লিখেছেনঃ কফিল কাঙ্গাল

রোজা আসার আগে বাজার দর নিয়ে চিরাচরিতভাবে যে হুলুস্থূল ঘটে তার ব্যতিক্রম এবারও হয়নি, কোনদিন হবেও না গ্যারান্টি দিয়ে বললাম, কারণ এটা ধার্মিকদের দেশ! আমরা ধর্ম পালন করি, লালন করি না, বিধর্মী, কাফের, নাছাড়া, পশ্চিমারা ধর্ম পালন করে না কিন্তু লালন করে। অর্থাৎ ওরা আমাদের ন্যায় ধার্মিক নয়, কিন্তু অধর্ম করে না। রমজানের একমাস পূর্ব থেকেই আমাদের ন্যায় স্বল্প আয়ের লোকদের মধ্যে এক মহাতঙ্ক সৃষ্টি হয়। হায়-হায় রব উঠে। অতএব এটিকে ধর্মজীবিরা যতোই পবিত্র বলে মনে করুক না কেন, এটি কখনোই পবিত্র তো নয়ই বরং সবচেয়ে নিকৃষ্ট একটি ধর্মানুষ্ঠান মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। রমজান নিয়ে রাজা যতোটুকু বলে, সভাসদ বলে তার চেয়ে বেশি, এটাই এখন বাস্তবতা। আমাদের আঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে, “দারোগার চে’ দারোগার বাইছার চোট বেশি।” অর্থাৎ থানার দারোগার চাইতে তার নৌকার মাঝির দাপট বেশি। রোজার পূর্বে বাজার দর বাড়বেই এটা চিরসত্য, তাই এ নিয়ে হৈ-চৈ করে রোজার অনেক পূর্বেই কেন যে মিডিয়াগুলো আরো বেশি জানান দেয়, তা বোধগম্য নয়। রোজার পূর্বে তারা একটিবার অন্তত চুপ থেকে দেখতে পারে বাজার এমনি এমনি কতটুকু বাড়ে। যাহোক, ইচ্ছা করেই এবছর ও নিয়ে ভাবি নাই। গত বছর এ নিয়ে একটি লেখা লিখিছিলাম, কিন্তু সময় অভাবে তা আর প্রকাশ করা হয়নি।

গত বছর রোজার পূর্বেকার কয়েকটি পত্রিকায় এরূপ হেডলাইন ছিলো, *সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার আহ্বান। *শুল্কছাড়ের লাভ যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। চিনি, ছোলা, রসুনে ১০০ কোটি টাকার শুল্ক সুবিধা, তবু বাজার অস্থির। *নিত্যপণ্যের এলসি খোলাতেও আছে সুবিধা। *চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি তবু দাম বাড়ে। *বাজার ভর্তি পণ্য তবু দাম নিয়ে শঙ্কা। *চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েছে চিনি ও ভোজ্য তেলসহ বেশকিছু পণ্যের দাম। *রমজান মাস ব্যবসায়ীদের স্বর্গবাস।

গতবছর ৭ আগষ্ট ২০১০ কালের কণ্ঠ পত্রিকায় “শরীরের নাম মহাশয়…” শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় পড়েছিলাম। লিখেছেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি নাকি, “শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়” এ শ্লোকটি রমজানের মাস দু’য়েক আগে থেকেই জপছেন। কেন জপছেন? এর প্রধান কারণ হিসেবে আমাদের অর্থনৈতিক সংকটকেই দায়ী করা যায়। বাজারে গিয়ে সামাদ সাহেব যেমন মাথা নিচু করে থাকেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, তিনি একাই বুঝি, কিন্তু আমরাও ঠিক তদ্রƒপভাবে থাকি। দোকানিরা আমাদের অপমান করলেও আমরা হই না। ওরা হয়তো আমাদের বেহায়া ভাবে। অপমানিত হওয়ার উপায় নেই, কারণ পকেট ফাঁকা। বাজারে গিয়ে আমরা এখন আর অপমানিত হই না, হয় যাদের পকেট ভারি তরাই। এদেশে আমরা যারা অর্থনৈতিক সংকটকে