পর্ব- ১ ও ২
পর্ব- ৩ ও ৪
পর্ব- ৫ ও ৬
পর্ব- ৭ ও ৮

-বস আরাম কইরা বসেন। কুনো সমস্য নাই। ধীরে সুস্থে যামু।

বেশ মুরুব্বি টাইপের গাধা। কথাও বলে বেশ ভারিক্কি মেজাজে। কথার ফাকে ফাকে যখন ঘাড় নাড়ে, গলায় ঝোলান ঘণ্টা বাজে। সেই ঘণ্টা- ভুতেশ্বরের বাণী আসার সময় যা শোনা যায়। তাকে বললাম- তুমি কথা বলতে পার?

– হ, পারি। ভুতেশ্বর আমারে জবান দিসে। হ্যার তো কথা কওনের কোন লোক নাই। তাই আমার সাথেই মাঝে মধ্যে সুখ দুঃখের প্যাচাল পারত।

-প্যচাল পারত মানে কি? এখন আর কথা বলেন না?

-না। অনেক দিন হইল ব্যাটায় কেমুন জানি ঝিম ধইরা আছে। মনে হয় খুব হিট পাইসে।

– হিট পাইসে মানে কি? আঘাত পেয়েছেন? কীভাবে?

– হ, আঘাত। তয় শরীরের আঘাত না মনের আঘাত।

– তাঁর মনে কে দুঃখ দিয়েছে?

-সুখটাই বা পাইল কোন দিন বলেন তো? প্রথম আধাত দিল শতান। তাঁর কথা হুনল না। তারপরে আদিম আর তাঁর বউ। তাঁর সখের জ্ঞান ফল মাইরা দিল। তাঁরপর সে মানুষরে বাগে আনবার জন্য কত শিষ্য পাঠাইল। কত কিসিমের বাণী দিল। মানুষ ঐ সব বাণী বিশ্বাস করে না। মানেও না। তবে তাঁর বাণী নিয়ে নানান ধান্ধা কইরা ব্যাড়ায়। ব্যাবসা করে। খুবই রমরমা ব্যাবসা।

-কে বলেছে মানে না? এখনও অনেক মুলুক আছে যেখানে ভুতেশ্বরের বাণী মোতাবেক মানুষের মুন্ডুচ্ছেদ করা হয়। এখনও ভুতেশ্বের টাটকা রক্ত পায়। রক্ত তো তাঁর প্রিয় খাবার, তাই না?

-তা ঠিক। কিন্তু ওভাবে আর কয় ফোটা রক্ত পাওয়া যায় কন? বানীতে বানীতে লড়াই হইল গিয়া আসল। সেরকম লড়াই কতকাল হয় না!

– বাণীতে বাণীতে যুদ্ধ? সেটা আবার কি?

– ভুতেশ্বর একদল কে কইসে গরু বলি দাও। আরেক দলকে বলেছে গরু তোদের মা। তারে রক্ষা কর। ব্যাস। লাইগ্যা গেল। কত রক্ত চান? আজকাল তেমন যুদ্ধ লাগে না বললেই চলে।

– কেন লাগে না?

– সব শতানের চাল। সে নতুন বুদ্ধি বাইর করসে। মানুষ আর আইজকাল মাইনসের মুণ্ডু ফালাইতে চায়না।

-কি সেই বুদ্ধি?

– যুক্তিবাদ না কি জানি। খুব খারাপ জিনিস। বিরাট অধর্ম। সেই চিন্তায়ই তো ভুতেশ্বর শয্যাশায়ী। শেষ বার যখন তারে দেখি কেমুন শুকাইয়া গেসে। খাওয়া দাওয়া কিসসু করে না। খাইতে নাকি বালা লাগেনা। মুখে স্বাদ নাই। কোন কিসু মুখে দিলেই বমি কইরা ফালায়। তারে কইলাম একাটা ডাক্তার দেখাইতে। দেখাইল না। কইল- নিজের মন্ত্রের বিরুদ্ধে যাই কি করে। স্বর্গলোকে সকলে হাসাহাসি করবে। কি আর করি, পুরান মন্ত্রগুলি পইড়া ফু দিলাম। মর্ত্য থেকে মধু, কালোজিরা, পবিত্র পানি আর উটের মুত্র আইনা খাওয়াইলাম। কিছুই হয় না। অহন হাল ছাইড়া দিসি।

