিবেকানন্দ বলেছেন, ভারতীয় নারীদের কাউকেই পুড়িয়ে মারা হয় না, তারা সবাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই যে স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেন তার উল্লেখ আছে ইংরেজি বিবেকানন্দ রচনাবলীর ৬৬৮ পৃষ্ঠায়-

Widows are not burned on the funeral pyre of their husband unless it is a voluntary act of self-immolation (vol 9, page 668)

বিদ্রোহী নারী নয়, বরং পতিভক্তা সর্বংসহা সীতাই, যাকে রামচন্দ্র সতীর অনলে দগ্ধ করে কলঙ্কিত হয়েছিলেন, তাকেই বিবেকানন্দ আদর্শ নারী ভাবতেন, তার স্বপক্ষে অজস্র উদ্ধৃতি হাজির করা যায়। যেমন,

O India! Forget not that the ideal of thy womanhood is Sita, Savitri, Damayanti (Vol 4, page 395)

বাংলা –

হে ভারত ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী ও দয়মন্তি

Any attempt to modernize our women, if it tries to take our women away from that ideal of Sita, is immediately a failure, as we see every day. The women of India must grow and develop in the footprints of Sita, and that is the only way (Vol 3, Page 214).

বাংলা-

আমাদের নারীগণকে আধুনিকভাবে গড়িয়া তুলিবার যে সকল চেষ্টা হইতেছে সেইগুলির মধ্যে যদি সীতাচরিত্রের আদর্শ হইতে ভ্রষ্ট করিবার চেষ্টা থাকে, তবে সেগুলি বিফল হইবে। ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই একমাত্র উন্নতির পথ

Sita is the ideal of a woman in India … (Vol 9, Page 345)

বাংলা –

ভারতীয় নারীগণের আদর্শ চরিত্র সীতা।

আমার মনে হয় আমার আর খোঁজাখুঁজি করার প্রয়োজন নেই, এগুলোই যথেষ্ট। আমি প্রমাণ করেছি যে, আমার লেখায় যে বাংলা উদ্ধৃতিগুলো আমি ব্যবহার করেছি সেগুলোর প্রায় সবগুলোই ইংরেজি রচনাবলীতেও আছে। তাহলে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হোল, সুমন চৌধুরী কেন সেগুলো খুঁজে পেলেন না?

কারণ, সুমন চৌধুরী আসলে এক লাউসি গবেষক, বিবেকানন্দের এক অলস পাঠক নিঃসন্দেহে। উনি ইংরেজি রচনাবলীর প্রামাণিকতা নিয়ে এত হৈ হুল্লোড় করেছেন, উনার নিজেরই তো ইংরেজি রচনাবলী খুঁজে এই উদ্ধৃতিগুলো  আমাদের সামনে নিয়ে আসার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি তা না করে আমার ঘারেই তা চাপিয়েছেন আর হাজির করেছেন রকমারি ‘চ্যালেঞ্জ’, যে চ্যালেঞ্জ-এর ঘায়ে কুপোকাত হয়ে নিজেই এখন ঘায়েল হয়ে পড়ে রয়েছেন।  উনি আসলে বিবেকানন্দের করা স্ববিরোধী  কুৎসিত উক্তিগুলো খুঁজে পেতে চাননি, কেবল উটের মত বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে চেয়েছেন আর নিজের আরাধ্য দেবতার স্তব করে যেতে চেয়েছেন। মুক্তমনা ব্লগার এবং আমার অবিশ্বাসের দর্শন বইয়ের সহলেখক রায়হান আবীর একবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলো –

যারা ধর্মগ্রন্থ পড়ে তারা আস্তিক, আর যারা ধর্মগ্রন্থ বোঝে তারা নাস্তিক।

উক্তিটি বিবেকানন্দ স্তাবকদের ক্ষেত্রেও বোধ হয় সমভাবে প্রযোজ্য।

আমরা ইংরেজি এবং বাংলা রচনাবলী থেকে উদ্ধৃতিগুলোর যথার্থতা দেখলাম, এবার আসুন সুমন চৌধুরীর অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো নিয়েও নাড়াচাড়া করা যাক।

জীবপ্রেম নিয়ে:

