দেবরাজ ইন্দ্রের পকেটমার
কফিল কাঙ্গাল।

“…সাধুপুরুষ ও ব্যক্তিগত ঈশ্বর আর এখন ‘ভক্তি’ প্রদর্শনের ল্যবস্তু নয়; ল্যবস্তু ব্যক্তির গুণ আরোপিত জাতি বা শ্রেণী এবং দেবত্বপ্রাপ্ত নেতা। পরিবর্তনটা সম্পূর্ণ মন্দের দিকে” (আলডাস হাক্সলি)। আমরা এমনই মন্দ যে স্বয়ং ভগবানও আমাদের ভয় পায়, তাই নিয়ে একটি শোনা কাহিনী বলছি। বহুদিন পূর্বে কোন এক লেখকের একটি ছড়া পড়েছিলাম, নামটিও মনে নেই। আমার স্মরণশক্তি অত্যন্ত কম, তাই ছড়াকারে বলতে পারবো না এবং উহার প্রকৃত অর্থও মনে নেই, তবে যা মনে পড়ছে তার খানিকটা নিজের চিন্তা মিলিয়ে-মিশিয়ে বর্ণনা করছি মাত্র।
একবার নাকি স্বর্গের দেবতা ইন্দ্রদেব নিজের চোখে মানুষের খোঁজখবর নিতে মর্ত্যে নেমে এলো। বিশেষ করে বাঙালিদের দেখতে কোলকাতা ও বাংলাদেশ সফরে। তার সঙ্গে ছিলো তার বিশ্বস্ত সহচর, নারদ মুনি।
মর্ত্যে এসেই ইন্দ্রদেব নারদকে বললো, একি! এতো কোলাহল কেন, ওরা এতো ছুটাছুটি করছে কেন? ওরা আমাদের মারবে না তো?
নারদ আশ্বস্ত করলো, না গুরুদেব এ ওদের গুঞ্জন মাত্র। শুধু অনেক লোকের কোলাহল।
ইন্দ্রদেব আশ্চর্য হয়ে বললো, এ যদি গুঞ্জন হয় তাহলে উচ্চরব কি? এরই মধ্যে তার চোখ পড়ল অট্টালিকার দিকে। একি এতো বিশাল সুউচ্চ অট্টালিকা! প্রশ্ন করলো, নারদ! এ অট্টালিকা ওরা তৈরি করলো কিভাবে? মানুষের মাথায় এতো বুদ্ধি! ওই যে দেখ্ তো ওরা কারা; এসি রুমে বসে আনন্দে মাতোয়ার? আবার অন্যদিকে তাকিয়েই আৎকে ওঠে গুরুদেব! নারদ! ওই যে অট্টালিকার পাশে রাস্তায় বসে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা খাবার খাচ্ছে মহাল্লোসে ওরাই বা কারা? একসঙ্গে এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গিয়ে নারদ বিপদে পড়লো।
গুরুদেব ভাবলো, একি অধপতন তার প্রিয় মানুষদের। ছুটছে দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লক্ষ লক্ষ মেয়েরা। আবার জিজ্ঞেস করলো, ওরাই বা কারা? ওহে নারদ, এরা কেন, কি কারণ এমন কঙ্কালসার দেহ নিয়ে এতো অন্ধকার ভোরে, এতো তেজে ছুটছে দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্য?
নারদ বললো, গুরু! এর সব গার্মেন্টস শ্রমিক, ফ্যাক্টরির শ্রমিক। সময়মত ফ্যাক্টরিতে পৌঁছাতে হবে তাই ভ্রুক্ষপে নেই কিছু। কারণ ৮টার আগে পৌঁছাতে না পারলে ওদের রক্তচোষা ওই যে অট্টালিকায় বসে আনন্দে মাতোয়ারা, ওইসব জানোয়ারেরা নামেমাত্র মজুরি থেকেও কেটে নিবে, কোন ওজুহাতেই কাজ হবে না। মায়ের অসুখ, পিতার শ্রাদ্ধ ওসব ওরা শুনে না কখনো, ওরা চায় শ্রমিকের রক্তে ওদের নিরাপত্তা, অহংকার, অহমিকা, দাপট- ক্ষমতা, ওদের জীবনের সুখ-শান্তি আর কাড়ি কাড়ি টাকা…!
তা এরা যা বেতন পায় তাতে কি পেট ভরে খেতে পায় না? মাসে কত বেতন পায়, এদের কঙ্কালসার এমন দেহ কেন নারদ? এদের মালিকদের কি কোন দয়ামায়া নাই?
নারদ বললো, গুরুদেব এরা একমাসে যা পায় তাতে পনের দিনও চলে না। তবু বাবুদের সুখের লাগি ওরা ছুটে, ওরা খেটে মরে অর্হনিশি। ওহে গুরু, দেবরাজ এখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের বড়ই অভাব। তাই অনেক নরনারী থাকে অনাহারী। শুধু মাত্র আজকের এতটুকু খাবারে জন্য ওদের এতো ব্যবস্তা এতো গুঞ্জন, কোথায় মিলবে খাবার তার সন্ধানে এতো ছুটাছুটি। ওই যে দেখেন অন্যপাশেই ক্ষুধার্ত নরনারী, শিশুরা ডাস্টবিনে নেমে খাবার খুঁজছে। ওদের শ্রমের টাকায় গড়া ওই যে অট্টালিকা, ওখানে এসি রুমে বসে আনন্দে মাতোয়ারা মুষ্টিমেয় কিছু লোক, নিজেদের সুখের লাগি এদের একপ্রকার বন্দি করে ইচ্ছেমত খাটিয়ে নিচ্ছে।
বন্দি করে কেন?