-মনে হয় ভুতেশ্বরের পেটের গণ্ডগোল। পেটের গণ্ডগোল থেকেই মাথার গণ্ডগোল শুরু হয়। স্বর্গে গ্যস্ট্রিকের কোন ভাল ডাক্তার নাই?

-আছে তো! বুকাই নামে একজন বে-দ্বীন ডাক্তারকে স্বর্গে রাখা হয়েছে। মর্ত্যে সে বে-দ্বীন হয়েও ভুতেশ্বরের বানীকে বিরাট একখান বিজ্ঞান বইলা বই লিখসিল। তার কাছেও গেসিলাম। কিন্তু লাভ হয় নাই।

-কেন সে কোন চিকিৎসা দিল না?

-না। হ্যায় নাকি কালোজিরা মধু আর মন্ত্র চিকিৎসা করে না। ভুতেশ্বরের বানীরে বিজ্ঞান বইল্যা বই ল্যাখলেও, ডাক্তারী করে নাস্তিক অবিশ্বাসী পদ্ধতিতে। তারে খুব রিকোয়েস্ট করালাম ভুত তরিকায় চিকিৎসা দিতে। রাজী হয়না।

কথাটা শুনে খুব রাগ হল। বললাম –
-সে ভুতবাণীর উপর বই লিখতে পারে। ভুতের বাণীরে বলে বিরাট বিজ্ঞান! ভুত তরিকায় চিকিৎসা দিতে তার অসুবিধা কি?

-সেই কথা তারেও জিগাইসিলাম। ব্যাটা ভীষণ ধুরন্ধর। বলে- চৌদি বাদশা টাকা দিসে লিখে দিসি। জগত জুড়ে তা পড়ার লোকেরও অভাব নাই। তোর ভুত বাপেরে বল টাকা ছাড়তে, যা চায় তাই লিখে দিব। কিন্তু এই ছাই ভস্ম যেন দয়া করে না গেলে। এগুলান লিখতে হয় অন্যের জন্যে, নিজের জন্যে আলাদা ব্যাবস্থা।

চলতে চলতে আগুনের পর্দার সামনে এসে পড়লাম। বিরাট বিরাট সব পর্দা। পর্দা গুলো যেন রক্তিম চাদর। পুবালী বাতাসে দোল খাচ্ছে। গাধাটা কীভাবে পর্দাগুলো ভেদ করবে বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে অভয় দিয়ে সে বলল-
-আগুনের পর্দা দেইখা ভয় পাইয়েন না বস। আসলে আগুন ফাগুন কিছু না। ভেল্কি! সেই কোন আমলের পুরান কাপড়ের পর্দা। লাল রঙ করা। বাতাসে যখন দোল খায় মনে হয় আগুনের পর্দা। আসলে শাতান কে ভয় দেখাতেই এ ব্যবস্থা। সে যাতে ঐ গুলান পার হইয়া ভুতেশ্বররে আসন দখল করে না ফেলে।

কাপড়ের পর্দা হলেও তা পার হওয়া মুখের কথা না। সেই কোন আমলে ঝোলান হয়েছে, ঝাড়া পোছার কোন বালাই নেই। পরিস্কারের কোন নাম গন্ধ নেই। নেই। তাঁর পরতে পরতে ধুলা আর ময়লা। আমার আবার কোল্ড এলারজি। খুব হাঁচি দিতে শুরু করলাম।
-তোমরা সব করটা কী? পর্দা গুলো মাঝে মধ্যে তো ধুয়ে দিত পার?