জীবপ্রেম নিয়ে সুমন চৌধুরী  এমনই সারবত্তা-হীন বক্তব্যও দিয়েছেন যে রীতিমত লজ্জিতই হতে হয়। বিবেকানন্দ যে একমুখে ‘জীবপ্রেম করে যে জন বলেছেন’ আবার পরক্ষণেই নিজেই মঠে পশুবলি প্রচলন করেছিলেন, সেটা সুমন চৌধুরী অস্বীকার করতে পারেননি। পারবেন কী করে? এটা তো ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বিবেকানন্দের স্ববিরোধিতা খোঁজার জন্য তার রচনাবলী পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, তার বিবিধ কাজকর্মেই অতি স্পষ্ট। এই স্ববিরোধিতা ঢাকতে গিয়ে ফেসবুকে উনি  বলেছেন ‘‎’Zibe prem kore je jon – means only human not animal…’। এই অদ্ভুত ব্যাখ্যা পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেছি। কবে থেকে জীব মানে কেবল ‘মানুষ’ হল, অন্য কিছু নয়? মানুষ হলে কেবল মানুষ বললেই হত। আলাদা করে জীব বলার কিছু নেই। আমি উনাকে এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম – এমনকি ইংরেজি ট্র্যান্সলেশনেও উনি  জীবপ্রেমের ইংরেজিতে’only human’ পাবেন না। আসলে একমুখে জীবপ্রেমের কথা বলে অন্য মুখে পশুবলি প্রথার প্রচলন করেছেন বিবেকানন্দ – সেই সত্যকে ঢাকতে গিয়ে এই ‘কেবল মানুষ’ ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে এসেছিলেন সুমন চৌধুরী। আর মানুষ ভাবলেও আপনার যুক্তি ধোপে টিকছে না, কারণ, বিবেকানন্দই বলেছেন –

আরে একটা পাঁঠা কী, যদি মানুষ বলি দিলে যদি ভগবান পাওয়া যায়, তাই করতে আমি রাজি আছি।

আবার ভাববেন না উক্তিটি আমি বানিয়েছি। উক্তিটি পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজির ঘটনাবলী(প্রথম খণ্ড)-এর  ৯৬ পৃষ্ঠায়। অন্য অনেক লেখকই উদ্ধৃতিটি হুবহু ব্যবহার করেছেন তাঁদের বইয়ে একই রেফারেন্স দিয়ে। যেমন এখানে আমি গোলাম আহমাদ মোর্তজার ‘বিভিন্ন চোখে বিবেকানন্দ’ বইয়ের  ২৯১ পৃষ্ঠার অংশবিশেষ স্ক্যান করে তুলে দিলাম –

সুমন  চৌধুরী বলতে চান, বিবেকানন্দ জীবপ্রেমের  কথাও বলবেন, সেই সাথে পশুবলিও দেবেন – এর মধ্যে নাকি কোন স্ববিরোধিতা নেই। উনার কথা শুনে মনে হয় উনি  ‘স্বর্ণলতার’ গদাধরের মতো হতে চান –যিনি টামুক (তামাক)ও খাবেন আবার ডুডুও (দুধ) খাবেন।  বলা বাহুল্য সুমনের ব্যাখ্যা তার গুরুর বানী আর কাজের মতোই স্ববিরোধী।  সুমন যেন সংকল্প নিয়েছেন যে তিনি বিয়েও করবেন, কিন্তু সবার তাকে ব্যচেলর ডাকতে হবে। কিংবা কেউ হিটলারের মতো গণহত্যা করলেও তাকে ‘মহামানব’ ডাকতে হবে আমাদের।

আমি আমার লেখায় রেফারেন্স দিয়ে দেখিয়েছি অধিকাংশ গুরুভাইদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি সব সময়ই দেবী পূজায় পশুবলির ব্যবস্থা রাখতেন। এমনকি বেলুড় মঠের দুর্গাপূজাতেও তিনি পশুবলির পক্ষে ছিলেন। তিনি ইংরেজ শিষ্য নিবেদিতাকে দিয়ে বিভিন্ন জনসভায় পশুবলির সমর্থনে বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন। পশুবলির সমর্থন ছাড়াও বিবেকানন্দ ‘বৃথা মাংস’ ভক্ষণেও অভ্যস্ত ছিলেন বলে জানা যায়। অথচ চৌধুরী সাহেব নিজস্ব ইন্টারপ্রিটেশন থেকে উপসংহারে চলে গেছেন, ‘Vivekananda never spoke about animal killing’। এটা হচ্ছে গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলার মতো। স্বামীজি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য অর্থ ব্যয় না করে শিকাগো গেছেন ধর্মসভা করতে, তারপর স্বদেশ তার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে প্রচুর অর্থব্যয় করতে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন আমেরিকা থেকেই। তখনো দেশে দুর্ভিক্ষ পুরোদমে চলছিলো। অভ্যর্থনা বাদ দিয়ে কিংবা সংক্ষেপিত করে সেই অর্থ তিনি দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং, তার বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছেন,

হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করেছিলাম যে আমায় নিয়ে একটা হৈ চৈ হয়। কি জানিস, একটা হৈ চৈ না হলে তাঁর (ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের) নামে লোক চেতবে কি করে! … তাকে ঠিক জানলে তবে ঠিক মানুষ তৈরি হবে; আর মানুষ তৈরি হলে দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি তাড়ানো কতক্ষণের কথা!