ঠিক হাত-পায়ে শিকল দিয়ে ওদের বন্দি করেনি। ওদের বন্দি করেছে দারিদ্রতার শিকলে। ওরা এই শিকল ভেঙ্গে যাতে না বেরুতে পারে, যাতে পেট ভরে খেতে না পায়, আবার মরেও না যায় সেরূপ ব্যবস্থা ওদের হাতে রেখেই ওদের পারিশ্রমিক দেয়া হয়।
দেবরাজ ইন্দ্র বললো, একি! এতো আমার খাতায় লিখিত নাই, তুমিও তো বলো নাই কোনদিন।
নারদ বললো, দেবরাজ স্বর্গের শুমারির সময় এমন ছিলো নাতো যে বলব। তাছাড়া এ হিসেব রাখা খুবই কষ্টকর, কারণ একজন মরলে তিন চার জন জন্মায়।
দেবরাজ রেগে বললো, তাহলে ডাক যম রাজকে কি করে সে? যদি জন্মমৃত্যুর ভারসাম্য রাক্ষ করতে না পারে তবে তাকে কেন চাকুরিতে রাখা?
যম রাজকে ডাকা হলো।
যমরাজ বললো হুজুর, লজ্জার কথা কি বলব, ফেমিলি প্ল্যানিং আইন জারি করা আছে। তাছাড়া বয়সী নারীর অপারেশনের মাধ্যমে বন্ধ্যাত্ববরণ করলেও পুরুষগণ নাবালিকাদের নিয়ে গবেষণায় রত হয়ে আছে। কু-পথে গিয়ে এইডস্ বাধিয়ে নিয়েছে, তবু এরা ভয় পায় না। আমি আর পারছি না, তাই ভাবছি এ চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। আমি মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে পেরে উঠছি না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেবরাজ সঙ্গী নারদকে বললো, চল বিজনে, নির্জনে। আমার আশা পুড়ছে এখানে থেকে আর কাজ নেই।
নারদ বললো চলুন একটু ওই মাঠের মধ্যে যাওয়া যাক।
দেবরাজ মাঠে প্রবেশ করে বললো, এ কোথয় এনেছ আমায়?
নারদ বললো, এ যে কলকাতার গড়ের মাঠ হুজুর।
দেবরাজ ইন্দ্র বললো, গড়ের মাঠই যদি হবে তবে রামমূর্তি কোথায়?
উত্তরে নারদ বললো, হুজুর এ যে কলির কাল, কবে হয়ে গেছে রামচন্দ্রের পতন! দুনিয়া মাঝারে এখন সত্যের দুর্গতি। কত যে পরিবর্তন হয়ে গেছে, তার খবর কে রাখে?
হঠাৎ দেবরাজের চোখে পড়লো এক প্রচণ্ড ভিড়ের দিকে। বললো, চলো তো ওখানে যাই, ওখানে এতো লোক কেন বলতে পারো?
নারদ বললো, হুজুর ওটা তো সিনেমা হল অর্থাৎ প্রমোদভবন, যাবেন ওখানে?
দেবরাজ বললো, চলো গিয়ে দেখি কেমন প্রমোদ বা মনোরঞ্জন করে আমার মানুষেরা!
অতঃপর একান্ত গোপনে তারা গেলো সেখানে, দেখলো একজনকে মারছে চার-পাঁচজনে। কিল, চড়, ঘুষি, লাথি যত খুশি মারে, যে যেমন পারে।
দেবরাজ বললো, ওহে নারদ একি! বাঁচাও ওকে, ধরো ওকে, ওর জীবন থাকতে। ওযে এক দরিদ্র লোক!
নারদ বলে, গুরু বাধা দেয়া ঠিক হবে না ওদের কাজে। তাহলে বিপদে পড়বো আমরা। তাছাড়া ওরা কেন মারে তাও জানতে গেলে বিপদ হবে। হয়তো অভিনয় করছে, অথবা মানুষের ভিড় জমিয়ে হাইজ্যাক বা পকেটমারের ব্যবস্থা করছে।
দেবরাজ বললো, তাহলে ওর গলায় গামছা বাঁধা কেন?
