(দ্বিতীয় পর্বের পর…)
.
জগতসৃষ্টির শাস্ত্রতত্ত্ব
পুরুষতন্ত্রের সন্দেহাতীত ধারক ও বাহক হিসেবে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় প্রায় শুরুতেই অনিবার্যভাবেই জগতসৃষ্টির হেতু পুরুষরূপী ব্রহ্মার অব্যক্ত স্বরূপের খোঁজ পেয়ে যাই আমরা-

‘আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।।’
এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বসংসার এককালে (সৃষ্টির পূর্বে) গাঢ় তমসাচ্ছন্ন ছিল; তখনকার অবস্থা প্রত্যক্ষের গোচরীভূত নয়; কোনও লক্ষণার দ্বারা অনুমেয় নয়; তখন ইহা তর্ক ও জ্ঞানের অতীত ছিল। এই চতুর্বিধ প্রমাণের অগোচর থাকায় এই জগৎ সর্বতোভাবে যেন প্রগাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল। (১/৫)।
‘ততঃ স্বয়ম্ভূর্ভগবানব্যক্তো ব্যঞ্জয়ন্নিদম্।
এহাভূতাদিবৃত্তৌজাঃ প্রাদুরাসীৎ তমোনুদঃ।।’
তারপর (প্রলয়ের অবসানে) অব্যক্ত (বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অগোচর অর্থাৎ যোগলভ্য) বৃত্তৌজাঃ (অপ্রতিহত সৃষ্টিসামর্থ্যশালী) ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান স্বয়ম্ভূ (স্বেচ্ছায় লীলাবিগ্রহকারী পরমাত্মা) তমোনুদ হয়ে অর্থাৎ প্রলয়াবস্থার ধ্বংসক, মতান্তরে প্রকৃতিপ্রেরক হয়ে, এই স্থূল আকাশাদি মহাভূত- যা পূর্বে অপ্রকাশ ছিল- সেই বিশ্বসংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে আবির্ভূত হলেন। (১/৬)।
‘যোহসাবতীন্দ্রিয়গ্রাহ্যঃ সূক্ষ্মোহব্যক্তঃ সনাতনঃ।
সর্বভূতময়োহচিন্ত্যঃ স এব স্বয়মুদ্বভৌ।।’
যিনি মনোমাত্রাগ্রাহ্য, সূক্ষতম, অপ্রকাশ, সনাতন (চিরস্থায়ী), সকল ভূতের আত্মাস্বরূপ অর্থাৎ সর্বভূতে বিরাজমান এবং যিনি চিন্তার বহির্ভূত সেই অচিন্ত্য পুরুষ স্বয়ংই প্রথমে শরীরাকারে (মহৎ প্রভৃতিরূপে) প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। (১/৭)।
‘সোহভিধ্যায় শরীরাৎ স্বাৎ সিসৃক্ষুর্বিবিধাঃ প্রজাঃ।
অপ এব সসর্জাদৌ তাসু বীজমবাসৃজৎ।।’
সেই পরমাত্মা স্বকীয় অব্যাকৃত (unmanifested) শরীর হতে বিবিধ প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছা করে চিন্তামাত্র প্রথম জলের সৃষ্টি করলেন এবং তাতে আপন শক্তিবীজ অর্পণ করলেন। (১/৮)।
‘তদণ্ডমভবদ্ধৈমং সহস্রাংশুসমপ্রভম্।
তস্মিন্ জজ্ঞে স্বয়ং ব্রহ্মা সর্বলোকপিতমহঃ।।’
জলনিক্ষিপ্ত সেই বীজ সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট একটি অণ্ডে পরিণত হল আর সেই অণ্ডে তিনি স্বয়ংই সর্বলোকপিতামহ ব্রহ্মারূপে জন্ম পরিগ্রহ করলেন। (১/৯)।

