আগেই স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি কোন পদার্থবিদ নই, মূলতঃ শখের বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে আমার আগ্রহ অনেকদিনের। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ সহ কিছু ছাইপাঁশ বইপত্র লেখার কারণেই হোক, আর ব্লগে বিজ্ঞান আর দর্শনের অন্তিম রহস্য নিয়ে লেখালিখি করার অপচেষ্টার কারণেই হোক, সম্প্রতি সার্নের একটি পরীক্ষায় আলোর চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল কণার ভ্রমণ সংক্রান্ত খবরটি মিডিয়ায় আলোড়ন তোলার পর আমাকে অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে। বন্যার সার্জারি সহ ব্যক্তিগত কিছু ঝুট ঝামেলার কারণে তখন এ নিয়ে লেখার সময় পাইনি। এর বাইরে আরও একটি বড় ব্যাপারও ছিল আমার নীরবতার কারণ। যেখানে পৃথিবীর ঝানু ঝানু পদার্থবিজ্ঞানীরাই এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, সেখানে আমার মত একজন শখের বিজ্ঞান লেখকের অভিমত কতটা উপযোগিতা দিবে, সেটাও ছিল একটি প্রশ্ন। তারপরেও এখন মনে হচ্ছে এ নিয়ে লেখাটা জরুরী, অন্ততঃ এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের অভিমতগুলো বাঙালি পাঠকেরা যদি জানতে পারেন, তাতেই বা মন্দ কী। এ ভাবনা থেকেই লেখাটির সূচনা। তবে এ নিয়ে আমার আগের সাবধান বাণী থাকছেই। ব্লগে অনেক হাতে কলমে কাজ করা পদার্থবিদ আছেন যারা এ বিষয়ে আমার চেয়ে ভাল ধারনা রাখেন। আমার তথ্যে কিংবা উপস্থাপনায় কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে তারা সংশোধন করে দেবেন বলে আশা করছি। আমার লেখাটি কেবল আলোচনার সূচনা, আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের যোগান মন্তব্য থেকে আশা করছি।

:line:

বিজ্ঞানে কোন কিছুই স্থির নয়। সেজন্যই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে -এটিতে ভুল প্রমাণের সুযোগ থাকতে হবে, যেটাকে আমরা বলি ‘বাতিল-যোগ্যতা’ বা ফলসিফায়াবিলিটি। সোজা কথায়, ‘scientific theories must be falsifiable’, না হলে সেটি তত্ত্ব হয়ে উঠে না[1]। নতুন নতুন পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের সাপেক্ষে বিজ্ঞানের পুরনো তত্ত্ব বাতিল কিংবা বদলে ফেলার দৃষ্টান্ত বিজ্ঞানে আছে বহু। পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণের সাথে মেলেনি বলেই টলেমির ভূ-কেন্দ্রিক তত্ত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিলো, কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণের ধাক্কায়। অতীতে ভূকেন্দ্রিক তত্ত্ব,ফ্লোগিস্টন তত্ত্ব, ইথার তত্ত্ব, ল্যামার্কের তত্ত্ব, প্যাঞ্জিয়াম তত্ত্ব, আলো চলাচলের জন্য নিউটনের কর্পাস্কুলার তত্ত্ব সবই একসময় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা পেরেছি পুরাতনকে বর্জন করে নতুন ‘আলোকেরই ঝর্ণাধারায়’ নিজেদের সিক্ত করতে। সেজন্যই কিন্তু বিজ্ঞান ‘ডায়নামিক’, ধর্ম কিংবা ডগমার মত স্থবির কিছু নয়। বিজ্ঞানে কোন কিছুই পাথরে খোদাই করে লেখা হয়নি, লেখা হয় না। বিজ্ঞানে ‘হিরো’ আছে, কিন্তু নেই কোন প্রফেট বা পয়গম্বর। আর এই হিরোদের অবদান নিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হয় বিজ্ঞানের জগতে – তা তিনি নিউটনই হোন, ডারউইনই হোন কিংবা হোননা তিনি জগদ্বিখ্যাত প্রতিভা আলবার্ট আইনস্টাইন।

কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞানের কিছু কিছু তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ দিয়ে এতোটাই সমর্থিত হয়ে উঠে যে, সেই তত্ত্বের উপর আস্থা প্রকাশ করে যান বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নির্ভয়ে। এমনি একটি আস্থা ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এর থেকে পাওয়া অনুসিদ্ধান্তগুলোকে ঘিরে। ১৯০৫ সালের পর থেকে একটি ব্যাপারে পদার্থবিদরা নিশ্চিত ছিলেন -আলোর গতি এক সেকেণ্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল (বা ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার), আর আলোর চেয়ে বেশি বেগে কোন পদার্থের পক্ষে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। আলোর চেয়ে বেশি বেগে কারো পক্ষে ভ্রমণ করা সম্ভব না – এটি বিজ্ঞানীদের কাছে আস্থার প্রতীক, হয়ে উঠেছিলো অনেকটা আগামীকাল পূর্বদিকে সূর্য ওঠার মতোই ধ্রুব সত্য। অবশ্য এই ধরনের আস্থার কারণও সহজেই বোধগম্য। আমাদের আধুনিক টেকনোলজি – জিপিএস, ট্রাঞ্জিস্টর, কম্পিউটার, ইন্টারনেট সহ যে অবদানগুলোর প্রতি নির্ভয়ে অহর্নিশি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি – সেগুলো আইনস্টাইনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত। তার চেয়েও বড় কথা সার্নের এই ফলাফলের আগে কোন পরীক্ষালব্ধ ফলাফলই আইনস্টাইনের তত্ত্বকে কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। আইনস্টাইন তার তত্ত্ব দেবার পর আক্ষরিক অর্থেই অন্ততঃ হাজার খানেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে তার তত্ত্বকে ঘিরে। প্রতিবারই এটি অতি সফলভাবে বাধা বিপত্তি আর সংশয়ের দেওয়ালকে অতিক্রম করতে পেরেছে[2]।

