আমার এখনকার জীবনটা সুমনের এই গানগুলোর লাইনের মতো হয়ে উঠেছে ক্রমশ, জীবন যেন আমাকে নিয়ে মুচকি হাসছে, অর্থপূর্ণ হাসি –

কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে
ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা।
অনেক দিনের পর মিলে যাবে অবসর
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।

আশা নিয়ে ঘর করি, আশায় পকেট ভরি
পড়ে গেছে কোন ফাঁকে চেনা আধুলি-
হিসেব মেলানো ভার আয় ব্যয় একাকার
চলে গেল সারাদিন এলো গোধূলি
সন্ধ্যে নেবে লুটে অনেকটা চেটেপুটে
অন্ধকারের তবু আছে সীমানা
সীমানা পেরোতে চাই জীবনের গান গাই
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা…

আসলে খুব বিচ্ছিরি একটা সময় যাচ্ছে আমার। জীবনে এমন কিছু সময় আসে একসময় – যখন কোন কিছুই পরিকল্পণা মতো হয় না, সব জায়গাতেই লেগে যায় কিছু না কিছু ভ্যাজাল আর বিপত্তি। একদিক ঠিক হয় তো আরেকদিক হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এদিক গুছিয়ে নেই তো আরেকদিক এলোমেলো হয় যায়। আমার এখনকার সময়গুলো এরকমের।

বেশ কিছুদিন হল বন্যার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। আমার খুব নিকটাত্মীয় আর আমার ঘনিষ্ট কয়েকজন বন্ধু বান্ধব ছাড়া ব্যাপারটা কেউ জানে না, অন্ততঃ এই লেখাটার আগে কেউই সেভাবে জানতো না। আমরাও কি ছাই জানতাম? ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিলো আমাদের দু’জনের কাছেই। অন্ততঃ মাসখানেক আগেও। বন্যার ঘারের কাছে ব্যাথা হত, মেরুদন্ডের হাড়ের ডিজেনারেশনের জন্য ঘাড়ের মাংশপেশীগুলো একটু শক্ত হয়ে যেত (মেয়েদের এই সমস্যাটা খুবই সাধারণ, অন্ততঃ একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে), তার জন্য কিছু এমআরআই করা হয়েছিলো। সেটা দেখতে গিয়েই ডাক্তার সাহেবের খটকা। বললেন, ডিজেনারেশনের চিকিৎসা পরে হবে, আপনার গলার কাছে একটা গ্ল্যান্ডের হাল হকিকত ভাল ঠেকছে না। থাইরয়েডের কিছু জায়গায় ‘এবনরমাল গ্রোথ’ দেখা যাচ্ছে। আপনি এক কাজ করেন ইএনটি স্পেশালিস্টকে আগে দেখান।

স্পেশালিস্ট দেখানোর পালা। আমি আর বন্যা গেলাম নর্থ ফুলটন হাসপাতালে। ডাক্তার তার ল্যাবে বন্যার গলায় কিছুক্ষণ গুতাগুতি করে বললেন মনে হয় না চিন্তার কিছু আছে। আপনারা যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি খুব সাধারণ। ওখানে অনেকেরই গ্ল্যান্ড এমনিতেই ফোলা থাকে একটু। আমার মনে পড়লো বিগত নব্বইয়ের দশকে এজন্যই আয়োডিনযুক্ত লবন বাজারে চালু করা হয়েছিলো। আর বন্যারও ছোটবেলা থেকেই থায়রয়েডে কিছু সমস্যা ছিলো সেটাও আমি জানি, যদিও সেটার সাথে ক্যান্সারের কোন সম্পর্ক নেই। তারপরেও নিশ্চিত হবার জন্য বায়োপ্সি করার নির্দেশ দিলেন।