এরপর পিতামহ ব্রহ্মা জগতের তাবত কিছু সৃষ্টি করতে লাগলেন। স্বর্গলোক, মর্ত্যলোক, আকাশ, অষ্টদিক, সমুদ্রাখ্য, দোষ, গুণ, মহত্ত, ইন্দ্রিয়, পঞ্চভূত, বেদ, যজ্ঞ, শাস্ত্র, দেবাদি, অগ্নি, বায়ু, সূর্য, কাল, ক্ষণ, তপস্যা, বাক্য, রতি, কামনা, ক্রোধ, সুখ, দুঃখ, ধর্ম, অধর্ম, ফলাফল, সত্য, মিথ্যা ইত্যাদি লৌকিক-অলৌকিক যাবতীয় ভাব ও বস্তুনিচয় তৈরি করলেন। উল্লেখ্য, একক স্রষ্টায় বিশ্বাসী পৃথিবীর সবগুলো ধর্মতত্ত্বেই জগতস্রষ্টার স্বরূপ ও সৃষ্টি সম্পর্কিত মৌলিক ধারণার মধ্যে সম্ভবত খুব একটা তফাৎ নেই। স্রষ্টার সর্বব্যাপ্ততা আর হও বললেই হয়ে যাওয়ার অকল্পনীয় ক্ষমতা না থাকলে তিনি স্রষ্টা হবেনই বা কী করে ! অতএব দৃশ্যমান অদৃশ্যমান প্রয়োজনীয় কোন কিছুই সৃষ্টির বাকি থাকার কথা নয়। যেহেতু তিনি জগতের স্রষ্টা বা প্রভু বা পতি, তাই প্রজা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা হবেন কী করে। অতএব এবার তিনি জীবজগতের সৃষ্টিতে মনোযোগী হলেন-

‘দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ।
অর্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু।।’
সেই প্রভু প্রজাপতি আপনার দেহকে দ্বিধা করে অর্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন এবং তারপর সেই নারীর গর্ভে বিরাটকে উৎপাদন করলেন। (১/৩২)।
‘তপস্তপ্তাসৃজৎ যং তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্।
তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ।।’
হে দ্বিজসত্তমগণ! সেই বিরাট পুরুষ তপস্যা করে স্বয়ং যাকে সৃষ্টি করলেন, আমি সেই মনু- আমাকে এই সমুদয়ের দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা বলে জেনো। (১/৩৩)।

অর্থাৎ ব্রহ্মা হচ্ছেন সর্বলোকপিতামহ, আর মনু হচ্ছেন জীবজগতের আদিপিতা। এবং তা যে নিশ্চিতভাবেই পুরুষবাচক তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রজাসৃষ্টির মানসে আদিপিতা মনু তপস্যা করে প্রথমতঃ দশজন মহর্ষি প্রজাপতি সৃষ্টি করলেন (১/৩৪)। (এরাও কিন্তু পুরুষই।) এই মহাতেজস্বী দশজন মহর্ষির মাধ্যমে বিস্তর ধাপে ধাপে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যক্ষ, রক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, নাগ, সর্প, সুপর্ণ এবং দেবলোক পিতৃলোক সবই সৃষ্টি হতে লাগলো। এভাবেই মানুষ এবং যাবতীয় পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ ইতরপ্রাণী সব সৃষ্টি হতে লাগলো। আর এসবের জন্মসৃষ্টির পেছনের কারণ হিসেবে জন্মান্তরবাদ নামের এক অদ্ভুত তত্ত্ব সৃষ্টি করে তারই যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো- যাকে বলে ‘পূর্বজন্মের কর্মফল’। পূর্বজন্মের নিজ নিজ কৃতকর্মের ফলস্বরূপ অবিনাশি আত্মার পরজন্মে বিভিন্ন যোনিদেহপ্রাপ্তির এই সুচতুর ধারণা তথা জন্মান্তরবাদের অদৃশ্য নিগড়ে পরবর্তীকালের বৈদিক তথা ভারতীয় সমাজদেহ যে ভয়ঙ্কর পাঁকচক্রে বাঁধা পড়ে গেলো, তা থেকে আর মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি আজো। কেননা পরমাত্মা ব্রহ্মার সৃষ্ট নিয়মেই এসব জন্ম-জন্মান্তরের অনিবার্য ধারাক্রম আবর্তিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করানো হয়। অবিনাশি আত্মার এই আবর্তন এমনই চিরায়ত ভয়াবহ আবর্তন যে জগতের প্রলয় বা ধ্বংস হলেও এ আবর্তন চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায় না। পরমেশ্বরের ইচ্ছারূপ কিছুকাল বিরতিমাত্র-

