পূর্ববর্তী পর্বঃ কলাম্বাসের নতুন পৃথিবী

১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবার ক্রিস্টোফার কলাম্বাস বাহামায় প্রথম নোঙ্গর করার প্রায় আট সপ্তাহ পর, ডিসেম্বার মাসের পাঁচ তারিখে আরো খানিকটা জাহাজ চালিয়ে এসে পৌঁছান বর্তমান দ্বীপ হাইতি এবং ডোমিনিকান রিপাবলিক-এ; যেটি সে-সময় পরিচিত ছিলো ‘হিস্পানিওলা’ নামে। ততদিনে কলাম্বাস আর তার সঙ্গীরা বুঝে গেছে, খুবই সহজ সরল আর বোকা প্রকৃতির, খুঁজে পাওয়া নতুন পৃথিবীর এই নতুন মানুষগুলো। সেই সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে গেছে পরিকল্পনারও। আক্রমণকারী লুটেরার দল চিরকাল যা করে এসেছে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

হিস্পানিওলার উপকূলে প্রচন্ড ঢেউয়ে ভেঙ্গে পড়ে কলাম্বাসের জাহাজ। সে-খবর জানতে পেরে, দ্বীপের অধিবাসী ‘তাঈনো’ সম্প্রদায়ের গোত্রপ্রধান ‘গুয়াকানাগারি’ সাথে সাথেই তার সমস্ত লোকজনকে নিয়ে এগিয়ে আসেন কলাম্বাস আর তার দলবলের সহযোগিতায়। অবাক চোখে সাদরে গ্রহণ করে নেন অজানা এই অতিথিদের। তাদের বসবাসের জন্য বানিয়ে দেন ঘর; খাবার-দাবার, আরাম-আয়েশের জন্য করে দেন সব ধরণের আয়োজন। সে সময় দ্বীপ ও তার আশপাশে প্রায় এক মিলিয়ন তাঈনো লোকজনের বসবাস। কল্পনাতীত রকমের সহজ-সরল, সদা হাস্যময় দ্বীপের অধিবাসীরা। কলাম্বাস আর তার সঙ্গীরা এখানকার মানুষের রীতি-নীতি আচার আচরণে মুগ্ধ হলেন। শুধু তাই নয়, নানান প্রজাতির অজানা পশু-পাখি, গাছ-পালা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মনোমুগ্ধকর। তবে সব কিছুকে ফেলে রেখে অবাক করে দেয় যে বস্তু, সেটা হলো স্বর্ণ; স্বর্ণের কোনো দামই নেই এই দ্বীপবাসীর কাছে। এখানকার বিভিন্ন গোত্র নিজেদের মধ্যে খাবার-দাবার আর পশুপাখির বাণিজ্য করেই সম্পর্ক গড়ে তুলে। তারা জানে, কি করে হাসি-খুশি দিয়ে ভরিয়ে রেখে একটা সহজ-সরল জীবন পার করে দেয়া যায়; তারা জানে না, কি মূল্য এই স্বর্ণের, তারা আরো জানে না – তাদের এই সহজ-সরল পৃথিবীর বাইরেও আরেকটা জটিল পৃথিবী আছে, যে পৃথিবীর মানুষজন হিংস্র আর লোভী, ধূর্ত আর নির্দয়। ধন-দৌলত আর সোনা-রূপার দামের কাছে যেখানে সাধারণ কোনো মানুষের দুই পয়সার দামও নেই।

কিছুদিন পরেই নতুন এই পৃথিবীর খবর নিয়ে কলম্বাস ফিরে গেলেন স্পেনে, সাথে করে নিয়ে গেলেন প্রচুর পরিমাণ উপহার। ১৪৯৩ সালের ডিসেম্বারে আবার ফিরেও এলেন স্পেন থেকে। কিন্তু, উপহারের বিনিময়ে সাথে করে উপহার নয়, নিয়ে এলেন সতেরটি জাহাজ ভর্তি সৈন্য আর গোলাবারুদ। শুরু হলো নোংরা স্পেনিশ আধিপত্য, সেই সঙ্গে শুরু হলো ইতিহাসের পালাবদল।

ভয় দেখিয়ে সমস্ত তাঈনো লোকজনকে পরিণত করা হলো দাসে । স্বর্ণ উত্তোলনের আকাঙ্খায় দিনের পর দিন স্বর্ণখনিতে তাদেরকে দিয়ে করানো হলো অমানুষিক পরিশ্রম। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর গেলো। সময়ের সাথে সাথে কলাম্বাস এবং কলাম্বাস পরবর্তী অভিযানসমূহে নেটিভ্‌ তাঈনোদের উপর স্প্যানিশদের অত্যাচার আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। সেরকমই এক অভিযানের সাথে থাকা ধর্মযাজক ‘বার্তোলোমি ডি লাস কাসাস’ এর নিজের লেখায় সেই নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে এভাবে-

“… mountains are stripped from top to bottom and bottom to top a thousand times; they dig, split rocks, move stones, and carry dirt on their backs to wash it in the rivers, while those who wash gold stay in the water all the time with their backs bent so constantly it breaks them; and when water invades the mines, the most arduous task of all is to dry the mines by scooping up pansful of water and throwing it up outside….”

“…সমস্ত পাহাড় সহস্রবার তন্ন তন্ন করে হয় খোঁজা হয় স্বর্ণ; তাঈনোরা পাহাড় কেটে, পাথর ভেঙ্গে চুরমার করে পিঠে করে নিয়ে যায় নদীতে ধোয়ার জন্য। নদীর পানিতে উপুড় হয়ে পাথর ধুতে ধুতে তারা কুঁজো হয়ে পড়ে; বড় বড় গর্তগুলো যখন পানিতে ভরে যায়, তখন তাদেরকেই আবার পানি সেঁচে সেটা শুকোতে হয়…”(ভাবানুবাদ)

এমতাবস্থায়, একপর্যায়ে সমস্ত দ্বীপে দূর্ভিক্ষ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু, তারপরও যে-কোনো মূল্যেই হোকনা কেন, স্পেনিশ্‌রা চায় স্বর্ণ আর স্বর্ণ, চায় তাদের খাবার-দাবার, আরাম-আয়েশের যোগান। আর সেটা জোগাড় করতে হবে ‘তাঈনো’দেরকেই। অসম্ভব এই নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হয়ে, এবার ‘তাঈনো’রা হয়ে উঠে বিদ্রোহী, গড়ে তুলে প্রতিরোধ। বিদ্রোহ দমনে শুরু হয় মিলিটারি আক্রমণ। তাঈনোরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাহাড়ে পাহাড়ে। কিন্তু, ততদিনে রোগ-শোকে, অমানুষিক পরিশ্রমে, ক্লান্তি-অবসাদে ভেঙ্গে পড়ে তাঈনোরা। সবচেয়ে বেশি ভেঙ্গে পড়ে লজ্জায় আর গ্লানিতে। তাই, আত্মসন্মান বাঁচাতে দলে দলে হাজারে হাজারে ‘তাঈনো’ বেঁচে নেয় আত্মহত্যার পথ।

http://youtu.be/jOfEAbNiKFM
ভিডিওঃ কলাম্বাসের আগমন (ফাইভ হান্ড্রেড নেশানস্‌)))) ))))(পর্ব ১)
http://youtu.be/BGuNpPt_tfw
ভিডিওঃ কলাম্বাসের আগমন (ফাইভ হান্ড্রেড নেশানস্‌)))) ))))(পর্ব ২)

কলাম্বাসের প্রথম অভিযানের ১১ বছর পর, ১৫০৩ সালের মধ্যেই তাঈনোদের সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। তবে, একটি দল ছিলো, যারা স্প্যানিশদের প্রভূত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন জীবন যাপন করে আসছিলো। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন এক নারী। যার নাম ‘আনাকাওনা’, যাকে বলা হতো ‘গোল্ডেন ফ্লাওয়ার’। এবার স্প্যানিশ্‌রা নজর দেয় আনাকাওনার দিকে, শুরু হয় তাঁকে পরাস্ত করার নোংরা প্রস্তুতি। ‘আনাকাওনা’র প্রতিরোধ নির্মূল করার গোপন প্রত্যয়ে স্প্যানিশ্‌ গভর্নর ‘আনাকাওনা’ এবং তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে এক শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিলেন। ‘আনাকাওনা’ রাজী হলেন এবং তাঁর আশিজন উপনেতাকে নিয়ে নির্ধারিত দিনে স্প্যানিশদের সাথে সভায় বসলেন। কিন্তু, যে ইতিহাস ‘আনাকাওনা’ জানতেন না- এই সেই স্প্যানিশদের দল যারা আবদ্ধ ঘরে আগুনে পুড়িয়ে দলে দলে জীবন্ত মানুষ মারে; এই সেই বর্বর, অসভ্যদের দল যারা ভিতরে পুড়তে থাকা জীবন্ত মানুষের চিৎকার আর পুড়ন্ত লাশের গন্ধ বাইরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে। নিরুপায়, সরল ‘আনাকাওনা’র আশিজন উপনেতার ভাগ্যের সেই করুণ পরিণতিই হলো। সভাঘরের দরজা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো; যারা আগুন পেরিয়ে বের হয়ে আসতে পারলো, চারদিকে ঘিরে থাকা স্প্যানিশ সৈন্যদের তরবারির আঘাতে তারা হয়ে গেলো টুকরা টুকরা। তাঈনোদের গোল্ডেন ফ্লাওয়ার ‘আনাকাওনা’কে ধরে এনে ঝুলানো হলো ফাঁসিতে।

ছবিঃ শিল্পীর তুলিতে আঁকা কলাম্বাসদের নির্যাতন

স্প্যানিশদের এই হত্যাকান্ডের ময়দান থেকেই একজন খ্রিস্টান মিশনারী (লাস কাসাস) কাছে টেনে নিলেন এক শিশুপুত্রকে, যার পিতাকে সে শিশুর চোখের সামনে অন্য আর সবার সাথে পুড়িয়ে মারা হয়। শিশুর নাম ‘এনরিকে’। ধর্মান্তরিত হয়ে সেই মিশনারীর তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠে এনরিকে। কিন্তু, স্প্যানিশদের করা নিয়ম অনুযায়ী একসময় এনরিকে’কেও দাসত্ব করতে বাধ্য করা হয়। এনরিকে দাসত্ব করতে বাধ্য হলেও মনে মনে ঠিকই লালন করতে থাকে জমানো ক্ষোভ, ধৈর্য ধরে সব মেনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে, তার মনিব কর্তৃক তার নিজ স্ত্রী ধর্ষিত হবার পর এনরিকের সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মনিবের নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে, এনরিকে আর তার অনুসারীরা পালিয়ে যায় দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, ঘোষণা করে বিদ্রোহ। বার্তোলোমি ডি লাস কাসাস এর লেখা অনুযায়ী-

“…The Spanish came to call him the rebel Enrique, and those who followed him were termed rebels and insurgents, although in truth they were not rebelling, but only fleeing from their cruel enemies, who were misusing and destroying them, just as a cow or an ox tries to escape from the slaughterhouse…”

“…স্প্যানিশরা তাকে আখ্যায়িত করলো বিপ্লবী এনরিকে নামে, তার অনুসারীদের ঘোষণা করলো বিদ্রোহী। অথচ, তারা কেউই বিদ্রোহ করেনি, তারা কেবল তাদের হিংস্র প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো, যারা তাদের তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। তারা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো, যেমন করে গরু মহিষগুলো কসাইখানার কাছ থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে চায়…” (ভাবানুবাদ)