বায়োপ্সি করার দিন চলে আসলো হঠাৎ করেই। বায়োপ্সির পদ্ধতিটা শুনতে কিছুটা আদিম মনে হবে। গলায় সন্দেহ জনক জায়গায় সুঁই ঢুকিয়ে টিস্যু নিয়ে কালচার করা হয়। টিস্যুর সাথে অনেক চাক চাক রক্ত বের হয় চোখের সামনেই। অবশ্য সুঁই ঢুকানোর আগে লোকাল এনেস্থিশিয়া দিয়ে গলার আশে পাশের জায়গাগুলো অবশ করে নেয়া হয়। কোন কোন জায়গায় সুই ঢুকানো হবে সেটা আবার আল্ট্রাসাউণ্ড করে দেখে নেয়া হয়। এটাকে বলে ফাইন নিডল এসপিরেশন বায়োপ্সি। আরো ভালভাবে বললে ‘আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেড ফাইন নিডল এস্পিরেশন (Ultrasound-Guided FNA)। সে দিনটা একটা ঘটনাবহুল দিন। আমার অফিসে একটা জরুরী মিটিং ছিলো সকালে। আমি সেটা বাতিল করে বন্যাকে নিয়ে ল্যাবে যাব ঠিক করছি। বন্যা বললো তোমার যাবার দরকার কী! আমি নিজেই যেতে পারব। সামান্য একটা বায়োপ্সি, সার্জারি তো নয়। তো আমাকে ছাড়াই বন্যা নিজে ড্রাইভ করে বায়োপ্সি করতে চলে গেল। এটা বন্যার মজ্জাগত স্বভাব। পারতপক্ষে কারো সাহায্য দরকার না পড়লে সবকিছু নিজেই করে ফেলে। কেউ তাকে ড্রাইভ করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, আর সে রোগীর মত পাশের সিটে মুখ পাংশু করে বসে থাকবে – এটা তার ধাতে সইবে না। একাই চলে যেতো, কিন্তু আমাদের মেয়ে তৃষা মহা নাছোড়বান্দা হয়ে বসে রইলো, মার সাথে সে যাবেই, দরকার হলে স্কুল বাদ দিয়ে হলেও। কী আর করা, তৃষাকে স্কুল থেকে তুলে বায়োপ্সি করতে চলে গেল বন্যা।

ভেবেছিলাম ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বন্যা ফিরে আসবে। দুই ঘন্টা হয়ে যাবার পরও বন্যা ফিরছে না দেখে ফোন করলাম। সেল ফোন বন্ধ। সেটা হবারই কথা। বায়োপ্সি করার সময় তো আর সেলফোন খোলা থাকবে না। কিন্তু এত সময় লাগছে কেন? দুই ঘন্টা পেরিয়ে তিন ঘন্টা হয়ে গেল – তাও বন্যা ফিরছে না। আমি এদিকে বন্যাকে সেল এ ম্যাসেজ রেখে যাচ্ছি। তৃষাকেও ফোনে পাচ্ছি না। অস্থির সময় ক্রমশঃ বুকে পাথরের মত ভারী হয়ে আসছে। ভাবছি হাসপাতালের ল্যাবের ফোন নম্বর খুঁজে নিয়ে সরাসরি ফোন করব কিনা … ঠিক এই সময় বন্যার ফেন পেলাম। চার/ সাড়ে চার ঘন্টা পরে। বন্যার গলায় বারোটা জায়গায় সুঁই ঢুকাতে হয়েছে, একগাদা টিস্যুতে খোঁচাখুঁচি করতে হয়েছে। আমাদের মেয়ে খুব সাহস করে পুরো প্রক্রিয়াটা নিজের চোখে দেখবে বলে ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে প্রথম থেকেই। পুরোটা সময় ভালই ছিলো। কিন্তু শেষ সুঁইটা গলায় ঢোকানোর সময়ই তার কেমন যেন ‘মাথা ঘুরে উঠল’, তারপর আর তার কিছু মনে নেই – হরাম করে মাটিতে পড়ে গেল। তখন ডাক্তারদের আবার তাকে নিয়ে শুরু হল টানাটানি। ডাক্তার অবশ্য এর আগে সাবধান করে দিয়েছিল – এ রকম কিন্তু হতে পারে, কাজেই তুমি বাইরে অপেক্ষা করে থাকবে নাকি ঠিক করো। কিন্তু আমার অসম সাহসী মেয়ে এগুলোতে কান না দিয়ে মার পাশে থাকবে বলে ঠিক করেছিল। আর এই হল সাহসের প্রতিফল। অবশ্য মাটিতে পড়ে যাবার সাথে সাথেই আরেক ডাক্তার পাঁজাকোলা করে তাকে অন্য ঘরে নিয়ে যায় ; তৃষার জ্ঞান অবশ্য সাথে সাথেই ফিরে আসে খুব প্রায় সাথে সাথেই।

আমি বন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম – তুমি কি বুঝেছিলে, তৃষা পড়ে গেছে?

