(১)
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সর্বত্র ইস্যুভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক বিতর্ক। ভিন্নমতের উৎসকি-এই প্রশ্নটা যেকোন তর্ককারীকে প্রশ্ন করলে, স্বভাবসিদ্ধ উত্তর আসবে অন্যপক্ষের অজ্ঞতা। মার্ক্সবাদী হলে বলবে শ্রেণী অবস্থান-অর্থাৎ আমরা সমাজের সে ক্লাসে অবস্থান করি- সেই ক্ষুদ্র কোনের দৃষ্টিতে দেখা অভিজ্ঞানই মতপার্থক্যের কারণ। অন্যদিকে ধার্মিকরা প্রত্যেকেই পরিবার এবং সমাজ থেকে যা শিক্ষা এবং নৈতিকতার আচরন পায়, সেই খুঁটি ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আমরা যুক্তিবাদিরা তাদের যুক্তিহীন প্রথানির্ভর আচরনের জন্যে “নিম্নমানের” বা নীচুবুদ্ধির মানুষ বলে মনে করি।
কিন্ত ভিন্নমতের উৎস কি তাই? অন্যপক্ষের অজ্ঞতা? আমরা কি কখনো গভীরে গিয়ে ব্যপারটা নিয়ে ভেবেছি?
(২)
সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত যে কোন সিদ্ধান্তই আমরা নিই না কেন-সেটা ঠিক না বেঠিক আমরা কি করে বুঝবো? একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, এই ঠিক বা বেঠিক ব্যপারটা পরম কিছু না। সবটাই স্থান-কাল-এবং তার পরেও জীবনের উদ্দেশ্য নির্ভর।
উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক -আমাদের একটা উদ্দেশ্য “সৎ থাকা” ।
এখান থেকেই শুরু করি-কারন এই উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিমত থাকা সম্ভব না। এবার ধরা যাক দাঙ্গার সময় অন্য ধর্মের কেও আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। দাঙ্গাকারীরা -যারা আপনার ধর্মের লোক-আপনার বাড়িতে এলে কি আপনি তাদের সত্যি কথা বলবেন? সৎ কথা বলতে গিয়ে তাদের ধরিয়ে দেবেন খুনিদের কাছে? ৯৯% ক্ষেত্রেই, দেখা যাবে, আপনি সততার থেকে “প্রাণ” বাঁচানোর “উদ্দেশ্য” কে ওপরে রেখেছেন।
অর্থাৎ যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই অনেকগুলো উদ্দেশ্যের “সংঘাত” থাকে। আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। ভারতে মাওবাদিদের বা নক্সালদের কার্যকলাপ। “খতম” লাইন ঠিক কি না-তাই নিয়ে ভারতের কমিনিউস্টদের মধ্যেই আছে দীর্ঘ বিতর্ক। এবং তার মূলে গেলে দেখা যাবে-সেই স্থান-কাল পাত্র। অর্থাৎ বিহার, ঝারখন্ড বা ঐ ধরনের আদিবাসিদের গ্রামে লোকেরা যে অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে বাঁচে, তাতে হাতে বন্দুক নিয়ে খতম লাইনে যাওয়াটাকে অনেকেই যৌত্বিক বলে মনে করে। অন্য স্থানে এবং কালে অবস্থান করা কোলকাতার সৌখিন বামবাবুরা তাদের যুক্তিকে “ভুল” বলে প্রমাণ করবে কি করে? এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখায় যে মাওবাদিদের হাতে মারা গেছে সেই সর্বহারা শ্রেণীর লোকজন। আর তোলা দিয়ে টিকে আছে ঠিকাদাররা। তাহলে কমিনিউজমের কি হইল?
আসলে স্টালিন থেকে অধুনা “শহিদ” কিশেনজির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে-আদর্শের থেকেও “বেঁচে” থাকার চেষ্টাটাই সিদ্ধান্তকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করে। এই বেঁচে থাকা গোষ্টিগত ভাবে বা ব্যক্তিগত ভাবে হতে পারে। একজন সেনা নিজের প্রাণ দেয়, দেশের লোককে বাঁচাতে। এতে নতুন কিছু নেই। প্রতিটা প্রজাতিই এই ভাবে বাঁচার চেষ্টা করে। ভারতের মাওবাদিদের কমিনিউস্ট ভাবলে ভুল হবে -এদের অধিকাংশই অত্যাচারিত আদিবাসী। হাতে বন্দুক পেয়ে, একটু ভাল ভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে।
(৩)
তাহলে জীবনের সব উদ্দেশ্যই কি “জৈবিক” যুক্তিবাদে সিদ্ধ?
আজকাল অনেকেই “চাইল্ডলেস বা চয়েস” থাকছে। এর পেছনে কি কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে? অনেকেই ভাবতে পারেন, পৃথিবীতে এত লোক-এই ট্রেন্ড ও সেই “গোষ্টিগত” ভাবে বাঁচার প্রয়াস। রসদ বাঁচিয়ে। সমস্যা হচ্ছে এই প্রবণতা বেশী ইউরোপের উন্নতদেশগুলিতে-যেখানে জনসংখ্যা দ্রুত হারে কমছে-কিন্ত তাদের লোক দরকার!
তাহলেত চাইল্ডলেস বাই চয়েস রাষ্ট্র বা জৈবিক- কোন যুক্তিবাদেই সিদ্ধ না। তবে চাইল্ড লেস বাই চয়েসের পুরুষ মহিলারা ভুল? তাদের অধিকার নেই নিজের পছন্দের ওপর?
