মাথার উপরে সূর্য্যটা যেন গনগনে আগুনের গোল্লা । বাতাসের আসা যাওয়াটারেও কে যেন থামিয়ে দিয়েছে গায়ের জোরে। গুমোট হাওয়ার অত্যাচারে গায়ের ঘাম গায়েই থেকে যায়। সূর্য্যটা মনে হয় মাথার এক বিঘত উপরে চলে এসেছে। আসমা খাতুন তার এই পয়তাল্লিশ বছরের জিন্দেগীতে এমন গরম দেখে নাই। কেয়ামত বুঝি এসেই গেল। হবে না কেন- মানুষ কি আর ঠিক আছে! যত দিন যাচ্ছে মানুষের ক্ষিদে বাড়ছে তত বেশী। শুধু পেটের ক্ষিদে হলে কথা ছিল না। হাজার কিছিমের চাহিদা এসে শরীরে বাসা বেধেছে। পাঁচ হাত শরীরে একশ হাত ক্ষিদে। এখন নাকি বয়স ঢেকে রাখার জন্যও বিদেশী তেল-পানি, শ্নো-ক্রিম লাগানোর দরকার হয়। আরও কত রকমের দরকার যে আছে তা একমাত্র খোদা-তালাই জানে। এই এত এত বেদাতী ক্ষিদে মিটাতে গিয়েই তো দিনদিন খোদার দুনিয়াটা বিগড়ে যাচ্ছে। সূর্য্যের আর কি দোষ। মাথার উপরে আগুন ঢালা তার কাজ, তাই সে করে যাচ্ছে। রিকশার ঝাপির পাশ দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকায় আসমা খাতুন। সেখানে একফোটা সাদা বা কালো মেঘ চোখে পড়ে না। কিন্তু কুয়াশার মত কি এক জিনিস চোখের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেয়। গরমের দিনে এ আবার কি আপদ।
রিকশায় করে আসমা খাতুন চলেছে ছেলের স্কুলে। হেডমাষ্টার সাহেব ডেকেছেন। তিন বছর ধরে ছেলের লেখাপড়ার ফলাফল খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সে সব ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চান প্রধান শিক্ষক। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে হঠাত করে হৃদরোগে মারা যায় আসমা খাতুনের স্বামী। তার স্বামীর যে ছোট্ট ব্যাবসাটা ছিল তা দিয়ে সংসার চলতো মোটামুটি। ছেলে পাভেলকেও ভর্তি করান হয়েছিল ভাল স্কুলে। একমাত্র ছেলে, তাও আবার তাদের বেশী বয়সের সন্তান। বাবা মা কেউই তাই ছেলের আদর যত্নে কমতি রাখে নি। স্বামীর খরচের হাত ছিল। কোন সঞ্চয় রেখে যেতে পারেনি- শুধু হাতির পুলে তিন কাঠা জমির উপরে ঐ আধাপাকা বাড়ীটা ছাড়া। সেটাই এখন আসমা খাতুনের একমাত্র সম্বল। শুধু বাড়ী তো সব না। সংসারে আছে আরও অনেক দাবী। সেই সব দাবী মেটাতে ঘরে বসে সেলাই এর কাজ নিয়েছে সে। সে সব করে আগে বেশ ভালই চলতো। কিন্ত বছর দুয়েক হলো আর পেরে উঠছে না অসহায় বিধবা। আগে যখন সকাল বিকেল তিন চার ঘন্টা কাজ করলে চলে যেত, এখন সেখানে আট দশ ঘন্টার খাটুনীতেও কুলায় না। বয়সও বেড়ে চলেছে। আর কত। ছেলে যত বড় হচ্ছে, তার চাহিদাও তত বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার মত। শুধু খাওয়া-পরা, লেখাপড়ার খরচ হলে তো হতো। ছেলের সখ আর বেদরকারী চাহিদার যাতায় পিষ্ট হয়ে হাপায়ে উঠে বিধবা। বাপমরা