– আরে না, আমার গলায় তো সুঁই ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। হঠাৎ শুনলাম পাশে ঝুপ করে শব্দ, আর একজন ডাক্তার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।  আমি তো আর বুঝিনি যে তৃষা পড়ে গেছে।

-তারপর?

-আমার সব কিছু শেষ হবার পর তৃষা এসে বলে মা জান, শেষ দিকে আমি ‘পাস আউট’ করেছিলাম। যেভাবে দাঁত কেলিয়ে বলল, তাতে মনে হল আমার বায়োপ্সি না, তার পাস আউটের অভিজ্ঞতাটাই গুরুত্বপূর্ণ!

আমি মনে মনে বলি, হুমম। ঘোর কলিকাল। কী করবা – আজকের জামানার পোলাপাইন…

বায়োপ্সির রিপোর্ট পাওয়া গেল কিছুদিন পর। বন্যার সবগুলো গ্রোথই নন-ম্যালিগনেন্ট, কাজেই চিন্তা করার কিছু নেই – কেবল একটি খুব ছোট জায়গা ছাড়া। জায়গাটা আকারে এতই ছোট যে ডাক্তারেরা প্রথমে ঐ জায়গাতে বায়োপ্সিও করতে চায়নি। সাধারণতঃ এক মিলিমিটারের কম জায়গার গ্রোথে ডাক্তারেরা বায়োপ্সি করে না। কিন্তু সে সময়ই আল্ট্রাসাউন্ডে গ্রোথ একটু ‘এনক্রাস্টেড’ দেখে বায়োপ্সি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ডাক্তারেরা। সেটাতেই পাওয়া গেল গড়বড়। যদিও রিপোর্টে একশতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হয়নি এটা ক্যান্সারই, কিন্তু অস্বাভাবিকতার উল্লেখ ছিলো এতে।

বন্যার মন স্বভাবতই খারাপ। অফিস থেকে আমাকে ফোন করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। আমি বললাম চিয়ার আপ! রিপোর্টে তো পরিস্কার করে বলে নাই ক্যান্সার। অন্য হাসপাতালে ভাল ডাক্তার দেখাই, চল। আটলান্টাতেই ক্যান্সারের জন্য খুব বড় হাসপাতাল আছে – এমোরি হেলথ কেয়ার। ক্যান্সারের রিসার্চের জন্য বিখ্যাত। থাইরয়েড ক্যান্সারের জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে তাদের। চিকিৎসাও খুব আধুনিক। সেখানকার দু’জন ডাক্তারের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করলাম আমি আর বন্যা গিয়ে। তারাও রিপোর্ট দেখলেন নিজেরাও বেশ কিছু পরীক্ষা করলেন। শেষ পর্যন্ত আমাদের নিশ্চিত করেন – হ্যা এটা ক্যান্সারই। মেডিকেলের ভাষায় ‘প্যাপিলারি কারসিনোমা’।

