(প্রথম অংশটির চিহ্ন)

এরকম আরো কিছু তথ্যভ্রান্তির কথা জেনে নেই প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে।
‘প্রফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ (ফাল্গুন, ১৩৭১) গল্পে তিনি জানাচ্ছেন, “লেমিং এক আশ্চর্য প্রাণী। বছরের কোনও একটা সময় এরা কাতারে কাতারে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে যাত্রা করে। পথে শেয়াল, নেকড়ে, ঈগল পাখি ইত্যাদির আক্রমণ অগ্রাহ্য করে খেতের ফসল নিঃশেষ করে, সব শেষে সমুদ্রে পৌঁছে সেই সমুদ্রের জলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে!” [৫০] এমনকি গল্পের একটি প্রাণিবিজ্ঞানী চরিত্র, আর্চিবল্ড অ্যাকরয়েড, শেষমেষ লেমিংদের সাথেই আত্মহত্যা করার জন্যে প্রস্তুতি নেন।

আমিও অনেকদিন ধরে এটাই বিশ্বাস করে আসছিলাম, হয়তো আমার মতো এমনি এই গল্পের হাজারো পাঠকও। অবশ্য, এই দোষ স্রেফ সত্যজিতের ওপর আমরা চাপাতে চাই না, শুধু এইটুকু বলতে চাই যে তিনিও বিভ্রান্ত হয়েছেন অন্য অনেকের মতো।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে লেখা এই গল্প বলে হয়তো তাঁর জানার উপায় অন্তত তখন ছিলো না যে বিবর্তনের মূল ধারার সাথে অসমঞ্জস এই প্রচলিত কাহিনিটি একটি লোককথা মাত্র। বস্তুত, আসল ঘটনা মোটেও এমন নয়।

আসুন, একটি বহুশ্রুত অবৈজ্ঞানিক ঘটনার পেছনকার বাস্তবতাটি জানা যাক।

লেমিং একটি ইঁদুরগোছের রোডেন্ট গোত্রের প্রাণী। এদের নিবাস মূলত আর্কটিক অঞ্চলে। কানাডা, নরওয়ে, আলাস্কা ইত্যাদি এলাকায় এদের পাওয়া যায় বহুল পরিমাণে। কখনো কখনো এদের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। আর তখন, সত্যজিৎ যেমনটা বলেছেন, ধারণা করা হয় তারা দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে পড়ে তাদের বাসস্থান থেকে আর আত্মহত্যা করে দল বেঁধে। এই আচরণ ইংরেজি ভাষায় “Lemming Suicide Plunge” নামে অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে আত্মহত্যার (মূলত রূপকার্থে) সমার্থক বাগধারা তৈরি করেছে যা বাংলায় ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’-এর সমধর্মী। এই ধারণা এতোটাই দৃঢ়ভিত্তি পেয়েছে যে ১৯৯১ সালে ‘লেমিংস’ নামের একটা ভিডিও গেমই তৈরি হয় যেটায় খেলোয়াড়কে লেমিংদের খাড়া চড়াই থেকে পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে হয়। জিএমটি গেমস ২০১০ সালে ‘লিপিং লেমিংস’ নামে একটা বোর্ড গেম বানায় যেটায় লেমিংকে নানা বাধা পেরিয়ে খাড়া চড়াইয়ে পৌঁছে দিতে হয়। এছাড়া নানা রূপকে এটি এসেছে এডাল্ট সুইমের শো রোবট চিকেন-এ, ১৯৭৩-এর মঞ্চ নাটক ন্যাশনাল ল্যামপুন’স লেমিংস কিংবা ব্লিংক ১৮২-এর গান ‘লেমিংস’-এ।

তাদের নিয়ে কিংবদন্তী অবশ্য ঠিক আজকের নয়। ইনুইটদের ধারণা ছিলো, এরা মেঘের ওপারের দেশ থেকে ঝড়বৃষ্টির সময় বিরাট সংখ্যায় নেমে আসে আর বসন্তের ঘাস গজাতে না গজাতেই অদৃশ্য হয়ে যায় প্রচুর পরিমাণে। আসল ঘটনাটা হচ্ছে এই যে, তারা অন্য রোডেন্ট বা তীক্ষ্ণদন্তীদের মতোই দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। এবং, বাড়তে বাড়তে হঠাৎ করেই বিপুল পরিমাণে তাদের মৃত্যু ঘটে। নানা কারণই প্রস্তাবিত এই ওঠা-পড়ার জন্যে (খাদ্যসংকট, আবহাওয়া, খাদকসংখ্যাবৃদ্ধি, সংখ্যাবহুলতার চাপ, সংক্রামক ব্যাধি এমনকি সৌরকলংক ইত্যাদি) কিন্তু কোনওটাই ঠিক পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না এই প্রপঞ্চ। দল বেঁধে নিজের জায়গা ছেড়ে তারা বেরিয়ে পড়ে বটে, তাও এমনিভাবে ‘কাতারে কাতারে..সমুদ্রের দিকে’ নয়। আত্মহত্যার ব্যাপারটা মূলত বেশি করে প্রচারিত হয় ১৯৫৮ সালে ডিজনি স্টুডিওর ‘হোয়াইট ওয়াইল্ডারনেস’ নামের ডকু-ফিচারে অস্কার-পাওয়া ছবিটার কারণে। সেখানটায় দেখানো হয় দলে দলে খুদে লেমিঙেরা চলেছে এবং পাহাড়ের খাড়া চড়াই থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। প্রমাণিত, ওই অংশটা ছিলো বানোয়াট। ইনুইট বাচ্চাদের কাছ থেকে লেমিং কিনে একটা বরফে-ঢাকা ঘোরানো টেবিলের ওপর থেকে তাদের নিচে পড়ার দৃশ্যটা কারসাজি করেই তোলা হয়েছিলো। মানুষও প্রকৃতির এই অভূতপূর্ব বস্তু দেখে মুগ্ধ। ক্যামেরা হাতে থাকলে মানুষকে ইচ্ছেমত খাওয়ানো যে দারুণ সহজ, সেটা এমনকি হিটলারও জানতেন!

আসল ঘটনা হচ্ছে, এই দেশত্যাগের কারণে তারা কিছু নদী বা জলভূমি পার হয়। খুব দক্ষ সাঁতারু তারা নয় বলে পারাপারের সময় অনেকেই আক্ষরিকভাবেই ভেসে যায় মৃত্যুর মুখে। বিশেষ করে, জল তাদের লোম ভেদ করে ত্বকে পৌঁছে গেলে তারা আর সাঁতরে উঠতে পারে না তীরে। এমনি অনেক ভাসমান মৃতদেহই বোধহয় এই গণমৃত্যুর কল্পকাহিনির ইন্ধন যুগিয়েছিলো।

আগ্রহীদের জন্যে আরো কিছু তথ্যমালা:

১.

২.

৩.

৪.

আসুন ‘কম্পু’ (১৩৮৫ বাং) গল্পে।

বিখ্যাত কম্পিউটার, যার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও আছে, তার চারপাশেই গল্পটা আবর্তিত। সেখানে একজায়গায় পাচ্ছি, কিয়োটোর এক বৌদ্ধমন্দিরে জাপানের বিখ্যাত মনীষী তানাকা তাঁদের “দিগ্‌গজ যন্ত্রটির কথা শুনে স্মিতহাস্য করে বললেন, ‘চাঁদটা সূর্যের সামনে এলে দুইয়ে মিলে এক হয়ে যায় কার খেয়ালে সেটা বলতে পারেন তোমাদের যন্ত্র?’

