(ষষ্ঠ পর্বের পর…)

মনুশাস্ত্রে স্ত্রীর কর্তব্য
বিবাহ নামক নারী-সংগ্রহ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত যে নারীটিকে শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী পুরুষের ব্যক্তি-মালিকানায় রক্ষিতা বানানো হয়েছে, সেই নারীকে বহুমাত্রিক ভোগ-ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ণতৃপ্তি বা সন্তোষ না পেলে পুরুষতন্ত্রের সার্থকতা থাকে না। বর্ণ-নির্বিশেষে নারী সামাজিকভাবে শূদ্রধর্মীতার কারণেই শ্রম বা উৎপাদন-যন্ত্রবিশেষ, পুরুষের উপভোগ্য দেহধারণের কারণে নারী ভোগ্যসামগ্রি এবং গর্ভধারণকারী প্রজননযন্ত্রের কারণে নারী সন্তান উৎপাদনকারী জৈবযন্ত্র ইত্যাদি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাই এধরনের যাবতীয় প্রয়োজনের নিরীখে নারী যাতে কিছুতেই অব্যবহার্য না থাকে সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্র সদাসতর্ক থেকেছে সবসময়-

‘অপত্যং ধর্মকার্যাণি শুশ্রূষা রতিরুত্তমা।
দারাধীনস্তুথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ।।’
সন্তানের উৎপাদন, অগ্নিহোত্রাদি ধর্মকর্ম সম্পাদন, পরিচর্যা, উত্তম রতি, পিতৃগণের এবং স্বামীর নিজের সন্তানের মাধ্যমে স্বর্গলাভ- এ সব কাজ পত্নীর দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়। (৯/২৮)।

যেহেতু নারীমাত্রেই জৈবযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত, তাই তাকে সর্বদাই সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাখা উচিত। এজন্যেই মনুর নির্দেশ-

‘অনৃতাবৃতুকালে চ মন্ত্রসংস্কারকৃৎ পতিঃ।
সুখস্য নিত্যং দাতেহ পরলোকে চ যোষিতঃ।।’
পতি মন্ত্রের মাধ্যমে বিবাহ-সংস্কার করেন। তাই তিনি ঋতুকালেই হোক বা ঋতুভিন্ন কালেই হোক, ভার্যাতে গমন করবেন এবং এইভাবে তিনি স্ত্রীর ইহলোকে ও পরলোকে সকল সময়েই তার সুখপ্রদান করেন [যেহেতু পতির সাথেই স্ত্রীর ধর্মকর্ম করার অধিকার, আর তার ফলেই স্বর্গাদি ফল লাভ করা যায়, এই জন্য স্বামীকে স্ত্রীর ‘পরলোকের সুখদাতা’ বলা হয়েছে]। (৫/১৫৩)।

তবে-

‘ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরতঃ সদা।
পর্ববর্জং ব্রজেচ্চৈনাং তদ্ব্রতো রতিকাম্যয়া।।’
ঋতুকালে অবশ্যই পত্নীর সাথে মিলিত হবে, সকল সময় পত্নীর প্রতি অনুরক্ত থাকবে; পত্নীর রতিকামনা হলে তা পূরণ করার জন্য (অমাবস্যা, অষ্টমী, পৌর্ণমাসী, চতুর্দশী প্রভৃতি) পর্বদিন বাদ দিয়ে ঋতুকাল ছাড়াও অন্য দিনে স্ত্রীর সাথে উপগত হতে পারবে। (৩/৪৫)।