আমাদের গাড়ির কিংবা আইফোনের জিপিএস সিস্টেমের কথাই ধরা যাক। এই জিপিএস সিস্টেমের বদৌলতে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান এমনকি কয়েক ফুটের পরিসীমায়ও আমরা এখন সূক্ষ্মভাবে বলে দিতে সক্ষম। অথচ জিপিএস ঠিকমতো কাজই করতো না যদি না আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া ‘সংশোধনীগুলো’ গোনায় না নেওয়া হত। আমাদের মতো আমজনতার কথা না হয় বাদ দেই, আমেরিকার পেন্টাগনের জেনারেলদেরও নাকি এখন পদার্থবিদদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ‘আপেক্ষিকতার সবক’ নিতে হচ্ছে, কারণ শত্রুদের অবস্থান স্যাটেলাইট কিংবা জিপিএসের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার জন্য এ ছাড়া গতি নেই[3]। তারা বুঝতে পেরেছে বেগ বাড়ার সাথে সাথে পৃথিবীর উপরে অবস্থিত জিপিএস এর ঘড়ির সময় বদলে যায় খাপে খাপ মতো আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গণনা অনুসরণ করে।

কাজেই আইনস্টাইনকে বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল থেকে হটানো ‘মামার হাতের মোয়া’ টাইপের কোন সহজ ব্যাপার নয়। তারপরেও, আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করার প্রচেষ্টা অতীতে বৈজ্ঞানিকভাবে যেমন হয়েছে, ঠিক তেমনি হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও। আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা ‘মার্ক্সিজমের সাথে সংগতিপূর্ণ’ মনে না করায় ‘সোভিয়েত এনসাইক্লোপিডিয়া’ প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে ‘নস্যাৎ’ করে। রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক তার তখনকার লেখায় বলেছিলেন[4] – ‘‘Einstein’s theory of relativity cannot be considered accepted since it was not accepted by the proletariats’’. আবার অন্যদিকে নাৎসি জার্মানি থেকে আইনস্টাইনের সমালোচনা করে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিলো ১৯৩০ সালে ‘একশ জন বিশেষজ্ঞের আপেক্ষিকতাকে অস্বীকার’ (100 Authorities Denounce Relativity) শিরোনামে। আইনস্টাইন সেটা জানতে পেরে বলেছিলেন, কোন তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করতে একশ জন বিশেষজ্ঞের অভিমত’ লাগে না, কেবল একটিমাত্র পরীক্ষালব্ধ প্রমাণই কিন্তু যথেষ্ট[5]।

বলা বাহুল্য, আইনস্টাইন কথিত এ ধরণের পরীক্ষালব্ধ প্রমাণের হদিস কখনোই পাওয়া যায়নি। উমম্‌ … যায়নি বললাম বটে, তবে সঠিকভাবে বললে বলা উচিৎ – যায়নি , কেবলমাত্র অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটি পরীক্ষা ছাড়া। সুইজারল্যাণ্ডের জগদ্বিখ্যাত সার্ণ ল্যাবে তাদের নিউট্রিনো উৎপাদক যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে একটি প্রজেক্টের নাম ছিল “অপেরা” [OPERA (Oscillating Project with Emulsion-tRacking Apparatus)]। সেই প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা সেখানে তাদের যন্ত্রের মাধ্যমে নিউট্রিনো (এগুলো এক অদ্ভুতরে কণা যারা সবচেয়ে বেশী ঘনত্বের বস্তুকেও অবলীলায় ভেদ করে যেতে পারে) প্রক্ষিপ্ত করছিলেন। এই প্রজেক্টের আরেকটি অংশ ছিল আবার ইটালিতে। সেখানে মাটির প্রায় ১৪০০ মিটার গভীরে গ্রান সাসো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে বসে আরেকদল বিজ্ঞানী সার্ণ থেকে ছুঁড়ে দেয়া নিউট্রিনো বিমগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টায় ছিলেন। প্রায় ৭৩০ কিলোমিটার (প্রায় ৪৫৪ মাইল) পথ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছুনো প্রায় ১৫০০০ নিউট্রিনোগুলোকে তাদের সংবেদনশীল ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখলেন সেগুলো আলোর চেয়ে তাড়াতাড়ি এসে পৌঁছুচ্ছে। কিন্তু কতটা তাড়াতাড়ি? সে প্রায় আলোর গতির তুলনায় ৬০ ন্যানো-সেকেন্ড মানে এক সেকেণ্ডের ৬০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ কম সময়ে।

