কাঁদো-বাঙ্গালী কাঁদো। কাঁদো শিরচ্ছেদকৃত আট হতভাগ্য শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্য। যারা পরিবারের মুখে হাসি ফোটার জন্য, এক মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য বিদেশ বিঁভুইয়ে দৈহিক শ্রম বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের জন্য গিয়েছিল।

বিগত ০৭/১০/১১ইং তারিখ রোজ শুক্রবার তথাকথিত হত্যা ও ডাকাতী মামলায় ৮ জন বাংলাদেশী শ্রমিকের শিরচ্ছেদের রায় কার্যকর করা হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে, দেশটি সৌদি আরব। ইসলামী বিশ্বের মুরব্বী রাষ্ট্র।
দন্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকগনকে যথাযথ আইনী সহায়তা দেওয়া হয়নি মর্মে গনমাধ্যমে প্রকাশ। উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পায়নি শ্রমিকগন। বিচার প্রক্রিয়া চলে আরবি ভাষায়। সেখানে দো-ভাষী নিয়োগ করা হয়নি। ফলে অল্প শিক্ষিত , অশিক্ষিত শ্রমিকরা তাদের প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করতে পারেনি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় যে, বিচার প্রক্রিয়া ছিল একতরফা।

বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি দন্ড প্রাপ্ত শ্রমিকদের প্রাণ ভিক্ষাচেয়ে সৌদি সরকারের নিকট আবেদন করেন, পরারাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে। রাষ্টপতির আবেদন সৌদি সরকার নাকচ করে দেন। শ্রমিকগনের শিরচ্ছেদের রায় কার্যকর করা হয় দিবালোকে। যারা ইর্ন্টারনেটে শিরচ্ছেদের ভিডিও দেখেছেন তারাই বলতে পারবেন কি নির্মম, বর্বর ভাবে শিরচ্ছেদ কার্যকর করা হয়েছে, তাহা আদি যুগের বর্বরতাকেও হার মানায়।

পৃথিবীর অনেক দেশে দন্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার বিধান আছে। আবার অনেক দেশে যাবত জীবন অথবা নির্জন দ্বীপে নির্বাসনের বিধান আছে বলে জানা যায়। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থা গুলি হত্যার বিরোধী। কথাও কোন প্রকার মানবাধিকার লংঘিত হলে তারাই হৈচৈ চেচামেচি শুরু করেন দেন। তাদের কর্মকান্ড চোর পালাইলে বুদ্ধি বাড়ে এই রুপ। এই ভাবেই তারা দায় মুক্তি চান। অথবা তাদের করার কিছু থাকে না। আশার কথা এই টুকু যে, এই ভাবেই মানুষ কিছুটা প্রতিবাদী হচ্ছে। বাস্তবতা উপলদ্ধি করছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশণ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও ব্যথিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা দারুন ক্ষুদ্ধ। তাতে ঐ মৌলবাদী রাষ্ট্রটির টনক নড়েছে? না নড়েনি। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশণ কে সৌদি সরকার একটুও পরওয়া করেননি। কার্যক্রমে মনে হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ঠুঁটো জগন্নাত। প্রতিবাদ ছাড়া করনীয় কিছু নাই। এই ভাবে মানবাধিকার বাস্তব রুপ পেতে পারে না। তার প্রমান বিগত ১১/১০/১১ ইং তারিখে কালের কন্ঠ প্রত্রিকায় প্রকাশিত সৌদি রাষ্ট্র দুতের দেওয়া ভাষনের একাংশ। তিনি সাংবাদিক গনের এক প্রশ্নে জবাবে বলেন যে, মানবাধিকার আল্লাহর আইনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে পারে না। নর হত্যার বদলে হত্যায় নিহতের হক আছে। এক্ষেত্রে কিসাস কার্যকর করা হয়েছে।