– কী যে কন না? ভুতেশ্বর কি কাউকে বিশ্বাস করে যে পরদায় হাত দিতে দিব? সে বলে-ময়লা যমে জমুক। সে আমি বুঝব। আমার আগুনের পর্দা আর আসনের কাছে কেউ যেন কোনমতেই না ঘেঁষে।

তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম পর্দায় লাল রঙটা বেশ জ্বলজ্বলে। মনে হয় মাঝে মধ্যেই রঙ মারা হয়। গাধা জানালো- রঙ মারার জন্যে ভুতেশ্বরের স্পেশাল ব্যবস্থা আছে। তিনি চৌদি আজবে মানুষের মুন্ডুচ্ছেদের বিধান চালু রেখেছেন। সেই নরবলীর রক্ত আইনা ভুতেশ্বরের পর্দায় রঙ লাগানো হয়। ভুতেশ্বর বলেন-পর্দাটা আসল না, আসল হল ভয়। মানুষকে যত ভয় দেখানো যায় তত তারা বাধ্য থাকে।

গাধাটা বেশ অলস প্রকৃতির। পর্দাগুলো যে খুব যত্ন করে সরাচ্ছে তাও না। কেমন একটা ঢিলে ঢালা ভাব। কি মনে হল আমাকে এক যায়গায় নামিয়ে রেখে একটা পর্দায় গোঁড়ায় পেচ্ছাব করতে শুরু করল। আমি তো আঁতকে উঠলামঃ
– এই, কর কি? ভুতেশ্বরের পর্দায় পেচ্ছাব কর। তিনি দেখলে ভীষণ মাইন্ড করবেন!

আমার কথা তাঁর কানে গেল কিনা বুঝলাম না। সে পেচ্ছাব সেরে পর্দার কোনা টেনে নিয়ে তাঁর গাধাঙ্গ পরিস্কার করল। আমাকে বললঃ
– বুঝলেন বস, এইটারে কয় কুলুফ করা। আপনার আগে যে শিষ্য আইসিল, সে আমারে শিখায়া দিয়া গেছে। সে বলেছে –মহা প্রলয়ের আগে স্বর্গ মর্ত্যের সকল বস্তু দিয়ে কুলুফ করা সম্পূর্ণ হবে। জগত বানানোই হইসে বিশ্বাসী গনের কুলুফের জইন্যে।

গাধাকে বেশ জ্ঞানীই মনে হল। শুধু পেচ্চাব না, হাগা মুতা সম্পর্কে অনেক জ্ঞনের কথা বলল। অনেক মন্ত্র তাঁর মুখস্ত। পেশাব, পায়খানা, হাঁচি, কাশী, নারীর রক্তস্রাব, নারী গমন, দাসী গমন – এগুলি যে এত জ্ঞানের বিষয়, এত মন্ত্রের বিষয় আগে জানা ছিল না। ভুত ধর্মের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম – তুমি এত মন্ত্র জানলে কি করে?

গাধা হাসে। বলেঃ বস বিষয়টা কারও সাথে শেয়ার কইরেন না। ভুতেশ্বর যখন কোন মন্ত্র বানায়- আগে আমারে শোনায়। আমি ভাল হইসে কইলে তবে সে সেটা প্রকাশ করে। কইতে পারেন আমি তাঁর পুরুফ রিডার।

নোংরা পর্দাগুলো পার হলে পরে ভুতেশ্বরের বাড়ীর কাছে পৌছুলাম। মন্দিরের মতই একটা সাদামাটা বাড়ী। চারদিক থেকে চারজন দুত শুন্যে ধরে রেখেছে। একটা সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ীর গেট পর্যন্ত। গেটের পাশে টাঙ্গানো ছোট একটা সাইন বোর্ড। তাতে লেখাঃ
ভুতেশ্বরের বাসভবন।
১/১, ভুত মুল্লুক।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সর্ব সাধারনের প্রবেশ নিষেধ।