এই হচ্ছে বিবেকানন্দের জীবপ্রেম এবং মানবপ্রেমের নমুনা! এখন পাঠকরাই বিচার করুক কে সঠিক আর কে ভুল।

এবার আসুন – অন্য প্রসঙ্গগুলোও দেখি।


বিবেকানন্দের বেহিসাবি জীবন:

বিবেকানন্দের বেহিসাবি জীবন নিয়ে আমার লেখায় অজস্র রেফারেন্স হাজির করা হয়েছে। সেগুলোর ধারের কাছে না গিয়ে চৌধুরী সাহেব আবেগময় বুলি আউড়েছেন –

A person who abandoned all the materialistic luxury at young age of 25 and passed his extreme beggar life from age of 25 to 33 !, a person who initiated monastic order of Ramakrishna Mission at 1897, collected some money to build Belur math at 1899 and passed away at 1902 after initiating a great karmayoga !

বস্তুত: আমার লেখায় আমি দেখিয়েছি খেতরির রাজা অজিত সিং-এর সাথে বিবেকানন্দের কেমন চমৎকার দহরম মহরম ছিলো। কিভাবে তার কাছ থেকে সারা জীবন ধরে বিবেকানন্দ অর্থ সাহায্য নিয়েছেন, নিজের জন্য পরিবারের জন্য – সেগুলোর সত্য মিথ্যা চৌধুরী সাহেব যাচাই করার প্রয়োজনবোধ করলেন না। শুধু অজিত সিংহ নয়, বহু রাজরাজড়াদের কাছ থেকে মঠের জন্য এবং ‘নানা জনহিতকর’ কাজের জন্য বিবেকানন্দ সাহায্য পেয়েছেন, বিদেশ থেকেও প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু সেই সংগৃহীত অর্থের একটা বিরাট অংশ তিনি নিজের পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করেন। আমি আমার লেখায় দেখিয়েছি স্টার্ডি, ম্যুলার প্রমুখ কয়েকজন বিদেশী ভক্ত স্বামীজির সংসর্গ ত্যাগ করেছিলেন। বিশেষতঃ হেনরিয়েটা ম্যুলার যিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, তিনি ভারতের জনগণের সেবার জন্য স্বামীজিকে প্রায় ৩৯,০০০ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন তা বিবেকানন্দ পারিবারিক প্রয়োজনে এবং বেলুড় মঠে নিজে থাকার জন্য বড় বড় তিনটি আরামপ্রদ ঘর তৈরিতে ব্যয় করেছেন। তিনি ১৮৯৮ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর ‘সোশাল রিফর্মিস্ট’ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বিবেকানন্দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

আমি আমার লেখায় যা উল্লেখ করেছি তার বাইরে আরো অনেক উদাহরণ আছে বিবেকানন্দের জিহ্বা লাম্পট্যের। যেমন, জুনাগড়ের নবাবের দেওয়ান হরিদাস বিহাড়িদাসের বাড়িতে তার আথিতিয়তার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি। ভারত পরিক্রমাকালে জুনানগড়ে পোঁছে যখন তার বাড়িতে উঠেন তখন বাড়ির মালিক উপস্থিত ছিলেন না। তার বাড়ি নিরামিষাশী ছিলো। কিন্তু সেই রান্না স্বামীজির পছন্দ না হওয়ায় তিনি পাচককে দিয়ে মাছ মাংস সহযোগে নিজের পছন্দমতো রান্না রাঁধিয়ে নিয়েছিলেন। এই ঘটনা মহেন্দ্র দত্তের ‘বিবেকানন্দের জীবনের ঘটনাবলি’ গ্রন্থেই পাওয়া যায়।

