প্রথম পর্ব এখানে

(লেখাটা আমি আমার প্রিয় ছোট বোনকে উৎসর্গ করলাম)

এমন হেমন্তে ছোট বোন এলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখে দিকে। কী সুন্দর নিস্পাপ চেহারা!
হঠাৎ রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলে জানালা দিয়ে দেখি, নারকেল গাছ যেন দৈত্যের মত লম্বা হয়ে ছায়া ফেলেছে। ভীষণ বাথরুম পেলে মা’কে ডাকি-

-মা বাইরে যাবো-
বাথরুম ঘরের ভেতরে নাই, তাই ভয়ে ভয়ে ডাকি। মা বলে-
-তুমি যাও আমি জেগে আছি,

টিপি-টিপি পায়ে দরজার হুড়কো খুলে গোসলখানায় পেচ্ছাপ করে হুড়োহুড়ি করে চলে আসি। না, ভূতের ভয় ঠিক না, তবে কিসের যেন এক ভয় তাড়া করে রাত্তিরে বাইরে গেলেই।

পড়াশনায় অমনোযোগী হবে সবাই, তাই বাবা একদিন ট্রানজিস্টারটা কাঠের আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল।
সবার মন ভীষণ ভার। চা খাবার উপাই নেই বাড়িতে। বাবা বাইরে গেলে মা আমাদের লুকিয়ে চা দেয়।
আরো রাত্তির হলে আলমারির দরজা ফাঁক করে, নানান কসরত করে হাত ঢুকিয়ে রেডিও অন করা হয়। সবাই মন দিয়ে রেডিও শোনে। আকাশবাণীতে কী দুর্দান্ত নাটক হয়!
বাবা বের হবার আগে মনে করিয়ে দেয়, অংক ট্রানশ্লেসন সবাই যেন করে রাখে যার যার মত।

এইভাবে ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় আমাদের ছোট পৃথিবী চলতে থাকে। যে টুন-টুনি পাখি রোজ করমচা গাছে বসে, সে সেই সময়টাই এসে বসে থাকে। ডানা ঝাপ্টায়।
হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামে। পাশের বাড়ির ভাঙ্গা বারান্দায় মাঝি নানা খড়ির চুলো জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে।
এক দৃষ্টিতে গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধোয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকে।

মাঝে মাঝে শুটকির গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। মাঝি নানা হাঁটু মুড়ে বসে থাকে। তার শুকনো হাড্ডিসার দেহ বেঁকে চুরে অদ্ভূত দেখায়। মাঝি নানার বৌ বাচ্চা কোথায় থাকে জানিনি কোনো দিন। চূলোর আগুনে তার ছায়াটা অনেক দীর্ঘ আর অদ্ভূত লাগে। তাকে যেন তখন জাগতিক জগতের মানুষ মনে হয় না।
বাতাসে বড় বড় গাছের পাতাগুলো থেকে কেমন এক হিস-হিস করে শব্দ বের হয়। আর গাছগুলোকে পেঁচিয়ে মাধবীলতা উপরে উঠছে,আর লতানো গাছের ফুল থেকে কী অপূর্ব সু-গন্ধ আসে হাওয়ায়!
গেটের কাছে যে বেলিফুলের গাছ আছে তা একদম পুরো বেড়া দেয়া জায়গাটা ছেয়ে ফেলেছে। সন্ধে বেলা পাগল হাওয়া আসে জানালা দিয়ে। আর বেলি ফুলের সুগন্ধ ঝাপ্টা মারে নাকে।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে, মাধবীলতার ঝাড়ে, বেলিফুল গাছের পাতায়। রোদটাও কেমন মিইয়ে লালচে হয়ে যায়।
মাঝিনানা রান্না চড়ায় খড়িতে। পোড়া গন্ধ আর পাট কাঠির শব্দ পাই পট-পট করে।

