মারা গেছেন প্রখ্যাত কবি বাবু মণ্ডল। তিনি বর্তমান সময়ের বেশ আলোচিত লেখক ছিলেন। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে আপামোর দেশের জনগণের কথা। তিনি ছিলেন জন-দরদী কবি। মানুষই তাঁর লেখার মূল উপজীব্য ও অনুপ্রেরণা। …কথাগুলো আমি একটি দৈনিকে পড়েছিলাম। এটা কিছুদিন আগের ঘটনা। বাবু মণ্ডল-এর কোনও লেখায় আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তিনি অপরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর পর রাতারাতি তারকা লেখক বনে গেলেন। ঢাকার প্রকাশকরা এখন তাঁর বই প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যে সকল লেখক তাঁর লেখার ভুল-ত্রুটি উদ্ধার করে বিভিন্ন কাগজে আলোচনা-সমালোচনা করতেন তারা এখন স্ত্ততি করছেন প্রাণ ভরে। একসময় পত্রিকার প্রুফ-রিডারের কাজ করার দরুন ঐ সকল আলোচনা-সমালোচনার কিছু আমাকে পড়তে হয়েছিল। দু-একটি সাহিত্যের বই যে জীবনে পড়ি নাই তা নয়, কিন্তু বাবু মণ্ডলের কবিতা পড়ার সুযোগ ও সময় আমার হয়ে ওঠেনি। যে পত্রিকা তাঁর একটা লেখাও ছাপেনি কোনদিন, সেই পত্রিকা এখন তাঁর জীবন নিয়ে বিশাল ফিচার করবে। আর তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমার ওপর, যে কিনা ঐ লেখকের একটা লাইনও পড়েনি। আজব!

আমাকে সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন, কারণ খবর গরম থাকতে থাকতে পরিবেশন না করলে বাজারে কাটবে না। এই অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর কোনো বই আমার পক্ষে পড়ে ফেলা সম্ভব না, কাজেই প্রকাশিত যে কয়েকটি বই আছে সেগুলোর নাম মুখস্থ করে রওনা হলাম নিচিনপুরের দিকে। নিচিনপুরেই কেটেছে কবি বাবু মণ্ডলের জীবনের বাল্য ও যৌবন। বাকীটা সময় তিনি সপুরাহাট গঞ্জে কাটিয়েছিলেন। আমার সাথে গেলেন হাসু ভাই। হাসু ভাই আগে একটি এ্যড এজেন্সিতে কাজ করতেন, সুবিধে না করতে পেরে আমাদের পত্রিকা অফিসে জয়েন করেছেন। তাকে সাথে নেওয়ার কারণ হল, তিনি বাবু মণ্ডলের অঞ্চলেরই মানুষ, একবার বাবু মণ্ডলের একটা কবিতাও নাকি তিনি পড়েছিলেন। কবিতার প্রথম লাইনের একটা শব্দ তাঁর এখনো মনে আছে, শব্দটি হল ‘পিরিত’। গাড়িতে গর্বের সাথে বেশ কয়েকবার জানালেন সে কথা। এ নিয়ে তিনি ছোটখাটো একটা গবেষণাও করে ফেললেন। তার ধারণা, কবিতাটি যদি কবি জীবনের প্রথমদিকে লিখে থাকেন তাহলে তিনি কোন তরুণীকে মাথায় রেখে তা লিখেছেন। এবং মেয়েটি সম্ভবত খুব একটা শিক্ষিত ছিলো না, এজন্যই প্রেম শব্দটা ব্যবহার না করে তিনি ‘পিরিত’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আর যদি জীবনের শেষের দিককার লেখা হয় তাহলে তিনি এই ‘পিরিত’বলতে জগতের প্রতি মায়াকে বুঝিয়েছেন। কারণ বৃদ্ধবয়সে সবাই পৃথিবীর প্রেমে পড়ে। ইম্প্রেসিভ। ভেরি ইম্প্রেসিভ! আপাতত তাও কবি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল।

আমরা বিকেল ৪টার সময় নিচিনপুরে পৌঁছলাম। গ্রাম বলতে যা বুঝে এসেছিলাম, নিচিনপুর ঠিক তার উল্টো। মিনি শহর বললে ভুল বলা হবে না। গ্রামে ঢুকেই বেশ বড়সড় একটা মোড়। এখানে খাওয়ার হোটেল, ডিসপেনসারি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দোকানপাট আছে। দোকানগুলোর পিছনে সদ্য গড়ে ওঠা কিছু পাকাবাড়ি অগোছালোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে ঢাকার মতো বিকলাঙ্গ শহরের জন্ম যথারিতী অব্যহত আছে। দোকানের চারিপাশে আবর্জনা-ময়লা বৃষ্টির পানিতে পচে পাঁচড়া ঘা-এর খ্যাতখ্যাত করেছ। অনেক মানুষের জটলা এখানে। হাসু ভাই বলল কাজটা এখান থেকেই সেরে ফেলতে। আমাকে যেটা করতে হবে তা হল, বাবু মণ্ডলের কাছের কিছু মানুষের সাথে কথা বলে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত লিখে নিয়ে যেতে হবে। মানে কি করতেন, কিভাবে চলাচল করতেন, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন – এইসব আরকি!