দার্শনিকের মতোই প্রশ্ন বটে। সূর্যের তুলনায় চাঁদ এত ছোট, অথচ এই দুইয়ের দূরত্ব পৃথিবী থেকে এমনই হিসেবের যে, চাঁদটা সূর্যের উপর এলে আমাদের চোখে ঠিক তার পুরোটাই ঢেকে ফেলে-এক চুল বেশিও না, কমও না। এই আশ্চর্য ব্যাপারটা যেদিন আমি বুঝতে পারি আমার ছেলেবেলায়, সেদিন থেকেই সূর্যগ্রহণ সম্বন্ধে আমার মনে একটা গভীর বিস্ময়ের ভাব রয়ে গেছে। আমরাই জানি না এই প্রশ্নের উত্তর, তো কম্পু জানবে কী করে?” [৫১]

বস্তুত, কথাটা সত্যজিতের নিজেরই। সত্যজিতের কাজ ও জীবন নিয়ে সবচে’ বিশদ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ এন্ড্রু রবিনসনের ‘সত্যজিৎ রায় দ্য ইনার আই’ (১৯৮৯)-তে সত্যজিতের বিজ্ঞান তথা বিশ্বচেতনার পরিচয়বাহী একটি সাক্ষাৎকারের (ইন্ডিয়া টুডে, ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে যেটা পড়লে আগ্রহী পাঠক হয়তো সত্যজিতের মনোজগৎ নিয়ে আরো আগ্রহী ও অভিজ্ঞ হবেন:
“this universe, and its incessant music, may not be entirely accidental. Maybe there is a cosmic design somewhere which we don’t know. Take for instance the apparent sizes of the moon and the sun. They’re exactly the same. At the time of total eclipse, the moon covers the sun edge to edge. The whole business of propagation of the species-of sexual intercourse-has been possible because of the delight that goes with it. Who made coitus so intensely pleasurable? Is that a coincidence too? Watch the protective colourations of birds and insects. The grasshopper acquires the exact shade of green that helps it merge in its surroundings. The marine life and the shore birds put in the exact camouflage. Could it all be coincidence? I wonder. I don’t mystify it either. I think some day the human mind will explore all the mysteries of life and creation the way the mysteries of the atom have been explored.” (এই মহাবিশ্ব, আর এর অবিরাম সঙ্গীত, হয়তো পুরোপুরি আকস্মিক নয়। হয়তো কোথাও কোন মহাজাগতিক নকশা লুকিয়ে আছে যার সন্ধান আমাদের কারোর কাছেই নেই। চাঁদ আর সূর্যের দৃশ্যমান আকারের কথাই ধরা যাক। ওদু’টো এক্কেবারে এক। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়, চাঁদ সূর্যের এক মাথা থেকে অন্য মাথা অবদি পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। জীবপ্রজাতির এই যে প্রজননের পুরো ব্যাপারটা-যৌন মিলনের ঘটনাটা-সম্ভবপর হয় এর সাথে পুলক জড়িত থাকার কারণে। সঙ্গম এতো অসহ্য আনন্দের করে তুললো কে? এটাও কি স্রেফ কাকতালীয় ব্যাপার? আমার ঠিক মনে হয় না। এটাকে আধ্যাত্মিকতার দিকেও অবশ্য আমি নিচ্ছি না। আমার মনে হয় যেমনিভাবে মানবমন আবিষ্কার করেছে অণুর রহস্য, তেমনিভাবে জীবন ও সৃষ্টির সব রহস্যের সমাধানও সে করবে।) [৫২]

একথা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই শোনায়, “বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ”। রবিনসন সাহেব বাংলা শিখেছিলেন এবং বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ পড়েছেন এবং কৃষ্ণা দত্তের সাথে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত তাঁর একখানা বইও আছে ‘রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর: দ্য মিরিয়ড-মাইন্ডেড ম্যান’। তিনি বলছেন, সত্যজিতের গল্পে “his thoughts were as uninhibited by convention and his lack of higher scientific knowledge as were Tagore’s.” [৫৩] সত্যজিতের মননে উচ্চতর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব সায়েবেরও চোখ এড়ায় নি।

আসল কথায় ফিরে আসি।

আসলেই কি চাঁদ সূর্যের ওপর এলে পুরোটাই টায়টায় ঢেকে ফেলে? এ কি সত্যিই এক ব্যাখ্যাতীত জ্ঞানাতীত প্রাকৃতিক আশ্চর্য?

সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে সহজতম কথাটা এই যে, চাঁদটা আমাদের আর সূর্যের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যায় বলে আমাদের চোখে সূর্যটা অন্ধকার হয়ে যায়, যেহেতু সেটাই আমাদের আলোর উৎস। সত্যজিৎ যেটার কথা বলছেন, সেটা মূলত পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, সবক্ষেত্রে সেটা হয় না। এবং, যাঁরা পঞ্জিকা ও পত্রপত্রিকা পড়েন, তাঁরা এটাও জানেন যে, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর সব জায়গা থেকে সমানভাবে দেখা যায় না। তার মানে চাঁদটা সূর্যের ‘edge to edge’ এমনকি সূর্যগ্রহণের সময়ও সর্বক্ষেত্রে ঢেকে ফেলতে পারছে না।

ব্যাপারটা হলো, পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ কেবল তখনই হয়, যখন চাঁদ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় যেখান থেকে আমাদের চোখে চাঁদের যে কৌণিক ব্যাস তা সূর্যের কৌণিক ব্যাসের প্রায় সমান। সাধারণত এটা হয় যখন চাঁদ পৃথিবীর সাথে অনুসূর অবস্থানে, মানে কাছাকাছি অবস্থানে (Perigee) থাকে। এটা হওয়ার কারণ, সূর্যের চাইতে পৃথিবীর দূরত্ব চাঁদের চাইতে পৃথিবীর দূরত্বের চাইতে ৪০০ গুণ বেশি, আর সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাসের চাইতে প্রায় ৪০০ গুণ বড়। এই দুটো অনুপাত একই হওয়ায় পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদ দেখতে প্রায় একই রকমের লাগে। কিন্তু তারপরও এ-ঘটনা বেশ বিরল, কারণ এটার সংঘটন দেখতে গেলে পৃথিবীর এমন জায়গায় থাকতে হয় যেখানে চাঁদের ছায়া (umbra) পড়ছে। এজায়গাটা লম্বায় হয় প্রায় ১,০০০ মাইল এবং চওড়ায় মাত্র ১০০ মাইল। এর নাম ‘সামগ্রিকতার পথ’ (path of totality)। এটা পৃথিবীর পরিধির মাত্র শতকরা ১ ভাগ। পৃথিবী থেকে আমরা যতোটা সূর্যগ্রহণ দেখতে পাই, তার সিংহভাগই হয় অন্য তিন ধরনের গ্রহণ, পূ্র্ণগ্রাস হয় সবচাইতে কম। আমরা যতো সূর্য থেকে দূরে থাকতাম এবং আমাদের উপগ্রহের সংখ্যা যতো বেশি হতো এবং তারা আমাদের যতো কাছে থাকতো, ততোই বাড়তো পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সংখ্যা। বুধের কোন উপগ্রহ নেই, তাই তাতে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে না। বৃহস্পতিতে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে সবচে’ বেশি, কারণ এটা সূর্য থেকে অনেক দূরে, ফলে সূর্যের আপেক্ষিক অনুপাত কম, এবং এর উপগ্রহের সংখ্যা সর্বোচ্চ।

পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের স্থান

সামগ্রিকতার পথ


আমার ব্যাখ্যা স্পষ্ট না হলে এগুলো দেখতে পারেন:

১.

২.

পুরো ব্যাপারটা মোটেও এতো অলৌকিক বা ব্যাখ্যাতীত কিছু নয় এবং আজকাল বাচ্চারা এসব স্কুলে থাকতেই জেনে ফেলে। একজন বিশ্বনন্দিত বৈজ্ঞানিক যিনি প্রায় অর্ধশত আবিষ্কার করেছেন যার মধ্যে বেশিরভাগ প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার এবং গবেষণাগারে তৈরি করা যায় না; পৃথিবীর হেন কোন নামকরা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান নেই যা তাঁকে সম্মানিত করে নিজে ধন্য হয় নি; বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যাতে তাঁর বিশেষজ্ঞতা নেই; এহেন বৈজ্ঞানিকের মুখে এসব কথা শুনলে যে বাঙালি হিসেবে লজ্জা পেতে হবে!

