নিজে কানা পথ দেখে না / পরকে ডাকে বারংবার
(এ কানার দলে আমি প্রথমেই সামি আহমেদ আনন্দকে অন্তর্ভূক্ত করে এ লেখাটা আমি স্নেহ ভরে তাকে উৎসর্গ করছি। সামি , যিনি ঈশ্বরহীন নামে মুক্ত-মনায় লিখতেন এবং স্বেচ্ছায় এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ।)

এক ভদ্রলোক নিজেকে বেশ জ্ঞানী গুণী মনে করেন। জ্যামিতিক জ্ঞান তার প্রখর। গজ,ফুট ও ইঞ্চির হিসাব তার কাছে হাতের মাপ। স্কেল লাগে না। হাত আর আঙ্গুলের কর থাকতে স্কেলের প্রয়োজন কেন?
তার ঘরের জানালার কপাট কতটুকু প্রস্থ্য হবে এর পরিমাপ দুই হাত দিয়ে মেপে হাত দুটোকে উঁচু করে ধরে কাঠমিস্রির কাছে যাচ্ছিলেন। বৃষ্টির দিন। রাস্তা পিচ্ছিল। ভারসাম্য না রাখতে পেরে আছাড় পড়েছেন। আছাড় পড়লেও তিনি উঠার চেষ্টা করছেন না, বরং হাত দুটোকে উঁচু করেই ধরে আছেন।
আরেক পথচারী জিজ্ঞেস করছে, ভাই আপনি উঠছেন না কেন? আপনাকে কি ধরে উঠাব? আর হাত দুটোই বা উঁচুতে ধরে রাখছেন কেন?
লোকটি উত্তর দিল, ভাই, আমাকে তো হাতে ভর দিয়ে উঠতে হবে। আমি হাত দিয়ে আমার ঘরের জানালার কপাট বানানোর জন্য পরিমাপ নিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাছে যাচ্ছিলাম। এখন হাতে ভর দিয়ে উঠতে গেলে আমার পরিমাপ চলে যাবে। আর পরিমাপ আনতে আবার বাড়ি যেতে হবে।
পাঠক, আমি কি বুঝাতে পেরেছি যে ভদ্রলোকের জানালার কপাটো বানানোর প্রয়োজন নেই। এখনও মনের জানালাই বানাননি। পরে তো কপাট।

আমরাও অনেকে নিজেকে খুব জ্ঞানী গুণী, মানী, দামী মনে করি।ভাবি, নিজের এত বেশি দর্শন ও বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় জ্ঞান এবং তা এত আলো ছড়াচ্ছে যে স্কেলের সাহায্য ছাড়াই শুধু হাত দিয়েই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে মাপতে পারি।
হাতে পরিমাপ নিয়ে হাঁটতে গেলে তো বটেই, আছড়ে পড়লে যে হাতের মাপটি বিচ্যুত হয় সে জ্ঞানটুকুও নেই।
তেমনি অনেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিয়ে নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করতে চায়।