সারাদিন জঙ্গলে,আদাড়ে, বাদাড়ে ঘুরে ময়লা ফ্রকের খুঁটিতে হাত মুছি, নাকের সর্দি মুছি। মা’র উগ্র মূর্তি দেখার ভয়ে ভাঙ্গা দালানে ঢুকে পড়ি। ওমনি বিড়ালটা-ম্যাও- করে ওঠে।
নাহ, কেউ টের পাবার আগেই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসি হ্যারিকেনের আলোয়।
রাত্রি তখন দৈত্যের মত জেঁকে বসেছে।
মেজো বোনকে দেখি কলতলায় একরাশ এঁটো বাসন ধুতে। বড় বোন চলে যাবার পর খুব কম বয়সেই মেজ বোনের ঘাড়ে সব কাজের ভার পড়ে গেছে। বাসন মাজা,বাচ্চা সামলানো, মা’কে সাহায্য করা সব।
আমি দেখেছি নির্ঘাত কলপাড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির দু’জন লোক মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি দেয়।
ভাবি মা’কে বলতে হবে যেন মাঝি নানাকে বলে বেড়ার ফুটোটা ঠিক করে দেয়।

চাঁদপুরে কেটেছে আমার দূরন্ত শৈশবের কিছুটা। একদিন কী ঝড় এলো। ঝড়ে বিষ্টিতে আকাশ কালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন তো চাঁদপুরে বেশির ভাগ বাড়িই টিনের ছিল। মড়-মড় করে আমাদের বাড়ির সামনে যে যে টিনের বিশাল ঘর ছিল, যাতে পিওন চাপরাশিরা থাকে- সে ঘর পড়ে গেলো কাত হয়ে।
বাবা সবাইকে নিয়ে বেশ দূরে দালানঘরের দিকে এগুতে থাকে।আমার হাত ধরে মা। সবাই ছুটছি। বাতাস মনে হয় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে একসময় বসে পড়ে। বাতাসের গতি তখন ভয়ঙ্কর।

ওদিকে দালানে যারা আশ্রয় নিয়েছে সবাই হা-পিত্যেস শুরু করেছে। ততক্ষনে মা আমাকে ধরে দ্রুত দালানে পৌঁছে গেল। ঝড়ের দাপা-দাপি তখনও চলছে।
এক সময় প্রকৃ্তি ঠাণ্ডা হল। চার দিকে ধংশস্তুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গাছ পালা উপড়ে পড়ে আছে।পুকুরের পানি টই-টই করে উপছে পড়ছে। সব মাড়িয়ে আমরা নিজ বাড়ি ফিরে এলাম।

সেদিন বিকেলে মেজ ভাই খেলছে। আমি ওদের বল এগিয়ে দিচ্ছি। এইকাজটা আমার খুব প্রিয় ছিল। যেন কৃতার্থ হয়ে যেতাম।ঈর্ষা হত ইশ! কী সুন্দর খেলা করে- অথচ আমাকে নেয়না।
তো সেদিন খেলার মাঝে ভট-ভট শব্দ শুনতে পেলাম। মেজ ভাই বলে,
-হেলিকপ্টার, চলো দেখি গিয়ে-
আমার হাত ধরে ছুট’তে শুরু করেছে। হেলিকপ্টার উড়ে আমরাও পেছন পেছন ছুটি।
উফফ! কী দৌড় না দৌড়াচ্ছি। ওমা! সামনে তাকিয়ে দেখি নদির ওপারে থামলো হেলিকপ্টার। উপায়!
এক মাঝি ছিল সে নৌকো বাইতো। তার নাম ষোলদানা। কি অদ্ভুত নাম। মানুষের কি এমন নাম হয়? কী জানি।
মেজ ভাই তাকে অনুরোধ করতেই সে আমাদের নদি পার করে দিল। ডাকাতিয়া নদি। বাপরে কী ভয়ংকর নাম!

হেলিকপ্টার দেখতে গেলাম। ভটভটানি শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। আমার রুক্ষ চুল উড়তে লাগলো।
চারদিকে ধানখেতের গাছগুলো দুলতে লাগল। আমি অবাক বিস্ময়ে উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগলাম।

(চলবে)