লিখেছেন : অমল কৃষ্ণ রায়

অতলান্তিক গভীর রহস্যময় এই জগৎ ও জীবন ! একটি চিন্তাশীল মুক্ত মনে এসে কত প্রশ্ন দেখা দেয় ! কি এই জগৎ – কোথা থেকে এর উৎপত্তি আর কোথায়ই বা এর বিলুপ্তি ? কি এই জীবন – কোথা থেকে এর সূচনা আর কোথায়ই বা এর সমাপ্তি ? কি এই জীবনের উদ্দেশ্য ? অনাদিকাল থেকে মানুষ এই সকল প্রশ্নের সম্মুখীন |যদি আমরা মনে করি একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে এই জগতের শুরু তাহলে প্রশ্ন জাগে এই জগৎ শুরুর পূর্বে কি ছিল ? আর কোন একসময়ে যদি এই জগতের বিলুপ্তি ঘটে তাহলে মনে প্রশ্ন আসে এই জগৎ শেষের পরে কি অবশিষ্ট থাকবে ? যদি আমরা জানি একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে জীবনের শুরু হয়েছিল তাহলে মনে প্রশ্নের উদয় হয় কেন তারও আগে জীবনের শুরু হলো না ? সৃষ্টির সেই বিশেষ মুহূর্তটি কি সেই বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত ছিল? এই জগৎ ও জীবনের সূচনা কি নিছকই একটা দুর্ঘটনার ফল, বা মানুষের বোধের অতীত এই বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত কোনো এক নিগূঢ় তত্ত্বের সহজাত ফসল, নাকি এর পিছনে ছিল কোনো এক অতীন্দ্রিয় অতি-মহান শিল্পীর কোনো এক মহা-পরিকল্পনা ? কে দিবে আমাদের এই সকল প্রশ্নের উত্তর ??

সুদূর ভবিষ্যতে মানব মস্তিষ্কের আরো ক্রম উন্নততর বিবর্তন আর সেই সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রম উন্নতির ফলে মানুষ হয়ত এক সময় এই সকল জটিল প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে সমর্থ হলেও হতে পারে, তবে বর্তমান সময়ে লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে এর একটি নিশ্চিত নির্ভুল উত্তর প্রদান প্রায় অসম্ভব | কবে কিভাবে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়েছিল, নাকি এই বিশ্বজগৎ সর্বদায় বিরাজমান ছিল, কবে কখন এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে জীবনের উৎপত্তি হয়েছিল, নাকি এই বিশ্বজগতের কোথাও না কোথাও জীবনের অস্তিত্ত্ব সবসময়েই বিদ্যমান ছিল তার আলোচনা করে সেই বিতর্কের একটা মীমাংসায় পৌঁছা আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয় – আমার নিবন্ধের বিষয় বর্তমানের লব্ধ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে এই চলমান জগৎ ও জীবনের একটি সাধারণ আলোচনা করা |

আমরা এই জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করতে পারি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে – এই পৃথিবীর কিছু ক্ষণজন্মা চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দার্শনিক বিচার বুদ্ধি প্রসূত ধ্যান-ধারণার নিরিখে, কোনো অসাধারণ মহামতি মহাত্মার অতীন্দ্রিয় সহজাত বোধশক্তির অনুভবের আলোকে, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের বিশ্বাসের ভিত্তিতে, অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ ফলাফল ভিত্তিক আহৃত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে | এই সব কিছুর মধ্যে আধুনিক মানুষের কাছে বৈজ্ঞানিক গবেষনার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিচার-বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ বিজ্ঞানের পরীক্ষা লব্ধ ফলাফল সাধারণত পুনরায় পরীক্ষাযোগ্য এবং এর অভিজ্ঞতা যেকোনো পরীক্ষকের জন্য লব্ধ এবং বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত যেকোনো চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং কঠোর সমালোচনার নিমিত্তে সকলের জন্য উন্মুক্ত | অতএব সঙ্গত কারণেই আমার এই আলোচনার ভিত্তি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ ফলাফল |

মহা-মহাবিশ্ব এবং আমাদের মহাবিশ্ব ও পৃথিবী
বর্তমানকালের মানুষের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উদ্ভাবন ও ক্রমপ্রসারমান উন্নতির যুগে এই জগতের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষনার ফলস্বরূপ আমাদের নিকট এই জগতের এক অভাবনীয় স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে | মহাজাগতিক গবেষনার ফলে একদল মহাকাশ বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেন যে আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি মহা-মহাবিশ্বের অন্তর্গত | আমাদের এই মহাবিশ্ব সেই মহা-মহাবিশ্বে বিদ্যমান আরো অনেক মহাবিশ্বের মধ্যে মাত্র একটি | তবে সেই মহা-মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত গবেষণা এখনো পর্যন্ত প্রায় অঙ্কুর পর্যায়ে | মহাকালের সময়ের বিচারে এই মহা-মহাবিশ্বে আমাদের এই মহাবিশ্ব কি প্রথম অথবা শেষ মহাবিশ্ব বা কোথায় এর অবস্হান সে সন্বন্ধে আমরা এখনো পর্যন্ত বিশেষ কিছুই জানি না, তবে আমাদের এই মহাবিশ্ব সম্বন্ধে অনেক তথ্যই এই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা দিতে সক্ষম হয়েছেন | সেই তথ্য কতটা নির্ভুল তা কেবল আগামী দিনের আহৃত জ্ঞানের আলোকেই বিচার্য |

এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষনার ফলাফলের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় যে আজ থেকে প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বৎসর (নতুন আর একটি তথ্য মতে ১৫.৮ বিলিয়ন বৎসর) পূর্বে আমাদের এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয় |বর্তমানের লব্ধ বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গাণিতিক নকশার মাধ্যমে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একদল বিজ্ঞানী মনে করেন যে “পদার্থ”, “শক্তি”, “শুন্যতা” আর “সময়”-এর সাথে “বুদ্ধি” আর “চেতনা”-র সমন্বয়ে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মূল উপাদান গঠিত | বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার (কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, কোয়ান্টাম জীববিদ্যা, মহাজাগতিক বিদ্যা, কোয়ান্টাম মস্তিষ্ক ও চেতনা সংক্রান্ত বিদ্যা) গবেষণা লব্ধ ফলাফলের সমন্বয়ের ভিত্তিতে বর্তমান কালের বিজ্ঞান-দার্শনিকেরা প্রায় নিশ্চিত যে এই মহাবিশ্বের সকল উপাদান সমূহ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং এরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল | এই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সমুদয় উপাদান সমূহের সামগ্রিক জ্ঞান লাভ করে এই সম্পর্কের ফলাফল নির্ধারণে একটি “সর্ব বিষয়ের সমন্বিত তত্ত্ব” আবিষ্কারের চেষ্টা বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা | জগৎ বিখ্যাত পদার্থ-বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও তাঁর জীবনের শেষ লগ্নে এই লক্ষে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন | কিন্তু এই সামগ্রিক উপাদান সমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ যতটা সহজ হবে বলে প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন বাস্তবে তা ততটুকুই জটিল | তবে একটি বিষয়ে অনেক বিজ্ঞানীই আজ প্রায় একমত যে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরুতে (এই শুরু যখনই হয়ে থাকুক না কেন ) একটি “মহাশক্তি” ক্রিয়াশীল হয় এবং এই ক্রিয়াশীল মহাশক্তি থেকেই এই সৃষ্টির শুরু এবং ক্রমে ক্রমে সেই মহাশক্তি চারটি বিশেষ পদার্থিক শক্তিতে পরিনত হয় আর তারা হলো – “বস্তু”, “শক্তি”, “শূন্যতা” এবং “সময়” | বস্তু আর শক্তির ক্রমাগত ভাঙ্গনের ফলস্বরূপ এই জাগতিক সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তু নিচয়ের বিকাশ | বিজ্ঞানীদের মতামত এই যে বস্তু আসলে শুন্যতার অতিশয় ঘনীভূত রূপ – অন্য কথায় অত্যন্ত ঘনীভূত বস্তু ক্রম প্রসারণের ফলে শুন্যতার সৃষ্টি এবং এই শুন্যতা শাব্দিক অর্থে শুন্য মনে হলেও আসলে তা শক্তিতে পরিপূর্ণ | আইনস্টাইন এর “সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের” সূত্র মতেও “বস্তু–শক্তি” “শুন্যতা” আর “সময়”- এর সাথে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত |

মহা-মহাবিশ্বের মধ্যে অবস্হিত অনেক মহাবিশ্বের মধ্যে আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত বর্তমান কলের সবচেয়ে আলোচিত মতবাদ “বিগ ব্যাং তত্ত্ব”| এই তত্ত্ব মতে অত্যন্ত অসাধারণ এবং অকল্পনীয় উত্তপ্ত এবং ঘনীভূত এক “বস্তু-শক্তি-শুন্যতা-সময়”-এর পিন্ড থেকে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি | মহাবিশ্বের এই সৃষ্টি লগ্নে “বুদ্ধি” আর “চেতনা” এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও অনেক বিজ্ঞানীই এই সম্পৃক্ততা থাকার পক্ষেই মত প্রকাশ করেন এবং তারা মনে করেন সৃষ্টির শুরু থেকেই এই “বুদ্ধি- চেতনা” ক্রিয়াশীল ছিল এবং পরবর্তীকালে এই “বুদ্ধি-চেতনা”-ই সব কিছুর সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে |

বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণে সৃষ্ট এই ক্রম প্রসারিতমান মহাবিশ্বের শুরুতে যখন এটি স্বল্প প্রসারিত ছিল তখন সৃষ্ট শুন্যতার মধ্যে একটি বিশৃঙ্খলতা বিরাজমান ছিল | ক্রমে ক্রমে এটি যতই প্রসারিত হতে থাকে ততই সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে সুশৃঙ্খলতা প্রকাশমান হতে শুরু হয় | একটি গাণিতিক নিয়মের মাধ্যমে যতই এর ঘনত্ব কমতে থাকে ততই অধিক শৃঙ্খলাবদ্ধ এই প্রক্রিয়ার বিবর্তন হতে থাকে | সৃষ্টির শুরুতে এই মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত – এবং এটি যতই ধীরে ধীরে শীতলীকরণ হতে থাকে ততই এতে বিশৃঙ্খলতার পরিমান কমতে থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে সুশৃঙ্খল হবার পরিমান গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে | বিজ্ঞানীদের মতে যতদিন পর্যন্ত এই মহাজগতে এই সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া চলতে থাকবে ততদিনই এতে সুশৃঙ্খলতার পরিমান বাড়তে থাকবে | আর এই সুশৃঙ্খলাবদ্ধতার গতি নির্ভর করে এই মহাবিশ্বের ক্রমপ্রসারতার গতি মাত্রার উপর | অন্য কথায় এই মহাজগতের আয়তন যত বাড়তে থাকবে এর শক্তির ঘনত্ব তত কমতে থাকবে এবং এই মহাবিশ্বে জাগতিক বিশৃঙ্খলতার মাত্রাও ততই কমতে থাকবে |

এই দলভুক্ত বিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টির মুহুর্তে “বুদ্ধি-চেতনা” সর্বতোভাবে “বস্তু-শক্তি”-র সাথে একত্রীভূত ছিল – এদের পৃথক কোনো অস্তিত্বই ছিল না | যদিও আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যে কেবল মানুষ বা মানব-সদৃশ প্রাণীকূলই কেবল “বুদ্ধি-চেতনা”র অধিকারী কিন্তু এই দলের বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এই মহাবিশ্বের আরো অনেক বস্তু-অবস্তুর অনর্ভুক্ত জড় ও জীব পদার্থ এই বুদ্ধি-চেতনার অধিকারী, এবং এই চেতনা প্রসারণের কারণেই ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বে যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে ক্রমাগত একটি সুশৃঙ্খল অবস্হা বিকাশ লাভ করছে |

মহাজাগতিক গবেষনার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বৎসর পূর্বে মহাজাগতিক বস্তুকণা আর মেঘমালার দুরন্ত ঘুর্ণনের ফলে সেই কনা সমূহের একত্রিকরণের মাধ্যমে আমাদের এই সৌরমন্ডলের সৃষ্টি | আর এই সৌর পরিবারের একটি সদস্য আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহ | শুরুতে এই পৃথিবী ছিল অতিশয় উত্তপ্ত – ক্রমে ক্রমে শুরু হয় শীতলীকরণ প্রক্রিয়া | এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে আস্তে আস্তে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভাগ থেকে নির্গত হতে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার গ্যাস – ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হতে থাকে পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডল | শুরুতে পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলে ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড , মিথেন, এমোনিয়া আর জলীয় বাষ্পের প্রাধান্য | পৃথিবীর এই অব্যাহত শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় ক্রমে ক্রমে এই জলীয় বাষ্পের ঘনীভবনের মাধ্যমে তৈরী হয় এই পৃথিবীর মহাসাগর সহ সব জলাভূমির |

জীবন এবং মানব জীবন
যদিও আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ত্ব অনুসন্ধানে আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু মানুষ এখন পর্যন্ত সক্ষম হয়নি অন্য কোন গ্রহে জীবনের অস্তিত্ত্ব আবিষ্কার করতে | অপরদিকে আমাদের এই পৃথিবী টইটম্বুর জীব-বৈচিত্রে | আর এই জীব জগৎ নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণারও অন্ত নেই | এদের সন্বন্ধে মানুষ অনেক কিছুই জেনেছে – নিরন্তর গবেষণা চলছে আরো অজানা অনেক কিছু জানার জন্য |

সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক সময় নিরুপন পদ্ধতি (ইলেকট্রন স্পিন রেজোনেন্স, থার্মলুমিনেস্সেন্স ও ফিশন ট্র্যাক ডেটিং) ব্যবহার করে এবং জীবাশ্ম থেকে প্রাপ্ত মাইটোকনিড্রয়াল ডি, এন, এ, বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রিকেমব্রিয়ান যুগের প্রাপ্ত জীবাশ্ম পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে আজ থেকে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বৎসর পূর্বে এককোষ জাতীয় জীবের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহে প্রথম প্রাণের উন্মেষ ঘটে | প্রথম এককোষ সম্পন্ন প্রাণের উদ্ভব কি করে হয়েছিল এ নিয়ে অতীতে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও নিরন্তর গবেষণা চলছে | এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে বিজ্ঞানীরা পৌঁছতে সক্ষম না হলেও তারা প্রাথমিক সিদ্ধান্তে প্রায় একমত যে পৃথিবীর এক মহা যুগ সন্ধিক্ষণে জীবন গঠনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় সকল উপাদান সমূহের এক অভূতপূর্ব সন্মিলনের মাধ্যমে কোন এক বিশেষ মুহুর্তে এই পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণের আবির্ভাব ঘটে | তখন এই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের জন্য অসংখ্য বিষয়ের সমন্বয়ের সহিত তিনটি প্রাথমিক উপাদানের প্রয়োজন ছিল – এক : জীবন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস, আর সেটি ছিল সমুদ্রে ভূপৃষ্ঠের তলদেশ থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে সৃষ্ট “তাপ” আর পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে প্রাপ্ত সূর্য-রশ্মি; দুই :জৈব যৌগ: – কার্বন- ভিত্তিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদান – প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড, এবং তিন: এই প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহের মিথস্ক্রিয়ার জন্য একটি মাধ্যম এবং সেটি ছিল তরল জল | আজ থেকে প্রায় চার বিলিয়ন বৎসর পূর্বে আমাদের এই তরুণ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে সালোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয় এবং তা পরিচলনের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে আনীত হয় | বৈদ্যুতিক মোক্ষনের মাধ্যমে এই বিক্রিয়ার সৃষ্ট বস্তু পৃথিবীর নবগঠিত মহাসাগরে বাহিত হয় | সেখানে সূর্য রশ্মি থেকে প্রাপ্ত শক্তি আর সমুদ্র তলদেশের ভূপৃষ্ঠের নিচে অবস্হিত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের স্ফুলিঙ্গের তাপশক্তির সমন্বয়ে ধারাবাহিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয় এবং তারই সুত্র ধরে সময়ের স্রোত বেয়ে একদিন সমুদ্রে প্রাণের উদ্ভব হয় | তারপর থেকে শুরু হয় পরিবর্তন আর বিবর্তনের বিরামহীন খেলা | আজ থেকে প্রায় ৩.০ বিলিয়ন বৎসর পূর্বে যখন পৃথিবীর এই জলাভূমিতে প্রাথমিক এককোষ বিশিষ্ট শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদের উদ্ভব হয় তখন থেকেই পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলে পরিবর্তনের এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয় | এই শ্যাওলা থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে পৃথিবীর আবহাওয়া মন্ডলে ক্রমে ক্রমে যুক্ত হতে থাকে অক্সিজেন |আজ থেকে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা যথেষ্ট পরিমানে পৌঁছে যা পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের উচ্চস্তরে একটি ওজোনস্তরের সৃষ্টি করে| এই সৃষ্ট ওজোনস্তর জীব জগতের জন্য ক্ষতিকর সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষনের ফলে এই পৃথিবী নামক গ্রহে উচ্চতর প্রাণীর আবির্ভাবের পথ সুগম করে তুলে |

সময়ের অবিরল ধারায় নিরন্তর পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় প্রায় ৩০০০ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এককোষ বিশিষ্ট প্রাণী থেকে উন্নততর বহুকোষ বিশিষ্ট জীবের উদ্ভব ঘটে | আজ থেকে প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে কেম্ব্রিয়ান যুগের শুরুতে প্রাথমিক খোলক-যুক্ত প্রাণীর উন্মেষ ঘটে | তারপর প্রথম মৎস্য জাতীয় প্রাণীর আগমন ঘটে প্রায় ৫০৫ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে অর্দভিসিয়ান যুগের প্রারম্ভে | প্রথম স্থলজ উদ্ভিদের আবির্ভাব সিলোরিয়ান যুগের শুরুতে আজ থেকে প্রায় ৪৩৮ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে | তারপর এই বিবর্তনের ধারায় ক্রমে ক্রমে উভচর প্রাণী (আজ থেকে ৪০৮ থেকে ৩৬০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে ), সরীসৃপ (৩২০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে, ডাইনোসরের আবির্ভাব ২৪৫ মিলিয়ন এবং বিলুপ্তি ৬৬ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে), স্তন্যপায়ী প্রাণী (২৩০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে ) এবং পক্ষী জাতীয় প্রাণী (১৪৪ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে)-র আবির্ভাব ঘটে | এই স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাবই এই পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রজাতির উন্মেষের পথ তৈরী করে |

আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় জেনেটিক ম্যাপিং -এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে বর্তমান কালেও আদিম জীবন-যাপন প্রণালীতে অভ্যস্ত মানবগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ এখনো আফ্রিকা মহাদেশে বিদ্যমান | এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা প্রায় নিশ্চিত যে আধুনিক মানুষ আসলে আফ্রিকান মানুষ | আজ থেকে প্রায় ২০ মিলিয়ন বৎসর পূর্বে আফ্রিকার গভীর গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্য অঞ্চলে বাসরত একপ্রকার তৃণভোজী বানর জাতীয় প্রাণী থেকে আমাদের মানুষ জাতীয় প্রানীদের পূর্বপুরুষের আবির্ভাব ঘটে | তাদের অসংখ্য উন্নত লাঙ্গুল বিহীন বানর সদৃশ উত্তর পুরুষ (গিবন ওরাং ওটাং-গরিলা শিম্পাঞ্জী -বনোবো) ক্রমে ক্রমে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বরফ যুগের শুরুতে তাদের সংখ্যার আর ক্রম সম্প্রসারণের অবনতি ঘটে | এরপর বিবর্তনের ধারায় ক্রমে ক্রমে আদিম মানুষ সদৃশ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব হয় | তারপর আজ থেকে প্রায় সাত মিলিয়ন বৎসর পূর্বে এই আদিম মানুষদের কোনো একটি প্রজাতি থেকে একশ্রেনীর তৃণভোজী আরো খানিকটা উন্নত মানুষ সদৃশ প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে – এবং এরাই প্রথম মানুষ জাতীয় প্রাণী যারা সোজা হয়ে হাঁটতে সক্ষম হয়ে উঠে | এই জাতীয় মানুষ মানব বিবর্তনের ইতিহাসে খাড়া মানুষ (হোমো ইরেকটাস)নামে পরিচিত | ক্রমে ক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে তাদের শরীর কাঠামোর উন্নতি ও মস্তিষ্কের আয়তনের বৃদ্ধি হতে থাকে| প্লিস্তসিন যুগের শেষভাগে আজ থেকে প্রায় ২০০, ০০০ বছর পূর্বে আফ্রিকার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরন্যে মানব সদৃশ পূর্ববর্তী এক প্রজাতি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘকায়, কৃষ্ণবর্ণ ও বৃহৎ মস্তিষ্ক সম্পন্ন এক নতুন মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে | এই প্রজাতিই বর্তমানের আধুনিক মানব প্রজাতি – হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স | এই অব্যাহত বিবর্তনের ধারায় বর্তমানের আধুনিক চেহারা সম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব মাত্র এক লক্ষ বছর আগে | এই প্রজাতিই ক্রমে ক্রমে হাতিয়ার আবিষ্কার আর ব্যবহারের ক্ষমতা আর দক্ষতা এবং ভাবের আদান প্রদানে ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করে | এই প্রজাতি ক্রমে ক্রমে সমগ্র আফ্রিকাতে ছড়িয়ে পড়ে | তারপর আজ থেকে ৬০,০০০ এবং ৮০,০০০ বৎসর পূর্বে এই প্রজাতির একটি অংশ আফ্রিকার পূর্ব দিকে এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার দিকে ধাবিত হয় | এর আর একটি অংশ ক্রমে মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার দিকে অগ্রসর হয় ও বসতি স্হাপন করে | তারা ক্রমে ক্রমে তাদের চামড়ার কালো রঞ্জক পদার্থ হারায় এবং ক্রমান্বয়ে ঠান্ডা জলবায়ুর সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয় | দলগত ভাবে আফ্রিকা থেকে সেই আদিম মানবগোষ্ঠীর যাত্রার সমাপ্তি হয় আজ থেকে ১০০০ বৎসর পূর্বে নিউজিল্যান্ডে বসতি স্হাপনের মাধ্যমে |

আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন বর্তমানের সবচেয়ে উন্নত বানর জাতীয় প্রাণীর মস্তিষ্কের আয়তন থেকে অনেক উন্নত হলেও জেনমিক বিচারে মানুষ আর উন্নত গরিলার মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য | সাম্প্রতিক কালে জেনোম ম্যাপিং এর মাধ্যমে মানুষ সহ অনেক প্রাণীর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কৃত হয়েছে | সামগ্রিক জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে আমরা মানব প্রজাতি আমাদের অতি নিকটবর্তী আত্মীয় শিম্পাঞ্জী থেকে মাত্র ১.২ ভাগ আলাদা -অর্থাৎ মানুষ এবং শিম্পাঞ্জী জেনেটিক ভাবে ৯৮.৮ ভাগ একই রকম | তবে শিম্পাঞ্জী থেকে মানুষ মাত্র ১.২ ভাগ ভিন্ন হলেও এই সামান্য ভিন্নতা অর্জন করতে মানুষের সময় লেগেছে ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন বৎসর | গরিলা থেকে শিম্পাঞ্জীতে উত্তরণে এই সময় ছিল ৭-৮ মিলিয়ন বৎসর, ওরাং ওটাং থেকে গরিলায় ১২ মিলিয়ন বৎসর এবং গিবন থেকে ওরাং ওটাং-এ পরিবর্তিত হতে প্রায় ১৮ মিলিয়ন বৎসর|

আমাদের বর্ধিত মানব পরিবার কমপক্ষে ২০ টি মানুষ জাতীয় প্রজাতির সমন্বয়ে গঠিত (তাদের কয়েকটি হলো অস্ত্রেলোপিথিকাস সেডিবা, হোমো হ্যাবিলিস, হোমো গর্জিকাস, হোমো ইরেকটাস, হোমো এর্গ্যাস্তার, হোমো এন্টিসেসর, হোমো হ্যাদেল্বের্জেন্সিস, হোমো নিয়েন্দের্থালেন্সিস, হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস) | তারা সবাই ছিল বর্তমানের আধুনিক মানবগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ ও আত্মীয় | যদিও সময়ের স্রোতধারায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিষ্ঠুর নিয়মের কবলে পতিত হয়ে তারা আজ সবাই বিলুপ্ত কিন্তু আজকের আধুনিক মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এই মানুষ জাতীয় প্রানীদের সাথে একত্রে বসবাস করেছে | জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে এমনকি আজ থেকে ১৮০০০ বৎসর আগেও আমাদের এই বর্ধিত মানব পরিবারের কোনো এক সদস্য প্রজাতি এই পৃথিবীর কোনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাসরত ছিল |

