আব্বু প্রায় চার বছর ধরে আমার বিয়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত (আমার সৌভাগ্যও) আব্বুর ইচ্ছেটা পূর্ণ হচ্ছে না। একসময় আমি পড়াশুনা করতে চেয়ে বলেছিলাম বিয়ে করব না। আব্বুর বিরোধিতা সত্ত্বেও আম্মি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিয়েছিল। আজ স্নাতকোত্তর পরার পরও যোগ্য পাত্র জুটছে না। অনেকেই জানে, আমি ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করেছি । এখনো গবেষণা করছি । তাদেরই কারো মুখে সেই কথা শুনে যে দু একজন আগ্রহ দেখাচ্ছে তারাও কেন জানি না হাত গুটিয়ে নিচ্ছে (আসলে জানি !)। আজ আমি কয়েকদিন আগের একটা মজার ঘটনা শোনাবো তোমাদের।
তার আগে বলে নিই ,আমার আব্বু ও আম্মি দুজনেই ধর্মপ্রাণ মানুষ। অবশ্য দুজনের কাছে ধর্মের সংজ্ঞাটা আলাদা। আব্বু খুব অর্থোডক্স মুসলিম। আমার উচ্চশিক্ষা উনার খুব একটা ভালো লাগেনি। আম্মির কাছে ধর্ম ধর্মের জায়গা তে, আর বাস্তবকেও তিনি কখনো অস্বীকার করেন নি । তাই কখনো দেখিনি আমার অবিশ্বাস কে তিরস্কার করতে বা হুমায়ুন আজাদ এর বই কে ঘৃণা করতে । কিম্বা কোন হিন্দু কে অসম্মান করতে । আমাকে তিনি সর্বদায় মানুষ কে সম্মান করতে শিখিয়েছেন। বলেছেন ওইটাই যথেষ্ট ।
সেদিন এক পাত্রের বাপ এলো আমাকে দেখতে। ভদ্রলোক কে দেখেই মনে হল গোঁড়া মুসলিম । আমি ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা করছি জেনে তিনি খুব আগ্রহ নিয়েই এসেছিলেন। সোফা তে একদিকে আব্বু আর একদিকে তিনি বসে কথা বলছিলেন । কিছুক্ষণ পরে আমার পরীক্ষার ক্ষণ এলো । আমি যথা রীতি আম্মির কথা মতো ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে । তিনি আমায় বসতে বললেন । কিন্তু আব্বুর সাথে গল্প থামালেন না । আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার । ব্যাঙ্গালরে থাকে। ৭৫০০০ স্যালারি । ওখানেই ফ্ল্যাট ,গাড়ি বছরে তিন চার বার আসে । এবং ছেলের আরও অনেক গুনের কথা । আমি চুপচাপ শুনছিলাম মাথা নিচু করে । পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক সেই সময়েই আম্মির ডাক—–
“ও রিয়াযের আব্বু । একটু শুনে যাও।”
আব্বু উনাকে একটু আসি বলে উঠে চলে গেলেন পাসের ঘরে । আমি বসে রইলাম । উনি আমার সাথে কথা সুরু করলেন । আমি কোথায় পড়াশুনা করেছি , কোন ইয়ার,এই জানো সেই জানো …ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করার পর তিনি ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলেন…
___আচ্ছা বেটি তুমি রোজ ৫ ওয়াক্ত নামায পড়ো তো?
আমি বললাম, “ না”।
উনি একটু অবাক হলেন । বুঝলাম, এই উত্তরের ন্যুনতম সম্ভাবনাও তিনি আসা করেন নি ।
____ তুমি ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা কর নি?
___ হ্যাঁ।
____তুমি আল্লাহ মানো না? আল্লাহ কে ভয় কর না?
____ না।
উনি থমথমে মুখ করে চুপ রইলেন । নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলেন বোধ হয় । এবার নিজেকে খানিকটা সংযত করে আমার সাহস টা অসহ্য হলেও সহ্য করে নিয়ে বললেন—-
“তুমি কি ধরম নিয়েই গবেষণা করছ এখন ?”
