বিশ্বমানের গবেষক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, গণিতবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর, দক্ষ প্রশাসক, প্রতিষ্ঠান-নির্মাতা – খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু যদি একই ব্যক্তির মধ্যে আমরা এই সবগুলো গুণের সমন্বয় দেখি – তখন তাকে অবাস্তব কাল্পনিক চরিত্র বলে মনে হয়। কিন্তু কল্পনা নয়, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা ছিলেন এমনই একজন বিরল সত্যিকারের মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন “যাদের সুযোগ ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে তাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজের দেশে থাকা এবং সেখানে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা”[1]। হোমি ভাবা নিজের দেশেই গড়ে তুলেছেন বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’, এবং একাধিক পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র – যা বিশ্বের বুকে ভারতের বৈজ্ঞানিক সামর্থ্যকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে স্বাধীন ভারতকে বৈজ্ঞানিক দক্ষতায় গড়ে তোলার জন্য দিনরাত প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন হোমি ভাবা। স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েও তিনি একই সাথে ছিলেন প্রচন্ড আন্তর্জাতিক। কাজ করেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি সহ বিশ্বের অনেক দেশের বিজ্ঞানীর সাথে [2]। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আভিজাত্য পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রেই, নিজের প্রতিভা আর পরিশ্রমে তা আরো সমৃদ্ধ করেছেন। পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে ‘ইলেকট্রন-পজিট্রন’ স্ক্যাটারিং-এর পরিমাণ হিসেব করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যা ‘ভাবা স্ক্যাটারিং তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। গবেষণা করেছেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী নিল্‌স বোর, এনরিকো ফার্মি, উলফ্‌গং পাউলি প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে। কেমব্রিজে পড়ার সময় তাঁর টিউটর ছিলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক পল ডিরাক। হোমি ভাবা পৃথিবীর যেখানেই যত ভাল জিনিস দেখেছেন শিখেছেন – বিজ্ঞান, প্রকৌশল কিংবা শিল্পকলায় – তার সুফল বয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন নিজের দেশের মানুষের জন্য। ভারতের পারমাণবিক শক্তির বিকাশ ঘটে হোমি ভাবার হাত ধরে। ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’ বর্তমানে বিশ্বের একটি প্রথম শ্রেণীর পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান [3]।

হোমি জাহাঙ্গির ভাবার জন্ম ১৯০৯ সালের ৩০ অক্টোবর বোম্বাই শহরের বিশিষ্ট পার্সি পরিবারে। হোমির বাবা জাহাঙ্গির হরমুসজি ভাবা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এম-এ এবং লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। টাটা শিল্পগোষ্ঠীর আইন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে টাটা গ্রুপের অনেকগুলো কোম্পানির পরিচালনা পরিষদেও ছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ও চিত্রকলার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল জাহাঙ্গির ভাবার। হোমির পিতামহ ডক্টর কর্নেল হরমুসজি ভাবাও লন্ডন থেকে এম-এ ও ডি-লিট প্রাপ্ত। মহিশুর রাজ্যের শিক্ষাবিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন তিনি। শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিশেষ সম্মান প্রদান করেন। হোমির মা মেহেরবাই ফ্রামজি পান্ডে ছিলেন ভিখাজি ফ্রামজি পান্ডের কন্যা এবং বিখ্যাত সমাজসেবী, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ব্যারোনেট স্যার দিনশ পেটিটের নাতনি। টাটা শিল্পগোষ্ঠীর সাথে পারিবারিকভাবে আত্মীয়তা ছিল হোমির পরিবারের। হোমির পিসির সাথে বিয়ে হয়েছিল টাটা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটার বড় ছেলে স্যার দোরাব টাটার।

প্রাচুর্য ও অভিজাত পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন হোমি ভাবা। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত আর চিত্রকলার সাথে পরিচয় ঘটে জন্মের পর থেকেই। নিজেদের বাড়ির বিরাট লাইব্রেরি এবং পিসির বাড়ি টাটাদের লাইব্রেরির হাজার হাজার বই, ছবি আর ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিশাল সংগ্রহের মাঝে নিরাপদ ও আরামদায়ক শৈশব হোমির। সাত বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হলো বোম্বাইএর সবচেয়ে অভিজাত ও ব্যয়বহুল স্কুলে। ক্যাথিড্রাল স্কুল ছিল মূলত ইউরোপিয়ানদের দ্বারা পরিচালিত ও ভারতে বসবাসরত ইউরোপিয়ান ছেলেমেয়েদের জন্য। ভারতের অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ার সুযোগ পেত। ক্যাথিড্রাল স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর জন কোনন হাই স্কুল। স্কুলের পড়াশোনায় খুব মনযোগী থাকলেও খেলাধূলার প্রতি খুব একটা উৎসাহ ছিল না হোমির। ক্লাসের পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল ফলাফল করলেও হোমির বন্ধুবান্ধব খুব একটা বেশি ছিল না। স্কুলের চেয়েও বাড়িতে অনেক বেশি লেখাপড়া হতো হোমির। মালাবার পাহাড়ের লিটল গিব্‌স রোডে হোমিদের দোতলা বাড়িতে একটা বিশাল লাইব্রেরি ছিল। হোমির পিতামহের সংগ্রহ ছিল প্রচুর, পরে তাতে যোগ হয়েছে হোমির বাবার সংগ্রহ। বিজ্ঞানের প্রতি হোমির আগ্রহ প্রকাশ পাওয়ার পর লাইব্রেরিতে বিজ্ঞান বিষয়ক বই এর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। হোমিদের বাড়ির কাছেই ছিল টাটাদের পৈত্রিক বাড়ি ‘এসপ্লানেড হাউজ’। স্যার দোরাব টাটা তখন ওখানেই থাকতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন হোমির পিসি। সেই সুবাদে সেখানেই অনেক সময় কাটতো হোমির। হোমির পিসি নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে হোমিকে তাঁরা নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করতেন। এসপ্লানেড হাউজেও একটা বিশাল লাইব্রেরি ছিল। বই-পোকা হোমির প্রচুর সময় কাটতো সেখানে। কৈশোর পেরোবার আগেই আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি সম্পর্কে প্রকাশিত সব পেপার ও বই পড়া হয়ে যায় হোমির। ছবি আঁকা শেখা শুরু হয় শৈশবে। ১৭ বছর বয়সে হোমির আঁকা ছবি বোম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীতে পুরষ্কৃত হয়।

সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা শৈশব থেকেই ছিল। তা আরো পরিণত হয় হোমির মাসি কুমা পান্ডের প্রভাবে। তাঁর কাছে বেঠোফেন, মোৎসার্ট, বাখ, হাইডন, শুবার্ট প্রমুখের গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহ ছিল প্রচুর। হোমি ছোট ভাই জামশেদের সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সঙ্গীত শুনতেন। হোমির পিসি চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন। পিসির কাছে পিয়ানো শিখেছিলেন হোমি। কিন্তু পড়াশোনার পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্যসবকিছু গৌণ হয়ে পড়ে। তবুও ছোটবেলা থেকে সবসময় সবকিছুর ‘সবচেয়ে ভালো’টুকু পেতে পেতে ‘সবচেয়ে ভালো’র প্রতিই আকর্ষণ জন্মায় হোমির। তাই যখন যা করেছেন – সবচেয়ে ভালো ভাবে করার চেষ্টা করেছেন সারাজীবন।

