লিখেছেনঃ এ. প্রামানিক

lokta

একটা মাঝবয়সী লোক পৃথিবীর পথে পথে শুধু হাটঁছে, শুধু হাটঁছে। তার হাতে একটা লাল মলাটের নোটবুক। বুক পকেটে একটা কলম। মস্তিষ্কে একটাই জিজ্ঞাসা-“মানুষের সর্বোচ্চ চাওয়া কি?”

গায়ে সাদা জামা। উস্কুখুস্ক চুল। চামড়ায় ময়লার বাড়তি একটা স্তর। দেখলেই বোঝা যায় ঘরের সাথে এর সর্ম্পকের ইতি হয়েছে অনেকদিন আগেই। ছাড়া ছাড়া হাত-পা গুলো বিষন্ন, অবসন্ন। কোনো রকমে মূল দেহ থেকে ঝুলে আছে। তারা যেনো বলছে- ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো। ক্লান্তিতে যে কোনো মুর্হূতে লোকটা বালুঘড়ির মতো ভেঙ্গে পড়বে আর ধূলো হয়ে পৃথিবীর পথে মিশে যাবে। শুধু জামা-প্যান্ট পথ শেষের মাইলফলক হিসেবে পড়ে থাকবে। এসবের মধ্যেও একটা ভীষণ অমিল আছে। তার চোখ দুটো। সবুজ রঙের তারার মতো যেন সেগুলো সবসময় মিটিমিটি জ্বলছে। দিনের আলোতেও যার ঔজ্জল্য একটুকু ম্লান হয় না। সে চোখের দৃষ্টি কোমল, শান্ত, স্হির কিন্তু ভেদ করার তীব্র ক্ষমতা সম্পন্ন। ঐ চোখের দিকে একবার তাকালে যে কেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য। এত তীব্রতা সহ্য করার মতো না। ভীষণ সজীব চোখগুলো যেন চনমনে, স্বত:স্ফূর্ততায় ভর্তি। সেখানে কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন গ্লানিমা। চোখগুলো যেন সবসময় কিছু একটা বলছে। সে বলার ভাষা বেশ স্পষ্ট কিন্তু নিরব। তাই লোকটাকে দেখলেই যে কাউকেই ধাধাঁয় পড়ে যেতে হয়, এর কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা ভেবে, কোনটা আসল আর কোনটা প্রতিফলন ভেবে।

কিন্তু লোকটার মনে একটুকুও দ্বিধা নেই। তার দাবী স্পষ্ট। তার লক্ষ্য নির্দিষ্ট। আর তা হলো মানুষের সর্বোচ্চ চাওয়া কি তা খুজেঁ বের করা। যৌবনের শুরুতে সেই যে ঘর থেকে বেরিয়েছে আর কখনো ঘরে ফেরা হয়নি। ঘরে ফেরার ইচ্ছাটাও কখনো জাগে নি। ঠিক যেন শঙ্খচিল। শঙ্খচিলের যেমন সীমানা থাকে না ঠিক তেমনি তারও সীমানা নেই। অনন্ত পথই এখন তার ঘর। এই পথই বা কি কম পাড়ি দিয়েছে সে? কত শহর-গ্রাম, কত মাঠ-ঘাট তার পিছনে পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। কত বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। কত দেশ-বিদেশ সে ঘুরে বেরিয়েছে। কত সংস্কৃতির মানুষের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। কত জায়গায় তার আশ্রয় হয়েছে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কিন্তু কোথাও তাকে আপন করে বাধঁতে পারেনি। তার চলার কখনো শেষ নেয়। গতিই যেন তার স্হিতি। তার এ চলার এ পথের শেষ কোথায় এ সব নিয়ে তার ভাবনা নেই। তার ভাবনা বলতে সেতো একটাই। হয়তোবা যেদিন যেখানে যখন তার উত্তর মিলবে সেদিন সেখানে সে ক্ষণে তার সফর শেষ হবে। তা কবে হবে তা কেউ বলতে পারে না। পৃথিবীর কম লোককে তো সে জিজ্ঞেস করেনি- তাদের সর্বোচ্চ চাওয়া কি? কত ভাষা-ভাষীর, কত চাষা-মজুর, কত মুটে-সাহেব, কত সাদা-কালো, কত জ্ঞানী-গুণী, সাধক, ভন্ড, নিবোর্ধকে সে জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু কেউ সঠিক ভাবে, নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেনি যার যার আপনার সর্বোচ্চ চাওয়া কি? কেউ বা বলেছে টাকা, কেও বা বলেছে প্রভাব-প্রতিপত্তি, কেউ বা বলেছে নারী, গাড়ী, বাড়ী ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার পরক্ষণেই বলেছে না, না, টাকা না সম্মান আমার বেশি চাই অথবা সম্মান না সৌন্দর্য আমার লাগবে। কেউই নিশ্চিত নয় তার চাওয়া সম্বন্ধে। মানুষের শুধু চাই চাই কিন্তু কেন চাই, কিসের জন্য চাই, কত চাই জিজ্ঞেস করলে উত্তর নেই।

এভাবে পথ চলতে চলতে একটা সময় লোকটা বুঝেছে মানুষ হয়তো জানেই না সচেতন ভাবে তার সর্বোচ্চ চাওয়া কি? পরক্ষণেই আবার সে ভেবেছে তাহলে মানুষ অবচেতন ভাবে কোনো কিছু কে সর্বোচ্চ কামনা করে। তাহলে সেটা কি? সেটা জানার উপায়ই বা কি? উপায় খোঁজার জন্য দিশাহীনভাবে আবার সে পথ চলতে থাকে। সে চলার কোন শেষ নেই।