অবশ্য মনে করার কোন কারণ নেই যে এসব তথ্য সত্যজিতের অজানা ছিলো। তাঁর প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে লেখা অল্প ক’টি গল্পের একটি ‘আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু’ (১৩৭৫ বাং)-তে দেখছি আর্যশেখর নামের মূল চরিত্রটি “…বুঝলেন চন্দ্র-সূর্যের আয়তন আপাতদৃষ্টিতে এক হওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। তাঁর মনে এই আকস্মিকতা প্রচণ্ড বিস্ময় উৎপাদন করল। পাঠ্যপুস্তকের কথা ভুলে গিয়ে তিনি বাপের আলমারি খুলে দশ খণ্ডে সমাপ্ত হার্মসওয়ার্থ পপুলার সায়েন্স থেকে গ্রহ নক্ষত্র সম্বন্ধে পড়তে আরম্ভ করলেন।”

শুধু তাই নয়, এই চিন্তাশীল ও অনিসন্ধিৎসু আর্যশেখর “তাঁর চতুর্দশ জন্মতিথিতে…পিতার টেবিলের দেরাজ খুলে তিনখানা অব্যবহৃত ডায়রি বার করে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটি বড় তার প্রথম পাতায় লিখলেন-আমার মতে সৌরজগতের অন্য কোনও গ্রহে প্রাণী থাকলেও তা মানুষের মতো কখনওই হতে পারে না, কারণ এমন চাঁদ আর এমন সূর্য অন্য কোনও গ্রহে নেই। যদি থাকত, তা হলে আমাদের মতো মানুষ সেখানে থাকত। কারণ আমার মতে চন্দ্রসূর্য আছে বলেই মানুষ মানুষ।”[৫৪]
এই আর্যশেখরের পরের আরো একটা কথা জেনে নেই।

“আর্যশেখরের যখন উনিশ বছর বয়স, তখন একদিন সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে একটি শিরীষ গাছের নীচে উপবিষ্ট অবস্থায় বৃক্ষস্থিত কোনও পক্ষীর বিষ্ঠা তাঁর বাম স্কন্ধে এসে পড়ায় তিনি সহসা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলেন। যথারীতি তিনি এ বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাঁর ধারণা ছিল নিউটনের আপেলের ঘটনাটা বুঝি কিংবদন্তি। প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের নিজের লেখায় সে ঘটনার উল্লেখ দেখে তাঁর ধারণার পরিবর্তন হল। তাইকো ব্রাহি গ্যালিলিও থেকে শুরু করে কোপারনিকাস, কেপলর, লাইবনিৎস-এর রাস্তা দিয়ে ক্রমে আর্যশেখর আইনস্টাইনে পৌঁছে গেলেন। আর্যশেখরের বিদ্যায় আইনস্টাইন জীর্ণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু পাঠ্য-অপাঠ্য বোধ্য-অবোধ্য সবরকম পুস্তকই আদ্যোপান্ত পাঠ করার একটা আশ্চর্য ছিল আর্যশেখরের। অবিশ্যি বর্তমান ক্ষেত্রে তাঁর পড়ার আগ্রহের একটা কারণ ছিল এই যে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে কিনা। আইনস্টাইন পড়ে এইটুকু তিনি বুঝলেন যে মাধ্যাকর্ষণ কী তা জানা গেলেও মাধ্যাকর্ষণ কেন, তা এখনও জানা যায় নি। তিনি স্থির করলেন, এই ‘কেন’-র অন্বেষণই হবে আপাতত তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য।” [৫৫]

সৃষ্ট প্রতিটির চরিত্রের প্রত্যেক মতামত বা কথা লেখকের নিজের বলে চাপিয়ে দেওয়া যায় না কোনভাবেই। কিন্তু, কোথাও লেখকের কিছু নিজস্ব মতও লুকিয়ে যে থাকে, তার উদাহরণ আমরা একটু আগেই দেখেছি। তাই সে-নিয়ে দুটো কথা বলা যেতে বোধহয় পারে নিরাপদেই।

সৃষ্টিজগতের রহস্য ভেদ করা অবধিই বিজ্ঞানের ক্ষেত্র। কেন বিগ ব্যাঙের সাহায্যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো, কেন মাধ্যাকর্ষণ বা মহাকর্ষ তৈরি হলো, কেন পৃথিবীতে প্রাণসৃজন হলো, কেন ঘটলো প্রাণীদের বিবর্তন ইত্যাকার প্রশ্ন ঠিক বিজ্ঞানের আওতায় আসে না। এগুলো চলে যায় অধিবিদ্যা বা দর্শনের আওতায়। আধ্যাত্মিকতাও এসব জায়গায় বেশ জাঁকিয়ে বসে নিজের গালভরা মতামত বা মতবাদ দিয়ে ইদানীং ধর্মগ্রন্থেও বিজ্ঞানের ঢাউস ঢাউস প্রমাণ ধুপধাপ দেখে ফেলে। ‘গডস ইন গ্যাপস’-ও এসব জায়গাতেই ঠাঁই করে নেয়, যেমন অন্ধকার কোনায় থাকে তেলাপোকা।

কিন্তু, এতে হতবিহ্বল হয়ে অলৌকিক মহাবৈশ্বিক শক্তি বা ধীমান নকশাকারের অস্তিত্বে নতশির হওয়াটা ঠিক বৈজ্ঞানিক মানসিকতা নয় এবং যৌক্তিকও নয় কোনোভাবেই।

পাশাপাশি বিবর্তনও উভমুখী বিক্রিয়া নয় যে চলবে দুদিকেই বা পুনরোৎপাদনযোগ্য কিছু। স্টিফেন জে গুল্ডের এই কথাটাই বোধহয় এব্যাপারে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং যথাযথ:
“Humans are not the end result of predictable evolutionary progress, but rather a fortuitous cosmic afterthought, a tiny little twig on the enormously arborescent bush of life, which if replanted from seed, would almost surely not grow this twig again.”(“মানুষ পূর্বনির্ধারিত বিবর্তনের কোনো শেষ ফলাফল নয় বরং সৌভাগ্যজনকভাবে জাত মহাজাগতিক এক অনুচিন্তার ফলাফল, জীবনের শাখাপ্রশাখাময় অনন্তবিস্তারী বৃক্ষের স্রেফ ছোট্ট একটা ডাল। বীজ থেকে আবারো যদি এর জন্ম হয়, একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এই শাখার পুনরাবির্ভাবের আশা নিতান্তই সীমিত।”)

ভাগ্যিস, সত্যজিৎ পড়েন নি জন ডি ব্যারো এবং ফ্রাঙ্ক জে. টিপলারের ‘The Anthropic Cosmological Principle (১৯৮৬)’ কিংবা, ড. উইলিয়াম ডেম্বস্কির ‘Intelligent Design: The Bridge between Science & Theology (১৯৯৯)’ অথবা, মার্টিন রিস-এর ‘Just Six Numbers (১৯৯৯)’। তবে, দানিকেন যে তিনি পড়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর ‘মহাকাশের দূত’ (১৩৮৬ বাং) গল্পটি যেখানে তিনি জানাচ্ছেন এপসাইলন ইন্ডি নক্ষত্রপুঞ্জের কোনও একটি গ্রহের উন্নত প্রাণীদের কথা। তাদের জবানিতেই শোনা যাক। “তোমাদের গ্রহের অস্তিত্ব আমরা জেনেছি পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে।…এই তথ্য আবিষ্কার করার পর তখনই আমরা প্রথম তোমাদের গ্রহে আসি, এবং সেই থেকে প্রতি পাঁচ হাজার বছর এসেছি। প্রত্যেকবারই এসেছি একই উদ্দেশ্য নিয়ে। সেটা হল পৃথিবীর মানুষকে সভ্যতার পথে কিছুদূর এগিয়ে দিতে সাহায্য করা।…আমরা অনিষ্ট করতে আসি না। আমাদের কোনও স্বার্থ নেই। সাম্রাজ্যবিস্তার আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল মানুষের সমস্যার সমাধানের উপায় বাতলে দিয়ে আবার ফিরে যাই। আজকের মানুষ বলতে যা বোঝো, সেই মানুষ আমাদেরই সৃষ্টি, সেই মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ গড়নও আমাদেরই সৃষ্টি। মানুষকে কৃষিকার্য আমরাই শেখাই, যাযাবর মানুষকে ঘর বাঁধতে শেখাই। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান–পৃথিবীতে এসবের গোড়াপত্তন আমরাই করেছি, স্থাপত্যের অনেক সূত্র আমরাই দিয়েছি।” [৫৬]