নারদ বললো, যাতে না পালাতে পারে।
দেবরাজ ভাবে, দরিদ্র বলে কি ওর বিচার পাইবার অধিকার নাই? নিরবে খাবে প্রহার? হায়! একি কলিকাল! দেবরাজ বললো নারদকে চল কলির কলকাতার এহেন কদর্য, কুৎসিত, কুকাজ দেখতে পারি না আমি।
অতঃপর চললেন দুজন ক্ষুন্ন মনে, কলির এ কর্মকাণ্ড দেখে ভাবছেন নিরবে ওহে কলিরাজ! একি ঘটছে আজ এ বিশ্ব জুড়ে? কোন বিধিমতে সকলকে টানছে কু-পথে, ধর্মের বুলি আওড়িয়ে? কোথায় বিশ্বকর্ম, নিরব কেন সে আজি এসো, দেখ, তোমার কি দয়া-মায় হয় না? কোন বিধিমতে ওরা চলছে অকারণ নির্যাতন করে? ধর্মপ্রাণ যারা ক্ষুন্নমন সবে তারা, তবে কী কাজ আজ বৃথা অরণ্যে কেঁদে? মনে মনে এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতে চলছে স্বর্গের দেবতা। অনুসরণ করছে নারদকে। নারদ তাকে প্রমোদ ভবনে নিয়ে এলো।
দেবরাজ চিৎকার দিয়ে উঠলো, একি! নারদ এ তুমি কোথায় নিয়ে এলো? এখানে বাহিরে ভেতরে কোথাও তো তিল ধারণের জায়গা নেই, অথচ চিত্র প্রদর্শনের এখনো তো ঢের বাকি। নারদ তুমি কেন আমায় মিথ্যে বললে, তুমি বললে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব এখানে। কোথায় অভাব? অভাব হলে কোথায় এরা অর্থ পায় টিকিটের জন্য? যদি সবাই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যোগাতে না পারে তাহলে এখানে কেন এতো ভিড় করবে?
কথা বলতে বলতে দেবরাজ পকেটে হাত দিয়ে দেখলো তার পকেট কাটা। রৌপ্যমুদ্রা, স্বর্ণমুদ্রা যা ছিলো কিছু নেই। তিনি নারদকে বললো, ওহে নারদ পকেট যে আমার গড়ের মাঠ! তুমি ছাড়া আমার সঙ্গে তো আর কেউ নেই তাহলে কে করল এমন কাজ? আমার পকেট কেটে অর্থ নিয়ে যাবে এমন সাহস কোন মানুষের?
নারদ বললো, হুজুর বৃথাই দোষ দিচ্ছেন আমায়।
তবে কে কাটিল পকেট আমার?
হুজুর দেখুন বিচার করে আপনি স্বয়ং দেবরাজ আপনার অজ্ঞাত কিছু নাই। সবই লিপিবদ্ধ আপনার খাতায়।
দেবরাজ রাগ সংবরণ করে বললো, হে নারদ বলতো আসলে ঘটনা কি? পৃথিবীর মানুষের সকল কিছু আমি জানি না, তুমিই ভালো জানো, সবিস্তারে বলো আমায়। কি করে আমার অর্থহরণ করলো মানুষেরা আজ।
নারদ শুধায়, শুনুন তবে, যখন আমরা গঙ্গার ঘাটে গেলাম কলি যুগের ধর্মকর্ম, গঙ্গা স্নান আর পূজা দেখতে তখন মনে পড়ে, দুই শিশু অতি নাবালক এসেছিলো আপনার কাছে। সেই ক্ষুদ্র বালকদ্বয় কেটেছে আপনার পকেট। আমার ধারণা ওরা ছাড়া আর কেউ আপনার নিকট আসে নাই হুজুর।
তাহলে নারদ কেমন করে, আমার মুদ্রাগুলো টং-টা, টুং-টাং শব্দ হলো না কেন?
আমার মনে হয় হুজুর, তাও এক আশ্চর্যের ব্যপার। ওদের হাতে যে বালুর ব্যাগ দেখেছেন আমরা ভেবেছিলাম ওদের খেলার জন্য বালু ভরে রেখেছে ওরা। আসলে একজন আপনার পকেট কেটেছে আর অন্যজন ওই বালুর ব্যাগ নিচে পেতে রেখেছে ফলে বালুর মধ্যে আপনার স্বর্ণমুদ্রা পড়ার কারণে শব্দ হয়নি। একটু পরে দেখবেন ওরাও আপনার সাথে সিনেমা হলে ঢুকবেখন।
তা তুমি কি করে জানলে এতোসব?
হ্যাঁ, হুজুর ওই তো ওরা এখানে আমাদের আগেই এসে গেছে? ওই যে ওখানে বসে ওরা আপনার পকেট কাটার পয়সায় বিড়ি ফুঁকছে।
তাই যদি সত্যি হয় ওদের ধরো না কেন? ধরে কেড়ে নিয়ে আসো আমার সেই মুদ্রাগুলো যত ছিলো আমার। তাছাড়া ওদের নিস্তার নেই।
হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনি ওই অর্থকড়ি কোথায় পাবেন আর, ওগুলো তো ওদের সাথে নাই যে প্রমাণ করা যাবে। ওদের চুরি করা টাকা মুহূর্তেই দলনেতার হাতে সবটাই চলে যায়, সেখান থেকে দলনেতা ওদের যা দেয় তাই নিয়ে ওরা সন্তুষ্ট থাকে। তাছাড়া দিনরাত সংবদ্ধ ওরা, একের হাতে আপনার অর্থ একবার গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাত চেপে ধরলেও আপনি তার হাত পাবেন, কিন্তু অর্থ পাবেন না।
তার মানে?
হ্যাঁ হুজুর, চোখের পলকে ওরা ওই অর্থ অন্য কাউকে, তারপর পরেরজনকে পাস্ করে দেবে এমনভাবে যে আপনি সর্বজ্ঞ দেবরাজ হলেও টের পাবেন না, কি হয়ে গেলো? অবাকই হবেন কেবল।
দেবরাজ এবার এক বিশাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, নারদ এবার বুঝেছি আমার সাধু সজ্জনেরা এ কলির কলিকাতায় কিভাবে দিন কাটায়?
কথায় কথায় তারা এগিয়ে গেলো প্রবেশ পত্র দেখিয়ে বক্সে বসে আরাম করে মর্ত্যরে প্রমোদ চিত্র দেখবে আশায়।
দেবরাজ বললেন, ওহে নারদ, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে আমায়? এযে সব বিনা টিকেটেধারিরা বক্স পূর্ণ করে বসে আছে। ওরা তো সব অশ্লীল বুলি আওড়াচ্ছে আর বিদেশী সিগারেট ফুঁকছে।
আসন না পেয়ে অগ্যতা তারা দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে রইল। যদিও তাদের হাতে ন্যায্যমূল্যের টিকট তথাপি ওদের হাবভাব দেখে প্রতিবাদ করতে ভয় পেলো স্বর্গের রাজ ও তার সঙ্গী।
দেবরাজ বললো নারদ মুনিকে, ওহে নারদ! এই কি তোমার ভূখা মর্তের মাবন সন্তান। তাহলে খাদ্যের সন্ধান ত্যাজি প্রোগৃহে কেন হাজির সবে অপূর্ব সাজে সাজি? মহাসুখে আরামে বসে নিশ্চিন্ত মনে।
কহে নারদ, স্বর্গের গোসাই দেখেন নাই কি সেই শিশুদ্বয়? বিড়ি ধরাবার কালে তাদের শিক্ষাগুরুকে বললো, আপনার জ্বলন্ত সিগারেটটি দিন আমরা বিড়ি ধরাই। গুরু বলেছিলো, বিড়ি খাওয়ার শখ যদি, দিয়াশলাই কিনিস নি কেন তবে? উত্তরে ওরা বলেছিলো, দিয়াশলাই কিনলে টিকেটের টাকায় কম হতো ওস্তাদ! আপনি যা দিয়েছেন তা হিসেব করেই দিয়েছেন উদ্বৃত্ত নাই একটুও। পুনরায় ছিনতাইয়ের সময় ছিলো না, তাই আর অর্থ যোগাতে পারি নাই।
এমন সময় পর্দায় ছবি ভেসে উঠলে সব কোলাহল নিরব হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে আরো অটিকিটধারিরা জনস্রোতের মতো এসে ঢুকতে থাকলো।
দেবরাজ চিৎকার দিলো, ওহে নারদ একি দশা! একি যাতাকলে পড়লাম রে বাপ! দেয়ালে পিশে মারবে নাকি ওরা আমায়। আখের কলে যেভাবে আখ ঢুকিয়ে রস বার করে আমারও তো সে দশা হলো রে! বাপ-মায়ের নাম স্মরণ করে ডাকেন দেবরাজ নারদ মুনিরে, বাঁচাও নারদ, জীবন বুঝি যায় এখনই। কোথা ছিলো এসব মানুষ আমাদের প্রবেশ কালে?
নারদ বলে, জানি না হুজুর। আমিও তো কোণঠাসা আপনার মতোই এ সর্বনাশা জনস্রোতে। এ ঘোর কলিকালে সম্মান না দেয় ওরা গুরুজনে। আপনি দেখছেন হুজুর, ওদের লাজ-শরম কিছু নেই। নিরব থাকুন দেবরাজ দয়া করে।
কষ্টেসৃষ্টে প্রত্যক্ষ করলো নিরবে দু’জন। যখন ছবির মধ্য বিরতি হলো, দেখলে আরেক কাণ্ড। হৈ চৈ, চিৎকারে যেন গগণ ভেঙ্গে পড়বে এমন অবস্থা। কেহ ডাকছে বাদাম, চানাচুর, কেহ ঝালমুড়ি, আইক্রিম আইসক্রিম… দিল্লীকা লাড্ডু… যো খায় গা, ও ভি পস্তায়গা! যো নেহি খায় গা ও ভি পস্তায় গা! আবার কেহ ডাকছেন শাড়ি রকমারি, গরদ, জামদানি, ঢাকাই মসলিন, আর টাঙ্গাইল শাড়ি, কেহ বলে লেস্ ফিতা, চুড়ি, ছেলের চুসি, খেলনা ঝুন্ঝুনি, এমন কিছু নেই যে এখানে বিক্রি হচ্ছে না।
এসব দেখে দেবরাজ বললো, ওহে নারদ একি! এদেশে কি মার্কেট নেই, তাহলে কেন বাজার বসেছে এখানে? কেন এতো হুলূস্থূল করছে? তাহলে এতো যে মার্কেটের নাম শুনি যেমন, নিউ মার্কেট, শিয়ালদহ, শ্যাম, রাধা, লক্ষ্মী, মল্লিক, হক মার্কেট, আর বউ বাজার…?
