ঊনিশ শতকে সমাজ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলর সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- মানুষের বিশ্বাস, আচার- আচরণ এবং জ্ঞানের সমন্বিত অবস্থাকে বলা যায় সংস্কৃতি। ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ, নিয়মকানুন, উৎসব, আমাদের প্রতিদিনের নিত্যকার কাজ কারবার, ইত্যাদি নানা উপকরনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। কোন সংস্কৃতি শাশ্বত নয় উপাদান গুলোর পরিবর্তনের সাথে সংস্কৃতিতেও লাগে পরিবর্তনের দোলা।

একটু স্থিতিশীল জীবনের সুখ ও দুমুঠো খাদ্য নিশ্চয়তার আশায় যাযাবর আর্যরা ভারতীয় অনার্যদের দেশে স্থানান্তরিত হলে সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছায়া সঙ্গী হয়ে তাদের সাথে চলে আসে। তা হল-বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। যা ভারতীয় উপমহাদেশের আদি অধিবাসী অনার্য সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ধর্ম বিশ্বাসে উপহার দেয় আমূল পরিবর্তন। দীর্ঘ দিন তারা অনার্যদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে কৃষিকাজ, বাণিজ্য, পশুপালন, বিয়ে-শাদী সহ সামাজিক ও নানান বৈষয়িক প্রয়োজনে স্থানীয় অনার্যদের সাথে তাদের যোগাযোগ গড়ে উঠে, বাড়াতে হয় সম্পর্ক। দৈহিক সৌন্দর্য্য, শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ছলেবলে, যুদ্ধ বিদ্যায়, বৌদ্ধিক-কৌশলিক জ্ঞানে উচ্চভিলাষি আর্যরা অনেক এগিয়ে থাকার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে বাধ্য করে নিরীহ শান্ত গোছের অনার্যদের। একই সাথে দখল করে নেয় সমাজ নিয়নন্ত্রণের ভূমিকা। নাক উঁচু আর্যরা প্রথম থেকেই প্রভুসুলভ আচরণে ঋদ্ধ থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ উচ্চ জাত ব্রাহ্মন ঘোষনা দিয়ে স্থানিয় অনার্যদের নীচু, তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাবাবেশে দেখতে থাকায় এই সম্পর্ক অনার্যদের জন্য কখনো মর্যাদাপূর্ণ বা সুখকর ছিল ভাবা যায় না। শক্তি হীনতা ও কূটকৌশল জ্ঞানে অজ্ঞ থাকায় নিজ দেশে বাস করেও অনার্যরা হয়ে পড়েছিল কোণঠাসা। দীর্ঘ দিন একি সাথে অস্বস্তিকর পরিবেশে পাশাপাশি অবস্থানের ফলে ধর্ম, সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরন, বিশ্বাসে ধীরে ধীরে একে অন্যের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শুরু হয় উভয় সংস্কৃতির নীরব সমন্বয়। কয়েক শতাব্দির মধ্যেই আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংখ্যা গুরু অনার্যদের ধর্ম বিশ্বাস অনেকটা মিলেমিশে একাকার হয়ে পরিবর্তন আসে ধর্ম বিশ্বাসে, জন্ম নেয় নতুন সংস্কৃতি। তবে কর্তৃত্বের ঝান্ডা যথারীতি সুকৌশলে আগলে রাখে আর্যরা। এই সংস্কৃতির পালা বদলের শীতল হাওয়ায় অনেক অনার্য দেব-দেবী সন্তর্পণে অনুপ্রবেশ করে বৈদিক ধর্মে। দেবতা গ্রহণ বর্জনের ক্রান্তিকালে অনুসারীদের নির্মল ভালোবাসার বিশ্বাস প্রভাবে বেশ কিছু দেবতার আসনে নীরবে ঘটে যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিছু দেবতা প্রমোশন পেয়ে লাভ করেন সর্বোচ্চ পদ মর্যাদা, কিছু দেবতা ডিমোশন পেয়ে হন তুলনা মূলক কম মর্যাদাহীন আর কিছু কিছু দেবতাকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয় চির অবসরে।