ক্যান্সার বললাম বটে, বন্যাকে দেখে কিছু বুঝবার উপায় নেই এমনিতেই। অফিস করছে, বাসায় এসে ঘরের কাজকর্ম করছে, মাঝে মধ্যে হই হুল্লোড় করে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া, এক্সোটিক রেস্তোরা খুঁজে খেতে ঢুকে যাওয়া সবই চলছে। ইদানিং আমাদের শখ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করার। দু’জনেই লাইব্রেরি থেকে একগাদা বই যোগাড় করছি। এর মধ্যে পিয়ার্স ব্রেন্ডন, নিয়াল ফার্গুসন, লরেন্স জেমস, পি. জে. কেইন -এর বেশ ভাল কিছু বই আছে। পশ্চিমে দাস ব্যবস্থার বিলোপ কি মানবিক কারণেই হয়েছিলো নাকি শিল্পবিপ্লবের পর যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের অবশ্যাম্ভাবী ফল হিসেবে করতে বাধ্য হয়েছিল – সেটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়। আলোচনা হয়, সে সময় উৎপাদনে শিল্পভিত্তিক পুঁজিতন্ত্রের বিনিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে – কিভাবে পুঁজির যোগান এসেছিলো সতেরো শতকের বণিকদের বিপুল মুনাফা থেকে, যে মুনাফা তারা অর্জন করেছিলো নতুন আবিস্কৃত দেশগুলোর খনি আর বাগিচা থেকে এবং হাজার হাজার ক্রীতদাসদের খাটিয়ে; এবং অন্যদিকে ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে, সেই ইতিহাস আরেকবার ঝালাই করে নেই দু’জনেই। বন্যা আমাকে পিয়ার্স ব্রেণ্ডনের ‘দ্য ডিক্লাইন এণ্ড ফল অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’ থেকে পড়ে শোনায় – অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবারের খুঁটি গাড়তে এসে ব্রিটিশরা কোয়ালা এমু, প্লাটিপাস, ক্যাঙ্গারু – এই সব কিম্ভুতকিমাকার অস্ট্রেলিয়ান জীব দেখে কিরকম হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, তারা ডায়রিতে লিখে রেখেছিল – ‘এই দেশে এসে দেখি সব কিছুই উলটা। এখানে বড় বড় পাখিরা হেটে বেড়ায় (এমু), আর ম্যামলেরা (পর্কুপাইন এন্টইটার, প্লাটিপাস) ডিম পাড়ে। শীতের সময় গরম, আর গরমের সময় শীত। এখানে পৃথিবীটাই যেন আপসাইড ডাউন!’। বেদনার্ত হয়ে বন্যার কাছ থেকে আরো জেনে নেই – কীভাবে ক্যাপ্টেন কুকের দলবল এবোরোজিনদের উপর, যারা কেবল ‘ওয়ারা ওয়ারা ওয়ারা’ (‘go away’) বলা ছাড়া ব্রিটিশদের সাথে কোন সঙ্ঘাতে যায়নি – তাদের উপর লাগাতার খুন ধর্ষণ আর নির্যাতনের রাজত্ব কায়েম করে নিঃশেষ করে দিয়েছিলো তাদের জাতিসত্ত্বাকে। তাদের ট্রাইবের কোন কোন উদ্ধত স্বামীর মুণ্ডু কেটে নাকি স্ত্রীর গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হত, আর বাধ্য করা হত ‘নেকলেস’ হিসেবে গলায় পরে থাকতে। কী বিভৎস ব্যাপার! এগুলো শুনতে শুনতেই আমার মনে পড়লো – ছোটবেলাকার বইগুলোতে (এমনকি কোন কোনটা স্কুলের পাঠ্যসূচীরও অংশ ছিলো) ডেভিড কুক, কলম্বাস আর ভাস্কো ডা গামার মতো দ্বিগবিজয়ী বীরদের নিয়ে কত রোমাঞ্চর বিরত্বের কাহিনী পড়তাম। কিন্তু এখন জানি – এরা তো আসলে বহিরাগত লুন্ঠণকারী, এবং চরম অত্যাচারী, নিপীড়ক জলদস্যু ছাড়া কিছুই ছিলো না। কিন্তু ভাস্কোডা গামা কিংবা কলম্বাস – এগুলো কোনটাই আমার মধ্যে আর রেখাপাত করে না। আমি বরং বন্যার বলে যাওয়া ইতিহাস শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে ভাবি – বন্যার গলার স্বর, বাচনভঙ্গি, হাত নেড়ে কথা বলা – সবকিছুই কী অসহ্য সুন্দর! আগে কেন ব্যাপারটা চোখে পড়ে নি! উদাস হয়ে যাই। বন্যা আমার উদাস ভাবলেশহীন মুখ দেখে পড়া থামিয়ে বিরক্ত চোখে বলে – ‘মনে তো হচ্ছে না তুমি কিছু শুনছ’! হাতের বই পাশে সরিয়ে রাখে।