সঙ্গী করে বাস করছি, তারা এখন আর ওদের কাছে মানুষের পর্যায়ে রয়েছি কি-না, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে! আমরা এখন যে খুব দ্রুত মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক সামাদ সাহেবের ন্যায় আমরাও যখন বাজারে যাই, দরকষাকষি করি, তখন বিক্রেতাগণের মুখের চেহারা দেখলে নিজেদের খুবই ছোট মনে হয়। অপমানিত বোধ করি তথাপিও কিছু বলা যায় না; কিছু বললে হয়তো বলবে, কিনবেন না অথবা টেহা নাই তো দাম জিগান ক্যান? যারা দরকষাকষি করে বিক্রেতাগণ তাদের সাথে আজকাল তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলে, অন্যদিকে ফিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও একআধটু উত্তর দেয় আর কি! অথচ যারা দরদাম না করে জিনিষ কিনে নিয়ে যায়, তাদের দেখলে ওরা স্যার, স্যার… শুরু করে দেয়। একটু বেশি দরদাম করলে আঙুল উঁচিয়ে বলে ওই দিকে দেহেন, বেশি প্যাঁচাল পাড়বেন না তো! আর যদি হাতে ধরে বেছে নিতে চাই তাহলে স্পষ্ট করেই বলবে, আরে মিঞা রাখেন তো, আমি বেছে জিনিষ বেচি না! আমরা যারা প্যাঁচাল পাড়ি তাদের সামনে থেকে বিক্রিতার চাহিদামত দামে ব্যাগ ভরে যারা বাজার করে নিচ্ছেন, আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং বিক্রেতা তখন আরো তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, দেখলেন আপনের কাছে চাইলাম সত্তর টাকা, আপনে প্যাঁচাল পারতেছেন, আর উনার কাছে এক’শ চাইলাম এবং আপনের সামনেই তো দেখলেন উনি কোন দামদর না কইরা ব্যাগ ভইরা নিয়া গেলো! আসলেই তাই, এরূপ ঘটনা আমাদের সামনে প্রচুর ঘটছে।

এরূপ ঘটনায় আমার এক আত্মীয় শুধু অবাকই হয়নি হতবাক হয়ে কিছুণ কথাও বলতে পারেনি। গল্প নয়, সত্য। কারণ আমার ওই আত্মীয় দীর্ঘ ১৪ বছর পর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছিলো ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। ফুটপাথের দোকান থেকে তিনি আম কিনতেছিলেন দরদাম করে ৭০/- টাকা কেজি হিসেবে। এর মধ্যে একটি দামি গাড়ি এসে সেখানে থামলো, এক মহিলা গাড়ির জানাল নামিয়ে উঁকি দিয়ে বললো, “আম কতো করে?” দোকানদার বললো, ১২০/- টাকা! মহিলা বললো, “দশ কেজি আম দাও তো।” দোকানদার তাড়াতাড়ি আমার সেই আত্মীয়কে দাঁড় করিয়ে রেখে দশ কেজি আম মেপে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে গুণে গুণে ১,২০০/- টাকা নিয়ে নিলো। গাড়ি ছেড়ে গেলে আমার আত্ময়টি জিজ্ঞেস করলো, আরে ভাই ঘটনাটা কি? দোকানদার বললো, কালো টাকা বুঝেন নাই! কালো টাকা! এখন এই সরকার সব শালাকে ধরে ধরে চৌদ্দ শিকের মধ্যে ঢোকাচ্ছে আর বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করছে কার-কার কালো টাকা আছে সেজন্য, তাই টাকা খরচ করার জায়গা পায় না এরা, টাকা তাড়াতাড়ি খরচ করে ঘর খালি করতে চায়। ওই যে শোনেন নাই মন্ত্রী-এমপিদের তোষকের নিচে, বাথরুমে বস্তা ভরা টাকা পায় আর ধরে! আমার আত্মীয়টি বললো, তা তুমি ভাই বুঝলে কি করে, এর কালো টাকা না সাদা টাকা