—হ্যাঁ।
___ তা তমার বিষয় টা কি? থিওলজি না ইসলাম স্টাডিজ ?
________তুলনামূলক ধর্ম (কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন)।
______তুমি কি সেইটা নিয়েই গবেষণা করছ ?
——–না । খানিক তা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম । বিষয় টা ফিলসফি বা কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন দুটোর ই অন্তর্ভুক্ত ।
—–তা ভাল । তা কোন ধর্ম তোমার সবচেয়ে পছন্দের ?
——-কোন ধর্মই নয় ।
—-কেন, কোরআন পড়ো নি ? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলাম ই একমাত্র ধর্ম । কোরআনে আল্লাহ তালাহ ও জানিয়েছেন সেকথা । এটাই পৃথিবীর সমস্ত রকম জীবন চর্যার মধ্যে একমাত্র পূর্নাঙ্গ জীবন চর্যার পদ্ধতি । আমরা গর্বিত যে আমরা by birth মুসলিম তুমি এটাকেও মানো না ?!!
_______ দুঃখিত । আপনার ধারনা একটু ভুল । আসলে পৃথিবীর সমস্ত ধরমের লোকেরাই দাবি করে যে একমাত্র তাদের জীবন চর্যার পদ্ধতি ই পূর্নাঙ্গ । স্বাভাবিক ভাবে আপনিও করছেন। দাবি সকলেই করে কিন্তু কোন ধর্মই আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি কিম্বা কখনই পারবে না যে তাদের জীবন চর্যার পদ্ধতিই পূর্নাঙ্গ ।
উনার মুখ কেমন যেন আর একটু লাল হয়ে গেল । এটা বলা টা যেন আমার অপরাধ হয়ে গেছে । উনি সেই থমথমে ভাব যথাসম্ভব চেপে বললেন… “ তা বেটি , তুমি ত প্রচুর পড়াশুনা করেছ ।আমি আর কি বুঝব ! (আসলে খোঁচা দিলেন ) তা তোমার কি মনে হয় , তুলনামূলক ভাবে কোন ধর্ম টা তোমার সবচেয়ে ভাল বলে মনে হয়েছে ?
—– বৌদ্ধ ধর্ম , আমি বললাম ।
উনি হয়ত এবার আর চুপচাপ থাকতে পারলেন না । বললেন—–
ও তো কাফেরের ধর্ম । ওরা তো কোনও কিছুকেই মানে না ।
——–কিন্তু ওদের চেয়ে আধ্যাত্মিক ধর্ম পৃথিবী তে আর দুটো নেই ।
উনি বিস্মিত সুধু না । মনে হল খুব আশাহতও হলেন। উনি আমাকে আর একটা কথাও জিজ্ঞাসা করলেন না। বললেন ঠিক আছে এস । আর তোমার আব্বা কে পাথিয়ে দাও । আমি অন্য ঘরে চলে এলাম। উনি আব্বুর সাথে কি কথা বললেন জানি না। তারপর খাওয়া দাওয়া করলেন কিন্তু আমার সাথে একটাও কথা বললেন না। তারপর চলে গেলেন। উনাকে ছেড়ে দিয়ে আসার পর আব্বু আমাকে নিয়ে উঠে পরে লাগলেন।
“—আমি যতই চেষ্টা করি তোর জন্য একটা ভালো ছেলেও জুটবে না। তোর মতো কাফির কে কোন ইমানদার মুসলিম ঘরে নেবে? আল্লাহ মানে না! বলি, জাহান্নামে যাবি যে! বলি শুনছো!”