অথবা ধরুন আত্মহত্যার অধিকার। কিছু কিছু দেশ দিয়েছে, অধিকাংশ দেশ দিচ্ছে না। আমারা জীবন শেষ করার অধিকার আমার নেই! এটাই অধিকাংশ রাষ্ট্রের আইন। এর পেছনে যুক্তি এই যে “প্রাণ” এত মহার্হ্য যে প্রাণটা যার, তারো অধিকার নেই সেই প্রাণ নেওয়ার। অর্থাৎ “প্রাণের” মূল্যই অন্তিম ” উদ্দেশ্য” হিসাবে ধরা হচ্ছে। মাওবাদিদের খতম লাইনের বিরুদ্ধেও সেই “প্রাণের” দামের যুক্তিটাই সবার আগে আসে।
কিন্ত এটা কি ধরনের যুক্তিবাদ? সব প্রাণই ত মরণশীল-ক্ষণস্থায়ী। সেই ক্ষণস্থায়ী, মরণশীল প্রাণকে আমরা এত মুল্যবান হিসাবে দেখি কেন?
ইতিহাসই বোধ হয় কারন। প্রানকে ” ক্ষণস্থায়ী মরণশীল” আলোকে দেখতে গিয়ে স্টালিন-হিটলার যা করেছেন, সেটাই যথেষ্ট বোঝার জন্যে প্রাণ কেন মুল্যবান। কিন্ত তাই যদি হয় তাহলে চাইল্ড লেস বাই চয়েস বা আত্মহত্যার অধিকার কিভাবে সিদ্ধ হয়?
(৪) এই সমস্যাগুলোর মূল এই যে জীবনের আসলেই কোন পরম উদ্দেশ্য নেই। থাকতে পারে না। কারন প্রতিটা জন্মই ক্ষনস্থায়ী। সবকিছুর মৃত্যু অবধারিত। নক্ষত্র, পৃথিবী মানুষ-সবকিছুই একদিন শেষ হবে।
মুশকিল হচ্ছে এইভাবে ভাবতে গেলে, বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় ভাল কিছু করার ইচ্ছাও। থাকে না নৈতিকতার ভিত্তি।
ফলে দেখা যাবে সব ধর্মীয় দর্শনে নানান রকমের রূপকথা সৃষ্টী করে মানুষকে “আশ্বস্ত” করা হয়েছে, নশ্বর জন্ম ক্ষনস্থায়ি বটে-কিন্ত স্বর্গের জীবন চিরস্থায়ী। বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজন্মবাদও ঠিক একই কারনে। যদি কেও জানে এটাই একমাত্র জীবন এবং পরম উদ্দেশ্য বলে কিছু থাকতে পারে না-কোন ধর্মীয় দর্শনের ভিতই দাঁড়াবে না। নৈতিকতার ভিত ও থাকবে না। ফলে পরজন্ম বা স্বর্গের অনন্ত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মগুলো মানুষকে তার জীবনে উদ্দেশ্য নিয়ে আশ্বস্ত করায়। স্বর্গ বা পরজন্ম যতই অযৌত্বিক গাঁজাখুরি হোক না কেন-নৈতিকতা ভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসের বিবর্তনে এদের গুরুত্ব আছে। কারন জীবনে উদ্দেশ্য না থাকলে নৈতিকতার কোন দর্শনই টেকে না। আর জীবনের পরম উদ্দেশ্যের যেহেতু কোন যুক্তিবাদি বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই-সেহেতু জীবনের সব উদ্দেশ্যই আপাত, ক্ষণস্থায়ী এবং কিছুটা অযৌত্বিকও বটে। সামাজিক বিবর্তনে ধর্মের আগমন মূলত এই পথেই। কারন পশুকুলে “জীবনের উদ্দেশ্য” জৈবিক-তাদের এত ভাবতে হয় না। কিন্ত মানব সমাজের প্রতিষ্ঠাতে শুধু জৈবিক উদ্দেশ্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে ঈশ্বর, স্বর্গ, অনন্ত জীবনের ধারনাগুলি “নির্বাচিত” হয়-কারন তা নীতিভিত্তিক সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর ছিল এক সময়।
১০০% যৌত্বিক জীবন বলে তাই কিছু সম্ভব না। আমদের প্রত্যেকেরই জীবনের উদ্দেশ্য আছে যার কিছুটা জৈবিক [ জিনের সূত্রে পাওয়া] কিছুটা সামাজিক ( যা ধর্ম , পরিবার বা সামাজিক আইন থেকে এসেছে) এবং বেশ কিছুটা নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তা। আবার আমাদের জীবনকালের মধ্যেই এই উদ্দেশ্যের বিবর্তন হয়। যৌবনে যে কমিনিউস্ট গেরিলা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, পৌঢ়কালে সে মহানন্দে বণিক হিসাবে অর্থ সংগ্রহে ব্যস্থ। জীবনে ধাক্কা পেয়ে আস্তিক থেকে নাস্তিক, নাস্তিক থেকে আস্তিক হয় লোকে। সবার মনেই কিছু দ্বন্দ থাকে। যার মনে যত বেশী চিন্তার দ্বন্দ থাকবে, সে তত দ্রুত বেশী আরো গভীর উপলদ্ধি্র জগতে প্রবেশ করতে সমর্থ হবে। কারন মনে দ্বন্দ না থাকলে নতুন চিন্তার সংশ্লেষ অসম্ভব।