কয়েক হাজার বছরের সমাজ বিবর্তনের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে নানান পরিবর্তন, সংস্কার, ধর্ম গুরুদের বাধা, রক্তচক্ষু, অভিসম্পাতের চড়াই উৎরাই পার হয়ে সনাতন, সনাতন থেকে হিন্দু ধর্মে নাম করন হয়ে বর্তমান বিশ্বে পরিচিতি লাভে সমর্থ হয় বৈদিক ধর্মটি।

বৈদিক ধর্মমত ছিল বহু দেবতাবাদে বিশ্বাস। বৈদিক সাহিত্যে সাধারন মানুষের মতই এই সব দেবতাদের এক দিকে যেমন দয়া, করুণা, ভালবাসার কথা উল্লেখ আছে অন্য দিকে আছে প্রচন্ড ক্রোধ, লোভ, হিংসা বিদ্বেষ, কামনা বাসনা, যৌন আকাঙ্ক্ষা, জিঘাংসার মূর্ত বর্ণনা। প্রায় প্রত্যেক শক্তিশালী দেবতা কল্পিত হত তেজস্বী দূর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা রূপে। সে যুগের সংস্কৃতিতে শৌর্য-বীর্য, ক্ষমতা, সন্মানের পারদ উঠা নামা করত পেশী শক্তি ও নিপুন লক্ষ্যভেদী অস্ত্র চালনা দক্ষতার উপর। আধুনিক রাইফেল, বোমা, গ্রেনেড তখনো আবিষ্কার না হওয়ায় বর্তমানে পরিত্যক্ত অথচ এক কালের ভয়াবহ মরনাস্ত্র তীর- ধনুক, গদা, ত্রিশূল, বর্শা হাতে, কাধে, পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই সব দেবতারা পুরাণে পুরাণে। এই রকম বৈদিক এক দেবতা ছিলেন রুদ্র। তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল ধনুর্বাণ (For archer and arrow associations Kramrisch, Chapter 2, and for the arrow as an “essential attribute” Kramrisch, p. 32) তিনি কল্পিত ছিলেন বজ্রবিদ্যুত সহ ঝড়ের দেবতা। সব কিছু উড়িয়ে লন্ড ভন্ড করে মুহুর্তে জীব জগৎ ধ্বংসকারী যে কোন শক্তিশালী সাইক্লোন বা ঘূর্ণীঝড় বিবেচিত হত রুষ্ট রুদ্রের বিভীষিকাময় কর্ম আবার বন্যার পানিতে খড় কুটুর মত সব ভাসিয়ে নিয়ে জনজীবণকে দূর্বিসহ করে তোলাও মনে করা হত রুদ্রের ক্রোধ উন্মাদ তেজ। অপর দিকে শিব অনার্য দেবতা হলেও শিবের মাঝে ধ্বংসকারী শক্তি কল্পিত হয়ে আসায় ধর্ম সমন্বয়ের ফলে সংখ্যাগুরু বিশ্বাস বলে তিনি ঢুকে যান আর্য দেবতায়। দুই ভিন্ন বড় দেবতা এক পোষ্টে থেকে একি কাজ করা এক সময় মনে হতে থাকে যেন আহান্মকি ভাবনার ফসল, অনাকাঙ্খিত গৃহ বিবাদের গন্ধ! সমাধান রুদ্র ও শিবকে ভিন্ন না ভেবে এক দেবতা হিসাবে কল্পনা করা। অবশ্য দুই ভিন্ন দেবতা এভাবে একিভূত হওয়ার দৃষ্টান্ত বৈদিক ধর্ম সাহিত্যে নতুন কোন ঘটনা নয়। এর আগে বৈদিক সাহিত্যে অগ্নি ও রুদ্র দুটি ভিন্ন দেবতা একিভূত হওয়ার ইতিহাস আছে। নিরুক্তি নামের গ্রন্থে বর্ণনা আছে অগ্নিকে রুদ্রে অঙ্গীভবনের কথা।(For translation from Nirukta 10.7, Sarup 1927, p. 155)। সম্ভবত শারীরিক শক্তি বিবেচনায় অগ্নিকে ষাঁড়ের শক্তি রূপে কল্পনা করা হত, যার ষাঁড়ের মত শিংও ছিল। (Rig Veda: Rig-Veda, Book 6: HYMN XLVIII. Agni and Others) আবার শিবের বাহন কল্পনা করা হত এক ষাঁড়। যার নাম ছিল নন্দী। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০-১১০০ সালের মধ্যবর্তী কোন সময়ে রচিত প্রাচীন আর্য ধর্মীয় গ্রন্থ ঋগ্বেদে রুদ্রের ভাল বর্ননা আছে। বিশেষ করে ধ্বংস করার অবাধ শক্তির বিচারে সমকক্ষ কল্পনা করায় শিব দেবতা রুদ্রকে গ্রাস করে পরিচিতি পান অভিন্ন এক দেবতা রূপে। যজুর্বেবেদে বর্ণনানুসারে একদিকে শিব নিষ্ঠুর ভয়ংকর(রুদ্রের ছায়া) অন্যদিকে দয়ালু ও মঙ্গলের প্রতীক। মহাভারতেও শিব দূর্জয়, ভয়ংকর আবার সন্মান ও মহত্বের মিলিত সত্ত্বা হিসাবে কল্পিত হয়েছেন।(For summary of Shiva’s contrasting depictions in the Mahabharata, Sharma 1988, p. 20-21)। ধাপে ধাপে এভাবে শিবের মর্যাদা বেড়ে পরিচিতি পান একি সাথে সৃষ্টি, স্থিতিশীলতা ও ধ্বংসের নিয়ামক সর্বোচ্চ দেবতা রূপে। অন্যদিকে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে রুদ্র বিলীন হয়ে যান শিবের মাঝে।

বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ঋগ্বেদ শুধু আর্যদের সব চেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত নয় এটা এখন বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ হিসাবেও বেশ সমাদৃত। ঋগ্বেদ ভাগ হয়েছে দুই পর্বে- ১) মন্ত্রভাগকে বলা হয় “সংহিতা” ২) গদ্যাংশ বা বর্ণনা মূলক ভাগকে বলা হয় “ব্রাহ্মণ”, এই গ্রন্থ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সব দেব দেবীর স্তুতি। এখানে আছে ইন্দ্র, বৃত্তাসুর, ব্রহ্মা, উষা, বৃস্পতি, পৃথিবী, সূর্য, রুদ্র, বায়ু ইত্যাদি দেবতার মজার সব কাহিনী। শিবের প্রধান দেবতা হিসাবে উঠে আসার পেছনে ভূমিকা রেখেছে অগ্নি, ইন্দ্র, প্রজাপতি, বায়ু, বরুণ ইত্যাদি বৈদিক দেবতাদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ভিত্তিক চেইন কাহিনীর সমন্বয় (For Shiva being identified with Agni, Indra, Prajāpati, Vāyu, and others : Chakravarti, p. 70) প্রচার ও অনুসারীদের কল্পনা ভুবনের দৃঢ় বিশ্বাস।

বৈদিক যুগের শুরুর দিকে বিষ্ণু ও শিব ছিলেন অপেক্ষাকৃত অপ্রধান দেবতা বরং ইন্দ্রের স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে আর্যদের কাছে। ১০০০-৭০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ ব্রাহ্মণ রচনার কাল থেকে তাদের গুরুত্ব, তেজ ও প্রভাব উত্তর উত্তর বাড়তে থাকে। পৌরণিক যুগে এই দুই দেবতাকে সামনে রেখে দুই পক্ষের অনুসারীদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে উঠে বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায় নামে দুটি পৃথক সম্প্রদায়। হিন্দু ধর্মে শাক্ত সম্প্রদায় নামে আরো একটি শাখা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। সে বিষয়ে পরে আলোচনায় আসছি।

