লিখেছেনঃ অমল কৃষ্ণ রায়

AMOL-1

ধর্ম কথাটার নিগূঢ় অর্থ বোধ করি “বৈশিষ্ট্য” বা “অন্তর্নিহিত গুণ” ইংরেজিতে যাকে বলে property বা characteristic বা inherent quality যা একেবারেই অন্তরের জিনিস এবং যা এই পৃথিবীর অনেক প্রাত:স্মরণীয় বরেণ্য ব্যক্তিরা বহুকাল ধরে বহুভাবে বলে গেছেন – যেমন জলের স্বাভাবিক ধর্ম তারল্য, আগুনের ধর্ম প্রজ্জ্বলন, আলোর ধর্ম উজ্জ্বলীকরণ, পশুর ধর্ম পশুত্ব আর এত বলাই বাহুল্য মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব | যদিও মনুষ্যত্ব কথাটার কি অর্থ সে বিষয়ে অন্তহীন তর্ক বিতর্কের অবকাশ আছে তবে এই কথা বোধ করি সত্য মানবপ্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই “মনুষ্যত্বের ” একটা অন্তত মোটামুঠি সাধারণ সংজ্ঞা বোধকরি এই যুগের সকল মানুষেরই জ্ঞাত | মানুষের ভিতর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান | আমরা সকলেই জানি মানুষের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যকেই মূলত মনুষ্যত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয় নইলে মানুষকে আবার পশু থেকে আলাদা করে দেখা হবে কেন ! মনুষ্যত্বের ইতিবাচক দিকগুলো হলো – বিচার বুদ্ধি, লোক হিতৈষণা (অপরের উপকার করা), সত্যের সন্ধান করা, বিনয় (নম্রতা), মায়া-মমতা-দয়া-প্রেম-ভালবাসা, পরমতসহিষ্ণুতা, শালীনতা-লজ্জা, ভদ্রতা, সহমর্মিতা, দানশীলতা ইত্যাদি | এইভাবে এই মনুষ্যত্বের সাথে সম্পর্কিত গুণাবলীর তালিকাকে আরো অধিক দীর্ঘতর করা যায় | আমার মতে এই সকল গুণকে সংক্ষেপিত করে কয়েকটি বিশেষ বিশেষণেও আখ্যায়িত করা যায় – যেমন প্রজ্ঞাবান হওয়া অর্থাৎ অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত জ্ঞান লাভ করা, সকল প্রাণীর প্রতি না পারলেও অন্তত সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা অনুভব করা, সকল মানুষকে সমান জ্ঞান করা, কারো কোনো ক্ষতি না করা, প্রকৃতি আর প্রতিবেশের প্রতি যত্নবান হওয়া ইত্যাদি | আর মানুষের নেতিবাচক দিকগুলো হলো মূলত ক্রোধ, ঈর্ষা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি |

তবে যাবতীয় বস্তুনিচয় এবং পশু-পক্ষীর ধর্ম যত সহজে প্রকাশিত মানুষের “মনুষ্যত্ব” ততটাই তার অনান্য নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের তলদেশে লুক্কায়িত | আন্তরিক সদিচ্ছা আর অনেক চেষ্টার ফলে মানুষ তার সেই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের তলদেশ থেকে তার সেই মনুষ্যধর্ম নামক বৈশিষ্ট্যেকে সযতনে উন্মোচিত করতে হয় | সাধনার দ্বারা মানুষের মধ্যে অবস্হিত এই সকল নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যকে দমিত করে মানুষের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মধ্যেই মানুষের “মনুষ্যত্ব” নিহিত | যে মানুষের মধ্যে এই সকল ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের যত প্রাবল্য সেই সকল মানুষকে বলা যায় যে তারা তাদের স্বধর্ম – মনুষ্যধর্মে তত প্রতিষ্ঠিত | এই বিষয়গুলি গভীরভাবে অনুধাবন করে এই কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে ধর্ম কোনো বাহ্যিক প্রদর্শনীর বিষয় নয়, তা একেবারেই অন্তরের জিনিস | তবে সে যদি লোককে দেখানোর বিষয়ই হয়ে দাঁড়ায় তবে আমার মতে কিন্তু তাকে আর ধর্ম নামে আখ্যায়িত করা চলে না |