‘এবং সর্বং স সৃষ্ট্রেদং মাং চাচিন্ত্যপরাক্রমঃ।
আত্মনান্তর্দধে ভূয়ঃ কালং কালেন পীড়য়ন্।।’
মহর্ষিগণ, সেই অচিন্ত্যপরাক্রম ভগবান এইভাবে স্থাবর-জঙ্গম সমুদয় জগৎকে ও আমাকে সৃষ্টি করে প্রলয়কাল দ্বারা সৃষ্টিকালের বিনাশসাধন করত প্রলয়কালে পুনর্বার আপনাতেই আপনি অন্তর্হিত হন। (১/৫১)।
‘তস্মিন স্বপতি তু স্বস্থে কর্মাত্মানঃ শরীরিণঃ।
স্বকর্মভ্যো নিবর্তন্তে মনশ্চ গ্লানিমৃচ্ছতি।।’
ভগবান প্রজাপতি যখন (জগতের প্রলয়কালে) আপনাতে আপনি অবস্থিত থেকে বিরাম উপভোগ করেন, অর্থাৎ দেহ-মনের ব্যাপার রহিত হন, তখন কার্যানুযায়ী-লব্ধদেহ শরীরিগণও স্ব স্ব কর্ম থেকে নিবৃত্ত হয় এবং তাদের মনও সকল ইন্দ্রিয়ের সাথে লীনভাবে অবস্থান করে অর্থাৎ কার্যরহিত হয়। (১/৫৩)।

‘যখন মহাপ্রলয়কালে সেই পরমাত্মাতে এককালে নিখিল সংসার লয় পেয়ে থাকে, তখন সেই সর্বভূতাত্মা নিশ্চিন্তভাবে যে পরম সুখে নিদ্রা যান।’ (১/৫৪)।
‘মহাপ্রলয়কালে জীবাত্মা তমঃ অর্থাৎ অজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে বহুকাল ইন্দ্রিয়সমূহের সাথে অবস্থান করে। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসাদি কোনও কর্মই করে না এবং তখন সে নিজের পাঞ্চভৌতিকাদি শরীর থেকে উৎক্রমণ করে অর্থাৎ দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে।’ (১/৫৫)।
‘জীবাত্মা যখন পুর্যষ্টকরূপ অণুমাত্রিক হয়ে অর্থাৎ সূক্ষ্ম পঞ্চ মহাভূত, জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, বাসনা, বায়ু, কর্ম ও অজ্ঞান- এই সব লিঙ্গশরীরযুক্ত হয়ে বৃক্ষাদিস্থাবরসৃষ্টির এবং মনুষ্যাদি জঙ্গম সৃষ্টির হেতুভূত স্থাবর ও জঙ্গমবীজকে সমাশ্রয় করে, তখন প্রাণাদির সাথে সংসৃষ্ট অর্থাৎ যুক্ত হয়ে সে বৃক্ষাদির রূপ বা মনুষ্যাদির রূপ ধারণ করে (এই সময় তার সৃষ্টি-অবস্থা এবং সেই অবস্থাতে সে স্থূল মূর্তি ধারণ করে)। (১/৫৬)।

‘এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যাদিমং সর্বং চরাচরম্।
সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।।’
এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন। (১/৫৭)।

.

বর্ণাশ্রম, মানবতা হননের প্রথম ধর্মীয় আগ্রাসন
ভারতীয় বৈদিক ধর্মে কর্মফল অনুবর্তী এই পরমার্থিক জন্মান্তরবাদের ধারণা বা দর্শন যে মূলত কুচক্রী ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকচক্রের সমাজ শাসনের এক ভয়াবহ সুচতুর শাসনতাত্ত্বিক ধর্মদর্শন তা মনুসংহিতার পরতে পরতে উৎকটভাবেই পরিদৃষ্ট হয়। কেননা কর্মফল অনুযায়ীই কেউ শাসক, কেউ শাসিত, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র হয়ে জন্মেছে। এবং নারীজন্মও তার পূর্বজন্মের কর্মেরই ফল। এই কর্মফল এমনই অবিচ্ছেদ্য অপরিবর্তনীয় যে, এজন্মে কর্মনির্দিষ্ট কার্যাদি সুষ্ঠু ও যথাযথ সম্পাদনের মাধ্যমেই শুধু পরবর্তী জন্মে উত্তম ফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই এজন্মের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাভোগ পূর্বজন্মের কোন দুষ্কর্মের ফল হওয়ায় এর জন্য নিজেই দায়ী এবং তা ভোগ করতেই হবে, অন্য কাউকে দোষী করার উপায় নেই। অন্য কেউ এজন্যে দায়ীও নয়। অন্যদিকে এ জন্মে যাবতীয় সুখ ভোগকারীর উপভোগ্য সকল সুবিধাও তার পূর্বজন্মের কোন সুকৃতিরই পুরস্কার। সমাজের ধর্মীয় শাসনতন্ত্রকে এমন নিরাপদ সর্বগ্রাসী উপভোগ্য করে তোলার এই যে প্রক্রিয়া, তা যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত বা শাসিতদের দিক থেকে কোনরূপ হুমকীর সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্যে ব্রহ্মার নামে সুকৌশলে প্রচারিত জন্মান্তরবাদের এই ধারাক্রমে মানবজীবনটাকেও বেঁধে ফেলা হয়েছে এক ভয়ঙ্কর অমানবিক বর্ণাশ্রম প্রথায়-