এবং তুমি যে দাম চাইবে সেই দামই তোমাকে দিয়ে দেবে? দোকনদার বিজ্ঞের ন্যায় হাসতে হাসতে বললো, “আমরা এদের দেখলেই বুঝি যে, এদের টাকার অভাব নেই, তাই যা চাই তাই-ই দেবে?” টাকার অভাব আমার সেই আত্মীয়েরও নেই। আমেরিকায় তার বিশাল ব্যবাস, বাড়ি-গাড়ি… তথাপিও তিনি যে হিসেব করে দরদাম করে জিনিষ কিনছেন তার অর্থ কি? তিনিও তো সেই কালো টাকার মালিকের ন্যায় দরদাম না করে দোকনদার ৮০/- টাকা কেজি চেয়েছিলো সেই দামেই নিতে পারতো, কিন্তু তিনি দরদাম করে ১০/- কেজিতে কমিয়ে নিলেন কেন? কারণ তার যতোই টাকা থাকুক তা সম্পূর্ণ হালাল টাকা! অর্থাৎ আমেরিকাতে তিনি ব্যবসা করে লাখপতি বা কোটিপতি যাই হোন না কেন, সৎভাবে অনেক কষ্ট করে সেই অর্থ আয় করতে হয়েছে। আর এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ঘুষখোরেরা আয় করে এক রাতে কোটি কোটি, তাই এদের বাজারে গিয়ে থলে ভরে মালামাল এবং বস্তা ভরে টাকা দিয়ে আসাতে গায়ে লাগে না। অতএব, সামাদ সাহেবের ন্যায় আমরাও এখন আর বাজারে গিয়ে বেশি কথা বলি না, চুপ করে পকেটে পয়সা থাকলে কিছু কিনি না হয় কিনি না, অনেক সময় দাম জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা জাগলেও জিজ্ঞেস পর্যন্ত করি না। আবার কোন কোন জিনিষের দাম ভয়ে জিজ্ঞেস করি না, পাশের কেউ জিজ্ঞেস করলে দোকানদারের উত্তরটি কান পেতে শুনি।

আতউস সামাদ সাহেবের এই কথাটি আমি প্রথম শুনি যখন আমাদের অজপাড়াগাঁয়ের ভাঙ্গাচোরা হাইস্কুলে পড়তে যাই, আমার প্রিয় শান্তশিষ্ঠ, সহজ-সরল সর্বেশ্বর স্যারের মুখে। আমার জীবনে হাইস্কুলে পড়ার তেমন একটা সুযোগ হয়নি। প্রাইমারী শেষে যা পড়াশোনা শিখেছি তা নিজ গৃহে এবং নিজ চেষ্টাতেই। আমার তেমন কোনো শিক্ষাগুরুও নেই যার কথা স্মরণ করবো। অজপাড়াগাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের শিকেরা নিজেরাও তেমন একটা শিক্ষিত ছিলেন না, তথাপিও তারা যতটুকু শিখিয়েছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। ভূমিহীন কৃষকের সন্তান তাই প্রাইমারী শেষে প্রচণ্ড অভাবের তাড়নায় স্কুল পড়া সমাপ্ত হয়ে গেলে, হাইস্কুলের পরিচিত হেডমাস্টারের হাতেপায়ে ধরে বিনা-বেতনে ভর্তি হয়ে থাকি বটে কিন্তু ক্লাস করার সুযোগ পাই না। তবে মাঝে-মধ্যে কদাচ স্কুলে যাবার সুযোগ হতো। অনেক শিক্ষকই তখন আমাকে বলতেন, ডুমুরের ফুল। স্কুলে পড়া মুখস্ত করে না গেলে বেত খেতে হতো, তাই সে ভয়েও আমি প্রায়ই সুযোগ পেলেও স্কুলে যেতাম না, তবে কষ্ট হলেও, না খেয়ে থাকলেও পরীক্ষার সময় ঠিকই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতাম। স্কুলের একমাত্র সর্বেশ্বর স্যারই বেত মারতেন না, অন্য সব স্যারদের হাতে বেত থাকতো। পড়া না পারলে হাত এবং পিঠ লাল করে ছাড়তেন। তবে পড়া না পারলে সর্বেশ্বর স্যার প্রথমে কৈফিয়ত চাইতেন, পরে বলতেন, “শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সওয়ায় তাই সয়।” অর্থাৎ কিনা তোমার যতো কষ্টই হোক না কেন চেষ্টা করলে তুমি পড়া মুখস্ত করে