স্বামীজি জনসেবার জন্য দেয়া টাকা নিজের জন্য খরচ করে ফেলতেন তার বহু প্রমাণ আছে। অলি বুল নামে এক ইংরেজ নারী ছিলো যাকে বিবেকানন্দ ‘ধীরা মাতা’ বলে ডাকতেন। তিনি বহু সময়ই বিবেকানন্দের বেহিসেবি খরচকে নানাভাবে সামাল দিতেন। যেমন, ১৯০০ সালের ১ মে তারিখে বুল বিবেকানন্দকে যে পত্র লেখেন তা থেকে জানা যায়, স্বামীজি বেলুড় মঠের জন্য সংগৃহীত অর্থ থেকে হাজার ছাব্বিশেক টাকা ভেঙে ফেলেছেন। বুল স্বামীজির জনহিতকর কাজের রেকর্ড ‘পরিষ্কার’ রাখার উদ্দেশ্যে তাকে এককালীন অনুদান হিসেবে ৩০,০০০ তাকা দেন। সেক্ষেত্রে মঠের ঋণ শোধ করার পরেও তার হাতে হাজার চারেক উদ্বৃত্ত থাকবে। এভাবেই কখনো অজিত সিংহ কখনো অলি বুল প্রমুখের শরণাপন্ন হয়ে স্বামীজি তার বেহিসেবিপনা সামাল দিয়েছেন, কেবল ‘karmayoga’ দিয়ে নয়, সমালোচক সেটা না বুঝলেও বুদ্ধিমান পাঠকেরা ঠিকি বুঝে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বিবেকানন্দ জাহাজে বা ট্রেনে  সওয়ার হলে সাধারণতঃ প্রথম শ্রেণীর যাত্রী হতেন এবং প্রথম শ্রেণীর হোটেলেই আশ্রয়প্রার্থী হতেন। আমেরিকার বাল্টিমোরে একবার প্রথম শ্রেণীর হোটেলে আশ্রয় নিতে গিয়ে তাকে অপদস্থও হতে হয়েছিল। আমি আমার মূল লেখায় দেখিয়েছিলাম, উনি নিজেই চিঠিতে লিখেছিলেন যে তের ডলার দিয়ে পাইপ কিনেছেন সেটা আবার ফাদারকে বলতে নিষেধ করেছেন –

‘গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা মীরশ্যাম পাইপ কিনেছি। ফাদার পোপকে যেন আবার বোল না। কোটের দাম পড়বে ৩০ ডলার। আমি তো বেশ ভালই আছি। খাবার দাবার জুটছে, যথেষ্ট টাকা কড়িও। আগামী বক্তৃতাগুলো হয়ে গেলে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব আশা করি’।

পাশাপাশি ইংরেজি স্ক্যান্ড ইমেজও দিলাম যাতে বলতে না পারেন, আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি –

‘সন্ন্যাসী’ নাম নিলেও তিনি যে তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি দারুণ টনটনে, এগুলো তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আমি Suman Chowdhury সাহেবকে বলেছিলাম লুই বার্কের ‘সেকেন্ড ভিজিট’ (Marie Louis Burke, Swami Vivekananda’s second visit to the west ) গ্রন্থে স্বামীজির ভোগবিলাস এবং জিহ্বা লাম্পট্যের অনেক উদাহরণ সংকলিত হয়েছে, সেগুলো পড়ে দেখতে, তা না করে উনি কেবল আবেগময় বুলি ব্যবহার করে চলেছেন। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকবে?

সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের বিলাস ব্যাসন আর অমিতব্যয়ী জীবন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলো যে, সাধারণ সন্ন্যাসীরা বেলুড় মঠের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘গরীব রামকৃষ্ণ সভা’ নামে আলাদা সংস্থা সৃষ্টি করে ফেলতে শুরু করেছিলেন। পরে অনেকের মধ্যস্থতায় তাঁদের অসন্তোষ দূর করা  হলেও ইতিহাস থেকে সেই ঘটনা মুছে দেয়া যায়নি।

নারী ভাবনা:

নারী সংক্রান্ত উক্তিগুলোর যে চ্যালেঞ্জ সুমন চৌধুরী করেছেন সেগুলোর সবগুলোর জবাবই আমি দিয়েছি। আবারো উনাকে একটু মনে করি দিতে চাই। যেমন, উনি লিখেছেন –

Challenge 1: Reference 8 : – ‘বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে’। ; Okay readers did you find anything like that? Answer is No.

আমি ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি যে সুমন চৌধুরীর মন্তব্য ভুল। উক্তিটি আছে। উক্তিটি আছে বিবেকানন্দ রচনাবলীর ২য় খণ্ডের ৮৯ পৃষ্ঠায়।  অনর্থক চ্যাঁচামেচি যেন না করেন, সেজন্য ছবিও তুলে দিচ্ছি পৃষ্ঠাটির –

child-marriage makes the race more chaste এর বাংলা করলে ‘বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করিয়াছে’- ই দাঁড়ায়।  প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যাও দিয়েছি উপরে যাতে বলতে না পারেন যে,  আমি আংশিকভাবে উদ্ধৃত করেছি।