‘লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহূরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ।।’
পৃথিব্যাদির লোকসকলের সমৃদ্ধি কামনায় পরমেশ্বর নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পাদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চারিটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন। (১/৩১)।

এই বর্ণ সৃষ্টি করেই থেমে যান নি। কেননা এমনি এমনি তা সৃষ্টি হয়নি। পূর্বজন্মের কর্ম অনুযায়ী এজন্মে তার ফল ভোগ করার নিমিত্তেই ব্রহ্মা কর্তৃক এই বর্ণসৃষ্টি। তাই শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট কার্যেরও ঘোষণা করা হলো-

‘সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।।’
এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন। (১/৮৭)।
‘অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।’
অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন। (১/৮৮)।
‘প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।।’
প্রজারক্ষণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন। (১/৮৯)।
‘পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।।’
পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল। (১/৯০)।
‘অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।
প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। (১০/১)।
‘এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রƒষামনসূয়য়া।।’
প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,- তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা। (১/৯১)।

উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই। তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ-

‘উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।।’
ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু। (১/৯৩)।
‘ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।।’
ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন। (১/৯৯)।
‘সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।।’
জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন। (১/১০০)।
‘স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।।’
ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে। (১/১০১)।

অন্যদিকে শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-

‘শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।।’
ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। (৮/৪১৩)।

এখানেই শেষ নয়। কেউ সন্তুষ্ট বা দয়াপরবশ হয়ে যদি শূদ্রকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে চায়, এটাও খুবই গর্হিতকর্ম হবে। তাই এ কাজ সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে শাস্ত্রে–

‘ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।।’
প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ? (৮/৪১৪)।

তাই–

‘বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।
তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।।’
রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে। (৮/৪১৮)।

উচ্চবর্ণিয়দের জন্য প্রতিকুল সময়ে ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ এই মনুসংহিতায় বিশদভাবেই দেয়া হলেও শূদ্রকে তার নিজ কর্মের বাইরে বিকল্প জীবিকা গ্রহণের কোন সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি মনুশাস্ত্রে শূদ্রের কোনরূপ সম্পদ অর্জনকেও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে-

‘শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।।’
‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷’(১০/১২৯)।

তারপরও কোন শূদ্র যদি কদাচিৎ ধন আহরণ করে ফেলে ? সেক্ষেত্রেও ধর্মের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর কোন উপায় নেই তার। কেননা-

‘বিস্রব্ধং ব্রাহ্মণঃ শূদ্রাদ্ দ্রব্যো দাদানমাচরেৎ।
ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ।।’
ব্রাহ্মণ নিঃসঙ্কোচে শূদ্রের জিনিস গ্রহণ করবেন; কারণ তার অর্থাৎ শূদ্রের নিজের বলতে কোন ধনও নেই, সেও প্রভুরই জন্য দ্রব্য আহরণ করে; সে স্বয়ং ধনহীন। (৮/৪১৭)।

শূদ্রের এই ভয়াবহ শূদ্রত্বের কারণ কী ? সেই পূর্বজন্মেরই কর্মফল এটা। এই কর্মফলের কারণেই এই মানবেতর অবস্থা উত্তরণে এ জন্মে তার মুক্ত জীবনধারী অর্থাৎ দ্বিজ হওয়া সম্ভব নয়। দ্বিজত্ব হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের সেই বর্ণবাদী প্রতারণা যার মাধ্যমে সমাজকে স্পষ্টতই বহু বিভাজনে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয়েছে। দ্বিজ অর্থ হচ্ছে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করেন যিনি। এই দ্বিতীয় জন্ম একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বর্ণবিভাজিত সমাজে এর প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এই দ্বিজ হয়ে ওঠাই বৈদিক বর্ণপ্রথার গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমেই অবধারিতভাবে সমাজের জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রভূ ও ভৃত্য বা দাসের বাধ্যতামূলক বিভক্তিকরণ বর্ণ বা বংশ পরম্পরা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রহ্মা কর্তৃক নির্ধারিত চারটি বর্ণের মধ্যে প্রথম তিনটি বর্ণে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বিজ হয়ে ওঠার সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ এরা প্রভূ বা প্রভূসম্পর্কিত জাতি-