মস্তিষ্ক এবং মানব মস্তিষ্ক ও এর ক্রম বিকাশ
শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যে বর্তমান মানব প্রজাতি বিশেষ বিবেচনায় তেমন কোনো অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত নয় – অনেক শিকারী প্রাণীর তুলনায় মানুষ শারীরিক শক্তিতে, দৌড়ের গতিতে এবং আত্মরক্ষামূলক প্রাকৃতিক শারীরিক অস্ত্রে (যেমন দাঁত, নখর ইত্যাদি) দূর্বল এক মধ্যম আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী | তবে কেবল মাত্র একটি বৈশিষ্ট্যে মানুষ আর সকল প্রাণী থেকে অস্বাভাবিক ভাবে ব্যতিক্রম, আর সেটি হলো তার মস্তিষ্কের আয়তন | মানুষের এই উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ তার নিজেকে জানার এবং তার অবলুপ্ত পূর্বপুরুষদের জানার আকাঙ্ক্ষা তাকে অন্যান্য সব প্রজাতি থেকে আলাদা করেছে | প্রাণীকুলের মস্তিষ্ক একটি আশ্চর্য অঙ্গ এবং মানব মস্তিষ্ক একটি অত্যাশ্চর্য অঙ্গ | একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ৩ পাউন্ড (১.৪ কিলোগ্রাম) | এই মস্তিষ্ক মানুষের চিন্তা-চেতনা, স্মৃতি, বিচারশক্তি, ব্যক্তিগত পরিচিতি সহ মানুষের মন নামক সত্ত্বার যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে | মস্তিষ্ক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, আর কল্পনার আধার এবং মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করার কেন্দ্র-স্হল | একটি মানব মস্তিষ্ক প্রায় ১০ বিলিয়ন নিউরনের সমন্বয়ে গঠিত | এই প্রত্যেকটি নিউরনের একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে এবং এই নিউরন গুলিই মস্তিষ্কের তথ্য আদান-প্রদানকারী মাধ্যম | প্রত্যেকটি নিউরনের একটি কোষ -শরীর থাকে এবং এই কোষ শরীর থেকে বৃক্ষের শাখা প্রশাখার ন্যায় অসংখ্য শাখা প্রশাখা নির্গত হয় যাদের বলা হয় ডেনদ্রাইট | এই ডেনদ্রাইটই অন্য প্রতিবেশী নিউরনের ডেনদ্রাইট থেকে তথ্য গ্রহণ করে কোষ শরীরে প্রেরণ করে | সেই সাথে প্রতিটি নিউরনের শরীর থেকে আবার নলের মত একটি তন্তু বাহির হয় যাদের বলা হয় একশ্যন এবং এই একশ্যন গুলোর প্রান্তভাগ ছোট ছোট শাখা প্রশাখা দ্বারা গঠিত | এই একশ্যন সমূহ ডেনদ্রাইটের কোষ-শরীর থেকে স্নায়বিক তাড়না অন্য প্রতিবেশী নিউরনের ডেনদ্রাইটে প্রেরণ করে |

যদিও মানুষের সাথে তুলনায় অন্যান্য প্রাণীরা তাদের মস্তিষ্কের বিধি বদ্ধ তাড়নায় তাড়িত হয়ে চালিত হয়, কিন্তু আধুনিক গবেষণায় এখন এটি প্রমানিত যে কোন প্রাণীই একশত ভাগ কেবল বিধি বদ্ধ তাড়নায় তাড়িত হয়ে তাদের জীবন পরিচালিত করে না | সব প্রাণীরই কিছু পরিমান স্মরণশক্তি, কিছু কার্য-কারণ বিবেচনার শক্তি এবং কিয়ৎ পরিমান সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা বিদ্যমান | অপর দিকে মানুষকে কেবল ‘বুদ্ধিমান’ প্রাণী এই বিশেষণে ভূষিত করলে একেবারে ঠিক বলা হবে না | বরং মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের মতই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মস্তিষ্কের বিধি বদ্ধ তাড়নায় তাড়িত হয়, তবে অন্যান্য প্রাণীদের সাথে তার পার্থক্য এই যে মানুষের মস্তিষ্কে বিধি বদ্ধ তাড়নার সাথে বুদ্ধির সংমিশ্রন অন্যান্য প্রানীদের তুলনায় অনেক বেশি প্রখর|মানব মস্তিষ্কের সাথে অন্যান্য অনেক প্রানীদের মস্তিষ্ক তুলনীয় – মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সেই সকল প্রানীদের মস্তিষ্কের পার্থক্য মূলত মাত্রাগত | বর্তমানের শিম্পাঞ্জী এবং আদিম মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের সকল নিউরাল উপাদানই বিদ্যমান – আধুনিক মানব মস্তিষ্কের সাথে তার পার্থক্য কেবল এই যে এই সকল নিউরাল উপাদানের পরিমান শিম্পাঞ্জী এবং আদিম মানুষের মস্তিষ্কে পরিমানে কম এবং তাদের আকৃতি এবং সামগ্রিক বিন্যাস ভিন্নতর | আমাদের আজকের মানবগোষ্ঠির উন্নততর মস্তিষ্ক দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় জটিল বিবর্তনের ফসল | বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের গড় আয়তন প্রায় ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার যা প্রথম মানুষ জাতীয় প্রাণী যাদের অস্তেলোপিথেকাস এপারেন্সিস নামে অভিহিত করা হয় তাদের মস্তিষ্কের তুলনায় তিন গুন বড় | অস্তেলোপিথেকাস এপারেন্সিস মানুষদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল মাত্র ৪৫০ ঘন সে: মি: | বিবর্তনের ধারায় পরবর্তী কালের খাড়া মানুষদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল প্রায় ১২০০ ঘন সে: মি: |

যদিও এক সময় ধারণা করা হত যে শৈশবে মস্তিষ্কের গঠন একবার পুরোপুরি সম্পন্ন হবার পর মস্তিষ্কের কেবল পরিবর্তন হয় যখন একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মস্তিষ্কের ক্রবাবনতি হতে শুরু হয় | কিন্তু বর্তমানের মস্তিষ্কের নিউরো – প্লাষ্টিসিটি গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে যে অধ্যবসায় সহকারে বিভিন্ন ধারাবাহিক মানসিক কার্যক্রমের দ্বারা মস্তিষ্কের পরিবর্তন এমনকি পরিবর্ধন সাধন সম্ভব | এমনকি একটি বয়সের পর মস্তিষ্কের যে অবনতি শুরু হয় তা রোধ করে বৃদ্ধবয়সেও মস্তিষ্ককে কার্যক্ষম রাখা বা আরো অধিক কর্মক্ষম করা সম্ভব | মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন মস্তিষ্কে নিহিত তার নিজস্ব ক্ষমতার দ্বারাই সম্পন্ন হয় |

মহা-মহাবিশ্বে জীবনের বিস্তৃতি
যদিও এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই মহাবিশ্বের অন্য কোন গ্রহে জীবনের অস্তিত্ত্ব আবিষ্কারে সক্ষম হয়নি, তবুও প্রশ্ন থেকে যায় শুধু কি আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহেই কেবল জীবন বিদ্যমান? বর্তমানের মহাকাশ আর জীবন নিয়ে গবেষণারত অনেক বিজ্ঞানীরাই মনে করেন যে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে “জীবন” কেবল আমাদের এই গ্রহেই বিদ্যমান | তারা মনে করেন প্রানের উদ্ভবের জন্য প্রয়োজনীয় অনুকূল পরিবেশ যখনি কোথাও তৈরী হয় তখনি সেখানে ধীরে ধীরে ভৌত, ভৌত-রাসায়নিক, এবং ক্রমে ক্রমে স্বপ্রণোদিত জৈবিক এবং প্রতিবেশিক উপাদান গঠনের মাধ্যমে জীবনের আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখা দেয় | বিজ্ঞানীরা এখন প্রায় নিশ্চিত যে “জীবন”-এর উদ্ভবের জন্য উপযুক্ত এমন পরিবেশ এই মহাবিশ্বের আরো অনেক স্হানেই বিদ্যমান | মহাকাশীয় প্রতিবিম্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে এই মহাবিশ্বের নক্ষত্র সমূহে এবং এদের ঘিরে তাদের গ্রহ সমূহের গঠিত উপাদানের মধ্যে আশ্চর্যরকম সমতা বিদ্যমান | প্রাচুর্যের ক্রম অনুসারে এই সকল গ্রহে বিদ্যমান মৌলিক উপাদান সমূহ হলো হাইড্রজেন, হিলিয়াম, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং কার্বন | এই সকল উপাদানের মধ্যে হাইড্রজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং কার্বন হলো জীবজগতের মৌলিক উপাদান | যেখানে এই সকল মৌলিক উপাদান সমূহ সঠিক পরিমানে এবং সঠিক অনুপাতে অবস্হান করে এবং সেই সাথে শৃঙ্খলাবদ্ধ ধারাবাহিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য শক্তির যোগান বিদ্যমান সেখানেই জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় যৌগ সমূহ তৈরী হয় | নক্ষত্র থেকে এই শক্তি আসে আলোক- রশ্মি, বিদ্যুৎ আর তাপ হিসাবে | যদিও পৃথিবী থেকে অত্যন্তিক দূরত্বের কারণে মঙ্গলগ্রহ ব্যতিত অন্যান্য গ্রহে অভিযান চালানো এখনো পর্যন্ত মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি তবে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কারণে এই পৃথিবীতে “প্রাণ”-এর উদ্ভব সম্ভব হয়েছে এমন পরিবেশ এই মহাবিশ্বের আরো অনেক গ্রহেই বিদ্যমান | গবেষনার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেন যে আমাদের এই মহাবিশ্বে ১০০০০০০০০০ বিলিয়ন (১০২০) এরও বেশী নক্ষত্র বিদ্যমান | এদের মধ্যে অনেক নক্ষত্রই তাদের সক্রিয় পর্বে বিদ্যমান বিধায় তারা সালোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আলোক-রশ্মি নির্গত করতে সক্ষম | এই সকল নক্ষত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট গ্রহ সমূহে যখন এই আলোক শক্তি পৌঁছে তখন সেখানে জীবন উদ্ভাবনী সালোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরুর সম্ভাবনা দেখা দেয় | তবে অবশ্যই এই সালোক-রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরুর জন্য সেই গ্রহটি তার নক্ষত্র থেকে একটি অতি নির্দিষ্ট পরিমান দূরুত্বে অবস্হান করতে হবে এবং সেখানে জৈব মৌল গঠনের জন্য মৌলিক উপাদান সমূহ সঠিক পরিমানে এবং সঠিক অনুপাতে বিদ্যমান থাকতে হবে | জীবন সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান এই ধরনের গ্রহের সংখ্যা আমাদের এই মহাবিশ্বে কতগুলো তারও একটি আনুমানিক সংখ্যা নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হয়েছেন | হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রফেসর হারলো শ্যাপলি ধারণা করেন যে আমাদের এই মহাবিশ্বের প্রতি ১০০০ টি নক্ষত্রের মধ্যে মাত্র একটি নক্ষত্রের গ্রহ বিদ্যমান এবং গ্রহ আছে এমন ১০০০ টি নক্ষত্রের মাত্র একটি নক্ষত্রের মাত্র একটি গ্রহ সেই নক্ষত্র থেকে জীবন সৃষ্টির জন্য সঠিক দূরত্বে অবস্হিত| (আমাদের সৌর জগতে এমন গ্রহ মাত্র দুটি – পৃথিবী এবং মঙ্গল ) | এই বিজ্ঞানী আরো অনুমান করেছেন যে নক্ষত্র থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্হিত এমন ১০০০ টি গ্রহের মধ্যে মাত্র একটি গ্রহ সেখানে একটি বায়ুমন্ডল থাকার জন্য যথেষ্ট বড় (আমাদের সৌর জগতে এমন গ্রহের সংখ্যা ৭ টি) এবং এমন গ্রহের ১০০০ টির মধ্যে মাত্র একটি তার সূর্য থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্হিত, একটি বায়ুমন্ডল থাকার জন্য যথেষ্ট বড় এবং সেখানে জীবন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদান সমূহ সঠিক পরিমানে এবং সঠিক অনুপাতে বিদ্যমান | এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর এই অতি পরিমিত হিসেব অনুযায়ীও আমাদের এই মহাবিশ্বের কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন গ্রহে জীবনের অস্তিত্ত্ব থাকার সম্ভাবনা বিদ্যমান |

জগৎ ও জীবনের পরিনাম
যদিও এখন এটি প্রায় নিশ্চিত যে এই মহাবিশ্বের আরো অনেক গ্রহেই জীবন বিদ্যমান – কিন্তু তাই বলে এটা বলা যায় না যে এই মহাবিশ্বে জীবন চিরকালই বিদ্যমান থাকবে | এটা নিশ্চিত যে এই কার্বন-ভিত্তিক (জীব- জগতের মূল উপাদান কার্বন) জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত উপাদান সমূহ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিদ্যমান থাকবে না | মানুষ এখন পর্যন্ত যে জীব -জগত সন্বন্ধে পরিচিত এই ধরনের জীবনের উদ্ভবের জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট সীমার তাপমাত্রা এবং সেই সাথে নির্দিষ্ট পরিমানে এবং নির্দিষ্ট অনুপাতে জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান | যদিও জীবনের জন্য সহায়ক এমন ধরনের অসংখ্য গ্রহ আমাদের এই মহাবিশ্বে বিদ্যমান কিন্তু সেই সকল গ্রহে জীবনের স্হায়ীত্ব “সময়” দ্বারা নির্দিষ্ট | কোন একটি গ্রহে জীবনের উন্মেষ আর স্হায়িত্ত্বের জন্য প্রয়োজন সেই সেই গ্রহের নক্ষত্র থেকে প্রয়োজনীয় আলোকশক্তি, এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় আলোকশক্তি কেবল আসে যখন সেই আলোকরশ্মি প্রদানকারী নক্ষত্রটি বিশেষভাবে কার্যক্রম ধাপে বিদ্যমান থাকে | সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় প্রতিটি নক্ষত্রের পারমানবিক ভাঙ্গনের ফলে উৎপাদিত আলোকরশ্মি এবং তাপশক্তি এক সময় স্তিমিত হতে থাকে | এর ফল স্বরূপ সেই নক্ষত্রের অন্তর্গত জীবন ধারণকারী গ্রহে একদিন প্রাণের বিলুপ্তি ঘটে এবং সেই সাথে একদিন সেই নক্ষত্রটিরও মৃত্যু ঘটে | বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে আজ থেকে এক ট্রিলিয়ন (১০১২) বৎসরের মধ্যে আমাদের এই মহাবিশ্বের বর্তমানের সকল নক্ষত্র নির্বাপিত হয়ে আসবে, আজ থেকে ১০১৪ বৎসরের মধ্যে আমাদের এই মহাবিশ্বের সকল “পদার্থ” পরিবর্তিত হয়ে “কৃষ্ণ বিবর”-এ পরিনত হবে | বর্তমানকালের একজন বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও মহাকাশ গবেষক স্টিফেন হকিং -এর মতে গ্যালাক্সি নিঃশেষ হতে হতে উৎপন্ন ‘কৃষ্ণ বিবর”ও এখন থেকে ১০৯৯ বৎসরের মধ্যে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে এবং আজ থেকে ১০১১৭ এবং ১০১২২ বৎসরের মধ্যে অগনিত গ্যালাক্সির ধ্বংসাবশেষ দ্বারা গঠিত অতিকায় “কৃষ্ণ বিবর”ও অন্তর্হিত হয়ে যাবে এবং তারপর একসময় মানুষের বোধের অতীত সময়ের ব্যবধানে আমাদের এই মহাবিশ্বে কেবল পসিট্রনিয়াম, নিউট্রিনো (যাদের বলা হয় ভৌতিক কণা ) আর গামা-রশ্মি-ফোটন ব্যতিত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না |

শেষ কোথায় ?
যদিও আমাদের ভাবতে কষ্ট হয় যে আমাদের এই বিশ্বজগতের একদিন বিলুপ্তি ঘটবে – কিন্তু আশার কথা এই যে এটাই এই মহা-মহাবিশ্বের মহামহিম জীবন নাটকের সর্বশেষ দৃশ্যপট নয় | যদিও বা একদিন আমাদের এই মহাবিশ্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিন্তু সময়ের নিরিখে এই মহা-মহাবিশ্ব অসীম -অনন্ত | কোনো একটি মহাবিশ্বের বিলুপ্তিতে সেই মহাবিশ্বে অবস্যম্ভাবী ভাবে জীবনের অবসান ঘটবে কিন্তু এই মহা-মহাবিশ্বে এই জীবনের খেলা চলতেই থাকবে | একটি মহাবিশ্বের বিলুপ্তিতে এই মহা-মহাবিশ্বে আরেকটি নতুন মহাবিশ্বের সৃজন হবে এবং সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সেই মহাবিশ্বে আবার নব জীবনের সঞ্চার হবে|

মহাজাগতিক বিবর্তন একটি চক্রাকারে আবর্তনশীল প্রক্রিয়া – এই মহা-মহাবিশ্বে প্রতিটি মহাবিশ্বের সূচনা হয় “প্রাণ” এর অস্তিত্ত্ব বিহীন অবস্হায় | তারপর সময়ের বিবর্তনে কোন মহাবিশ্বের কোন গ্রহ যখন “প্রাণ” ধারণের উপযোগী হয় তখন সময়ের পথ ধরে সেই গ্রহে একদিন প্রানের উন্মেষ হয় | আবার সময়ের মহাস্রোতে নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে একদিন যখন সেই গ্রহ আবার জীবন ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন ধীরে ধীরে সেখানে জীবনের বিলুপ্তি ঘটে | কিন্তু অসংখ্য মহাবিশ্বের সমন্বয়ে গঠিত এই মহা-মহাবিশ্বের “শুন্য “-তার মধ্যে জীবন উদ্ভাবনের বীজ নিহিত থেকেই যায় | এক মহাবিশ্বে জীবনের সমাপ্তিতে এই মহা-মহাবিশ্বের শুন্যতার মধ্যে নিহিত “জীবনের বীজ” অন্য আর এক মহাবিশ্বে নব জীবনের সঞ্চার করে | এই ভাবে সময় আর স্হানের অনন্ত ধারায় জীবনের সৃষ্টি আর বিনাশের মহাখেলা হয়তবা চলতেই থাকবে – শেষ হয়েও তার কোনো দিনই শেষ হবে না |