নারদ কহে, ওহে গুরু! এখানে যে ঘরভাড়া লাগে না, বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় না, ইজারাদারের ট্যাক্স নেই, তাই ওদের লাভ বেশি। ওজনে চুরি করলেও এতো ব্যস্ততার মধ্যে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়।
পুনরায় ছবি শুরু হলো। সকলে নিরব হলো। অতঃপর ছবি শেষ হলে বের হবার পালা।
সব কিছু দেখেশুনে দেবরাজ বললো, সবার আগে বের হতে হবে নারদ। বালকদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, গঙ্গাতীরের অভিজ্ঞতা আর দেখতে চাই না। কারণ সবখানেই কলিরাজের জয়জয়কার।
তাই তড়িৎ বেগে চললো বাইরের দিকে পশ্চাতে জনস্রোত যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ার সবকিছু বিনাশ করে নিয়ে যাবে মুহূর্তে। ভয় হলো কলির অধিবাসীরা কি তাদের পদতলে দলে মারবে নাকি আজ।
সহসা বাইরে এসে থমকে দাড়ালো, একি! কলির কলিকাতা এতো উজ্জ্বল কেন? অন্যদিকে একি দেখছে দেবরাজ!
ডাকলো নারদকে, ওহে নারদ! একি দেখি, স্বর্গের সব অপ্সরি শূন্য করে আমার পুরি মর্তের প্রোক্ষাগৃহে এলো কেমন করে? আমি চলে এসেছি বলে স্বর্গের সব দারোয়ান-চৌকিদার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়!
নারদ মুনি দেবরাজকে বললো, গুরু! শান্ত হোন, আপনার রাগ দমন করুন, এরা আপনার স্বর্গের অপ্সরি নয়। এরা মানুষ! আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন গুরু।
দেবরাজ অবাক হয়ে বললো, তাহলে তুমি যে বলেছিলে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের খুবই অভাব, তাহলে এরা এতো দামি পোষাক, সাজকাজ পেলো কোথায়? তাহলে এদের অভাবটা কি? এরা তো আমার স্বর্গের অপ্সরিদেরকেও হার মানিয়েছে সাজকাজে! আমার স্বর্গের অপ্সরিদের পরাজিত করে দিয়েছে এরা!
নারদ বললো, গুরু! অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অপ্রতুলতার কথা এখানে নয়, এ যে কলিকাতা, কলিকালের শহর! এরা রূপ-লাবণ্যের আর আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় মত্ত সবাই।
স্বর্গরাজ সবিনয় বললো, নারদ, তাড়াতাড়ি করে স্বর্গরাজ্যে ফিরে চলো, কাজ নেই আমার এ কলির কলকতায়। আমার আর কোনপ্রকার বাসনা নেই এসব দেখার।
তখন নারদ বিনয়ের সাথে বললো, গুরু! কলকাতায় এসে যদি আপনার বিখ্যাত ধর্মালয় কালিবাড়ি না দেখেন তবে যে কলকাতা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। যদি সম্মতি দেন তবে আমি নিয়ে যাবো আপনাকে সেখানে।
বিশ্বস্ত সঙ্গীর কথা শুনে স্বর্গরাজ সম্মিতি দিলো। বললো, নারদ তোমার কথামতো আমি মাত্র একনজর দেখবো, তারপর খুবই তাড়াতাড়ি ফিরবো আমার রাজপুরিতে। কারণ আমার এসবে এখন আর রুচি নেই।
স্বর্গরাজ ও নারদ যখন কালিবাড়িতে পৌঁছালো তখন বলির সময়। পাঠা বলি দেয়া হচ্ছে। তারা দু’জনে খুবই কৌতূহলে দেখছে বলির দৃশ্য। খড়গধারি একজন পাঠা বলি দিচ্ছে মা কালির চরণতলে। পাশে ঠাকুর মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছে যা খুশি।
সবকিছু দেখে দেবরাজ বলে উঠলো, ওহে নারদ! একি দেখলাম, বলির শিরাংশ দীর্ঘ কেন এতো? এতো নিয়ম নয়, এর কারণ কী? ওরা স্বয়ং কালি মাতার সাক্ষাতে প্রতারণা করছে নাকি?
নারদ মুনি বললো, গুরু! আমি কেমন করে বলবো বলুন! আপনি স্বয়ং দেবরাজ আপনিই তো ভালো জানবেন আমার চেয়ে। তবে আমার মনে হয় ওই ঘাতকের চালাকি এটা, কারণ বলির পাঠার মাথার অংশ পুরোটাই পায় ঘাতক। আর বাকিটা পায় ঠাকুর। শুধু মাত্র রক্তটুকু মা কালির।
দেবরাজ বলেন, মন্দ প্রথা নয় মানুষের। তা ওরা তো পাঠার লেজে কেটে থালায় করে মা কালির সামনে রেখে বাকি অংশ নিয়ে গিয়ে উদর পূর্তি করতে পারে। কি দরকার গলায় কাটার?
তখন নারদ বললো, কি জানি কোনদিন হয়তো এ প্রথাই চালু হবে! যে মানুষ মা কালির পূজার সময় প্রবঞ্চনা করতে পারে, যে মানুষ স্বয়ং দেবরাজের পকেট কাটতে পারে তাদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। সবই তো স্বক্ষচে দেখলেন হুজুর কলির কলকাতায়! দুঃখ কেন করেন হে মহারাজ! আপনার চোখে কেন জল? দেখেন না মন্দির, মসজিদ, গির্জাতে সবত্রই চলছে আজ অতি জঘন্য কাজ। এসব পবিত্র স্থানে আজ বোমা হামলা হয়, নির্বিচারে গুলি চলে নামাজরত অবস্থায়, পুলিশ জবাই করা হয়, শিয়-সুন্নি-কাদিয়ানী-কাফের ধর্মের দোহাই দিয়ে সবাই, কে করিবে কার মুণ্ডুপাত সে চেষ্টাই শ্রেষ্ঠ বলে বিধিত আজ ধরায়! ধর্মের বাণী নিয়ে কতো ভাগ, কতো উপভাগ, জাতি-উপজাতি, গোত্র, গোষ্ঠি। যে যেভাবে পারছে খন্ড খন্ড করে ধর্মের বাণী, যার যার মনের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়ে একেকজন নেতা বনে যায় আজ নিমেশেই।
হ্যাঁ রে নারদ! ডাকলো দেবরাজ।
নরদ বললো, বলুন গুরু!