এক্ষেত্রে নারীর স্বাভাবিক ঋতুকালও মনু কর্তৃক চিহ্নিত করা হয়েছে-

‘ঋতুঃ স্বাভাবিকঃ স্ত্রীণাং রাত্রয়ঃ ষোড়শ স্মৃতাঃ।
চতুর্ভিরিতরৈঃ সার্দ্ধমহোভিঃ সদ্বিগর্হিতৈঃ।।’
স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক ঋতুকাল হলো (প্রতিমাসে) ষোল দিনরাত্রিব্যাপী। এগুলির মধ্যে (শোণিত-স্রাব-যুক্ত) চারটি দিন-রাত্রি সজ্জনগণকর্তৃক অতিশয় নিন্দিত। (৩/৪৬)।
.
‘তাসামাদ্যাশ্চতস্রস্তু নিন্দিতৈকাদশী চ যা।
ত্রয়োদশী চ শেষাস্তু প্রশস্তা দশ রাত্রয়ঃ।।’
ঐ ষোলটি রাত্রির মধ্যে প্রথম চারটি রাত্রি (প্রথম শোণিত দর্শন থেকে চারটি রাত্রি), ষোলটি রাত্রির মধ্যগত একাদশ ও ত্রয়োদশ সংখ্যক রাত্রি- এই ছয়টি রাত্রি ঋতুমতী ভার্যার সাথে সঙ্গম নিন্দিত; এবং এ ছাড়া অবশিষ্ট দশটি রাত্রি প্রশস্ত। (৩/৪৭)।

এখানে প্রশস্ত দশটি রাত্রি চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, সন্তান উৎপাদনের নিমিত্তেই নারীকে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তবে পুত্রসন্তান উৎপাদনই যেহেতু পুরুষের প্রধান আগ্রহ, তাই আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে-

‘যুগ্মাসু পুত্রা জায়ন্তে স্ত্রিয়োহযুগ্মাসু রাত্রিষু।
তস্মাদ্যুগ্মাসু পুত্রার্থী সংবিশেদার্তবে স্ত্রিয়ম্।।’
ঐ দশটি রাত্রির মধ্যে যেগুলি যুগ্মরাত্রি সেগুলিতে অর্থাৎ ষষ্ঠী, অষ্টমী, দশমী, দ্বাদশী, চতুর্দশী ও ষোড়শী এই রাত্রিগুলিতে স্ত্রীগমন করলে পুত্রসন্তান জন্মে। আর পঞ্চমী, সপ্তমী, নবমী প্রভৃতি অযুগ্মরাত্রিগুলিতে স্ত্রীগমন করলে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। অতএব পুত্রলাভেচ্ছু ব্যক্তি ঋতুকালের মধ্যে যুগ্মরাত্রিতেই স্ত্রীর সাথে মিলিত হবে। (৩/৪৮)।

অর্থাৎ পুরুষাধিপত্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে নির্দিষ্ট কতকগুলো দিনে ঘোষিত বিধিবিধান মোতাবেক যৌনক্রিয়ায় বাধ্য করা হচ্ছে তো বটেই, তবুও পুত্রসন্তানের জন্ম না হয়ে যদি কন্যা বা কীব সন্তান জন্মে সেক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু কুযুক্তি আরোপ করে নারীকেই দায়ী করা হচ্ছে-

‘পুমান্ পুংসোহধিকে শুক্রে স্ত্রী ভবত্যধিকে স্ত্রিয়াঃ।
সমেহপুমান্ পুংস্ত্রিয়ৌ বা ক্ষীণেহল্পে চ বিপর্যয়ঃ।।’
মৈথুনকর্মে প্রবৃত্ত হয়ে স্ত্রীগর্ভে শুক্রনিষেক করার পর পুরুষের রেতঃ ও স্ত্রীর গর্ভস্থ শোণিত (এই দুটিকে অর্থাৎ পুরুষের রেতঃ ও স্ত্রীলোকের গর্ভস্থ শোণিতকে ‘শুক্র’ বা বীর্য বলা হয়) যখন মিশ্রিত হয়ে যায়, তখন পুরুষের বীর্যাধিক্য হলে (শুক্রের আধিক্য কথাটির অর্থ পরিমাণতঃ আধিক্য বা অধিক পরিমাণ নয়, কিন্তু সারতঃ আধিক্য বুঝায়) অযুগ্ম রাত্রিতেও পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। আবার স্ত্রীর বীর্যাধিক্য হলে (অর্থাৎ স্ত্রীর গর্ভস্থ শোণিতভাগ সারতঃ বেশি হলে) যুগ্ম রাত্রিতেও কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। আর যদি উভয়ের বীর্য (শুক্র ও শোণিত) সমান সমান হয় তাহলে অপুমান্ (নপুংসক) জন্মায় অথবা যমজ পুত্র-কন্যা জন্মায়। কিন্তু উভয়েরই বীর্য যদি ক্ষীণ অর্থাৎ অসার বা অল্প হয়, তাহলে বৃথা হয়ে যায়, গর্ভ উৎপন্ন হয় না। (৩/৪৯)।

