প্রথম ব্লগ লিখতে বসেছি। তাই যা বলতে চাইছি তার ঠিক কতটুকু গুছিয়ে বলতে পারবো সেই সন্দেহ নিয়েই শুরু করছি।

৪০ বছর হয়ে গেলো, ৪০ বছর! আজও দেখি অনেকে বিজয় দিবসকে স্বাধীনতা দিবস বানিয়ে দেয়। এইটুকু ভুল হয়ত আমি ক্ষমা করে দিতে রাজি আছি, কিন্তু সেদিন দেখা গেলো এক কোচিং সেন্টারের জনৈক শিক্ষার্থীকে (সে সম্ভবত এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে), তাকে জিজ্ঞেস করা হল গোলাম আযম কে? উত্তরে সে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে জবাব দিলো, “আমি ঠিক নিশ্চিত নই, শুধু এটুকু জানি উনি একজন বীরশ্রেষ্ঠ।” অন্য আরেকজনের কাছেতো শোনা গেলো মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭২ সালে হয়েছিল। কারো কাছ থেকেই ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের নাম পুরোপুরি জানা গেলো না। এই মানুষগুলোও এই দেশেরই মানুষ বিশ্বাস করতে আমি এখনো কিছুটা দ্বিধায় ভুগি। এতোটুকু পড়ে আপনি হয়তো ভাবছেন আমি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। না, আমি বোধহয় ঠিক দেশপ্রেমিক নই।

যে গল্পটা শুরু করতে যাচ্ছি সেখানে দুটি চরিত্র। আমি ‘ফ’ এবং ‘ন’, আমার প্রেমিকা। আমি বগুড়ার ছেলে। স্কুলজীবন পর্যন্ত কেটেছে বগুড়াতেই। ততদিন পর্যন্ত ওখানে বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারী বা পহেলা বৈশাখ বেশ সাদামাটাভাবেই পালিত হতে দেখেছি। এখন অবশ্য শুনি ওখানেও প্রায় ঢাকার মতই ঘটা করে উদযাপন চলে। যাহোক, একারণেই হয়ত আমার ঠিক শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাবার বা বিজয় উৎসবে যোগ দেবার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। পত্রিকায় এসবের ছবি দেখে ভালোই লাগতো, নটরডেম কলেজে সময় থেকেই ভাবতাম একবার ঠিকই যাব। কিন্তু ছুটির দিনের আলসেমি দূর করে কখনই ঠিক যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবারও সেই একই পরিকল্পনা ছিল। আর দশজনের মত ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করে আর বিজয় দিবস উপলক্ষে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দিব্যি শুয়েছিলাম। কিন্তু ‘ন’ ফোন করে জানালো স্বাধীনতা স্তম্ভে বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাসকে উপজীব্য করে লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে যাবে আর জানতে চাইলো আমি যেতে চাই কিনা। আগেই বলেছি আমারও আগে থেকেই ইচ্ছা ছিলো তাই রাজি হয়ে গেলাম। এখানে বলে রাখা উচিৎ, ‘ন’ আমার মত দেশ সম্পর্কে এতটা উদাসীন না। সে অনেক আশাবাদী আর দেশ নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সক্রিয় প্রতিযোগী ছিলো একসময়। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা মুনির হাসানদের মত মানুষেরা যে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে ওদের মনে সেগুলো বেশ ভালোভাবেই ধারণ করেছে সে।

যাহোক, ৬টায় শো। আমরা সোয়া পাঁচটায় বুয়েট থেকে রিকশা নিয়ে রওনা দিলাম। রিকশা থেকেই চারপাশের অসংখ্য মানুষকে খেয়াল করছিলাম। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। এর মধ্যে আবার ট্রাকের পর ট্রাক। কোন কোন ট্রাকে সাউন্ড সিস্টেমও আছে, অধিকাংশ ট্রাক ভর্তি মানুষ। তাদের গালে আবার পতাকা আঁকা এবং তারা দেখলাম ভীষণ খুশিও। আমি ‘ন’ কে বলছিলাম যে ঢাকার মানুষ যে এতো বিপুল উদ্দীপনায় বিজয় দিবস পালন করে জানতাম না। দেখে মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি ১৯৭১ সালেই চলে এসেছি! ‘ন’ কেও দেখলাম বেশ উৎফুল্ল এরকম উৎসব উৎসব পরিবেশ দেখে।