বাল্য বিবাহের স্বপক্ষে বিবেকানন্দের আরো অনেক উক্তিই যে আছে, সেগুলো আমার প্রবন্ধটি পুরোটুকু পড়লেই এর প্রমাণ পাবেন।  আমার লেখা যদি না পড়তে চান, তবে বিবেকানন্দ রচনাবলীটাই ঠিক ঠাক মত পড়েন না কেন বাপু! বহু জায়গায়, বাল্যবিধবাদের শোচনীয় অবস্থা দেখেও বিবেকানন্দ না দেখার ভান করেছেন। বাল্যবিবাহিত নারীদের নাজুক অবস্থা অস্বীকার করে উলটো বলেছেন –

‘ভারতে  সাধারণভাবে বিধবাদের বিস্তর প্রতিপত্তি, কারণ সে দেশে সম্পত্তির বড় অংশ বিধবাদের করায়ত্ত। বস্তুত, বিধবারা এমন একটা স্থান অধিকার করে আছে যে, মেয়েরা এবং হয়তো পুরুষেরাও পরজন্মে বিধবা হবার জন্য সম্ভবত প্রার্থনাও করে থাকে’।

এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বিধবা মেয়েরা ভারতে এমনই সুখে আছে যে, নারীরা তো বটেই, এমনকি পুরুষেরাও পরজন্মে বিধবা হবার জন্য নাকি  প্রার্থনাও করে থাকে! এই যদি হয় বাল্যবিধবাদের নিয়ে বিবেকানন্দের বিচারবোধ, তাহলে বলার আর কিছু নেই।

পাশাপাশি ইংরেজি উদ্ধৃতিও দেই, নইলে আবার কোন এক চৌধুরী সাহেব দাবী করে বসবেন ওগুলো নাকি রচনাবলীতে নেই।  ইংরেজি রচনাবলীর অষ্টম খন্ডে লাইনগুলো আছে এভাবে –

He denied that the condition of the child widows is as bad as has been represented, saying that in India the position of widows in general is one of a great deal of influence, because a large part of the property in the country is held by widows. In fact, so enviable is the position of widows that a woman or a man either might almost pray to be made a widow (Vol 8,  page 170) .

এখন, a woman or a man either might almost pray to be made a widow –এর বাংলা সুমন সাহেবকে করতে দিলে উনি ঠিক কী করবেন তা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

আরেক জায়গায় বিবেকানন্দ বলেছেন, ভারতের নারীরা এমনিতেই মাছ মাংস মদ খান না (এটাও বিবেকানন্দের আরেকটি মিথ্যাচার) , তাই তাঁদের জন্য বিধবা হয়ে আচার ব্যবহার পালন করা  বড়  কোন সমস্যা যে নয়, সেটা তিনি তুলে ধরেছেন এখানে –

I have just told you that in the first two or three castes the widows are not allowed to marry. They cannot, even if they would. Of course, it is a hardship on many. There is no denying that not all the widows like it very much, because non-marrying entails upon them the life of a student. That is to say, a student must not eat meat or fish, nor drink wine, nor dress except in white clothes, and so on; there are many regulations. We are a nation of monks — always making penance, and we like it. Now, you see, a woman never drinks wine or eats meat. It was a hardship on us when we were students, but not on the girls. (vol 8, page 14)

সহমরণের সমর্থনে বিবেকানন্দ বলেন –

প্রথমে সেই ভাবটাই উস্কে দিয়ে তাঁদের (হিন্দু নারীদের) character form করতে হবে – যাতে তাঁদের বিবাহ হোক বা কুমারী থাকুক, সকল অবস্থাতেই সতীত্বের জন্য প্রাণ দিতে কাতর না হয়। কোন একটা ভাবের জন্য প্রাণ দিতে পারাটা কি কম বীরত্ব?’

বিবেকানন্দ বিধবা বিবাহ বিরোধিতা করতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন ভারতে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি। কাজেই বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হলে নাকি ‘কুমারী মেয়েদের স্বামী মিলবে না’।  আমি উপরে বাংলা এবং ইংরেজি রচনাবলী থেকে উদ্ধৃতিটি তুলে দিয়েছিলাম। এখানে ইমেজ হিসেবেও দিলাম –

বলা বাহুল্য, বিবেকানন্দের এই উক্তিটি যে সঠিক ছিলো না, তা আমি আমার প্রবন্ধেই দেখিয়েছি। আমি বলেছিলাম,  পৃথিবীতে নারী এবং পুরুষের অনুপাত হল ১ :১.০১ । পুরুষেরাই বরং সামান্য হলেও সংখ্যায় অধিক। এমনকি ভারতের ক্ষেত্রেও স্বামীজির বক্তব্য যে অসার তা দৈনিক আজকালে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সম্পাদিকা সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৪ সালের ৮ ই এপ্রিল –

‘১৯০১ সালের সেন্সাস অনুজায়ই ভারতীয় নারী-পুরুষের অনুপাত হল ৯৭২ : ১০০০। অর্থাৎ, প্রতি একহাজার জন পুরুষ পিছু ৯৭২ জন নারী। সুতরাং স্বামীজি তার স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারী পরিসংখ্যানকে শুধু বিকৃত করেননি, বিদ্যাসাগরের মত একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’কেও অস্বীকার করেছেন’।

বিবেকানন্দের অভিমত সত্যি হলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিয়ে প্রচলন করে কুমারী মেয়েদের স্বামী পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছেন। এর চেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর কী হতে পারে!