একমাত্র সন্তানের চাহিদায় লাগাম দিতে গিয়ে স্নেহের দড়িতে টান পড়ে আসমা খাতুনের। হবেনা কেন, তার ছেলেওতো এই সময়ের মানুষ। দুনিয়ার বেবাক মানুষের এই সব লাগামছাড়া বেদাতী ক্ষিদের চেহারা ভাবনায় ধরা দেয় আসমা খাতুনের। নাকের দুই পাশে তার বিরক্তির রেখাটা দৃশ্যমান হয়ে উঠে সহসা। রিক্সার উপরে আর কত সময় বসে থাকা যায়। এ যাত্রা বুঝি শেষ হবার নয় । তার উপরে আছে রিক্সার আছাড়ি বিছাড়ি। ঝাল-পেয়াজ-তেল দিয়ে যেন মশল্লা মুড়ি মাখছে- যে মরার রাস্তা। মেজাজ হঠাত করে তিরিক্ষি হয়ে শব্দ করে বেজে ওঠে যেন।
– এই রিকশাঅলা তুমারে না কলাম এট্রু আস্তে চালাতি। মানষির কতা কানে যায় না? ঝাকাতি ঝাকাতিতো পেটের খোলে খোলে বিষ ব্যাতা ঢালে দিচ্ছো।
-কি করুম আফা – আস্তে চালাইলে খাডনী হয় বেশী।
– এই, আফা কি? আমি কি তোমার আফার বয়সী? সেদিনের পোলা। চাচী কতি কি হয়? কও চাচী।
মেজাজের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে পারে না বিধবা। এই গরমে কতজন পারে তা ধরে রাখতে?
-চাচী।
যাত্রীর দিকে একবার পেছন ফিরে তাকায় ছোকড়াবয়সী রিকসাওলা। সবগুলো দাত তার কেলিয়ে পড়ে বিনা দরকারে।
-থাক চাচি কওয়া লাগবে না। রিকশা থামালে কেন তাই কও?
-ঝাপির ভেতর থেকে গলাডা বাইর কইরা দেহেন- রাস্তা বন্ধ, হগ্গলডি খারাই গ্যাছে।
কথা বলে আবার হাসে ছোকড়া।
ভাল করে চারিদিক দেখল আসমা খাতুন – কথা সত্য। সবাই দাড়িয়ে গেছে। রিকসা, বাইক, মটরগাড়ী, ঠৈলাগাড়ী, তিন চাকার জান সহ যত রকমের যান থাকতে পারে তাদের যেন মহা সমাবেশ ঘটেছে পুরা রাস্তাটা জুড়ে। গরু ছাগল হাতে মানুষও অপেক্ষায় আছে রাস্তা পার হবার। গোটা কয় সবুজ-জামা পুলিশ আড়া আড়ী বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। পুলিশ বাঘের বাচ্চা বটে, বাশ দিয়ে নদীর স্রোতও আটকে রাখতে পারে। মতিঝিলের এই রাস্তা দিয়ে একটু পরে মন্ত্রী যাবেন-পুরামন্ত্রী নয়, উপমন্ত্রী। কিন্তু কখন যাবেন তা কেউ বলতে পারে না-পুলিশও না। সরকারী মন্ত্রিদের নিরাপত্তা, আয়েশ ঠিকমাত্রায় রাখাটা খুবই জরুরী। মন্ত্রনা দেয়া তাদের কাজ -কাজটা অত সোজা না। তাদের জন্য একটু ত্যাগ তো করতেই হবে। এখানে আটকে গেছে সবাই। নানা কাজে বের হওয়া ঘামে দদ্দর শত শত মানুষের চোখে কৌতুহল, ক্লান্তি আর নিরীহ তৃনভোজী দৃষ্টি। অনিয়মে আটকে আছে কৃষক, দর্জি, মুদি, পকেটমার, ঈমাম, নেতা, পতিতা। ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সবার। ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষকের, বাটপাড়ের, দানবীরের , অভিনেতার । আসমা খাতুনেরও ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে অনেক।