সোহরাওয়ার্দীর গেটে পৌঁছলাম একসময়। ততক্ষণে আমরা রিকশা ছেড়ে দিয়েছি। অবর্ণনীয় ভীড়। মানুষের কথাতো বাদই দিলাম, কেউ কেউ তার মধ্যে মোটর সাইকেল ঢুকিয়েছে। এত্ত ভীড় সত্ত্বেও ঢুকেই পড়লাম। কিন্তু মানুষের স্রোত থামছিলো না। আমি খুব বিরক্তি সহকারে তাকালাম ‘ন’ এর দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম এ কোথায় নিয়ে এলো ও আমাকে যেখানে হাঁটাতো দূরের কথা ঠিকঠাক দাঁড়াতেও পারছিনা। চারপাশে তাকিয়ে দেখি ‘ন’ ই একমাত্র মেয়ে ওখানে। এমন সময় শুরু হল প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি। ‘ন’ কে বললাম চল, বের হয়ে যাই এখান থেকে। ‘ন’ এমন দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে যার মানে হল এমনতো হয়ই বাংলাদেশে তার জন্যে কি এটা না দেখে চলে যেতে হবে নাকি? কিন্তু ধাক্কাধাক্কি একসময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। পেছন থেকে প্রচন্ড জোরে মানুষ ঠেলে চলছিল। এতোক্ষন হাত ধরে থাকলেও, তখন আর সম্ভব হচ্ছিলো না, ‘ন’ ছিটকে কোথায় যেন চলে গেল। এবং কিছুক্ষণ পরে আমি দেখতে পেলাম ‘ন’ মাটিতে পড়ে আছে আর ওর চারপাশে অসংখ্য হায়েনা! প্রানপণ চেষ্টা করে ওর কাছে গিয়ে  ওকে তুলে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। ‘ন’ এর দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম যে ওর উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর তীব্রতা টের পেলাম যখন কেউ আমার যৌনাঙ্গ ধরে টানাটানি শুরু করলো! আমার টাকা-পয়সা আর মোবাইল ফোনও হাতড়াবার চেষ্টা চালালো হায়েনাগুলো। আমি চিৎকার করে কাকুতি মিনতি করে বাইরে বের হওয়ার জন্য সাহায্য পাবার চেষ্টা করলাম। এভাবে কিভাবে যেন একসময় গেটের কছে চলে এলাম। বের হয়ে দুইজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সম্ভবত বুঝতে চেষ্টা করলাম কি হল কিছুক্ষণ আগে আমাদের সাথে! ‘ন’ কে একবার জিজ্ঞেস করতেও সাহস পেলাম না যে ও ঠিক আছে কিনা। শুধু একবার সে বলল যে আমি ভেবেছিলাম আজ বেঁচে ফিরতে পারবোনা। ও যে এর মাঝেও সংজ্ঞাহীন হয়ে যায়নি এতেই আমি বেশ অবাক হচ্ছিলাম। শুধু জিজ্ঞেস করলাম যেতে পারবে? ও হ্যাঁসূচকভাবে মাথা নাড়তেই দুজনে হাঁটতে শুরু করলাম।

