তাং-১৪/০৯/১১

কারবারী,

পত্রে আমার শুভেচ্ছা নিবেন। আশাকরি পাড়ার সকলকে নিয়ে ভাল আছেন।
পর বার্তা আগামী ১৮/০৯/১১ ইং রোজ রবিবার সকাল ১০.০০ ঘটিকায় ক্যাম্প গণসংযোগ মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত মিটিং এ আপনী হাজির থাকবেন।

বি:দ্র: ০৫ কেজি মোরগ নিয়ে আসবেন।

ক্যাপ্টেন
ক্যাম্প কমান্ডার
মদক বিওপি
(স্বাক্ষর-অস্পষ্ট)

বান্দরবানের দুর্গম থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর বর্ডার অবজার্ভিং পোস্ট (বিওপি)-এর ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন রশিদ-এর পত্র এটি। বানানরীতি হুবহু রাখা হয়েছে। তিনি এই পত্রটি লিখেছেন স্থানীয় একজন মারমা আদিবাসী পাহাড়ি গ্রাম প্রধানকে (কারবারী)।

এই লেখকের নিজস্ব সূত্রে পাওয়া পত্রটির একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, তারিখ ও স্বাক্ষর বাদে মাত্র পাঁচটি বাক্যের এই হাতচিঠির শেষ দুটি বাক্য সরাসরি আদেশ :

উক্ত মিটিং এ আপনী হাজির থাকবেন। বি:দ্র: ০৫ কেজি মোরগ নিয়ে আসবেন।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ও সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী অস্র সমর্পনের মাধ্যমে বিলুপ্তির দেড় দশক পরেও পাহাড়ে যে নির্ভেজাল সামরিক শাসন চলছে, ওই হাতচিঠিটি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নইলে সীমান্ত রক্ষার মহান ব্রত বাদ দিয়ে একজন শাসকের কায়দায় তিনি ‘ক্যাম্প গণসংযোগ মিটিং’ এর এখতিয়ার রাখেন কী ভাবে? শুধু তাই-ই নয়, পাহাড়ের এক সময়ের সামন্ত প্রভু রাজাদের সঙ্গে দেখা করতে এলে কারবারী বা হেডম্যানদের (মৌজা প্রধান) জোড়া মোরগ, দু-এক বোতল মদ ভেট হিসেবে নিয়ে আসতে হতো। ক্যাপ্টেন রশিদের ‘০৫ কেজি মোরগ’ নিয়ে আসার আদেশ সেই সামন্ত-অবশেষ বন্দুকবাজীর কথাই মনে করিয়ে দেয়।

যারাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সর্ম্পকে খোঁজ-খবর রাখেন, তারাই জানেন, শান্তিচুক্তিতে তিন পার্বত্য জেলায় ছয়টি সেনা নিবাস ছাড়া সকল অস্থায়ী সেনা ছাউনি প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি লংঘন করে এখনো সেখানে দাপটের সঙ্গেই চলছে সেনা বাহিনীর ‘অপারেশন উত্তরণ’। এখনো সেখানে প্রায় সাড়ে ৪০০ অস্থায়ী সেনা ছাউনি বহাল বহাল রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ড়্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি ও বনরক্ষী বাহিনীর অসংখ্য স্থায়ী ও অস্থায়ী ছাউনি। শান্তিচুক্তির আগে সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে এই সব নিরাপত্তা বাহিনী ও পাহাড়ে অভিবাসিত বাঙালি সেটেলাররা অন্তত ১৩ টি গণহত্যায় সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে।

সে সময় ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনী দিয়ে কসাইয়ের মতো দা দিয়ে কুপিয়ে, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝড়া করা হয়েছে শত শত নিরীহ আদিবাসী পাহাড়ি।… লোগাং, লংগদু, ন্যান্যাচর, বরকল, কাউখালি, দীঘিনাল, পানছড়িসহ একের পর এক গণহত্যায় নিভে গেছে শত শত আদিবাসীর তাজা প্রাণ। সহায় সম্বল সব কিছু ফেলে জীবন বাঁচাতে প্রায় ৭০ হাজার পাহাড়িকে একযুগ শরণার্থীর গ্লানিময় জীবন বেছে নিতে হয়েছিল ত্রিপুরার আশ্রয় শিবিরে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি সাক্ষরের পরেও প্রত্যক্ষ সেনা মদদে অন্তত ১৪ টি সহিংস ঘটনায় পাহাড়িরা আক্রান্ত, খুন, ধর্ষণ ও ঘর-বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। বাঘাইছড়িতে এই সেদিনও সেনা-সেটেলার যৌথ অভিযানে পুড়েছে প্রায় ৩০০ পাহাড়ি ঘরবাড়ি, নিহত হয়েছেন দু’জন। এরপরেই রামগড় সহিংসতায় নিহত হয়েছেন তিনজন বাঙালি, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, মারপিট ও জখম করা হয়েছে আরো অসংখ্যজনকে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, এই সেনা-সেটেলাররাই পাহাড়ের হর্তা-কর্তা-অধিকর্তা। তারাই সেখানের প্রধান প্রশাসন, রাষ্ট্রের ভেতর আরেক তালেবান রাষ্ট্র। …

আর এসবই সেনা বাহিনী করছে, লেফটেনেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে জারি করা ছয়-ছয়টি ‘ইনসার্জেন্ট অর্ডার’ বলে, যা শান্তিবাহিনী বিলুপ্তির দেড় দশক পরে এখনো কার্যকর!

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন বাংলাদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান — এই তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে বিন্যস্ত পাঁচ হাজার ৯৩ বর্গমাইল এলাকার পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে প্রায় ১৪ লাখ লোক বাস করেন। ১৯৮১ সালে পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ির সংখ্যা ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বাঙালি ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সেখানে ৫১ শতাংশ বাঙালি ও ৪৯ শতাংশ পাহাড়ির বসবাস। সর্বশেষ ২০০১ সালের হিসাবে ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি সেখানকার বাসিন্দা।


আরো পড়ুন: লেখকের ই-বুক, ‘রিপোর্টারের ডায়েরি: পাহাড়ের পথে পথে’, মুক্তমনা ডটকম।