হু…এক সেকেণ্ডের ৬০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ সময়! এটা একটা বিষয় হল? এই সময় কম লাগলো না বেশি লাগলো তা নিয়ে আমাদের মত ছা-পোষা মানুষদের হয়তো কিছু যায় আসে না, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীদের আক্ষরিক অর্থেই মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম হল এই খবরটা পেয়ে। কারণ খবরটা সত্য হলে, মানে কোন কণা আলোর চেয়ে একচুল বেশি বেগে গেলে আইনস্টাইনের তত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই ধ্বসে পড়ে! আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী, আপনার বেগ যত বাড়তে থাকবে, তত আপনার জন্য সময় ‘ধীরে’ চলবে, আপনার ভর বাড়তে থাকবে, আর দৈর্ঘ্য সঙ্কুচিত হতে থাকবে (বলা নিষ্প্রয়োজন যে, প্রতিটি অনুসিদ্ধান্তই কিন্তু ল্যাবে পরীক্ষা করে যাচাই করা হয়েছে)। এখন আপনার বেগ যদি আলোর বেগকে অতিক্রম করে যায়, মানে আপনি আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করতে থাকলে নানা ধরণের অস্বাভাবিক ব্যাপার স্যাপার ঘটতে থাকবে। আপনার জন্য সময়ের চাকা সামনে না চলে পেছনের দিকে চলতে থাকবে, আপনার ভর অসীমতার স্তর পার হয়ে, হয়ে যাবে কাল্পনিক, এবং আপনার দৈর্ঘ্য হয়ে যাবে ঋণাত্মক। সামগ্রিকভাবে এ ব্যাপারগুলো যুক্তি বহির্ভূত কেবল নয়, হাস্যকরও। সেজন্যই আইনস্টাইনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল কোন বস্তুকণার পক্ষেই আলোর গতিবেগকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

এই ফলাফলে সার্নের বিজ্ঞানীরা এতোটাই অবাক হয়েছিলেন যে, তারা প্রায় ছয় মাস ধরে বারবার নিজেদের পরীক্ষার ভুল বের করার চেষ্টা করেছেন। কেননা, তারা জানতেন যে, এই ফলাফল প্রকাশ পেলে অপদস্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু বার বার করে সবকিছু দেখে শুনেও কোন ভুল না পেয়ে অবশেষে তাঁরা এই ফলাফল প্রকাশ করে দেন[6], [7]। কিন্তু তারা তাদের গবেষণাপত্রে এই ফলাফলের কোন ব্যাখ্যা দেননি। তাদের পাওয়া ফলাফল কেবল তারা সততার সাথে বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে পেশ করেছেন, এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের পরীক্ষাটি পুনর্বার করার আহবান জানিয়েছেন। তারা মনে করেছেন বিজ্ঞানীদের সমবেত প্রচেষ্টাই ভবিষ্যতে এই অস্বাভাবিকতার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে সমর্থ হবে। এ প্রসঙ্গে শোনা যাক প্রকল্পের সাথে যুক্ত প্রোফেসর এন্টনিয়ো এরিডিটাটোর বক্তব্য –

httpv://www.youtube.com/watch?v=HS2wE6hkbPY

সম্প্রতি সার্নের ২য় আরেকটি পরীক্ষাতেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে[8]। এই অবিশ্বাস্য ফলাফল প্রকাশের পর সাধারণ মিডিয়ায় তো বটেই এমনকি খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের মধ্যেও নানাদিক থেকে নানা রকম সাড়া পরে গেল সাথে সাথেই। কেউ কেউ মহা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কারণ এর মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচনের আভাস মিললো, আর নতুন দ্বার উন্মোচন মানেই নতুন নতুন গবেষকদের জন্য নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির সম্ভাবনা। আরেকদল বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবার বয়ে গেল ভয়ের শীতল স্রোত। কারণ গবেষণার ফলাফল সত্য হলে পুরো পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিটাই নতুন করে সাজাতে হবে তা হলে। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লিখতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষণ নতুন করে রি-ক্যালিব্রেট করতে হবে।

শুধু যন্ত্রপাতি নয়, পুরো মহাবিশ্বের চেহারাটাই যাবে আমূল বদলে। পৃথিবী থেকে নক্ষত্ররাজি আর নিহারিকার দূরত্ব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের বয়স (যা আমরা ১৩.৭ বিলিয়ন বলে জানি) পর্যন্ত সব কিছুই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। এমনকি মহাবিশ্বের প্রসারণ, মহা বিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহবর সহ সবকিছুই নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, করতে হবে পুনঃ পরীক্ষণ।

নানা সমস্যা হবে নিউক্লিয়-পদার্থবিদদের জন্যও, কারণ তাদের অর্জিত এতোদিনকার জ্ঞান হয়ে পড়বে অপাংক্তেয়। এখন একজন স্কুলের বাচ্চাও আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত সমীকরণটির কথা জানে – E=mc2। তারা জানে সামান্য পরিমাণ ভর থেকে কী বিপুল শক্তি আহরণ করা যায়। কারণ এখানে c বা আলোর বেগের বর্গ করলে যে বিশাল সংখ্যাটা পাওয়া যায় সেটার সাথেই প্রদত্ত ভরকে গুন করতে হয়। এখন আলোর বেগ যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে তবে, পুরো নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানই ঢেলে সাজাতে হবে। পারমানবিক অস্ত্র, পারমানবিক চিকিৎসা, রেডিও অ্যাকটিভ ডেটিং – সব কিছুই থয়ে যাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের মধ্যে ঘটা সকল রাসায়নিক বিক্রিয়াই মূলতঃ আইনস্টাইনের ভর শক্তির এই বিখ্যাত সমীকরণের উপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। এপ্রসঙ্গে বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকুর উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য[9] –