শেষ কথা
আজ থেকে প্রায় চার বিলিয়ন বৎসর পূর্বে কোন মাহেন্দ্রক্ষণে এই পৃথিবীর কোন মহাসমুদ্রের কোন জলস্রোতে প্রথম প্রানের উন্মেষ ঘটেছিল তা আজ আর হয়তো সঠিক করে বলা সম্ভব নয় | প্রানের প্রথম উদ্ভবের পিছনে কোনো এক অতিবুদ্ধিমান অতীন্দ্রিয় সত্ত্বার সজ্ঞান পরিকল্পনার ইঙ্গিত বা ছায়া ছিল কিনা তাও হয়তো সঠিক করে বলা দুষ্কর, তবে আজকের উন্নত মানব প্রজাতি সহ পৃথিবীর যাবতীয় জীবকূল যে সেদিনের প্রথম প্রানের উন্মেষ থেকে দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল সে বিষয়ে আজকে আমাদের আর সন্দেহ থাকার কথা নয় | প্রথম সৃষ্ট আমাদের এই ভূগোলক ছিল একটি উত্তপ্ত গলিত অগ্নিকুন্ড – জীবনের উন্মেষ আর ধারণের জন্য ছিল অনুপযোগী – তারপর সময়ের এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিবর্তনের এক দীর্ঘ চড়াই উৎরাইয়ের পথ ধরে আমাদের আজকের এই শ্যামলে-নীলে রাঙানো আর প্রানের উচ্ছাসে ভরপুর এই প্রিয় পৃথিবী | আজও আমাদের এই মানবগোষ্ঠীতে বিতর্ক হয় এই চলমান জগৎ এবং জীবনকূল কি সজ্ঞান বুদ্ধিপ্রসূত কোন এক সত্ত্বার তাৎক্ষনিক সৃষ্ট ফল নাকি চলমান সময়ের ধারায় দীর্ঘ ধারাবাহিক পরিবর্তন আর বিবর্তনের ফল স্বরূপ উদ্ভূত ফসল | পরিবর্তন আর বিবর্তন যে হচ্ছে তা আমরা চারিদিকে সচেতন ভাবে চোখ মেলে তাকালেই বুঝতে পারি | চার্লস ডারউইন তাঁর ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী “দি অরিজিন অব স্পিসিস” গ্রন্হে উল্লেখ করেছিলেন, “জটিল এবং অল্পজ্ঞাত সূত্রসমূহ যা জাত উদ্ভাবনের নিমিত্তে কাজ করে, তা আমরা যতদুর বিচার করতে পারি সেই মতে প্রজাতি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যে সকল সূত্র কাজ করছে তাদেরই মত” | তারপর চার্লস ডারউইন-এর আমল থেকে আরো প্রায় দুই শতাব্দী কাল অতিক্রান্ত হতে চলল | এর মধ্যে বংশগতি আর প্রজনন বিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি সাধিত হয়েছে |এই পৃথিবীর বুদ্ধিমান মানুষ প্রজনন, জেনেটিক মিউটেশন আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে উদ্ভিদ আর প্রাণী জগতে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটিয়ে যাচ্ছে | আর প্রকৃতি নিয়ত নীরবে, নিভৃতে চালিয়ে যাচ্ছে তার পরিবর্তন আর বিবর্তনের অবিরাম খেলা | এই পরিবর্তন আর বিবর্তন এই মহাবিশ্বের অমোঘ নিয়ম | মহামনীষী কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন এই মহাজগতে একটি বাক্যই কেবল অপরিবর্তনশীল আর তা হলো, “এই জগত সংসারের সবকিছুই পরিবর্তনশীল” | পরিবর্তনের সুদীর্ঘ এবং দূর্গম পথ ধারায় চালিত হয়ে আজ আমরা এই পর্যায়ে উপনীত – বিবর্তনের এই অবিরাম স্রোতধারায় আমরা নিয়ত সন্মুখপানে ধাবিত | চার্লস ডারউইন-এর বিবর্তনবাদের তত্ত্ব সন্বন্ধে বিশ্বখ্যাত মনস্তাত্বিক ও “মনোবীক্ষণের জনক” হিসেবে পরিগণিত সিগমুন্ড ফ্রয়েড মন্তব্য করেছিলেন “এই জগতকে বোঝার জন্য একটি অসাধারণ অগ্রগতি” | তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি আজও আমরা অনেকেই তা বোঝার চেষ্টা করি না | বিবর্তনের এই অমোঘধারায় আমাদের এই বুদ্ধিমান মানবগোষ্ঠী (হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স ) এখন পর্যন্ত সার্বিক বিচারে বিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম ফসল | জাতি, বর্ণ, আর ভৌগোলিক অবস্হান নির্বিশেষে এই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের সক্ষম পুরুষ/মহিলা পৃথিবীর অন্য যেকোনো আর এক প্রান্তের মহিলা /পুরুষের সাথে দৈহিক মিলনে এমন মানব শিশু জন্মদানে সক্ষম যারা তাদের পরবর্তী বংশধর প্রজননে সক্ষম | পৃথিবীর তাবৎ মানবগোষ্ঠীর এই আন্ত:প্রজনন ক্ষমতা এই বৈজ্ঞানিক সত্যই আজ পুন:প্রতিষ্ঠিত করে যে এই পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠী মিলিতভাবে এক অভিন্ন প্রজাতি | আশা করি আমরা এই মানবসমাজ আরো খানিকটা বিবর্তিত হয়ে আমরা আমাদের নিজেদেরকে আরো ভালো করে চিনতে পারবো, আমরা সত্যিকার অর্থেই বুঝতে পারব যে আমরা এই মানবগোষ্ঠী একই উৎস থেকে উৎসারিত এক অভিন্ন মানবসত্ত্বা এবং আমরা একই পরিনামের উদ্দেশ্যে নিয়ত ধাবিত | এই নিয়ত ধাবমান জীবনের উদ্দেশ্য কি সেই সন্বন্ধে সঠিক ভাবে আমরা কেহই কিছু জানি না – হয়তবা এ নিছকই এই বিশ্ব প্রকৃতির এক হেঁয়ালি “খেলা” – খেলার আবার কিইবা উদ্দেশ্য ? আর উদ্দেশ্য যদি কিছু থেকেই থাকে তা হয়তবা নিতান্তই “আনন্দ” | এই “আনন্দ” থেকেই হয়তবা সবকিছুর সৃষ্টি !!

সবশেষে এই কথা বলা যায় যে আমাদের এই মহাবিশ্ব সহ এই মহা-মহাবিশ্বে জীবন নিত্য প্রবাহিত – এই প্রবাহের পরিনাম পরিবর্তন, আর বিজ্ঞান জগতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় এই অনুসিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছতে পারি যে এই পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তন ক্রিয়াশীল | তবে এই বিবর্তন কি এই মহাজগতের স্বগ্রথিত শক্তির অন্তর্নিহিত ক্রিয়ায় স্বপ্রণোদিত সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নার দ্বারা চালিত, নাকি এই পিছনে অতীন্দ্রিয় অতি বুদ্ধিমান কোন এক জগৎ সত্ত্বার নীল-নকশা ক্রিয়াশীল, সেই দার্শনিক প্রশ্ন থেকেই যায় | তবে যদি এর পিছনে এমন কোন সত্ত্বা থেকেই থাকে তবে তিনি যে এই “বিবর্তন” প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর এই নীল নকশার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছেন তা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না !

সহায়ক গ্রন্হপঞ্জী
1 Blomquist, R. Integrated Theory of Intelligence. Newhorizonscrisiscenter.com
2. Darwin, C. The Origin of Species – by means of natural selection or the preservation of favored races in the struggle for life. Modern Library Classics
3. Doidge, N. 2007.The Brain that Changes Iitself. V P Book Club. USA
4 Laszlo, E. 2004. Science and the Akashic Field .2nd Edition. Vermont.Inner Traditions.
5. Moran, J. M. 2009. Weather Studies – introduction to atmospheric science. 4th edition.. American meteorological society
6. Nolte, J. 2009. The Human Brain: An introduction to its functional anatomy. Sixth Edition, Mosby/Elsevier
7. Palmer, D. 2010. Origins – Human Evolution Revealed, illustrated, Mitchell Beazley Pub.
8. Palmer, D. 2009. Evolution –the story of life.. University of California Press, Berkely, Los Angeles
9. The Britannica Guide to The Brain. –a guided tour of the brain-mind, memory and intelligence. 2008. Runningpress Book Publishers, Philadelphia, USA