আসতে পারতে। এ বাক্যটি যে সত্য তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আজকাল আমরা সংযম, ভদ্রতা, শালীনতা… ভুলে গেছি। রমজানের সময় আমরা যেরূপ প্রচুর পরিমাণে আহার করি তাতে একে সংযম বলা যায় না। আমরা এখন পরশ্রীকাতর, ঈর্ষা-হিংসা, অতিলোভ-লালসা, অতিলাভ, অতি-আসক্তি… রোগে ভুগছি। অর্থাৎ শরীর মহাশয়কে মাত্রাতিরিক্ত আরাম-আয়েশের দিকে ধাবিত করছি। আমরা এখন আর দুঃখ-কষ্ট এসব সহনীয় করার জন্য শরীরকে বলি না, বলি শরীর তুমি যতো পারো সুখ কর, শান্তি কর আর সুখ-শান্তির জন্য যে অর্থ তা যেভাবেই হোক আয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছি। শরীর মহাশয়কে দুর্নীতি হজম করার, মনকে তা হালাল করার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান করে ফেলেছি। ঘুষ খাই প্রকাশ্যে অর্থাৎ মানসম্মানের মাথা খেয়ে শরীর-মনকে ঘুষ খাওয়ার মতো করে গড়েছি। মিথ্যা কথা অবলীলায় বলতে আমাদের শরীর ও মন উচাটন হয়ে থাকে।

যাহোক সামাদ সাহেব তাঁর লেখায় তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আমার নিকট কারণ একটি এবং তাহলো আমাদের অর্থনৈতিক সংকট। আমরা যারা অতি সাধারণ, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে সাধারণ তাদের নিকট রোজার সময়কার বাজারদর শুধু আতঙ্কই নয়, মহাতঙ্কও বটে। আমি ওনার তিনটি কারণের মধ্যে তৃতীয় কারণ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করছি। তৃতীয় কারণে তিনি লিখেছেন, “রোজা এসে গেছে দুয়ারে। বাংলাদেশে রোজার মাস আসা মানেই ব্যবসায়ীদের জন্য যদৃচ্ছ দাম বাড়ানোর মহোৎসব। সত্যি কথা বলতে কি, গত বছর (২০০৯) রমজানে যেভাবে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে, একেবারে দাপাদাপি করে বৃদ্ধি পেল, তাতে সেটাকে যাঁরা মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগাম ছিঁড়ে যাওয়া বলে বর্ণনা করেছিলেন, তাঁরা একবিন্দু অসত্য কথা বলেননি। তাঁরা সম্পূর্ণ খাঁটি কথা বলেছিলেন। …রোজার এক বিকালে আনারস কেনার ইচ্ছা হয়েছিল। পথের ধারের এক ফলের দোকানে গিয়ে একটা আনারস দেখলাম। দোকানদার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে বললেন, ‘ওটা পঞ্চাশ টাকা।’ প্রথমে আমার একটু সময় লাগল ওটা বুঝতে যে তিনি কি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন, না অন্য কারো। দোকানে আর কোনো ক্রেতা না দেখে বুঝলাম যে তিনি আমাকেই ধন্য করেছেন। তখন মিনমিন করে বললাম, ‘ভাই, গত পরশু আপনার দোকান থেকে এ রকম একটা আনারস ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, আজ এত দাম?’ দোকানদার তখন খুব রুক্ষ্মভাবে বললেন, ‘গত পরশু কেন? আজ সকালে এ রকম আনারস বেচেছি বিশ টাকা করে, এখন ৫০ টাকা, নিলে নেন নাহলে যান।’ মনে হচ্ছিল তিনি যেন বলছেন, ‘কেনার মুরোদ থাকলে কিনুন, না থাকলে বিদায় হোন।’ শূন্যহাতে মাথা নিচু করে বিদায়ই নিলাম। আর যাইনি কোনোদিন ওই তল্লাটে। …তিনি যে অহেতুক আমাকে অপমান করতে পেরেছিলেন সেটা তাঁকে দেখলে আমার খুব স্পষ্ট করেই মনে পড়বে। …ইফতারের ঘণ্টাখানে আগে সবজির একটা ভ্যানকে ঘিরে ভিড় দেখে থামলাম! দেখলাম, সবাই যার যার পছন্দমতো সবজি বাছাই করে বিক্রেতাকে দিচ্ছেন আর তিনি সেগুলো পাল্লায় তুলেই একটা দাম বলে দিচ্ছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই, ক্রেতারা খুশি হয়ে সেই দাম চুকিয়ে চলে যাচ্ছেন। সবজিওয়ালা একসময় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘আপনি নিবেন না কিছু?’ ততক্ষণে তাঁর ভ্যান প্রায় খালি হয়ে গেছে। তো আমি গুটিকয়েক কচি শসা, গাজর, কিছু ধনেপাতা আর কয়েক গুচ্ছ পুদিনা পাতা বেছে তুলে দিলাম তাঁর হাতে। তিনি কোনো ওজন বা হিসাবের মধ্যে না গিয়ে বললেন, ‘ত্রিশ টাকা দ্যান স্যার।’ আমি ভাবছিলাম, একটু দরকষাকষি করি। বিক্রেতা বললেন, ‘আজ সকালেই এইটুকু সবজি বিক্রি করেছি পঞ্চাশ টাকায়, দুপুর আরেকটু বেশি দামে বেচেছি, এখন বাড়ি চলে যাব তাই কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছি।’ তাঁর এ কথার পরও প্রশ্ন করলাম, ‘এক দিনে দর এত ওঠানামা করে?’ তিনি বললেন, ‘স্যার, আমরাও আগে এমন দেখি নাই। এখন বাজার পাগলা হয়ে গেছে। আপনি যা আদায় করতে পারবেন সেটাই ঠিক দাম। কোনো রেট-ফেট নাই। আর এ তো রোজার বাজার।’ জানি না, গতবার চিনি আর তেল নিয়ে যে কেলেংকারি হয়েছে সেটা বাজার পাগল হয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল কি-না…।”

রমজান এদেশের মুসলমানদের কাছে অতি পবিত্র হলে এদেশের সংখ্যালঘুদের কাছে মহাতঙ্ক। যদিও মুসলমানদের ভয়ে তারা মুখ খুলে সত্য বলতে পারে না। আমার এক সংখ্যালঘু বন্ধু কিছুতেই একে পবিত্র বলে স্বীকার করে না। পরে আমি ইসলাম সম্পর্কে সংখ্যালঘুদের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত লিখব বলে আশা রাখছি। যাহোক, আমার এ বন্ধুটি রমজানকে মহাতঙ্ক মনে করে, তার মতে এতে মুসলমানদের পূণ্যির পরিবর্তে পাপই হয়। কারণ এ সময় ব্যবসায়ীরাই নিজেরা মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বহুগুণ বেশি ব্যবসা করার সুযোগ হাতছাড়া করে না। অথচ উন্নত বিশ্বের ঘটে এর উল্টোটাই। সেখানে ধর্মীয় উৎসবে কেন্দ্র করে তারা দাম কমিয়ে, গিফট দিয়ে ক্রেতাদের খুশি করার চেষ্টা করে। তাছাড়া যে পর্যন্ত একটি জিনিষ তাদের দোকানে থাকে সে পর্যন্ত একই দামে বিক্রি করে। না থাকলে বলে নাই, কিন্তু এদেশে প্রচুর মালামাল স্টকে থাকতেও বলে, নাই অথচ দাম বেশি দিলেই তা মিলে। যাহোক, এসময় বাজারদর নিয়ে যতো হৈ-চৈ হয়, অন্য সময় ততো হয় না, তবুও কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং এ সময় বাজারদর নিয়ে মিডিয়া এবং সরকারের উচিত হৈ-চৈ না করা। হৈ-চৈ করলে যখন কাজ হয় না, তখন মনে করিয়ে দিয়ে লাভ কি? এসময় কোমর বেধে নামে সরকার, নামে ব্যবসায়ীরাও, সকলেই রমজানের পবিত্রতা রায় বদ্ধপরিকর, এর জন্য মুখে তুবড়ি ছুটায়, অথচ বাজারদর বৃদ্ধির মহোৎসব কেউই ঠেকাতে পারে না। ধর্ম নিয়ে এরূপ ব্যবসা কি কাফেরদের দুনিয়াতে কেউ দেখেছেন?