স্বামী বিবেকানন্দ যে সহমরণ সমর্থন করতেন, তা ভগ্নি নিবেদিতার ভাষ্যেও স্পষ্ট হয় – ‘জগতের চোখে সহমরণ এত বড় প্রথা কেন – কারণ ওতে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়’। বিবেকানন্দ কি রকম নারী জাগরণ চেয়েছিলেন, তা বোঝা যায় ‘ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া নিজেদের উন্নতি বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে’ এই উক্তি থেকেই।

উক্তিটির স্ক্যান্ড কপি ইংরেজিতেও দিলাম (এটি আছে ইংরেজি রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ডে)–

‘মহাত্মা’ রাম সীতার গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্ম্যহত্যাকে পতিব্রতের আগ্নেয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থিত করেছেন । পুরাণের প্রথম বধূ হত্যাকারী রামচন্দ্রের সর্বংসহা পতিব্রতা স্ত্রী হয়ে উঠেছেন বিবেকানন্দের ‘আদর্শ চরিত্র’ (বিবেকানন্দের সতীদাহের পক্ষের উক্তিগুলো এর নিরিখেই যাচাই করুন, তাহলেই বুঝবেন)। আর সেটারই সাফাই গাইতে চান বিবেকানন্দের ভাব-শিষ্য Suman Chowdhury।

ব্রিটিশ বিরোধিতা:

চৌধুরী সাহেব টিপিকাল বিবেকানন্দ ভক্তের মতোই বলেছেন, বিবেকানন্দ তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী ছিলেন। তার উদাহরণ হিসেবে বলেছেন – ‘most of the Indian freedom fighters were indeed inspired from his lectures.’ এতে প্রমাণিত হয় তিনি বিপ্লবী? ব্রিটিশ বিরোধী? বঙ্কিমের আনন্দমঠ থেকেও তো অনেক স্বাধীনতাকামীরা ‘ইন্সপিরেশন’ পেয়েছেন। তা বলে তো বলা যায় না যে বঙ্কিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রণী সৈনিক ছিলেন। বরং রামমোহন বঙ্কিমেরা কিভাবে ব্রিটিশদের প্রশস্তি করেছেন, তার বহু উপকরণই তাঁদের লেখায় এবং কাজে আছে। চৌধুরী সাহেব লিখেছেন ‘he protested with two English men in a train trip’। হতে পারে (যদিও এটার কোন রেফারেন্স দেননি, এবং এটা উনার ইংরেজি পিডিএফ-এও নেই)। যদি ধরেও নেই – ঘটনা সত্য, আমরা দেখি আবার সেই বিবেকানন্দই ইংরেজদের ‘বীরের জাতি’,’ প্রকৃত ক্ষত্রিয়’, ‘অটল ও অকপট’, এবং ‘প্রভু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, কিংবা বলেছেন, সকল কথার ধুয়ো হচ্ছে –ইংরেজ আমাদের দাও। বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়াছে, তারের খবর দিয়াছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়াছে, ডাকাতদের তাড়াইয়াছে, বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়াছে। আবার কী দেবে? নিঃস্বার্থভাবে কে কী দেয়? বলি তোরা কী দিয়েছিস?”

উক্তিটির স্ক্যাণ্ড কপিও দিলাম , ‘বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থ থেকে –

অবশ্য এটা বলার অর্থ এই নয় যে, ব্রিটিশদের বিপক্ষে স্বামীজি কিছু বলেননি। অবশ্যই বলেছেন। কিন্তু অন্য অনেক দিকের মত ব্রিটিশ তোষণ-বিরোধিতার ব্যাপারটাতেও  স্বামীজির  স্ববিরোধিতাই পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

আউট অব কনটেক্সট:

