মনে করুন একজন লোক একটি সাধারণ দড়িকে সাপ মনে করে ভয় পেয়ে মারা গেল।পরবর্তীতে পরীক্ষা করে দেখা গেল যে ওটা দড়ি। এখন কোন ব্যাপারটি খুব সত্যি? অনেকেই এই যুক্তির উপসংহার টানেন জগতের পরম-আপেক্ষিকতার মতবাদে।বলেন যে সব কিছুই সাবজেক্টিভ বা ব্যাক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ব্যাপার।এ উপসংহার মেনে নিলে প্রশ্ন উঠে তাহলে নিখাদ ও নৈর্ব্যাক্তিক বাস্তবতা বলতে কী কিছুই নেই?যদি অধিকাংশ লোক ঐ বস্তুটিকে দড়ি বলে সাব্যস্ত করে তবে কী অধিকাংশের দাবি প্রসূত ব্যাপার বলেই তাদের কথা সঠিক?এবং ঐ মৃত ব্যক্তি একজন বলেই দাবিটি ভুল? আমি অনেককেই প্রশ্নটি করেছি।তাদের অধিকাংশই মনে করেন বাস্তবতা একটি সাবজেক্টিভ ব্যাপার।কিন্তু সেই সাথে এটাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে ঐ বস্তুটি দড়িই-সাপ নয়।কিন্তু অনেকাংশেই তাদের ঝোঁক থেকে যায় পুরো ব্যাপারটিকে আপেক্ষিক ব্যাপার হিসেবে ব্যাখ্যা করার।আমার ধারণা এই যে পুরো ব্যাপারটিকে আপেক্ষিকভাবে বিচার করার ঝোঁক থেকে যায় তার পেছনে যুক্তির বদলে একটা বিরাট সহানুভূতি কাজ করে-আর সেটা হচ্ছে মৃত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি। এ সহানুভূতির ফলেই তৈরী হয় সব কিছু আপেক্ষিক ভাবে বিচার করার মনস্তত্ত্ব।সেই সাথে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে ঐ বস্তুটি আসলে দড়িই। এ উদাহরণের মধ্য দিয়ে একটি বিরাট ব্যাপার উঠে আসে।তা হল- আমাদের সমস্ত অপরিক্ষীত ঘটনাবলীর সাথে জড়িত থাকে আমাদের মৌলিক ও আদিম নানারকম আবেগের মিথস্ক্রিয়া।আমরা এটাকে নাম দিতে পারি আবেগযুক্ত-ভ্রান্তি। এ আবেগযোগ্য ভ্রান্তির ফলেই মানব মনে তৈরী হতে পারে বিশ্বজগতের নানারকম প্রতিরূপ। হ্যাঁ এটা সত্যি হতে পারে যে অন্যান্য প্রজাতির কাছে জগতের প্রতিরূপ মানুষের তৈরী করা প্রতিরূপের থেকে কিছুটা ভিন্ন।কিন্তু এ ভিন্নতা প্রকৃতির কোন সাধারণ সূত্র কে লঙ্ঘন করে না ।কিন্তু একই প্রজাতির মধ্যে প্রকৃতি সম্পর্কিত এই যে মতপার্থক্যের উদ্ভব তার নিশ্চয় সবগুলোই সত্যি হতে পারে না। এর নানারকম প্রমাণ পাওয়া যায়।মানুষ হাজার হাজার কুসংস্কারে বিশ্বাস করে।এবং এগুলোর যে কোন ভিত্তি নেই তা প্রমাণিত।কিন্তু প্রামাণিক না হয়েও কিছু কিছু ব্যাপার কেন এখনো আমাদের আনন্দ দেয়?কেন আমরা উপভোগ করি ইলিয়াড, ওডিসি কিংবা মহাভারত রামায়ণের পৌরাণিক দেব-দেবীদের কাহিনী ও তাদের প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত কার্যকলাপ?একজন কবি আমাকে যুক্তি দিচ্ছিলেন যে আমাদের লজিক নানারকম ভাবে খেলা করতে পারে।এবং তিনি মনে করেন মানসিক-বাস্তবতা বলতে কোন ব্যাপার আছে যা কিনা যৌক্তিক এবং যা কিনা এখনও আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। কবিতায় ব্যবহৃত অযৌক্তিক ও অসমাঞ্জস্যহীন উপমা কিংবা উৎপ্রেক্ষা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের তৃপ্তি দেয় কেন? মস্তিষ্ক কী ব্যাপারটিকে বাস্তবিক ও যৌক্তিক মনে করে? মস্তিষ্ক যা কিছু যৌক্তিক মনে করে তাতেই তৃপ্তি পায় এবং সন্তুষ্ট হয় বলেই আমার ধারণা।কেননা যা কিছু মস্তিষ্কের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় তা কখনো মস্তিষ্ককে তৃপ্তি দিতে পারে না। কিন্তু কেন মানুষের মন কিছু অদ্ভূত ব্যাপারকে গ্রহণযোগ্য মনে করে?এবং বর্জন করে সঠিক যৌক্তিক প্রক্রিয়া?