রতিক্রিয়ায় পুত্র জন্মালে তা পুরুষেরই কৃতিত্ব। অন্যদিকে পুত্র না হয়ে ভিন্ন ফল হলে নারীর শারীরতাত্ত্বিক কুপ্রভাবই দায়ী বলে গণ্য হয়। এতে করে এই পুরুষতান্ত্রিক ভ্রষ্টদর্শনের দায় কাঁধে নিয়ে নারীকেই হীনম্মন্যতায় ভোগে পুরুষের নির্যাতন দণ্ড ভোগ করতে হয়। কেননা পুত্রদর্শনের অনিবার্যতায় শাস্ত্রবিধি পুরুষকে একাধিক দারপরিগ্রহে প্ররোচিত করে। এক্ষেত্রে ল্ক্ষ্যণীয় যে, পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা শান্ত্রানুমোদিত থাকায় শাস্ত্রবিধির শুভঙ্করী হিসাবে পুরুষ ঘুরে ঘুরে কোন না কোন স্ত্রীর ঋতুকালের যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে গোটা মাসই রতিসুখ লাভ করলেও সর্বোচ্চ গুটিকয় দিন বাদে বাকী সময় একজন নারীর জৈবমানসিক চাহিদা অতৃপ্ত বা অস্বীকৃত থেকে যায়। অর্থাৎ তার যৌনস্বাধীনতাও এক্ষেত্রে বঞ্চিত বা অবহেলিত হয়। এরপরও স্ত্রীলোকের প্রতি মনুর উপদেশ বর্ষণে কার্পণ্য নেই-

‘সদা প্রহৃষ্টয়া ভাব্যং গৃহকার্যেষু দক্ষয়া।
গুসংস্কৃতোপস্করয়া ব্যয়ে চামুক্তহস্তয়া।।’
স্ত্রীলোক সকল সময়েই হৃষ্টচিত্ত হয়ে থাকবে, গৃহের কাজে দক্ষ হবে, গৃহসামগ্রিগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং অর্থব্যয়-বিষয়ে মুক্তহস্ত হবে না। (৫/১৫০)।

এবং শুধু স্বামীর মনোরঞ্জন এবং তাঁকে আকৃষ্ট করার জন্যেই স্ত্রীকে সেজেগুজে থাকতে হয়। কেননা-

‘যদি হি স্ত্রী ন রোচেত পুমাংসং ন প্রমোদয়েৎ।
অপ্রমোদাৎ পুনঃ পুংসঃ প্রজনং ন প্রবর্ততে।।’
শোভাজনক বস্ত্র-আভরণাদির দ্বারা যদি নারী দীপ্তিমতি না হয় (বা যদি তার তৃপ্তিবিধান না করা হয়), তাহলে সেই স্ত্রী পতিকে কোনও রকম আনন্দ দিতে পারে না। ফলে, স্ত্রী পতির প্রীতি জন্মাতে না পারলে সন্তানোৎপাদন সম্ভব হয় না। (৩/৬১)।

অর্থাৎ স্বামীর ইহলোক-পরলোকের মোক্ষলাভ করতে সন্তানোৎপাদনের দায়ও শেষপর্যন্ত নারীর উপরই বর্তায়। কেননা সন্তান উৎপাদন না হলে বা স্ত্রীর প্রতি স্বামীকে আকৃষ্ট করতে বা প্রীতি জন্মাতে না পারলে বা রুষ্ট হলে স্বামীটি যৌনতৃপ্তির খোঁজে পুনর্বিবাহ করে আরেকটি যৌনসম্পর্ক স্থাপন করবে।