কি বলবো তোমায়? মনে শঙ্কা হচ্ছে তাহলে কি আমার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ আমার বাক্য শ্রবণ না করে কলিরাজের কথায় ওঠবস করছে? তাহলে তো বলতে হয় ধন্য হে কলিরাজ! তোমার এহেন বর্বরতায় তুমি মহান! নারদ, পুরাকালে পৌরাণিক কতো কথা শুনেছি তখন তারা নাকি নরবলি দিতো দেবতার তুষ্টির জন্য! তাহলে কি সে নরবলি ফিরে এসেছে অন্যরূপে মসজিদ-মন্দির-গির্জাতে? তখন হয়তো একজন বলি হতো এখন হয় শতশত! সব দেখে শুনে তাই তো মনে হচ্ছে নারদ, কলিরাজ আজ সেই আদিম প্রথা চালু করেছে আবার। দেখছো না কতো শিশু অপহরণ, শিশু বধ অবাধে চলছে মর্ত্যে আজ। শান্তিকামী সৎ লোকের সংখ্যা নাই বললেই চলে। দুষ্কর্মকারীদের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে, এর সমাধন কি?
বললো নারদ মুনি, গুরু! তাহেল একটি কাজ করলে কি হয় না!
দেবরাজ বলো, কি কাজ নারদ বলো তাড়াতাড়ি।
নারদ বললো, এখন পর্যন্ত যে কয়জন শান্তিপ্রিয় মানুষ আছে তাদের সকলকে জেলে পুরে রাখলে তারা শান্তিতে থাকবে বলে আমার মনে হয়!
দেবরাজ শুধালো, তোমার এহেন চিন্তার কারণ কি নারদ?
নারদ বললো, বুঝলেন না গুরু! জেলখানা আজ দুর্বৃত্তে ভরে গেছে একজনের গায়ে একজন লেপ্টে আছে। তিল ধারণেরও জায়গা নেই তবু দিন দিন আরো ঠাসাঠাসি করে ঢুকাচ্ছে সেখানে। জেলাররা, দেশের শাসকরা হিমশিম খাচ্ছে সব সামাল দিতে। দেশ শাসক ও জেলারদের এতো কষ্টের কি দরকার এর উল্টো কাজটি করলেই তো পারে। যারা শান্তি ভালবাসে, যারা ভালো মানুষ, যারা নিরীহ, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজী, হুমকি-ধামকি দিয়ে বাঁচতে পারছে না তাদের ধরে জেলে পুরে রাখলে আর জেলর সব অপরাধীদের বের করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। জেলখানার যে জায়গা তাতে শান্তিপ্রিয়রা নিরাপদে থাকতে পারবেন। আর বাইরে বেরিয়ে অপরাধীরা যে যার মতো অপরাধ করতে থাকবে, একসময় ওরা নিজেরা নিজেদের খুন করে ফেলবে! ব্যাস! কারো কোন কষ্ট করার দরকার নেই। এমনিতেই সব অপরাধীরা সাফ!
দেবরাজ বললো, তুমি যা বলো তা তো এক অর্থে ঠিক, কিন্তু জেলখানা তো অপরাধীদের জন্য, শান্তিপ্রিয় মানুষ কি সেখানে থাকতে পারে। তাদের চাই আলো-বাসাত খোলালেমা জায়গা যেখানে তারা ঘুরেফিরে বেড়াতে পারে মনোরঞ্জন করতে পারে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের মেধা ও মনন আরো দৃঢ় করতে পারে। জেলে বসে তো তা পারবে না।
দেবরাজ এবার বললো, নারদ! চলো তো চলো তাড়াতাড়ি চলো! কি জানি আমার স্বর্গপুরিতে আমি নাই, ওরা কলিবাসীরা এই ফাঁকে যদি আমার স্বর্গে ঢুকে পড়ে আমার যে সমস্ত দারোয়ান ও অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারি ওরা খুবই সহজ-সরল ওদের ফাঁকি দেয়া এসব কলিবাসীর কাছে মোটেই কঠিন নয়। ওরা যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ, সুচতুর যম দূতের মতো। কখন গিয়ে না জানি আমার সিংহাসন দখল করে বসে। যদি আমার সিংহাসন হারাই ওরা আমাকে ওই যে দেখছো কালাপানি ওখানে নির্বসনে পাঠাবে, যেমন বৃটিশরা একসময় পাঠিয়েছে দেশপ্রেমিকদের। ওখানে হিংস্র শ্বাপদ, রক্তপিপাসু কতো জীব আছে।
নারদ এবার অনুনয় বিনয় করে, শিশুর মতো, সব ভয়ডর ফেলে বললো গুরু! স্বর্গে যাবার কালে একটু পাশের দেশ বাংলাদেশ ঘুরে গেলে ভালো হতো আর তো আসা হবে না। আপনার আবার স্বর্গারোহনের পর মনে হবে যে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় না গিয়ে ভুল করেছি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু তো আমাদের আসার সময় বলছিলো, নারদ হুজুরকে আমার সোনার বাংলা দেখিয়ে নিয়ে আসিস কিন্তু। কতো সুন্দর আমার বাংলা দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। মনে নেই হুজুর! তাছাড়া আপনি যখন আপনার সিংহাসনে বসে বিচার করবেন তখন কলিবাসীর এসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে হুজুর! কে কিভাবে জীবনযাপন করছে তা দেখা আমাদের কর্তব্য।
হ্যাঁ, আমি তো তাই চেয়েছিলাম, কিন্তু কী সুকঠিন জীবন-যাপন করছে এরা কলিরাজের অধীনে এ আর দেখতে ইচ্ছা করছে না যে আমার। তবে তুমি যখন বলছো, চলো যাই সোনার বাংলা না দেখে গেলে যে অনেককিছু অপূর্ণ থেকে যাবে। না দেখে গেলে বঙ্গবন্ধুকে কি বলবো? সে যে আমারও বন্ধু। আমি জানি তার ইচ্ছা ছিলো যে অন্য কেউ সোনার বাংলার ধন-সম্পদ লুটে নিতে না পারে তাই তো তার নেতৃত্বে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করলো। তাহলে চলো যাই।
কথায় কথায় তারা চলে এলো ঢাকা বন্দরে।
দেবরাজ বললো, নারদ এ কোথা আনলে আমায়?
