পূর্ববর্তী পর্বঃ পর্ব ১

রমজান মাসে নামাজ আদায় করার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশানের অনুরোধে স্টুডেন্ট সেন্টারের বিশাল হল রুমের একটি কর্নার ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করলো। দলে দলে দল বেঁধে, সর্বমোট বিশ কি ত্রিশ জন মুসলিম স্টুডেন্ট জামাতের সাথে প্রতিটি রমজানে সেখানে মাগরিবের নামাজ আদায় করে এবং তারপর একসাথে ইফতার করে। সমস্যা হলো, হল রুমটি অন্যসব স্টুডেন্টদের জন্যও উন্মুক্ত, যেখানে বসে তারা বরাবরের মতই লেখাপড়া কিংবা গ্রুপস্টাডি চালিয়ে যেতে পারে। সমস্যা আসলে সেটাও না, লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সমস্যা হবে কেন। আসল সমস্যা হলো, লেখাপড়ার বিরতিতে একটু পর পর চালিয়ে যাওয়া যুগল সম্প্রদায়ের প্রেম নিবেদন কার্যক্রম। বাংলাদেশি প্রেমের সাথে এদের প্রেমের আবার পার্থক্য আছে, এরা প্রেম করে শব্দ করে। বাংলার আনাচে-কানাচে, মফস্বল কিংবা শহরতলীতে সর্বপ্রথম যে লাইব্রেরীটা গড়ে উঠে সেটার নাম হয় ‘ইসলামিয়া লাইব্রেরি’। সেখানে কাসেম কিংবা হাশেম বিন জাতীয় কিছু শরীয়াভিত্তিক ঔপন্যাসিকের লেখা শরীয়াভিত্তিক প্রেমের উপন্যাস পাওয়া যায়। তাতে, ‘আসসালামুয়ালাইকুম’ বলে প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেমালাপ শুরু করে। কিন্তু, এই বেত্তমিজ যুক্তরাষ্ট্রে সে-রকম শরীয়াভিত্তিক লেখকের আবির্ভাবও ঘটেনি, সে-রকম লেখারও জন্ম হয়নি। অতএব, এখানকার প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেম করবে বিদেশি কায়দায়, তেমনটাই স্বাভাবিক।

রমজানের কোনো এক বেরসিক বিকেলে আমিও গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই স্টুডেন্ট সেন্টারে। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে রুকুতে গিয়ে সমস্ত মুসল্লিগণ যখন চারিদিক শান্ত করে দিল, তখনি পাশ থেকে শব্দ উৎপাদনকারী প্রেমের ‘চুকুর-মুকুর’ শব্দ প্রখর হয়ে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতার সাথে সাথে মেজাজ ভারী হলো, রাগও হলো। তবে, রাগ আমার এদের কারো উপর নয়। রাগের কারণ অন্য। বাংলা ব্যকরণবিদগণ হাতির ডাক, ঘোড়ার ডাক, ময়ূরের ডাক সবকিছুর জন্য হ্রেষা-ম্রেষা, বৃংহিত-সৃংহিত নামের কি-সব অত্যাশ্চর্য শব্দের অবতারণা করেছেন; এমনকি পাতার ধ্বণি, বাতাসের ধ্বণি জাতীয় নির্জীব কর্মকাণ্ডের জন্যও শব্দ বরাদ্দ করেছেন; কিন্তু, এই মহান প্রেমের আওয়াজের জন্য কোনো শব্দতো দূরে থাক একটি বর্ণও বরাদ্দ করে যাননি। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ‘চুকুর-মুকুর’ জাতীয় বেমানান শব্দটি ব্যবহার করতে হলো। তবে, এর থেকেও বড় সমস্যা হলো, আসসালামুয়ালাইকুম বলে যখন পাশে মুখ ফেরাবে, তখন কি হবে, একেবারেতো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবার কথা। নামাজের সর্বশেষ পর্যায়ে এ-দৃশ্য দেখলে, যে-কোনো মুমিন বান্দার মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কথা। টান-টান উত্তেজনায় আমি মুসল্লি স্টুডেন্টদের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম; এক সম্ভাব্য সমস্যা আর তার সমাদান দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু একি! আসসালামুয়ালাইকুম বলে মুখ ফিরিয়ে, সামনের দৃশ্য দেখে, মুসল্লিদের দুইচোখ খুশিতে ভরে গেলো। সকলে মহা খুশি, তাদের আনন্দের যেন সীমা নাই। ঘটনা আসলে অন্য। প্রেমিক যুগলকে অতিক্রম করে খানিক দূরে সাজানো আছে ইফতারের জন্য নিয়ে আসা ‘চিকেন বিরিয়ানী’। সমস্ত দিন অভূক্ত থেকে দুনিয়ার অন্য যত দৃশ্যই থাকুক চোখ সবার আগে খাবারের দিকেই যাওয়ার কথা। হলোও ঠিক সেটাই।

ওদিকে, এমনি করে একে এক তিরিশটি দিন পার হবার পরে কোনো এক সপ্তাহান্তে ঈদ চলে আসলো। এখানে চাঁদ দেখে ঈদ হয় না, ঈদ হয় ‘উইক-এন্ড’ দেখে। সবসময় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় শনি কিংবা রবিবারে ঈদের বন্দোবস্ত করার জন্য। ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত’ এই লাইনটির মত এখানে ‘চাঁদ উঠুক আর না উঠুক, আজ ঈদ’। এই ঈদটা আমার কাছে আবার একটু অন্যরকম। বিয়ের পরে ইউএসএতে এটাই আমার প্রথম ঈদ। ঈদ উপলক্ষ্যে, আমার শাশুড়ী আড়ং থেকে হাজার টাকা ব্যয় করে চকচকে আকাশী কালারের একটি বাহারী পাঞ্জাবী উপহার দেন। এবারে সেই চকচকে আড়ং পাঞ্জাবী পরে করে ঈদের নামাজে চললাম। এখানে ঈদের নামাজও একটা দেখার বিষয় হয়। বাংলাদেশে আমরা ঈদগাহে যাই; এখানে যেতে হয় বিল্ডিং এর উপরে। ডাউনটাউনের কোনো এক আশি-তলা একশো-তলা বিল্ডিয়ের পঞ্চাশ তলায়। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে ঈদের জামাত মনে হয় এখানে, এই শিকাগোতেই হয়।

তবে, প্রতিবারের মত এবার আর ডাউনটাউন যাচ্ছি না। ডাউনটাউন থেকে কিছুটা দূরে, অন্য আর আটদশটা এলাকার মত এখানেও একটি নতুন মসজিদ নির্মিত হয়েছে। আমরা ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি স্টুডেন্টরা মহা আনন্দে সেখানে ঈদ করতে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠে পড়লাম। চুপচাপ বসে থাকা যাত্রীরা আমাদেরকে তাকিয়ে দেখছে। এখানে নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা সংস্কৃতির মানুষ। সবাই এ-সব দেখে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু, সকল নীরবতার অবসান ঘটিয়ে, লাল-নীল পাঞ্জাবি আর সাদা টুপি পরিহিত আমাদের দেখে, ছোট্ট এক অবুঝ শিশু ট্রেনের ভিতর চিৎকার করে বলে উঠলো, “লুক, মাম্মি লুক, জোকারস্‌”। ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাম্মি প্রায় শিশুর মুখ চেপে ধরলো, আর লজ্জিত হয়ে শুধু ‘সরি’ ‘সরি’ করতে লাগলো। এর মধ্যে আবার ট্রেনের যাত্রীগণ জোকারদের দেখে চোখ জুড়িয়ে নিচ্ছে। হাসি আসলেও কেউ খুব একটা প্রকাশ করছে না। মাওলানা ওসামা বিন লাদেন যে ভয়ঙ্কর আসনে আমাদের বসিয়ে গেছেন, এখানকার বেশিরভাগ লোকই হয়তো মনে করেন, আমরা পাঞ্জাবীর দুই পকেটে দুইটা করে বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়াই। সুযোগ বুঝে আমিও তাই বার কয়েক পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলাম, হাসি বন্ধ।

