অনেকদিন বিরতির পর আজকে একটু কিছু লেখার চেষ্টা করছি। কী লিখবো তা নিয়ে ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ লেখার একটা শিরোনাম পেয়ে গেলাম এক বৃদ্ধার মুখ থেকে।চাকমা বাংলা মিলে আজকের লেখার শিরোনাম দিলাম “পার্বত্য জেলা পরিষদে নিয়োগ দুর্নীতিঃ পাঙেই ম্যূঅরা বলে। কী বলে?” এ শিরোনামের শেষ অংশটা ঐ বৃদ্ধার কাছ থেকে ধার করা। সে কথা পরে আসছি।

বিকেল বেলায় কম্পিউটার খুলে অনলাইন সংস্করণে পত্রিকা পড়ছিলাম। আর ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ছিলাম। চোখে পড়লো হরি দা (প্রথম আলোর সাংবাদিক হরি কিশোর চাকমা) রাঙামাটি জেলাপরিষদের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির খবরটা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। খবরের মূল বিষয় হলো, রাঙামাটি জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। বিক্ষুব্ধ লোকজন জেলাপরিষদে ভাংচুর চালিয়েছিলো। অন্যদিকে, আওয়ামীলীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের একাংশও বিক্ষুব্ধ হয়ে মিছিল করার চেষ্টা করেছিলো। কিন্ত জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে সে মিছিল বাতিল হয়ে যায়।পার্বত্য জেলাপরিষদগুলোর দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর নতুন নয়। এ পরিষদগুলো অনেক আগেই দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছিলো। তবে এবারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে সেটা হলো বিক্ষুব্ধ জনতার ক্রোধ। প্রথমবারের মত রাঙামাটি জেলা পরিষদে ভাংচুর চালালো।এর আগে চাকরী না পাওয়ার ক্ষোভে এভাবে কেউ ভাংচুর করেছিলো বলে জানা নেই।

এ ভাংচুরের খবরটা মোটামুটি এখন মুখে মুখে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। যারা চাকরী প্রার্থী ছিলো, কিন্তু চাকরী হয়নি তারাও মুখ খোলার চেষ্টা করছে, ক্ষোভ ঝাড়ছে বিভিন্নভাবে। আমাদের পাড়ার এক বৃদ্ধার ছেলেও তেমনি এক চাকরী প্রার্থী ছিলো। তবে শিক্ষক পদে নয়, অন্য একটি পদে। কয়েক সপ্তাহ আগে সে পরীক্ষা দিয়েছিলো, ইন্টারভিউ পর্যন্ত গেলেও চাকরী হয়নি। ফল প্রকাশের সময় বলা হয়েছিলো, যোগ্য প্রার্থীর অভাবে সকল পদ পূরণ করা গেলো না।মূল সমস্যা যোগ্য প্রার্থীর অভাব নয়, ঠিকমত টাকা না পাওয়ার কারণে তা করা হয়েছিলো বলে ধারনা করা যায়, অথবা ভাগবাটোয়ারাতে সদস্যদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় তা হয়েছিলো।

পাড়ার সেই বৃদ্ধা কোন এক কাজে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। বাসাতে আরো কয়েকজন মহিলা একত্রিত হয়েছিলো।তামাক খেতে খেতে গল্পগুজব করছিলো।কয়েকজন একত্রিত হলে অনেক আলাপ জমে। মহিলাদের এসব গল্পগুজবকে চাকমারা অনেক সময় মজা করে বলে, “মুরগীর মুখে চিংড়ি পড়া”। এক কথা থেকে সাত কথা উঠতে উঠলো। আমার রুম থেকে তাদের কথাবার্তাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

এক মহিলা বললো, “চিজিও (মেয়েটা’র আদরের ডাকনাম) জেলাপরিষদের মাস্টারি পরীক্ষা দিয়েছিলো……জেলাপরিষদের অফিসে নাকি মারামারি হয়েছিলো। নেই, নেই, কোন আশা নেই।আজকাল লেখাপড়া শিখলেও কোন চাকরীর আশা নেই। কেবল নাকি নেতাদের আত্মীয় স্বজনদের চাকরী হয়েছে”।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের মত গরীবদের কী আর চাকরী হবে? নেতাও নেই, টাকাও নেই। টাকা ছাড়া কী আর আজকাল চাকরী হয়?” আরো একজন গড়গড় করে বলে গেলো।

আরো এক মহিলা বলে উঠলো, “আগে আমাদের চাকমারা চাকরী করতে চাইতো না।আর এখন টাকা দিয়েও চাকরী হয় না। কি যে দিনকাল পড়েছে!আর চাকরী না হলেও “পো-ছা” (ছেলে-মেয়েরা)কীভাবে বাঁচবে? জায়গা-জমি সংকুচিত হয়ে গেছে, ধন-দৌলত কমে গেছে।”

“ঠিক ঠিক! সেজন্যে তো এখন নাতি-পুতিদের জন্যে খুবই চিন্তা হয়। আমাদের জীবন তো চলে গেছে। কিন্তু ওরা কীভাবে বাঁচবে সে কথা চিন্তা করলে কুল পাই না”।এক মহিলা বললো।

এভাবে গল্প চলছিলো। এক পর্যায়ে পাড়ার ঐ বৃদ্ধাও কথায় যোগ দিলো।সে বললো, “আমাদের চিকনগুলোও (ছোট ছেলেটা) গত মাসে জেলাপরিষদে চাকরী ইন্টারভিউ দিয়েছিলো।ভগবান দিলে ওর একটু মাথা আছে। যেখানে পরীক্ষা দেয় সেখানে টিকে যায়।কিন্তু টাকা [ঘুষ] দিতে পারি না বলে তার কখনো চাকরী হয় না”।

আরো এক মহিলা বলে উঠলো, “কষ্টবিষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে নেতা ধরো না কেন?”

বৃদ্ধা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো, “আহ! বোন!আমা সংসার চলে উন্ধুরো নাগত্তুন চাজ হুবেইন্যা। হুত্তুন টেঙা জুগুলেদঙ। (হায় রে বোনটি আমার! আমাদের সংসার চলে ইঁদুরের* নাক থেকে মাংস বের করে আনার মত করে। কোথা থেকে টাকা জোগার করবো!)

“তোমাদের তো বড় নেতার সাথে সম্পর্ক আছে। সন্তুবাবুকে তো রান্না করে কত খাওয়াছিলে। সন্তুবাবুরে ধরতে পারো না? উনি সুপারিশ করলে তো চাকরী হয়ে যেতো।”

ঐ বৃদ্ধা মহিলা বললো, “অয়, ঠিক কধা। পাঙেই মূঅ কয় পারা। তারাবন্ন্যা থাকদে হদকদিন সন্তুবাবুসুত্ত বহুত নেতারে ভাত রানি খাবেইয়ং। কয়জনে আর আমারে মনত রাগান দে!বড় মানুজো ইদু যাদেইয়্যো লাজ গরে (হ্যাঁ, ঠিক বলেছো।পাঙেই মুঅ** বলার মত। তারাবন্যা থাকার সময় সন্তুবাবুসহ অনেক নেতাকে ভাত রান্না করে খাওয়াছিলাম। এখন কয়জনে আর সেসব কথা মনে রাখে। বড়লোকের কাছে যেতেও লজ্জা করে)।


মহিলারা আরো অনেক কথা বলেছিলো। তারা রাজনীতি করে না।রাজনীতির অ-আ-ক-খও বোঝে না। কিন্তু রাজনীতি তাদের জীবনে অভিঘাত হানে। জেলাপরিষদ কী এবং কীভাবে সৃষ্টি হলো, কী উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হলো সেসব হয়তো তারা জানে না। অথচ পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো এসব গরীব দুঃখি পিছিয়েপড়া অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে দাবী করা হয়েছিলো। পাহাড়ের চাহিদার আলোকে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্যে এসব পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর ভূমিকা রাখার কথা ছিলো। সাধারণ গরীব দুঃখি মানুষের ছেলে-মেয়েরা, নাতিপুতিরা লেখাপড়া শেষ করে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরী করবে, সমাজের জন্যে কাজ করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই সাধারণ আশা-প্রত্যাশা কী পূরণ হচ্ছে? সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা কী নিজের মেধা ও যোগ্যতায় চাকরী পাচ্ছে? বিস্তর অভিযোগ আছে পার্বত্য জেলাপরিষদগুলোর বিরুদ্ধে। পাহাড়ের এসব জেলা পরিষদ এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। যাদের টাকা পয়সা আছে, যাদের নেতাদের সাথে উঠাবসা আছে, যারা নেতাগিরি করে কেবল তাদের জন্যে এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এসব পরিষদ। কিন্তু যাদের টাকা নেই, ঘনিষ্ঠ কোন নেতাও নেই, তাদের কী হবে?

পত্রিকা পড়ার পর ফেসবুকের স্টাটাস পড়ছিলাম কে কী লিখেছিলো। দেখলাম ফেসবুকেও রাঙামাটি জেলা পরিষদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে। জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর লোকজন পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে করতে যেভাবে নিজেদের শক্তিক্ষয় করে, কিন্তু তাদেরকে জেলাপরিষদের এসব দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নিয়ে আলোচনা করতে দেখতে পেলাম না। এখানেও রাজনৈতিক নেতা, আন্ডানেতা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য স্পষ্ট চোখে পড়ে। জেএসএস-ইউপিডিএফ বৃত্তের বাইরে থেকে কয়েকজন ফেসবুক বন্ধু স্ট্যাটাসে এ ব্যাপারে লিখেছেন। যেমনটা শুরুতে উল্লেখ করেছি, হরি দা একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। জুনোপহর, ভবতোষ চাকমা ও কিরন চাকমার স্টাটাসে পোস্ট দেখলাম। তারা রাঙামাটি জেলাপরিষদের দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এখানে কিরণ চাকমার স্ট্যাটাস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন,