কিন্তু একদিন, একদিন, যেদিন দুপুর না হতেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে, সাপের মতো ফণা তোলে সমুদ্রের বিশাল ঢেউ, গাছগুলো সকল লজ্জা ভুলে দিনের আলোতেই আচঁল উড়িয়ে দেই ঊর্ধ্বপানে, বিল্ডিং আর ঘরবাড়িগুলো এখনি ছিন্ন হয়ে যাবে এই ভয়ে থাকে সেই উত্তাল সময়ে তার হৃদয় সন্ধান পায় সেই, সেই কাঙ্খিত উপায়।

কাঙ্খিত উপায়টি হলো- এক কথায় স্বর্গ। ধর্মাবলম্বীরা ইহকালের শেষে পরকালে স্বর্গ পায়। স্বর্গ হলো সে স্হান যেখানে মনের সব ইচ্ছা পূরণ করা হয়। মানুষের যখন ইচ্ছা পূরণের সুযোগ আসবে তখন সে সর্বপ্রথম কোনো ইচ্ছা পূরণ করবে। সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তু। এটাই স্বাভাবিক। আর সেই চাওয়াটাই হলো মানুষের সর্বোচ্চ চাওয়া।

লোকটা ভাবতে থাকে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সে এখন মৃত্যু ছোঁয়া দূরত্বে। তাই সে মৃত্যুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে।।

সাদা সাদা কুয়াশায় ঢাকা সিঁড়িটি। চারপাশে একটা নিথর, শান্ত, পবিত্র ভাব। লোকটা একটা সিড়িঁটে একটু থামলেন। বুক পকেট থেকে আধখাওয়া একটা সিগারেট আবার ধরালেন। একটা টান দিয়ে আনমনে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। সিঁড়ির শেষ মাথায় একটা লোহার দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজার ও পাশেই স্বর্গ।

একটা সময় লোকটা শেষ সিঁড়িতে এসে পৌছাঁয়। সে হাপিয়ে উঠেছে তাই একটু ঝিরিয়ে নেয়। পকেট থেকে চিরুনি বের করে সে তার চুল আঁচড়ায়। তাকে অতটা ক্লান্ত লাগছে না সে মনে মনে ভাবে। সে বিস্মিত হবার জন্য, একটা বিস্ময় কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে স্বর্গের দরজায় হাত রাখে। এই সেই কাঙ্খিত স্বর্গ, যার জন্য এতো আরাধনা, এত সাধনা, এত ত্যাগ যেখানে মানুষের সব্বোর্চ চাওয়া পূর্ণ হয়, সে স্হানে বিস্ময় কিছু তো থাকবেই, যা এতোদিন মানুষের কল্পনার বাইরে ছিলো, সেখানে রঙের ফোয়ারা ফুটবে, পথে পথে বিছানো থাকবে গোলাপের পাপড়ি, এসব ভাবছিলো লোকটা। কিন্তু স্বর্গের দরজা খুলে যেতেই তার মুখ হা হয়ে গেলো। সে একি দেখছে। যেখানে অবাস্তব অবাস্তব জিনিস দেখে তার বিস্মিত হওয়ার কথা সেখানে এতো চেনা জানা আপন পরিবেশ দেখে সে থতমত হয়ে যায়। সে অবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ কি করবে সে বুঝতে না পেরে একইভাবে দাড়িঁয়ে থাকে সে? তারপর সে তার বুক পকেট থেকে কলমটা আশেপাশে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে আর নোট নিতে থাকে।

একখানে দেখছে, এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক তার মেয়েকে নিয়ে তুষারাবৃত পথে শুধু হাটঁছৈ, শুধু হাঁটছে। আর ছোট্ট মেয়েটা তার ছোট্ট হাতে তার বাবার কুনোই আঙ্গুল ধরে আছে। তখন সে ভাবে তাহলে এ ভদ্রলোকের সর্বোচ্চ চাওয়া ছিলো তার ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো।

একটা লোক বারবার জম্মগ্রহণ করছে। সে বড় হচ্ছে। একই কাজ বারবার করছে। একই ভুলগুলো বারবার করছে। গোধূলি বেলায় বৃদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। তখন সে ভাবে তাহলে এ ভদ্রলোকের বিগত যাপিত জীবন যাপন করাই তার সবচেয়ে প্রিয়।

এভাবে ঘুরে ঘুরে সে স্বর্গ দেখে বেড়ায়। ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে বসে। সে তার হাতে ধরা নোটবুকটা খুলে দেখে। সেখানে আজ অনেক নোট নেওয়া হয়েছে। সে একটা লেখা একটু পড়ার চেষ্টা করে, দেখতে নোট হিসেবে সে কি লিখেছে তখন। মাথার উপর ডালে একটা রঙিন কিন্তু ভীষণ নীল পাখি লেজ উঠিয়ে হঠাৎ ডেকে ওঠে। আচমকা ডাকে সে বিস্মিত হয় এবং তখনই তার সর্বোচ্চ চাওয়া কি তা জানতে ইচ্ছে করে লোকটার। সে যখন পৃথিবীতে ছিলো তখন সে পথে পথে শুধু হাটঁতো আর নোট নিতো এখন স্বর্গে এসে সে একই কাজ করছে। এই অদ্ভুত মিলটা খুঁজে পেয়ে সে একটু প্রসন্ন বিস্মিত হাসি হেসে তার লাল মলাটের ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে।