রিকশাটা থেমে গেল। থেমে গেল একেবারে রূপমতি ব্রীজের গোড়ায়। গেল কোথায় টোকাইগুলো? অন্যদিন এই সময় অনেক ছেলে-পেলে থাকে সেতুর গোড়ায়। ওরা ঠেলে দেয় রিকশা একেবারে ব্রীজের খাড়া ধারের মাঝ বরাবর। তার বদলে পয়সা পায়- টাকা কামায়। রিক্সাওলা রমিজ সন্ধানী চোখে বার কয়েক এদিক ওদিক তাকায়। নাহ্‌, কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। ঢাকা শহরের এই বড় সেতুটার নীচ দিয়ে চলে গেছে যে খালটা তার নামও রূপমতির খাল। কি কাজে যে এইটার নাম রূপমতির খাল হয়েছিল বুঝতে পারে না রমিজ। এর ভিতরে রূপের কি আছে আল্লাই জানে। চৈত মাসের হালকা গরম বাতাস খানিকটা বাস সাবানের গন্ধ এনে রমিজের নাকে ঢেলে দেয়। আবার খানিক বাদে খাল থেকে ভেসে আসে পুরোন পঁচা কাদার গন্ধ। এগুলো সব ভদ্দর লোকদের গন্ধ। বুঝতে পারে রমিজ। একদলা থুথু পায়ের কাছে ফেলে স্বস্তি পায়। খালটা আসলে অনেক লম্বা। শহরের সেই চকচকে অঞ্চল থেকে তাবৎ ময়লা-নোংরা-কলংক ধুয়ে মুছে খালটা অতঃপর বয়ে চলেছে সোজা, কখনও একে বেকে নানান জাত পাতের ছোট লোক দের ঘর গেরস্থলির পাশ দিয়ে সবশেষে পড়েছে গিয়ে বুড়িগঙ্গার উদরে।
– কি হলো, রিকশাওলা ভাই?
রিকশার আরহী মহিলা ঝাপির ভেতর থেকে কৌতুহলে গলা বের করে দিল। সে জানে কেন এখানে রিকশাটা থেমে গেছে। তারপরেও কিছু একটা বলতে হয়, তাই প্রশ্ন করা। কথা বললে সাহস বাড়ে বুকে। একা একা ভাবটা কেটে যায়। একা লোকের কপাল মন্দ হয়- বিপদ বাড়ে। যা দিন কাল পড়েছে সাবধানে চলা ভাল।

রিকশার আরোহী সাহারা খাতুন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। পরিপাটি সাজগোজের কোথায় যেন একটা ইষৎ দুর্বলতার ফুটো দিয়ে তার সত্যিকার বয়সটা হড় হড় করে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। তবে প্রথম দর্শনে তাকে বাইশ কিংবা তেইশ মনে হলেও হতে পারে। সখের সমাজকর্মী- কাজের তাকিদে চলেছে কোন নির্ধারিত গন্তব্যে। পেটের তাকিদ নেই। বন্ধু পরিজনদের জৌলুশের সামনে দাড়িয়ে যেন সে বলতে পারে- আমি কিন্তু ফেলনা না। এসব দরকারেই কাজটা নেয়া। সাতপুরুষ ধরে বসে বসে খেলেও তার উকিল বাপের তামাম সহায় সম্পদ ফুরোবে না। জীবনটা তার রাগপ্রধান সংগীতের মতন মসৃন ভাবে বয়ে চলেছে, সেটা তার চেহারা দেখলেই ধরা যায়।