‘বন্ধ্যাষ্টমেহধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা।
একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্ত¡প্রিয়বাদিনী।।’
নারী বন্ধ্যা হলে আদ্য ঋতুদর্শন থেকে অষ্টম বৎসরে অন্য একটি বিবাহ করবে, মৃতবৎসা হলে দশম বৎসরে, কেবল কন্যাসন্তান প্রসব করতে থাকলে একাদশ বৎসরে এবং অপ্রিয়বাদিনী হলে সদ্য সদ্যই অধিবেদন করবে অর্থাৎ অন্য বিবাহ করবে। (৯/৮১)।

কী সাংঘাতিক কথা ! নারীর এই অপ্রিয়বাদিতা যেহেতু কেবল স্বামী ব্যক্তিটির নিজস্ব রুচি বা মনোবাঞ্ছার উপরই সম্পূর্ণত নির্ভরশীল, তাই নিশ্চিন্তে আশঙ্কামুক্ত হয়ে নারীর মানসিক স্থিরতা পাওয়ার বা দু’দণ্ড বিশ্রামের কোন উপায় নেই। গৃহের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করেও নারীকে সারাক্ষণই স্বামীদেবতার মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলেই যে স্বামী অন্য নারীর খোঁজে বেরিয়ে যাবে-

‘যা রোগিণী স্যাৎ তু হিতা সম্পন্না চৈব শীলতাঃ।
সানুজ্ঞাপ্যাধিবেত্তব্যা নাবমান্যা চ কর্হিচিৎ।।’
স্ত্রী যদি রোগগ্রস্তা হয় অথচ শীলসম্পন্না এবং স্বামীর হিতকারিণী, তা হলে তার অনুমতি নিয়ে স্বামী অন্য বিবাহ করবে, তাকে কোনক্রমেই অপমান করা চলবে না। (৯/৮২)।

কিন্তু নারীর সেরূপ কোন যাবার জায়গা নেই। কেননা-

‘যস্মৈ দদ্যাৎ পিতা ত্বেনাং ভ্রাতা বানুমতে পিতুঃ।
তং শুশ্রূষেত জীবন্তং সংস্থিতং চ ন লঙ্ঘয়েৎ।।’
পিতা নিজে যাকে কন্যা সম্প্রদান করবেন অথবা পিতার অনুমতিক্রমে ভ্রাতা যার হাতে নিজ ভগ্নীকে সম্প্রদান করবে, সেই স্বামী যতদিন জীবিত থাকবে, ততদিন ঐ স্ত্রী তার শুশ্রূষা করবে এবং স্বামী সংস্থিত অর্থাৎ মৃত হলেও সে ব্যভিচারাদির দ্বারা বা শ্রাদ্ধতর্পণাদি না করে সেই স্বামীকে অবহেলা করবে না। (৫/১৫১)।

আবার স্বামী অধিবেদন অর্থাৎ আরেকটি বিয়ে করলেও পূর্ব-স্ত্রীর তা মেনে নেয়া ছাড়াও কোন উপায় থাকে না-

‘অধিবিন্না তু যা নারী নির্গচ্ছেদ্রুষিতা গৃহাৎ।
সা সদ্যঃ সন্নিরোদ্ধব্যা ত্যাজ্যা বা কুলসন্নিধৌ।।’
অধিবেদন করা হয়েছে বলে যে স্ত্রী ক্রোধে গৃহ থেকে চলে যাবে তাকে তখনই গৃহমধ্যে আবদ্ধ করে রাখবে অথবা তার পিতা প্রভৃতি আত্মীয়ের নিকট রেখে আসবে। (৯/৮৩)।
.
‘সংবৎসরং প্রতীক্ষেত দ্বিষন্তীং যোষিতং পতিঃ।
ঊর্দ্ধং সংবৎসরাত্ত্বেনাং দায়ং হৃত্বা না সংবসেৎ।।’
স্ত্রী যদি পতিদ্বেষিণী হয় তা হলে স্বামী তার জন্য এক বৎসর অপেক্ষা করবে। এক বৎসরের মধ্যে তার দ্বেষভাব বিগত না হলে তার অলঙ্কারাদি কেড়ে নিয়ে তার সাথে আর বসবাস করবে না। (৯/৭৭)।