ইসলামী হত্যার বদলে হত্যা অনুমোদিত। আল কোরানের শুরা আল মায়েদা আয়াত (৪৫) এই দেখুন, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, কানে বদলে কান, দাতের বদলে দাত নেওয়ার বিধান আছে। আর এই বিধান অমান্য কারীরা জালেম। এই হলো ববর্তার উৎস। আল কোরানের উৎস্য হতে আরব এবং মধ্য প্রাচ্যের কয়েকটি ইসলামী রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন থেকে শিরচ্ছেদ চলছে। ইসলামী তথা আল্লাহর বিধান মতে। যাহা হউক সৌদী রাষ্ট্রদুতের জবাবে একটি প্রশ্ন আসে যে, একজন খুনের জন্য যে ৮ জনের শিরচ্ছেদ করা হলো তা কি যুক্তি সংগত হয়েছে? স্রষ্ঠা কি তাহা হলে তার সৃষ্টিকে এই ভাবে বরর্তার দিকে উস্কে দিয়েছে ? স্রষ্ঠা কি এত বর্রর ? স্রষ্টা থাকলে বা বিধানটি স্রষ্টার হলে সৃষ্টিকে এই ভাবে বরর্তার দিকে উস্কে দিতে পারে না। আইনটি মানুষের সৃষ্টি। যাহা স্রষ্টার বিধান মতে মানুষকে ধোকা দেওয়া হয়েছে।
এখানে আর একটি কথা বলতে হয় যে, আদিকাল হতে মধ্য যুগ পর্যন্ত ভাববাদ প্রচারে ভাববাদী গুরুরা যে মানবাধিকার লংঘন করেছেন। কথিত ঈশ্বরের নামে। তাহা কাল্পনিক এবং অমানবিক। বর্তমানে যুগে ঐ কার্যকলাপ পরিচালিত হলে, মানবাধিকার লংঘন সহ হত্যার অভিযোগে ভাববাদী গুরুদের মহাশাস্তির ব্যবস্থা হতো আর মানবাধিকার থাকার জন্য তারা শিরচ্ছেদ থেকে রক্ষা পেত। যে বিধান মানবতা বিরোধী, যেখানে মানবতা নাই, সেই বিধানকে কি ভাবে ঐশ্বরিক বিধান হিসাবে মেনে নেওয়া যায় ?
শ্রমিক গনের শিরচ্ছেদের ঘটনায় বিশ্ব ব্যাপী ক্ষুদ্ধ এবং ঘৃনিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সাংবাদিক লেখক বুদ্ধি ও রাজনীতিবিদগন তাদের লেখার মাধ্যমে নিন্দা এবং প্রতিবাদ করেছেন। ঐ সকল বুদ্ধি জীবিগন জাতির বিবেক। তারা জাতিকে আলোর পথ দেখান। জাতি তাদের কাছে ঋনী। সাংবাদিক লেখক তথা বুদ্ধিজীবি গনের লেখায় দেখা গেল যে, উনারা দায় মুক্তির জন্য লিখেছেন। নিন্দায় প্রতিবাদ করে তাঁরা জাতির নিকট দায় মুক্ত হতে চেয়েছেন।

দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায়, সময়ের প্রতিন্ধনি কলামে শিরচ্ছেদ মানবতা বিরোধী শিরোনামের লেখাটি পড়লাম। পৃষ্টানং ১৬ তারিখ ১২/১০/১১ইং লেখাটি সুনাম ধন্য কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব মোস্তফা কামাল সাহেবের।

তিনি উক্ত কলামে শিরচ্ছেদের তীব্র নিন্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেছেন শিরচ্ছেদ মধ্য যুগের বর্বর বিধান। পবিত্র ভুমিতে মানবতা বিরোধী বর্বর ঘটনাটি কোন ভাবে সমর্থন যোগ্য নহে। এই ধরনের শাস্তি দেওয়া হতো মধ্য যুগে। বর্তমান যুগে এই ধরনের বিধান অগ্রহন যোগ্য। ইসলাম মানবতার ধর্ম। ধর্মের দোয়াই দিয়ে মানবতা বিরোধী কাজ চলতে পারে না। মানবতা বিরোধী আইনের আমরা ঘোর বিরোধী।

লেখক একজন মুসলমান। ধর্মের তাঁর অটুট বিশ্বাস আছে। ইসলামে যদি তার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বোধ থাকে, তবে তিনি কিভাবে আল কোরআনের বানী তথা আল্লাহর বিধানকে বর্বর বলেন। ঐ বিধানটি তো আল্লাহর। তিনি আল্লাহর বিধানকে বর্বর বলেছেন, প্রশ্ন আছে যে, বিধান ববর হলে বিধায়ক কি হবে?