এ প্রসঙ্গে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে। সামাদ সাহেব আনারস বিক্রেতার সাথে মিনমিন করে কথা বলছেন। এখন আর আমাদের মতো কোনো ক্রেতাই জোর গলায় কথা বলতে পারে না। যারা পারেন তারা হলেন, গিয়েই সেই ব্যাগ ভরে বিক্রেতার চাহিদা মোতাকে যারা দাম দিতে পারেন। যেমন ওই সবজিওয়ালা এবং আমার আত্মীয়ের দেখা সেই ফল বিক্রেতা, তারা যা চাইছেন ক্রেতারা তাই দিয়েই নিয়ে যাচ্ছেন। এক দিনে তিন রকম দর। ক্রেতা কিন্তু পাইকারি বাজার থেকে একদিনে তিনবার সবজি কিনে আনেনি। এনেছেন সেই ভোরবেলা একবার, এক দামেই। অথচ তিনি সুযোগ বুঝে সবজির দাম বাড়িয়ে নিয়েছেন যতো খুশি।

একজন ক্রেতা যখন দরদাম করে জিনিষ কেনেন তখন হয়তো তার পাশে অন্য একজন এসে ব্যাগ পেতে বিক্রেতার চাহিদা মতো দরে মালামাল নিয়ে যায়। তখন দরদাম করতে থাকা ক্রেতার প্রতি বিক্রেতার অঙ্গভঙ্গিসহ কথাবার্তা তো ব্যাঙ্গাত্মক হবেই এবং নিজেদের প্রচণ্ডরকম অপমানিত বোধ হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও মাথা নিচু করে সেখান থেকে অতি সত্ত্বর সরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাই আমি নিজে এব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকি, যে দোকানে লোকজন কম সেখানে যাই। ফটকাবাজ ব্যবাসী এবং অবৈধভাবে রোজগার করা লোকের সংখ্যা আমাদের দেশ এখন প্রচুর, তাদের এড়িয়ে থাকাও দায়। বাজারে গিয়ে এদের যে প্রচুর টাকা আছে তা দেখাতেও তারা গর্ববোধ করে। আমার ধারনা ঢাকাতে এখন এই অবৈধ আয়ের লোকজনই বেশি। মনে হচ্ছে ঢাকার অর্ধেক সংখ্যক লোকই অবৈধ টাকার তোরে ভাসছে। এরূপ লোকের জন্য আজকাল অনেক অর্থহীন শিতি লোককে মাথা নিচু করে চলা ছাড়া উপায় নাই। বিক্রেতাদের হাবভাব দেখে বোঝা যায়, ওরা এসব অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অথচ শিতি লোকদেরকে ছোটলোক বলেই ভাবে।

কেউ বলেন ঢাকা মসজিদের শহর, কেউ বলেন, কাকের শহর। তবে মসজিদ না আছে এমন কোন অলি-গলি নেই। ভোর রাতে একসাথে হাজারো মাইকে যখন আযান দেয় তখন ঘুমের ঘোরে চমকে উঠতে হয়, মনে হয় পৃথিবীটা বুঝি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রমজানের পুরো মাসটাতে আমার বাসার পাশের মসজিদের ভোরের ডাকাডাকিতে প্রচণ্ড বিরক্ত হই কিন্তু কিছুই বলা যাবে না। মসজিদের ধর্মজীবিরা জোরে জোরে মাইকে ডাকে সেহেরী খাবার সময় হয়েছে উঠুন, উঠুন…, আবার কিছুণ পরে বলে আর মাত্র এতো মিনিট বাকি, কিছুণ পরে বলে, আর মাত্র এতো মিনিট… এরপর বলে আর সময় নাই, একটু পরে আযান দেওয়া হবে…। প্রায় আধঘন্টা ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ধর্মজীবিদের আচমকা কাঠখোট্টা গলার চিৎকার শুনে হৃদপিন্ড কেঁপে ওঠে। তথাপিও কি খোদা এদেশের প্রতি কৃপাবান হচ্ছে?