আমি চুপচাপ। রাগে ফেতে যাচ্ছি মনে মনে।
——“ও রিয়াজের আম্মী! এবার তো একটু শেখাও ওকে । নিজে তো সারা জীবন কুফরি করলে। আর এখন মেয়েকেও শেখাচ্ছো! এবার আমার উপর একটু রহম করো! মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আল্লার কাছে কি মুখ দেখাবো? এই ঘরে থেকে আমি দোযখের রাস্তা পরিষ্কার করব না।”
বলে জুতো পায়ে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলো। আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
আমি বুঝলাম আজ আমার বারোটা বাজলো। আব্বু তো বলে টলে বেড়িয়ে গেল। রাতে খাবার সময় ফিরলো। বুঝলাম, এই জামা-আত থেকে ফিরছেন, মহাশয় ! ফিরেই আম্মির উপর হুকুম হল খাবার নিয়ে আসার । আম্মি এতদিন ঘর করছে । গলা শুনেই বুঝে গেছে আজ ঘরে আবার অশান্তি । আমার আর আব্বুর নিত্যদিনের কলহে আম্মিই ভোগে সবচেয়ে বেশি ।
বাড়ি ফিরেই আব্বু সুরু করলো ,“রিয়াজের আম্মি ! বলি শুনছো—-”
আম্মি তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো । আব্বু শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বললেন , “এক কাপ চা পাওয়া যাবে ?”
আম্মি প্রতিদিনের মতই চা করে রেখেছিলেন । চা নিয়ে আব্বুর সামনের টেবিলে চায়ের কাপ টা রাখলেন । আমি পরদিন ফিল্ডে যেতে হবে বলে সেখানকার কাজ নিয়ে একটু তৈরি হচ্ছিলাম । আব্বু প্লেট টা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন , “ তোমার মেয়ের জন্য ভাল পাত্র তো জুটবেই না—” একটু থেমে বললেন , “ এই মেয়ে শেরেক করতে কখন পিছপা হয় না । এই কাফের মেয়ে কে কোন ইমানদার বিয়ে করে দোজখের পথ পরিষ্কার করবে ? কোন ইমানদার মা বাপ তার ছেলের জন্য এমন কাফের, মুনাফেক মেয়ের বিয়ে দিতে চাইবে ?”
আম্মি কখনো আব্বুর কথার উপর কথা বলে না । আম্মি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল চা শেষ হওয়ার আশায়। আব্বু আম্মি কে চুপ থাকতে দেখে বলল , “সব তোমার জন্য ! তোমাকে আমি বারবার বলেছিলাম মুসলিমের ঘরের মেয়ে মাধ্যমিক পাস করেছে ,এবার বিয়ে দিয়ে দাও । তুমি বললে , ‘ও যখন পড়তে চাইছে পড়াও না কিছুদিন ।’ উচ্চ মাধ্যমিকের পর ও বললাম । তুমি বললে, ‘স্কুলে প্রথম হয়েছে । অতনু মাস্টার বললে আপনার মেয়ে অনেক দূর এগুবে , দেখ না পরিয়ে । দেখো ও ঠিক তোমার মুখ একদিন উজ্জ্বল করবে ।’ এরপর বি এ , এম এ , সব পরিয়ে ফেললাম ধর্ম কে আল্লাহ-র বানি কে জলাঞ্জলি দিয়ে । কোন সয়তান আমার উপর ভর করেছিল কে জানে !”