এই পাঁচ হাজার বছরের উল্লেখ আমায় ভীষণ নাড়া দেয় সেই কৈশোরেই, যেমনি দিয়েছিলো দানিকেনের ‘দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ’। তবে, ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছিলাম ‘পাঁচ হাজার বছরের’ অসাড়তা। একটা ছোট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়।

মানব জাতির ইতিহাসে বিরাট একটি সংঘটনময় ঘটনা হলো ‘আফ্রিকা থেকে বহির্গমন’। একাধিকবার এই ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হলেও প্রথমত এই ঘটনা ঘটে প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে। ভিনগ্রহীরা প্রথম এসেছে বলা হয়েছে পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে। এমনকি, আধুনিক মানুষের বিবর্তনও ঘটেছে এর অনেক পরে। ৩০/৪০ হাজার বছর আগেও নিয়ান্ডার্থাল মানুষ ছিলো। পাশাপাশি হোমো গণের অন্য অনেক প্রজাতিও। তাছাড়া, নানা অঞ্চলে নানা সভ্যতা রূপ নেয়। ভিনগ্রহীদের দাবির অসাড়তা এখানেই স্পষ্ট। এই ঘটনাটার উল্লেখ করলাম এই জন্যেই যে, এখনো অনেকে দানিকেনের কল্পগল্প বিশ্বাস করেই যায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালেরও এরকম একটি গল্প আছে ‘বিষ’ নামে, যেটিতে তিনি দেখান যে, আমরা মূলত ভিনগ্রহী কোন প্রাণীর গবেষণাগারের গিনিপিগ। [৫৭] এর জন্যে তিনি কিছু ধর্মগর্ধভের রোষেরও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, কারণ তিনি যে শির্ক করেছেন! অবশ্য, ব্যাপারটা তাঁর জন্যে খুব নতুন কিছু নয় নিশ্চয়।

অঙ্কে মেলে না এমনি কিছু উদাহরণও দেখা যাক শঙ্কুর গল্পে।

‘প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়’ (পৌষ, ১৩৭০) গল্পে এক সাধুবাবার কথা পাওয়া যায়, যাঁর নাম উল্লিখিত নয় কিন্তু যিনি মৃত প্রাণীর কঙ্কাল মন্ত্রবলে জীবন্ত করে তুলতে পারেন। শঙ্কু তাঁর অলৌকিক কীর্তি দেখে অস্থিতত্ত্বে আগ্রহী হন এবং পড়াশোনা করে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একবার এক ভদ্রলোক একটি বিরাট অস্থি তাঁকে দেখিয়ে হাতি না গন্ডারের হাড় জানতে চাইলে তাঁর স্বগতকথন: “মনে মনে বললুম তুমি গণিতজ্ঞ হতে পারো কিন্তু অস্থিবিদ নও! এ হাড় হাতিরও নয়, গণ্ডারেরও নয়। এ হাড় যে জানোয়ারের, সে জানোয়ারের অস্তিত্ব অন্তত কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে মুছে গেছে।
আমি নিজে বুঝেছিলাম-হাড়টা ব্রন্টোসোরাসের এবং তখনই মনে মনে স্থির করেছিলুম-নীলগিরিতে একটা পাড়ি দিতেই হবে।” [৫৮]

আবার দুই অনুচ্ছেদ পরেই তিনি পাঠকদের জানাচ্ছেন, “আগেই বলেছি, এ জানোয়ার আমার অপরিচিত। শুধু আমার কেন, প্রাণিবিদ্যার জগতে এ জানোয়ারের পরিচয় কেউ জানে বলে মনে হয় না।” কিন্তু, কিন্তু, একটু ওপরেই না আপনি…মানে…বললেন…।

গল্পের শেষে দেখা যায় সাধুবাবা দেখাচ্ছেন বিপরীত ভোজবাজি। একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকে তিনি মন্ত্র পড়ে জীবন্ত অবস্থা থেকে পরিণত করেন কঙ্কালে এবং পাশাপাশি তিনি নিজেও পরিণত হন কঙ্কালে। বোঝা যায় না শঙ্কু কাছে থাকার পর এবং সেই মন্ত্র শোনার পর তিনি কেন কঙ্কাল হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। এবং, যে-মন্ত্র অতিকায় আদিম জানোয়ারকে অস্থিস্তূপে পরিণত করে, কেন তার প্রতিক্রিয়া হয় না সাধুবাবার নিজের ওপরও, আবার কেনই বা মৃত্যুর পর সাধুবাবার প্রাণহীন দেহ পরিণত হয় কঙ্কালে। এই পক্ষপাত অযৌক্তিক তবে মেনে নেই সত্যজিৎ প্রেজেন্টস বলে!
‘প্রফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য’ গল্পে প্রফেসর শঙ্কু ‘টেরাটম’ নামের একটি গ্রহের সন্ধান পান যা কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং শঙ্কুর প্রতিবেশী অবিনাশবাবু সেটি জলায় আবিষ্কার করেন। কিন্তু, পরবর্তীকালে সেটির কীটনাশক গুণ দেখে এবং নিজের শরীরের ওপর প্রতিক্রিয়ায় এবং সেটির ক্ষণে ক্ষণে বর্ণপরিবর্তনের ক্ষমতা দেখে ভীত হয়ে সেটি রেখে যান শঙ্কুর কাছে। শঙ্কু সেসময় প্রায় দেড় বছরের পরিশ্রমে আবিষ্কার করেছেন মাইক্রোসোনোগ্রাফ যা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দও শ্রাব্যসীমায় এনে দিতে পারে। ওটির মাধ্যমে টেরাটমবাসীর সাথে তাঁর আলাপ হয়। তারা জানায়, “আমরা কক্ষচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে এসে পড়েছি। জলের মধ্যে পড়েছিলাম, তাই আমাদের কোনও ক্ষতি হয় নি, কারণ আমরা মাটির নিচে বাস করি। কিন্তু, তোমার এই কাচের আচ্ছাদন আমাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ অক্সিজেন আমাদের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।” [৫৯]

কথা হচ্ছে, যাদের জন্যে অক্সিজেন প্রয়োজনীয়, তারা কেন মাটির নিচে থাকে? মাটির নিচে অক্সিজেন পেলেও জলের নিচে কিভাবে পাওয়া যায় অক্সিজেন? আবার, যারা মাটির নিচে বা জল থেকে অক্সিজেন পায়, তারা কাচের আচ্ছাদনের ভেতরে অস্বস্তি বোধ করে কেন?

সবই কি তাঁর লীলাখেলা আসলে?

তাঁর গল্পে অকাল্টের আর অলৌকিকের ছড়াছড়ি।

একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রোফেসর শঙ্কু যখন বলেন, “ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স-এ সবই যে একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার অনেক দিন থেকেই আছে। বহুকাল ধরে বহু বিশ্বস্ত লোকের ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনী সেই সেব লোকের মুখ থেকেই শুনে এসেছি। ভূত জিনিসটাকে তাই কোনওদিন হেসে উড়িয়ে দিতে পারিনি।”, [৬০] কিংবা, “আমি নিজে ভারতীয় বলেই হয়তো ভূতপ্রেত মন্ত্রতন্ত্রের ব্যাপারটাকে সব সময়ে উড়িয়ে দিতে পারি না। আমার নিজের জীবনেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে পাওয়া শক্ত।” [৬১] তখন কিন্তু কিশোর মনে এই ধারণাই বাসা বাঁধে যে ওসব নিয়ে যা রটনা, তাহলে তা নেহাৎ ভুয়ো নয়, রীতিমত ‘বৈজ্ঞানিক’ সমর্থন আছে তার!