প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ দেবতাকে মনে করে একে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, ক্ষমতাশালী ও উচ্চ। এই প্রতিযোগিতা চলে অনেক দিন। পরে বিষ্ণু কেন্দ্রিক পৌরণিক সাহিত্য লেখকেরা বিষ্ণু ও শিবকে একিভুত করে ফেলেন কোন এক সময়।( For Visnu becoming Shiva in Vaishnava myths, Zimmer 1946, p. 125) এই একিভূত করা হিন্দু ধর্মে অবশ্য নতুন কোন ঘটনা নয় যা আমরা আগেই দেখেছি। কিন্তু শিব কেন্দ্রিক পৌরণিক সাহিত্যে রচনায় শৈব লেখকরা শিবকে অপরিবর্তিত রাখেন আপন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে।(For predominant role of Shiva in some myths: Zimmer 1946, p. 128)। এতে শিবের প্রভাব ও প্রসার হয় আরো অধিক সুসংহত, বাড়ে গ্রহণ যোগ্যতা। খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে বিষ্ণু পুরাণ অনুসারে মতবাদ আসে বিষ্ণু বিশ্ব সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা আর অন্যায় ধ্বংসের জন্য শিবে রূপান্তরিত হন। ভগবত পুরাণে আছে শিব বিষ্ণুরি আরেক রূপের কথা।(For identification of Shiva as a manifestation of Vishnu : Bhagavata Purana 4.30.23, 5.17.22-23, 10.14.19)। সমন্বয়বাদীরা হরিহর নামেও বিষ্ণু(হরি) ও শিব (হর) যৌথ মিলন ঘটিয়েছেন মহাভারতে।(Chakravarti, pp. 54-55) এভাবে বিভিন্ন দেবতাদের ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে তাদের শক্তির সাথে শৈব শক্তির একিভূত সমন্বয় ও অনুসারীদের ক্ষমতা, শক্তি, চেষ্টায় ও বিশ্বাসের বৌদলতে অনান্য দেবতাদের পিছনে ফেলে শিব প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান সব চাইতে বড় দেবতার আসনে।

অপরদিকে অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতন্ত্রের পরিবারের গঠন ও উর্বর শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনায় এনে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃ প্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী ধারনা নতুন কিছু নয় ২২,০০০ বছর পূর্ব ভারতে প্যালিওলিথিক জন গোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে ইতিহাসে। সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের আর্দশকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে শাক্ত সম্প্রদায়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম।শাক্ত মতে কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অনান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র।

প্রধান শাক্ত ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণে দেবীই সকল শক্তির উৎস। তিনিই সব। এখানে দেবী স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন:
“আমিই প্রত্যক্ষ দৈবসত্ত্বা, অপ্রত্যক্ষ দৈবসত্ত্বা, এবং তুরীয় দৈবসত্ত্বা। আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব; আবার আমিই সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী। আমি সূর্য, আমি নক্ষত্ররাজি, আবার আমিই চন্দ্র। আমিই সকল পশু ও পাখি। আবার আমি জাতিহীন, এমনকি তস্করও। আমি ভয়াল কর্মকারী হীন ব্যক্তি; আবার আমিই মহৎ কার্যকারী মহামানব। আমি নারী, আমি পুরুষ, আমিই জড়।( Srimad Devi Bhagavatam, VII.33.13-15, cited in Brown(a), p. 186)।

শাক্তরা ব্রহ্মের শক্তিরূপে দেবীর পূজা করেন। এ সব দেবীর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল- চন্ডি বা কালী। তবে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী আর্যদের আগমনের পর অনার্য এই সব দেবীদের একক প্রভাব আস্তে আস্তে কমে গিয়ে আর্য পুরুষ দেবতাদের সাথে সমন্বিত হয়ে পাশাপাশি অবস্থান নেয় এইসব দেবী। তাই শাক্তমতে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি দেখা যায় শিবের।

শাক্তধর্মের মূলতত্ত্ব অনুসারে- “শক্তির সহিত মিলিত হইলে শিব সৃষ্টিক্ষম হন; না হইলে তাঁহার আলোড়ন তুলিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই।”

শাক্তদের এই দেবী শক্তির একক নেতৃত্ত্ব পুরুষ তান্ত্রিক শৈব সম্প্রদায় পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি কখনো। তাই শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম দিকে আপন আপন বিশ্বাসে অটল থাকায় ছিল প্রচন্ড বিরোধ। পরে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে অর্থাৎ সমন্বয়ে এসে স্থির হতে সময় লেগে যায় বেশ কিছু দিন।
শিবের সাথে সম্পর্ক সমন্বয় করে কেউ হয়েছেন শিবের স্ত্রী, কেউ বা কন্যা, আবার কারো স্থান হয়েছে পুত্রবধূ রূপে।