এই সমস্যাটি ও নতুন কিছু না ভারতীয় দর্শনে। অদ্বৈতবাদিরা “মায়ার” ধারনা – জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য-অথবা এই বর্তমান জগত আসলেই “আপাত সত্য” -এই ধারনা বহুদিন থেকেই বহন করত। সমস্যা হচ্ছে, ভারতের ইতিহাসের ওপর মায়াবাদের প্রভাব ঋণাত্মক। নিউটন, কোপার্নিকাসদের জন্ম নালন্দাতে না হয়ে, হয়েছে ইউরোপে। কারন, সব দর্শনের এবং ধারনার ধাত্রীভূমি হচ্ছে মানুষ। সুতরাং মানুষের বস্তুবাদি “সারভাইভালের” উন্নতি না করে,কোন দর্শন বা ধারনাই টিকতে পারে না। সুতরাং আমরা চাই বা না চাই- একটা “অযৌত্বিক” বিশ্বাস নিয়ে আমাদের চলতেই হবে। আর সেটা হচ্ছে সবার ওপর মানুষ সত্য। এর কষ্টিপাথরেই বিচার করতে হবে সমস্ত ধর্ম, আদর্শ এবং দর্শনকে।
আশাবাদী মনোভাব ভুল হলেও ভালো। সত্য-মিথ্যার বিতর্কের পর যে মতবাদ বেশি আশা জাগানিয়া, সেটাকেই গ্রহন করি। 🙂
@আতিকুর রাহমান সুমন,
সেই আশাবাদ ও ত জীবনের উদ্দেশ্য তিরোহিত না। যারা ধার্মিক, তারা লোকেদের ইমান বাড়ছে দেখেই আশাবাদি হোন। তার কাছে সেটাই বেশী আশাজাগনিয়া। আপনার কাছে না। কারন আপনার জীবনের উদ্দেশ্য আলাদা। আর জীবনের উদ্দেশ্যের প্রশ্ন আসলে সেই বিতর্ক এবং পরম উদ্দেশ্যের অভাব এসেই যাবে।
নৈতিকতার সাথে সম্পর্ক জীবনের উদ্দেশ্যের-আর জীবনের সেই উদ্দেশ্যটা বলে দিচ্ছে ধর্ম।
জীবনের উদ্দেশ্য না থাকলে কোন নৈতিকতার দরকার থাকে না। মানুষ একটা “প্যাটার্নে” বাঁচতে চাইছে, সামাজিক ভাবে বাঁচতে চাইছে”-সেটা জন্যেই নৈতিকতার জন্ম। তাই নৈতিকতার ভিত্তিই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য। পশুকূলেও নৈতিকতা আছে-এবং তার সবটাই তাদের জৈবিক উদ্দেশ্যহেতু।
ঈশ্বরের আবির্ভাবের কারন, মানব রচিত” পরম উদ্দেশ্যকে” ঈশ্বর নামে এক কাল্পনিক সর্বশক্তিধর, সর্ববিচারকের নামে বলপূর্বক চাপানোর জন্যে।
সেটাই ত গণতন্ত্রে করে। যেমন ধর, মুসলিম দেশগুলিতে সমকামীতা অপরাধ। মুসলিমদের মধ্যে সমকামীর অভাব নেই। এখন, তাদেরকেও কিন্ত সংখ্যাগুরুর নৈতিকতা মেনে চলতে হচ্ছে-কারন সংখ্যাগুরুর “জীবনের উদ্দেশ্য ” ( এক্ষেত্রে কোরান মাফিক জীবন) দিয়েই তাদের জীবনের নৈতিকতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সুতরাং নৈতিকতার সংজ্ঞায় “সমাজের সংখ্যাগুরুর জীবনের উদ্দেশ্য” এসেই যাচ্ছে। আর সব মুসলিমই কোরান মাফিক নৈতিকতাকে জীবনের “পরম” উদ্দেশ্য বলে মানে। সেই জন্যে সেটাই নৈতিকতার উৎস হয়ে যাচ্ছে। বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রেও রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরকে প্রমান করতে হয়েছিল তা বেদ বিরোধি না। কারন এক্ষেত্রে বৈদিক জীবন ছিল “পরম উদ্দেশ্য”।
না, এখানে গুলিয়ে দিলে। আমেরিকানরা মনে করে প্রাণের দাম বেশী। কিন্ত আমেরিকান প্রাণ। ইরাকি প্রানে কিছু যায় আসে না। হিটলার ও তাই মনে করত। কমিউনিটি ফিট করতে গেলে প্রাণ নেওয়া দরকার।
আলট্রুইজম এবং যুদ্ধ-দুটোই সারভাইভাল স্ট্রাটেজি। কিন্ত এটা অতিসরলীকরন। আজ আমেরিকার যা সমর শক্তি-তারা অনায়াসেই অসংখ্য দেশ দখল করতে পারে। সেটা করে আমেরিকান “জীন” বাড়ানো, তাদের কর্তব্য? সেই ভাবে বর্তমানে কিছু সম্ভব?
হলডোমারের সময় রাশিয়াতে ৮ মিলিয়ান লোক মরেছিল। স্টালিন খেতে দেয় নি। খাবার ছিল। কিন্ত রাশিয়ান গম বিক্রি করে রাশিয়াতে ভারীযন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল।
কেন এমন করেছিলেন স্টালিন? কেন এত লোক মেরেছিলেন? উনার ধারনা ছিল, যে রাশিয়া পশ্চমী শক্তি আক্রমন করবেই। এবং মাস স্কেলে স্টিল ইত্যাদি উৎপাদন করতে না পারলে, রাশিয়া যুদ্ধে হারবে। স্টালিনকে এই খুনের জন্যে গাল দিতে পারি-কিন্ত তার হিসাব নিখুত ছিল। জার্মানরা উন্নত মানের প্যান্থার ট্যাঙ্ক নিয়েও রাশিয়ার কাছে শুধু হেরেছিল এই জন্যে যে প্রতি প্যান্থআরের জন্যে ১০ টা টি-১২ ট্যাঙ্ক তৈরী করত রাশিয়া। শুধু সংখ্যাতেই এত বিপুল ছিল রাশিয়া সমর সজ্জা, জার্মানী পেরে ওঠে নি। তাহলে অই ৮ মিলিআনকে যে মেরে ফেলা হল? সোভিয়েতের জেতার পেছনে, ওই গণখুনের বিশাল ভূমিকা আছে। কিন্তু সেটা কি কাম্য?