শঙ্কুর নানা গল্পে উপস্থিত তাঁর জার্মান বন্ধু উইলহেল্‌ম ক্রোলকে দেখা যায় নানান প্রেততত্ত্বের চর্চা করতে, এমনকি শঙ্কুও যে ভূতপ্রেত নিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক’ গবেষণা চালিয়েছেন তার প্রমাণ মেলে শঙ্কুর প্রথম দিককার গল্প ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক’-তে, যেখানে জানতে পারছি “…ভূতপ্রেতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে আমার একটি মৌলিক গবেষণামূলক বই আছে…”। [৬২] ক্রোল আসলে যে ঠিক কী করেন, তা শঙ্কুর কোন গল্পেই তেমন স্পষ্ট নয়। যেমন, ‘একশৃঙ্গ অভিযান’-এ দেখছি সন্ডার্স শঙ্কুকে পত্র মারফৎ জানাচ্ছেন, “জাদুবিদ্যা, উইচক্রাফ্‌ট ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রোলের মূল্যবান গবেষণা আছে, তুমি হয়তো জান।” [৬৩] ওটাই শঙ্কুর গল্পে ক্রোলের প্রথম আগমন। ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ’ গল্পে তো ক্রোল রীতিমত আত্মা নামান এবং সে-আত্মা দশম শতাব্দীর বিখ্যাত অ্যালকেমিস্ট জবীর ইব্‌ন হায়ানের। প্ল্যানচেটের টেবিলে ঝুপ করে শূন্য থেকে মুক্তোর জপমালা বা তসবিহ এসে পড়ে, ক্রোল আচ্ছন্ন অবস্থায় শূন্যে ভাসমান হন এবং মুক্তোর মালা থেকে মুক্তোগুলো আলাদা হয়ে টেবিলে আরবি ভাষায় তিনটি বাক্য লিখে হাওয়া হয়ে যায়। ‘নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো’ গল্পে নকুড়বাবু নামের যে সাদাসিধে ভদ্রলোককে আমাদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর রয়েছে টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স, হিপনোটিজম, ভবিষ্যদ্দর্শনের আশ্চর্য ক্ষমতা। ক্রোল তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ ও মুক্তকণ্ঠ। অথচ, এই নকুড়বাবুই ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ.এফ.ও.’ গল্পে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক কুলির মাথায় চাপানো স্টিল ট্রাঙ্কের ধাক্কা খেয়ে মাথার বাঁ দিকে আহত হন এবং এতে করে তাঁর মনোযোগে ও ক্ষমতায় বেশ কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা নিজের ভবিষ্যৎই দেখতে পান না?

‘শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান’ (১৩৮৮ বাং)-এ দেখছি ক্রোলের ব্যাপারে জানানো হচ্ছে, “সে বেশ কয়েক বছর ধরেই ঝুঁকছে অতিপ্রাকৃতের দিকে। তা ছাড়া নানান দেশের মন্ত্রতন্ত্র ভেলকি ভোজবাজির সঙ্গে সে পরিচিত। এ সবের সন্ধানে সে আমার সঙ্গে তিব্বত পর্যন্ত গিয়েছে। নিজে গত বছরে হিপ্নোটিজম অভ্যাস করে সে ব্যাপারে রীতিমতো পারদর্শী হয়ে উঠেছে।” [৬৪] ‘ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী’ (১৩৯৬ বাং) গল্পেও দেখছি পৃথিবীতে মানুষের চাইতে উন্নততর প্রাণী থাকতে পারে জেনে ক্রোলের এমত মতামত: “এই প্রাণী যদি থেকেও থাকে, তা হলে আমি প্রথমেই অনুসন্ধান করব এরা অলৌকিককে বিজ্ঞানের আওতায় এনে ফেলতে পেরেছে কি না। আমাদের অনেক বিজ্ঞানীই অলৌকিক ঘটনাকে হেসে উড়িয়ে দেন, অথচ সেগুলো যে কী করে ঘটছে তার কোনও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন না।” [৬৫] সেই গল্পেই আবার ইচ্ছাশক্তির বশে সেই উন্নত প্রাণীরা চলন্ত সিঁড়ি, মানুষের চেহারাবিশিষ্ট ‘অটোপ্লাজম’ (উন্নত প্রাণীটির নিজেদের দেওয়া নাম) ইত্যাদি তৈরি করতে পারে। অবিশ্বাসী খাস জন বুল জেরেমি সন্ডার্স যখন সেটা অস্বীকার করতে চান, তখন শঙ্কু তাঁকে বোঝান, “সত্যিই যদি এদের তেমন উইলপাওয়ার থাকে, তা হলে তার জোরে অনেক কিছুই সম্ভব।” [৬৬] নানা অলৌকিক ঘটনায় অবিশ্বাস প্রকাশ-করা তাঁর ইংরেজ বন্ধুকে অবশ্য অলৌকিকতার কাছে হার মানিয়ে ছেড়েছেন তিনি ‘নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো’ গল্পে। সেখানটায় তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, কারণ কথাটা বলছেন শঙ্কু স্বয়ং: “..সন্ডার্সের যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মনের ভিত এই প্রথম দেখলাম একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল। সে মানতে বাধ্য হয়েছে যে, সব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, আখেরে এর ফল ভালোই হবে।” [৬৭]

এমনিতে ভৌতিক আবহ নিয়ে শঙ্কুর দুটি গল্পই আছে, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ (১৯৬৬ খ্রিঃ) এবং ‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’ (১৩৯৪ বাং)। দ্বিতীয়টিতে তো তিনি ক্রোল এবং অন্য এক জার্মান যুবকের সাথে কম্পিউডিয়াম নামের এক ভূতাহ্বানকারী যন্ত্রই তৈরি করে বসেন। অবশ্য প্রথমটিতেও তিনি একখানা ভূত হেলমেট (‘নিও-স্পেক্ট্রোস্কোপ’) আবিষ্কার করেন যা হয়তো শীর্ষেন্দু তাঁর ‘অদ্ভুতুড়ে’ উপন্যাসে ব্যবহারও করে থাকতে পারেন। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে তাঁর আবিষ্কৃত এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি আরশোলার ভূতও দেখে ফেলেন। তাঁর এই ইতর প্রাণীর আত্মাদর্শন ধর্মতত্ত্বের সাথে তো রীতিমত সাংঘর্ষিক!

এই মানসিকতা তাঁর অন্যকিছু চরিত্রেও দেখতে পাই। সত্যজিতের তারিণী খুড়ো নামের আরেকটি রোমাঞ্চকর চরিত্রের একটি গল্পে-‘তারিণী খুড়ো ও বেতাল’-তারিণী খুড়ো জানাচ্ছেন, “আমার মনের সব কপাট খোলা, ভোজরাজজী। আমি হাঁচি টিকটিকি ভূত-প্রেত দত্যি-দানা বেদ-বেদান্ত আইন্সটাইন-ফাইন্সটাইন সব মানি।” [৬৮] কে জানে, তাঁর পিতা সুকুমারের দারুণ রসাত্মক একাঙ্কিকা ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’-র ভবদুলালের সেই সংলাপ এক্ষেত্রে কোন ছাপ ফেলেছিলো কি না: “হ্যাঁ…হার্বার্ট স্পেন্সার, হাঁচি, টিকটিকি, ভূত, প্রেত সব মানি।” [৬৯]

সত্যজিতের সবচাইতে জনপ্রিয় চরিত্র প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর প্রদোষ চন্দ্র মিত্র আকা ফেলুদার মুখে প্যারাসাইকলজি নিয়ে তোপসের কিছুটা সংশয়ের মুখে চরম বাস্তববাদী ফেলুদা জানাচ্ছেন, “আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হল এই যে, প্রমাণ ছাড়া কোন জিনিষ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করাটা বোকামো। মনটা খোলা না রাখলে যে মানুষকে বোকা বনতে হয়, তার প্রমাণ ইতিহাসে অজস্র আছে। এককালে লোকে পৃথিবীটা ফ্ল্যাট বলে মনে করত, জানিস? আর ভাবত যে একটা জায়গায় গিয়ে পৃথিবীটা ফুরিয়ে গেছে, যার পর আর যাওয়া যায় না। কিন্তু ভূপর্যটক ম্যাগেলান যখন এক জায়গা থেকে রওনা হয়ে ভূপ্রদক্ষিণ করে আবার সেই জায়গাতেই ফিরে এলেন, তখন ফ্ল্যাটওয়ালারা সব মাথা চুলকোতে লাগলেন। আবার লোকে এটাও বিশ্বাস করেছে যে, পৃথিবীটাই স্থির, গ্রহ-নক্ষত্র-সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করছে। এক সময় এক দল আবার ভাবত যে, আকাশটা বুঝি একটা উপুড়-করা বাটি, যার গায়ে তারাগুলো সব মণিমুক্তোর মত বসানো আছে। কোপারনিকাস প্রমাণ করলেন যে সূর্যই স্থির, আর সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী সমেত সৌরজগতের সব কিছু ঘুরছে। কিন্তু কোপারনিকাস ভেবেছিলেন যে, এই ঘোরাটা বুঝি বৃত্তাকারে। কেপলার এসে প্রমাণ করলেন এলিপটিক কক্ষে। তারপর আবার গ্যালিলিও… যাক গে তোকে এত জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই। তোর নাবালক মস্তিষ্কে এসব ঢুকবে না।” [৭০]