শাক্তদের কাছে প্রধান দেবী হলেন কালী। তাঁর গায়ের রং মিশ কালো চিত্রিত করার পেছনে অনার্য দেবী হওয়াকে দায়ী করেন ইতিহাসবিদেরা। কারণ অনার্যদের দেহের রং ছিল কালো। বাংলায় কালীর বিভিন্ন রূপের কথা বলা আছে। যেমন – দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। কালী সাধকদের মধ্যে রামকৃষ্ণ পরমহংস, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, রাজা রামকৃষ্ণ বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে। কিছুকাল আগেও কালী প্রভাবের অবস্থান এতটাই শক্তিশালী ছিল ভিন্নধর্মী হয়েও কাজী নজরুল ইসলামের উপর পড়েছিল তার রেশ যা আমরা দেখি তাঁর লেখা শ্যামাসংগীতে। তাঁর অনেক কবিতাতে পড়েছে কালী প্রভাবের ছাপ।

বাংলায় কখন থেকে শক্তির আদি বলে খ্যাত কালী পূজার প্রচলন শুরু হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ইতিহাসে। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজার প্রমাণ মিলে। নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয় (৩.০ ৩.১ ৩.২ ৩.৩ ৩.৪ ৩.৫ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৫-৮৭)।

মহাভারতে কাল রাত্রি বা কালী নামে এক দেবীর কথা আছে যিনি মৃত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেছিলেন।

এই রকম আরেক শক্তিশালী দেবী ছিলেন মনসা। মনসা পূজা ছিল কিছুটা প্রাচীণ। দূর্গার আগে থেকেই নিম্ন বর্ণের আদিবাসী হিন্দুরা মনষা পূজার চর্চা করত। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের এই সব পূজিত দেবী উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের কাছে কখনো পূজার গুরুত্ব লাভ করেনি। ফলে মনষা দীর্ঘ দিন উচ্চ বর্ণর কাছে থাকেন নিপ্রভ। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নিলে মনসার গুরুত্ব কিছুটা বেড়ে যায়। এর আগে পুরাণ অনুসারে মনসা পূজিত হতেন সর্প পিতা কস্যপ কন্যা রূপে। শিব কন্যা বিবেচিত হওয়ার পর উচ্চ বর্ণের কাছে মনসা কিছুটা মর্যাদা পান বটে তবে থেকে যান তুলনা মূলক কম আলোচনায়, কম শক্তিধর দেবী হিসাবে। অন্যদিকে চন্ডি, দূর্গা বা কালী শিবের স্ত্রী কল্পিত হওয়ায় সুবাদে লাভ করেন প্রভূত মর্যাদা, বিবেচিত হন অসীম শক্তির অধিকারিণী দেবীর ভুমিকায়।

মহাভারত অনুসারে দূর্গা বিবেচিত হতে থাকেন কালী শক্তির আরেক রূপ হিসাবে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দূর্গার রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল সে রহস্য আজো অজানা।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে দূর্গা পূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয় বার দূর্গা পূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দূ্র্গা পূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধসাগরের তীরে দূর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হতে ( প্রবন্ধ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, আশ্বিন ১৪১৪, অক্টোবর ২০০৭, পৃ. ১৬৩-৬৪ দ্রঃ), মূল বাল্মীকির রামায়ণে দূর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব আমরা দেখতে পাই না। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎলালীন সমাজে প্রচলিত অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তাঁর এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে। যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় দ্রুত। সেখানে তিনি কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দূর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে রাম দূর্গা পূজা করে দূর্গার কৃপা লাভ করেন বলে বর্ণনা করেছেন তিনি (রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ), তবে দূর্গা পূজার সব চাইতে বিশদ বর্ননা পাওয়া যায় মার্কন্ডুয়ে পুরানে। যেখানে মহির্ষী জৈমিনি ও মহির্ষী মার্কন্ডুয়ের কথোপকথনের ভিত্তিতে পুরাণটি রচিত হয়। এই পুরাণের মধ্যে তেরটি অধ্যায় দেবীমহাত্ম্যম নামে পরিচিত। বাংলায় শ্রীশ্রী চন্ডি নামে সাতশত শ্লোক বিশিষ্ট দেবী মহাত্ম্যম পাঠ আছে যা দূর্গা পূজার প্রধান ও অবিচ্ছদ্য অংশ হয়ে স্থায়ি হয়ে গেছে পূজার আসরে।