তাহলে তোমার কথা অনুযায়ী যারা চাইল্ড লেস বাই চয়েস, তারা অনৈতিক এবং অপরাধি। তাদের জেলে পোরা হোক। ইরানে সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে। এক মাস্টার ডিগ্রি করা মহিলা, তার স্বামীর সাথে ডিভোর্স চেয়েছে। কারন সে পি এইচ ডি করতে চাইছে। তার স্বামী সন্তান সংসার চাইছে। কোর্টে মহিলা ডিভোর্স পায় নি-কোর্ট রায় দিয়েছে মেয়েদের শিক্ষার চেয়ে সব চেয়ে বড় দ্বায়িত্ব সংসার এবং ভবিষয়ত প্রজন্মকে বড় করা। অর্থাৎ সেই কমিউনিটি ফিটনেস। আমেরিকাতে এই ভাবে কোর্টগুলো নারী স্বাধীনতা বিরোধি অবস্থান নিলে এখানেও হয়ত সংসার অনেক স্টেবল হত, কমিউনিটি ফিটনেস বাড়ত।
ইরানের ছেলে মেয়েরা কিন্ত আমেরিকান ছেলে মেয়েদের থেকে অঙ্ক এবং অনেক স্কুল স্কিলে এগিয়ে। আমেরিকা ক্রমশ পিছচ্ছে। আমেরিকান শিক্ষা এর জন্যে যেমন দায়ী, আমেরিকাতে আনস্টেবল সংসার ও অনেক দায়ী।
কিন্ত নারী স্বাধীনতাকে হরন করে কি কমিউনিটি ফিটনেস বাড়ানো ঠিক হবে? এই সিদ্ধান্ত কি করে নেবে?
নৈতিকতার সাথে ধর্মের উৎপত্তির সম্পর্কটাও বুঝলাম না। ধর্মের পক্ষে প্রাথমিক যুক্তি কিন্তু Teleological, মানুষ কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য সবার আগে নৈতিকতার যুক্তি দেয় না। বিবর্তনের কারণে প্রত্যেকটি মানুষই জন্মগতভাবে teleologist, সবকিছুর মধ্যেই মানুষ উদ্দেশ্য খুজে পায়। ধর্মের উৎপত্তি তো এরপর শুধু সময়ের ব্যাপার।
নৈতিকতার সংজ্ঞা হয়ত পারসন টু পারসন আলাদা হয়, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে ঠিকই একটা সাধারণ কাঠামো দাঁড়া করানো সম্ভব। সমাজ সংস্কার তো এভাবেই ঘটে। এককালে সমকামীতাকে মানুষ পাপ ও ঘৃণ্য ভাবত, এখন কিছুটা হলেও সেই প্রেজুডিস কেটে যাচ্ছে। বিধবাদের পুনঃবিবাহ করাটাও কিন্তু প্রথমে সর্বজনমতে “নৈতিক” ছিল না।
মানুষের প্রাণকে সবার উপরে স্থান দেওয়াও কিন্তু আসলে কমিউনিটি ফিটনেস নিশ্চিত করা। যেই কমিউনিটিতে মানুষের প্রাণের দাম নেই, সেই কমিউনিটি বেশিদিন টিকবে না। পরোপকারীতার উৎপত্তি এমনি এমনি ঘটে না, এটা একটা প্রয়োজনীয়তা।
আসলে কমিউনিটি ফিটনেসের ব্যাপারটা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব না। ধর্ম কিংবা ঈশ্বরই যদি হয় পরম উদ্দেশ্য(এছাড়া আর কোন “পরম উদ্দেশ্য” আছে বলে তো মনে হয় না), সেক্ষেত্রেও কমিউনিটি ফিটনেস এড়ানো সম্ভব না। ধার্মিক তার ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য মানবতাবিরোধী কাজ করতে পারে। তার কাছে ঈশ্বরই যেহেতু “পরম উদ্দেশ্য”(মানুষ না), তাই সে কেবল তার পরম উদ্দেশ্যকে ফুলফিল করছে না, একই সাথে সে নৈতিকতার চর্চাও করছে(তার দৃষ্টিতে) এবং তার নিজস্ব ধর্মীয় কমিউনিটির ফিটনেসও বৃদ্ধি করছে। এখন কমিউনিটির সংজ্ঞা থেকে ধর্মীয় বিভাজনকে বাদ দিয়ে যদি আমি মানবতাকে সবার উর্ধ্বে রাখি, তাহলে আবার সবকিছু বদলে যায়।
মোদ্দা কথা হল, “ফিটনেস” এর সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও কমিউনিটি ফিটনেস বৃদ্ধি করাই যে নৈতিকতার উদ্দেশ্য, এ ব্যাপারে দ্বিমত চলে না। ফিটনেসের সংজ্ঞা নির্ধারণে সবার সমান অংশগ্রহণ আবশ্যক, নইলে স্বৈরচারীতা কিংবা গণহত্যা ঠেকানো যাবে না।
দ্বিমত।
স্টিভেন পিঙ্কারের ব্ল্যাঙ্ক স্লেট থেকে,
জীবনের পরম অর্থের সাথে তো বেঁচে থাকার ইচ্ছার কোন সম্পর্ক দেখি না। ব্যক্তিগত আর কর্মজীবনের প্যাড়া সামলাতে সামলাতেই আমাদের জীবন শেষ হয়ে যায়। মানুষের জীবনে ultimate causation এর কোন মূল্য নেই, শুধুমাত্র proximate causation এরই প্রাসঙ্গিকতা আছে।
“উদ্দেশ্য” বিষয়টাই সাবজেকটিভ। এর কোন স্বতন্ত্র্য অস্তিত্ব থাকে না, একে তৈরী করে নিতে হয়। আপনার জীবনের উদ্দেশ্য যদি হয় ভাল চাকুরী করে কিছু টাকা কামানো, তবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তাটা আপনার ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি হয় নানা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থায় যুক্ত হয়ে মানবসেবা করা, বাংলাদেশের বিভ্রান্ত নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌছে দেওয়া, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও দর্শনের ভান্ডার সমৃদ্ধ করা, তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে কয়েক হাজার বছর সময় দিলেও তা আপনার কাছে অপ্রতুল মনে হবে। যারা জীবনের আপাতঃ উদ্দেশ্যহীনতা নিয়ে বিষাদে ভুগে, আমার দৃষ্টিতে তারা স্রেফ স্বার্থপর ছাড়া কিছু না।
পরম উদ্দেশ্যের সাথেও নৈতিকতার ভিত্তির কোন সম্পর্ক দেখি না। নৈতিকতা কোন বিলাসিতা না, এটি আমাদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক। নৈতিকতার ভিত্তি হওয়া উচিত কমিউনিটির ফিটনেস ভ্যালু। যা কমিউনিটির জন্য ক্ষতিকর, তাই অনৈতিক গণ্য হওয়া উচিত।
পরম উদ্দেশ্য থাকলেও জীবনটা যাপনযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না, কারণ তখন আমাদের কোন স্বাধীনতা থাকবে না, ওই উদ্দেশ্যটা সাধন করাই হবে আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কেউ কি চায় ডিটারমিনিস্টিক জীবনযাপন করতে?