মুক্ত-মনা ও নাস্তিক কি সমার্থক শব্দ? এ প্রশ্নের উত্তর ও সংশয় কাটাতে আনুসঙ্গিক আরও কিছু প্রশ্ন ও সংশয় স্বাভাবিকভাবেই মনে ভীড় করেছে। যেমনঃ
আস্তিকদের নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে দাবি করা কি যৌক্তিক?
অনেকের মতের সাথে আমিও একমত যে আস্তিকদের নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে দাবি করা মোটেই যৌক্তিক নয়। কারণ একজন হিন্দু বা মুসলিমের পক্ষে মনুসংহিতায় বা কোরাণের পাশাপাশি নারী মুক্তিকে সমর্থণ করা স্ববিরোধী কথা। সোনার পাথর বাটি বা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মত অসম্ভব ধারণা ? আর সমাজ ও সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান প্রগতিশীলতা নির্ণয়ের বড় মাপকাঠি।
একজন আস্তিক আল্লাহ বিশ্বাস করে, তার অনুগত পথে চলে। আবার মানবতাবাদী বলেও নিজেকে দাবি করে। কীভাবে সম্ভব? অমুসলিম মানেই তো মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের বাইরে। বহু ইফতার পার্টিতে গিয়ে বিব্রতবোধ করি যখন ইফতারের মাঝখানে নামাজ পড়ে দোয়া করে মুসলিম উম্মাহর মঙ্গল কামনা করে ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে। একবার তো আমি বলেই বসলাম, আমাদের জন্যও কিছু বলুন।
আর আস্তিক বলে যারা দাবি করে তারা সব সময় আস্তিক নয় বা মোটেই আস্তিক নয়। যেমনঃ একজন চোর বা একজন ঘুষখুর সরকারী কর্মকর্তা পাঁচওয়াক্ত নামাজ পরলে বা নিয়মিত প্রাত্যহিক সন্ধ্যা আহ্নিক-পূজা অর্চনা করলেই কি তার আস্তিকতার প্রমাণ মিলে? সে তো ধর্মের মূল চেতনা (spirit) বলে যা দাবি করা হয় তা ই মানছে না।
নাস্তিক মানে কি প্রগতিশীল? অথবা ঈশ্বরবিহীন হলেই কি অনৈতিক? এ সম্বন্ধে অবশ্য অনেক লেখা ( মুক্ত-মানায়ও ) আছে। আর আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে একজনও সম্পূর্ণ আস্তিক বা পরিপূর্ণ নাস্তিক মানুষ পাইনি।
সব সংশয়বাদী। “ ক্ষণেক দেখি দেখি শূন্যে ভাসে , ক্ষণেক দেখি জলে।”
বিভিন্ন ব্লগে নাস্তিক ও আস্তিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে বা অন্য কোন কোন বিষয়ে — যেমনঃ মোঃ ইউনুস ও গ্রামীণ ব্যাংক,রবীন্দ্র নাথ বা পহেলা বৈশাখ বিষয়ে কেউ কেউ এমন সব অযৌক্তিক যুক্তি দেয়, একজন আরেকজনকে এমনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে যে তাদেরকে মুক্ত মনা তো দূরে থাক, শুধু বদ্ধ মন নয়, তালাবদ্ধ মন বললেও কম বলা হবে। মন একেবারে সীলগালা করা।
মুক্ত মনা মানে তো শুধু অলৌকিক শক্তিতে অবিশ্বাস নয়, বিজ্ঞানের জয়গান গাইতে গাইতে উন্মাতাল হয়ে পথ চলতে গিয়ে দুর্বলকে পায়ের নীচে পিষ্ট করে ফেলা নয়। তাকে অন্যের মতামত শুনে তা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে হবে।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। এ সত্যকে যদি আমি না মানি তবে আমাকে মূর্খ বলে বকাবকি করলে মুক্ত –মনাদের দল বাড়বে না। আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, শিখিয়ে দিতে হবে কীভাবে হল। কয়েক শত বছর আগে মীমাংসিত সত্যে যদি আমার আস্থা না থাকে তা আমার সীমাবদ্ধতা। যদি আমি না বুঝি বা না বুঝতে চাই তবে নতুন কোন পদ্ধতি বা কৌশল আবিষ্কার করতে হবে আমাকে বুঝাবার জন্য। আমি মূর্খ। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আমি অন্ধবিশ্বাসী। আমি বোকা, আমি জ্ঞানপাপী, আমার মাথায় ঘিলু নেই। আমি আস্তিক। সবই সত্য। কিন্তু এ সত্য যদি সত্যই থাকে তবে তো মুক্ত মনাদের আসল সত্য আমার মনের দরজা ভেদ করতে পারবে না। আমি কি বলি তা শুনে সে মোতাবেক মুক্ত-মনাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। অধৈর্য হয়ে, অন্যকে খাটো করার মনোবৃত্তি নিয়ে আর শুধুমাত্র ব্লগে ব্লগে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করে মুক্ত-মনাদের দল ছড়াবে না।
পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য করে রাখা, সমাজকে সংস্কারমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখা,ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিসরকে জটিলতা মুক্ত ও সংবেদনশীল রাখাও একজন মুক্ত-মনার বৈশিষ্ট্য বলে আমি মনে করি।