তাহলে কি প্রমাণ ছাড়া বলে দৈত্য ভূত প্রেত জিন পরি রাক্ষস দেব দেবী পক্ষীরাজ বোরাক ফিনিক্স সিমুর্গ সব মেনে নিতে হবে? এখানে কারোর কারোর ‘একশৃঙ্গ অভিযান’-এর ডুংলুং-ডো-এর কথা মনে পড়তে পারে যেখানে রূপকথার সব চরিত্রই লভ্য। অথচ, সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রকর্মে মোটেও ঠাঁই দেন নি ধর্মীয় ক্ষুদ্রতা, কুসংস্কার বা আবেগ-অনুভূতির। বরং ‘দেবী’ (১৯৬০) থেকে শুরু করে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯) অবধি প্রায় পাঁচটা ছবিতে তিনি বারবার মৃদু বা উচ্চকিত কণ্ঠে কথা বলেছেন ধর্মভিত্তিক মুগ্ধতার বা আবেগের বিপক্ষে। তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ (১৯৯১)-এও দেখছি তিনি তাঁর আদলে গড়ে-তোলা চরিত্র মনোমোহনের মাধ্যমে তাঁর বিশ্ববীক্ষার প্রগাঢ়তম প্রসার দেখিয়েছেন। কখনোই কোনভাবে তিনি মানসিক ক্ষুদ্রতার শিকার হতে দেন নি নিজেকে বা তাঁর প্রিয় চরিত্রদের। ধর্মীয় সংস্কারও তাঁর মধ্যে কাজ করে নি, বরং আমরা দেখেছি তিনি মানবিকতার কাছেই ফিরে গেছেন বারংবার। তাঁর আমৃত্যু এবং জীবনের বহুক্ষেত্রের সাথী সহধর্মিণী বিজয়া রায় এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন:
“না, মানিক একেবারেই ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিল না। তবে শেষের দিকে, অসুস্থতার সময় আমাদের হাউস ফিজিসিয়ান ডক্টর মল্লিক, হার্ট স্পেশালিস্ট ডক্টর বকসির দারুণ ঈশ্বরবিশ্বাস এবং কনভিন্সিং কথাবার্তার প্রভাবে বলত, থাকতে পারে ঈশ্বর, আমি জানি না। ‘মানি না’-র বদলে ‘জানি না’ হয়েছিল।” [৭১]

কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে তিনি কেন যে ছদ্মবেশী বিজ্ঞানের এসব রোমাঞ্চকরী প্রভাব এড়াতে পারেন নি, তা গবেষণার এবং কিছুটা আফসোসেরও বিষয়। মোটামুটিভাবে যা আন্দাজ করা যায়, তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

মনের দিক থেকে, অন্য অনেক প্রতিভাবানের মতো, তাঁর ভেতরেও একটি শিশু লুকিয়ে ছিলো। শিশুদের জন্যে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-র শিশুকিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ প্রকাশের কাজ করতে গিয়েই যে তাঁর মাথায় উপন্যাসটি নিয়ে ছবি করার চিন্তা আসে, সেটা অনেকেই জানেন। বিজয়া রায়ও তা-ই সাক্ষ্য দেন: “অবিশ্যি মানিকের মধ্যে সুপরিণত বয়সেও এক শিশু লুকিয়ে থাকত, পরিস্থিতি এলেই সে বেরিয়ে পড়ত।” [৭২] এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পুত্র সন্দীপের আবদার মেটাতে তাঁর শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৯) এবং এরপরে ‘ফেলুদা সিরিজ’ তৈরির কথা। গাঁটের পয়সা খরচা করে বিপুল অর্থ গচ্চা দিয়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটি চালিয়ে যাওয়ার (দুঃখজনক ব্যাপার খুবই) মানসিকতাটাও এখানে ধরা যায়। রহস্যময়তার দিকে তাঁর ঝোঁকই সম্ভবত যুক্তিবাদী হওয়ার পরও তাঁকে দিয়ে শঙ্কুর জবানীতে লিখিয়ে নেয়, “অতি প্রাকৃত ক্ষমতা বা ঘটনা সম্পর্কে পশ্চিমে অনেক বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটা হেসে উড়িয়ে দেবার ভাব লক্ষ করেছি। শ্রীমান নকুড় বিশ্বাসকে একবার তাদের সামনে নিয়ে ফেলতে পারলে মন্দ হত না। আমি নিজে অবশ্য এই সন্দেহবাদীদের দলে নই। নকুড়বাবুর এই ক্ষমতা আমি মোটেই অবজ্ঞা বা অবিশ্বাসের চোখে দেখি না।” [৭৩] কিংবা, “আমার বৈজ্ঞানিক মনের একটা অংশ আক্ষেপ করছে যে, তাকে ভাল করে স্টাডি করা গেল না, তার বিষয়ে অনেক কিছুই জানা গেল না। সেইসঙ্গে আরেকটা অংশ বলছে যে, মানুষের সব জেনে ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত। এমন কিছু থাকুক, যা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে পারে।” [৭৪]

বলাই বাহুল্য, ঠিক হার্ড-বয়েলড যুক্তিজাত বা বৈজ্ঞানিক মানসিকতা এ নয়, কেউ হয়তো ঠোঁট মুচড়ে অস্ফুটে ‘অ্যাবসার্ড’-ও বলতে পারেন। কিন্তু, যেমনটা কিশোর মন রহস্যের উল্লেখে নেচে ওঠে, তেমনিই হয়তো হতো তাঁরও এবং সাহিত্যে তিনি তাঁর সেই পরিচিত যৌক্তিকবৌদ্ধিক মননের বাইরে যাওয়ার সুবিধে উপভোগ করেছিলেন পূর্ণমাত্রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর এবং বিজয়া রায়ের প্রিয় লেখকের তালিকার প্রথমদিকেই ছিলেন শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল এবং আগাথা ক্রিস্টি। এন্ড্রু রবিনসনও স্বীকার করেছেন যে, সত্যজিৎ আর্থার সি ক্লার্কের মতো আধুনিক কল্পবিজ্ঞানলেখকদের লেখার চাইতে বরং কিছুটা বারোক (Baroque) পরিবেশেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির ‘মস্তিষ্কপ্রক্ষালন’ যন্ত্রের বাস্তবায়ন দেখলে তাঁর সাথে একমত হওয়া যায়। এর পাশাপাশি যদি যোগ করি বিজ্ঞানের গভীরতর রাজ্যে তাঁর প্রবেশের কিছুটা দূরত্বের তথ্য, তাহলে ব্যাপারগুলো আর তেমন অবাক মনে হয় না।

পাশাপাশি, কিছুটা পারিবারিক আবহও ছিলো।

ব্রাহ্মেরা আদর্শিক ও নৈতিকভাবে চেষ্টা করতেন কুসংস্কার থেকে সর্বতোভাবে দূরে থাকার। তপন রায়চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণমূলক প্রথম রচনা ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচর্চা’ নামক প্রবন্ধে, যা পরে ‘রোমন্থন’ নামধারী গ্রন্থ হিসেবে বেরোয়, তাতে লিখছেন,
“জ্যাঠামশায় বরিশাল-কৃষ্টি সম্পর্কে অনেক কাহিনী শোনাতেন। ওঁদের ছোটবেলায় নাকি স্থানীয় ব্রাহ্মরা ‘কুসংস্কার-নিবারণী সভা’ স্থাপন করেন। জনহিতৈষী ব্রাহ্ম যুবকবৃন্দ প্রভাতফেরিতে বের হতেন, খোল-করতাল সহযোগে কুসংস্কার-নিবারণী কীর্তন করতে করতে,-(রাগ ভৈরবী, ঝাঁপতাল)
“প্রভাতে উঠিয়া দেখ মাকুন্দ চো-ও-পা-আ।
বদন ভরিয়া বল ‘ধোওপাআ, ধোওপাআ।” [৭৫] [এর পরেও কিছু কথা আছে, ফুটনোটে দেখুন।]