এর মধ্যে একদিন ঠিক করলাম ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ মুভমেন্টে যোগ দিব। আমেরিকার নিউইয়র্কে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ক্রমশঃ জোরদার হয়ে সাড়া পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। এর ঢেউ আটলান্টাতেও লেগেছে পুরোদমে। সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছে অনেকেই। এই মুভমেন্ট-এর সময়কার মানুষ হয়ে সেটার সাথে একাত্ম হব না তা হয় নাকি! সব মিলিয়ে সব কিছুই চলছে আগের মতই। আর এমনিতেও আমরা খুব ফুর্তিবাজ মানুষ। আমরা জীবন নিয়ে দুঃখ প্রকাশের চেয়ে জীবন উপভোগ করতেই পছন্দ করি। দুঃখের মধ্যেও হাসি তামাসা বাদ যায় না আমাদের। তামাসা করি মৃত্যু নিয়েও। হয়তো বিপদ ভুলে থাকতেই। বন্যাকে বলি – ‘আরে ডায়রিয়ায় মরার চেয়ে ক্যান্সারে মরা তো ভাল। ডায়রিয়ায় মরলে পাবলিকেই বা কি কইবো, আর তুমিই বা হাশরের ময়দানে কী জবাব দিবা’!

বন্যা সেটা আবার তার অফিসে গিয়ে তার বসকে বলে – ‘কোথায় আমার হাসবেণ্ড একটু সহানুভূতিশীল হবে, তা নয় – আমাকে শুনিয়ে বলে ডায়রিয়ায় মরার চেয়ে নাকি ক্যান্সারে মরা ভাল’।

বন্যার বস আবার এক কাঠি সরস। বলে, ‘আই অ্যাম শিওর – সার্জারির পরে তোমার ভোকাল কর্ড ঠিক থাকবে না। তাই সার্জারির আগে ভয়েস রেকর্ড করে রাখ’।

অনেকের কাছেই মৃত্যু কিংবা শারীরিক অসঙ্গতির আশঙ্কা নিয়ে এভাবে কথা বলাটা খুব বিভৎস মনে হবে হয়তো। বন্যার অফিসে তার অধীনে এক ভারতীয় ডেভেলপার কাজ করে, এগুলো শুনলেই তার চোখ ছল ছল করে উঠে। মিন মিন করে বলে – এগুলো এভাবে বলা উচিৎ না। বন্যা আবার তখন তাকে সান্ত্বনা দেয়, আরে তুমি কি ভাবছ যারা এগুলো বলছে তারা আমার অমঙ্গল চায়! এরা কেবল সিরিয়াস ব্যাপারটাকে হাল্কা করার জন্য রসিকতা করছে।

রসিকতা করলেও আমি জানি আশঙ্কাগুলো কোনটাই মিথ্যে নয়। প্যাপিলারি কারসিনোমা সার্জারির সময় একটু গোলমাল হলেই গলার স্নায়ুতে আঘাত লাগতে পারে – আর তার ফলাফল হিসেবে পরবর্তীতে ভোকাল কর্ডে নানা সমস্যা হয়। অনেকের স্পিচ থেরাপি টেরাপি লাগে। এটা যে হবেই তা নয়, সবার ক্ষেত্রে তা হয়ও না, তবে হওয়ার চান্স আছে সেটা কম হলেও। বন্যার অফিসে তার বসের কথা মেনেই কিনা কে জানে, একদিন দেখি তৃষা তার কম্পিউটারে তার মাকে ডেকে নিয়ে ভিডিও করতে বসে গেছে। আমাকেও ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য মার কথা রেকর্ড করে রাখা। কিন্তু দেখা গেল মার কথা রেকর্ড বাদ দিয়ে ভিডিওর সামনে বসে আমি আর আমার মেয়ে মিলে নানা ধরণের মুখভঙ্গি করতে লেগে গেছি। বন্যা কড়া চোখে আমাদের দিকে তাকায়। তাতে অবশ্য লাভ হয় না, আমরা মুখভঙ্গি করেই যাই। আর আমাদের মেয়ে মহা উৎসাহে সেই ভিডিওগুলো রেকর্ড করে যায়।