বেশী সময় অপেক্ষা করতে হলো না। কোথা থেকে দৌড়ে এলো এক হতচ্ছড়া টোকাই।
-এই তোরা কই গেছস রে?
রিকশাওলার মুখে বিরক্তি স্পষ্ট হয়। যাত্র্রী নিয়ে এত সময় বসে থাকাতে সেই বিরক্তি তেঁতে গিয়ে রাগ হয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাবে বসে থাকলে তার ব্যাবসার বারোটা বাজবে।
– হগলডি বলখেলা দেখবার গ্যাছে ইষ্টিডিয়ামে। আমি যাই নাই।
কথা বলা আর রিকশা ঠেলা একসাথে চলতে থাকে টোকাইএর। যাত্রী ভাব জমানোর চেষ্টা করে ইচড়েপাকা বালকের সাথে। মানুষের সাথে কথা বলাই তো তার কাজ।
– কেন, তুমি যাওনি কেন?
সাহারা খাতুন প্রশ্নকরে, সাথে ছদ্ম-স্নেহ। টোকাইরা স্নেহের কাঙাল হলেও সহজে তাতে ধরা দেয় না।
-কি করুম আফা। পেডের জ্বালায় কাম করি। খেলা দেখতে গেলে প্যাড চলবো? খালি হাতে বারিত গেলে চাচী ঠ্যাংগাইবো না!
– কেন, তোমারা বাবা-মা নেই?
– আছে, হগ্গলে আছে। তয় বাজানে এক হারামী বেডিরে বিয়া করছে। আমার মায়রে তালাক দিছে।
– আর তোমার মা?
কয়েক মুহুর্ত নীরব হয়ে যায় বেওয়ারিশ বালক। কত আর বয়স হবে- এই দশ-এগার। পরনে একটা ময়লা বেসাইজ হাফপ্যান্ট, গায়ে শতছিন্ন হাফশার্ট, তার বুকটা খোলা। একটাও বেতোম নেই তাতে। চৈত মাসের হালাকা বাতাসে থেকে থেকে হাড় বেরুনো শরীরটা উদোম হয়ে পড়ছে। সাহারা খাতুনের চোখের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে পথশিশু। বিশুদ্ধ দার্শনিকের মত ডান হাতের তর্জনি দিয়ে যাত্রীর কথার উত্তর দেয়। একবার বুক পকেটের দিকে আরেকবার বাঁকা ব্রিজের চুড়ার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে। বালকের কথার ভেদ বুঝতে পারে না সমাজকর্মী। শতছিন্ন জামাটার শক্ত-মজবুত পকেটের ভেতরে হাত চালিয়ে অনেকগুলো ভাজকরা কাগজ বের করে আনে টোকাই। সেগুলোর ভেতর থেকে একটা ময়লা শক্ত কাগজ মেলে ধরে সে সাহারা খাতুনের চোখের সামনে।
-এইডা আমার মায়ের ফুটু। আমার সাথে থাহে সব সময়। কেন রাহি এইডা জানেন?
কেন রাখ?
-কারন আমার মায়েরে আমি জবান দিছিলাম- মা, তরে আমি কখনই ছাইরা যামু না।
-সেটা কিভাবে? ফটো কখনও আসল মা হতে পারে?
আরোহীর প্রশ্ন শুনে গান্ধার মুর্তির মতো রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে ছন্নছাড়া বালক নিস্পলক। হঠাত করে কন্ঠ তার বেজে উঠে।
-ঐ যে আফা দেহেন, ঐ যে রিকশাডা আইতাছে, ঐ হানে আমার মায়েরে চাপা দিছিল একটা টিরাক।
অবাক হয় রিকশার যাত্রি। এতবড় একটা করুন ঘটনার কথা বলছে ছেলেটা, কিন্তু তার মুখে এতটুকু দুঃখ-শোকের স্পর্শ নেই। সে এতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে কিভাবে?
-তারপর কি হলো?
-আর কি হইবো আফা! হেইত্থেকা আমার এক চাচী আমারে পালে। যেদিন ট্যাহা আনতে না পারি ঠ্যাংগানী দেয়।
-তুমি আমার সাথে চলো। তোমাকে আমি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। খাওয়া পরার সব ব্যাবস্থা হবে সেখানে।

ততক্ষনে টোকাইয়ের কথা বলা আর রিকশা ঠেলার কাজ শেষ হয়ে এসেছে। রিকশা প্রায় বাকা ব্রিজটার চুড়ায় পৌছে গেছে। চিৎকার করে কথা বলে উঠলো ছন্নছাড়া বালক।
-না, আমি কোত্থাও যামুনা। ছোড বেলায় আমার মায় কইছিল- বাজান, তোর বাপের মত তুই আমারে ছাইরা যাবিনা, কতা দে। আমার মায়রে আমি কতা দিছিলাম। এই ব্রিজে আমার মায় আছে। হ্যারে ছাইরা আমি কোত্থাও যামুনা।
এক ফোটা পানি নেই ছিন্নমূল বালকের চোখে, কিন্তু কন্ঠ তার হঠাৎ কেপে ওঠে অচেনা আবেগে। যাত্রীর কাছ থেকে মজুরী না নিয়ে দ্রুত পায়ে পালিয়ে যায় দৃষ্টির অন্তরালে। কিন্তু সাহারা খাতুন চোখের পানি আটকাতে পারেনা। তারা অল্প শোকে কাতর হয়। রুপালী পর্দার শোক দেখেও তারা রূমাল ভিজিয়ে ফেলে। উচ্চাঙ্গ ছন্দে গড়া সাহারা খাতুনদের জীবন। সে জীবনের ছায়া কোন দিনও এসে পড়বে না দৈবাৎ টোকাইদের শুকনো খটখটে জীবনে। চোখের জল মুছে ফেলে সাহারা খাতুন। মাঝে মাঝে মন তার বড্ড বেশী অবুজ হয়। কোলের উপরে যত্নে রাখা দামি ভেনেটি ব্যগের ভেতর থেকে ছিন্নমূল শিশুদের উপর তার বারো’শ পঞ্চাশ পাতার গবেষনা পত্রটা বের করে সে। ওদিকে মন দেয় সহসা। গন্তব্যে তাকে পৌছাতেই হবে। তার জন্য তথ্য চাই- আরও তথ্য। রং বেরং-এর নানা মুখী বাস্তবতা লাগাম তুলে দেয় সমাজসেবীর অবুঝ মনে। তা সত্তেও বিকেলের উদাসীন বাতাস ব্যাথাতুর করে রেখে যায় সমাজকর্মীর দেহ-মন।

সেতুর নীচে খালের কোল বরাবর গজিয়ে উঠেছে মাঠ- খাস জমিন। সেখানে সামিয়ানা খাটিয়ে মচ্ছব বসেছে রাজনীতির। মাইকের তীক্ষ্ণতায় ভর করে কোন এক নেতার বড় গলা আরও বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বসন্তের বাতসে। বেওয়ারিশ টোকাইদের অজানা অচ্ছুত নানা ব্যথার গন্ধও কোন না কোন ভাবে সে বাতাসে ছড়িয়ে যায় চুপি চুপি। বসন্তের বাতাস শুধু ব্যাথাই বয়ে আনে না, সেতুর পাশের খোলা মাঠের মেঠো বক্তার রাজনীতির প্রতিশ্রুতিও সে বয়ে আনে। খালের নষ্ট পঁচা কাদার গন্ধের সাথে সেসব প্রতিশ্রুতি মিলে মিশে চৈতমাসের বাতাসকে নিঃশ্বাসের অযোগ্য করে তোলে।