হিন্দুসমাজে সকালে উঠে মাকুন্দ তথা তূবরদের মুখদর্শন অশুভ বলে বিবেচিত হতো বিধায় তাঁদের এই প্রগতিশীল সাঙ্গীতিক জিহাদ।

বাংলার সমাজসংস্কারে ব্রাহ্মদের অবদান প্রভূত। বিধবাবিবাহ, নারীদের যথাবয়সে বিবাহ, সংস্কৃতিচর্চা, বিদ্যোৎসাহ, শিক্ষাবিস্তার ইত্যাদি বহু ব্যাপারেই তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু, সেই পরিবারের সন্তান হওয়ার পরও এবং যথেষ্ট বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সত্ত্বেও সুকুমার তাঁর মৃত্যুর আগে ব্রাহ্মসমাজে একটি শোকসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় হঠাৎ করে ভাষার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁর বিশ্বাসের বিপরীতে নানাবিধ নিরাশাব্যঞ্জক কথাবার্তা বলে বসেন এবং এই ঘটনা তাঁর মৃত্যুর অগ্রিম বার্তাবাহী বলে তিনি স্বয়ং ধারণা করেন। এক বন্ধুর কাছে উক্ত ঘটনাটি ব্যক্ত করার সময় তিনি চিঠিতে ‘ডেথ’ শব্দটি ইংরেজিতে লিখে তার নিচে দাগ টেনে দেন। এ-ঘটনার ছ’মাস পরেই কালাজ্বরে তাঁর মৃত্যু ঘটে। এই ব্যাপারটি সত্যজিতের মনেও গভীর ছাপ ফেলে। বহু বছর ধরে, এটা পারিবারিক গুপ্ততথ্য হিসেবেই বিদ্যমান থাকে।

রবিনসনের কাছে এই ব্যাখ্যাসম্ভব ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “This is something you have to believe, you can’t help it.” [৭৬]

এ-প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বৃদ্ধ প্রপিতামহ লোকনাথ মজুমদারের কথাও টেনে আনেন। মজুমদার বংশের এই প্রতিভাবান পুরুষ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পিতামহ। সংস্কৃত, আরবি ও পার্সি ভাষা তিনি এতোটাই ভালো করে জানতেন যে, তাঁর সম্পর্কে রীতিমত লোকপ্রসিদ্ধি আছে যেকোন ভাষার লেখা পুঁথি তাঁর সামনে ধরলে তিনি সেটা এতো গড়গড়িয়ে পড়ে যেতে পারতেন যে লোকেরা বুঝতেই পারতো না তাঁর হস্তধৃত পুস্তকটি আসলে কোন ভাষায় লেখা। তিনি বিয়ে করেন এবং মাত্র বছর বিশের কোঠাতেই তন্ত্রসাধনায় ব্রতী হন। তন্ত্রাচরণে যথেষ্ট নিবিষ্ট হয়ে তিনি বহির্জগতের সাথে সম্পর্ক মোটামুটি ত্যাগই করেন। পুত্র সন্ন্যাসী হয়ে যাবে এই ভয়ে তাঁর পিতা রামকান্ত মজুমদার এক রাতে তাঁর সব তন্ত্রসাধনার উপকরণ এবং পুঁথিপুস্তকাদি নদীজলে নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনায় ভগ্নহৃদয় লোকনাথ প্রায়োপবেশন করেন এবং এর তিন দিনের ভেতরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুশয্যায় তিনি ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে এই বলে সান্ত্বনা দেন, “এখন তোমার একটা আছে, কিন্তু এই এক থেকেই একশ’ হবে।” সেসময়ে তাঁদের একটিই পুত্র, উপেন্দ্রকিশোরের পিতা কালিনাথ, জন্ম নিয়েছিলেন। রায় পরিবারে এই কিংবদন্তী বেশ শ্রদ্ধার সাথেই উচ্চারিত হতো বারবার। সত্যজিৎ ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে এই পূর্বপুরুষের আদলেই শঙ্কুর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ বটুকেশ্বর শঙ্কুকে তৈরি করেন যিনি তন্ত্রসাধনা করতেন এবং মৃত্যুর পরে তাঁর যোগসাধনার সরঞ্জামাদি, অকালমৃত্যুর ফলে যেগুলোর কোন ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারেন নি, জলে নিক্ষেপ করার জন্যে শঙ্কুর ভূতদর্শন যন্ত্র ‘নিওস্পেক্ট্রোস্কোপ’ যন্ত্রের সাহায্যে পুনরাবির্ভূত হন। অকালপ্রয়াত এই তান্ত্রিক ভবিষ্যদ্বক্তা পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করে সত্যজিৎ রবিনসন সায়েবকে আরো বলেন: “There’s probably some streak of mysticism or spiritualism in our blood. This whole business of creation, of the ideas that come in a flash, cannot be explained by science. It cannot. I don’t know what can explain it but I know that the best ideas come at the moments when you’re not even thinking of it. It’s a very private thing really.” (“আমাদের রক্তেই বোধহয় মরমিয়াবাদ বা আধ্যাত্মিকতার কোন একটা ছাপ আছে। সৃজনশীলতার এই পুরো ব্যাপারটা, এমনি হঠাৎ করে মাথায় একটা ধারণা চলে-আসা, বিজ্ঞান এটার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আসলেই পারে না। ঠিক কী দিয়ে এটার ব্যাখ্যা হয় সে আমার জানা নেই কিন্তু আমি এটুকু জানি যে সেরা চিন্তাগুলো ঠিক তখনই আসে যখন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোই হয় না। ব্যাপারটা আসলে খুবই ব্যক্তিগত পর্যায়ের।”) [৭৭]

শুধু তাই নয়, তাঁর সুরসিক, প্রতিভাবান, খামখেয়ালি, শিশুসাহিত্যিক, সন্ন্যাসীপ্রায় ছোটকাকা সুবিমল রায়ও ছিলেন যথেষ্ট মহাপুরুষভক্ত। কলকাতায় তাঁর পরিচিত এরকম কোন সাধক বা বাবার আগমন ঘটলেই তিনি দর্শন করতে ছুটতেন সেই সাধকটিকে এবং ফিরে এসে নিজের ভাষায় বিবরণ দিতেন কিশোর সত্যজিতের কাছে। সত্যজিতের ভাষায়, “আমার ছোটকাকা যেসব বাবাদের চিনতেন, তাঁরা সবাই ছিলেন নির্ভেজাল। তাঁদের কারোরই কোন বুজরুকি ধরা পড়ে নি। তাঁরা ছিলেন বেশ বিনীত, মহর্ষির [মহেশ যোগী] মতো লোক-দেখানো নন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন, মানুষ এখনো তাঁদের যথেষ্ট সৎ লোক হিসেবেই জানে।” [৭৮]

কাজেই দেখছি, ঈশ্বরদর্শন বা ঈশ্বরোপসনা অগ্রাহ্য করলেও তিনি অলৌকিকতা বা আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দিতেন না। অবশ্য, সেই তিনিই এই ‘বাবা’দের ভণ্ডামি নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের সম্ভবত সেরা ছবিটি করেছিলেন, যার নাম মহাপুরুষ (১৯৬৫) এবং যেটা নিয়ে এক আলোচনায় যুক্তিবাদী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও মাতা-বাবা-জ্যোতিষী-অলৌকিকতাবিরোধী প্রবীর ঘোষ বলছেন, “বিজ্ঞান-মনস্কতাই এই ছবির মেরুদণ্ড। ‘মহাপুরুষ’ ছবিটাকে নানা জায়গায় প্রদর্শন করে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।” [৭৯]