সময়ের সাথে সাথে, ধীরে ধীরে এনরিকে এর সাথে যোগ দেয়া তাঈনোর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত স্প্যানিশবাহিনী বারবার আক্রমণ করতে থাকে, বর্শা-বল্লমে সজ্জিত অপরিপক্ক নেটিভ্‌ এনরিকে বাহিনীকে। কিন্তু, তারপরও অসম্ভব সাহস আর ক্ষিপ্রতা দেখিয়ে এনরিকে বাহিনী বারবার স্প্যানিশদের পিছু হটতে বাধ্য করে। অচিরেই নেটিভদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এনরিকে’র সুনাম। দলে দলে তাঈনোরা এসে যোগ দিতে থাকে এনরিকে’র সাথে। প্রায় এক দশক ধরে অবিরাম চেষ্টা করেও পরাজিত করতে না পেরে, অবশেষে স্প্যানিশরা আবারো শান্তি চুক্তি করার প্রস্তাব দিলো। কিন্তু, যে শান্তি চুক্তির নাম করে স্প্যানিশরা তার পিতাসহ বহু নেটিভ্‌দের হত্যা করে, সেই ফাঁদে পা দেওয়ার মানুষ এনরিকে নয়। কোনোভাবেই সে শান্তি আলোচনায় বসতে রাজী নয়। উপায়ান্তর না দেখে স্প্যানিশরা এনরিকে’র লালনকারী সেই মিশনারি লাস কাসাস কে দায়িত্ব দিলো শান্তি আলোচনার। এনরিকেরা তথাকথিত সভ্য পৃথিবীর মানুষদের মত বিশ্বাসঘাতক নয়। যে লাসা কাসাস একদিন শিশু এনরিকে’কে কোলে তুলে এনে লালন-পালন করেছিলেন, তার অনুরোধের কছে নতি স্বীকার করলো এনরিকে। অবশেষে, লাসা কাসাসের প্রচেষ্টায়, এনরিকে’র লোকজনকে স্বাধীনতা দেয়ার বিনিময়ে এবং তাদের জীবন-যাপনে কোনো রকমের উপদ্রব না করার শর্তে এনরিকে’র বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটলো।

ছবিঃ মিউজিয়াম অব দ্যা ডমিনিকান ম্যান এর সামনে এনরিকে'র স্ট্যাচু

এরপর, মাত্র চারহাজার অনুসারী নিয়ে এনরিকে তাদের স্বাধীন অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করলো। কিন্তু, ততদিনে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক কিছু। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা তাদের জনপদ আর ঐতিহ্য; খুন হয়ে গেছে তাদের হাজার হাজার অধিবাসী, প্রতিবেশি, আত্মীয়, স্বজন, পিতা, মাতা, সন্তান। তারই ধারাবাহিকতায় শতাব্দীর শেষের দিকে ‘তাঈনো’ জাতীগোষ্ঠিকে অফিসিয়ালি বিলীন বা নির্মূল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ লাসা কাসাসের হিসাব অনুযায়ী কলাম্বাসের আগমন কালে তাদের সংখ্যা ছিলো প্রায় বিশ লক্ষের কাছাকাছি। কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ নয়, কোনো ভূমিকম্প, সুনামির আঘাতে নয়, কোনো ধূমকেতুর আবির্ভাবেও নয়; যে হিংস্র প্রজাতি এই সাধারণ মানুষগুলোকে খুন করেছে সেই প্রজাতির নামও ‘মানুষ’, সভ্য জগতের মানুষ। এরা না-কি আবার সৃষ্টির সেরা জীব! বুদ্ধিমান হওয়া মানেইতো সেরা হওয়া নয়।

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]

তথ্যসূত্রঃ
১। অ্যা পিপলস্‌ হিস্ট্রি অব ইউনাইটেড স্টেটস্‌ – হাওয়ার্ড জিন্‌
২। মুভ্যিঃ ১৪৯২: কনকোয়েস্ট অব প্যারাডাইজ
৩। ৫০০ নেশানস্‌(
৪। কলাম্বাস নেভিগেশান
৫। উইকিপিডিয়া
৬। ইন্টারনেট