ওকে পৌঁছে দিয়ে নিজে বাসায় ফিরলাম। সারা রাস্তায় ভয়ে জিজ্ঞেস করতে পারিনি ঠিক কি কি হয়েছে ওর সাথে।শুধু একবার সে বলল যে আমি ভেবেছিলাম আজ বেঁচে ফিরতে পারবোনা।  ফিরে এসে ফেসবুকে আমাদের অনেক পরিচিত বন্ধুদের সাথে যখন ঘটনাটা শেয়ার করছিলাম তখন ‘ন’ শুধু এই কথাগুলো লিখেছিল, “কি হচ্ছে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু একবার শুনলাম ‘ফ’ বলছে, ‘ন’ ঢুকতে পারবে না।  চলো বের হই। এটা শোনা মাত্র দেখলাম আমি মানুষের ধাক্কায় কই যেন চলে যাচ্ছি। ‘ফ’ আমাকে টানার চেষ্টা করছে। আমি কোনভাবেই নিজের ব্যালান্স রাখতে পারছি না। এবং আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হাত ঘোরাঘুরি করছে। আমি পড়ে গেলাম ওখানে,আমার  মনে হল এখনই মানুষের পায়ের চাপে আমি মারা যাবো। হঠাৎ দেখলাম ‘ফ’ কিভাবে যেন হাত দিয়ে আমাকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। যেই আমি উঠে দাঁড়ালাম,বুঝতে পারলাম আমার শরীরে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কারো হাত নেই। এমনকি আমার কাপড় খুলে ফেলার চেষ্টা চলছে। আমি যদি জিন্স না পড়ে একটা সালোয়ার পড়ে যেতাম তাহলে আজকে এই খবর সবাইকে পত্রিকায় পড়তে হত। আমি আর ‘ফ’ পাগলের মত হেল্প হেল্প করে চিৎকার করছিলাম। এবং সবার দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পারছিলাম, এখানে হেল্প করার কেউ নেই। সবাই একই কাজে ব্যস্ত।একসময় বুঝলাম ‘ফ’ কোনভাবে আমার পেছনে এসে আমাকে ঠেলে সামনে নিয়ে আসছে। তারপরে কিভাবে যে বের হলাম, আমি নিজেও  ঠিক sure না।”

এটুকু লেখার পর ‘ন’ ওর পরিচিত বন্ধুদেরকে একটা প্রশ্ন করেছিল, “পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে বাঙ্গালীদের হত্যা করেছিলো, নারীদের ধর্ষন করেছিলো।তাই আমরা তাদের ঘৃণা করি। আজকে আমি যদি আমার দেশে গণ ধর্ষন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাই, আমার দেশে যদি নির্দ্বিধায় মানুষ গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলতে পারে আমি কিভাবে আমার দেশকে ভালোবাসবো??

প্লিজ, আমার এই প্রশ্নের উত্তর এখন খুব দরকার।”

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এতো ভয়াবহ না হলেও এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। কারো হয়তো শহীদ মিনারে গিয়ে পশ্চাদদেশে থাবা পড়েছে, আবার কারো বইমেলায়। প্রবাসী এক বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম তার প্রেমিকাও আজ একই জায়গায় গিয়ে একই ঘটনার স্বীকার হয়েছে। দূর থেকে তার কষ্ট আমি শুধু কল্পনাই করতে পারি।

এসব শুনছিলাম আর প্রচন্ড ঘেন্না হচ্ছিলো নিজের উপর, পুরুষ হবার জন্য। পরে মনে হল আমি বোধ হয় ঠিক পুরুষ হতে পারিনি। ভীড়ের মধ্যে আমার পাশে থাকা নারীকে যৌন হেনস্থা করার পাশবিক আনন্দ পেতে আমার কখনোই ইচ্ছে করেনি, সুন্দর মেয়ে দেখে তাকে আদ্যন্ত নগ্ন কল্পনা করে আমার মুখে কখনো লালা জমে ওঠেনি। আমি ভেবেছি সুন্দর কিছু দেখে আমার মুগ্ধ হবার কথা, লালা জমিয়ে শিশ্ন উঁচিয়ে কাউকে চিরে খুঁড়ে খাবার কল্পনা কখনো করা হয়নি। একেকটা পুরুষ যেন মানসিকভাবে একেকটা হায়েনা।