এখন আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলি, গত বছর রোজার ৪/৫ দিন পূর্বেই কিছু কিছু জিনিষের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারপর রোজা শুরু হয়ে গেলে তা বেড়েই চলেছে, রোজার ৪/৫ দিন পূর্বে যে বেগুণ ছিলো ২৫-৩০ টাকা তা হয়েছে ৬০ টাকা হয়তো আরো বাড়বে। যে মরিচ ছিলো ৮০ টাকা তা হয়েছে ১৫০ টাকা, এরূপভাবে শশা, লেবু, ধনে পাতা, পেয়াজ, রসুন… ইত্যাদি অর্থাৎ যেসব সবজি ইফতারির জন্য প্রয়োজন তার প্রায় সবটাই বেড়েছে সুনামির বেগে। এসব খুচরা বাজারের দর। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৩ আগস্ট ২০১০ তারিখ সকালে কাওরান বাজার গিয়ে দেখলাম, অনেক বেগুন পঁচিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। কুমড়াও পচছে। ৩/৪ কেজি ওজনের দুটো কুমড়া আমি মাত্র ২০ টাকায় নিলাম। কুমড়াওয়ালা ডাকছে ১০ টাকা পিছ। দেখলাম অজস্র কুমড়া পচে গেছে তা যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছে। বেগুনের আড়তেও দেখলাম প্রচুর বেগুন আছে এবং পচে যাওয়া অনেক বেগুন ফেলে দিয়েছে। সেখানে বেগুনের দাম দেখলাম ৪০ টাকা। এখন প্রশ্ন হলো, ৪০ টাকার বেগুন খুচরা বাজারে ৮০ টাকা হয় কিভাবে? ১০ টাকার একটি কুমড়া খুচরা বাজারে ৪০ টাকা, এটাও কি সম্ভব? স্ত্রীকে বললাম, এখন কুমড়ার ব্যবসা করলে বোধ করি আমার বেশি লাভ হতো! এসব কথা বললাম এই জন্য যে, আমাদের নৈতিকতার অবয় যে কতো বেশি হয়েছে এবং সেখান থেকে জাতি যে আর কোনো দিন ফিরবে এমন আশা নেই। এখানে ধর্ম কোনোই কাজ করেনি, করেছে টাকা বা অর্থ! বেগুন পচে যাচ্ছে তারপরও পাইকারগণ দাম কমাবে না। হয়তো এক কেজি বেগুনের দাম কৃষক পেয়েছেন, ১০ টাকা আর পাইকার বিক্রি করতেছেন ৪০ টাকা এবং খুচরা বাজারে গিয়ে তা হয়ে যাচ্ছে ৮০ টাকা। এইরূপ লাভ কি সরকার এবং মিডিয়ার চিৎকার, অনুরোধ, অনুনয়-বিনয়, বিশেষ করে ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনোকালেও থামিয়ে, দমিয়ে অথবা কমিয়ে রাখা গেছে? কোনো দিনও না। তাহলে চিৎকার আর ধর্মের দোহাই দিয়ে লাভ কি? ধর্মের বাণী, ধর্মের অহংকার, ধর্মের সারমর্ম আমরা কেউ কারো চাইতে কম জানি না! ধর্ম যথাতথা অর্থ চাই আগে। অর্থ দ্বারা যে দেশে আইন ক্রয় করা যায়, যে দেশে আইনের শাসন মুখে আছে কার্যেেত্র নাই, যে দেশে সর্বোচ্চ মহল থেকে দুর্নীতির সুনামি বইছে, সেই দেশে ধার্মিক থাকলেও ধর্ম থাকতে পারে না। শুধু এদেশে নয় পৃথিবীর কোথাও মানুষের নৈতিক উন্নতির জন্য ধর্ম কখনোই কাজ করেনি কোনদিন করবেও না। অতএব ধর্ম নিয়ে সাংবাদিকদের হৈ-চৈ বন্ধ করা উচিত। ধর্মের কথা না লিখে পত্রিকাতে নৈতিকতা নিয়ে লিখুন, নিজেরাও দলবাজি ছেড়ে নৈতিক হোন, বুদ্ধিজীবি, আইনজীবি, পেশাজীবিদের প্রতিও একই আবেদন স্বার্থপরতা, দলবাজি