লিখেছেনঃ নাস্তিক দীপ

২০০৬ সালের ঘটনা। তারও আগের থেকে খুব সম্ভব ২০০১ সাল থেকে আমি কোন প্রাণী হত্যাই করিনা।এদিকে বৌদ্ধ ধর্মেও প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ।বাবাকে বললাম আমি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে চাই।বাবা বললেন,বেশ ভাল কথা। আমি,বাবা আর মা আমরা তিনজনে বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরে গেলাম।ঐদিন ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা।সবাই অনেক ব্যাস্ত। ভান্তেরা(বুদ্ধ পুরোহিত) আরও ব্যাস্ত। বাবা একজন ভান্তের সাথে কথা বলতে চাইলেন। ভান্তে প্রথমে কথা বলতেই চাইলেননা।অনেক কাজ তাঁর।তারপর বাবা নিজে থেকেই বললেন,‘ভান্তে আমার ছেলে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে চায়’।

ভান্তে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবার কথা শুনে সাথে সাথে ফিরে আসলেন।

‘কি বললেন আপনি?’ভ্রু কুঁচকে বললেন ভান্তে।

‘আমার ছেলে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে চায়।সে কোন প্রাণী হত্যাই করেনা অনেক ছোট থেকেই।’

‘বেশ ভাল কথাতো।তা কোন ধর্মের মানুষ আপনারা?ও কি আজকেই ধর্মান্তরিত হবে?’ভান্তে জানতে চাইলেন।

‘ভান্তে,আমার একমাত্র ছেলে।ওর বৌদ্ধ ধর্ম ভাল লাগে।বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষিত হতে চায়।খুব ভাল কথা।আমি ধর্ম সম্পর্কে এতো কিছু জানিনা।কিন্তু আমিতো আমার ছেলেকে এভাবে ধর্মান্তরিত হতে দেখতেও চাইনা মশাই।

আমার কিছু প্রশ্ন আছে।এগুলোর উত্তর জানতে চাই।আপনি উত্তর দেন।এরপর বাকিটা ওর ইচ্ছা।ওর আপনার উত্তর পছন্দ হলে ধর্মান্তরিত হবে।আর অপছন্দ হলেও ওর ইচ্ছা হলে ও ধর্মান্তরিত হবে।ও যা ভাল মনে করে।’

এতক্ষণে আরও কয়েকজন ভান্তে আর বেশ কিছু মানুষ জড় হয়েছে আমাদের চারপাশে।খবর পেয়ে আরও কয়েকজন ভান্তে আমাদের ঘিরে ধরলেন।সবাই জানতে চায় কি প্রশ্ন এই ভদ্রলোকের!

‘তা কি প্রশ্ন আপনার? করে ফেলুন।’ বয়স্ক একজন ভান্তে জানতে চাইলেন।

‘আমার দুটি প্রশ্ন।প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে আমরা জানি প্রাণী হত্যাতো বৌদ্ধ ধর্মে নিষিদ্ধ। এখন মনে করুন আপনি এমন একটা জায়গায় এসেছেন যেখানে অনেক মশা।মশা আপনাকে কামড়াচ্ছে।কি করবেন আপনি?’জানতে চাইলেন বাবা।

‘কি করব মানে?সরিয়ে দেবো মশা।আর কি করব?আপনি কি আমাকে মশা মারতে বলছেন নাকি?একটা অবুঝ প্রাণী আপনাকে কামড়াচ্ছে আর এর জন্য আপনি কি তার জীবন নিয়ে নেবেন?আজব প্রশ্ন।’রেগে গেলেন ভান্তে।

‘ভাই আমিতো আগেই বলেছি যে ওখানে অনেক মশা। আপনি কয়টাকে সরাবেন!ডেঙ্গু,ম্যালেরিয়া,এনসেফেলাইটিস ইত্যাদি অনেক রোগ আছে মশার কারনে হয়।কয়েকমাস আগেই আমার এই প্রাণী হত্যা না করা ছেলেরই ডেঙ্গু হয়ে গেল।তাই এতো মশা আপনি সরাতে পারবেননা।আমার জানা মতে এমন কোন মন্ত্র-তন্ত্রও নেই যা দিয়ে মশা সরানো যায়।’

‘আরে মশাই এতো মশা যেখানে সেখানে যাবেন কেন আপনি?’ আরেকজন ভান্তে বললেন।সবাই যথেষ্ট রেগে যাচ্ছেন!উপস্থিত ভান্তেরা তাঁকে সমর্থন জানালেন। সত্যিই তো যেখানে এতো মশা সেখানে কেন যাবেন আপনি?