হুডফেলা রিক্সার উপরে বসা অড়তদারের মত দেখতে মোটা কালো একজন বেশ একটু উচ্চস্বরে মনের খেদ ঝাড়লো।
-শোনেন ভাই, এই লোকগুলো ভুট চাতি আমাগো দুয়োরে যায়, ভিক্ষা চায়। ভোটে জিতে এরা আমাগো গোলাম বানায়ে এক হাট থেইকা আরেক হাটে বেইচা দেয়। এই এহন যেমন পায় শেকল দিয়ে বাইন্ধা রাখছে।
আড়তদারের কথা শুনে অনেকগুলো কন্ঠ একসাথে সশব্দে গলা মেলায়-
-হ ভাই ঠিক কইছেন, ঠিক।
কিছু লোক উপরে নীচে সম্মতি সুচক মাথা নাড়ে। কিছু লোক তাকিয়ে থাকে নিরামিষ দৃষ্টিতে। আসমা খাতুনও এক নজর দেখে নেয় কালো মোটা বক্তাটাকে। ভাবে সে, এইনা হ’লে মানুষ। একটু নড়াচড়া না দিলে তারে কি মানুষ কওয়া যায়?
রিক্সার হুডের ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে আরও ভাল করে দেখে বিধবা- ছেলের স্কুল খুব বেশী দুরে নেই। হেটে যেতে বড়জোর পনের মিনিট লাগতে পারে । এমন জাগায় এসে আটকা পড়তে হ’লো তাকে? দেরী হয়ে যাবে নির্ঘাত । কি ভাববে হেড মাস্টার সাহেব!
নির্ধারিত সময়ের আরও একঘন্টা পরে গিয়ে পৌছালো আসমা খাতুন ছেলের স্কুলে। হেডমাষ্টার সাহেব তো রেগে টং। মানুষের সময় জ্ঞান এমন হলে চলে? এখন তার লাঞ্চের সময়। খেতে খেতে সংক্ষেপে স্কুলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন শিক্ষক। ভাঙ্গা, হতাশ মন নিয়ে বাড়ী ফিরে আসলো আসমা খাতুন। হঠাত করে বাবা মারা যাবার পর স্কুল কতৃপক্ষ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়ে ছিল পাভেলকে। তবে শর্ত ছিল ফলাফল মধ্যম পর্যায় রাখতে হ’বে কমপক্ষে। এবার অষ্টম শ্রেনীর পরীক্ষায় মান খারাপ করলে এই সুযোগ কেটে দেয়া হবে। বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। এই সিদ্ধান্তের উপরে কোন কথা বলার নেই আসমা খাতুনের। ছেলে তার বখাটে, এব্যাপারে এখন তার আর কোন সন্দেহ নেই। এমনতো না যে বৈষম্য করে তারা তার ছেলেকে সুযোগ দিচ্ছে না। ছেলে ভাল হলে তার জন্যে কথা বলা যায়। এখন কি করবে সে? অত দামী স্কুলে কিভাবে সে পড়াবে এই ছেলেরে ? পড়াশুনার দিকে কোন মন নেই ছেলের । প্রতিমাসে শুধু এটা কিনে দাও, ওটা কিনে দাও বায়না। বাপ থাকলে না হয় কথা ছিল। এখন সে কিভাবে সামাল দিবে এতসব। বিরাট দুশ্চিন্তার ঝাপি মাথায় নিয়ে সেলাই কলে গিয়ে বসে পড়ে আসমা খাতুন। হাত চলে পা চলে, কাপড়ে সেলাই পড়ে একটার পর একটা।
ছেলেটা হয়েছে ঠিক ওর বাপের মত – বড্ড খেয়ালী আর জেদী। গায়ে গতরেও বেড়ে উঠেছে- আগের মতো যখন তখন মেরেধেরে আর শাসন করা যায় না। এই যাহ! সেলাইয়ে আবার ভুল হয়ে গেল। পুরোন সেলাইটারে খুলতে বসে আসমা খাতুন। আজকাল বেশ অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। কোথা থেকে দৌড়ে এসে মায়ের কোল ঘেসে বসে পড়ে ছেলে।
– এই ভর বিকেলে কোথায় গিছিলে, বাজান?