এর মাঝে হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি বন্যা তার কম্পিউটারে বসে ‘উইল’ করছে। ঠিক ‘কৃষ্ণকান্তের উইলের’ মতন ‘বন্যার উইল’ জাতীয় কিছু নয়, সে যদি মারা যায় তাহলে তৃষার জন্য কি কি করণীয় তার একটা তালিকা করে রাখছে। ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন। এগুলো যে আমাদের কখনো করতে হবে তাই ভাবিনি। তৃষাটার কলেজের জন্য যেন পর্যাপ্ত টাকা আমরা রেখে যেতে পারি সেটা নিয়ে আমাদের চিন্তা হয়, আমরা সেটা নিয়ে আমরা কথাও বলতাম, কিন্তু দাপ্তরিকভাবে কিছু কখনো করতে হবে বলে ভাবিনি। আর তৃষা এমনিতেই পড়াশুনায় খুব ভাল। তার এখন যা রেজাল্ট, জর্জিয়া টেক এ পড়লে ফুল স্কলারশিপ পাওয়ার কথা। কিন্তু জর্জিয়া টেক এ না পড়ে “আইভি লীগ”-এর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে পয়সার জন্য যেন তাকে থেমে যেতে না হয় সেটা নিশ্চিত করা অন্ততঃ আমাদের দায়িত্ব। বন্যার উইল করা দেখে হঠাৎ করেই যেন বাস্তবে ফিরলাম। রূঢ কঠিন বাস্তবতা -‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’! জীবনের হিসেব নিকেশগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি শুরু করে দিতে হল।

বন্যার উইলের নীচের দিকে এসে চোখটা আটকে গেল। বন্যা পরিস্কার ইংরেজীতে লিখে রেখেছে –

* Donate my organs.
* Do not do any religious funeral for me after my death.
* Do not keep me in life support in case I enter persistent vegetative state.

যার বাংলা করলে দাঁড়ায় –

– আমার দেহের অঙ্গপ্রত্যংগ দান করে দেয়া হোক।
– আমার মৃত্যুর পর যেন কোন ধর্মীয় রীতি-নীতি মোতাবেক কোন কিছু না করা হয়।
– পারসিসটেন্ট ভেজিটেটিভ স্টেট বা স্থায়ী নিষ্ক্রিয় দশায় চলে গেলে কোন লাইফ সাপোর্ট দেয়ার দরকার নেই।

সহজ সরল তিনটা বাক্য। কিন্তু বাক্য তিনটা পড়ে আমার মতো পাষাণহৃদয় নাস্তিকের চোখের কোনাও চিক চিক করে উঠলো। চোখের জলের হয়না কোন রঙ, তবু কত রঙের ছবি আছে আঁকা …। কে বলে ‘There are no atheists in foxholes” ? আমার ইচ্ছে হয় যারা বলে বিপদে পড়লেই নাকি নাস্তিকেরা ঠাকুর জপ আর আল্লাহ বিল্লা করতে বাধ্য হয় – তাদের ডেকে এনে বন্যাকে দেখাই আর বলি – দেখো – পৃথিবীতে অনেক নাস্তিকই আছে যারা মৃত্যুকালেও ঈশ্বর নিয়ে চিন্তিত হয় না, বরং মারা যাবার পরেও নিজের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করে দিয়ে যায় মানব কল্যাণে। মনে মনে আবৃত্তি করি নির্মলেন্দু গুণের ‘নাস্তিক’ কবিতার চরণগুলো –

নেই স্বর্গলোভ কিংবা কল্প-নরকের ভয়,
অলীক সাফল্যমুক্ত কর্মময় পৃথিবী আমার৷…
সেই শ্রেষ্ঠ মানব-সন্তান, যার মন মুক্ত ভগবান৷
আমার মস্তক নিত্য নত সেই নাস্তিকের তরে৷