@পৃথিবী,
আপনার আগের কথাগুলো না হয় বুঝলাম কিন্তুঃ
এটার অর্থ অধরাই থেকে গেল। স্বার্থপর কেন মনে হল?
@বিপ্লদ দা,
আমার কাছে মনে হয় কজ এন্ড ইফেক্টটাই যুক্তি। সব ক্ষেত্রে হয়ত এটা কাজ করে ন।
মনে হয় নৈতিকতা হল শুধু উপকারের সাথে সম্পর্কিত। যেখানে উপকারের প্রয়োজন নাই সেখানে নৈতিকতা স্রেফ বালখিল্যতা।
যতক্ষন পর্যন্ত কারো কোন প্রকার ক্ষতি আপনি না করছেন সেই পর্যন্ত ঠিক আছে। কারো ক্ষতি করলেই কজ ইফেক্ট অনুযায়ী আপনার উপরেও ক্ষতি বর্ষিত হইবে। :))
আর উদ্দেশ্যের ভাবনাটাও হয়ত কজ ইফেক্ট থেকেই আসছে। সমস্ত ক্ষেত্রেই যেহেতু একটা উদ্দেশ্য/কারন কাজ করে সুতরাং বেঁচে থাকারও একটা উদ্দেশ্য/কারন থাকতে হবে বলেই মানুষ ভাবতে ভালোবাসে। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবেই সেটা অবৈজ্ঞানিক। আমি বুঝি না জীবনের উদ্দেশ্য থাকতেই হবে কেন?
আরেকজন ধর্মের ব্যাপারে যেটা বললেন, আপনিও লেখায় একটু এনেছিলেন, যে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নৈতিকতার ক্ষেত্রে। ধর্মহীন নৈতিকতা কখনও ধর্ম বিরাজকরা অবস্থায় আসবে না। মানুষ যখন বুঝতে শিখবে ধর্ম নামক হাজার বছরের পুরোন আবর্জনা আসলে নৈতিকতা হতে পারে না তখনই সে ধর্ম বাদ দিয়ে যৌক্তিক নৈতিকতার উপরে নির্ভর করবে। এর আগে পর্যন্ত ধর্ম কারো কারো কাছে নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে থাকতেই পারে।
লেখার জন্য ধন্যবাদ। অল্প কথায় অনেকগুলো দার্শনিক আলোচনা এসেছে।
@সাইফুল ইসলাম,
ব্যপারটা অতটা জলবৎ তরলং হলে, আমাদের মধ্যে বিবাদ, ভিন্নমত এসব থাকত না।
সমস্যা এটাই যে “উপকার” একটি স্বাধীন চলক না-এটি জীবনের উদ্দেশ্যের কাছে পরাধীন।
আবার মাওবাদিদের উদাহরণ দিচ্ছি। ওরা মনে করে সমাজের উপকারের জন্যে, শ্রেনী শত্রুর খুন দরকার। খুন ওদের কাছে একটা উপকারি প্রক্রিয়া।
অধিকাংশ মানুষের কাছে, তা নাও হতে পারে।
অর্থাৎ উপকার ব্যপারাটা আপেক্ষিক এবং তার সবটাই জীবনের উদ্দেশ্য কি তার দৃষ্টির সাপেক্ষে সিদ্ধ।
ব্যপারগুলো এত সহজ হলে, পৃথিবীতে এত বিতর্ক ভিন্নমত কিছুই থাকত না। মেয়েদের কথাই ধর। রক্ষণশীল সমাজে একজন বাবা, তার মেয়েকে আগলে রেখে ভাবছে সে তার মেয়ের উপকার করছে। ক্ষতি থেকে বাঁচাচ্ছে।
কিন্তু মেয়েটার ক্ষতি হচ্ছে। সে আর স্বাধীন ভাবে দাঁড়াতে পারবে না জীবনে।
সমস্যা এটাই যে সব সিদ্ধান্তে, সব কাজেই কিছু “লাভ” কিছু “ক্ষতি ” হয়। ক্ষতি ছারা লাভের অস্তিত্ব নেই। আমি যেটা আমার জীবনের উদ্দেশ্যের সাপেক্ষে লাভ বলে ভাবছি, সেটা অন্যের কাছে, যার জীবনের উদ্দেশ্য আলাদা-ক্ষতি বলে ভাবতে পারে।
আমি মনে করি বাঙালীর জীবন থেকে ইসলাম, হিন্দু ধর্ম উঠে গেলে, বাঙালী এগোবে অনেক বেশী দ্রুত। কিন্ত অধিকাংশ বাঙালীকি তা মনে করে? তাদের প্রায় সবাই ঈষ্ট দেবতা বা আল্লার কাছে সমর্পনেই জীবনের পরম উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে-আমাদের চিন্তাকে তারা তাদের জীবনের জন্যে দারুন ক্ষতিকর বলে মনে করবে।
কে ঠিক কি ভাবে বিচার করবে? যে লোক ধর্মের আশ্রয়ে মনে শান্তিতে আছে, আমি বলার কে যে ধর্ম তোমার জীবনে আসলেই ক্ষতিকর?