তবে সাধারণ ভাবে ধর্ম বলতে মানুষ যা বুঝে, যার একটা মোড়ক বেশির ভাগ মানুষের শরীরে-মনে সাঁটা হয়ে আছে তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, ইংরেজিতে যাকে বলে Organized religion – এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মোড়কে আমরা কেহ হিন্দু, কেহ ইহুদি, কেহ পার্সী, কেহ বৌদ্ধ, কেহ শিন্তো, কেহ জৈন, কেহ খ্রিস্টান, কেহ মুসলমান, কেহ শিখ, আবার কেহবা বাহাই, আবার এই আধুনিক কালের নতুন নতুন ধর্মের মোড়কে কেহবা সায়েন্টলজিস্ট আর কেহবা রায়েলিয়ান | আর এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিয়ে এই পৃথিবীতে কত বিভ্রাট, কত বিবাদ-বিসংবাদ ! আমাদের মহান মানবতাবাদী দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বহু আগেই বলে গেছেন ” যে ধর্ম আমাদের মুক্তি দিতে আসে সেই হয়ে উঠে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রচন্ড শত্রু” | রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক মহা-মনীষী – তাই তিনি ধর্মের নিন্দা করেছেন অতীব মার্জিত ভাষায় | কিন্তু আমার মত সাধারণ মানুষরা বলি – এই সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কেবল মানুষের শত্রু হয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি সেগুলি অনেক মানুষকে করে তোলে বর্বর ও অমানুষ | এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দ্বারা তাড়িত হয়ে মানুষ এই পৃথিবীতে যত অপকর্ম আর অনাসৃষ্টি সংঘটিত করেছে আর কোনো একক কারণ দ্বারাই বোধ হয় এই পৃথিবীতে এমনটা ঘটেনি | এর কারনটা কি ? – অন্ধ বিশ্বাস ! মানুষ যখন এই ” অন্ধ বিশ্বাস ” এর মোহে মোহাবিষ্ট হয় তখন তাকে যা করতে বলা হয় এই মোহে তাড়িত হয়ে সে তাই করে | তার “মনুষ্যত্বের” শ্রেষ্ট দান “বিবেচনা শক্তি” তা তখন সে হারিয়ে ফেলে – সেই বিশ্বাসের ভিতরে যদি কিছু ভালো জিনিস থাকে তবে তো মঙ্গল তবে সেখানে যদি খারাপ কিছু থাকে তবে তা করার জন্যে সে আরো দ্বিগুন উৎসাহে এগিয়ে চলে | আর তাই তো দেখি ইসলাম বাঁচানোর নামে গোলাম আজম, আর মওলানা মান্নানরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে পাকিস্তানের জল্লাদদের সাথে আঁতাত করে লক্ষ লস্ক মানুষকে হত্যা করে আর অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে, ধর্মান্ধ একদল হিন্দু রামজন্মভূমি রক্ষার নামে ভারতে ৪৬৫ বৎসরের পুরানো মুসলমানের মসজিদ ভাঙ্গে – আবার তারই পাল্টা জবাব দিতে আর এক দল ধর্মান্ধ মুসলমান বাংলাদেশে নিরীহ নিরপরাধ হিন্দুদের উপর আক্রমন করে, তাদের উপাসনালয় ভাঙ্গে | দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি অতীব সত্য অনেক মানুষই- বরং বলি তথাকথিত অনেক শিক্ষিত অথবা উচ্চশিক্ষিত মানুষই আর সকল বিষয়েই অনেক যৌক্তিক, বিবেচনাশীল এবং বিশ্লেষণাত্বক কেবল একটা বিষয় ছাড়া – আর সেটা হলো ধর্ম | সেই সকল যুক্তিবাদী মানুষদের সাথে আপনি যখন আলাপ করবেন তখন স্পষ্টতই দেখবেন তাদের অনেকেই বুদ্ধিদীপ্ত, অনেক বিষয়েই তারা অতীব জ্ঞানী, বিচক্ষণ এবং যুক্তিবাদী কেবল একটি বিষয় ছাড়া – আর সেটি হলো তারা যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত সেটির আলোচনা | ধর্ম নিয়ে কথা বলতে যাবেন – তবে তারা একেবারে বদ্ধ-আবদ্ধ, তাদের মস্তিষ্কের সকল শিরা -উপশিরার দরজা-জানালা এমনকি ভেন্টিলেটর পর্যন্ত বন্ধ – বন্ধ মানে কি একেবারে নিশ্চিদ্র – সেখান দিয়ে সুক্ষাতি-সুক্ষ ভাইরাস ঢোকার রাস্তাটিও নেই | তাদের ধর্ম বিশ্বাসে যদি কোনো ভাবে ফাটল ধরে যায় সেই ভয়ে মাঝে মাঝে এমন হয় যে তারা আপনার কোনো কথাটিও পর্যন্ত শুনতে চাবে না – আর যদি বা কোনো না কোনো ভাবে শুনেও বা শুনতে বাধ্য হয় আর আপনার যুক্তিগ্রাহ্য কথাটি যদি কোনো ভাবে হয় তার বিশ্বাসের বাহিরে তবেত সময়ে তিনি আপনার প্রতি খরগহস্ত হতেও দ্বিধা করবেন না |