নতুন মসজিদে বাংলাদেশি নারী-পুরুষ সকলে এসেছেন, ঈদের নামাজ পড়তে এসেছেন। সাথে এসেছেন মাশরাফি ভাইও। তিনি ঢাকা থেকে এমবিবিএস পাশ করে এসেছেন, এখন এখানে ডাক্তারীর পরবর্তী ধাপগুলো পার করছেন। সাথে আছেন উনার দুইবছরের ছেলে ‘মীর’। ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, শুধু মাঝে মাঝে ‘ইয়েস’ ‘নো’ জাতীয় দু’একটা শব্দ বলতে পারে। এরকম আরো অনেক ফ্যামিলির সব লোকজন ঈদের নামাজ পড়তে এসেছেন, এসেছেন উঠিতি বয়সী কিশোর-কিশোরীরাও। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ঈমাম সাহেবও সুযোগ বুঝে শরীয়াভিত্তিক প্রেমের ওয়াজ-নসিহত করতে শুরু করলেন। বহুমুখী সম্পর্কের বহুরূপী অপকারিতার কথা বর্ণনা করতে করতে অবশেষে তিনি প্রশ্ন করিলেন, “আপনি কি চান এভাবে জীবনের একটা স্বাভাবিক ধারা নষ্ট করে ফেলতে? আপনি কি চান এভাবে উদ্দেশ্যহীণভাবে একাধিক অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে?” সমস্ত মসজিদের সবাই নীরব, পিনপতন নীরবতা। শুধু মাশরাফি ভাইয়ের দুইবছরের ছেলে, সকল নীরবতার অবসান ঘটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো-‘ইয়েএএএএএএএএএএএএএএএএস’।

শ্বাশুড়ীর কথা যদি বললাম-ই, তাহলে শ্বশুরের কথাও একটু বলতে হয়। এই ভদ্রলোকের সাথে আমার প্রতিযোগিতা বিয়ের আগে থেকে। বিয়ের ঠিক দুইদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রিক্সা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। রিক্সাওয়ালাকে বললাম, দ্রুত চালাতে। সেও চলছে ঝড়ের গতিতে। এর মাঝখানে পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে জোরে জোরে হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা মেজাজ নিয়ে ভাবলাম, কি এমন ব্যস্ততা এই লোকের। আমার দুইদিন পরে বিয়ে, আমার থেকেও সে বেশি ব্যাস্ত না-কি। অতএব, দু’কথা শুনিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিলাম। যেই কথা সেই কাজ, কটকট চোখে পিছনে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম, ‘আসসালামুয়ালাইকুম’। আমার হবু শ্বশুর। বেচারা মেয়ের বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে আমার চেয়েও ব্যস্ত হয়ে গেছেন, একটু হর্ন বাজাতেই পারেন।

এখানেই শেষ নয়, বিয়ের কিছুদিন পর লিভিং রুমে বসে তিঁনি টেস্ট ক্রিকেট দেখছেন। আমিও এসে বসলাম। খেলা দেখতে দেখতে বললাম, “ একমাত্র এই ইন্ডিয়ার সাথে আসলেই অস্ট্রেলিয়া তাল হারিয়ে ফেলে।” কথা শুনে শ্বশুর মশাই একটু আমতা আমতা করতে লাগলেন। আমি ভাবলাম এইতো সুযোগ। ভারত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচ এর সব ইতিহাস তুলে ধরা শুর করলাম। যতই বলতে থাকছি শ্বশুর আমার ততই লজ্জায় কুটুকুটু হয়ে যাচ্ছে। আমি আরো উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নতুন জামাইয়ের লজ্জা পাওয়ার কথা শুনেছি, কিন্তু নতুন শ্বশুরের লজ্জা পাওয়ার কথা শুনবো কি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। ভাবলাম, এখনি দেখিয়ে দিতে হবে, কি ব্যতিক্রম একটা ছেলের কাছে মেয়ে দিয়ে দিয়েছেন, সমস্ত পরিসংখ্যান মুখস্ত, একজন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। মনে হলো, আমার তথ্যের ভারে শ্বশুর মশাই শেষ পর্যন্ত হতাশই হয়ে পড়লেন। তাঁর হতাশার কারণ আমি বুঝতে পারি, যতই সিনিয়র হোন না কেন, মেয়ের জামাইয়ের ক্রিকেট প্রতিভার কাছে এভাবে নতজানু হতে কার আর ভালো লাগে। অতঃপর, শ্বশুর মশাইকে ধরাশায়ী করে বিজয়ীর ভঙ্গিতে, লাস্ট বলে অস্ট্রেলিয়ান এক ব্যাটস্‌ম্যান পরাস্ত হবার পর মন্তব্য করলাম, ‘এই যে দেখেন না, ইন্ডিয়ান স্পিন অস্ট্রেলিয়ানরা খেলতেই পারে না’। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না, লাজলজ্জ্বার মাথা খেয়ে শ্বশুর আমার মুখ খুললেন। গভীর হতাশা আর বিষাদের সুর মেখে আস্তে করে বললেন, “খেলাতো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া আর পাকিস্তানের”।

(চলবে)

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]