গাধা বলল- এই সিঁড়িটা দিয়ে সোজা উপ্রে উইঠা যাইবেন। গেটে দেখবেন একখান প্রহরী। ব্যাটা সাধারণত ঘুমায়। জোরে জোরে দরজা ধাক্কাইবেন। কোন কলিং বেল নাই। দরাম দরাম দরজায় বাড়ি দিলে তবেই তাঁর ঘুম ভাঙবো। আপনার পরিচায় দিলে সে ভিতরে ঢুকতে দিবো। ঢুকে হাতের ডানের দেয়ালেই ধনুকটা পাইবেন।

-ধনুক! সেটা দিয়ে কি করব?

-ওমা সেইডাই জানেন না। ভুতেশ্বের আপনার কত কাছে থিকা কথা কইব সেইডা তো ধনুক দিয়া মাইপা ঠিক করতে হইবো। যেমন ধরেন উন্মাদ শিষ্যের সময় ছিল দুই ধনুক। আপনি কিন্তু তিন ধুনুকের কমে রাজি হবেন না।

-কেন? সমস্যা কি? কাছে থাকাই তো ভাল?
গাধাটা খুব হাসল । বলল- ধুর মশাই। সারাদিন সে মর্ত্য থেকে পাঠানো বলির পশু খাইতেসে। রক্ত খাইতেসে। কোথাও কোথাও নরবলীর বিধানও ব্যাটা দিয়া রাখসে ছদ্মনামে। সেইগুলিও খাইতেসে। তাঁর মুখ দিয়ে বেজায় গন্ধ। সহ্য করতে পারবেন না।

-মহাউন্মাদ কি করে সহ্য করেছিল?

-সে পারত। বোঝেন তো, রতনে রতন চেনে। সে নিজে কি কম রক্তারকি করসে?

গাধা একটু থামল। কাছে এসে বলল- বাঙালিদের অনেক নাম শুনেছি। তাঁরা নাকি মর্ত্যের সবচাইতে শান্তশিষ্ট আর শান্তি প্রিয় জাতি। আপনেরে দেইখা বড় ভাল লাগসে।

সে আমাকে একটা রুমাল দিল। বলল- বস জিনিষটা কাছে রাইখেন। এইটা ভুতেশ্বরের পর্দা ছেঁড়া না। এইটাতে কোন কুলুফ করি নাই। ভুতেশ্বর যখন বাণী দিবো, এইটা নাকে চাপা দিয়েন, ভুতেশ্বরের বাণী নাকে রুমাল ছাড়া সহ্য করন যায় না।

১০

অনেক ডাকাডাকি করেও ভুতেশ্বরের প্রহরীর ঘুম ভাঙ্গাতে পারলাম না। কতকাল এভাবে ঘুমুচ্ছে, কে জানে। ঘুমুচ্ছে না মরে পড়ে আছে তাই তো বোঝা যায় না। এ মরার ঘুম সহজে ভাঙ্গবে না। তাকে জাগানোর চিন্তা বাদ দিলাম। দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকলাম। গাধার কথামত ধনুকটা হাতে নিলাম। তারপর ভুতেশ্বরের খাস কামড়ায় ঢুকলাম।

ঘোর অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। ভুতেশ্বর কি অন্ধকারে বসে থাকে? সে চোখে দেখে কিভাবে? ধীরে ধীরে পাঠ করলাম সেই অপ্ত বাক্যঃ ‘ভুতেশ্বর ছাড়া ভুত নেই। মদন তাহার চামচা’।

কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অগত্যা বাইরে এলাম। প্রহরীটা আগের মতই ঘুমুচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। দেখি গাধাটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘটনা কী? একি ঘুমের রাজ্য?