‘নাভিব্যাহারয়েদ্ব্রহ্ম স্বধানিনয়নাদৃতে।
শূদ্রেণ হি সমস্তাবদ্ যাবদ্বেদে ন জায়তে।।’
মৌজ্ঞীবন্ধন অর্থাৎ উপনয়নের পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ যতক্ষণ না বেদজন্মরূপ উপনয়ন প্রাপ্ত হয় ততক্ষণ) স্বধা অর্থাৎ শ্রাদ্ধসম্বন্ধীয় বেদমন্ত্র ছাড়া অন্য বেদবাক্য উচ্চারণ করাবে না (এটি পিতার প্রতি উপদেশ)। যতক্ষণ না উপনীত হয়ে বেদাধ্যয়নদ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করবে, ততক্ষণ (ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণ) শূদ্রেরই সমান। (২/১৭২)।
‘ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি। (১০/৪)।

এই সঙ্করজাতিরা ব্রহ্মাসৃষ্ট চতুবর্ণেরও বাইরে। অর্থাৎ এদের থেকেই অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। উত্তর-ভারতীয় ভাষায় যাকে বলে দলিত সম্প্রদায়। এরাই বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্ঠী।
.
শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনার প্রধান শিকার নারী
বৈদিক শাস্ত্রে নারীর অবস্থান নির্ণয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই এই দ্বিজত্বপ্রাপ্তির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। (এদের মধ্যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই শীর্ষে অবস্থান করে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পাবে। আর শূদ্র হচ্ছে সর্বনিম্ন অবস্থানে, যার প্রত্যক্ষ যোগ হচ্ছে দাসত্ব।) এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর (১০/৬-২৭)। চারটি বর্ণের মধ্যে উর্ধ্বতন তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণীয় দাস। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না। কারণ এই জাত-কর্মাদির অধিকার কেবল দ্বিজদেরই আয়ত্তে। একইভাবে যেহেতু এই শাস্ত্রসূত্রানুসারেই নারীর জন্যেও দ্বিজ হবার কোন অধিকার রাখা হয়নি, তাই নারীও শূদ্রসমতুল্য বা শূদ্রই-

‘অমন্ত্রিকা তু কার্যেয়ং স্ত্রীণামাবৃদশেষতঃ।
সংস্কারার্থং শরীরস্য যথাকালং যথাক্রমম্।।’
পুরুষের মতো স্ত্রীলোকদেরও শরীরসংস্কার বা দেহশুদ্ধির জন্য এই সমস্ত আবৃৎ (অর্থাৎ জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে সংস্কারগুলির আনুষ্ঠানিক কর্মসমূহ) যথা-নির্দিষ্ট কালে এবং যথানির্দিষ্ট ক্রমে সম্পন্ন করতে হয়; কিন্তু তাদের পক্ষে ঐ সমস্ত অনুষ্ঠানে কোনও মন্ত্রের প্রয়োগ থাকবে না। (২/৬৬)।

সংস্কার মানে হচ্ছে শুদ্ধ হওয়া। এর জন্যে অবশ্যই মন্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মশাস্ত্রানুযায়ী মন্ত্রহীন সংস্কার অর্থহীন, ফলহীন। নারীর জন্য মন্ত্রের প্রয়োগ না থাকার অর্থ হলো কিছু অর্থহীন ফালতু সংস্কার আরোপ করা হলেও মূলত নারীর উপনয়ন-সংস্কার হয় না। কেননা ওই সংস্কারকর্ম কোন ধর্মানুষ্ঠানই নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, দ্বিজ হওয়া নারীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। ফলে মূলত মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে-

‘নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ, – এই হলো শাস্ত্রস্থিতি। (৯/১৮)।

তবে যত মিথ্যা-অপদার্থই হোক না কেন, পুরুষের অনিবার্য প্রয়োজনেই গোটা মনুশাস্ত্রে নারীর জন্য একটি সংস্কারকে সবার উপরে স্থান দিয়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও অবধারিত করে দেয়া হয়েছে- তা হলো বিবাহ-সংস্কার। এ ব্যাপারে মনুসংহিতার স্পষ্টোক্তি-

