আনন্দ

আনন্দ। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আমার। এমন করে আর কাউকে অনুভব করিনি আগে। দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অন্য রকম কিছু। কি? আমি তা বলতে পারব না। দেখতে ও খুবই সুন্দর ছিল। মুখের দিকে তাকালেই মায়া লাগে- এমন চেহারা। আমার সঙ্গে ওর কখনো ঝগড়া হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে খিটিমিটি লাগত। কে বেশি লম্বা- এই নিয়ে। ওর দাবি ছিল ও বেশি লম্বা। আমি তা মানতে চাইতাম না। আমাদের দুজনের পার্থক্য ছিল এখানেই। আমি কখনো ছোট হতে চাইতাম না। আর ও চাইতো বড় হতে। ওর এই বড় হতে চাওয়ার ইতিহাসটা অনেক লম্বা। ওর মার মুখে এ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। ওর যখন ১০ বছর বয়স তখন একবার দোকানে গিয়েছিল লকেট বানাতে। সঙ্গে ওর মাও ছিল। দোকানদার যখন ওর বয়স জিজ্ঞেস করল, ও বলল ১৬ বছর। ওর মা অবাক হয়ে গেল। ওকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বয়স বাড়িয়ে বললে কেন? ও বলল, ১০ বছর বললে আমাকে অনেক ছোট ভাববে না?

একটু বয়স হওয়ার পর মাকে প্রায়ই বলত, মা আমাকে দাড়ি রাখলে বেশি ভালো লাগে নাকি শেভ করলে বেশি ভালো লাগে? ওর মা বলত, বাবা তোমাকে সব রকমই ভালো লাগে। ও বলত, আমি দাড়ি রাখব, দাড়িতে একটু Aged (বয়স্ক) লাগে। এবার ৫ সেপ্টেম্বর আনন্দর জন্মদিন নীরবে পার হয়েছে আবারও আসবে। কিন্তু ও আর বড় হতে পারবে না। শুধু ২৩ এপ্রিল এলে বাড়বে ওর না থাকার সময়।

ছোটবেলা থেকেই আনন্দ অনেক বেশি স্পর্শকাতর (Sensitive) ছিল। ওর যখন দুই বছর বয়স তখন বাসায় ভিসিআরে মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত … সিনেমা দেখেছিল। এরপর থেকে সারাদিন বসে বসে ওই সিনেমাটি দেখত আর কাঁদতো। সে কি কান্না তার…। ও যখন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ে তখন মিথিলা নামে এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতো। মিথিলার বাবা ছিল পুলিশের ওসি। সে আনন্দকে মিথিলার সঙ্গে মেলামেশায় বাধা দেয়। আনন্দর কান্না দেখে কে। সারাদিন কাঁদতো, হাত পা কামড়াতো। দেয়ালে মাথা ঠুকতো। একেবারে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল তখন। শেষমেশ ওকে বাঁচানোটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে ওকে পাঠানো হলো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এরকম স্পর্শকাতর ছিল আনন্দ।

মা বাবার সঙ্গে আনন্দর সম্পর্ক ছিল একেবারে আলাদা। আমাদের সময়ে এরকম কোনো উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর। বাবা মা দুজনে ছিল ওর বন্ধুর চেয়েও বেশি। মাকে ডাকতো নাম ধরে, তুমি করে খুব আদুরে স্বরে কথা বলতো মায়ের সাথে। ঘরে ফিরে মাকে দেখলেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে চুমু খেতো। আনন্দর মা কখনো ওর ঘুম ভাঙাতো না। উনি বলেন, আমার ছেলেরা ঘুমিয়ে থাকলে আমার কি যে শান্তি লাগে, কাউকে আমি তা বোঝাতে পারব না। ঘুম ভাঙলে আনন্দ অন্তত এক ঘন্টা ধরে আড়মোড়া ভাঙতো। আমি মাঝে মাঝে মারতাম। তবু ও উঠতে চাইতো না। মা ওকে কখনো বাসা থেকে গাড়ি নিতে দিতো না। ওর মা ভয় পেত। পত্র পত্রিকায় বন্ধুবেশি শয়তানদের নানা গল্প থেকে তার এ ভয়ের জন্ম। উনি বলতেন, গাড়ি নিয়ে গেলে যদি কোনো বন্ধু বান্ধব গাড়ির লোভে ওকে মেরে ফেলে।

আনন্দ গাড়ি নিয়ে বের হয়নি। ২৩ এপ্রিল সকাল থেকে মা ওর জন্য রান্না করছিল। আগের দিন বিরিয়ানি খেতে চেয়েছিল আনন্দ। মা তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিল সকাল থেকে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমাদের আরেক বন্ধু ইরফানকে ও একটা বার্তা (sms) পাঠায়। তারপর ওর গাড়ি নিয়ে বের হবার সম্ভাবনা চিরদিনের মতো শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়েছে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনাও। শত মারলেও আনন্দ আর আড়মোড়া ভেঙে উঠবে না।

আনন্দ আমাকে বলত, ‘তোর লেখার হাত অসাধারণ। এই ক্ষমতা পেলে আমি আর দুনিয়ার অন্য কোনো কাজ করতাম না।’ অথচ আজ এই লেখাটার এতটুকু লিখে আমি অবাক হয়ে দেখছি, যে বন্ধুর সঙ্গে আমার প্রেমের চেয়েও গভীর সম্পর্ক, যার জন্য আমি অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত, সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুর জন্য এ আমি কী লিখলাম। এ তো অতীব দায়সারা গোছের অতি আনুষ্ঠানিক একটি লেখা। হায়! দুর্ভাগ্য আমার…

আনন্দ ছিল আমাদের সময়ের নায়কদের একজন। দেশে যুদ্ধ থাকলে যে হতো মহাবীর, দেশে জ্ঞানচর্চ্চার যুগ চললে যে হতো মহাপণ্ডিত। আজ এই অস্থিরতার যুগে, অনুৎপাদনশীলতার কালে সে হয়েছে ছন্নছাড়া এক যাযাবর। যে কারো দিকে ফিরে তাকায়নি। সব মায়া পাশ কাটিয়ে পা বাড়িয়েছে অজানার দিকে। আমি বুঝেছি বন্ধু, তোর জন্য নৈবেদ্য সাজানোর যোগ্যতা এখনো আমার হয়নি। আমি অপেক্ষা করছি। ‘আমাদের সময়ের নায়ক’ একদিন আমি ঠিকই লিখব। এখনো বেশি কিছু করতে পারিনি। তবে শুরুটা লিখে ফেলেছি।

‘‘তোর কাছে আমার একটা নালিশ আছে। তুই মারা যাবার পর শুনেছি তোর বাবা তোর নামে মিলাদ দিয়েছে। এটা আমি সহ্য করতে পারিনি। নিজে বাধাও দিতে পারিনি। তাই তোর কাছে আমার এই নালিশ…’’

[আনন্দ মুক্তমনায় ঈশ্বরহীন নামে লিখত।]