ছেড়ে দিন। যা সত্য তা সত্য করে বলুন। খালেদা সত্য না হাসিনা সত্য এতে দেশের কোন মঙ্গল হবে না। স্বার্থপরের ন্যায় কেউ হাসিনা, কেউ খালেদা জিন্দাবাদ না দিয়ে যা সত্য তা ধারন না করলে জাতি আরো অধপতনে যাবে। ধর্মীয় ভন্ডামো থেকে এসব লোকদের বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্ম ব্যাখ্যা করে বুঝতে হবে যে ধর্ম মানুষের জীবন বদলাতে পারে না, যদি তাই সত্য হতো তাহলে এদেশের মানুষ কেন উল্টোদিকে বদলাচ্ছে আর পশ্চিমারা কেন সঠিক পথে বদলাচ্ছে?

২৫ আগষ্ট ২০১১, বিবিসির খবরে প্রকাশ অক্সফামের রিপোর্ট অনুয়ায়ী কয়েকটি মুসলিম দেশে রোজার সময় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অতিরিক্ত বৃদ্ধির মূল কারণ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা শীর্ষে। বাংলাদেশ সরকার তার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি বা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারপরও খাদ্যমন্ত্রী তা স্বীকার করছে না, কারণ আমাদের দেশে ব্যর্থতা স্বীকার করার কোন কালচার নেই।

যাহোক, গত বছর মুক্তমনায় প্রকাশিত আমার প্রথম লেখাটির শিরোনাম ছিল, “সংবিধানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রাখাই জরুরি, তাতে কি জাতি দুর্নীতিমুক্ত এবং সৎ হবে?” সংবিধানে আল্লাহার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় না রাখলে কি এই ধার্মিক জাতির ধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে? হয়তো বা তাই, নতুবা কেন একজন উচ্চশিক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ বিষয়টিকে জরুরি বলে তা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য সরকার এবং দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের আকুতি জানিয়েছিল? তার আকুতিতে কাজ হয়েছে, কিন্তু এতে দেশের ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনজীবি, বুদ্ধিজীবিসহ সাধারণ জনগণের কতোখানি নৈতিক উন্নতি হয়েছে? মোটেও না। হতে পারে না, কারণ ধর্ম মানুষকে মানুষ করতে পারে না। ধর্ম পারে মানুষকে ধার্মিক করতে। ধার্মিক হওয়া আর মানুষ হওয়া এক কথা নয়। খাঁটি মানুষদের ধর্মের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু অমানুষদেরই ধর্মের প্রয়োজন হয়। একজন স্বশিক্ষিত অতি সাধারণ মানুষ হয়ে আমি মনে করি, এ জাতির ধর্ম নষ্ট করে হলেও যাতে নৈতিকতা ফিরে আসে তার জন্য যা যা করণীয় রাষ্ট্রের তাই করা শুধু জরুরিই নয়, অত্যন্ত জরুরি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি এটিকে জরুরি মনে করে তবে একজন সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে ধর্মজীবিদের নিকট তা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।