ভুতেশ্বরের বাসাটা ভাল করে ঘুরে দেখলাম। লক্ষ্য করালাম তাঁর পেছন দিকে আরও একাটা দরজা আছে। দরজাটা হাট করে খোলা। সেদিক দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি আলো আর আলো। আলো এত সুন্দর! আলো এত স্বচ্ছ! আলোর পথ ধরে সামনে এগোলাম। এবার পেলাম তাঁর দর্শন। সামনেই ভুতেশ্বরের আসন। আর তাঁর উপর উপবিষ্ট যিনি- তিনি স্বয়ং ভুতেশ্বর। নিশ্চল, নিশ্চুপ। কেমন এক অপার্থিব স্তব্ধতা।

ধীরে ধীরে তাঁর সামনে এগিয়ে গেলাম। উপুড় হয়ে তাঁর পায়ে মাথা ঠুকলাম। এবার পাঠ করলাম সেই অপ্ত বাক্যঃ ‘ভুতেশ্বর ছাড়া ভুত নেই। মদন তাহার চামচা’।
কোনো সাড়া নেই। তিনি কি রাগ করেছেন? রাগ তো করতেই পারেন। আমার অন্তরে তো তিনি নেই। তাঁর জায়গা জুড়ে বসে আছে মধুমালা। কী করব আমি। আমি যে পাপী। মধুপাপী!

-আমাকে ক্ষমা করুন ভুতেশ্বর। আমার ডাকে সাড়া দিন। ‘ভুতেশ্বর ছাড়া ভুত নেই। মদন তাহার চামচা’।
এবারও তাঁর সাড়া নেই। সেই নিশ্চল অপার্থিব স্তব্ধতা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। লক্ষ্য করলাম উপবিষ্ট ভুতেশ্বরের চোখের পলকও পড়ছে না। ভুতেশ্বরকি একটা ছবি, নাকি পাথুরে প্রতিমা। এই অসাধারণ সুন্দর ভুত কার সৃষ্টি কে জানে?

তাঁর আসনের সামনে ছোট্ট একটা টেবিল। তাঁর উপরে রাখা পত্র খানা। পত্রটা তুলে নিয়ে ভাজ খুললাম। সুন্দর গোটা গোটা হাতে লেখা। কিছুটা মেয়েলি ঢঙ্গে লেখা, অক্ষরগুলি ঘুরিয়ে পেচিয়ে ফুলের মত করা হয়েছে। এমন সুন্দর হাতের লেখা মর্ত্যলোকে মধু ছাড়া আর কারও দেখিনি। পত্রটা পাঠ করলামঃ

পরম করুনাময় ভুতেশ্বরের নামে শুরু করিলাম।
হে অনাগত শিষ্যবৃন্দঃ
তোমাদের অভিবাদন গ্রহন করিলাম (আমি কাহাকেও অভিবাদন জ্ঞাপন করিনা, কেননা তাহা আমার নীতি বিরুদ্ধ)।
অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ তোমাদের উদ্দেশ্যে এ বাণী লিপিবিদ্ধ করিতেছি। কেননা এ বাণী যখন তোমাদের কাছে পৌঁছাইবে, তখন আমি আর তোমাদের মাঝে, কিম্বা উপরে, কিম্বা পাশে কিম্বা নীচে কোথাও নাই। আমি ক্ষণস্থায়ী পরলোকের মায়া ত্যাগ করিয়া চিরস্থায়ী ইহলোকের পথে পাড়ি জমাইয়াছি।

সেইখানে আমার স্রষ্টা মনুষ্য সম্প্রদায় আমার চূড়ান্ত বিচার সমাধা করিয়া আমাকে জাদুঘর নামক চিরস্থায়ী স্বর্গ বা চিরস্থায়ী নরকে নিক্ষেপ করিবেন।

হে শিষ্য বৃন্দ,
আমি লক্ষ্য করিয়াছি, তোমারা আমার উপাসনার ব্যাপারে অতিশয় বিমুখ হইয়াছিলে। কিন্তু তোমরা নিশ্চয়ই অবগত আছ কিরূপে আমি ধীরে ধীরে তোমাদের উপর আমার কঠিন উপাসনা পদ্ধতি সহজ করিয়া আনিতেছিলাম।

তোমারা কি লক্ষ্য করোনি, আমি মুসি শিস্যের সময় প্রতি দিবস ভিত্তিক উপাসনা পদ্ধতি প্রদান করিয়াছিলাম, যাহাতে করিয়া তাহার যাযাবর অনুসারীদিগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাইতে পারে।

অতঃপর তোমারা কি লক্ষ্য করোনি, আমি আমার পুত্রের সময় সপ্তায় সপ্তায় উপাসনা পদ্ধতি প্রদান করিয়াছিলাম, যাহাতে করিয়া তাহার ব্যস্ত মনুষ্য সম্প্রদায় সারাদিন ধর্মচিন্তা না করিয়া মর্ত্যের কল্যাণ চিন্তায় ব্রতী হয়।

অতঃপর আমি মহাউন্মাদ শিষ্যের সময় নির্দিষ্ট মাস ভিত্তিক উপাসনা পদ্ধতি প্রদান করিলাম, সেকারণে সিদ্ধ মাস অসিদ্ধ মাস বিভাজন করিলাম ও উপাসনের জন্যে মাস নির্ধারণ করিলাম। যাহাতে করিয়া সময়ের পরিক্রমায় অধিক ব্যস্ত মনুষ্য সম্প্রদায় মর্ত্যের শুভাশুভের দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে অর্পণ করিয়া লইতে পারে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় উন্মাদ আমার ক্রমহ্রাসমান উপাসনা পদ্ধতি পালটাইয়া প্রতিদিনে এমনকি প্রহরে প্রহরে উপাসনা চালু করিয়ায়াছে। আর এই অতি উপাসনা তাহদের নিরর্থক সময় ক্ষেপন এবং নানাবিধ কলহের কারন হইয়াছে। অসংখ্য মন্দির নির্মাণ করিতেছে আর কৃষিজমির বিনাশ সাধন করিতেছে।
আধুনিক কালে মানুষ্য সম্প্রদায় অধিকতম ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে ও তাহারা জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় সন্তোষজনক আগ্রগতি লাভ করিয়াছে। তাহারা এখন নিজেরাই মর্ত্যের এবং জল, স্থল ও শুন্যে অবস্থানরত সকল জীব ও জড়ের প্রতিপালনের সক্ষমতা লাভ করিয়াছে।

এমাতবস্থায় ভুতেশ্বরের উপাসনা এখন তাহাদের পক্ষে নিরর্থক সময়ের অপচয় বহি কিছুই নয়।

বিধায় আমি সকল প্রকার ভুত উপাসনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করিলাম। সর্ব প্রকার পশুবলী ও নরবলী নিষিদ্ধ করা হইল। কেবল মাত্র জীবন ধারনের নিমিত্তে প্রানী বৈচিত্র যথাযথ সংরক্ষণ সাপেক্ষে প্রানী হত্যা বৈধ করা হইল।

প্রিয় শিষ্য বৃন্দ,

আমি জন্মাবধি স্বর্গে বসিয়া তোমাদিগকে দেখিয়া দেখিয়া সুখ পাইতেছিলাম। তোমাদের উপাসনা আমার কোন কাজে না লাগিলেও আমি তোমাদেরই মঙ্গলার্থে তাহা চালু রাখিয়াছিলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় উপাসনার নামে তোমারা নিজেরাই হানাহানি করিতেছ, উপাসনার ধরন, প্রক্রিয়া, সময়, স্থান, মন্দির এই সকল লইয়া তোমরা কলহে নিমজ্জিত হইয়াছ। আমি যাহার উপর উপবিষ্ট সেই আসনের কসম, যে জলাশয়ে সূর্য অস্ত যায় তাঁহার ঘোলা জলের কসম তোমাদের কোন উপাসনায় না আমার উদর পূর্তি হয়, না আমার আয়ূস্কাল এক মুহূর্ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।