– একটু বাইরে। তোমার সাথে একটু কথা আছে মা।
ছেলের কথা শুনে প্রমাদ গুণে বিধবা। ‘কথা আছে’ মানে আবার কোন কিছুর বায়না। আবার নাওয়া খাওয়া বাদদিয়ে রাতদিন কাজ। ছেলেটার কান্ডজ্ঞান বুঝি আর হবেনা। তারে আর বাঁচতে দেবেনা এই ছেলে। মানুষের জিনিস দেখে এসে সেটা পাবার জন্যে বায়না। বোঝাবে কে ওকে, এটা একটা অসুখ- দুরারোগ্য ব্যাধি। এই ব্যাধিতে মরতে হবে তাকে। ছেলের বায়নাতে বাগাড় দিতে ভয় পায় বিধবা। মনে আছে দুই দুই বার বাড়ী ছেড়ে গিয়েছিল ছেলে চাহিদায় লাগাম দিতে গিয়ে। মায় এখন আর তা করতে চায় না। বড় কিছু হওয়া লাগবেনা, ছেলে তার বেচে থাক জানে- এটা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই তার।
– তোমার স্কুলে গিছিলাম, বাজান। তোমার হেডমাস্টার কি কইল জানো?
ছেলে যেন মায়ের কথা শুনতে পায়নি এমন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে কাঁধটাকে উপরে তুলে আবার নামিয়ে ফেলে হঠাত করে।
-ওইটে কি করলে, বাজান?
-মা তুমি কিচ্ছু বোঝ না। এটাকে বলে ‘শিরাগ’।
মনে মনে ভাবে মা- এই ছেলে নানান কিছিমের জিনিস শিখে আসে বাইরে থেকে। কোন দিন মায়ের মুখের ভাষাটা ঠিক ঠিক উচ্চারনও করলনা। বড় আফসোস লাগে। সেওতো দশ ক্লাশ পর্যন্ত পড়েছিল। সাধু বাংলায় কথাও জানে। কোন দিন চেষ্টাত করেনি তা বলার আপন জনদের সাথে।
– তুমি বাবা, চেরাগ কর আর যাই করো এবার পরীক্ষায় খারাপ করলে আর ফ্রি ঐ স্কুলে পড়তে পারবা না। মনে রাইখো।
– পরীক্ষা ভাল হবে, তুমি কোন চিন্তা করো না। তবে আমাকে একটা ছোট্ট জিনিস কিনে দিতে হবে, বেশী দাম না। কথা দাও দিবে, মা।
মহা ফাপরে পড়ে বিধবা মা। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে ছেলেকে, “কি জিনিস?”