‘ … এতকিছুও যদি আপনার কাছে খারাপ বলে না মনে হয়, তবে শুনে রাখুন – এর মানে দাঁড়াবে পদার্থবিজ্ঞানের মূলনীতিগুলোই সংকটাপন্ন। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে – একটি হল আপেক্ষিকতা অন্যটি হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই পদার্থবিজ্ঞানের অর্ধেকটাই নতুন ধারণা দিয়ে বদলাতে হবে। আমার নিজের ক্ষেত্র – স্ট্রিং তত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজেরই সমস্ত তত্ত্বকে পরিসংশোধন করতে হবে, কেননা স্ট্রিং-তত্ত্ব একদম শুরু থেকেই আপেক্ষিকতার উপর নির্ভর করে রচিত।’

মিচিও কাকুর নিজস্ব অভিমত হল, সার্নের এই ফলাফল আসলে একটি ‘ফলস অ্যালার্ম’। এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার মধ্যে কোথাও না কোথাও কিছু ত্রুটি লুকিয়ে আছে, যা সাদা চোখে ধরা পড়ছে না। সামনের পরীক্ষায় পড়বে। একটি সেমিনারে তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন তা হয়তো পাঠকদের আগ্রহ জাগাবে –

httpv://www.youtube.com/watch?v=fyWbNNnn7-Y

একই ধরণের সংশয়ী মনোভাব ব্যক্ত করেছেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, মার্টিন রিস এবং লরেন্স ক্রাউস সহ অনেক বিজ্ঞানীই। তাদের মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে[10] (অনলাইনে তা পড়া যাবে এখান থেকে)। যেমন, অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস গবেষণার ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খুব স্পষ্টভাবেই বলেন –

‘এটা আসলে লজ্জাজনক। কোন পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা ছাড়া কোন গবেষণা-নিবন্ধ দাখিল করা অযৌক্তিক কিছু নয়, কিন্তু এমন একটি ফলাফলের উপর প্রেস-কনফারেন্স করা – যেটা ভুল হবার সম্ভাবনাই আসলে বেশি, এমনকি পেপারটি কোথাও রেফার করার আগেই – খুবই দুর্ভাগ্যজনক – শুধু সার্নের জন্যই নয়, বিজ্ঞানের জন্যও। ভুল প্রমাণিত হলে সবাই তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। নিউট্রিনো পরীক্ষা এমনিতেই খুব কঠিন। বিভাজনের সীমায় নিয়মানুগ ত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। অধিকন্তু, মনে হচ্ছে পরীক্ষাটি লোরেন্সের বিবর্তভেদমান (Lorentz invariance) কে লঙ্ঘন করে যা ‘হার্ট অব ফিজিক্স’ হিসেবে স্বীকৃত। কাজেই এই ফলাফলের প্রতি সংশয়বাদী হবার পেছনে যথেষ্ট কারণই আছে। সংশয়বাদী হবার পেছনে আর বড় একটি কারণ হচ্ছে ১৯৮৭ সালের সুপারনোভা (SN 1987A) থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে এর অসঙ্গতি…’

লরেন্স ক্রাউস অবশ্য ভুল কিছু বলেননি। আলোর বেগের চাইতে বেশী বেগ সম্পন্ন মানে ‘সুপারলুমিন্যাল নিউট্রিনো’ দেখবার ব্যাপারটি এর আগেও মিডিয়ায় এসেছিল। যেমন, ১৯৮৭ আলে সুপারনোভা পর্যবেক্ষণের সময় বিজ্ঞানীরা দেখেন নিউট্রিনোগুলো আলোর তিন ঘণ্টা আগে পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে। আলোক কণার আগে এসে পৌঁছানোর কারণে পর্যবেক্ষকদের অনেকে এগুলোকে প্রাথমিকভাবে ‘সুপারলুমিন্যাল নিউট্রিনো’ মনে করলেও পরবর্তীকালে সেই দাবী যে ভুল তা বোঝা গেছে। কারণ সুপারনোভার কার্যপ্রণালী ভালোভাবে অধ্যয়ন করে বিজ্ঞানীরা দেখেন, নিউট্রিনো প্রক্ষিপ্ত হয়েছিলো নক্ষত্রের অন্তঃস্থল বিধ্বস্ত হবার সাথে সাথেই। তার যাত্রাপথ শুরু হয়েছিলো আলোর কণা উদ্ভূত হবার তিন ঘণ্টা আগেই। যতক্ষণ না অভিঘাতী তরঙ্গ (shock wave) প্রত্যাঘাত করতে পেরেছিলো, ততক্ষণ আলোর কণা তৈরি হতে পারেনি। ‘সুপারলুমিন্যাল নিউট্রিনো’ হবার কারণে নয়, বরং আলোর কণা যাত্রা করার তিন ঘণ্টা আগে নিউট্রিনোগুলো যাত্রা করার কারণেই সেগুলো তিন ঘণ্টা আগে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছিলো। আরও বড় ব্যাপার হল, যদি সার্ণের এই ফলাফল সত্য হয়, তবে নিউট্রিনোর গতিবেগ আলোর চেয়ে প্রায় ৭.১৪গুন বেশি। এই মান ধরে হিসেব করলে ১৯৮৭ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তারিখে সুপারনোভা যে নিউট্রিনোগুলোর দেখা পাওয়া গেছে সেগুলো পৃথিবীতে আসার কথা ছিল তার থেকে চার বছর আগে[11]। কিন্তু এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। চার বছর আগে (মানে ১৯৮২ সালের শেষ দিক থেকে শুরু করে ১৯৮৩ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত) কোন নিউট্রিনোই পাওয়া যায়নি।

অসঙ্গতি আছে আরও অনেক ক্ষেত্রেই। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সেলডন গ্ল্যাশো এবং এণ্ড্রু কোহেন তাদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, আলোর চেয়ে বেশি বেগে নিউট্রিনো ভ্রমণ করলে ‘চেরেনকভ এফেক্ট’ (vacuum Cherenkov effects)-এর কারণে সুপারলুমিন্যাল নিউট্রিনোগুলো ইলেকট্রন এবং পজিট্রন বিকিরণ করে শক্তি ক্ষয় করে ফেলার কথা। কিন্তু এমন কোন কিছুই সার্নের ফলাফলে পাওয়া যায়নি[12]। এই ব্যাপারটি সার্নের ফলাফলের প্রতি একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারপরেও কোন কোন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আবার এই ঘটনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হাজির করতে প্রয়াসী হয়েছেন। যেমন, লণ্ডনের কিংস কলেজের পদার্থবিদ গিয়াকোমো ক্যাক্কিয়াপাগ্লিয়া ধারনা করেন, নিউট্রিনোগুলো স্ট্রিং তত্ত্ব বর্ণিত অতিরিক্ত মাত্রার ফোঁকর গলে ডিটেক্টরে পৌঁছেছে, সেজন্যই সম্ভবতঃ নিউট্রিনোগুলোর কোন শক্তি-ক্ষয় ঘটেনি[13]।

কিন্তু এই সব অতিরিক্ত মাত্রা ফাত্রা এনে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস দেখে অন্য বিজ্ঞানীরা আবার ভুরু কুঁচকেছেন। বিজ্ঞানী এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক প্রয়াত কার্ল স্যাগান প্রায়ই বলতেন, ভং চং করলে হবে না – ‘অসাধারণ দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ প্রমাণ লাগবে’। অতিরিক্ত মাত্রার ফোঁকর গলে ডিটেক্টরে পৌঁছেছে বললেই তো হল না, এর পেছনে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে কই? বলা বাহুল্য, এমন কোন প্রমাণই কিন্তু পাওয়া যায়নি। তাই অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের সন্দেহের তীর এখনো মূলতঃ সার্ণের পরীক্ষায় পাওয়া অস্বাভাবিক ফলাফলের দিকেই। আর পরীক্ষায় অসতর্কতার কারণে ভুল সিদ্ধান্তে যাওয়ার উদাহরণ কিন্তু আমাদের অল্প হলেও আছে। যেমন, ১৯৬০ সালে একদল পদার্থবিদ আলোক রশ্মির উপর মাধ্যাকর্ষণের ছোট খাট প্রভাব পরিমাপ করতে বসেছিলেন। তাদের একটি পরীক্ষার ফলাফলে পাওয়া গেল যে, আলোর বেগ পরিবর্তনশীল – দিন আর রাতে উঠা নামা করে! অনুসন্ধান কয়রে দেখা গেলো তাদের পরীক্ষণ-যন্ত্র যেহেতু ল্যাবের বাইরে স্থাপন করা হয়েছিলো, এর সেন্সর দিনের আলো এবং আনুষঙ্গিক তাপমাত্রা দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলো, তাই এই অস্বাভাবিক ফল। সার্নের পরীক্ষাতেও এই ধরণের অসতর্ক ভুল লুকিয়ে থাকতে পারে। সেটার সম্ভাবনাই বেশি।

জানা গেছে শিকাগোর বাইরে ফার্মি ল্যাবের বিজ্ঞানীরাও সার্ণ -গ্রান সাসো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এই ‘অপেরা পরীক্ষা’টি পুনরায় নিজেরা করবেন। এর ফলাফলও আমরা জানবো শিগগিরই। এভাবে আরও কয়েক দফা পুনঃ পরীক্ষণ চলবে, চলবে ক্রস-চেকিং। বিজ্ঞান এভাবেই কাজ করে। কিন্তু আসলেই যদি সার্ণের এই ‘অপেরা পরীক্ষায়’ যদি শেষ পর্যন্ত কোন ভুল না পাওয়া যায়? অর্থাৎ, সার্নের ফলাফল যদি সত্য হিসেবে বেরিয়ে আসে, তবে? তাহলেই যে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে তা নয়, অন্ততঃ অনেক বিজ্ঞানীই তা মনে করেন না। পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ভিক্টর স্টেঙ্গর সম্প্রতি একটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন –আইনস্টাইনের তত্ত্ব লঙ্ঘন না করেই কীভাবে পুরো ব্যাপারটির একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। ভিক্টর স্টেঙ্গর সংশয়বাদী পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে সুবিদিত এবং সম্প্রতি ‘গড দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় বইয়ের প্রণেতা। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে অধ্যাপক স্টেঙ্গর নিউট্রিনো নিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে একাডেমিয়ায় কাজ করেছেন। কাজেই সার্নের এই নিউট্রিনো পরীক্ষার ব্যাপারে তার অভিমত অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। এ বিষয়ে ভিক্টর স্টেঙ্গর যে প্রবন্ধটি লিখেছেন তা থেকে আমি দু চার কথা আলোচনায় আনব। তার প্রবন্ধটি হাফিংটন পোস্টের ব্লগে দেওয়া হয়েছে দুই ভাগে – প্রথম পর্বটি আছে এখানে এবং ২য়টি এখানে। অন্য অনেক বিজ্ঞানীদের মতো ভিক্টর স্টেঙ্গরও মনে করেন, সার্ণের এই পরীক্ষার মধ্যে কোথাও না কোথাও ঘাপলা আছে, এবং তা হয়ত সামনে বেরিয়ে আসবে, সেজন্যই তিনি প্রবন্ধটির প্রথমেই বলে নিয়েছেন –

‘পৃথিবী থেকে ১৬৮, ০০০ আলোকবর্ষ দূরে এক জায়গায় এক সুপারনোভা বিস্ফোরণের কথা আমরা জানি। এটাকে প্রথম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিলো ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দৃশ্যমান আলো পৃথিবীতে পৌঁছানোর তিন ঘণ্টা আগে বেশ কিছু সংখ্যক নিউট্রিনোর পৃথিবীতে পৌঁছুনোর ব্যাপারটি সনাক্ত করা হয়েছিল তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভূ-গর্ভস্থ ডিটেক্টরের সাহায্যে সনাক্ত করা গিয়েছিল। সার্নের এই পরীক্ষার ফলাফল যদি সঠিক হয় তবে তাদের আসা উচিৎ ছিল ১৯৮২ সালে। কাজেই আমি যদি বাজি খেলতাম, তবে বলতাম এই প্রভাব একটা সময় পর চলে যেতে বাধ্য, কারণ এমন এক ভুল পরীক্ষাটির ভিতর লুকিয়ে আছে যা এখনো কারো চোখে পড়েনি।’

ভিক্টর স্টেঙ্গর তার প্রবন্ধটিতে আরো যা বলেছেন তা হল, আইনস্টাইনের তত্ত্ব আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলমান কণার অস্তিত্ব কখনোই বাতিল করে দেয় না, বরং তাদের জন্যও এক ধরণের সীমা বেঁধে দেয় যে, তারা কখনোই আলোর সমান বা তার চেয়ে কম বেগে চলতে পারবে না। তাদের চলতে হবে আলোর চেয়ে বেশি বেগে সব সময়ই (অনেকটা নীচের ছবির মতো)। এধরণের কণার কোন বাস্তব অস্তিত্ব আবিষ্কৃত না হলেও গণিতের মাধ্যমে এ কণাকে প্রকাশ করা হয়েছে অনেক আগেই। এদের আমরা ট্যাকিয়ন নামে চিনি।

ভিক্টর স্টেঙ্গরের অভিমত অনুযায়ী, আলোর চেয়ে গতিসম্পন্ন কণার বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে তা কার্য-কারণ বা ‘Cause and Effect’ এর উপর প্রভাব ফেলবে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার উপর নয়[14]। কার্য কারণের ব্যাপারটি আমাদের কাছে এতটাই স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে হয় যে, আমরা এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করি না। ভাবি যে, ব্যাপারটা হয়তো সব সময়ের জন্যই কিংবা সর্বত্রই একই রকমভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নাও হতে পারে।

‘ব্যাপারটা যে সেরকম নাও হতে পারে’ – মানে, আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তগুলোই সবসময় স্বতঃসিদ্ধ নাও হতে পারে – ঠিক এই অভিমতটাই প্রায় একশ বছর আগে যৌক্তিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬)। আমাদের অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে কোন একটি ঘটনা ঘটার পূর্বে আরেকটি ঘটনা ঘটলে, তার মানে সব সময় এই নয় যে, প্রথম ঘটনাটি দ্বিতীয় ঘটনার কারণ। অন্ততঃ সব ক্ষেত্রে তা নয়।

রসায়নের জগতে আমরা এমন অনেক বিক্রিয়ার সাথেই পরিচিত যে বিক্রিয়াগুলোকে সামনে থেকে পেছনে চালানো যায়, কিংবা পেছন থেকে সামনে। দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা থেকে কোনটা ঘটছে। আমরা সেগুলোকে অভিহিত করি পরাবর্তী (Reversible) বিক্রিয়া বলে। যেমন, কার্বন পরমাণু আর অক্সিজেন অণু বিক্রিয়া করে আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড এবং শক্তি পাই। উল্টোভাবে কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে শক্তি যোগ করেও আমরা কার্বন পরমাণু এবং অক্সিজেন অণু পেতে পারি।