১৯২৪ সালে সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করলেন হোমি। স্বাভাবিক ভাবেই এর পরের ধাপ হলো ইংল্যান্ডে গিয়ে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। কিন্তু হোমির বয়স তখন মাত্র ১৫। কেমব্রিজে ভর্তির সর্বনিম্ন বয়স ছিল ১৮। তাই হোমিকে অপেক্ষা করতে হলো আরো দু’বছর। এই দু’বছর সময়ও ভালোভাবে কাজে লাগানো হলো। ১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে তিনি এলফিনস্টোন কলেজে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করলেন। পরবর্তী বছর ১৯২৬-২৭ শিক্ষাবর্ষ কাটালেন রয়েল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে’র বিএসসি ক্লাসে। ১৯২৭ সালে ১৮ বছর পূর্ণ হলে হোমি ভাবা ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন – কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য।

হোমির বাবা জাহাঙ্গির ভাবা ও পিসেমশাই দোরাব টাটা’র পরিকল্পনা ছিল হোমি কেমব্রিজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে জামশেদপুরে টাটার নতুন ইস্পাত কারখানার দায়িত্ব নেবেন। হোমিরও আপত্তি ছিল না এতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কেমব্রিজের গনভিল এন্ড কেইয়াস কলেজে ভর্তি হন হোমি ভাবা। কেমব্রিজে পড়াশোনা করাটা টাটা বা ভাবা পরিবারের জন্য নতুন কিছু নয়। হোমির বাবা ও পিসেমশাই পাস করেছেন এখান থেকে। দোরাব টাটা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত অনুদান দেন।

হোমি ভাবা যখন কেমব্রিজে ভর্তি হলেন তখন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নতুন বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে লর্ড রাদারফোর্ডের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস ও পারমাণুর গঠন সম্পর্কে যুগান্তকারী সব আবিষ্কার হচ্ছে। অন্যদিকে হাইজেনবার্গ, শ্রোডিংগার, ডিরাক, বোর প্রমুখ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন। পদার্থবিজ্ঞানের এ এমন একটা উর্বর সময় – ডিরাকের মতে তখন “দ্বিতীয় শ্রেণীর পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষেও প্রথম শ্রেণীর আবিষ্কার করে ফেলা সম্ভব” ছিল [4]। হোমি ভাবা প্রথম বর্ষের পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাসেই টিউটর হিসেবে পেলেন পল ডিরাককে। গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সমন্বয় ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চেয়ে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়তে বেশিদিন সময় লাগলো না হোমির। মেকানিক্যাল সাবজেক্ট ছেড়ে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে মনস্থির করে চিঠি লিখলেন বাবাকে। ১৯২৮ সালের ৮ আগস্টে লেখা চিঠিতে হোমি ভাবা তাঁর বাবাকে লিখলেন, “একটা কথা আপনাকে সরাসরি বলছি যে ব্যবসা করা বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওসব আমার স্বভাব ও মেজাজের পরিপন্থি। পদার্থবিজ্ঞানই আমার লাইন। পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। আমি বিখ্যাত হতে চাই না, বড় কোন ফার্মের প্রধান হবার ইচ্ছেও আমার নেই। ওসব কাজের জন্য অনেক মানুষ আছেন যারা ওসব পছন্দ করেন। সুতরাং আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমাকে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার অনুমতি দিন” [4]।

কিন্তু অত সহজে অনুমতি পাওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা হোমির বাবা ভালো করেই জানেন। ছেলেকে পদার্থবিজ্ঞান পড়ার অনুমতি দিলেন এই শর্তে যে – হোমি যদি মেকানিক্যালে প্রথম শ্রেণী পায় তবে পরের দু’বছর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। হোমি পদার্থবিজ্ঞান পড়ার জন্যই মনযোগ দিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেন। ১৯৩০ সালে মেকানিক্যালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। তারপর প্রায় সাথে সাথেই গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে গেলেন। মেকানিক্যাল সাবজেক্টের রেজাল্টের ভিত্তিতে হোমি ভাবা ‘সলোমন্‌স স্টুডেন্টশিপ’ পান ১৯৩১-৩২ শিক্ষাবর্ষের জন্য। তারপর তিনি গণিতের রেজাল্টের ভিত্তিতে ‘রুজ বল ট্রাভেলিং স্টুডেন্টশিপ’ পান ১৯৩২-৩৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য। হোমি ভাবা ইউরোপের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে গবেষণা করলেন এই এক বছর। কোপেনহেগেনে গিয়ে কাজ করলেন নিল্‌স বোরের সাথে, জুরিখে গিয়ে কাজ করলেন উলফ্‌গং পাউলির সাথে এবং রোমে গিয়ে কাজ করলেন এনরিকো ফার্মির সাথে। ১৯৩২ সালে গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন হোমি।

১৯৩২ সালে জেম্‌স স্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করলেন। পজিট্রনও আবিষ্কৃত হলো একই বছর। ডিরাকের ইলেকট্রন থিওরির সাহায্যে নিউট্রন ও পজিট্রনের ধর্মাবলী ব্যাখ্যা করার একটা বিরাট ক্ষেত্র খুলে গেলো তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে। প্রায় একই সময়ে কসমিক রশ্মির পরীক্ষামূলক গবেষণার ব্যাপ্তিও বাড়তে শুরু করেছে। ভাবা তাঁর গাণিতিক দক্ষতা ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি অসীম ভালোবাসায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন গবেষণার জগতে। ১৯৩৩ সালে পাউলির তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হলো হোমি ভাবার প্রথম গবেষণাপত্র [5]। প্রথম গবেষণাপত্রেই হোমি ভাবা গামা রশ্মির বিকিরণে ইলেকট্রনের ভূমিকার অনুসন্ধানী ব্যাখ্যা দেন। এই গবেষণাপত্রের জন্য ১৯৩৪ সালে ‘আইজাক নিউটন স্কলারশিপ’ পান। ১৯৩৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি পান হোমি। তাঁর পিএইচডি’র সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ফাউলার।

কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে তখন। হাই এনার্জি ফিজিক্সের ছোট্ট একটা গ্রুপ তখন কাজ করছেন এ বিষয়ে। হোমি ভাবা এই গ্রুপের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী। তিনিই হলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি ইলেকট্রন-পজিট্রন স্ক্যাটারিং ক্রস-সেকশান হিসেব করেন ১৯৩৫ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত গবেষণা-পত্রে [6] – যে তত্ত্ব ‘ভাবা-স্ক্যাটারিং’ নামে পরিচিত [7]। পজিট্রন ও অন্যান্য অ্যান্টি-পার্টিক্যাল তৈরির ক্ষমতা সম্পন্ন যে কোন বড় এক্সিলারেটরের ক্যালিব্রেশান করার সময় ‘ভাবা স্ক্যাটারিং’ ব্যবহার করা হয়।