তা যা হোক এগুলো সব পুরাণের কথা। ঘটা করে দূর্গা পূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ন হিন্দুদের গৃহকোনে ঘরোয়া পরিবেশে চালু ছিল এই পূজা। করা হত অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে। ঘটা করে দূর্গা পূজার ইতিহাস খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল তা নিয়ে পরিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল- কারো মতে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন, আবার কারো মতে প্রথম দূর্গা পূজা আয়োজন করেন তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ন। অনেকে মনে করেন ১৬০৬ নদিয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক। দূর্গার ছেলে মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার। ১৭৯০ সালের দিকে এই পূজার আমেজে আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বার জন বন্ধু মিলে টাকা পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীন ভাবে আয়োজন করে বড় আকারে দূর্গা উৎসব। যা বারোইয়ার বা বারবন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। কাসীম বাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোইয়ারের এই পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উচ্চ বর্নের হিন্দু বাঙ্গালী জমিদারদের কাছে।

ব্যাপক লোকের সমাগম, মেলা, হৈ হুল্লুর, উৎসবের আমেজে ধনী জমিদারেরা কিছু দিনের জন্য ডুবে থাকতেন গরীব প্রজাদের সাথে বিনোদনে যা বাঙ্গালী সমাজে এনে দেয় নতুন মাত্রা। ভক্ত কুলের সহায়তায় হু হু করে বাড়তে থাকে দূর্গার শক্তির মহাত্ম, বাড়ে পূজার সমর্থন। ধনীদের দেখা দেখি এই পূজা দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করে দরিদ্র ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের কাছে। ভক্তি ও বিনোদনের স্বাদ এক সাথে পাওয়ায় তারাও শুরু করে পূজা উৎসব। প্রথম দিকে নিম্ন বর্ণের এই পূজা উৎসবে ধনী ও উচ্চজাত ব্রাহ্মণদের সাদরে অংশ গ্রহণ করতে বেশ মানসিক সমস্যা দেখা দিলেও এক সময় মেনে নেন।

মানুষের দুঃখ-দূর্দশা, অভাব-অনটন, রোগ-শোক, সামাজিক নানা অনাচার দূরীকরণে পূজা অর্চনা শতভাগ বিফল প্রমাণিত হলেও চলমান জীবনযুদ্ধ ব্যস্ততার ডামাডোলে খানিকটা রেশ টেনে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজকে দূর্গা পূজা বইয়ে দেয় কিছুটা স্বস্তির হাওয়া, দেয় আনন্দঘন অনাবিল উৎসবের আমেজ, তৈরী করে ক্ষণস্থায়ী মানব মিলনের অপূর্ব ক্ষেত্র, ব্যস্ততা বাড়ে উচ্চকূল দাবীদার ব্রাহ্মনদের, তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায় রঙ্গিন সাজে, বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে আনায়ন করে প্রাণ চাঞ্চল্য। বাঙ্গালী জন গোষ্ঠির সৃষ্ট এই দূর্গা পূজা উৎসবের জোয়ার স্বাভাবিক ভাবে সীমিত থেকে যায় বিশেষ করে বাঙ্গালী হিন্দু জনগোষ্ঠির সংস্কৃতির মাঝেই। বহু দেবতায় বিশ্বাসী ভারতবর্ষের অনান্য অঞ্চলের হিন্দুদের কাছে এ পূজা উৎসব খুব একটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়নি আজো।

বিঃদ্রঃ- সব তথ্য নেট থেকে আহরণ করা