‘আপনারা শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছেন। মানুষ তো আর সাধ করে মশার কামড় খেতে যায়না। কিন্তু আপনাকে কোন দরকারি কাজেই হয়তো যেতে হতে পারে এমন জায়গায় যেখানে গেলে আপনার মশার কামড় না খেয়ে উপায় নেই। জেলখানার কথাই ধরেন। কয়েদীদের খাবারের থেকে মশার কামড়ই বেশী খেতে হয়।’

বাবার প্রশ্ন শুনে যথেষ্টই মজা পাচ্ছিলাম। এতো এতো মানুষ এখানে একজনও বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা!ভান্তেরাও চুপ করে আছেন। উপস্থিত দুই একজনের কথা কানে আসছে।ফিস ফিস করে কে জানি বলল,ভাল প্রশ্ন! সত্যিই তো এমন হলে কি করা উচিত?

‘এছাড়াও ধরেন আপনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন পথে একটা বিষাক্ত খ্যাপাটে সাপ তারা করল আপনাকে। আপনার পিছু ছাড়ছেইনা…’

‘আরে দাদা যে রাস্তায় সাপ থাকে সে রাস্তা দিয়ে আপনি যাবেন কেন?’ বাবাকে থামিয়ে দিলেন আরেকজন ভান্তে।

‘ভাই,কেউ তো আর ইচ্ছা করে সাপের খপ্পরে পড়তে যায়না। কিন্তু তারপরেও অনেক সময় সাপের দেখা আমাদের পেতে হতেই পারে। সাপের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু সুন্দরবনে অনেক জেলে,মৌয়াল বা অন্যান্য মানুষেরা পেটের দায়ে সুন্দরবনে যায় আর পরবর্তীতে বাঘ-কুমিরের পেটে যায়। এরা কেউ কিন্তু সাধ করে বাঘ কুমিরের পেটে যায়না দাদা।’

‘দুই নম্বর প্রশ্নটা করে ফেলুন।’মধ্যবয়স্ক একজন ভান্তে বললেন।

উপস্থিত সব ভান্তের মুখই এতক্ষনে কাল হয়ে গেছে।তাও জানতে চায় দুই নম্বর প্রশ্নটা কি।

‘আমার জানা মতে বৌদ্ধরা সব মাংসই খায়।হিন্দু-মুসলিমদের বিধি নিশেধ নেই আপনাদের। এখন ধরুন এমন একটি বৌদ্ধ এলাকা রয়েছে যেখানে ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৯৯ জন মানুষই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী।কিন্তু বাকি যে ১ জন মানুষ আছেন,তিনি একজন হিন্দু/মুসলিম।ওই ব্যাক্তি একজন পেশাদার কসাই।মাংস বিক্রি করে তার পেট চালাতে হয়। যেহেতু বৌদ্ধরা সব প্রানির মাংসই খায় কিন্তু নিজেরা হত্যা করেনা তাই ঐ লোকের মাংসের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ঐ এলাকায় জীব হত্যার পাপের দায়ভারের অধিকারী কি ঐ এলাকার বৌদ্ধরা হবেনা? তারা যদি মাংস না খেত তাহলে তো এই জীব গুলোকে অকালে মরতে হতোনা। সব পাপের দায় কি ঐ গরীব কসাইয়ের নিতে হবে?এলাকার বৌদ্ধদের কোন পাপ হবেনা?’বাবা প্রশ্ন শেষ করলেন।

আমি ভান্তেদের দিকে তাকাচ্ছি কে উত্তর দেবেন বুঝতে পারছিনা।

বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকলেন ভান্তেরা।অবশেষে বয়স্ক ভান্তে বললেন,‘আপনার প্রশ্ন গুলো যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আমরা আসলে জানিনা। কিন্তু এর সমাধান আছে। আজকে তো সময় দিতে পারবোনা আপনাদের। আপনারা একদিন সময় করে আসেন। আমরা আলোচনায় বসি। আলোচনায় বসে এর উত্তর দেওয়া সম্ভব।’

উপস্থিত ভান্তেরাও সম্মতি জানালেন মাথা নেড়ে।

বাবা বললেন,আচ্ছা আবার একদিন সময় করে আসবো আমরা।

ভান্তেরা যে যার কাজে চলে গেলেন।আমরাও তখন মুল মন্দির থেকে সরে এসেছি। বাবা ফিসফিস করে আমার কাছে জানতে চাইলেন,‘বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করবেনা?’

‘বাসায় চল। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা!’ বললাম আমি।