১৯৩৬ সালে হোপেনহেগেনে নিল্‌স বোরের গ্রুপে কাজ করার সময় প্রফেসর মেঘনাদ সাহার সাথে প্রথমবারের মত পরিচয় হয় হোমি ভাবার। প্রফেসর মেঘনাদ সাহা কার্নেগী ফেলোশিপ নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে এসে নিল্‌স বোরের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেন কিছুদিন। স্বাভাবিক ভাবেই হোমি ভাবার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা।

১৯৩৬ সালে হোমি ভাবা জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াল্টার হেইটলারের সাথে যৌথভাবে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। মহাবিশ্বের কোটি কোটি নক্ষত্র থেকে আগত অত্যন্ত শক্তিশালী এই রশ্মিগুলোর সাথে অসংখ্য চার্জিত কণা প্রতিনিয়ত আসছে আমাদের বায়ুমন্ডলে। ঊনিশ শতকে চার্লস উইলসন কসমিক রশ্মির অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করেন এবং রবার্ট মিলিক্যান এদের নাম রেখেছিলেন ‘কসমিক রে’। মহাকাশ থেকে আমাদের বায়ুমন্ডলের বাইরের স্তরে যেসব রশ্মি আসে তাদের প্রাথমিক কসমিক রশ্মি আর বায়ুমন্ডলের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার পর পাওয়া যায় ‘সেকেন্ডারি কসমিক রে’ বা মাধ্যমিক কসমিক রশ্মি। অতি উচ্চশক্তির ইলেকট্রন যখন কোন বস্তুর সাথে ধাক্কা খায় তখন ইলেকট্রন যে শক্তি হারায় তা বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায়। ক্লাউড চেম্বারের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তখন বস্তুর মধ্যে অসংখ্য কণার ঝর্ণা (পার্টিক্যাল শাওয়ার) তৈরি হয়। হ্যান্স বেথে ও ওয়াল্টার হেইটার এর কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেন নি। কিন্তু ভাবা ও হেইটার জুটি এ সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। কসমিক রশ্মির ইলেকট্রন-পজিট্রন ঝর্ণা সৃষ্টির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। ১৯৩৭ সালে ‘ভাবা-হেইটলার তত্ত্ব’ প্রকাশিত হয় রয়েল সোসাইটির জার্নালে [8]। এই গবেষণাপত্রে হেইটলার ও ভাবা কসমিক রশ্মির মিথষ্ক্রিয়ায় ইলেকট্রন ছাড়াও ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যবর্তী ভরের নতুন কোন কণার অস্তিত্বের উল্লেখ করেছিলেন – পরবর্তীতে যা ‘মেসন’ নামে পরিচিত হয়েছে।

১৯৩৫ সাল থেকে রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম থিওরি ব্যবহার করে ফোটন ও ইলেকট্রনের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যবর্তী ভরের কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিন্ত হয়ে জাপানে ইউকাওয়া, সাকাতা ও তাকেতানি এবং ব্রিটেনে ফ্রুলিখ, হেইটলার ও কেমার এ ব্যাপারে আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৩৮ সালে হোমি ভাবার ‘থিওরি অব হেভি ইলেকট্রন্‌স এন্ড নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ [9] প্রকাশিত হবার পর এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব পাওয়া গেলো পরবর্তীতে যা ‘ভেক্টর মেসন থিওরি’ নামে পরিচিত হয়েছে। হোমি ভাবাই প্রথম হিসেব করে দেখালেন যে মহাকাশ থেকে আসার সময় মেসনের আয়ুষ্কাল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বে বর্ণিত ‘টাইম ডাইলেটেশান’ দ্বারা প্রভাবিত হয় [10]। হোমি ভাবা উচ্চ-পর্যায়ের একটা পরীক্ষণের প্রস্তাবনা দেন – যার তত্ত্বীয় ভিত্তি হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব। প্রায় আলোর বেগে চলমান একটা ঘড়ির কাঁটা স্থির হয়ে থাকা একটা ঘড়ির কাঁটার চেয়ে অনেক আস্তে চলবে। এখন মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে আসার সময় মেসন কণা প্রায় আলোর বেগে ছুটে আসে। ফলে ছুটন্ত মেসনের বিকিরণ যে সময়ের মধ্যে ঘটবে – তার চেয়ে অনেক দ্রুত ঘটবে যখন মেসনের গতি কমে আসবে। তাই পৃথিবীতে এসে গতি কমতে কমতেই মেসন কণাগুলো শক্তি হারিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়। তাই গতিশীল মেসন কণার গতিপথ সনাক্ত করা গেলেও স্থির মেসন সনাক্তকরণ ভীষণ দুরুহ। পরবর্তীতে হোমি ভাবার তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

অব-পারমাণবিক (সাব-এটমিক) কণা ‘মেসন’ এর নামটাও হোমি ভাবার দেয়া। আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল এন্ডারসন (যিনি পজিট্রন আবিষ্কার করেছেন) যখন মহাজাগতিক বিকিরণে নতুন ধরণের কণার সন্ধান পান যাদের ভর ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে বেশি কিন্তু প্রোটনের ভরের চেয়ে কম, তখন এই নতুন কণাগুলোর নাম রেখেছিলেন ‘মেসোটন’। পরে রবার্ট মিলিক্যানের পরামর্শে মেসোটন পরিবর্তন করে ইলেকট্রন ও প্রোটনের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা হয় ‘মেসোট্রন’। বেশ কিছুদিন চলেছিল এই নাম। কিন্তু ১৯৩৯ সালে নেচার সাময়িকীতে হোমি ভাবার ‘ফান্ডামেন্টাল লেংথ ইন্ট্রোডিউসড বাই দি থিওরি অব দি মেসোট্রন (মেসন)’ [11] প্রকাশিত হবার পর সবার টনক নড়ে যায়। ওই গবেষণাপত্রে হোমি ভাবা যুক্তি দেখান- মেসোট্রন শব্দে মধ্যবর্তী বোঝানোর জন্য যে গ্রিক শব্দাংশ ‘মেসো’ ব্যবহার করা হয়েছে তা ঠিক আছে, কিন্তু তার সাথে ‘ট্র’ শব্দাংশটার কোন দরকার নেই। কারণ ‘প্রোটন’ ও ‘নিউট্রন’ শব্দে যে ‘ট্র’ আছে তার সাথে ‘মেসোট্রন’ এর ‘ট্র’র কোন মিল নেই। সুতরাং ‘মেসোট্রন’ এর বদলে ‘মেসন’-ই অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। সেই থেকে ‘মেসন’ নামটা চালু হয়েছে।

বয়স ত্রিশ হবার আগেই হোমি ভাবা নিজের যোগ্যতায় বিশ্ববিজ্ঞানীদের সভায় আসন করে নিয়েছেন। তখন কেমব্রিজে বিশ্বসেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই কাজ করছিলেন। রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী পিত্রর কাপিৎজা সেই সময় লর্ড রাদারফোর্ডের ছাত্র ছিলেন। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাপিৎজা’র রুমে বৈজ্ঞানিক সভা অনুষ্ঠিত হতো। অত্যন্ত উঁচুমানের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা ছাড়া ওই সভায় যোগ দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রথম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ‘কাপিৎজা ক্লাব’ নামে পরিচিত ছিল ঐ বিজ্ঞান-সভায়। ১৯৩৮ সালের শুরুতে কাপিৎজা ক্লাবে বক্তৃতা দেন হোমি ভাবা। কাপিৎজা ক্লাবে হোমি ভাবা যাঁদের সংস্পর্শে এসেছিলেন পরবর্তীতে তাঁদের প্রত্যেকেই পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, অনেকেই পেয়েছেন নোবেল পুরষ্কার।

১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কার করেছেন জেম্‌স স্যাডউইক এবং এজন্যে তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৫ সালে। তখন তিনি ছিলেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের রিডার পদের জন্য উপযুক্ত কাউকে খুঁজছিলেন স্যাডউইক। হোমি ভাবার গবেষণা কাজে মুগ্ধ স্যাডউইক হোমি ভাবার সাথে কথা বললেন। হোমি ভাবার সাথে আলোচনা শেষে জেম্‌স স্যাডউইকের মুগ্ধতা এতই বেড়ে গেলো যে তিনি হোমিকে লিভারপুল ইউনিভার্সিটিতে রিডারপদ নেয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারলেন না। স্যাডউইকের মতে “লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও রিডার হবার জন্য যে যোগ্যতা দরকার হোমি ভাবার যোগ্যতা তার চেয়ে অনেক বেশি” [4]।

১৯৩৯ সালে হোমি ভাবা ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানী প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের ল্যাবে গবেষণা করার জন্য রয়েল সোসাইটির একটা বড় গ্রান্ট পান। ব্ল্যাকেট তখন কসমিক রশ্মি ও ক্লাউড চেম্বার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। (১৯৪৮ সালে ব্ল্যাকেট পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান)। হোমি ভাবা ব্ল্যাকেটের ল্যাবে কাজ শুরু করার আগে কয়েকদিনের জন্য ভারতে নিজেদের বাড়িতে গেলেন ছুটি কাটাতে। কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইংল্যান্ড ও ভারতের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। হোমিকে ভারতেই থেকে যেতে হয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য।

কেমব্রিজে বেশ কিছু গবেষণা অসমাপ্ত রেখে এসেছিলেন হোমি। এখন ভারতে বসে তা শেষ করা যায় কি না দেখতে শুরু করলেন হোমি। নিজের শহরের বিশ্ববিদ্যালয় – বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে কসমিক রেডিয়েশানের ওপর তিনটি বক্তৃতা দিলেন হোমি ১৯৩৯ সালের শেষার্ধে। ব্যাঙ্গালোরে প্রফেসর সি ভি রামন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে (আই আই এস) বিভিন্ন গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেমব্রিজের আরেকজন তুখোড় ভারতীয় ছাত্র বিক্রম সারাভাইও তখন হোমি ভাবার মত ভারতে ছুটিতে এসে আটকে পড়েছেন। বিক্রম তখন কেমব্রিজের বিকল্প হিসেবে ব্যাঙ্গালোরে প্রফেসর রামনের অধীনে গবেষণা শুরু করেছেন কসমিক রশ্মির ওপর। হোমি ভাবাও কাজ শুরু করলেন আই-আই-এস এ। ‘স্পেশাল রিডার ইন কসমিক রে রিসার্চ ইউনিট’ পদ তৈরি করা হলো হোমি ভাবার জন্য। এজন্য ‘দোরাব টাটা ট্রাস্ট’ থেকে টাকা দেয়া হলো।

ব্যাঙ্গালোরে হোমি ভাবার কাজ করার পদ্ধতি ছিল কিছুটা ব্যতিক্রমী। থাকতেন শহরের সবচেয়ে দামী হোটেল “ওয়েস্ট এন্ড” এ। (যখন যে শহরেই তিনি যেতেন – সবচেয়ে অভিজাত হোটেলে থাকা, সবচেয়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টে খাওয়া, দামী গাড়িতে চড়া তাঁর জন্য খুবই স্বাভাবিক ছিল)। রাত জেগে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতেন। ঘুম থেকে উঠতেন দেরি করে। নিজের ঢাউস গাড়িতে চড়ে ইনস্টিটিউটে যেতেন দুপুরের পরে। সেখানে ছোট্ট অফিসঘরে বসে একটানা কাজ করতেন পাঁচ-ছয় ঘন্টা। কেমব্রিজের কাজের সুযোগ সুবিধা ও পরিবেশের সাথে ব্যাঙ্গালোরের কত তফাৎ। ল্যাবের অভাবে তত্ত্বীয় গবেষণাতেই পুরো সময়টা দিচ্ছেন হোমি। এসময় হোমির পরিচয় হয় গণিতবিদ মাধব রাওয়ের সাথে। ম্যাক্স বর্ন যখন রামনের আমন্ত্রণে আই-আই-এস এ কাজ করছিলেন তখন মাধব রাও কিছুদিন কাজ করেছিলেন বর্নের সাথে। ভারতে সর্বপ্রথম গ্রুপ থিওরি পড়ানো শুরু করেন মাধব রাও। এডিনবরায় হোমি ভাবা যখন ম্যাক্স বর্নের সাথে দেখা করেছিলেন তখন ম্যাক্স বর্ন বলেছিলেন মাধব রাওয়ের কথা। মাধব রাওয়ের গাণিতিক দক্ষতার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলেন হোমি। ১৯৪০ সালে মাধব রাওয়ের সাথে যৌথভাবে গবেষণাপত্র লিখলেন হোমি ভাবা। ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স থেকে প্রকাশিত হলো এ গবেষণাপত্র – ‘স্ক্যাটারিং অব চার্জড মেসন” [12]।