আমরা জানি অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির মূল বিষয় বস্তু অজানা-অচেনা সৃষ্টি কর্তার অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে ধন-দৌলত, মান-সম্মান স্বাস্থ্য আর সমৃদ্ধি লাভ করার নিমিত্তে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা, মানুষের মূল্যবোধের উন্নতি সাধন বা সমাজে ন্যায় নীতির প্রতিষ্ঠা করা এবং – কল্পিত পরকাল বিষয়ক আলোচনা – ঈশ্বর বা খোদার সন্তুষ্টি সাধনের মাধ্যমে মৃত্যুর পর স্বর্গ বা বেহেস্ত লাভ করা | নির্দোষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে আমি কোন দোষ দেখিনা – অন্য কোন মানুষ বা প্রাণীর কোন ক্ষতি না করে যে সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয় তা হতে পারে একটি সংস্কৃতির অংশ | তবে বর্তমানে প্রচলিত অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানও আধুনিক সভ্য মানুষের কাছে প্রতিভাত হয় আদিম প্রথা হিসাবে | উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে জাঁকজমক সহকারে নরমুন্ডধারী মা মহাকালীর কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে হিন্দুর পাঁঠাবলি আর পরম দয়াবান আল্লাহতা’লার সন্তুষ্টি বিধানের নিমিত্তে মুসলমানের পশু কোরবানি !

এবার আসা যাক মানুষের ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠায় ধর্মের ভূমিকা নিয়ে | অনেকে বলবেন ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয় বটে, তবে প্রশ্ন হলো এক অলৌকিক সৃষ্টিকর্তা ও তার রচিত এক কাল্পনিক নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষকে ধর্মের নামে যে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হয় তা মানুষ গ্রহণ করে কতটা ? যুগ যুগ ধরে মানুষ তা করে যাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো- তার ফলাফল কি হচ্ছে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যত বিস্তৃতি সেখানে অন্যায় আর দুর্নীতির ততটাই ছড়াছড়ি, পুলিশ আর কোর্ট -কাছারির প্রয়োজন সেখানে মনে হয় তত বেশি | শুধু তাই নয় এমনকি ধর্মের অনেক প্রথা নৈতিকতার পরিবর্তে মানুষকে বরং অনৈতিকতার পথে ঠেলে দেয় | উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় হিন্দুর ধর্মের অন্তর্গত ধর্ম আর ঈশ্বরের নামে প্রচলিত নিষ্ঠুর ও অমানবিক চতুর্বর্ণ প্রথা যে কোনো বিবেচনায় মনুষ্যধর্মকে কলঙ্কিত করেছে | সেই তথাকথিত উচ্চ-বর্ণের হিন্দুর ধর্ম-রক্ষার নামে এই লজ্জাকর প্রথা লক্ষ লক্ষ মানুষকে অস্পৃশ্য হিসাবে আখ্যায়িত করে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মুখে কালিমা লেপন করেছে | কেবল মাত্র তথাকথিত নিম্ন বর্ণের পিতা-মাতার ঘরে জন্মের কারণে সেই অমানবিক বর্ণ-ভেদ প্রথার বিষ-বাষ্প থেকে রেহাই পাননি এমনকি ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রী ও ভারতের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান বাবাসাহেব নামে পরিচিত অর্থনীতিবিদ-রাজনীতিবিদ-চিন্তাবিদ-নৃতত্ববিদ-লেখক-দার্শনিক ড: ভিমরাও রামজি আম্বেদকর | এখন প্রশ্ন হলো এই একবিংশ শতাব্দীতে উপনীত হয়েওকি হিন্দুধর্মে নিষ্ঠাবান হিন্দুরা সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পেরেছে এই অমানবিক,পাপজনক বর্ণ-ভেদ প্রথার নিষ্ঠুর কবল থেকে ?

