(স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের মুখ আমাদের স্মৃতিতে অম্লান।হারিয়ে যাওয়া সেইসব স্বজনদের স্মরণে প্রতি বছরের মত এবারও বিজয় দিবসের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে ১০ ডিসেম্বর ২০১১ নিবেদন করেছিল নারীপক্ষ’র (নারীপক্ষ বাংলাদেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠন) শ্রদ্ধাঞ্জলি “আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার”। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর একটি বিশেষ বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে নারীপক্ষ। এবারের বিষয় ছিল “৭১ – এর যে নারীদের আমরা ভুলেছি”। সে অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটি একটু সংক্ষেপ করে মুক্ত-মনার পাঠকদের জন্য)

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা।সেখানে মুক্তির আনন্দ এবং বীরগাঁথা যেমন রয়েছে তেমনই আছে অপরিসীম দুঃখ-যন্ত্রণা,অত্যাচার-নির্যাতন, লাঞ্ছনা,আছে আপনজন হারানোর বেদনা,শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে বাঁচে থাকার বিড়ম্বনা। ঐ যুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু নারী।স্বাধীনতার পরও তাদের সইতে হয়েছে বাড়তি অপমান এবং সামাজিক – পারিবারিক তাচ্ছিল্য,বিদ্রুপ ও অবহেলা।রাষ্ট্রীয় অবহেলায়, রাজনৈতিক দলও সুধী সমাজের মনোযোগের বাইরে, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিবার ও আপনজনদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার কারণে যাঁদের গর্ভে সন্তান এসেছিল গর্ভপাত ছাড়া আর কোন উপায় বা সুযোগ তাঁদের সামনে তুলে ধরা হয়নি।যে যুদ্ধশিশুরা জন্মগ্রহন করেছিল তাদেরকেও আমরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারিনি।

মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাঁদেরকে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান “বীরাঙ্গনা” উপাধি দিয়েছিলেন।শাব্দিক অর্থে বীরাঙ্গনা হচ্ছে বীর যোদ্ধা, বীর নারী, বীর্যবতী বা সাহসী নারী, অর্থাৎ অসীম সাহসী নারী যাঁরা দেশের জন্য প্রাণাপাত করে লড়াই করেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ বিপরীত।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতার পর পরিবার তাঁদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে তাঁরা আত্ম পরিচয় আর আশ্রয় আবাসনের সংকটে পড়েন।। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, শঙ্কা, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা ও মর্যাদার সংকট সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাঁদের দিন কাটে।

বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ, ধারণা ও ব্যবহারের দিকে লক্ষ্য না রেখেই বীরাঙ্গনা উপাধি দেওয়া হয়।এর ফলে তাঁরা মূলধারা হতে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হওঁয়ে পড়েন।বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী সে সময়ে তাঁদের সম্মানীত করার জন্য প্রস্তুত ছিলনা”। বরং এই উপাধির কারণে তাঁরা হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। এই উপাধি তাঁদের জন্য অসম্মান,অপমান,অপবাদ এবং লাঞ্ছনারকারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্বাধীনতার পরবর্তীচল্লিশ বচরে তাঁরা সেই বীরের সম্মান,মর্যাদা এবং জীবন যাপনের ন্যায সুযোগ-সুবিধাটুকু পায়নি, এমনকি তাঁদের ওপরে সংঘটিত অপরাধের বিচারও তাঁরা পায়নি।

আমাদের সমাজ সংস্কৃতির চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ধর্ষণ বা যে কোন ধরণের যৌন নির্যাতন নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রমহানি ঘটায়।পরিবার ও সমাজ নির্যাতনের শিকার নারীকেই অপমান ও অপদস্থ করে এবং তাকেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে।’ ৭১ ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রতিহত করতে তাঁদেরকে প্রকাশ্যে সম্মান প্রদানের কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।আমাদের আজও শুনতে হয় ‘দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে…।” ইজ্জত ও সম্ভ্রম কোনভাবেই শরীর কেন্দ্রীক নয়, তাই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীদের ইজ্জত ও সম্ভ্রমের প্রশ্ন তোলা তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণ্ন করার সামিল। যারা বীরাঙ্গনা, তাদের ইজ্জত যায়নি,সম্ভ্রমহানি হয়নি, তাঁরা যুদ্ধপরাধের শিকার, সুতরাং এই ধরণের উক্তি আমরা আর শুনতে চাই না।

চল্লিশ বছর বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনে সবাই ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের ব্যথিত করে, লজ্জিত করে।আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।আমরা চাই, রাষ্ট্র বীরাঙ্গনা সম্বোধনের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার অনেক বীরাঙ্গনা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আজ বেঁচে নেই,যাঁরা বেঁচে আছেন, আমরা চাই তাঁরা যেন আর্থিক স্বচ্ছলতায় ও সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারেন, সকল আড়াল ভেঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, সর্বত্র সমান ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।
আমাদের দাবিঃ
• ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নারীর ওপরে সংঘটিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোন সাধারণ অপরাধ নয়, তা যুদ্ধপরাধ। এই অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিচার করতে হবে।
• বীরাঙ্গনাদের প্রতি সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে লিখনে, বলনে বা ভাষণে শব্দ ও ভাষা ব্যবহারে ধর্ষিতা, ইজ্জতহানি,সম্ভ্রমহানি, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।সকল রাষ্ট্রীয় দলিল ও কার্যক্রম থেকে ‘দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে …” বা “‘দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি…” ধরণের কথা বাতিল করে সে স্থান সরাসরি “ ১৯৭১- এর মুক্তিযুদ্ধে ‘দুই লাখ নারী ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন” এই বাক্য ব্যবহার করতে হবে।
• ’ ৭১-এর বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকারী সহায়তা, যথা সকল সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা এবং ভাতা প্রদান যাতে তাঁরা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন, সম্মান ও মর্যাদার সাথে তাঁদের পছন্দমতো স্থানে বসবাস করতে পারেন।
মুক্তিযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণে আজ আমরা মোমবাতির যে আলো জ্বেলেছি তা সকল অন্যায়- অবিচারের অন্ধকারকে দূর করে দেশের প্রতিটি মানুষের ন্যায অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়ে সমুজ্জ্বল হোক।এই আলো এনে দিক ’৭১-এর ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের জীবনে প্রশান্তি, এই আলো ফিরিয়ে দিক “বীরঙ্গনা” সম্বোধনে সম্মান ও মর্যাদা।