হাসু ভাইয়ের কাছে একটা ভয়েস রেকর্ডার ছিল। হোটেলে চা-শিঙ্গাড়া খেতে খেতে প্রথম উঠল কবি বাবু মণ্ডলের কথা। হোটেলের মালিক হেতেম মিয়া কবি সম্পর্কে অনেক কথায় বললেন। যথাসম্ভব এডিট না করে তার মুখের কথায় আমি এখানে উঠিয়ে দিচ্ছি-
‘হেই বড়ো ভাল লোক ছেল। মান্ষের মুখে তার কথা মেলা শুনচি। বয়স তো কম ছেল না। বাবজানের মুখে শুনচি, ওরা নাকি সেই গরিব ছেল! আমাদের তো কবকার দুকান, তেকুন দুকানে আমার দাদার সাথে বাপও বসতুক। বাপের থেকি বয়সে বাবু মণ্ডল বছর পাঁচেকের ছোট ছেল। বাপরা সবাই তাকে হাবু বুলি ডাক-তুক। বুদ্ধি-সুদ্ধি নাকি কিছুই ছেল না। আমাদের হটিলের ছামনে খালি বসি থাকতুক। আমার বাপের ছোট-খাটো হুকুম-টুকুমও শুনতুক। ও ছেল গরীব ঘরের ছাওয়াল। হের মায় নাকি মান্ষের ঘরে কাজ করতুক। আমাদের হটিলে থেকি বাবু মণ্ডল এটা-ওটা বানাতিও শিকি গি-ছেল। একবার নাকি তার হটিল কারবার তার খুব খায়েস হ-ছেল, বাপজানকে সে কথা বুলিছেল। একবার আমার দুকানে চা খেতি ঢুকি ফ্যালফ্যাল করি হটিলটা দেখছিল। আমি মশকরা করি বুল্লাম, কি হাবু চাচা, হটিলটা তুমার মনে ধরিচে নাকি? কোনও উত্তুর দেননি। হাবুচাচা বুলাই বোধহয় মাইন্ড করিছেল। আসলে এই এলাকায় আমাদের হটিল ব্যবসার খুব নাম-ডাক আছে। আমার দাদায় শুরু করিছেল এই ব্যবসা। বাপেও করিছে। একুন আমি হাল ধরিচি। বাবু মণ্ডল এই ব্যবসা করলি ভালই করতুক। শুনচি শেষ বয়সে লোকটা না খেতি পেয়ি মরি গিছে। কি সব কবিতা-টবিতা নাকি লিকতুক। মানষিটার এই ভিমরতি ধরাতেই তো ঐ দশা। বাপেই আগেই বুলিছিল, আই আমার সাথে হাত লাগা। বাপজানকে বুলিছিল, তুমি মান্ষের দেহের খাবার ব্যবস্থা করো, আমি করবু মনের। তুমি আর আমি মিলেই তো মানুষ! কি সব ভাবের কথা, অত সব আমি বুঝি না। তই লোকটার জন্যি ময়া লাগে। সারাজীবন ধরি কি সব লিখলু, একটাও কাজে দিলু না। বিনা চিকিৎসায় মরলু। হের বইয়ির কাগজ দি’ আমার হটিলে মান্ষে হাত মোচে।…’ সে বকেই চলে একটানা। হাসু ভাই বিরক্ত হয়ে তার রেকর্ডারটা অফ করে ফেলে।

ঐদিন ওখানেই সন্ধ্যা নেমে এলো। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার মান্নান সাহেবের বাড়িতে। হাসু ভাই আগেই ব্যবস্থা করেছিল সব। রাতে মান্নান সাহেবের বাড়িতে বেশ ভালোই খাওয়া-দাওয়া হলো। মান্নান সাহেব আমার বাবার বয়সী, আর আমার বাবার বয়স কত আর, এই ৭২ বছর হবে, মানে জীবিত থাকলে সেটাই হতো আর কি! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কবি বাবু মণ্ডলের প্রসঙ্গে আমরা কথা বলা শুরু করলাম। হাসু ভাই ঘুমাতে গেলেন। শরীরটার মত ঘুমও তার বেজায় ভারী। এ দুটোকে সামলাতে তাকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। এ নিয়ে আমাদের অফিসে মজাও কম হয় না। অফিসে কাজের সময়ে কেউ হাসু ভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুরুই করেন এই বলে – হাসু কি জেগে আছো? সে অন্য প্রসঙ্গ। আমরা প্রখ্যাত কবি বাবু মণ্ডল সম্পর্কে কথা বলছিলাম। মান্নান সাহেব একটা পান মুখে গুঁজে বলা শুরু করলেন। ভঙ্গিমাটা এমন যেন তিনি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। রেকর্ডারটা হাতে শক্ত করে ধরেছিলেন।
‘বাবু মণ্ডল বেশ বড় ঘরের ছেলে ছিল। মণ্ডল বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিল বাবু মণ্ডলের দাদা হাফেজ মণ্ডল। কিন্তু লোকটা সংসারী ছিল না মোটেও, শুনেছি তিনি নাকি আমার দাদার পেছনে বেশ ঘুরঘুর করতেন। আমার দাদা বেশ এডুকেট মানুষ ছিলেন। এই দশগায়ে তাঁর মত এডুকেট মানুষ দুটো ছিল না। এ-গ্রাম সে-গ্রাম থেকে মানুষ দাদার কাছে ভ্যারিয়াস বিষয়ে জ্ঞান নিতে আসতো। ইংরেজরাও নাকি দাদার ইংরেজি শুনে টাসকি খেয়ে যেত! দাদার কাছ থেকে বাবাও ভাল ইংরেজি শিখেছে। আর আমি বাবার কাছ থেকে শিখেছি খানিকটা। (আমি বাবু মণ্ডলের প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিলে)। ও হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম, বাবু মণ্ডলের দাদা জুয়া খেলে, এ-দেশ সে-দেশ জার্নি করে সব সম্পত্তি ফিনিশ করে ফেললো। একেবারে যে কিছু ছিল না তাদের তা না। বাবু মণ্ডল যদি শক্ত করে ফ্যামিলির হালটা ধরতো তাহলে ভালোই চলতো তার। বলা যায়, অনেকের থেকেই ভাল চলতো। বাবু মণ্ডল আমার থেকে বছর তিনেকের সিনিয়ার ছিল। স্কুলে দেখতাম, পড়াশুনা না করে কবিতা লিখে মেয়েদের শুনিয়ে বেড়াত। আমি ক্লাস টু-এর ছাত্র হয়ে যা জানতাম ও ক্লাস ফাইভের ছাত্র হয়েও তা জানতো না। পরে অবশ্য আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠলাম, ততদিনে সে লেখাপড়াই ছেড়ে দিল। না দিলে আমরা এক ক্লাসের ছাত্র হতাম। হয়ত ছাড়িয়েও যেতাম তাকে। তারপর এদিক-ওদিক কাব্য করে বেড়াতে শুরু করলো। ভাতের জন্য কিছু না করলে কি আর ফ্যামিলি টেকে? টেকেও নি। বাপ জোর করে বিয়ে দিয়েছিল পাশের গ্রামের চাউল ব্যবসায়ী রইস মিয়ার মেয়ের সাথে। বছর পাঁচেকের মাথায় উত্তর পাড়ার কালু কসাই-এর সাথে বৌটা ভেগে গেল। পরে শুনেছি ওর বাপ মারা গেলে ছোট বোনের স্বামী এসে ভিটেমাটি সেল করে চলে গেছে। তারপর বাবু আসলে এর ওর বাড়ি থাকতো। আমার বৈঠক খানায়ও থেকেছে দু’একবার। ঐসব সহায়-সম্পদের ব্যাপারে তার কোনদিনই কোন ইন্টারেস্ট ছিল না। (তার কোন কবিতা পড়েছেন কিনা জানতে চাইলে, একটু বিরক্ত হয়ে।) আমার বাপু অত টাইম কোথায়? স্কুলের হেড মাস্টারি করা চারটে খানিক কথা? কত ঝামেলা-ঝক্কি পোহাতে হয়, তার কি হিসেব আছে। তোমরা ছোকরা পোলাপান, নো ওয়ার্ক, তোমরা ঐসব পড়বা। আর তাছাড়া আমি ইংরেজির ছাত্র। তবে শুনেছি বেশ ভাল লিখতো সে। একবার আমাদের স্কুলে যিনি বাংলা পড়ান, বলতে শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের মত লাইন-ঘাট থাকলে নাকি নোবেল জিতা বাবু মণ্ডলের ওয়ান-টুর ব্যাপার। সে যে লেখা পড়া না জেনে শুদ্ধ করে লিখতে পারতো এই তো বিরাট ব্যাপার। শুনছি ঢাকার মানুষজনও নাকি তাকে নি মেলা আলোচনা করেছে।’