এই রেখে আসা বা সাথে বসবাস না করার অর্থ এমন নয় যে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অবহেলায় তাকে পরিত্যক্ত করা হয়েছে, কিন্তু শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী তার মালিকানা স্বামীপ্রভুটিরই থেকে যাচ্ছে। ফলে আত্মীয়দের গলগ্রহ হয়ে থাকলেও নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার শাস্ত্রিয় অধিকারে নেই। কেননা-

‘ন নিষ্ক্রয়বিসর্গাভ্যাং ভর্তুর্ভার্যা বিমুচ্যতে।
এবং ধর্মং বিজানমিঃ প্রাক্ প্রজাপতিনির্মিতম্।।’
দান, বিক্রয়, বা পরিত্যাগের দ্বারা ভার্যা স্বামী থেকে সম্বন্ধচ্যুত হতে পারে না। প্রজাপতি-কর্তৃক এইরূপ ধর্মই সৃষ্টিকালে নির্দিষ্ট হয়েছে বলে আমরা জানি। (৯/৪৬)।

ফলে পুরুষতান্ত্রিকতার তীব্র যাতাকলে পরাধীন নারীকে এভাবে প্রতিনিয়ত পর্যুদস্ত হয়েই থাকতে হয়। ফলে যা কিছুই ঘটুক না কেন, স্বামীসেবাই হয়ে যায় আমৃত্যু নারীর পরম ধর্ম-

‘বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈ র্বা পরিবর্জিতঃ।
উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।।’
স্বামী বিশীল (অর্থাৎ জুয়াখেলা প্রভৃতিতে আসক্ত এবং সদাচারশূন্য), কামবৃত্ত (অর্থাৎ অন্য স্ত্রীতে অনুরক্ত) এবং শাস্ত্রাধ্যায়নাদি ও ধনদানাদি গুণবিহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রীর কর্তব্য হল স্বামীকে দেবতার মতো সেবা করা। (৫/১৫৪)।

এবং সাধ্বী স্ত্রী কাকে বলা হয় তাও মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া আছে-

‘পতিং যা নাভিচরতি মনোবাগ্দেহসংযতা।
সা ভর্তৃলোকানাপ্লোতি সদ্ভিঃ সাধ্বীতি চোচ্যতে।।’
যে স্ত্রী কায়মনোবাক্যে সংযত থেকে পতিকে অতিক্রম করে না, সে ভর্তৃলোকে গমন করে এবং সাধু লোকেরা তাকে ‘সাধ্বী’ বলে প্রশংসা করে। (৫/১৬৫)।

তাই-

‘পাণিগ্রাহস্য সাধ্বী স্ত্রী জীবতো বা মৃতস্য বা।
পতিলোকমভীপ্সন্তী নাচরেৎ কিঞ্চিদপ্রিয়ম্।।’
সাধ্বী স্ত্রী যদি পতিলোক [অর্থাৎ পতির সাথে ধর্মানুষ্ঠান করে যে স্বর্গাদি লোক অর্জন করা যায়, সেই পতিলোক] লাভ করতে ইচ্ছা করে, তাহলে যে ব্যক্তি তার পাণিগ্রহণ করেছে তার জীবিতকালেই হোক বা তার মৃত্যুর পরেই হোক তার কোনও অপ্রিয় কাজ সে করবে না। (৫/১৫৬)।