বিবেকানন্দের অন্ধকার দিক কিংবা কদর্য বাণীগুলোকে নির্মোহ-ভাবে উল্লেখ করলে চৌধুরী সাহেব ইসলামিস্টদের মতই জ্বলে উঠে বলেন ওগুলো নাকি সব ‘আউট অব কন্টেক্সট’! কোনটা উইদিন কন্টেক্সট আর কোনটা আউট সেটা কি চৌধুরী সাহেবের ইন্টারপ্রিটেশনে নির্ধারিত হবে নাকি? আমিও তো বলতে পারি ‘জীবপ্রেম করে যেই জন’ কিংবা ‘হে ভারত ভুলিও না ‘ মার্কা যে ভাল ভাল কথা বলেছেন, সেগুলো সব আউট অব কনটেক্সট। মুশকিল হচ্ছে চৌধুরী সাহেবের মত বিবেকানন্দভক্তরা ভাল ভাল বানীর ক্ষেত্রে কনটেক্সট ভুল হয়েছে বলে মনে করেন না, যত সমস্যা হয় কেবল চাঁদের উলটো পিঠটি দেখালেই। টিপিকাল ইসলামিস্ট এটিচুড। বোঝা যাচ্ছে রসুনের গোঁড়া সবই শেষপর্যন্ত এক!

মন্তব্য আটকে দেয়া

‘মন্তব্য আটকে দেয়া’ নিয়েও চৌধুরী সাহেব মিথ্যাচার করেছেন। উনার কোন মন্তব্যই আটকে দেয়া হয়নি। উনাকে কেবল অনুরোধ করা হয়েছিলো ইংরেজিতে কিংবা বাংরেজিতে মন্তব্য না দিয়ে বাংলায় মন্তব্য করতে। এর আগে বহু মন্তব্যকারীর মন্তব্যই মডারেটরেরা ডিলিট করে দিয়েছিল ইংরেজিতে কিংবা বাংরেজিতে মন্তব্য করা জন্য। অথচ উনি নিজের ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম দাবী করেন। পাঠকেরা যদি খেয়াল করেন তবে দেখবেন, উপরে চৌধুরী সাহেবের বাংরেজি মার্কা চারটি মন্তব্য ইতোমধ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে যা মুক্তমনা নীতিমালার পরিপন্থী। তারপরেও মডারেটরেরা উনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেগুলো প্রকাশ করেছেন। উনার মন্তব্য যে প্রাকশিত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। এমনকি উনার লেখার একই লিঙ্ক দিয়ে দুইবার উনি মন্তব্য করেছেন একবার chowdhury নামে আরেকবার Suman নামে। দুটোই প্রকাশিত হয়েছে।

তারপরেও উনি মুক্তমনার নামে গীবৎ গেয়ে চলেছেন। বস্তুতঃ আমি উনার কোন মন্তব্যই আটকে দেই নাই। উনার মন্তব্যে এমন কিছু ছিলোও না যে আটকে দিয়ে বিশাল কোন দুর্লঙ্ঘ্য কোন গিরি অতিক্রম করব আমি। তার লেখা আর মন্তব্য এতোটাই দুর্বল যে সেটার প্রত্যুত্তর না দিলেও চলে। উনি বিবেকানন্দ রচনাবলী পড়েননি, বিবেকানন্দকে নিয়ে বাংলায় বা ইংরেজিতে ভাল কোন বই পড়েছেন সেটার কোন  প্রমাণও তার লেখা থেকে পাওয়া যায় না।  উনি ভেবেছেন উনি এক বিরাট ‘হনু’ – যার মন্তব্যে অভিজিৎ রায়ের বড্ড ভয়। আবারো বলছি আমি উনার কোন মন্তব্যই আটকে দেই নাই।  তবে আমি ছারাও মুক্তমনায় আরো অন্য মডারেটররা আছেন, তারা নিজ দায়িত্ব কোন সিদ্ধান্ত নিলে আমি দায়ী নই। আমি সেইদিন ঘুম থেকে উঠে সার্ভারে গিয়ে উনার যে মন্তব্যগুলো দেখেছি (সেগুলো ইংরেজি- বাংরেজি হওয়া সত্ত্বেও) সেগুলো এপ্রুভ করে দিয়েছি। তাও যদি বিবেকানন্দের শিষ্যের আত্মা শান্ত হয়! কিন্তু উনার মন বিভিন্ন কারণেই অশান্ত। উনাকে বাংলায় লিখতে অনুরোধ করা হলেও কিংবা অভ্রের লিঙ্ক দেয়া হলেও উনি বাংলায় লিখবেন না বলে ঠিক করেছেন। এমনকি এটাও বলেছেন বাংলায় লেখা নাকি ‘waste of time’ । এ নিয়ে ফেসবুকেও তাকে কথা শুনতে হয়েছে।