মানব মনের এ রকম একটি প্রবণতার উদাহরণ দেখা যায় ভাষা ব্যবহারে।ভাষা ও বস্তুর মধ্যকার সম্পর্ক এতোটাই আরোপিত যে এর সঠিক কোন ব্যখ্যা আজো পাওয়া যায় নি।কিন্তু ভাষা ব্যবহার করার যোগ্যতা প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে নিয়ে আসে।আর অনেক দার্শনিকের মতো যদি এটা স্বীকার করে নেই যে কোন কিছুই ভাষার বাইরে নয়-তবে একটি ব্যাপার উঠে আসে যে মানুষ জগত সম্বন্ধে যে প্রতিরূপ তৈরী করে তাও ভাষা দ্বারা আবদ্ধ।আমরা যে পরিচ্ছন্ন যুক্তি তৈরী করি তাও কী ভাষা দ্বারা আবদ্ধ? যদি তাই হয় তার মানে কী এটা যে (যেহেতু ভাষার অনেকাংশ আরোপিত;ফলে এটি একটি অযৌক্তিক ক্ষেত্র) আমরা যখন যুক্তি তৈরী করি তখন কেটে ফেলি বা ছেঁটে ফেলি ভাষার অযৌক্তিক অংশগুলোকেই? যদি ভাষাকে ধরা হয় মিম পুলে জড়িয়ে থাকা কোন স্বত্ত্বা রূপে তবে ধরে নিতে হয় ভাষা আমাদের বিবর্তনের ধারায় একটি উপজাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।যেমন উপজাত হিসেবে এসেছে ধর্ম ও ভালোবাসা বা প্রেম,স্বজাত্যবোধ। আমরা পৌরাণিক ধর্মে যখন আস্থা হারিয়ে ফেলি তখন কী ছেঁটে ফেলি ভাষার অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ?এবং অসীম বাক্যক্ষেত্র থেকে তুলে আনি অন্য কোন বাক্য পরিপূরক হিসেবে? এবং যখন এ পরিশোধন ক্রিয়া চলে তখন কী তার সাথে যুক্ত হয়ে যায় কিছু নতুন অপরিশোধিত আবেগ?এবং এটিই কী আমাদের মাঝে জন্ম দেয় কিছু অযৌক্তিক ব্যাপারকে উপভোগ করার তাড়না?অথবা এমন কী হতে পারে মানুষের ভাষা শুধুমাত্র বর্ণনা করতে পারে বলেই তা অন্য ইন্দ্রিয় যেমনঃ চোখ কান নাক বা ত্বকের অনুভূতিকে ব্যখ্যা করার জন্য অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে?যদি তাই হয় তবে এক ধরণের ব্যাখ্যা চলে আসে যে আমরা যেটাকে অযৌক্তিক মনে করি তা আসলে আমাদের জন্মগতভাবে পাওয়া বর্ণনা করার (ভাষা ব্যবহারের) ত্রুটি। ফলে যা আমরা বর্ণনা করতে ব্যর্থ হই তা আমাদের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হয়?।যেমন একজন পেইন্টার ব্যাবহার করেন রঙ তুলি।ফলে একই বিষয় নিয়ে একজন কবি যা বলেন তা একজন আর্টিস্টের কাজের সাথে হুবহু যায় না।আর্ট তৈরী করে আলাদা ভাষা-সম্ভবত আলাদা বাস্তবতাতাহলে ইলিউশনের ব্যাপারটি কী রকম?এটা কী সত্যি?তা হতে পারে না-ইলিউশন হচ্ছে এটা সত্ত্যি।কিন্তু এর ফলে আমরা যে উপসংহারে পৌঁছাই তা সত্যি হতে পারে না।এবং এটি কী এরকম যে আমরা যখনই এ রকম ইলিউশনের সঠিক ব্যখ্যা করে ফেলি তখনই আমরা পরিশুদ্ধ করে ফেলি আমাদের ভাষাকে? কিন্তু সম্ভবত পরিত্যক্ত জিনিসের প্রতি আমাদের ভালোলাগা অনেক দিন ধরেই থেকে যায়।তাই আমরা উপভোগ করতে পারি কবিতার মতো ভালো লাগার ব্যাপারগুলোকে যার অধিকাংশের কথাই হয়তো এখন বাজে কথায় পরিণত হয়েছে। এ কথাও কী তাহলে বলা যায় যে ধর্মগ্রন্থ( যেগুলোকে আমি কবিতার বই হিসেবে পড়ি এখন) সমূহের অযৌক্তিক বাণী আমাদের অশিক্ষিত মনে প্রভাব ফেলে যাবে আরো বহু বছর?কেননা আমরা মাত্র (মোটামুটি একশ শতাব্দী) শুরু করেছি ধর্মকে বাতিল করার যুদ্ধ;পুরনো জিনিস এখুনি মানুষের মন থেকে পুরোপুরি সরানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।একজন ধার্মিকের রিয়েলিটি ( পুরোটাই ইলিউশন) কতদিন আমাদের মিম পুলে থাকবে তা হয়তো নির্ভর করবে আরো নানা ঘটনা প্রবাহের উপর। এবং এ সময়ে হয়তো ঝরে যাবে আরো কিছু মেধাবী আর প্রগতিশীল মানুষ।

( এ লেখাটি আমার নিজস্ব অভিমত।এবং এর কোন কিছুই হয়তো প্রমাণসিদ্ধ না।আমি আমার কিছু এসাম্পশনের আলোকে কবিতা ও ভাষা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে চেয়েছি।মুক্তমনায় অনেকেই আছেন যারা এ ব্যাপারে অনেক ভালো বলতে পারবেন। নিখাদ বাস্তবতার সাথে ভাষা ও কবিতার উপমা উৎপ্রেক্ষার অনেক বিরোধ রয়েছে বলে আমার ধারণা।এ ব্যাপারটির ব্যাখ্যা খুঁজতেই এ প্রসংগে আলোচনার সূত্রপাত করলাম)