ইতোমধ্যে হোমি ভাবাকে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ দেওয়ার জন্য সুপারিশপত্র পাঠালেন প্রফেসর রামন। দ্বিতীয় প্রস্তাবকারী হিসেবে দস্তখত করলেন পল ডিরাক। মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেলেন হোমি ভাবা। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি’র ‘অ্যাডাম’স প্রাইজ’-এর জন্য হোমি ভাবা মনোনয়ন পেয়েছেন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অনুরোধে হোমি ভাবা মৌলিক কণার ওপর একটা অধ্যায় লিখলেন ‘দি থিওরি অব এলিমেন্টারি পার্টিক্যাল্‌স এন্ড দেয়ার ইন্টারেকশান’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে স্থান পেলো হোমি ভাবার প্রবন্ধ। ১৯৪২ সালে ‘অ্যাডাম’স প্রাইজ’ পান হোমি ভাবা। একই বছর আই-আই-এস এর ফুল রিসার্চ প্রফেসর পদে পদোন্নতি পান তিনি। আই-আই-এস এর কসমিক রে গ্রুপের সুনাম দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মেধাবী বিজ্ঞানীরা ভাবার গ্রুপে কাজ করতে আসতে শুরু করেন। কলকাতা থেকে এলেন এস কে চক্রবর্তী, ডি বসু। তারপর এলেন হরিশ চন্দ্র। হোমি ভাবা এই মেধাবী ভারতীয় তরুণদের কর্মক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কত সামান্য সুযোগ সুবিধা ও অনুপ্রেরণায় কত উন্নতমানের কাজ যে ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করা যায় তা হোমি ভাবা কেমব্রিজে থাকতে কখনো ভাবতেও পারেন নি।

১৯৪২ সালে হোমির বাবা জাহাঙ্গির ভাবা মারা যান। মাস দুয়েক লেগে যায় হোমির পিতৃশোক কাটিয়ে উঠতে। আবার পুরোদমে কাজ শুরু করেন প্রফেসর ভাবা। ভাবার গবেষণার গতি ও মান ভারতের বিজ্ঞান জগতে নতুন আশা ও উৎসাহের সঞ্চার করলো। মাদ্রাজ, এলাহাবাদ, লখনৌ সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য অনুরোধ আসতে লাগলো ভাবার কাছে। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ৩০তম অধিবেশনে ফিজিক্স সেকশানের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন হোমি ভাবা। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পূর্ণ অধ্যাপক পদে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স থেকেও অফার আসে ফুল প্রফেসর পদে যোগ দেয়ার জন্য। বোম্বের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব এডুকেশান হোমি ভাবাকে অনুরোধ করেন রয়েল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের দায়িত্ব নিতে। হোমি ভাবা সবগুলো প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর যুক্তি হলো তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-দের মধ্যে দলাদলি বা সংকীর্ণ রাজনীতি কিংবা জুনিয়র-সিনিয়র ইত্যাদি প্রসঙ্গে অহেতুক ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব পছন্দ করেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত অধ্যাপকদের পক্ষে এসব এড়িয়ে চুপচাপ গবেষণা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি চান কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজের ইচ্ছেমতো গবেষণা করতে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হোমি ভাবার সব শর্ত মেনে নিয়েই ভাবাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাবা রাজি হননি। কারণ তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত কর্মপদ্ধতির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর নিজেরই একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার যার কর্মপদ্ধতি হবে তাঁর নিজের মনের মত।

ছোটবেলা থেকে ইউরোপীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠা এবং আঠারো বছর বয়স থেকে ইংল্যান্ডে থাকা ও পড়াশোনার সুবাদে হোমি ভাবা ইংরেজদের চেয়েও নিখুঁত ইংরেজ, ইউরোপিয়ানদের চেয়েও বেশি ইউরোপিয়ান ছিলেন – অন্তঃত ১৯৪০ সাল পর্যন্ত [13]। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সংগীত, স্থাপত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি সম্পর্কে ভাবার জ্ঞান ছিলো গভীর। কিন্তু সে তুলনায় ভারতীয় সবকিছুই প্রায় অচেনা ছিল ভাবার কাছে। কেমব্রিজে থাকতে কখনোই ভাবেন নি যে ভারতে এসে থাকবেন বা কাজ করবেন কোন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে। জামশেদ নগরের টাটা ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব নেয়ার কথা থাকলেও কোন উৎসাহ দেখাননি হোমি ভাবা। কিন্তু কয়েক বছর ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করে ভারতবর্ষের প্রতি ক্রমশ ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করলো হোমি ভাবার মনে। ব্যাঙ্গালোরে বিক্রম সারাভাই এর স্ত্রী মৃণালিনী সারাভাই এর নেতৃত্বে একটা সাংস্কৃতিক দলের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জন্মে হোমি ভাবার। ভারতের সব প্রদেশে ঘুরে ঘুরে ভারতীয় স্থাপত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের সাথে পরিচিত হলেন ভাবা। সর্বোপরি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের কাছ থেকে দেখে নিজের দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মালো ভাবার। বিশুদ্ধতা ভাবার সবচেয়ে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি যা-ই করেন তাতেই সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা নিশ্চিন্ত করেন। তাঁর দেশপ্রেমও বিশুদ্ধ। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর সাথে পারিবারিকভাবেই ঘনিষ্ঠতা ছিলো ভাবার। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ভাবাদের এবং টাটাদের বাড়িতে নিয়মিত ভাবে আসা-যাওয়া করছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপারে আলোচনা করছেন। ভারতের স্বাধীনতার যে আর দেরি নেই তা বুঝতে পারলেন ভাবা। বিজ্ঞানী ভাবা এটাও বুঝতে পারলেন যে স্বাধীন ভারতকে উন্নত দেশের সমতুল্য করে গড়ে তুলতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত হতে হবে। বাইরে থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ধার করে নিয়ে এলে চলবে না – নিজের দেশেই গড়ে তুলতে হবে বিজ্ঞানী গড়ার প্রতিষ্ঠান।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পাবার পরও সেখানে ফিরে যাবার আর কোন আগ্রহ দেখান নি ভাবা। কারণ ততদিনে তাঁর নিজের হাতে গড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু হয়ে গেছে। ১৯৪৩ সাল থেকেই নিজের দেশে বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিলেন। ১৯৪৩ সালের ১৯ আগস্ট জাহাঙ্গির টাটাকে লেখা একটা চিঠিতে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। জাহাঙ্গির টাটা হোমির চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড়। একই সাথে বেড়ে উঠেছেন তারা ধরতে গেলে একই পরিবারে। হোমি ভাবার ইচ্ছের গুরুত্ব বুঝলেন জাহাঙ্গির টাটা। তিনি জানালেন – যদি হোমি ভাবা বা তাঁর কোন সহকর্মী গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বাস্তব পরিকল্পনা নিয়ে স্যার দোরাব টাটা ট্রাস্টের কাছে পাঠান তাহলে প্রস্তাবটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে। পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে রিসার্চ সেন্টার গড়ে তোলার বিস্তারিত প্রকল্প পরিকল্পনা তৈরি করা হলো। ১৯৪৪ সালের ১২ মার্চ স্যার দোরাব টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার সোরাব সাকালাতভালার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠালেন। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল দোরাব টাটা ট্রাস্টের ট্রাস্টিরা আলোচনায় বসলেন রিসার্চ সেন্টার গড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এত বড় মাপের একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারি সাহায্যও দরকার। সিদ্ধান্ত হলো অর্ধেকেরও বেশি অর্থ জোগান দেয়া হবে টাটা ট্রাস্ট থেকে, বাকিটা আসবে স্থানীয় বোম্বে প্রদেশের প্রাদেশিক সরকার। প্রাথমিক প্রশাসনিক সহযোগিতা দেবে বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়।
এক মাসের মধ্যেই হোমি ভাবার প্রস্তাবের বেশির ভাগই গৃহীত হলো দোরাব টাটা ট্রাস্টে।

ইনস্টিটিউট গড়ার হাজারো কাজের মধ্যেও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ভাবা। কিন্তু শুধুমাত্র গাণিতিক নিয়ম প্রয়োগ করে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেই কোন কিছু প্রমাণিত হয়ে যায় না। এর জন্য চাই পরীক্ষামূলক প্রমাণ। কেমব্রিজে থাকতে পরীক্ষাগারের যে সুযোগ সুবিধে ছিল এখানে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। কিন্তু যন্ত্রপাতি না থাকলেও দমে যাবার পাত্র নন ভাবা। তিনি যে কেমব্রিজ থেকে পাস করা প্রথম শ্রেণির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার – তা এতদিনে কাজে লেগে গেলো। নিজেই বানিয়ে নিলেন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। ইলেকট্রনিক্সে তাঁর দক্ষতা ঈর্ষনীয়। বায়ুমন্ডলে প্রবেশের আগে এবং প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কসমিক রশ্মির মেসন কণা শনাক্ত করার জন্য গেইগার-মুলার কাউন্টার টেলিস্কোপ নির্মাণ করলেন। কিন্তু টেলিস্কোপগুলোকে তিরিশ হাজার ফুট উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে তাদের ভেতর কসমিক রশ্মি প্রবেশ করাবেন কীভাবে। ১৯৪০ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিক্যান এ কাজে রাবারের বিশাল বেলুন ব্যবহার করেছিলেন। ভাবার বেলুন নেই বটে- কিন্তু বিকল্প হিসেবে তিনি যা ব্যবহার করলেন তা অভূতপূর্ব। বিশ্বযুদ্ধের কারণে আমেরিকান এয়ারফোর্সের ৮৪তম এয়ার ডিপো তখন ব্যাঙ্গালোরে ঘাঁটি গেঁড়েছে। হোমি ভাবা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমেরিকান এয়ারফোর্সের বিমান ব্যবহার করে ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় তাঁর টেলিস্কোপ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন। ১৯৪৪ সালের ২৬ ও ২৮ ডিসেম্বর দুটো ফ্লাইটে করে পাঁচ হাজার থেকে তিরিশ হাজার ফুট উচ্চতায় বিভিন্ন স্থানে টেলিস্কোপ স্থাপন করে কসমিক রশ্মির বিকিরণ ধারণ করা হয়। পরীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয় এর পরের বছর দুটো গবেষণাপত্রে।

১৯৪৫ সালের ১লা জুন বোম্বে শহরে টাটাদের পুরনো বাড়িতে কার্যক্রম শুরু হলো “টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ” (টি-আই-এফ-আর) এর। হোমি ভাবা হলেন ইনস্টিটিউটের প্রথম পরিচালক। টি-আই-এফ-আর কে বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য হোমি ভাবা দিনরাত পরিশ্রমের পাশাপাশি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়ও কাজে লাগিয়েছেন। যাকে যে পদের জন্য যোগ্য মনে করেছেন তাঁকে সে-ই পদে নিয়োগ দিয়েছেন। সারাদেশের সব ভালো ভালো বিজ্ঞানীকে নিজের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন যাঁরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে করতে একটা ভালো অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন তাঁদেরকে সেখান থেকে নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এলে নতুন প্রতিষ্ঠানের লাভ যতটা হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের – যেখান থেকে তাঁকে আনা হয়েছে। নতুন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে আসতে পারলেই সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে তরুণদের প্রশিক্ষণ সহ যথোপযুক্ত সুযোগ সুবিধে নিশ্চিন্ত করতে হবে। ভাবা সেরকম ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিলেন।

যে কোন দেশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হলে মৌলিক বিজ্ঞান – পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। তাই শুরু থেকেই পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের গবেষণা বিভাগ খোলা হলো। পরে আস্তে আস্তে যোগ হলো পারমাণবিক শক্তি, বেতার ও মহাকাশ বিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স, বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞান, আণবিক জীববিজ্ঞান সহ আরো অনেক বিভাগ।

ভারতবর্ষের অসংখ্য মেধাবী তরুণ বিজ্ঞানী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তাঁদের যদি দেশের প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায় – তাহলে দেশের মেধা-সম্পদ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। কেমব্রিজে ভাবার খুব কাছের বন্ধু ছিলেন সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর। টি-আই-এফ-আর এ যোগ দেয়ার জন্য তাঁকে আহ্বান করলেন হোমি ভাবা। চন্দ্রশেখর তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুল প্রফেসর। এর আগে ১৯৩৭ সালে চন্দ্রশেখরকে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর কাকা সি ভি রামন। কিন্তু চন্দ্রশেখর রামনকে সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার হোমি ভাবার মুখের ওপর সরাসরি ‘না’ বলতে পারলেন না চন্দ্রশেখর। ঠিক হলো তিনি বছর খানেকের জন্য টি-আই-এফ-আর এ আসবেন। যদি দেখেন কাজ এগোচ্ছে তাহলে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। ১৯৪৬ সালে চন্দ্রশেখরকে পূর্ণ-অধ্যাপকের স্থায়ী পদের জন্য নিয়োগপত্র পাঠানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে চন্দ্রশেখর যোগ দেন নি টি-আই-এফ-আর এ। ১৯৪৬ সালে ছয় মাসের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ভারতীয় তরুণ বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলেন ভাবা। চন্দ্রশেখর না এলেও অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ফিরে এসেছিলেন ভারতবর্ষে, উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন উপমহাদেশের বিজ্ঞান গবেষণায়।

১৯৪৬ সালে হাই-এনার্জি এক্সেলারেটর কেনা হলো। দশজন বিজ্ঞানীকে নিয়োগ দেয়া হলো উচ্চ-শক্তির গবেষণা প্রকল্পে। ভারতের স্বাধীনতা যত এগিয়ে আসছিলো – ততই বেগবান হচ্ছিলো গবেষণার কাজ। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম স্থানান্তরিত হলো ‘রয়েল বোম্বে ইয়ট ক্লাব’-এর পুরনো ভবনে। ভাবার আহ্বানে পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের অনেকেই টি-আই-এফ-আর এ এসে গবেষণা-সহযোগিতা করেছেন। প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট, পল ডিরাক, নিল্‌স বোর, মারি গেল-ম্যান, ফেলিক্স ব্লখ, জন ককক্রফ্‌ট, জন বার্নাল, সিসিল পাওয়েল প্রমুখ নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে এসেছেন হোমি ভাবার আমন্ত্রণে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ম্যানহাটান প্রজেক্টের পারমাণবিক শক্তির সাফল্য দেখে হোমি ভাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে স্বাধীন ভারতের জন্য পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে সরাসরি কথা বলার অবাধ সুযোগ ছিল হোমি ভাবার। নেহেরু ভাবাকে ছোটভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। ভাবা প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে চিঠি লিখতেন ‘ভাই’ সম্বোধন করে। ভাবা নেহেরুকে বোঝাতে সক্ষম হলেন স্বাধীন ভারতে পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা। ১৯৪৫ সাল থেকেই টি-এফ-আই-আর এ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণা শুরু হয়েছে। স্বাধীনতার পর একটুও সময় নষ্ট না করে আন্তর্জাতিক আইন মেনে পারমাণবিক শক্তি কমিশন গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল হলেন হোমি ভাবা।