এ ধরণের ব্যাপার শুধু রসায়নেই নয়, পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সত্য হতে পারে। যেমন, প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান একবার বলেছিলেন, কোন এন্টি-ইলেকট্রন কণিকার (পজিট্রন) সময়ের সাথে সাথে সামনে অগ্রসর হওয়া আর কোন ইলেকট্রনের সময়ের বিপরীত দিকে চলার মাঝে কারো পক্ষে পার্থক্য করা অসম্ভব ব্যাপারই হবে।

এবারে মূল বিষয়ে আসা যাক। ধরা যাক উপরের ছবিতে কোন পার্থিব বস্তু কণা পয়েন্ট A থেকে পয়েন্ট B এর দিকে যাচ্ছে। যাত্রাপথটিকে লাল দিয়ে দেখানো হয়েছে। আর ট্যাকিয়নের গতিপথকে দেখানো হয়েছে সবুজ দিয়ে। লাল দাগের বাঁ দিকে ট্যাকিয়ন যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ সে বস্তুটিকে A থেকে B এর দিকে যেতে থাকবে সত্যি, কিন্তু ওই লাল দাগকে অতিক্রম করে গেলে ট্যাকিয়ন বস্তুকণাটিকে উলটো দিকে যেতে দেখবে, অর্থাৎ এর যাত্রাপথ তখন তার চোখে হবে – B থেকে A এর দিকে। আমি বিস্তৃত ব্যাখ্যায় এখানে যাচ্ছি না, পাঠকেরা ব্যাখ্যা পেতে চাইলে সরাসরি অধ্যাপক স্টেঙ্গরের প্রবন্ধের ২য় পর্বটি পড়ে নিতে পারেন[15])। কাজেই কার্যকারণ সম্পর্ক কিংবা আদি কারণের ব্যাপারগুলো (অন্ততঃ ট্যাকিয়নের কাছে) আর সেভাবে সত্য থাকছে না।

অবশ্য কার্যকারণকে প্রশ্নবিদ্ধ না করেও সুপারলুমিন্যাল নিউট্রিনোর অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেটা করেছেন বিজ্ঞানী শন ক্যারল তার একটি ব্লগ-প্রবন্ধে[16]। তিনিও সার্নের এই ফলাফলে সংশয় প্রকাশ করেছেন, কারণ সার্ণের ফলাফল সত্য হলে Supernova 1987A তে দেখতে পাওয়া নিউট্রিনোগুলো বছর খানেক আগেই দেখতে পাবার কথা ছিল। তবে একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপার তিনি উল্লেখ করেছেন SN 87A এর ক্ষেত্রে নিউট্রিনোগুলো ছিল ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউয়ন নিউট্রিনো নয়, ফলে তাদের শক্তিস্তর তুলনামূলক-ভাবে অনেক কম ছিল। আর যদি সার্ণের পরীক্ষার ফলাফল সত্য হয়, তবে সেটকেও বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব কিছু হবে না। ইতোমধ্যেই কীভাবে লোরেন্স ইনভ্যারিয়েন্স লঙ্ঘন করে নিউট্রিনো আলোর বেগের পরিসীমা অতিক্রম করতে পারে, তা নিয়ে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পেপার প্রকাশিত হয়েছে[17], আরও বেশ কিছু রিভিউ পেপার ইতোমধ্যেই জমা পড়েছে[18]। উইকিতেও এ নিয়ে আলাদা পাতা আছে।

যাহোক, সার্ণ এবং গ্রান সাসো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির অপেরা প্রকল্প নতুনভাবে বিজ্ঞানের অমিত শক্তিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এটা বোধ হয় বলে দেওয়ার দরকার নেই যে, বিজ্ঞানে তত্ত্বের ভাঙ্গা চোরা চলে নিয়ত, হয় পুরনো তত্ত্বের পতন, কিংবা নতুন তত্ত্বের উত্থান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়মাল্য যায় বিজ্ঞানের গলাতেই। প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি, বিজ্ঞানে কোন কিছুই পাথরে খোদাই করে লেখা হয় না। বরং বিজ্ঞান নির্দয়ভাবে সংশয়ের তীর হানতে থাকে সর্বক্ষণ তা যে রথী মহারথীর তত্ত্বই হোক না কেন। বিজ্ঞানের এই সংশয়, এই পরিবর্তনশীলতাই বিজ্ঞানের এগিয়ে চলার শক্তি। অনেকেই সেটার মর্ম না বুঝে একে ধর্মবিশ্বাস কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মতোই এক ধরণের বিশ্বাস বলে মনে করেন। এটি সত্য নয়। গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৮ শে সেপ্টেম্বর একটি ব্যতিক্রমী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ‘Faster than light story highlights the difference between science and religion’ শিরোনামে। সেখানে লেখক স্পষ্ট করেছেন, বিজ্ঞান কখনোই কোন কিছুকে ‘বিশ্বাস’ করে বসে থাকে না, বরং পুনঃ পুনঃ পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত ‘জ্ঞান’ এর আলোয় নিজেকে আলোকিত করে এগিয়ে যেতে চায়। বিজ্ঞান স্থবির নয়, প্রগতিশীল। আজ আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভুল পাওয়া গেলে সেই তত্ত্ব প্রত্যাখ্যাত হতে সময় লাগবে না। প্রাচীন কালের কোন পয়গম্বরের কিংবা দেবদূতের বাণীর মতো আঁকড়ে ধরে ফুল চন্দন যোগে পুজো চলতে থাকবে না নিঃসন্দেহে। বিজ্ঞানে ‘পবিত্র তত্ত্ব’ বলে কিছু নেই। এখনে ‘একশ জন বিশেষজ্ঞের’ অভিমতের মূল্য নগণ্য। বরং নিগুঢ় এবং নির্ভুল পরীক্ষণ, এবং সেই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল, যা আবার অন্যদের দ্বারা পুনঃ-পরীক্ষিত এবং সমর্থিত হবে – সেটাই ‘বিজ্ঞানের রায়’ বলে বিবেচিত। তাই আমাদের আস্থা থাকবে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার প্রতি, সেখান থেকে পাওয়া নির্মোহ রায়ের উপরেই।