‘এথিস্টস্‌ ইন ফক্স-হোল’-এর উদাহরণ তো আমাদের চারিদিকে অজস্র! আমরা কী দেখিনি – দুরারোগ্য ‘মোটর নিউরণ ডিজিজ’ এ আক্রান্ত হয়েও হকিং কীভাবে মৃত্যুকে জয় করেছেন? ঈশ্বর নাম জপায় নিজেকে নিয়োজিত না রেখে কিভাবে মহাবিশ্বের অন্তিম সব রহস্য সমাধানে ব্রতী হয়েছেন, ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’-এর মতো বই লিখেছেন, অস্বীকার করেছেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর নিয়ন্ত্রণে ঈশ্বরের ভূমিকা; স্পষ্ট কন্ঠেই  সাম্প্রতিক একটা সাক্ষাৎকারে বলছেন বেহেস্ত-দোজখের কাহিনি সব রূপকথা। হকিং এর মতো ক্রিস্টোফার হিচেন্সের কথাও জানেন অনেকেই। এসোফেগাস ক্যান্সার আক্রান্ত হিচেন্স ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সিএনএন এর এণ্ডারসন কুপারের সাথে তার সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে গেল, যে সাক্ষাৎকারে হিচেন্স পরিস্কার ভাবেই বলছেন – ক্যান্সারে মৃত্যু হবে জেনেও তিনি প্রার্থনা টার্থনা করার কথা কখনোই ভাবেন না, বরং জীবনকে পরিচালিত করেন মানবিকতা আর মুক্তবুদ্ধির পথে

httpv://www.youtube.com/watch?v=l6XncYCZTc4

আসলে আমি জানি – বন্যার জীবনটা বিদ্রোহের, আমার মতোন মধ্যবিত্তসুলভ ম্যারম্যারা প্যানপ্যানানি মার্কা নিস্তরঙ্গ জীবন ছিলো না তার কখনোই। একসময় ঢাকা শহরের সেরা ছাত্রী ছিলো সে, ঢাকা মেডিকেলে পড়তে পড়তেই ঠিক করেছিলো গতানুগতিকভাবে লেখা পড়া নয় – মানুষের জন্য কাজ করবে। মেডিকেল ছেড়ে চলে গিয়েছিলো উত্তরবঙ্গের সুদূর সাঁওতাল পল্লীতে। পরে গার্মেন্টস শিল্পীদের সাথে মিলে সেলাই সেখার এবং তাদের সাথে মেস ভাড়া করে বাংলাদেশের প্রায় বস্তিসম পরিবেশে থাকার বিরল সব অভিজ্ঞতা আছে তার ঝুঁলিতে, যে অভিজ্ঞতাগুলো আমার মত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়া মিডিওকার মানুষের কখনোই হয়নি। সে বরাবরই দুরন্ত, উচ্ছ্বল, জীবন নিয়ে নানা বাজি ধরতে ওস্তাদ। এমনকি আমেরিকায় এসেও পড়াশুনা শেষ করে চাকরী জীবনে সাফল্য পেয়েছে, কর্পোরেট দুনিয়ার সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে গেছে এমন এক পর্যায়ে, যে জায়গাটাতে খুব কম দেশী অভিবাসীরাই পৌঁছুতে পারে। আমি কী তার ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে ঈর্ষান্বিত? কিছুটা তো বটেই। খুব ইচ্ছে করে তার জীবনের এই বিরল অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লেখার, কিন্তু বন্যার চোখ রাঙানির ভয়ে থেমে যেতে হয় সব সময়ই। তার শক্তি অসীম, অফুরন্ত। আমাকে থামানোর, এমনকি ক্যান্সারের মত রোগকেও। আমি অবাক হয়ে ভাবি -নিজের ক্যান্সারকে থোরাই কেয়ার করে ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ মুভমেন্টে জড়িত হবার তাগিদ আর শক্তি এই মেয়েটা কোথা থেকে পায়? হয়তো শক্তি পায় সে বন্যা বলেই; জাহানারা ঈমাম কী এভাবেই শক্তি পেয়েছিলেন নিজের ক্যান্সার বুকে নিয়ে একটা সময় ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে যাওয়ার? হয়তো।