ধর্ম কিছু মানুষকে হয়তবা ন্যায়-নীতি শিক্ষা দেয় – তবে আমি বলি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে আত্যন্তিক সম্পৃক্ততা বেশিরভাগ মানুষকে অন্ধ করে – ধর্মের মোহে মানুষ যখন অন্ধ হয়ে যায় তখন তার মনে আর কোনো যুক্তি-বুদ্ধির আলো প্রবেশ করার পথ খোঁজে পায় না | নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তাকে যা বিশ্বাস করায় এর বাইরে সে আর কিছু বুঝে না – অন্য কোনো কিছুতে বিশ্বাসী আর কোনো মানুষের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকে না – আর যারা যুক্তিবাদী – কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেই যাদের বিশ্বাস নেই তাদের প্রতি তো একেবারে খড়গহস্ত | সুযোগ পেলে এক ধর্ম বিশ্বাসী অন্য আর এক ধর্ম বিশ্বাসীর প্রতি চড়াও হতেও দ্বিধা করে না – এবং তা তারা করে ধর্মের নামে, তার ঈশ্বর, আল্লা, ভগবান, জিওভাকে খুশি করার নামে | এই পৃথিবীতে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে সেখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে অবিশ্বাসী-যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না | বরং তারাই সেই সকল দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে – শান্তি মিছিলের আয়োজন করেছে – সেখানে অংশ গ্রহণ করেছে | সেখানে এক ধর্মের বিশ্বাসী মানুষ অন্য আর এক ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী মানুষকে হত্যা করেছে | এক ধর্মের মানুষ ভেবেছে যে তার ধর্মটাই কেবল ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত এবং অনুমোদিত – মনোনীত একমাত্র সত্য ধর্ম অতএব অন্য যেকোনো ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ ঈশ্বর কর্তৃক ঘৃণিত – অতএব যে ঈশ্বর কর্তৃক ঘৃণিত তাকে আমি ঘৃনা করলে আমারতো পাপ হওয়ার কথা নয় বরং আমি তাকে ঘৃনা করলে আমার তো ঈশ্বর কর্তৃক সাধুবাদই পাবার যোগ্য – এমনকি তাকে বধ করলেও আমার তো ঈশ্বর কর্তৃক পুরস্কৃত হওয়ারই কথা !

এবার আলোচনা করা যাক বেশির ভাগ ধর্মেরই যা মূল বিষয় বস্তু – সেই ঈশ্বর নিয়ে | সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বিষয়েও ধর্মগুলি সৃষ্টি করেছে এক বিশেষ বিপত্তি – এক এক ধর্ম দিয়েছে ঈশ্বর, আল্লা, ভগবান সন্বন্ধে এক এক রকম ব্যাখ্যা | কোনো একটা নির্দিষ্ট ধর্ম বা সেই ধর্মের আবিষ্কর্তা সৃষ্টিকর্তার একটা নির্দিষ্ট স্বরূপ বর্ণনা করেছে আর সেই ধর্মমতের বিশ্বাসীরা তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে – তার বাহিরে কোনো কিছু চিন্তা করা তাদের এক্তিয়ারের বাহিরে | এই ধর্মসকল সৃষ্টিকর্তার বিষয়ে নীরব থাকলে প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের মত করে তার নিজের সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ কল্পনা করত – সৃষ্টিকর্তা বলে কেহ আছে বা নেই সেই ব্যাপারে আরো অধিক সংখ্যক মানুষের আরো অসংখ্য চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটত | মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে একটা বদ্ধ জলাশয়ে যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হাবু- ডুবু খেত না |

ঈশ্বর যদি একজনই হবেন তবে কোন যুক্তিতে আপনি বলবেন সেই সর্বজ্ঞানী পরম দয়াশীল ঈশ্বর একটার পর একটা ধর্ম সৃষ্টি করে তাঁরই সৃষ্ট প্রাণীকে দ্বিধাগ্রস্ত করবেন | কোন যুক্তিতে আপনি বলবেন তারই সৃষ্ট বিভিন্ন ধর্মে তিনি তাঁর অস্তিত্ব আর স্বরূপ সন্বন্ধে এক এক রকম ব্যাখ্যা দিবেন ? যুক্তিগ্রাহ্য মন বলে ঈশ্বর সত্যি থাকলে এটা কখনই হত না | মানুষই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে বলে ঈশ্বরের এত রকম আর তার এত হেনস্থা !

ঈশ্বর নিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসার অন্ত নেই – ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলেই বা তাঁর কি স্বরূপ, আর ঈশ্বর বলে কেহ না থাকলেই বা এই সমস্ত সৃষ্টির উৎস কোথায় – তা নিয়ে কত প্রশ্ন – কত জিজ্ঞাসা অনন্তকাল ধরে | ঈশ্বর যদি থেকেই থাকেন তবে তিনি কেন এতদিনে এই সমস্যার একটা সুরাহা করে দিচ্ছেন না – তিনি কেন নিজেকে এক মহা-রহস্যজালে আবদ্ধ করে রেখেছেন – কেন তিনি নিরন্তর তাঁর সৃষ্ট জীবের সাথে এই লুকোচুরি খেলছেন ? আর ঈশ্বর বলে যদি কারো অস্তিত্ব না-ই থেকে থাকে তবে তো ঈশ্বর নামক আর কাউকে দোষ দেয়া যায় না ! তখন সব অপবাদ প্রাপ্য এই বুদ্ধিমান মনুষ্য জাতির – এই বুদ্ধিমান মানুষ কেন এখনো এই নিগূঢ় সত্যটি আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলো – তিনি যদি থেকেই থাকেন -তবে তো তিনি নিশ্চয়ই জীবন্ত – আর একটা জীবন্ত অস্তিত্বের অনুসন্ধানতো এতটা কঠিন হবার কথা নয় ! তবে এটা সত্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যাদের অবস্হান তাদের সেই অবস্হান কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা- নিরীক্ষার ভিত্তিতে নয় – তা কেবল তাদের অন্ধবিশ্বাসের ভিত্তিতে – আর তাদের সেই অন্ধবিশ্বাসের ভিত্তি হলো মানুষের প্রাচীন সকল ধর্মগ্রন্থ – আর এই সকল ধর্মগ্রন্থসমূহ যে প্রাচীন মানুষদের সৃষ্টি তা আজ প্রমানিত সত্য | যদিও অনেক মানুষই (মূলত যারা ধর্মে বিশ্বাসী ) মনে করে থাকেন যে ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বর কর্ত্তৃক প্রেরিত, তবে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের পক্ষে কোনো যুক্তিতেই তা গ্রহণযোগ্য নয় – অতএব কি দাঁড়ালো – ঈশ্বরের আবিষ্কার কিছু মানুষের মনগড়া কল্পনা – এই কল্পিত ঈশ্বরের অন্ধমোহে তাড়িত হয়ে কেহ যদি জীবন যাপন করতে চান তবে তা করতে পারেন বৈকি – তবে তাদের অন্ধবিশাস দিয়ে অন্যকে বশীভূত করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় নয় কি ?

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এক সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আছেন এই মহাবিশ্বের সাত আসমানের উপরে কোনো এক অকল্পনীয় সৌন্দর্যমন্ডিত এক অতি মনোরম স্হানে যেখানে দুধের নহর সদা প্রবাহিত, পারিজাত ফুলের অসাধারণ গন্ধে চারিদিক আমোদিত, উর্বশী, মেনকা, রম্বার মত অগনিত অপ্সরা, হুর-পরী দ্বারা চারিধার কল হাস্যে মুখরিত – তিনি সদা ব্যস্ত সৃষ্টি আর বিনাশ কর্মে – তাঁর অসীম করুনা তাঁর সৃষ্ট প্রাণীর প্রতি আবার খরগহস্ত মহাপ্রলয়ের দিনে তাদের বিচার করার অপেক্ষায় – তিনি অসীম অনন্ত প্রেমময় আবার অন্যদিকে নিষ্ঠুর বিনাশায় ! এখন প্রশ্ন হলো এই পরম দয়ালু – অসীম কৃপাময় ঈশ্বর যদি এই পৃথিবীটা নিজ হাতেই তৈরী করলেন তবে কেন তিনি এটাকে আরো একটু ভালো করেই তৈরী করলেন না – তাঁর ভান্ডারে কি এত অভাব ছিল যে পৃথিবীর প্রকৃতি তিনি এতটাই বন্ধুর করে তৈরী করলেন – কি এমন তাঁর ক্ষতি হত পৃথিবীর উপরিভাগটা যদি আরো একটু মসৃন হত – তাঁর মহিমা কি আরো একটু বাড়ত না যদি পৃথিবীর আবহাওয়াটা আরো একটু বন্ধু ভাবাপন্ন হত – এই ঝড়-ঝন্ঝা–ভূমিকম্প- জলোচ্ছ্বাসে-পূর্ণ এই পৃথিবীতে বাস করে মনে হয় যেন তিনি মানুষকে শাস্তি দেয়ার জন্যেই এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন – তাহলে যে ঈশ্বরকে বলা হয় পরম দয়ালু – এটাইকি তাঁর পরম দয়ার পরাকাষ্ঠা ? রোগ-শোক-মহামারিতে পূর্ণ এই পৃথিবীতে প্রতিদিন যেন মানুষকে মৃত্যুদূতের সাথে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হয় | একজন পরম দয়ালু সৃষ্টি কর্তাই যদি পরম দয়া পরবশ হয়ে এই মনুষ্য আর প্রাণীকুল সৃষ্টি করলেন তবে সাথে করে কেন এত ব্যাধি-মহামারীর অশান্তিও দিলেন ? ঈশ্বর ভক্তরা হয়ত বলবেন তিনি এইসকল দিয়েছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যে আর সব সময় ব্যস্ত রাখার জন্যে | ধিক তাদের সেই কুযুক্তির !

ধর্মগ্রন্থগুলিতো ঠাসা সেই সকল আপ্ত বাক্যে যেন মানুষ সকাল সন্ধ্যা তাঁর পূজা ভজন করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, নয়তো প্রতি রবিবারে গির্জায় প্রার্থনা করে | মানুষকে এতটা দুর্দশাগ্রস্ত না করলেকি মানুষ তাঁর পূজা ভজন আরো একটু বেশি করে করার ফুরসত পেত না ? এখন তো যারা তার পূজা ভজন করে তা করে একান্তই তাঁর শাস্তির ভয়ে আর মানুষ যদি এই পৃথিবীতে একটু শান্তিময় জীবন যাপন করতে পারত তবে মানুষ তার পূজা ভজন করত তার প্রতি অপার ভালবাসতে – সেই পরম দয়ালু ঈশ্বর -আল্লা- ভগবানের জন্যে কি সেটা আরো অনেক সুখকর হত না ?

আপনারাতো অবগত আছেন এই তো মাত্র কিছুদিন আগেই জাপানে কি ভয়াবহ সুনামিটাই না হয়ে গেল ! আপনাদের মনে কি প্রশ্ন জাগে না কেন এই নিষ্টুর সুনামির কবলে এই জাপান জাতি পতিত হলো – ঈশ্বর বিশ্বারীরা কি করে এর ব্যাখ্যা করবেন – আপনাদের পরম দয়ালু -কৃপাসিন্ধু ঈশ্বর কি কারণে জাপানী জাতিকে এমন নির্মম শাস্তি দিলেন ? আমরা সবাই জানি জাপানিরা কত ভদ্র, কত মার্জিত, কত দয়াবান একটা জাতি – কত গুনের আর বিনয়ের অধিকারী এই জাতি – ধর্মগ্রন্হগুলিতে যে সকল বিশেষ গুনের কথা বলা আছে – যা করলে ঈশ্বরের পরম অনুগ্রহ পাবার কথা তার প্রায় সবকটাই জাপানি জাতিতে বিদ্যমান – তবে ঈশ্বর কেন তাদের এমন শাস্তি দিলেন – কিসের অপরাধে – আমার ধর্ম বিশ্বাসী বন্ধুরা যে বলেন ঈশ্বর পরম দয়ালু – এই কি তাঁর পরম দয়ার প্রদর্শনী ?

সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মহাত্মা গান্ধী হয়ে উঠেছিলেন পরম ধার্মিক – মনুষ্য-ধর্মের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ | পরম সত্যের অনুসন্ধানকে করে ছিলেন জীবনের ব্রত | অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে “সত্যাগ্রহ” (অহিংস প্রতিরোধের অনুশীলনের দর্শন) কে অবলম্বন করেছিলেন তার সংগ্রামের অস্ত্র হিসাবে | ধর্মান্ধ হিন্দু-মুসলমানের ভাতৃঘাতী দাঙ্গা দমনের প্রয়াসে আমরণ অনশনের মত ব্রত গ্রহণ করে তিনি মানবতার জয়গানই ঘোষণা করেছিলেন | কিন্তু হায় ! এমন মানব-প্রেমী মহাত্মাকে প্রাণ হারাতে হলো ধর্মান্ধ হিন্দু নাথুরাম গডসের নির্মম বুলেটের আঘাতে !

আমাদের অতি প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম যিনি মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি হিসাবে পরিচিত,ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি কতভাবে বলেছেন | প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উপরে উঠে তিনি মানবতার জয়গাঁথা গেয়েছেন | একটি সাধারণ মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও মুক্তবুদ্ধির চেতনায় তাড়িত হয়ে বাহ্যিক ধর্মের মোড়ক থেকে বের হয়ে এসে ধর্মান্তরিত না করে একজন হিন্দু আশালতা (প্রমীলা) দেবীকে বিবাহ করার মত উদারতা দেখাতে পেরেছিলেন এবং ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক গোড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নামকরণ করেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ – কিন্তু হায়! তবু কিছু কিছু মানুষের কিছুতেই চেতনার দ্বার উন্মোচিত হয়,তাদের ধর্মান্ধতার গ্লানি কিছুতেই ঘুচে না!!

বাংলাদেশের আরজ আলী মাতুব্বর কোনো স্কুল কলেজে পড়ালেখা করেননি – তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত সাধারণ মানুষ – কিন্তু এই সাধারণ হয়েও এই অসাধারণ দার্শনিক মানুষটির মনে যে সকল প্রশ্নের উদয় হলো – কেন অনেক তথাকথিত উচ্চ-ডিগ্রিধারী মানুষের মধ্যেও তা জাগ্রত হয় না – কেন তাদের মনের আগল খুলে না – কেন কোনো যুক্তি- বুদ্ধি সেখানে কোনো পথ খুঁজে পায় না ? ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহনের জন্যে মানুষের প্রতি আরজ আলী মাতুব্বরের উদাত্ত আহবান বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:- “মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মিটাইতেছে বিজ্ঞান। আপনি যদি বিজ্ঞানের দান গ্রহণে অমত করেন, তাহা হইলে আকাশের দিকে তাকান, ঘড়ির দিকে নয়। আপনি যদি বিজ্ঞানের দান গ্রহণ করিতে না চাহেন, তাহা হইলে যানবাহনে বিদেশ সফর ও জামা-কাপড় ত্যাগ করুন এবং কাগজ-কলমের ব্যবহার ও পুস্তক পড়া ত্যাগ করিয়া মুখস্থ শিক্ষা শুরু করুন। ইহার কোনটি করা আপনার পক্ষে সম্ভব? বোধহয় একটিও না। কেননা মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের দান অনস্বীকার্য। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন হইতে শুরু করিয়া দেশলাই ও সুচ সুতা পর্যন্ত সবই বিজ্ঞানের দান। বিজ্ঞানের কোন দান গ্রহণ না করিয়া মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। মানুষ বিজ্ঞানের কাছে ঋণী। কিন্তু সমাজে এমন একশ্রেণীর লোক দেখিতে পাওয়া যায়, যাঁহারা হাতে ঘড়ি ও চক্ষে চশমা আঁটিয়া মাইকে বক্তৃতা করেন আর ‘বস্তুবাদ’ বলিয়া বিজ্ঞানকে ঘৃণা ও ‘বস্তুবাদী’ বলিয়া বিজ্ঞানীদের অবজ্ঞা করেন। অথচ তাঁহারা ভাবিয়া দেখেন না যে, ভাববাদীরা বস্তুবাদীদের পোষ্য। বিজ্ঞান মানুষকে পালন করে। কিন্তু ধর্ম মানুষকে পালন করে না, বরং মানুষ ধর্মকে পালন করে এবং প্রতিপালনও।”

জীবন-দার্শনিক লালন ফকির কোনো স্কুল-কলেজে পড়েননি – কিন্তু এই সাধারণ হয়েও এই অসাধারণ মানুষটি সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে এক গভীর মানবতাবাদী দর্শনের প্রচারক ছিলেন | বাহ্যিক জাত-পাত সন্বন্ধে তিনি যে সকল গভীর চিন্তাশীল প্রশ্নসকল করে গেছেন তা বোধ করি সকল শিক্ষিত মনুষেরই গভীর অনুভবের বিষয় | যেমন লালনের একটি অসাধারণ গান: “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে | … … … … যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কি হয় বিধান ? বামন চিনি পৈতা প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে ||

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি অনেক মানুষের এই আত্যন্তিক আনুগত্যের মূল কারণ বোধ করি তার শৈশবকালীন শিক্ষা | জন্মের পর থেকেই একটি মানবশিশুকে তার পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমনি শিক্ষা দেয়া হয় যে এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপরীতে অন্য কোনো ধারণার আভাস পাওয়ার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হয় | ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে ডারউইনের বিবর্তনবাদের মত প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক মতবাদের সাথে আজও অনেক মানব শিশুকে পরিচিত করানো হয় না | ধর্মবিশ্বাস কে স্বত:সিদ্ধ সত্য বলে তাকে শিখানো হয় | এমন ভাবে তাকে শৈশবে শিক্ষা দেয়া হয় যে সে মনে করতে বাধ্য হয় যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আনুগত্য ছাড়া তার জীবনযাত্রা অচল | প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগ্রন্থসমূহে নি:সন্দেহে মানুষের জন্যে কল্যানকর অনেক জিনিস আছে বটে তবে মানবতা বিরোধী উপাদানের প্রাধান্যও সেখানে যথেষ্ট | ধর্মের ভালো জিনিসগুলি পালন করে অনেকে ভালো মানুষ হতে পারেন বৈকি তবে ধর্ম গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান জিনিসগুলোকে ঈশ্বর বা আল্লার বাণী বলে গ্রহণ করে তার পুরোটাই বিশ্বাস করলেই যত বিপত্তি | আজ একথা বিশেষ ভাবে প্রমানিত যে একজন মানুষ কোন একটি নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী না হয়েও তিনি একজন নীতিবান, সুখী, এবং সর্বদিক থেকে ভারসাম্য রক্ষাকারী একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বে পরিনত হতে পারেন |

আবারও বলি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষকে অন্ধ করে – একজন গোঁড়া হিন্দু মনে করেন তার ধর্মটাই আদি, সনাতন এবং শ্বাশত, আর অন্য সব ধর্মের অনুসারীরা নিম্নশ্রেণীর মানুষ এবং তারা অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্য, একজন পরম বিশ্বাসী বৌদ্ধ ভাবেন গৌতম বুদ্ধই একমাত্র পরম সত্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন, একজন গোঁড়া ইহুদি মনে করেন মোজেজ এর প্রবর্তিত ধর্মই কেবল ঈশ্বর-প্রেরিত সত্যধর্ম, একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান মনে করেন ঈশ্বরের পুত্র যীশুর আশ্রয়ই কেবল ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করে স্বর্গে যাওযার একমাত্র পথ, একজন ঈমানধার মুসলমান মনে করেন আল্লার শেষ নবী কর্তৃক প্রচারিত তার ধর্মটাই সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আর আল্লা কর্তৃক অনুমোদিত একমাত্র সত্য ধর্ম এবং আর সকল ধর্মের অনুসারীরা কাফের এবং আল্লা কর্তৃক ঘৃণিত, আর একজন টারবানধারী শিখ মনে করেন গুরুনানকই কেবল সব সত্যের উপরে এক অকৃত্রিম পূর্ণ সত্যের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন |

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির অন্তর্গত ঈশ্বরের নামে প্রণীত ধর্মগ্রন্থগুলি ঠাসা অসঙ্গতিপূর্ণ আর অযৌক্তিক বচনে – সেই সকল আপ্তবাক্যসমূহ যুগে যুগে বহু মানুষকে প্ররোচিত করেছে অন্ধবিশ্বাসে আসক্ত হতে | ফলে মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তার চর্চা হয়েছে অবদমিত – জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চার পথকে করেছে কন্টকাকীর্ণ – ধীরগতি সম্পন্ন – আর তার চেয়েও ভয়াবহ – এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের বিস্তৃতি এই মানবপ্রজাতিকে করেছে বহুধা-বিভক্ত -তাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে ভাতৃঘাতী সংঘর্ষ !

এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসকল এই পৃথিবীতে না থাকলে -১৯৪৬ সালে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হত না – সেখানে ১০ লক্ষ লোকের প্রাণের বলি হত না আর ৭৫ হাজার নারী নির্যাতিত হত না, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হত না এবং দেড়কোটি মানুষকে তাদের অনিচ্ছায় বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করে অজানা অচেনা দেশে শরণার্থীতে পরিণত হতে হত না | মৃত্যুর পরে কাল্পনিক স্বর্গ লাভের লোভ না থাকলে এই পৃথিবীতে হয়ত আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী মানুষ থাকত না, ধর্ম যুদ্ধের নামে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বলি হত না| অর্ধ শতাব্দীরও অধিক কাল ধরে ইসরাইল- প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ লেগে থাকত না, ৯/১১ সংঘটিত হত না , তালিবানরা ধর্মের দোয়াই দিয়ে হাজার হাজার বছরের পুরানো বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করত না, কাল্পনিক ঈশ্বরের নামে ধর্ম দ্রোহীতার অপরাধে কারো মস্তক খন্ডিত করার ফরমান জারি হত না, কিছু মানবতাবিরোধী শরীয়া আইনের নামে সামান্য অপরাধের কারণে (এমন কি কোন সুনির্দিষ্ট প্রমান ছাড়া) নিরীহ নারীকে পাথর ছুড়ে বা দোররা মেরে মেরে ফেলা হত না !!!

AMOL-2
ছবি : ধর্ষিতা এবং শরীয়া আইনে দোররা মারায় আহত এক নিরীহ নারী – ছবি: প্রথম আলো

কৈফিয়ত: আমি জানি আমার এই লেখা পড়ে হয়তো আপনারা অনেকেই আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন – আমাকে ঘোরতর ঈশ্বর- এবং ধর্ম- অবিশ্বাসী হিসাবে আখ্যায়িত করবেন – কেহ কেহ হয়তবা এই ব্লগের সম্পাদকের প্রতিও অশেষ বিরাগ ভাজন হবেন এমন একটি ধর্মদ্রোহী নিবন্ধ ছাপানোর জন্যে | তবে আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন তবে তাঁর প্রতি আমি পরম বিশ্বাসী এবং পরম শ্রদ্ধেয় – আমি তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করি | তবে এই পৃথিবীতে বর্তমানে বিরাজমান, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসকল যে ঈশ্বরের কথা বলেছে, যে ঈশ্বরের বর্ণনা দিয়েছে – সেই ঈশ্বরে আমার ঘোরতর সন্দেহ – আমি মনে করি ধর্মগ্রন্থগুলি মানুষের রচিত এবং এই সকল ধর্মগ্রন্থগুলি ব্যর্থ হয়েছে তাদের বর্ণিত ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে | আমি যে ঈশ্বরে আস্থাবান সেই ঈশ্বর এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুর অঙ্গীভূত – বিশ্বপ্রকৃতি – সেটি বোধহয় বর্ণনার অতীত – কেবল বোধের বিষয় – সেই ঈশ্বরের স্বরূপ উন্মোচন বোধ করি এখনো গবেষণার বিষয় – সেই ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কিনা জানি না – তবে নি:সন্দেহে মহাশক্তিধর – সর্বজ্ঞাত কিনা জানি না – তবে মনে হয় সর্বদা সবকিছু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যস্ত – এবং বোধ করি সেই ঈশ্বর এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বত্রই সবকিছুর মধ্যেই বিরাজিত |