নারদ বললো, গুরু এই তো ঢাকা।
ঢাকা কোথায় এ যে উন্মুক্ত ধরা, চির সবুজে ভরা। ফলে ফুলে ভরা পূর্ণ বসুন্ধরা।
দেবরাজের পুষ্পকরথ বিমান বন্দরে থামলে টার্মিনালের বাইরে এসে দেখেন এযে ফকিরের দল সর্বত্র। তারা ছুটাছুটি করছে আর কোলাহলে ভরে রেখেছে সর্বত্র। হাত পাতছে আর বলছে, ভিক্ষা দাও, বকশিশ দাও। দাও আর দাও…। অন্য কোন ভাষা এরা কি জানে না? তাদের মগজে কি আর কোন ভাষা নেই? আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা, শিশু, কিশোর, বয়সী, কিংবা দুহিতা…। কঙ্কালসার স্তন্যপায়ী শিশু কোলে সকল বয়সী, সবার দাবি দাও টাকা, দাও দান-খয়রাত, আমরা উপোস আছি দলে দলে। দিন, দিনার, মোহর, সোনার টাকা, ফরেন মানি, স্বদেশী মুদ্রা আমরা চাই না, বিদেশী মুদ্রা চাই!
দেবরাজ বললো, দেখ দেখ নারদ! তুমি কাকে দেবে কাকে দেবে না, এতো হাত পেতে আছে। কলকাতায় তো এতো বেশি দেখি নাই। এ যে তলাবিহীন ঝুড়ি!
হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো, কে হে তুমি নিন্দা করছো মোদের সোনার বাংলাদেশকে? নিজের যে পকেট ছিন্নভিন্ন নাই কিছু সেখানে।
দেবরাজ জিজ্ঞেস করলো, নারদ! কি করে ওরা জানলো আমার পকেট কাটা। আমি যে লজ্জায় মরি।
নারদ বললো, হুজুর এ হাজার হাজার ভিখারির মধ্যে কখন কে যে অপনার পকেট মারার জন্য হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলো, তা আপনি টের পাননি। তাই তো ওরা পকেট মারতে গিয়ে দেখলো আপনার পকেট শূন্য ও তলাবিহীন। তাই ওরা টিটাকারি দিচ্ছে আপনাকে, নিজের পকেটের তলা নেই তো তাদের দেশকে তলাবিহীন বলছেন! গুরু! এদেশে কেহ মারে পকেট, কেহ কাগজে দাগ কেটে মারে সহস্র সহস্র কোটি, কেহ লুটে পুঁজিবাজার, কেহ ভূমিদস্যু, কেহবা জলদস্যু…। চোর-বাটপার আর দস্যু-তষ্করে ভরা যে এদেশ!
সহসা গগণভেদী চিৎকার উঠলো, হরতাল, হরতাল, হরতাল…। চলবে চলছে…। চলবে না, চলবে না, স্বৈরশাসন চলবে না…। রক্ত চাই, রক্ত চাই…। রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো… ইত্যাদি।
গুরুদেব বললো, হরতালই যদি হয় তাহলে কি দিবানিশি কাটাতে হবে টার্মিনালের এ বন্দিশালায়। ওহে নারদ, এখন কি উপায়! দেখছো তুমি কেউ বলছে হরতাল চলছে, চলবে… আবার কেউ বলছে চলবে না, চলবে না…! এর মানে কি? ফিরে চলো কাজ নেই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার, ওরা সবাই স্বাধীন, তাই তো যে যার খুশিমত বলছে ও করছে।
যাহোক, আমরা মানুষ, আমাদের বলা হয়, সৃষ্টির সেরা জীব। শুধু মানুষই নয়, ৯৯.৯৯% ধার্মিক আমরা। কিন্তু ধার্মিক হলেই কি মনুষ্যত্ববোধ জন্মে? কই, তাই যদি হবে তাহলে ধর্মের নাম নিয়েই কোনো এতো দুর্নীতি, লোভ-লালসা, হত্যা, হানাহানি… লেগেই আছে?
