প্রবাদ আছে যে, কোনো ব্যাক্তি যদি সারা জীবন তালোয়ার নিয়ে “খেলে” তবে তালোয়ার দ্বারাই তারা মরণ ঘটে। কথাটি লিবিয়ার “সম্রাট” গাদ্দাফীর বেলায় অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হলো।

আজ (অক্টো. ২০ তারিখ) খবরে প্রাপ্ত যে গাদ্দাফী তার পৈতৃক বাস-ভূমি সারটি তে লিবিয়ার মুক্তিসেনাদের হাতে আহত হয়ে আটক অবস্থায় নিহত হয়েছে। গাদ্দাফীর জীবনের শেষ মহূর্তটি একটি ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে ‘ইয়াহু’ খবরের সাইটে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য বটে! রক্তাক্ত সেই দৃশ্য না দেখাই ভাল বলে আমি মনে করি।

লিবিয়ার মুক্তি সংগ্রামীরা সারটি আবরোধ করে রেখেছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। সবার ধারণা ছিল যে গাদ্দাফী সেখানে তার ছেলেগুলোকে নিয়ে দুর্গের সমতুল্য কোনো জায়গায় আছে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে সেই ধারণাটা সঠিকই বটে! আজ সকালে নাকি সারটি থেকে ৭০-৮০ টি গাড়ী ‘কনভয়’ করে পশ্চিম দিকে রওয়ানা হয়েছিল। এই খবরটি ফ্রান্স এয়ারফোর্সকে জানানো হলে ফ্রান্সের জঙ্গী বিমান এসে এই ‘কনভয়’ এর অপর বোমা বর্ষন করে। প্রথম দিকে খবরে বলা হয় যে এই উপর থেকে বোমা বর্ষনের ফলে গাদ্দাফী সাংঘাতিক ভাবে আহত হয় আর এটাই তার মৃত্যুর কারণ।

আজ সন্ধ্যার দিকে অন্য এক খবর বেরিয়ে আসে যুদ্ধ ভূমি থেকে। ফ্রান্সের জঙ্গী বিমান আক্রমণ করার পর নাকি মুক্তিসেনারা এক জায়গায় দেখতে পায় যে কিছু অস্ত্রধারী সেনা একটি জল নিষ্কাষণের পাইপ বা ড্রেনের ভিতর আশ্রয় নিচ্ছিল। তারা সেদিকে ধাবিত হয়। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্রের বিনিময় হয়। মুক্তিসেনারা এখন বলছে যে গাদ্দাফী নাকি ড্রেনের ভিতর ঢুঁকে বসেছিল তার সৈন্যদের নিয়ে। গাদ্দাফীকে সেখান থেকে বের করা হয় জীবিত অবস্থায়। কেউ কেউ আবার বলছে যে গাদ্দাফী তখনই আহত অবস্থায় ছিল। ক্ষেপা মুক্তি সেনারা বোধ হয় গাদ্দাফীকে তখনই বুলেট দ্বারা মেরেছে। গাদ্দাফীর এই অপমৃত্যুর জন্য ‘এম্নেস্টি ইন্টারন্যাশানাল’ একটি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। লিবিয়ার মুক্তি সেনারা একটি বিশেষ ভুল করে ফেলেছে গাদ্দাফীক এ’রকম ভাবে মেরে। গাদ্দাফীর বিচার হবার দরকার অবশ্যই ছিল যে রকমটি হয়েছিল সাদ্দাম বা হুস্‌নে মুবারকের বেলায়। একনায়কত্ত্বের হিরোরা তাদের জীবদ্দশায় যদি শাস্তি পায় তাহলে সেটি মানবতার জন্য একটি বলিষ্ট পদক্ষেপ। তবে অনেকেই হয়তো এটাও বলবেন যে, গাদ্দাফী তার মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী। অতএব, এই জল্লাদের জন্য খামাখা কুম্ভীরঅশ্রু বর্ষণ করে কিবা লাভ? তবে, ‘লো অফ্‌ দ্যা ল্যান্ড’ বলে একটি কথা আছে। এই নরাধমের বিচার ত্রিপলিতে হওয়া উচিত ছিল যা তে মধ্যপ্রাচ্যে এ’রকম হীন মনোবৃত্তির লোক ভবিষৎ এ বন্দুকের ভয় দেখিয়ে আর কোনোদিন ক্ষমতার গদিতে আসীন হতে না পারে।

এখন আসা যাক গাদ্দাফীর ‘লিগ্যাসী’তে। আগেই বলে রাখি যে আমি এই ইংরেজী শব্দের সমতুল্য আর কোন বাংলা শব্দ পাই নি কোনো বই বা অবিধানে। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে এই ‘লিগ্যাসী’ শব্দটি ব্যবহার করছি। তবে ‘উদাহরণ’ শব্দটা ব্যবহার করলে তা করা যেত।

আমার সুস্পষ্ট মনে আছে যে ১৯৬৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসে আমি যখন আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য আসি তখন লিবিয়ার কিছু কর্নেল-কেপ্টেন জাতীয় উঠতি বয়সের সেনারা তাদের দেশের বাদশাহ্‌ ইদ্রিসকে ঘাড় ধরে দেশ থেকে দেশান্তরী করে দেয়। এই নওজোয়ান সেনাদের রিং-লিডার ছিল ২৭ বছরের কর্নেল যার নাম মুয়ামার গাদ্দাফী। সে মিশরের আরেক সেনা অফিসার – গামাল নাসের – এর ভক্ত ছিল। নাসের ১৯৫২ সনে যে ভাবে মিশরের বাদশাহ্‌ ফারুককে দেশ থেকে বের করে মিলিটারী কুঁ করেছিল ঠিক তেমন ভাবে গাদ্দাফী লিবিয়ায় সামরিক শাসন চালু করেছিল। ক্ষমতা পুরোপুরি হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে অল্প সময়ের মধ্যেই। গাদ্দাফী মিশরের সাথে কন্‌ফেডারেসী বা অর্ধ-যুক্ত থাকার জন্য চেষ্টা করেছিল ‘প্যান-আরাবিজম’ দীক্ষায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে। পাগলাটে স্বভাবের এই মিলিটারী নেতা খেয়ালের বশবর্তী হয়ে তার জীবনে অনেক কিছুই করেছে লিবিয়ার জন্য। ১৯৬০ দশকে চীনে মাও সেতুং একটা লাল রঙের চটি বই বের করেছিল চীনের জনতাকে উদ্ভুদ্ধ করার জন্য। সেটির নাম দেয়া হয়েছিল “রেড-বুক”। সেই বই এ মাও এর উক্তি সন্বলিত করা হয়েছিল চীনেদের মগজ ধোলাই করার জন্য। লিবিয়ার গাদ্দাফী অনুরূপ ভাবে তার উক্তি একটি চটি বই এ ভরে দিয়ে তার নাম দিয়েছিল – “গ্রীণ-বুক”।

গাদ্দাফীর পাগলামীর দৃষ্টান্ত এত বেশী যে সেটি একটি লিখায় তার বিবরণ কুলিয়ে উঠবে না। প্রথম দিকে সে ছিল প্যান-আরবিস্ট কিন্তু সেটি যখন আর হয়ে উঠলো না, তখন সে পরে প্যান-আফ্রিকানিস্ট হয়ে গেল। কিছু দিন আগে আমি কোথাও যেন পড়েছিলাম যে সে নিজেকে আফ্রিকার বাদশাহ্‌ বলে দাবি করেছিল।

প্রেসিডেন্ট বুশের পররাষ্ট্র সচিব ডঃ কন্ডেলিস্‌সা রাইসকে সে তার মানসীর মত মনে করতো। ত্রিপলির রাজপ্রাসাদে মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি সেনারা একটি ফোটো এলবাম খুঁজে পেয়েছিল মিস্‌ রাইসের। সেই এলবামে গাদ্দাফী নাকি কন্ডির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে অনেক কবিতা লেখেছিল।

বেদুইনদের মত গাদ্দাফীর উঠ ও তাঁবুর প্রতি ছিল অনেক টান। ত্রিপলিতে সে রাজপ্রাসাদতুল্য ইমারত বানিয়েছিল বটে কিন্তু সে সেই প্রাসাদসম বাড়ীর উঠানে তাঁবু খাটিয়ে ঘুমাতে খুবই পছন্দ করতো। বেশীদিন আগের কথা নয় যখন গাদ্দাফী জাতীসংঘের বাৎসরিক সভায় যোগ দিতে এসেছিল নিউ ইয়ুর্কে তখন সে নিউ জার্সিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে উঠসমেত এসে হাজির হয়েছিল। তাঁবুও খাটাতে চেষ্টা করেছিল সেখানে। এলাকার লোকরা প্রতিবাদ করাতে সেই যাত্রায় গাদ্দাফীর আর তাঁবুতে থাকা হয়ে উঠে নি।

গাদ্দাফী প্রাশ্চাত্তের দেশগুলোকে মোটেও পছন্দ করতো না আর ইজরাইলকে তো নয়ই। এ’সব দেশের পেছনে সে লেগেই থাকতো একটা না একটা অজুহাত নিয়ে। ১৯৮৮ সনে প্যানএম এর একটি প্লেনকে তার চর দ্বারা আকাশচ্যুত করায়। প্রথম সে অস্বীকার করে যে লিবিয়া এই কাজের সাথে লিপ্ত ছিল না, তবে পরে ক্ষতিপূরণও দিতে বাধ্য হয়। গাদ্দাফীর লাজ-লজ্জা খুব কমই ছিল। আন্তর্কজাতিক পর্যায়ে নানান বেআইনী কাজের সাথে সে লিপ্ত ছিল। ১৯৭৫ সনে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর সে মুজিব হত্যাকারীদের অনেককে লিবিয়ায় চাকুরী দেয়। তার বিবেক বলে যে কিছু ছিল তা আমার জানা নেই।

গাদ্দাফী তার প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তার জন্য লিবিয়ার লোক না নিয়ে আফ্রিকার আন্যান্য দেশ থেকে ভাড়া করে মহিলা সৈনিক নিয়ে এসেছিল। এই ‘আমাজন’ এর বাহিনী তার ত্রিপলির প্রাসাদ রক্ষা করতো। সে রাশিয়া বা ইউক্রেন হতে এক মাঝ বয়সী সুন্দরী নার্স জোগাড় করেছিল তার নিজের জন্য। আর বেদুইনদের মত একাধিক বিয়ে করেছিল। তার পাশে যে বউকে দেখা যেত সেটি ছিল তার ছোট বউ।

গাদ্দাফী তার চেহারার ও সৌন্দর্যের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিল। খুব সম্ববতঃ ইটালী বা অন্য ইউরোপিয়ান এক দেশ থেকে প্লাস্টিক সার্জন আনিয়ে সে কয়েকবার মুখের উপর স্কালপেল চড়িয়ে বয়স কমিয়েছে কয়েকবার। সে সার্জনকে বলেছে যে তার দেশে কম বয়সী জনগণ বেশী তাই বুড়ো চেহারার হলে নওজোয়ানরা তাকে আর নেতা হিসাবে পছন্দ করবে না। মাথায় টাঁক পড়ার জন্য সে সবসময় পাগড়ী বা টুপি পড়ে থাকতো। কী আশ্চর্য যে আজ ভোরে মুক্তি সেনারা যখন তাকে নর্দমার ড্রেন থেকে বের করে নিয়ে আসে তখন তার মাথায় টুপি পর্যন্ত ছিল না। তাকে সে সময় দেখে চেনাই যাচ্ছিল না!

এই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে বেন্‌গাজীতে যখন জনতা রাস্তায় নেমে এসে তার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো তখন সে প্রতিবাদীদের ইঁদুর বলে আখ্যায়িত করলো। ক্ষমতার লোভে সে হাজার হাজার লিবিয়াবাসীদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দিল। সারা পৃথিবীর লোক প্রতিবাদ জানালো তবুও সে কারু কথা শুনলো না। সাত মাস ধরে গিদিতে ঠায় বসে রইলো। একমাত্র পাগল বা ‘মেগালোমেনিয়াক’ না হলে কেউই এরকম ভাবে নিজের দেশের লোকদের এত অত্যাচার বা হত্যা করতো না। আফ্রিকার অন্য দেশগুলো যেমন তিউনিশিয়া বা মিশরে এরকমটি হয়নি যেটি হলো লিবিয়ায়। গাদ্দাফী মিস্রাটা শহরকে বলতে গেলে ধূলিসৎ করে দিয়েছে তার ভাড়াটে সেনা দিয়ে। তার একাধিক ছেলেকে সামরিক বাহিনীর সেনাপতি বানিয়ে সে মনে করেছিল তার ডাইনেস্টি বহাল তবিয়ৎ এ থাকবে। আমার মতে গাদ্দাফী ছিল সল্প-বুদ্ধি সম্পন্ন নেতা। অন্য আর কেউ তার জায়গায় থাকলে আতি সহজেই বুঝতে পারতো যে তার দেশের লোকরা তাকে আর চাইছে না। পৃথিবীর ইতিহাস তাকে এক দয়ামায়াহীন ও নিষ্ঠুর নেতা বলে আখ্যায়িত করবে এবং তাকে জোসেফ স্টালিন, এডোলফ হিটলার, ইদি আমিন, ও সাদ্দাম হুসেনের দলে ফেলবে।

পিপিলিকার পাখা যেমন গজায় মরিবার তরে, তেমনি গাদ্দাফীর গদিতে এত সুদীর্ঘ দিন (৪২টি বছর) বসে থাকাটিও হয়েছিল তার মরিবার তরে। তার মহাপ্রয়াণে পৃথিবী হারালো একটি অতি আলোচিত ও পাগলাটে অধিনায়ক। তাকে নকল করে পৃথিবীর আর কোনো দেশে অন্য কোনো নেতা একনাগাড়ে ৪০-৪২ বছর রাজত্ব করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। যে লোক জীবিত অবস্থায় কখনো শান্তি খুঁজে পায় নি, সে যেন মৃত্যুর মাঝে শান্তি খুঁজে পায় – এই কামনাই করি।