মান্নান সাহেব আরও অনেক কথা বলেছিলেন, কিন্তু কখন যে রেকর্ডারের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল টের পাইনি। তাই তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাই এভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হল না।

রাতে ঘুমটা বেশ ভাল মতই হল। পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শেষ বারের মতন আমরা আরও কয়েক জনের সাথে কথা বললাম। তাদের মধ্যে হুজুর গোছের এক ব্যক্তি, নামটা ভুলে গেছি, কবি বাবু মণ্ডলের বিরুদ্ধে অ-ইসলামিক কথাবার্তা বোলার অভিযোগ তুললেন। তিনি বললেন-
‘লোকটা সারা জীবন কি সব অকাম-কুকাম লিখচে। শেষ বয়সেও ভীমরতি ধরছিল। গঞ্জে কাকে নাকি মেয়ে পাতিয়ে তার বাড়িতে থাকতো। সেখানেও কত কোথা শোনা যায়। নাউজুবিল্লাহ! লোকটাকে আমি একদিনও মসজিদে দেখি নাই। ঈদের নামাযও পড়ে কি না সন্দেহ! আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি সময় মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে না কাল কেয়ামতে তার জন্য অপেক্ষা করছে কঠোর শাস্তি। এই সব পাঁজি লোকদের সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা উচিত।’
শিক্ষিত আধা বয়স্ক সোবহান বললেন-
‘খুবই চিন্তশীল মানুষ ছিলেন। তাঁর চিন্তা মোতাবেক আমরা যদি সমাজটাকে সাজাতে পারতাম তাহলে কি আর এত অশান্তি হয়? তাঁর মত ভাল মানুষ আমি জীবনে একটাও দেখি নাই। যদিও তিনি সংসারী ছিলেন না- তিনি মানুষ নিয়ে ভাবতেন, সমাজ নিয়ে ভাবতেন। তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়নি কিন্তু তাঁর সাথে একবার কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মুখ দিয়ে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ বের হত- গাঁজা খেতেন বোধহয়।’
এক কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে কবি বাবু মণ্ডল সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন-
‘বাবু মণ্ডল ? কে সে? আপনে কি আমাদের কলেজের পিয়ন বাবু ভাইয়ের কথা বলছেন?’

আমাদের ঢাকা ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। আসবার পথে বাবু মণ্ডলের কবরটা রাস্তার বাম হাতে পড়েছিল। হাসু ভাই ঘুমচ্ছিল বলে আর নামা হয়নি। তাছাড়া ঢাকায় ফিরেই কাজটা রেডি করতে হবে, আমাদের হাতে এত সময় কই?