@সাইফুল ইসলাম,
আপনার ম্যাটেরিয়াল উন্নতি আপনি এক জীবনেই সাধন করতে পারেন, খুব অল্প সময়েই করতে পারেন। কিন্তু আপনি যখন পুরো একটি সমাজ সংস্কারে হাত দেন, তখন একটা জীবনকাল কোনমতেই যথেষ্ঠ হতে পারে না। যারা জীবনকে অর্থহীন মনে করে, আমার দৃষ্টিতে তারা কেবল নিজের জন্যই বাঁচে। শুধু নিজের জন্য বাঁচতে গেলে বেঁচে থাকার আনন্দ ফুরোতে বেশি সময় লাগবে না।
@পৃথিবী,
ব্যপারটা এর থেকে একটু বেশী জটিল।
নৈতিকতার ভিত্তি কমিউনিটি ফিটনেস ভ্যালু হলে সেটা আরেকটা হিটলার বা স্টালিনের জন্ম দেবে। এরা অসংখ্য মানুষ খুন করেছে এই বলে যে কমিউনিটি ফিটনেস আসল, মানুষের প্রাণের কোন মুল্য নেই। এটা পরীক্ষিত ভয়ংকর পথ।
পরম উদ্দেশ্যের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক না থাকলে বিবর্তনের পথে ধর্মের জন্ম হত না।
নৈতিকতার একটা দিক হল, আমি যেটাকে নৈতিক ভাবছি, সেটাকে সমাজের অন্য লোকেরা নৈতিক বলে না মানা পর্যন্ত সেই নৈতিকতা এফেক্টিভ না। ফলে আমার জীবনের উদ্দেশ্য যদি সমাজের থেকে আলাদা হয়, আমার নৈতিকতার সাথে সমাজের সংঘর্ষ লাগবেই। মাওবাদিরা উদাহরন। ওরা অবাধে মানুষ খুন করাকে নৈতিক বলে মনে করে। আমরা বা রাষ্ট্র কি তাই মনে করি??
সুতরাং নৈতিকতা শুধু ব্যক্তি স্বতন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে হয় না- সমাজে মানুষের উদ্দেশ্যের একটা সাধারন “লেমা” রাখতেই হয়। যেকোন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সেটা হচ্ছে মানুষের প্রাণের মূল্য সবার ওপরে।
অযৌত্বিকতা জিনিসটা কি তাই তো বোধগম্য হইলো না, বিপ্লব। সন্ধান তো পরের কথা।
@অভিজিৎ,
জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদের সীমানা নানা লোকের কাছে, নানান জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। সেই সীমানাটা খোঁজার চেষ্টা করছি, বিশ্বাস বস্তুটার উৎসের গভীরে গিয়ে।
এটা শুধু লিখে হবে না। আলোচনার মাধ্যমে লোকে ভাল জানবে। পৃথিবী, সইফুল বা কাজী যে প্রশ্নগুলো করেছে, সেই প্রশ্ন এবং উত্তরের মাধ্যমে আস্তে আস্তে বোঝা যাবে যুক্তির সীমানা।
@অভিজিৎ,
নটর ডেম কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন মোখতার স্যার । যৌন বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হওয়াই ছিল স্যারের সংগ্রাম । যাই হোক এই স্যার এর ই একটা উদাহরন আজও আমার কানে বাজে। উনি অপ্রয়োজনীয়তার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন , আমাবস্যার রাত, গ্রামের ধু ধু মেঠো পথ , এই পথ দিয়ে তাড়াতাড়ি পার হবার জন্য কোনাকুনি ভাবে চলাচল করতে করতে মেঠো পথে একটি কোনাকুনি রাস্তাও তৈরী হয়ে গেছে যা দিয়ে পাশাপাশি দুইজন ও হাটা যায় না । কিন্তু আমি এই আমাবস্যার রাতেও শিষ দিতে দিতে কোনাকুনি রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তে পার হয়ে যাই। কারন টা কি?। কারন টা এই যে প্রয়জনীয় কোনাকুনি রাস্তার দুই পাশের দিগন্ত বিস্তৃত অপ্রয়োজনীয় সবুজ জমিন যা আমাকে মানসিক নিরাপত্তা দেয়। অথচ মাটি থেকে মাত্র একশত ফুট ওপরে দুপুর বেলায় দশ ফুট চওড়া ব্রিজ যার রেলিং নেই তাঁর ওপর দিয়ে হেটে যেতে আমার হাটু কাঁপে , আমি পারি না। অপ্রয়োজনীয়তার প্রয়োজনীয়তা মানসিক । আর বর্তমানে মানসিক স্বাস্হ ত কোন কোন ক্ষেত্রে শারীরিক সাস্থের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ!
@অভিজিৎ, আমারো একই অবস্থা। ‘অযৌক্তিকতা’ হলে মনে হয় কিছুটা বুঝতাম।
বিল্পপ দা। আপনার এই লাইনটাই ঠিক- আমদের প্রত্যেকেরই জীবনের উদ্দেশ্য আছে যার কিছুটা জৈবিক [ জিনের সূত্রে পাওয়া]- বাকি সামাজিক কারনটা নেহাত বেঁচে থাকতে। কারন সমাজ না থাকলেও মানূষ থাকবে ঐ একটা কারনের জন্যই।
তাই এখানে কিছুটা না বলে পুরোটাই বলা ভাল।
আর নিচের দুটো বাক্য বুঝলাম না//একটা “অযৌত্বিক” বিশ্বাস নিয়ে আমাদের চলতেই হবে। আর সেটা হচ্ছে সবার ওপর মানুষ সত্য।//
সবার উপরে মানুষ সত্য- মানুষ সকল জীবকে নিয়েই চিন্তা করে কেন? আমরা জানি আমাদের খাদ্য চক্রের কথা। তাই আমার মনে হয় গরু- ছাগল, মুরগী সবই সত্য। কারন এগুলো মাংশ খেয়ে মানুষ আমিষ পায় এখন। না খাইলেও চলে। কিন্তু খায় যেহেতু, তাই সেগুলোও সত্য।
@রঞ্জন বর্মন,
সত্য অনেক কিছুই-কিন্তু তার ওপরেও মানুষ সত্য কারন-মানুষই সব আদর্শ চিন্তা জ্ঞান ও ধর্মের আধার।
অনেকদিন পর অসাধারণ এক দার্শনিক আলোচনা নিয়ে ফিরে আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ, বিপ্লব-দা!