বন্যা এখন অফিসে। সে ঠিক করেছে সার্জারির আগের দিনও স্বাভাবিকভাবেই অফিস করবে। সার্জারির সময় যে কটা দিন অফিসে আসতে পারবে না – তার দায়িত্বগুলো সে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার অধীনস্থদের। আর আমি চুপি চুপি এই লেখাটা মুক্তমনায় দিচ্ছি। তার চোখে পড়ার আগেই লেখাটা মুক্তমনার পাঠকদের চোখে পড়ে যাবে। এই লেখাটা লেখার জন্য আমার কপালে বিরাট ঝামেলা অপেক্ষা করছে, জানি। বন্যা তাকে নিয়ে, তার ব্যক্তিগত বিষয় আশয়, রোগ শোক নিয়ে লেখালিখি করা একদমই পছন্দ করে না। এমনকি শুনেছি, অফিসেও তাকে ভয়ে নাকি কেউ ক্যান্সারের কথা জিজ্ঞাসা করে না। রোগ নিয়ে সহানুভূতি দেখানো, মেকি কর্পোরেট চোখের পানি ফেলা, কার্ড পাঠিয়ে ‘গেট ওয়েল সুন’ জাতীয় ম্যাসেজ বন্যার ধাতে সয় না। বন্যা এমনই।

আর চারদিন পরেই বন্যার সার্জারি। মন জুরে ভীড় করে নানা শঙ্কা, দুর্ভাবনা। কিন্তু আমি জানি এগুলো বন্যার জন্য অমূলক। সে সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আগের মত সুস্থ সবল হয়ে ফিরে আসবে। আসতে তাকে হবেই। আজীবনের সংগ্রামী মেয়ে সে। এর চেয়েও বড় বড় বিপদ সে পাড়ি দিয়ে এসেছে নির্ভয়েই। মামুলি থায়রয়েড সার্জারি তো তার কাছে নস্যি। মুক্তমনার অসংখ্য পাঠক লেখকের ভালবাসাকে মূল্য দিয়ে সে ফিরবে। মুক্তমনায় লেখা শুরু করবে আবার, নতুন উৎসাহে। ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটার পর মানুষের বিবর্তন নিয়ে যে বইটা লেখার কাজ শুরু করেছিলো, সেটা সে শেষ করবে। আর, আমরা এমনিভাবে দুজনে হাতে হাত রেখে হেটে যাব আরো অনেকটা দূর ।

সীমানা পেরুতে চাই, জীবনের গান গাই,
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’ আনা …

নভেম্বর ৫, ২০১১

আপডেট  (নভেম্বর ১০, ২০১১):

আমার এই পোস্টটির পরে অনেক পাঠকই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে আমাদের ইমেইল করেছেন, অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে টেক্সট করেছেন, ফোনও করেছেন ব্যক্তিগতভাবে । সবার প্রশ্নের উত্তর দেয়া কিংবা কলব্যাক করে আপডেট জানানো সম্ভব হয়নি। আশা করছি – এই আপডেটটির পর তাদের দুঃশ্চিন্তা কমবে সামান্য হলেও। হ্যা, বন্যার সার্জারি হয়ে গেছে (মেডিকেলের ভাষায় একে বলে টোটাল থাইরোডিকটমি)। হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। সামান্য কিছু শারিরীক দুর্বলতা এবং সার্জারি সংক্রান্ত ব্যাথা বেদনা ছাড়া মোটামুটি সুস্থ আছে … (বিস্তারিত এখানে) ।

আপডেট (ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১২):

এবারে বন্ধুদের জন্য আরেকটি আপডেট। এর আগের আপডেট যখন দিয়েছিলাম, তখন বন্যার সার্জারি হয়েছিল। তার সপ্তাহ খানেক পর শুরু হয়েছিলো রেডিও এক্টিভ আয়োডিন ট্রিটমেন্ট। সেটি শেষ হবার পর গতকাল ফুল বডি স্ক্যান করে ক্যান্সারের কোন মার্ক আর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বন্যা এখন পরিপূর্ণ ক্যান্সার-মুক্ত (বিস্তারিত এখানে)। যদিও ছয় মাস পর পর চেক-আপ চালিয়ে যেতে হবে, থাকতে হবে ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে, কিন্তু আপাততঃ আশঙ্কা করার মত কিছু নেই। এ কটা মাস আমাদের খুব পরিশ্রান্ত করে দিয়েছিল, শারীরিক এবং মানসিক দুভাবেই। আজ যেন প্রবল প্রশান্তির ছায়া। জীবনানন্দ দাসের কবিতাটা মনে পড়ছে খুব –

চারিদিকে শান্ত বাতি-ভিজে গন্ধ-মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-এশিরিয়া ধুলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে…

মুক্তমনার সকল শুভান্যুধায়ীদের পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।