শিরচ্ছেদ মানবতা বিরোধী প্রবন্ধে কলামে আরো কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। যেমন আইনটিকে মধ্য যুগের তথা আদি যুগের বলেছেন তিনি। তাই এখানে প্রশ্ন আসে যে, তবে কি স্রষ্টা আদি যুগের, মধ্য যুগের এবং আধুনিক যুগের হয় ? লেখকের প্রবন্ধের আর একটি বিষয় হচ্ছে যে, তিনি ইসলামকে সবচেয়ে মানবিক বলেছেন। বক্তব্যটি মৌলবাদী আঙ্কিকের হয়েছে। সব ধর্মের মৌলবাদীরা নিজ নিজ ধর্ম কে সবচেয়ে মানবিক বলে দাবী করেন। এ যেন বিক্রেতার পন্য বিক্রির মত। বিক্রেতা তার পন্যকে সর্বদাই ভাল বলেন। ভাববাদ প্রচারের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যায় শুরুতে সকলেই বেশি বেশি মানবাধিকার লংঘন করেছেন। ভাববাদে এক মানুষকে আরেক মানুষের শক্র রুপে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে মানুষে মানুষে ঘোর শক্রতা শুরু হয়েছে। খুন, খারাবি, হত্যা, ধর্ষন তৎকালে দৈনদিন ঘটত। এই তো গেল আদি ও মধ্য যুগের অবস্থা। আর বর্তমানে যুগে ঐ একই অজুহাতে উগ্রভাববাদিরা যে কত শত মানবতা বিরোধী কর্মে লিপ্ত তাহা বিশ্বের হাওয়ায় পাওয়া যাচ্ছে। যাহা হউক সৌদী আরবে ৮ বাংলাদেশী শ্রমিকের শিরচ্ছেদ বিষয়ে, এ দেশের বিভিন্ন জাতীয় এবং আঞ্চলিক পত্র পত্রিকায় বহু লেখক সাংবাদিক এবং বুদ্ধি জীবিগন তাদের মুল্য বান লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান। ঐ সকল গুনি মানুষের লেখার ধরন আর প্রতিবাদের ভাষা ভাববাদী গুরুদের মত বোকাকে ধোকা দিচ্ছেন বলে প্রতিয়মান হয়।

আমাদের লেখক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিগণের ক্ষোভ ও নিন্দাজ্ঞাপনের এই রুপ। দোষ করে বছির আর থাপ্পর খায় কছির। তাদের বক্তব্য মানবতার কাছে প্রতারণার শামিল বলে মনে হয়। উনারা দায়সারা গোছের বক্তব্য দিয়ে জাতির নিকট হইতে দায় মুক্তি চাচ্ছেন। বাস্তব সত্যকে পাশ কাটিয়ে সস্তা বুলি দিয়ে দায় মুক্তির চিন্তা করছেন। উনারা কি একবারো ভেবে দেখছেন না যে, যে, অপরাধে ছেলে কে দোষারুপ করা হচ্ছে সে দোষ ছেলের নয় ছেলের বাপের। উনারা এই বাস্তব সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এই ভাবেই আদিকাল হতে সমাজে কিছু কিছু মানুষ বাস্তব সত্যকে পাশ কাটিয়ে সাধারন কে ঠকাইতেছেন। এই ভাবেই সমাজে প্রতারনা চলছে। আর কতকাল চলবে। মানবাধিকার কি কোন দিন আলোর পথ দেখবে না ?
(চলবে)