১৯৪৮ সালে ‘ইন্ডিয়ান এটমিক এনার্জি অ্যাক্ট’ পাস হলো। এই আইনের ফলে ভারতে পারমাণবিক গবেষণার পথ খুলে গেলো। মিনিস্ট্রি অব ন্যাচারাল রিসোর্স-এর অধীনে ‘এটমিক এনার্জি কমিশন’ গঠিত হলো। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার স্বরূপ জানতেন হোমি ভাবা। তিনি দ্রুত কাজ করতে অভ্যস্ত। এখন নিয়ম মেনে যদি আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার ভেতর দিয়ে আসতে হয় তাহলে ছোটখাট সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময় নষ্ট হবে। হোমি ভাবা তাই কমিশনের নিয়মই এমনভাবে তৈরি করলেন যেন সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি না হয়। এটমিক এনার্জি কমিশন গঠিত হলো মাত্র তিন জনের সমন্বয়ে। হোমি ভাবা হলেন কমিশনের চেয়ারম্যান, অন্য দু’জন সদস্য হলেন শান্তিস্বরূপ ভাটনগর ও কে এস কৃষ্ণান। এই কমিশন এতটাই স্বাধীন ছিল যে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা ছিল না এই কমিশনের।

পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করলো এটমিক এনার্জি কমিশন। টি-আই-এফ-আর এর গবেষণাগারে চলছে পারমাণবিক শক্তির গবেষণার কাজ। কমিশন তিনটি ধাপে কাজ শুরু করলো। প্রথমতঃ ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মত তেজষ্ক্রিয় পদার্থের সন্ধানে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ শুরু হলো। দ্বিতীয়ত শুরু হলো পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানে উন্নতমানের গবেষকদল সৃষ্টির লক্ষ্যে উন্নতমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ। তৃতীয় পর্যায়ে শুরু হলো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান অনুষঙ্গ ইলেকট্রনিক্স। সেখানে দেশীয় দক্ষতা থাকা দরকার। হায়দারাবাদের বিশাল ‘ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশান অব ইন্ডিয়া লিমিটেড’এর শুরুটা টি-আই-এফ-আর এর ইলেকট্রনিক্স ইউনিটেই শুরু হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজ্ঞানী হোমি ভাবার পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৪৮ সালে কেমব্রিজ ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির হফকিন্স প্রাইজ দেওয়া হয় হোমি ভাবাকে। ১৯৫১ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশানের সভাপতি মনোনীত হন ভাবা। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার পদ্মভূষণ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন হোমি ভাবাকে।

১৯৫৪ সাল নাগাদ এটমিক এনার্জি কমিশনের কার্যক্রম এত বেড়ে গেলো যে টি-আই-এফ-আর এর ভবনে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। ভাবা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘এটমিক এনার্জি এস্টাব্লিস্টমেন্ট’ গড়ে তোলার। বোম্বের কাছে ট্রোম্বেতে ১২০০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠলো ভারতের প্রথম এটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্ট। আর এর প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য গঠন করা হলো সরকারের “ডিপার্টমেন্ট অব এটমিক এনার্জি’। এর সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন হোমি ভাবা। আমলাতন্ত্রকে এড়িয়ে চলা হোমি ভাবা হয়ে গেলেন বড় আমলা – পারমাণবিক শক্তি বিভাগের সচিব। হোমি ভাবা দিল্লিতে গেলে এটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্টের কাজের ক্ষতি হবে চিন্তা করে পারমাণবিক শক্তি বিভাগের সচিবালয় স্থাপন করা হলো বোম্বেতে।

টি-আই-এফ-আর এর নতুন ভবন তৈরির পরিকল্পনা চলছিলো অনেক দিন ধরে। ১৯৫৪ সালে আরব সাগরের তীরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। হোমি ভাবা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের স্থাপত্য রীতির সমন্বয়ে অনন্য এক ভবন তৈরি করলেন যা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনাগুলোর একটি [2]। নতুন ভবনের আসবাবপত্র, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, এমন কি বাইরের বাগানের গাছপালাগুলোও ভাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী লাগানো। ১৯৬২ সালে এই ভবন উদ্বোধন করেন নেহেরু।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন দি পিসফুল ইউজ অব এটমিক এনার্জি’। এই কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোমি ভাবা। একই বছর গঠিত হলো জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি’। এজেন্সির প্রধান কার্যালয় ভিয়েনায় স্থাপন করার পেছনে হোমি ভাবা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেকেই মনে করেন ভিয়েনাকে পছন্দ করার প্রধান কারণ হলো সংগীত। ভাবা যতবারই ইউরোপে গেছেন ভিয়েনায় গিয়ে অপেরা উপভোগ করেছেন। আই-এ-ই-এ’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন হোমি ভাবা। ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জেনেভা সম্মেলন ও ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জেনেভা সম্মেলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন হোমি ভাবা।

১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব পিওর এন্ড এপ্লাইড ফিজিক্স’ এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ভাবা। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের বিদেশি সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একই বছর নিউ ইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্স তাঁকে সম্মানজনক আজীবন সদস্যপদ দেন। ১৯৬৪ সালে মাদ্রিদের রয়েল একাডেমি অব সায়েন্স হোমি ভাবাকে সম্মানজনক সদস্যপদ দেন।

হোমি ভাবার নেতৃত্বে ১৯৫৫ সালে ট্রোম্বেতে স্থাপিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে এশিয়ার প্রথম পারমাণবিক রিএক্টর – অপ্সরা। ১৯৫৬ সালে কানাডিয়ান এটমিক পাওয়ার প্রোগ্রামের সহযোগিতায় শুরু হলো দ্বিতীয় রিএক্টরের কাজ। হাজার খানেক ইঞ্জিনিয়ার – যার মধ্যে মাত্র ত্রিশ জন ছিলেন কানাডিয়ান – চার বছর ধরে কাজ করে ১৯৬০ সালে রিএক্টর তৈরি সম্পন্ন করে। এর নাম রাখা হয় সাইরাস (CIRUS – Canada-India Reactor Utility Service)। অপ্সরা আর সাইরাস নির্মিত হয়েছে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডার সহযোগিতায়। এবার ভাবা চাইলেন শতভাগ ভারতীয় রিএক্টর তৈরি করতে। ১৯৬১ সালের জানুয়ারির মধ্যেই সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদ ব্যবহার করে তৈরি হলো জারলিনা (ZERLINA – Zero-energy research reactor for lattice investigation)।

এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ডিপার্টমেন্ট অব এটমিক এনার্জির সচিব হিসেবে হোমি ভাবা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথেই আলোচনা করতেন ভারতের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পর্কে। বেশির ভাগ আলোচনারই কোন রেকর্ড থাকতো না। কমিশনের অন্য দু’জন সদস্যের একজন শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের মৃত্যু হয়েছে ১৯৫৫ সালে। তাঁর জায়গায় অন্য কোন সদস্য নেন নি ভাবা। ১৯৬১ সালে কমিশনের অন্য সদস্য কে এস কৃষ্ণানেরও মৃত্যু হয়। তখন ভাবা অনেকটা একা হাতেই সবকিছু সামলেছেন। নেহেরুর পরামর্শ ও অনুমোদনে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে কোন অসুবিধে হচ্ছিলো না ভাবার। কিন্তু ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর বড় ধরণের ধাক্কা খেলেন ভাবা। জওহরলাল নেহেরুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর সাথেও কিছুটা বোঝাপড়া হয় ভাবার। সেই বছরই চীন তাদের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাঁর কেবিনেট মন্ত্রীদের পরামর্শে হোমি ভাবার কাজ যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলতে দিলেন। ১৯৬৫ সালে প্লুটোনিয়াম প্ল্যান্টের কাজ শুরু হয়। কিন্তু হোমি ভাবার জন্য আরো একটা ধাক্কা অপেক্ষা করছিলো। ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শপথ নিলেন ২৩ জানুয়ারি। পরের দিন ২৪ জানুয়ারি আই-এ-ই-এ’র সভায় যোগদানের জন্য ভিয়েনায় রওয়ানা হয়েছিলেন হোমি ভাবা। কিন্তু ভিয়েনায় পৌঁছার আগেই মন্ট ব্ল্যাংক এর চূড়ায় আছড়ে পড়ে হোমি ভাবার বিমান। হোমি ভাবা মারা যান।

হোমি ভাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয় ভারতের পারমাণবিক শক্তির গবেষণা ও প্রশাসনে। নতুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পারছিলেন না পারমাণবিক প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিলো হোমি ভাবার পদে কাকে বসাবেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের কাছে এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হলো। কিন্তু তিনি এবারো রাজি হলেন না। হোমি ভাবা যে সব কাজ এতদিন একা সামলেছেন – তা করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী তিন জন বিজ্ঞানীকে নিয়োগ দিলেন। এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ও ডিপার্টমেন্ট অব এটমিক এনার্জির সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দিলেন পদার্থবিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইকে। এটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্টের দায়িত্ব দিলেন ইঞ্জিনিয়ার হোমি সেঠনার হাতে। টাটা ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদের দায়িত্ব দেয়া হলো পদার্থবিজ্ঞানী এম জি কে মেননের হাতে।

হোমি ভাবার সম্মানে ১৯৬৭ সালের ১২ জানুয়ারি এটমিক এনার্জি এস্টাব্লিশমেন্ট এর নতুন নামকরণ হয় ‘ভাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টার’। টি-আই-এফ-আর এর অডিটরিয়ামের নাম রাখা হয় ‘ভাবা অডিটরিয়াম’। দক্ষিণ মুম্বাইএর নেভি নগর থেকে যে রাস্তাটা টি-আই-এফ-আর এর দিকে চলে গেছে তার নাম রাখা হয়েছে ‘হোমি ভাবা রোড’। মুম্বাই এর বিখ্যাত জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারির লাইব্রেরির নাম রাখা হয়েছে ‘হোমি ভাবা আর্টস রেফারেন্স লাইব্রেরি’। হোমি ভাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে হোমি ভাবা ফেলোশিপ কাউন্সিল গঠন করা হয়।

অন্যরকম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন হোমি ভাবা। নিখুঁত আভিজাত্য ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডে। চমৎকার ছবি আঁকতেন। লন্ডনের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তাঁর চিত্রকর্ম। কেমব্রিজে থাকতে কলেজ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অপেরা শো’র জন্য মঞ্চসজ্জা করেছেন দক্ষতার সাথে। বিজ্ঞানের সাথে শিল্পের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডে। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলোর ভাষা এতটাই নিখুঁত যে তাদেরকে মোৎসার্টের সঙ্গীতের সাথে তুলনা করা হয় [13]। ভীষণ বিশুদ্ধবাদী ছিলেন হোমি ভাবা। আর সে কারণেই সবার সাথে সহজভাবে মিশতে পারতেন না তিনি। কাজের ব্যাপারে সবসময় গণতান্ত্রিক ছিলেন – এমন বলা যাবে না তাঁর সম্পর্কে। তাঁর এটমিক এনার্জি কমিশনের কাজকর্ম সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। তাঁর কাজের পদ্ধতির সমালোচকদের মধ্যে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহাও ছিলেন। কিন্তু তাঁর কাজের মান যে সর্বোচ্চ সে ব্যাপারে সবাই একমত। হোমি ভাবা বিয়ে করেন নি। প্রাত্যাহিক জীবনের বন্ধনে হয়তো নিজেকে জড়াতে চান নি। নিজের জিনের সরাসরি উত্তরাধিকারি না থাকলেও ভারতের বৈজ্ঞানিক উত্তরণের অনেকখানিই হোমি ভাবার উত্তরাধিকার।

তথ্যসূত্রঃ
1. Robert S. Anderson, Building scientific institutions in India: Saha and Bhabha. 1975, Montreal: McGill University.
2. Lord Penney, Homi Jehangir Bhabha. Biographical Memories of Fellows of the Royal Society, 1967. 13(November): p. 35-55.
3. শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ

4. Chintamoni Deshmukh, Homi Jehangir Bhabha. 2006.
5. Homi J Bhabha, Zur Absoption der Hohenstrahlung. Z. Phys., 1933. 86: p. 120.
6. Homi J Bhabha, Electron-positron scattering. Proc. Roy. Soc. A, 1935. 154: p. 195.
7. Pranab Bandyopadhyay, Great Indian Scientists. 1993, Delhi: Book Club.
8. Homi J Bhabha and W. Heitler, Passage of fast electrons and the theory of cosmic showers. Proc. Roy. Soc. A, 1937. 159: p. 432.
9. Homi J Bhabha, Theory of heavy electrons and nuclear forces. Proc. Roy. Soc. A, 1938. 166: p. 501.
10. Homi J Bhabha, Nuclear forces, heavy electrons and the beta decay. Nature, 1938. 141: p. 117.
11. Homi J Bhabha, Fundamental length introduced by the theory of the mesotron (meson). Nature, 1939. 143: p. 276.
12. Homi J Bhabha and B. S. M. Rao, Scattering of charged mesons. Proc. Indian Acad. Sci., 1941. 13A.
13. George Greenstein, Portraits of Discovery Profiles in Scientific Genius. 1998, New York: John Wiley & Sons, Inc.,.