মহান শিষ্য বৃন্দ,
আমার এই অন্তিম মুহূর্তে জানাইতে চাই, যেই দিন গালিলিও নামক নরাধাম মনুষ্য সন্তান দুরবীন নামক যন্ত্র তৈরি করিল, সে দিনই আমি বুঝিয়াছিলাম আমার অন্তিম ঘণ্টা বাজিয়া উঠিয়াছে। সেই ঘণ্টা দিকে দিকে বাজিতেই থাকিল। মানুষ চোখ মেলিল আকাশে। আকাশ উধাও হইল। সে বিচরন করিল মহাশূন্যে। তাঁহার বায়ু নিঃশেষ হইয়া গেল। এখন আর আমার ডানাওয়ালা প্রানীগুলিরে শূন্য যাত্রায় পাঠাইতে পারিনা। তাহারা পড়িয়া থাকিয়া থাকিয়া অচল হইয়া গিয়াছে। ছয় শত ডানা লাগিয়ে তৈরি করিয়াছিলাম বার্তা দুত। সে কোন বার্তা নিয়া যাইতে পারেনা। বায়ুহীন শ্যূন্যে ডানা ঝাপ্টাইয়া মরিতেছে। কিন্তু মর্ত্য বাসী ঠিকই বার্তা পাঠায় অদৃশ্য তড়িৎ পথে। তাদের সব তড়িৎ বার্তা আর তীব্র দৃষ্টির আপঘাতে আমার সব কিছু উধাও হইতে বসিয়াছে। আর কত লুকাইয়া রাখিব আমার স্বর্গ, নরক, আমার ভুতাসন মর্ত্য বাসীর নিকট হইতে?

মর্ত্যবাসীর জ্বালায় এমনিতেই অস্থির হইয়া উঠিয়াছিলাম। পরিশেষে এক মহাপাতকের আবির্ভাব হইল মর্ত্যলোকে। যাহাকে নিপাত করার মন্ত্র আমারও জানা ছিল না। তাহার চরম অবাধ্যতায় আমাকে চির বিদায় লইতে হইল।

আমার অকাল মৃত্যুর জন্যে ডারউইন দায়ী।

ইতি,
ভুতেশ্বর।

পত্রটা পড়া শেষ হল কি হলনা, আবার সেই মুহূর্তের অনন্ততা। কোথায় ভুতেশ্বর। কোথায় সাত আসমান। কোথায় রজনীর মধু ভ্রমন। আমি সপাট নিপতিত মধুতলে। তাঁর প্রসারিত উন্মুক্ত বাহু মধ্যে, তাঁর স্ফীত বক্ষের দীর্ঘতম উত্তান আর পতনের জোয়ার ভাটায় নিঃশেষিত আমি এক মদন। মধ্য রজনীর মধু ভ্রমনে ক্লান্ত, শ্রান্ত।
-মধুমালা, তুমি সাক্ষী আমার রজনী ভ্রমনের। আমার ভুত দর্শনের পরম লগ্নের তুমিই পরম লগ্নপ্রসু। আর সে লগ্ন মাঝেই লুকিয়ে ছিল মধুমিলনের অনন্তকাল। তুমি আমার মধু। আমার হানি।
মধুমালা হাসে। খিল খিল করে হেসে ওঠে আকাশ। বাতাস।

প্রত্যয়নঃ আমি আরেক বক্কর (ওরফে সত্যের সাক্ষ্যদাতা) এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মদন বর্ণিত ভ্রমন বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভুল। ইহা মধুমালার গৃহে ঘুমন্ত মদনের মধ্য রজনীর বা অন্তিম রজনীর স্বপ্ন বা কোনো ভ্রান্তিবিলাস নহে। বরং ইহা তাঁর সশরীরে সংঘটিত ভ্রমন বিবরন। মদন যেমন সত্যবাদী তেমন চরিত্রবান। সেকারনেই আমার ষষ্ঠ বর্ষীয়া সাবালিকা কন্যাকে তাহার চরনে (তাহার) স্ব-ইচ্ছায় অর্পণ করলাম।