তাহলে ধর্মেরও কিছু মূল্য রয়েছে, তাই তো? এই প্রশ্নটা আমার দীর্ঘদিনের যে, ধর্ম যদি না থাকে, স্বর্গ-নরকের ধারনা যদি উঠে যায়, জীবনের সব উদ্দেশ্য যদি বর্তমান পৃথিবীকে ঘিরেই রচিত হয়, তাহলে মানুষ কি এখনকার চেয়ে আরও বেশী অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে না? পুলিশ দিয়ে কি তাকে পুরো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? ধর্ম কি এক্ষেত্রে একটি স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স হিসাবে কাজ করছে না? এ প্রশ্ন করছি ধর্মবিরোধীদের সব যুক্তি মাথায় রেখেই।
নিউটন, কোপার্নিকাস না জন্মালেও ভারতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে; তাই আপনি ঋণাত্মক বলছেন কেন, তা বুঝতে পারছি না! অন্তত ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ এই দর্শনের চারণভূমি তো ভারতই, নাকি?
বরাবরই আপনার লেখা থেকে জীবন ও সমাজের অনেক গভীর সত্য শিখি; এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। (W)
@কাজি মামুন,
ধর্ম ” একটি নির্বাচিত” সামাজিক শক্তি। ধর্মীয় মিথ গুলো কেন নির্বাচিত হল-এই সরল সত্যগুলি অধিকাংশ নিধার্মিকরা ভুলে যায় বা গভীরে ঢোকার চেষ্টা করে না। মনুবাদ বা শরিয়া নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকার বিরোধি-এগুলো আমরা জানি-কিন্ত কেন নারী বিরোধি আইন গুলি “নির্বাচিত” হল এবং কেন মিথবিহীন ধর্ম গুলি ( যেমন বৌদ্ধ ধর্ম) হেরে গেল-এগুলো আমরা বোঝার চেষ্টা করি না। এগুলোর গভীরে না ঢুকতে না পারলে, নিধার্মিকতার আন্দোলন কখনো সফল হবে না।
However, position of religion as a rendering force in the ethical structure of the society for modern and future time is debatable. In advanced society, we are already more controlled by algorithm than by religious force these days. That will be another topic for discussion.
তবে সমাজের নিয়ন্ত্রনে, ধর্মের ভূমিকা আর থাকা সম্ভব না। আমরা উন্নত সমাজে এখনই এলগোরিদম নিয়ে বেশী চালিত ( যেমন ডলার-টাকার দাম, বাজারের খাদ্যমুল্য- চাকরির দাম)-এবং আস্তে আস্তে উন্নত সমাজ সম্পূর্ন এই ভাবেই এগোবে।
@বিপ্লব পাল,
“তবে সমাজের নিয়ন্ত্রনে, ধর্মের ভূমিকা আর থাকা সম্ভব না। আমরা উন্নত সমাজে এখনই এলগোরিদম নিয়ে বেশী চালিত ( যেমন ডলার-টাকার দাম, বাজারের খাদ্যমুল্য- চাকরির দাম)-এবং আস্তে আস্তে উন্নত সমাজ সম্পূর্ন এই ভাবেই এগোবে।”
হাঁ এটাই মূল কথা। ফরাসী ভাষায় একটা কথা আছে , ” মানুষ যতই তাঁর খোলস পাল্টায় ততই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় । ” এখানে যা বলা হয়নি তা হোল , “মানুষ যতই খোলস পাল্টায় ততই সভ্যভাবে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।” । অর্থাৎ সভ্য সমাজে বা আধুনিক সমাজে একজন পতিতা বা যৌন কর্মীকে যে সম্মান দেয়া হয় আমাদের সমাজে একজন প্রথম শ্রেনীর নারীও তা পায় না । আধুনিক সমাজে একজন যৌন কর্মী এখন সোশ্যাল ওয়ার্কার । এটাই সভ্যতা , এটাই প্রগতিশীলতা।
মানুষ শতকরা একশত ভাগ যুক্তিনির্ভর হতে পারে?। পারলে ভাল হত কিন্তু পারে না। আজকে যদি বাংলাদেশের মাটির নীচে কোটি কিলোগ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায় কোথায় যাবে অর্থনীতির কচকচানি আর কোথায় যাবে শেয়ার মার্কেট সুচক। অথচ স্বর্ণ , রুপা এগুলো ত খনিজ পদার্থ ,শুধুমাত্র নস্ট হয় না তাই এদের বিনিময় মূল্য আকাশ ছোঁয়া। একই ভাবে পানির বিনিময় মূল্য এখন পর্যন্ত প্রায় শুন্য যা অর্থনীতির খুব প্রিয় একটা আলোচনার বিষয়। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদ খ্রিস্টান ও এহুদি ধর্মের ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটাই জীবন।আস্তিক কে গালি দেয়া অপরাধ , নাস্তিক কেও গালি দেয়া অপরাধ। কেও কারো জন্য ভিতিকর না হলেই যথেস্ট।
@সপ্তক,