সৌভাগ্য আমাদের, এবং পুরো পৃথিবীর, যে সত্যজিৎ যান নি আধ্যাত্মিকতা বা অলৌকিক সাধনার দিকে। যুক্তিবাদের দৃঢ়মূলভিত্তি গাঁথুনিতে, সৌন্দর্যবোধের নান্দনিক গঠনে, শিল্পরুচির স্নিগ্ধ প্রলেপে তিনি মানুষের সৃজনীশক্তির কিছু মহান নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন যার জন্যে পৃথিবীর নরকুল আজও গর্ব করতে পারে যে তারা সত্যজিতের অমর সৃষ্টি দর্শনের সৌভাগ্য অর্জন করেছে।

আমি আশা করি আমার সন্তানের হাতে আমি তুলে দেবো প্রোফেসর শঙ্কুর কল্পজগতের গল্পসুন্দর কাহিনিগুলো এবং সেই শিক্ষাই তাকে দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে বড় হয়ে সে এর দুর্বলতাগুলো বোঝার এবং ভালোবাসার দৃষ্টিতে সেগুলো মেনে নেওয়ার উদারতা লাভ করে।

আমার কৈশোরে শঙ্কুকাহিনির কল্পনার তুঙ্গস্পর্শের ও রোমাঞ্চের এবং পাশাপাশি তাঁর মতো অন্তত ভাষাবিদ হতে চাওয়ার অলীক আকাশকুসুম স্বপ্নের একটা বড় জায়গা আছে। তাই, লেখাটা দুটো আফসোসের সাথে শেষ করছি।

এক, সত্যজিতের মহান ক্ষমতা ছিলো গল্পরচনার। তিনি গল্পে মানবিকতার, বিবেকবোধের, রসবোধের জয়জয়কার এনেছেন বারবার। কিন্তু, বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ জাগালেও তিনি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পথে উদ্বুদ্ধ বোধহয় ততোটা করতে পারেন নি। রোমাঞ্চের স্বাদ মেলে তাঁর লেখায়, কিন্তু গল্পগুলো শেষাবধি গল্পই থেকে যায়। বরং, সে-তুলনায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখাগুলো অনেকই অগ্রগামী। বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেক নিরাপদ সেগুলো এবং অন্তত ছদ্ম- বা অর্ধবিজ্ঞানের মোহজালে জড়াবে না সেগুলো নতুন প্রজন্মকে। কিংবা, কে জানে, হয়তো রসগ্রহণই শেষ কথা অনেকের কাছে বা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে মরে-যাওয়াও তেমন দুঃখের কিছু নয়!

দুই, শঙ্কুপ্রেমীরা বিজয়া রায়ের সাক্ষাৎকারের এই অংশটি দেখুন:

“আচ্ছা ফেলুদার মতো, আর-এক স্বসৃষ্ট চরিত্র প্রফেসর শঙ্কুকে নিয়ে ছবি তৈরির কথা কখনো ভাবেননি সত্যজিৎ?

-ভেবেছে, তাছাড়া আমরাও বলেছি শঙ্কুকে নিয়ে ছবি করার জন্য। কারণ ফেলুদা এবং শঙ্কু দুটোই ইকোয়ালি ফেভারিট আমার-বাবুরও। কিন্তু মানিক বলত- ফেলুদার যেমন পপুলারিটি, সিনেমায় তাকে দেখবার জন্য দর্শকের যে-প্রস্তুতি- শঙ্কুর ক্ষেত্রে তেমন নেই। তার চেয়ে বড়ো কথা শঙ্কুর বাড়ি গিরিডি হলেও, তার কর্মকাণ্ড প্রায় সবই বিদেশে। শুটিঙের খরচ, বিদেশের লোকেশনে কাজ করা দুটোই এলাহি ব্যাপার এবং বেশ ট্রাবলসাম।”

[৮০]

আশা করি, ভবিষ্যতে কোন মেধাবী পরিচালক ও উদার প্রযোজকের যুগলবন্দীতে আমার মতো এমনি অনেক শঙ্কুপ্রেমীর হাহুতাশের অবসান ঘটবে।

(খতম)

পু: এই লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে আমায় অনেকের সাহায্যই নিতে হয়েছে যাঁদের আমি কাছের মানুষ মনে করি। তাই আলাদা করে তাঁদের নামোল্লেখ করতে চাই না। আশা করি, তাঁরা এতে কিছু মনে করছেন না।

কৃতজ্ঞতা:
[৫০]. শঙ্কুসমগ্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০৯, পৃ. ৪৯
[৫১]. ঐ, পৃ. ৩৮৩
[৫২]. সত্যজিৎ রায়-দ্য ইনার আই, এন্ড্রু রবিনসন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ দিল্লি, ভারত (প্রথম ভারতীয় সংস্করণ), ২০০৪, পৃ. ২৯৯-৩০০
[৫৩]. ঐ, পৃ. ২৯৯
[৫৪]. গল্প ১০১, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০১, পৃ. ৭৬০।
[৫৫]. ঐ, পৃ. ৭৬২।
[৫৬]. শঙ্কুসমগ্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০৯, পৃ. ৪১১
[৫৭]. সায়েন্স ফিকশন সমগ্র (এক),মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা, বাংলাদেশ, অবসর, ১৯৯৪, পৃ. ৪০০
[৫৮]. শঙ্কুসমগ্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০৯, পৃ. ৩৮
[৫৯]. ঐ, পৃ. ৭২
[৬০]. ঐ, পৃ. ৯২
[৬১]. ঐ, পৃ. ৩৫৭
[৬২]. ঐ, পৃ. ২২
[৬৩]. ঐ, পৃ. ২৫৩
[৬৪]. ঐ, পৃ. ৪৪৩
[৬৫]. ঐ, পৃ. ৫৯২
[৬৬]. ঐ, পৃ. ৬০০
[৬৭]. ঐ, পৃ. ৪৩৭
[৬৮]. গল্প ১০১, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০১, পৃ: ৩৭২
[৬৯]. সুকুমার রচনাসমগ্র (অখণ্ড সংস্করণ), সুকুমার রায়, ক্যাবকো, বাংলাদেশ, ১৯৯৮, পৃ. ৩৩৩
[৭০]. আরো সত্যজিৎ, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ১৯৯৩, পৃ: ৪১৪
[৭১]. পাঁচালী থেকে অস্কার (দ্বিতীয় খণ্ড), অনিরুদ্ধ ধর, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, অতনু চক্রবর্তী, প্রতিভাস, কলকাতা, ভারত, ২০১১, পৃ. ৫৮২
[৭২]. ঐ, পৃ. ৫৮১
[৭৩]. শঙ্কুসমগ্র, সত্যজিৎ রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০৯, পৃ. ৪১৯
[৭৪]. ঐ, পৃ. ৫১৩
[৭৫]. রোমন্থন, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ২০০৭, পৃ. ৬০।
এর পরের অংশটা যদিও অপ্রাসঙ্গিক, তারপরও এতোই মজার যে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
[সনাতনীরা বিরক্ত হয়ে ব্রাহ্মদের ব্যঙ্গ করে প্রার্থনা সভা বসালেন। প্রার্থনা হত, “হে পরম-কারুণিক পরমেশ্বর, তুমি আমাদের অন্ধকার হইতে আলোকে লইয়া যাও। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হউক। কিন্তু পিতঃ, তোমার এই মঙ্গলময় সৃষ্টিতে অবিচার কেন? তুমি জোনাকীর পশ্চাতে আলোক দিয়াছ, আমাদের পশ্চাতে ত দাও নাই প্রভু?”]

[৭৬]. সত্যজিৎ রায়-দ্য ইনার আই, এন্ড্রু রবিনসন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ দিল্লি, ভারত (প্রথম ভারতীয় সংস্করণ), ২০০৪, পৃ. ২৬
[৭৭]. ঐ, পৃ. ২৬
[৭৮]. ঐ, পৃ. ১১১
[৭৯]. পাঁচালী থেকে অস্কার (দ্বিতীয় খণ্ড), অনিরুদ্ধ ধর, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, অতনু চক্রবর্তী, প্রতিভাস, কলকাতা, ভারত, ২০১১, পৃ. ৭০
[৮০]. ঐ, পৃ. ৫৮২