– জিনিসটা নতুন বের হয়েছে মা। ওটার নাম আইপড । আমার ক্লাসে সবার ওটা আছে। তুমি আমারে কিছু কিনে দাও না।
নাকি নাকি সুরে কান্নার ভান ধরে ছেলে, পাভেল।
– এইডে তুমি কি কলে বাজান তোমারে আমি কিছু কিনে দিনে। গতমাসে না তোমারে আমি লিভিশ না খবিশ জিন্সের প্যান্ট কিনে দিলাম তিন হাজার টাহা দিয়ে, তার আগের মাসে এম পি ফোর, তার আগে এম পি থ্রি-এগুলো তাইলে কিছুই না।
ছেলে কোন কথা বলে না। মাথা নীচু করে থাকে কিছুক্ষণ। কিছু সময় পরে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার ঘাড়টারে ‘শিরাগ’ করে।
– তবুও মা, এটা না হলে আমি স্কুলে যেতে পারবো না। সবাই আমাকে ফকির বলবে।
এই হদ্দ বোকা ছেলে নিজের ভালটাও বোঝে না। যা দেখে তাই করতে চায়। সত্য ক্ষিদে আর মিথ্যে ক্ষিদের ভেতরে পার্থক্যটাও বোঝে না। এই ছেলে তারে মেরেই শান্তি পাবে। এই বুড়ো হাড়ে এত কাজের চাপ তার আর সহ্য হচ্ছে না। কয়েক মাস থেকে আসমা খাতুনের শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না। এই বেক্কল ছেলেরে এসব বলে কোন লাভ নেই। সেলাইয়ের কাজে মন দেয় বিধবা। সেলাইয়ের পর সেলাই চলে। গভীর রাতে শেষ হয় আসমা খাতুনের কাজ।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেও আসমা খাতুনের কোন ছুটি নেই। শুক্রবারে তার কাজ থাকে আরও বেশী। দুপুরের খাবার সময় হয়েছে। সূর্য্য মধ্য গগণ ছেড়ে সামান্য একটু পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সেলাই করতে করতে টেবিলের উপর মাথা রেখে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বিধবা। তার দুঃখ বোঝার মত এই সংসারে কেউ নেই। থাকলে বলতো-আহারে বেচারা! বাইরে একটু ঘুরে বাড়ীতে এসেছে ছেলে দুপুরের খাবার খেতে। টেবিলে মাকে ঘুমুতে দেখে ইতস্তত: করে ডাকতে। দুষ্ট বুদ্ধি খেলে বখে যাওয়া হদ্দ বোকা ছেলের মাথায়। একবার ভাবে মা তাকে বলেছিল- চেষ্টা করবে জিনিসটা কিনে দিতে। মা কোথায় টাকা লুকিয়ে রাখে জানে সে। পা টিপে টিপে ঘরে ঢোকে একমাত্র ছেলে। প্রথম তোষক, তার উপরে দ্বিতীয় তোষক, তার ডান পাশে একটুখানি ছেড়া যায়গা-ওটার ভেতরে সাবধানে হাত চালায় ছেলে। ছয়টা পাচশত টাকার নোট আর দুটো একশ টাকার নোট উঠে আসে হাতে। আগে কখনোই এমন কাজ করেনি সে, এখন এটা করা ঠিক হবে কিনা দোটানায় ভোগে কিছুক্ষণ। আরে ধুর-এটাকা তো তারই জন্য মায় রেখেছে এখানে। মুখে হাসি ফোটে নির্বোধ ভোক্তার মুখে। সবগুলো টাকা পকেটে ভরে এক দৌড়ে সোজা মতির দোকানে ওঠে পড়ে আসমা খাতুনের একমাত্র ছেলে। দুপুরে খাবার কথা বেমালুম ভুলে যায়। হাতে আসে তার নতুন দিনের নতুন পন্য। বন্ধুদের দেখায়, খুশি ভাগভাগী করে-সারা শহর উড়ে বেড়ায় মনের আনন্দে। একটা ‘আইপডের’ মালিক হ’য়ে অনেকদিন পর মনটা শান্ত হয় তার। কিন্তু সে জানে না কয়েকদিন পর আবার তার মন অশান্ত হয়ে পড়বে- ভয়াবহ আশান্ত, নতুন কোন পন্য- নতুন কারও হাতে দেখে। এ এক দুরারোগ্য ব্যাধি, যার খবর রাখতো তার বিধবা মা। কিন্ত সে মায়ের কথা কোনদিন ছেলে কানে তোলে নাই। তাই আরোগ্যের কোন পথও নেই।
সারাটা দিন মহাসুখে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে অবশেষে সন্ধার দিকে ঘরে ফেরে আসমা খাতুনের ছেলে-এবাড়ীর একমাত্র ছেলে পাভেল। উঠোনে পা রেখে থমকে দাড়ায় সে। উঠোনে এত লোক কেন? সাদা কাপড়ে মুড়ে কাকে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছে? কে মরলো? তার সামনে অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কোনটা তাকে তেমন ব্যাতিব্যাস্ত করলো বলে মনে হলো না। তখনও তার কানের ভেতরে হেডফোনটা ভরা। প্রতিবেশী হারুন কাকা এলাকার মুরুব্বী। এগিয়ে এলেন তিনি হতভাগা পাভেলের দিকে।
– কান থেকে খোল ঐটা। তোর মা কাম করতে করতে দুপুরের দিকে মেশিনের উপর মইরা পরছে, হেইডা কি তুই জানতি?