সুমন চৌধুরীর  বিবেকানন্দ পঠন শুধু নয়, তার লেখাও দুর্বল, নানান হেত্বাভাস-দোষে  দুষ্ট।  যেমন উনি লেখার প্রথমেই অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, কবীর চৌধুরীর মত পণ্ডিত ব্যক্তি যেখানে বিবেকানন্দের প্রশংসা করেছেন সেখানে অভিজিৎ এসেছে তার সমালোচনা করতে।  প্রথমতঃ কবীর চৌধুরীর লেখাটা মুক্তান্বেষা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো আমাদের উদ্যোগেই, ওটার পিডিএফ আমি নিজে করে মুক্তমনায় দিয়েছিলাম, আর সেটার লিঙ্ক আমার মূল লেখায় উদ্ধৃত করেছি বলেই সুমনের মত ‘গবেষকেরা’ ওটার হদিস পেয়েছেন।  কিন্তু কবীর চৌধুরী কারো প্রশংসা করলে অন্য কেউ সেই বিষয়ের সমালোচনা করতে পারবেন না সেই দিব্যি কে দিয়ে রেখেছেন? এ ধরণের ছাই-পাশ লেখার আগে উনার ‘অ্যাপিল টু অথরিটি’ ফ্যালাসি সম্বন্ধে আরেকটু ভালভাবে জানা দরকার। উনি ফেসবুক থেকে চৈতি দেবীর মন্তব্য উদ্ধৃত করে নিজের যুক্তিকে জোরালো করতে চেয়েছেন, অথচ, চৈতি দেবীর যুক্তিগুলোকে ফেসবুকেই খণ্ডন করা হয়েছিলো তখনই। সেই খণ্ডিত যুক্তিগুলোই সুমনের আশা-ভরসার স্থল!  সুমন এবং চৈতি দেবী দুজনেই নিবেদিতার প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন।  বলেছেন নিবেদিতার মত অনেকে বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় ভারতে এসেছিলেন।  কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্য যে, অনেকেই বিবেকানন্দের অসন্ন্যাসীমার্কা কার্যকলাপ এবং বেহিসেবী জীবনের পরিচয় পেয়ে স্বামীজির কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। আমার প্রবন্ধেই আমি এডওয়ার্ড স্টার্ডি এবং হেনরিয়েটা মুল্যারের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছি। সমালোচক সাহেব সেগুলো কোনটাই খণ্ডন করতে পারেননি।

শেষ করার আগে একটি কথা। আমার প্রবন্ধটিকে খণ্ডণ করার জন্য দয়া করে পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের ভাল ভাল উক্তিগুলো আবার সামনে নিয়ে আসবেন না যেন। স্বমীজির ভাল ভাল উক্তিগুলোর উপস্থিতি সম্বন্ধে এই অধম যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। কিন্তু আমি যেটা দেখাতে চেয়েছি সেই ভাল ভাল উক্তিগুলোর একশ আশি ডিগ্রী বিপরীত কথা স্বামীজিই আমাদের শুনিয়ে গেছেন। একমুখে নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন, আবার অন্যমুখে তিনিই বাল্যবিবাহের পক্ষে ওকালতি করেছেন, সতীদাহকে ডিফেন্ড করেছেন, বিধবা বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। শূদ্রদের নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে আবার ব্রাহ্মণদেরই আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে বলেছেন। এগুলো কোন বিরাট সমাজসংস্কারকের লক্ষণ নয়, আগাপাশতলা স্ববিরোধী ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। তারপরেও যদি সুমনবাবু বিবেকানন্দকে খুব বিরাট ‘সমাজ সংস্কারক’ বলে মনে করে থাকেন, তাহলে তার জন্য দিচ্ছি বিবেকানন্দেরই একটি উক্তি –

১৯৯৫ সালে  আলাসিঙ্গাকে তিনি বলছেন,

‘বাজে সমাজ সংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজ সংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজ সংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না। ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না (পত্রাবলী, পত্র নং ২০৯, পৃঃ ৩৫৮)

ইংরেজীতে –

DEAR ALASINGA,

19 W., 38 ST.,

NEW YORK, 1895.

Meddle not with so-called social reform, for there cannot be any reform without spiritual reform first. Who told you that I want social reform? Not I. Preach the Lord — say neither good nor bad about the superstitions and diets (Vol 5, page 90)

রাজেশ দত্তের একটা উক্তির অনুসরণেই বলি – পাঠকেরা কিন্তু বুঝতে শুরু করেছে – প্লাবনের জোরালো ধাক্কায় বিবেকানন্দের ‘অবতারত্ব’ ভেসে যাচ্ছে, মূর্তি থেকে মাটির আস্তরণ ক্রমশ সরে যাচ্ছে, ধুয়ে যাচ্ছে আলগা চাপানো রঙ। বিগ্রহ খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে হাড্ডিসার কংকালসার নগ্ন রূপের বিবেকানন্দকে, যে কদর্য কুৎসিত রূপটিকে উনি নিজেও আর সহ্য করতে পারছেন না। এটাই নির্মম সত্য।