আম্মি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন , “অত চিন্তা কর না । দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে । এত বড় পৃথিবী তে কেউ না কেউ ঠিক জুটে যাবে ।”
আব্বুর গলার স্বর সপ্তমে চড়ে গেলো —– “ এই ‘চিন্তা কর না’ বলে বলেই তুমি আমার মাথা টা খেলে । নিজে তো দোজখের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছ এবার মেয়ে কেও শেখাচ্ছ । মা মেয়ে মিলে ঘর তাকে জাহান্নাম বানিয়ে দাও ! এই জাহান্নামে কি নামাজ রোজা কায়েম হবে ? আমি আর এই ঘরে থাকব না । শুধরাও শুধরাও । এখনো সময় আছে ,একটু শুধরাও নিজেদের —”
আমি বাধ্য হয়ে উঠে এলাম কাজ ফেলে রেখে । আব্বু তখনো আম্মি কে বকতে বকতে বলে চলেছে, “— এত দিন তো মা মেয়ের কুফরি কালামেই গেলো । এবার একটু দ্বীন এর দিকে মুখ ফেরাও। চেষ্টা কর যাতে মরণের পড়ে জান্নাত নসিব হয় ।” আমি অনেকক্ষণ সহ্য করছিলাম । আম্মির মত আদ্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ কে কাফের বলে গালাগালি করছিল বলে মাথা গরম হয়েই ছিল । আমার পড়াশুনা নিয়েও গালাগালি করছিল। যেই জান্নাত জান্নাত বলতে লাগল আমার মেজাজ আর ঠিক থাকল না । চিৎকার করতে করতে সামনে এসে বললাম , “পকেটে রাখো তোমার বেহেস্ত আর জান্নতের গল্প । কি আছে তোমার জান্নাতে যে কোরআন হাদিস মেনে চলতে হবে আমাকে ? সেখানে কি সুযোগ সুবিধা আছে যা এখানে নেই ,বলতে পার ?”
—“কেন পরিস নি কোরআন বুখারি তিরমিযী মুসলিম ? জানিস না কি আছে সেখানে ? আল্লার রহমতে যা চাইবি তাই পাবি সেখানে।”
যা চাই টা যদি পাওয়া যেতো তাহলে আমি কোরআন হাদিস মেনেই চলতাম । আল্লাহ যা দিয়েছে সবই তো ছেলেদের । মেয়েদের জন্য তো আল্লাহ কিছুই রাখেনি জান্নাতে । ছেলে দের জন্য সুরা ,হুরী আর গেলমান । আনন্দ ফুর্তি সেই সব জান্নাতি অদ্ভুত জীব দের সাথে । মেয়েদের জন্য কি আছে ? বলেছে কোরআন হাদিস ? (এর চেয়ে ডিটেল আব্বু কে বলতে পারলাম না ,কিন্তু আমার বক্তব্য তিনি ঠিকই বুঝে যাবে জানতাম , কিন্তু আমার কথা না শুনে উলটে আমাকেই প্রশ্ন করলো)
“—কি চায় কি তোর জান্নাতে ? অনন্তকাল সুখ এর চেয়ে বেশি চাওয়ার কি থাকতে পারে ?”
“______কোথায় বলা আছে সেখানে অনন্ত কাল মেয়েরা সুখ পাবে ? অত জন হুর পরি আর গেলমান দের সাথে নিজের আপন জন কে ভাগ করে নেওয়ার সুখ কি মেয়েরা কখনো চাইতে পারে ? কোরআন হাদিস তুমি একা পড়নি আব্বু ,আমিও পড়েছি । তোমার চেয়ে বেশি ই পড়েছি ।”
“_______হ্যাঁ হ্যাঁ তোর পড়া আমার জানা আছে ।” তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠলো আব্বু ।
আমি বল্লাম , ঠিক আছে ।আমি না হয় জানি না । তুমি বল দেখি । জান্নাতে কি সকল জান্নাতি মানুষের মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয় ?
আব্বু খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো, “ হ্যাঁ” ।
আমি বললাম , “আচ্ছা ধরো আব্বু , আমি যদি আজ থেকে সব ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলি তাহলে আমি জান্নাতে যেতে পারব ? সামনা সামনি আল্লাহ কে দেখতে পাবো?”
আব্বু আবার বলে উঠলো , “ হ্যাঁ ।”
আমি বললাম , “ আমার একটাই ইচ্ছা । আল্লাহ কে সামনা সামনি পেলে দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারতে চাই । ব্যাটা মেয়েদের জন্য শুধু বঞ্চনা রেখে দিয়েছে সারাজীবন। হবে? আমার আসা পূরণ হবে? নাকি হবে না?”