এখানে হয়তো কূট-প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে যে, স্ত্রী যদি নিতান্তই বর্তমান বিশিল বা কামবৃত্ত পতির প্রতি অনাগ্রহহেতু পতিলোক লাভে ইচ্ছুক না হয় ? এরকম প্রশ্ন বৈদিক সমাজে প্রযোজ্য হওয়ার কোন সুযোগই নেই আসলে। কেননা নারীর নিজস্ব কোন ইচ্ছা থাকতে পারে তা পিতৃতান্ত্রিক মনুশাস্ত্রে সম্পূর্ণতই অস্বীকার করা হয়েছে। পুরুষের অনুগামী হওয়াই নারীর জন্য অনিবার্য ও বাধ্যতামূলক। তবে একজন নারীর জন্য এই অনুগামীতাও কেবল একজন পুরুষের দিকেই, যিনি তার পতি হবেন। সেই পতিদেবটি যদি বিশীল কিংবা সন্তানদানে অক্ষমও হয়, তবুও নারীর তাকে ছেড়ে যাবার উপায় নেই-

‘অপত্যলোভাদ্ যা তু স্ত্রী ভর্তারমতিবর্ততে।
সেহ নিন্দামবাপ্লোতি পতিলোকাচ্চ হীয়তে।।’
যে স্ত্রী সন্তানের লোভে স্বামীর অতিবর্তন করে অর্থাৎ স্বামীকে লঙ্ঘন করে এবং পরপুরুষের সাথে সংসর্গ করে, সে ইহলোকে নিন্দা বা লোকাপবাদ প্রাপ্ত হয় এবং পরলোক থেকেও বঞ্চিত হয় (অর্থাৎ স্বর্গলাভ করতে পারে না)। (৫/১৬১)।
.
‘নান্যোৎপন্না প্রজাস্তীহ ন চাপ্যন্যপরিগ্রহে।
ন দ্বিতীয়শ্চ সাধ্বীনাং ক্বচিদ্ভর্তোপদিশ্যতে।।’
(নিয়োগপ্রথা ব্যতিরেকে) পরপুরুষের দ্বারা উৎপাদিত সন্তান কোনও নারীর নিজসন্তান হতে পারে না; সেইরকম যে নারী নিজের পত্নী নয় তার গর্ভে উৎপাদিত পুত্রও কোনও পুরুষের নিজপুত্র হতে পারে না। সাধ্বী স্ত্রীদের দ্বিতীয় পতিগ্রহণের উপদেশ নেই। (৫/১৬২)।

তাই পতি মারা গেলেও স্ত্রীর কর্তব্য হচ্ছে-

‘কামং তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।
ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।।’
পতি মৃত হলে স্ত্রী বরং পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি অল্পাহারের দ্বারা জীবন ক্ষয় করবে, কিন্তু ব্যভিচারবুদ্ধিতে পরপুরুষের নামোচ্চারণও করবে না। (৫/১৫৭)।

অর্থাৎ নারীর সহজাত মাতৃত্বসত্তার স্বীকার তো দূরের কথা, তার কোন জৈবিক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, মনুশাস্ত্রে তাও স্বীকৃত হয়নি। কেননা মনুশাস্ত্রে নারীর দ্বিতীয় পতিগ্রহণের উপদেশ নেই। অথচ পুরুষের কামচরিতার্থতার প্রয়োজনকে কিন্তু কোনভাবেই অস্বীকার করা হচ্ছে না। বরং পুরুষের জন্য পবিত্র বিধানও তৈরি করে দেয়া হয়েছে-

‘ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি।
পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ।।’
(সুশীলা-) ভার্যা স্বামীর পূর্বে মারা গেলে তার দাহাদি অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে পুরুষ পুনরায় দারপরিগ্রহ ও অগ্ন্যাধ্যান করবে (যদি ধর্মানুষ্ঠান ও কামচরিতার্থতার প্রয়োজন থাকে, তবেই ঐ স্বামীর পুনরায় দারপরিগ্রহ করা উচিৎ। তা না হলে পত্নী নেই বলে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস অবলম্বন করতে পারে)। (৫/১৬৮)।
.
‘অনেন বিধিনা নিত্যং পঞ্চযজ্ঞান্ ন হাপয়েৎ।
দ্বিতীয়মায়ুষো ভাগং কৃতদারো গৃহে বসেৎ।।’
পূর্বোক্ত বিধানানুসারে কোনও সময়ে পঞ্চযজ্ঞ পরিত্যাগ করবে না এবং দারপরিগ্রহ করে পরমায়ুর দ্বিতীয়ভাগে গৃহাশ্রমে বাস করবে। (৫/১৬৯)।