অর্থনীতির ভিত্তিই হচ্ছে মানুষের যৌত্বিক সিদ্ধান্ত। কিন্ত সেটা হওয়া সম্ভব না। আমাদের সামাজিক অস্তিত্বে অসংখ্য অযৌত্বিক সত্ত্বা- দেশ, জাতি, ধর্ম, আদর্শ, ট্রাডিশন। ফলে অর্থনীতির কতটা বিজ্ঞান আর কতটা অপবিজ্ঞান -সেই সমস্যাটা থেকেই যায়।
আদর্শ বাজার বলে কিছু হয় না। কিছু ভারতীয় যেমন এখানে পাকিস্তানি স্টোরে যাবে না-সস্তায় দিলেও না। অনেক মুসলিম ধর্মের কারনে বিবর্তন নিয়ে পড়বে না বা জানবে না-যেগুলোর কোনটাই যৌত্বিক আচরন না।
আমার কাছে মনে হয় সব ই যেন আপেক্ষিক , আজ যেটা ভালো, কাল সেটা ভালো না ও লাগতে পারে। এটা নির্ভর করবে কালকের পরিবেশ , পরিস্থিতির উপর।
কারন মনে দ্বন্দ না থাকলে নতুন চিন্তার সংশ্লেষ অসম্ভব।
আমরা মনে হয় যুক্তি নির্ভর চিন্তাটাই গ্রহন করি। আর এই গ্রহণটা অবশ্যই সময় নির্ভর।
@কামরুল আলম,
সমস্যাটা হচ্ছে-যুক্তি কোনটা? জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি নির্ভর চিন্তাটা জীবনের উদ্দেশ্যের বাইরে হতে পারে না। যেমন যারা চাইল্ডলেস বাই চয়েস থাকছে, তাদের যুক্তিটা কি? একটাই ” চাইল্ডলেস বাই চয়েস” থাকা অধিকার। ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তিটাই তাদের কাছে সব থেকে “বড়” -কারন তারা ওই উদ্দেশ্যটাকেই জীবনের সব থেকে বড় উদ্দেশ্য বলে মনে করছে। আবার তাদের যুক্তি অনেকের কাছেই কুযুক্তি বলে মনে হবে, যারা জীবনের জৈবিক উদ্দেশ্য অর্থাৎ প্রজননের উদ্দেশ্যকে সব থেকে বড় উদ্দেশ্য বলে মানছে।
সুতরাং সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষের “যুক্তি” র স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। সবটাই জীবনের উদ্দেশ্য নির্ভর। আর জীবনের পরম উদ্দেশ্য নেই। সুতরাং কোন যুক্তিই সেক্ষেত্রে ” পরম” না-আপাত। এবং যুক্তির খুঁটিতেই বিশ্বাস বস্তুটা এসেই যাচ্ছে।
@বিপ্লব পাল,
“সুতরাং সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষের “যুক্তি” র স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। সবটাই জীবনের উদ্দেশ্য নির্ভর। আর জীবনের পরম উদ্দেশ্য নেই। সুতরাং কোন যুক্তিই সেক্ষেত্রে ” পরম” না-আপাত। এবং যুক্তির খুঁটিতেই বিশ্বাস বস্তুটা এসেই যাচ্ছে।”
জীবনের পরম উদ্দেশ্য নেই বলেই আপাত উদ্দেশ্য গুলো হাসিল করার জন্যেই আমারা যুক্তির অবতারনা করি, আপাত উদ্দেশ্যগুলো ব্যাক্তি স্বার্থের স্বপক্ষে নেওয়ার জন্যেই যুক্তি দেয়া। যুক্তির খুঁটিতেই বিশ্বাস বস্তুটা আসলেও সে বিশ্বাস তা ও আপাত। উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেলে বিশ্বাস তা নড়বড়ে হয়ে যায়। শুধুমাত্র সেই বিশ্বাসটাই টিকে থাকে যেটা অর্জিত, আর অর্জিত বিশ্বাস গুলো ও আপাত । পরবর্তী যুক্তির ধাপে সেই বিশ্বাস ও চুরমার হয়ে যেতে পারে। আর এ চুরমার নির্ভর করে ব্যাক্তি কত সহজে প্রভাবিত হয়। ব্যাক্তি মস্তিস্কের কিছু কিছু বিশ্বাস চিরকাল একই থাকে। শত শত যুক্তির মাধ্যমেও তা খণ্ডন করা যায় না, এসব ব্যাক্তি মস্তিস্ক তার নিজস্ব কাল্পনিক জগতকেই প্রধান বলে মনে করে। আর তাই সেসব ক্ষেত্রে যুক্তির কোন আপাত বা স্থায়ী প্রভাব নেই।
@কামরুল আলম,
বৈজ্ঞানিক গবেষণাতে এটা প্রমানিত আমাদের মন ভীষণ ভাবে স্থিতিস্থাপক-অর্থাৎ নতুন নতুন পরিবেশ এবং আইডিয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর সাংঘাতিক ক্ষমতা এর আছে।
কিন তা সত্ত্বেও বিশ্বাস কি করে গভীরে প্রেথিত হয়? কেন একজন হিন্দু বা মুসলমান তার বিশ্বাস ( ইমানে) অটল থাকে?
এই নিয়ে আমার যদ্দুর পড়াশোনা-তাতে এটুকু বুঝেছি ছেলে মেয়েদের ৫-১৪ হচ্ছে ফর্মেশন ইয়ারস-বা এই বয়সে যেসব জিনিস মাথায় ঢোকে, সেগুলো মনের খুব গভীরে চলে যায়। আর ঢোকে পরিবারের শিক্ষা থেকে। এই সময় কিছু কুশিক্ষা, বিশ্বাস ঢুকে গেলে, সেটা মাথা থেকে পরিস্কার করা মুশকিল। এই জন্যে বাচ্চাদের জন্যে বিজ্ঞান ও যুক্তি শিক্ষার প্রচার করা দরকার আগে।