(আব্বু একটু অপ্রস্তুতে পড়ে চুপ করে রইল । কেন না , যদি জান্নাতে আল্লাকে চড় মারার ইচ্ছা পূরণ হয় , তাহলে তো আল্লাহ কে আর পরম উপাস্য অর্থাৎ “আল ইলাহ” বলা যাবে না, যেহেতু তাকে যে কেউ এসে চড় থাপ্পড় মেরে যেতে পারে । কিম্বা আল্লাহ কে সর্বশক্তিমান ও বলা যাবে না যেহেতু তাকে চড় মারার ইচ্ছা করলেও তিনি তা আটকাতে পারবেন না । অন্য দিকে যদি বলা হয় যে আমার এই ইচ্ছা কখনো পূরণ হবে না ।তাহলে আমার কথাই মেনে নিতে হবে , অর্থাৎ মেনে নিতে হবে যে , ষে জান্নাতে সব ইচ্ছা পূরণ হয় না । অবশেষে কয়েক সেকেন্ড ভাবার পর আব্বু তৃতীয় পন্থা বের করলেন ।) যুক্তির দুর্বলতা ঢাকতে একটু গম্ভীর গলায় বললেন , “ জান্নাতে আল্লাহ-র রহমতে এই ইচ্ছাই তোর থাকবে না !”
আমি বললাম , “ তার মানে জান্নাতে আমার স্বাধীন ইচ্ছাও থাকবে না । আমি যা করতে চাই ,যা পেতে চাই তা তো পাবই না ,উলটে নিজের বিচার বুদ্ধি টুকু হারিয়ে আল্লাহ-র পুতুলে পরিণত হব । আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর তিনি সর্বদা হস্তক্ষেপ করবেন ? সেখানে যদি স্বাধীন ইচ্ছা টুকুই না থাকে ,তাহলে তার সুখই বা কি আর তার দুখই বা কি? আমি মানুষ , স্বাধীন ইচ্ছাই আমার স্বাতন্ত্র্য, আমার সত্তা । এটা হারাতে আমি পারব না । জান্নাতেও না , জাহান্নামেও না। তোমার জান্নাতের গল্প যদি সত্যিও হয় তবুও সেখানে যেতে আমার এক বিন্দু আগ্রহ নেই । ”
( আমি একটু থেমে আব্বু কে বলার সুযোগ দিলাম । আব্বু বাইরে ইসলাম নিয়ে বক্তৃতা দিতে পারে কিন্তু আমার সাথে যুক্তি তে কখনই পেরে ওঠে নি । ভুল তত্ত্ব তথ্য আর যুক্তি নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য মানুষ কে প্রভাবিত করা যায় । কিন্তু স্থায়ী ভাবে নয় । আমাকে কখনই ভুল বোঝানোর ক্ষমতা তার নেই, এটা আব্বু খুব ভাল ভাবেই জানে । আব্বু চুপ করেই রইল ,যদিও মুখ চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছিল ।)
——-“ তার চেয়ে আমি রক্ত মাংসের মানুষ । মরার সময় আমি প্রদীপের মত দপ করে নিভে যাবো । তখন আমি আর নেই । এটা ভাবতে আমার ভয় লাগলেও আমি মেনে নিতে প্রস্তুত । তবু গোর আযাব কিম্বা জান্নাত আর জাহান্নাম মেনে নিতে পারব না । যত্ত সব ঈশ্বরবাদীদের দেওয়া গোঁজামিল তত্ত্ব! বোগাস !”