তাছাড়া, দিন দিন আমরা যেভাবে লোভী, স্বার্থপর, চোর-বাটপার, মিথ্যাবাদী… হয়ে উঠছি তা দেখে ভগবান ইন্দ্র কেন সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, সর্বশক্তিমান, সর্বক্ষমতাধর আল্লাও যদি আমাদের শুধরাতে আসে, সেও কথা বলার সাহস পাবে না, গ্যারান্টি! তাহলে তাকেও ফাঁসিয়ে দেয়া হবে না মিথ্যা মামলায়, তার উপর হবে না হামলা, এর গ্যারান্টি কে দেবে?
আজ এদেশে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে সমস্ত খাদ্যে বিষ। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই অথচ ধর্মকর্ম ঠিক ঠিক করছি, ধর্মরাক্ষয় সদাজাগ্রত, ধর্মের একনিষ্ঠ সৈনিক আমরা। সত্যিই কি এগুলো স্বাধীনতার ফসল? নাকি ধর্মের ফসল? ধর্মকে লাগিয়েছি সংবিধানে, লাগিয়েছি রাস্তাঘাটে, কপালে ফেলেছি ধর্মের দাগ… সর্বত্রই ধর্মের জয়জয়কার। ঘরের আনাচে-কানাচে নিত্য নতুন মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা গজাচ্ছে, তথাপিও দিনদিন আমাদের নৈতিক অধপতনে মহোৎসব চলছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমাদের ভয়ে তথাকথিত নবী-রাসূলরাও গাঢাকা দিয়েছে। যখন মানুষ এতো অসৎ ছিলো না, তা নাহলে তখন কেন ওরা ঘনঘন আসছে, আর এখন একটাও আসে না?
তবে সত্য যে, ধর্মের বিধি-বিধান পালন করলেই ধার্মিক হওয়া যায় কিন্তু মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ অর্থাৎ খাঁটি মানুষ হতে হলে এসবের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু মানবতা। তবে মানবতার ধর্মে যারা বিশ্বাসী সমাজ তাদেরকে খারাপ চোখে দেখে। এমনকি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন কথায় কথায় খোঁচা মারে। বন্ধুরাও সামনে না হলেও আড়ালে-আবডালে বলে ও শালা কাফের। যারা প্রতিনিয়ত মসজিদ/মন্দির/গির্জায় যায় নিজ নিজ সমাজে তাদের একটা বিশেষ সম্মান রয়েছে; বিপদে-আপদে সমাজের লোকজন দৌঁড়ে আসে, বিভিন্ন সহায়তা করে কিন্তু অবিশ্বাসী/নাস্তিকদের বেলায় ঘটে উল্টোটা। এরা বিপদে পড়লে ওরা খোদা/ভগবানের বিভিন্ন বাণী উচ্চারণ করে উল্লাসিত হয়। বলে, দেখেছো, খোদার মার দুনিয়ার বার। সমাজে নাস্তিকদের স্থান নেই, এরা বন্ধু-বান্ধবহীন, চাকুরি কি ব্যবসায়ে, জীবনে একাকী পথ চলতে হয়। অথচ ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কপালে যারা কালো দাগ ফেলেছে, ঠাকুরঘরে/গির্জঘরে যারা প্রতিদিন দৌঁড়ায়, বকধার্মিক দুর্নীতিবাজদের এমনিভাবে নিগৃহীত হতে হয় না; সমাজের উচ্চ স্থানগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত। কারণ এরাই মোটা অংকের দান-খয়রাত দেয় গরিবদের; শুধু গরিবদের নয় ভগবান/আল্লা/ঈশ্বরকেও ওরাই বেশি বেশি দান করে; দান-খয়রাত ছাড়া যে ভগবান/আল্লা/ঈশ্বরও বেঁচে থাকতে পারে না। ভগবান/আল্লা/ঈশ্বর এরা খাবার হালাল বা হারাম করলেও টাকা-পয়সার বেলায় হারাম-হালাল করেনি কেন? চোর-বাটপার, খুনি, দুর্নীতিবাজ… সকলের টাকাই তো এদের কাজে লাগে, তাহলে এরা সকলেই কি অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা? নাকি অর্থলোভে উম্মাদ? যাহোক, ধর্মের মধ্যে মোটেও মানবতা নেই তা বলছি না, কিন্তু এর মধ্যে যে হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব, অহংবোধ… রয়েছে তাতে সেখানে মানবতার বিকাশ লাভ প্রায় অসম্ভব।
কলির অসম্ভ চালাক-চতুর, ধাপ্পাবাজ, ঠগ, জোচ্চোর, মহাদুর্নীতিবাজ এই দেশ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র আর নাদর মুনি পালিয়ে বাঁচতে পারলেও আমাদের পালিয়ে যাবার উপায় নেই। বকধার্মিক রহমান গংদের যাতাকলে পিষ্ট আমরা হবোই। কারণ যেখান থেকে স্বর্গরাজ ভয় পেয়ে পালায়, সেখানে সাধারণ মানুষ বাঁচে কি করে?