আবার বৈদিক সমাজে নারী অত্যন্ত সহজলভ্য বলেই নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্র কতোটা অবহেলাপরায়ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে তার নমুনাও মনুশান্ত্রে বিরল নয়-

‘বিধায় প্রোষিতে বৃত্তিং জীবেন্নিয়মমাস্থিতা।
প্রোষিতে ত্ববিধায়ৈব জীবেচ্ছিল্পৈরগর্হিতৈঃ।।’
স্বামী যদি গ্রাসাচ্ছাদনাদির ব্যবস্থা করে দিয়ে বিদেশে বসবাস করতে যায়, স্ত্রীর কর্তব্য হবে- নিয়ম অবলম্বন করে থাকা [যেমন, স্বামী কাছে থাকলে পরের বাড়ীতে গিয়ে থাকা প্রভৃতি স্ত্রীর পক্ষে নিষিদ্ধ, তেমনি স্বামী প্রোষিত হলেও ঐ সব নিয়ম গ্রহণ করে কালাতিপাত করবে], আর যদি বৃত্তির ব্যবস্থা না করেই স্বামী বিদেশে অবস্থান করে, তাহলে সূতা কাটা প্রভৃতি অনিন্দিত শিল্পকর্মের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করবে। (৯/৭৫)।
.
প্রোষিতো ধর্মকার্যার্থং প্রতীক্ষ্যোহষ্টৌ নরঃ সমাঃ।
বিদ্যার্থং ষড্যশোহর্থং বা কামার্থং ত্রীংস্তু বৎসরান্।।’
স্বামী যদি ধর্মকার্যের জন্য বিদেশে গিয়ে বাস করে তা হলে আট বৎসর, বিদ্যার্জনের জন্য বিদেশে গেলে ছয় বৎসর, যশোলাভের জন্য গেলে ছয় বৎসর এবং কামোপভোগের জন্য বিদেশ গেলে তিন বৎসর স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করবে। (৯/৭৬)।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপেক্ষা পূর্ণ হবার পর নারীর কর্তব্য কী হবে ? এখানে মনু উত্তরহীন হলেও অন্যত্র এই কর্তব্যবিধান দেয়াই আছে। যেহেতু নারীর পুনর্বিবাহ বৈধ নয়, যেহেতু নারীর পরপুরুষের চিন্তা করাও নিষিদ্ধ এবং যেহেতু নারীর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক গন্তব্য হিসেবে একজন স্বামীই নির্দেশিত, তাই ধরেই নিতে হয় যে একজন স্বামীদেবতার তিলকচিহ্ন ধারণ করে নারীটি আসলে পরিত্যক্তাই। এবং স্পষ্টতই তার গন্তব্য বিধবা-নির্দিষ্ট পথেই। অথচ যে স্বামীটি কর্তৃক এই নারী পরিত্যক্তাবস্থায় নিক্ষিপ্ত হলো, হয়তো সেই স্বামীদেবতা বিদেশে তখন শাস্ত্রবিধি অনুসারেই আরো একাধিক স্ত্রী নিয়ে লীলায় মত্ত রয়েছে।
.
মোটকথা মনুশান্ত্রে নারী শুধু ভোগ্য ও ব্যবহার্যই কেবল, কিন্তু কোন ইতিবাচক ফলাফলের অধিকারিণী সে নয়। সেখানে পুরুষই কর্তৃত্বপরায়ণ। আর এই পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রশ্নহীন ও যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যেই নিরূপায় নারী যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাই নারীর পরম ধর্ম ও কর্তব্য হিসেবে কীর্তিত হয়েছে কেবল।

(চলবে…)
[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [৩য় পর্ব] [৪র্থ পর্ব] [৫ম পর্ব ] [৬ষ্ঠ পর্ব] [*] [৮ম পর্ব ]