বলতে বলতে কখন আমার গলা চড়ে গিয়েছিল নিজেই বুঝি নি । আমার এই তাচ্ছিল্য ভরা উত্তরে যা হওয়ার ছিল তাই হল । একমাত্র পন্থা যেটা ধার্মিকরা বরাবর করে এসেছে । বলপ্রয়োগ । আব্বু আমার বাঁ গালে এক চড় কষিয়ে বললেন ,
“——–সব তোর ওই কুফরি কালাম চর্চার ফল ! জেনে রাখ বিচারের দিনে এসব কোন কাজে লাগবে না ! ”
গালে আচমকা প্রচণ্ড লাগায় আমার বাঁ হাত টা বাঁ গালে চলে গিয়েছিল । কস্ত পেলেও আনন্দই হচ্ছিল । আব্বুর আবার হারার আনন্দ। ওই অবস্থাতেও হাসি পেয়ে গেলো ।একটু মুচকি হেসে গালে হাত বোলাতে বোলাতে নিজের রুমে চলে গেলাম । বাইরে আব্বু তখনো চিৎকার করেই যাচ্ছিল ।
[285 বার পঠিত]
মহসিনা খাতুন
[/img]
অনেক অনেক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ এইজন্য যে, একজন মেয়ে , সে নিজে যা উপলব্ধি করেছে, পারিবারিক বা সামাজিক কোনো চাপের কাছে মাথা নত না করেই, কোনো রকম মুখোশ না পরেই , ক্ষতির আশংকা জেনেশুনেই, অ-কপট ভাবে সরল করে তার চেতনায় উৎসারিত কন্সেপ্ট অবলীলায় বলেছে। এটা আমরা পারিনা। বহু লোকেই পারিনা। আপনার মতো খুব খুব কম লোকেই এটা পারেন। একজন আস্তিক তার বিশ্বাস প্রসুত বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে গঠিত যুক্তি ( তার নিজের ধারণা মতে খারাপ সংস্কারমুক্ত যুক্তি) প্রসুত ধারণা সদম্ভে প্রকাশ করতে পারে , কারণ তাতে তার স্বার্থে লাভ আছে , কিছু ক্ষেত্রে লাভ না থাকলেও ক্ষতি নেই। চেতনাহীন সমাজ এই উপরিগত পরিকাঠামো তাকে সমর্থিত করেছে, কিন্তু আমার মতো নাস্তিকরা যখন দেখি আমার মনের উপলব্ধি যদি অকপটে বলি তাহলে সম্যক ক্ষতি আছে ;পারিবারিক, সামাজিক, ব্যাবসায়িক, বৈষয়িক সকল ক্ষেত্রেই ক্ষতি আছে ,যেটা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাহলে জাস্ট নীরব থাকি। না বিশ্বাস থাকলেও ঈদ ও বকরিদে ঈদ্গাহে ভড়ং করতে নামাজ পড়তে যাই। দেখি মা আনন্দময়ীর, শ্যামাময়ী, মৃত্তিকা নির্মিত দেহ বা শালগ্রাম শিলা জাস্ট একটা জড় পদার্থ , তবুও পুজোয় মাতি। পাড়ার ধর্মীয় উৎসবে চাঁদা দিই। মসজিদ সংস্কারের জন্য চাঁদা দিই। আমার যুক্তিশীল মননে যা আশু বর্জনীয় বলে মনে হয়, মন না চাইলেও তা করতে হয়। আজো আমরা একটা Rational Society গড়ে তুলতে পারিনি। আপনি একজন মেয়ে হয়ে স্পষ্ট করে যা বলেছেন কোনো ক্ষতির তোয়াক্কা না করে, আমি ছেলে হয়েও আস্তিক সমাজে বসবাস করে, সর্বক্ষেত্রে আমার নাস্তিক মনের প্রকাশ করতে পারিনি আমার পরিবারের ক্ষতির কথা ভেবে, এই মানসিক যন্ত্রণা আমার বিবেককে কুরে কুরে খায়। বড়জোর আমি বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আমার যুক্তি উপস্থাপন করে তাদের নিরস্ত করতে পারি, তারাই আবার তাদের সমাজে আমার কিভাবে ক্ষতি করা যায় সেই চেষ্টা করে। তাই মাঝে মাঝে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিই এই বলে যে কি হবে উলু বনে মুক্তো ছড়িয়ে? আর যখন দেখি আপনাদের মতো কিছু লোক আছেন যারা পারবেন সমাজটাকে শোধরাতে, তাদের কুর্ণিশ জানাই।
[img