অনেকেই ব্যক্তি ধর্ম, নাস্তিক্যবাদ, আস্তিক্যবাদ, বিজ্ঞানের সাথে প্রচলিত মূল্যবোধের সম্পর্ক, আধুনিকীকরণের নামে শিশু শিক্ষার সাথে নৈতিক জীবন যাপনের দ্বন্ধ্ব সৃষ্টি করছে। অন্য আরেক গোষ্ঠি ধর্মকে আঁকড়ে ধরে মধ্যযুগীয় জীবন যাপনে বাধ্য করানোর জন্য রাজনীতিসহ সর্বত্র হিংসার পথকে পূঁজি করছে।
ঈশ্বর, স্বর্গ ও পরকাল ভিত্তিক ধর্মীয় জীবন যাপনে অভ্যস্ততা নয়, নয় আধুনিক জীবন যাপনের নামে অনৈতিক জীবন যাপন। আবার দুটোর সংমিশ্রণে জগাখিচুরিও কাম্য নয়।
কাম্য কি তবে সহনীয়, মধ্যপন্থী, আপোষ করা মনোভাব? না, তা ও নয়।
কাম্য মুক্ত জীবনযপন। স্বাধীন জীবনবোধ। মুক্ত –মনা। মুক্ত চিন্তা, মুক্তান্বেষা। মুক্ত বুদ্ধি। প্রচলিত অচলায়তনকে অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে চলা । জীবনকে নিজের ইচ্ছেমত থামিয়ে দেওয়া নয়?
আমাদের ছোটবেলা আদর্শলিপি পড়তে হত। অ তে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর। আ তে আলস্য দোষের আঁকর। ঈশ্বরকে বন্দনা করিও। উর্ধ্বমুখে পথ চলিও না। ঝগড়া করিলে বিপদ ঘটে। ঠককে বিশ্বাস করিও না। ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেকটি বর্ণ দিয়ে একটি করে আদর্শিক বাক্য তৈরি। আর শ্লেটে মাটির পেন্সিল দিয়ে লেখা শিখেছি। ঈশ্বরকে বন্দনা করিও শিখলেও ঈশ্বর বলতে মানস পটে কোন সাকার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথবা নিরাকার কোন অস্তিত্ব নিয়েও ভীতির সৃষ্টি হয়নি। ঈশ্বর মানে স্বর্গে যাওয়ার মাধ্যম নয়। ঈশ্বরবোধ মানে ছিল সত্যবাদিতা ও মানবতাবোধের অনুশীলন।

উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭২-৭৩ সালে বঙ্গ ভারতের ইতিহাস বইয়ে ধর্ম নির্বিশেষে গৌতম বুদ্ধের জীবনী পড়তে হত; যার মূল বিষয় ছিল তার অষ্ট মার্গের কথা। সৎ কাজ, সৎ চিন্তা। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভূর জীবনীও ছিল। কলসীর কান্দার বাড়ি খেয়েও ভালবাসার কথা, প্রেমের বিলানোর কথা বলা।আরও ছোট ক্লাসে বাংলা বইয়ে হযরত মোহাম্মদের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত যে বুড়ি একদিন কাঁটা না দেখে বুড়ির বাড়ি গিয়ে বুড়িকে সেবা করার কাহিনী। যদিও বিশেষ ধর্মীয় পুরুষদের গল্প। কাহিনী। ঘটনা। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা।তবে তা সর্বজনীনরূপে উপস্থাপিত হয়েছিল। আর এগুলো পড়ে বিশেষ ধর্ম নয়, পারলৌকিক সুখ নয়, অলৌকিক শক্তির মাহাত্ম্য নয় — নিজের ছোট জীবনকে আদর্শিক ভাবে গড়ে তোলার প্রেরণা ছিল। লৌকিক জীবন সুন্দর করার মন্ত্র ছিল। আজ এ মন্ত্র ছড়ানো প্রয়োজন।