হেডফোনটা কান থেকে সরিয়ে ফেলে পাভেল। তবে কথার কোন উত্তর দিতে পারেনা। তার কাছে কোন উত্তর আছে বলেও মনে হলো না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কাধটা উপরে তুলে ‘শিরাগ’ করার চেষ্টা করে একবার।
– কতা কইলে গিট্টি উচা করে। আমরা সব জানি। এই পোলার লাইগা ওর মায় খাটতে খাটতে মরছে। কুপূত্র ঐটা।
আরেক প্রতিবেশী মুরুব্বী বেশ চড়া গলায় সবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ক্ষান্ত দেয়। মুরুব্বীরা যে যার মত গুন গুন করতে থাকে। সে সবের দিকে কোন খেয়াল নেই মৃত বিধবার ছেলের। শোকের লেশমাত্র নেই তার শরীরে কোথাও। মনের ভেতর থাকলেও থাকতে পারে। সেটা সে কাউকে দেখাতে চায়না। কারণ সে জানে, আজ সে কি করেছে। এতদিন পরে মায়ের কষ্টটাকে সহসা ছুয়ে ফেলে ছেলেটা। চমকে উঠে। ভাবে সে মনে মনে- মায়ের জন্য এখন শোক করা প্রতারণাই হবে। অত খারাপ সে হতে চায়না। মা তাকে সারা জীবন বোকা বলতো। আজ শেষ বোকামীটা সে করতে চায়।
সন্ধার আগে মোর্দা কবরে রাখতে হয়। এটাই নিয়ম। তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় পরে আসার জন্য ঘরে ঢুকলো বখে যাওয়া ছেলে পাভেল। বাইরে লোকজন অপেক্ষা করছে এতিম পোলাটার জন্য। এত সময় ধরে কি করছে ছেলেটা। জানাজা পড়া ফরজে কেফায়া। লোকজন অধৈর্য্য হয়ে যায়। এরকম দেরী করলে সন্ধ্যের আগে মাটি দেয়া যাবে না কিছুতেই। দেরীটা বেশী হয়ে যাচ্ছে দেখে দরজায় টোকা দিল লোকজন। কেউ কেউ বললো- ছেলেটা আসলে চরম বেয়াদব। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। টোকা দিয়ে কাজ না হওয়াতে লোকজন দরজা ভেঙ্গে ফেললো সন্দেহের বশে। সব সন্দেহ সত্য হল। সবাই দেখলো- আশ্চর্য্য হয়ে দেখলো, গলায় ফাঁস লাগিয়ে চালের ফ্রেমের সাথে ঝুলছে বখাটে ছেলে পাভেল। পাভেল নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। তাই সামনে যা পেয়েছে তাই বেছে নিয়েছে। নিজেকে প্রকাশও করতে পারেনি কারও কাছে। আত্মহননের ভেতর দিয়ে বোকা ছেলে আজ একটি বারের মত নিজেকে চালাক ভেবে যেতে পেরেছে। তবে অধৈর্য্য প্রতিবেশীদের সন্ধার আগে আর জানাজার নামাজ পড়া হলো না। তারা একসঙ্গে দুটো মানুষের জানাজা পড়লেন কালো রাতের আঁধারে- আশ্চর্য্য হলেন, শোকাবিভুত হলেন। কিন্তু তারা জানলেন না, কেন এমন হলো? কী রোগে মারা গেল বখে যাওয়া ছেলেটা।