তথ্যসূত্র:

[1] একটি ব্যাপার এখানে পরিস্কার করা দরকার। ফলসিফায়েবল মানে ভুল প্রমাণেয়তা বা পরীক্ষার মাধ্যমে ভুল প্রমানের চেষ্টা করা, অর্থাৎ বাতিলযোগ্যতা। তত্ত্বটা ভুল তা কিন্তু নয়। ‘ফলসিফিফায়াবিলিটি’ বা ‘বাতিলযোগ্যতা’ একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অন্যতম গুণ। এটা যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণের অপরিহার্য শর্ত। মুলতঃ এই গুনটিই বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানকে পার্থক্য করে দেয় পরিস্কারভাবে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। যেমন, ‘যুধিষ্ঠির স্বশরীরে স্বর্গে গেছেন’ – এটি এমন একটি বক্তব্য যেটা পরীক্ষা করে আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারি না। কাজেই এটি একটি টটোলজিকাল স্টেটমেন্ট – ফলসিফায়াবেল নয়। কারণ আমরা কোনভাবে পরীক্ষা করে এর যথার্থতা নির্ণয় করতে পারি না। কিন্তু ‘ইলেক্ট্রন প্রটোনের চেয়ে ভারী’ –এটি একটি ফলসিফায়েবল স্টেটমেন্ট। কারণ পরীক্ষা করে আমরা এর সত্যমিতথ্যা যাচাই করতে পারি। কার্ল পপার তার ‘দ্য লজিক অব সায়েন্টিফিক ডিস্কভারি’তে পরিস্কার করে বলেছেন – ‘A theory is scientific to a degree to which it is testable.’

[2] আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কীভাবে কাজ করে তা এই প্রবন্ধের বিষয় নয়, আমি আমার আগের একটি লেখায় এ নিয়ে বিষদভাবে লিখেছিলাম। উৎসাহী পাঠকেরা মুক্তমনায় প্রকাশিত ‘এক পেটেন্ট ক্লার্কের অসাধারণ মানস পরীক্ষণের কাহিনী’ প্রবন্ধটি দেখে নিতে পারেন।

[3] Michio Kaku, Physics of the Impossible: A Scientific Exploration into the World of Phasers, Force Fields, Teleportation, and Time Trave, Doubleday; 2008

[4] John Grant, Corrupted Science: Fraud, Ideology and Politics in Science, Facts, Figures & Fun, 2007

[5] Michio Kaku, Has a Speeding Neutrino Really Overturned Einstein? The Wall Street Journal, September, 2011

[6] T. Adam et al. OPERA collaboration, Measurement of the neutrino velocity with the OPERA detector in the CNGS beam, 22 September, 2011.

[7] Edwin Cartlidge, “Faster-Than-Light Neutrinos: OPERA Confirms and Submits Results, But Unease Remains”. Science, 17 November 2011.

[8] Alok Jha, Neutrinos still faster than light in latest version of experiment, The Guardian, 17 November 2011

[9] Michio Kaku, Has a Speeding Neutrino Really Overturned Einstein? The Wall Street Journal, September, 2011

[10] John Matson, Faster-Than-Light Neutrinos? Physics Luminaries Voice Doubts, Scientific American, September 26, 2011

[11] D. Fargion, D. D’Armiento, Inconsistence of super-luminal Opera neutrino speed with SN1987A neutrinos burst and with flavor neutrino mixing, arXiv:1109.5368v5 [astro-ph.HE]

[12] Andrew G. Cohen and Sheldon L. Glashow , Pair Creation Constrains Superluminal Neutrino Propagation”. Physical Review Letters 107 (18): 181803, 2011.

[13] Eugenie Samuel Reich, Finding puts brakes on faster-than-light neutrinos, Nature, 20 October 2011.

[14] Victor Stenger, No Cause to Dispute Einstein; huffingtonpost

[15] Victor Stenger, No Cause to Dispute Einstein Part-2, huffingtonpost

[16] Sean Caroll, Faster-Than-Light Neutrinos?, Discover Magazine Blog

[17] John Ellis, Nicholas Harries, Anselmo Meregaglia, Andre Rubbia, Alexander Sakharov, Probes of Lorentz Violation in Neutrino Propagation, http://arxiv.org/abs/0805.0253

[18] Alan Kostelecky, Matthew Mewes, Lorentz and CPT Violation in the Neutrino Sector, Submitted on 28 Aug 2003 (v1), last revised 22 Jun 2004, http://arxiv.org/abs/hep-ph/0308300