‘বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া।।’
বিবাহ-সংস্কারই স্ত্রীলোকদের উপনয়নস্থানীয় বৈদিক সংস্কার (অর্থাৎ বিবাহের দ্বারাই স্ত্রীলোকদের উপনয়ন সংস্কার সিদ্ধ হয়); বিবাহের পর স্ত্রীলোকেরা যে তাদের পতিদের সেবা করে (শুশ্রূষা বা সন্তোষ বিধান করে), তা-ই তাদের গুরুগৃহে বাসস্বরূপ (গুরুগৃহে বাস করা অবস্থায় বেদাধ্যয়ন কর্তব্য, কিন্তু স্ত্রীলোক তো সত্য-সত্য গুরুগৃহে বাস করে না, তাই তাদের বেদাধ্যয়নের প্রসঙ্গ আসে না); স্বামীর গৃহস্থালীর কাজই হলো (যেমন, অন্নরন্ধন, পোষাকাদি সাজিয়ে রাখা, টাকাকড়ি গুণে ঠিকমতো রাখা ইত্যাদি) স্ত্রীলোকেদের পক্ষে গুরুগৃহে (সায়ং ও প্রাতঃকালীন হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা [ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে থেকে সায়ং-প্রাতঃকালীন যে সমিৎ সংগ্রহ করে, তা স্ত্রীলোকদের পক্ষে গৃহস্থালীর কাজের দ্বারা সম্পন্ন হয়। আর স্ত্রীলোকেরা গৃহস্থালীর কাজকর্ম অর্থাৎ অগ্নির দ্বারা নিষ্পাদনীয় রন্ধনাদি যে সব কাজ করে, তার দ্বারা ব্রহ্মচারীর করণীয় যতকিছু যম-নিয়ম প্রভৃতি সেগুলিও পদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। অতএব, এখানে স্ত্রীলোকদের অগ্নিপরিষ্ক্রিয়াটি পুরুষদের যম-নিয়মাদি কর্তব্যগুলির উপলক্ষণ]। (২/৬৭)।

অর্থাৎ এক কথায় এটা এমনই এক শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনা, যার মাধ্যমে খুব সচেতনভাবে নারীকে সমস্ত বৈদিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পুরুষের অনুগামী অধীনস্থ হওয়াই নিয়তি-নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
.
অনুগত ক্রিতদাসের প্রতিও ন্যূনতম যেটুকু মানবিক সহানুভূতি অন্তত মানুষের স্বাভাবিক মনোবৃত্তিতে থাকা উচিত বলে মনে হয়, গোটা মনুশাস্ত্রে শূদ্রদের জন্য এর ছিটেফোটাও কোথাও দেখা যায় না। এবং নারীর ক্ষেত্রে এই মনেবৃত্তি এতোটাই আপত্তিকর পর্যায়ে নেমে গেছে যে, মনুশাস্ত্রে নারী যে বস্তুত কোন মানুষ বা মানবিক সত্তাধারী কোন প্রাণী তাও স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বলেই মনে হয়। মনুসংহিতা তো আর যে সে গ্রন্থ বা শাস্ত্র নয়, খোদ বেদাশ্রিত ধর্মশাস্ত্র-

‘যঃ কশ্চিৎ কস্যচিদ্ধর্মো মনুনা পরিকীর্তিতঃ।
গ সর্বোহভিহিতো বেদে সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।।’
ভগবান মনু যে কোনও ব্যক্তির যে কোনও (যেমন, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম, সংস্কারধর্ম প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণাদি বিশেষ বিশেষ বর্ণের জন্য বিহিত বিশেষ বিশেষ ধর্ম) উপদেশ দিয়েছেন, সে সবগুলিই বেদে প্রতিপাদিত হয়েছে। কারণ, সেই বেদ হলো সকল প্রকার জ্ঞানের আকর (অর্থাৎ জ্ঞাপক কারণ)। (২/৭)।

তাই মনুর শাস্ত্র মনুসংহিতা অনিবার্য ও অবশ্যপালনীয় জীবনবিধান, যার ব্যতিক্রম হওয়ার কোন উপায় বৈদিক সমাজধর্মে কোথাও রাখা হয়নি। ফলে মনুসংহিতায় নারীর জন্যে আরোপিত বিধান বা অনুশাসনগুলিও যে আচরিত সমাজ ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ছিলো তা আর নতুন করে বলা বাহুল্য। অতএব প্রশ্ন আসে, মনুশাস্ত্রে নারী আসলে কী বস্তু ?

(চলবে…)
[১ম পর্ব ] [২য় পর্ব ] [*] [৪র্থ পর্ব ]