আমি আর ‘ন’ যখন হাঁটছিলাম তখন কেন জানি পুরো ক্ষোভটাই দেশের উপর গিয়ে পড়ছিলো! ঘটনার দুইদিন পরে যখন লিখছি তখন অনেকটাই শান্ত হবার পরও আমারও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। বন্ধুরা আমাকে বুঝাচ্ছিলো যে এরকম যেকোন দেশেই হতে পারে। USA তেও pedophile/ sex offender দের অভাব নেই। আমি জানিনা, কিন্তু যারা সেদিন ওখানে ছিল তারাতো কোন একই পরিবার থেকে আসেনি কিংবা তারাতো কোন গ্রুপ হয়েও আসেনি। বিভিন্ন পরিবার থেকে, বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা এসেছিল ওখানে কিন্তু কেউই হেনস্থা করতে একবিন্দু ছাড় দেয়নি। এরকম একদল sex offender এর মহাবেশের কোন দেশ আছে কি? আমারতো মনে হয় এরাই এখন এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা ভীড়ের মধ্যে সুজোগ পেয়েও কিছু করবেনা, তারাই কি আজ সংখ্যালঘু না? দেশ জিনিসটা কি আলাদা কোন বিশেষ অস্তিত্ব? আমাকে যদি এই দেশের এসব হায়েনাকে ভালোবাসা নিবেদন করতে বলা হয়, তাহলেতো এটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আর এই দেশের সংস্কৃতি? ঘৃণা করি আমি এই সংস্কৃতিকে। ছোটবেলা থেকেই খুব ভালোভাবে পরিবার থেকে পুরুষদের হায়েনা হবার আর নারীদের পুতুল হবার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। (সিগমন্ড ফ্রয়েড নারীদের ‘penis envy’  নিয়ে আস্ত একটা থিওরী দিয়ে বসে আছেন, ভাব খানা এমন যে একখানা শিশ্ন দিয়ে উনি বিশ্ব জয় করে ফেলবেন। নগন্য সংখ্যক মানুষের কথা আর কি বলবো!) সংস্কৃতির মানেতো আর শুধু রবি ঠাকুর আর নজরুল না, পরিবারের শিক্ষা দীক্ষাওতো এর মধ্যে পড়ে, তাই না?

কোথাও একবার পড়েছিলাম, একজন ভালো মানুষ হবার জন্য ৫টি গুণাবলী থাকা প্রয়োজন। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না কি কি গুণাবলী ছিল, কিন্তু এটুকু মনে আছে যে এর মাঝে দেশপ্রেম ছিল। আমি জানি মুক্তমনার অধিকাংশ লেখক-পাঠক দেশ নিয়ে অনেক ভাবেন। রিচার্ড ডকিন্সকে একবার বলতে শুনেছিলাম, ‘একজন মুসলিম বা হিন্দু বা খ্রিষ্টান হওয়া কিভাবে একটা গর্ব করার মত বিষয় হতে পারে? এটাতো সে অর্জন করেনি, এটা শুধুই একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা যে সে একটা মুসলিম/হিন্দু/খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছে। তেমনি আমার মতে এই কথাটাতো দেশের জন্যও প্রযোজ্য। একটি বিশেষ দেশে জন্ম নেয়াতো একটা নিছক ঘটনাই। আমি আজকে কেনিয়াতে বা ফিজিতে বা সুইজারল্যান্ডে জন্ম নিতে পারতাম। শুধুমাত্র বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি বলেই আমাকে শুধু এই দেশকেই ভালবাসতে হবে, এই তত্ত্বটা আমি ঠিক মানতে পারিনা। আমি কোন বিশেষ একটা দেশ নিয়ে গর্ব করার কিছু পাইনা। গত বছর যখন মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম তখন ফেরার আগের দিন ভাবছিলাম, কত ছোট এই পৃথিবী। আজ আমি কুয়ালালামপুরের রাস্তায় কাল হয়তো ফার্মগেটে থাকবো। ছোট্ট একটা পৃথিবীকে ভেঙ্গে দেশ-জাতি কত কিই না বানিয়েছি আমরা। আর বিভেদের পরিণাম কখনই শুভ হয়নি। যত বিভেদ বেড়েছে হানাহানি, হিংস্রতা ততই বেড়েছে। আমি এতো ভেদাভেদ চাই না, আমি তাই বিশ্ব নাগরিক হতে চাই। বাংলাদেশের শীতার্ত বা বন্যার্তদের যেমন সাহায্য করতে চাই, আফ্রিকার বাচ্চাদের দিকেও তেমনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে চাই।

আমি পুরো বিশ্বের বিজয় উদযাপন করতে চাই। আর হায়েনার বদলে ঘরে ঘরে মানুষ দেখতে চাই।