“আমার এক আত্মীয় ৩০০০০০ টাকা ঘুষের বিনিময়ে একটি চাকরি নিশ্চিত করেন।এভাবে ২০০টির বেশি পোস্টে কত টাকা লেনদেন হয়েছে তা সাদা চোখে দেখা যায়।যার ফলে এখন সেখানে মেধার আর কোন দাম থাকছে না।বস্তুত এখন সেখানে টাকাওয়ালারাই চাকরি পাচ্ছে।একটা গরিব মানুষ অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেও টাকা না দিতে পারাই যখন তার চাকরি হয় না তখন তার মনের অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়।আর একটা লোকের দশ আনসার দেওয়ার পরও চাকরি হয়”।

কিরণ চাকমার হিসাব অত্যন্ত সোজা। প্রতি চাকরীর বিনিময়ে ৩০০,০০০ টাকা x ২০০ টা পদ = ৬০,০০০,০০০ টাকা। মানে ৬ কোটি টাকা। এটা তো সরল অংক কষে হিসাব করা হয়েছে।কিন্তু কিছু কিছু পদ ছিলো যেগুলোর দাম ৫০০,০০০ থেকে ৬০০,০০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিলো।

পাঠক বন্ধুরা একটু হিসেব করে দেখুন এই বিপুল পরিমাণ টাকা কাদের পকেট থেকে যাচ্ছে আর কাদের পকেটে ঢুকছে? সাধারণ মানুষরা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যেভাবে হোক ঐ টাকা জোগার করে চাকরী পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। আর জেলা পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান, কখনো মন্ত্রী বা ম্যাডাম, আর কখনো বা সংশ্লিষ্ট সরকারী কমকর্তাদের হাতে তারা সেসব টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেউ কী প্রশ্ন করেছে ঐ টাকা কীভাবে জোগার হয়? কেউ জমি বেচে, কেউ গরু-ছাগল বেচে, কেউ আদা-হলুদ বেচে আর কেউ ধার দেনা করে ঐ টাকা জোগার করে। ভাবতে কষ্ট লাগে, সাধারণ মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত ঐ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারী কমকর্তারা। সেই সাথে আরো কিছু লোক আছে যাদেরকে দালাল বলা হয়। ঐ দালালরাও নেতাদের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চাকরী পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছ টাকা আদায় করে। দালালদের চাকরী বাণিজ্য। “যদি লাইগা যায়” তাহলে তো দালাদের পোয়াবারো হয়। যারা টাকা জোগার করতে পারছে তারা না হয় চাকরী পাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু যাদের টাকা পয়সা নেই তাদের অবস্থা কী? কেউ কী তাদের কথা চিন্তা করে? তাদের মনের দুঃখগুলো কে দেখবে?

কিরণ চাকমা তার স্ট্যাটাসে আরো বলেছেন, ১০ নম্বর উত্তর দিয়েও কারোর চাকরী হয়েছিলো। কিন্তু অনেকে ১০০ নম্বর উত্তর দিয়েও চাকরী পায়নি। যেমন, উপরের সংলাপে আমাদের পাড়ার ঐ বৃদ্ধা বলেছিলো, তার ছোট ছেলে পরীক্ষা দিলে টিকে যায়, কিন্তু টাকা [ঘুষ] দিতে না পারার কারণে তার বারবার চাকরী হয় না। টাকা না দেওয়ার কারণে শুন্যপদ খালি করে রাখা হয়। এ তো মহা অন্যায়। এসব অন্যায়ের প্রতিকার কে করবে?

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মত। যারা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হচ্ছেন, তারা শিক্ষক হিসেবে কেমন হবেন? তাদের কী প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে শিক্ষকতা করার কোন মানসিকতা থাকবে? তাদের আদর্শ, জ্ঞান ও দক্ষতা কেমন হবে? এসব পয়সাওয়ালা শিক্ষকের অনেকে তার শিক্ষকতা পেশাকে বর্গা দেবেন না এমন গ্যারান্টি কেউ কী দিতে পারবেন? এসব শিক্ষকরা কমেপক্ষে ২০ – ২৫ বছর চাকরী করবেন। দীর্ঘ এ সময়ে এসব আদর্শহীন ও বর্গাদার শিক্ষক দিয়ে আমরা কেমন ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে চাচ্ছি? আমাদের শিশুদের ভবিষ্যত কাদের হাতে তুলে দিচ্ছি? এসব প্রশ্ন নিয়ে কেউ কী ভাবছেন?

সাদা চোখে দেখতে পাচ্ছি শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। চরম দুর্নীতি হচ্ছে। গরীব দু:খি মানুষের টাকার হরিলুট হচ্ছে।কিন্তু আমরা কেউ কথা বলছি না। মুখ বন্ধ করে আছি। এসব কথা কাকে বলবো?এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে কেউ কী নেই?
জনৈক ফেসবন্ধু জুনোপহর বলেই ফেলেছেন,

“সন্তুজ, গন্ডুষ, ফান্ডুস – এরা কোথায় গেছে? এদের তো কোন শব্দ নেই….এরা শুধু নিজের কর্মী একটা মারা গেলে ব্যাঙের মত চিল্লাপাল্লা করে ফাল মারে…এদিকে জাতিকে মেধাশুন্য করে দিচ্ছে তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে”।

জুনোপহরবাবুর সাথে একমত। জাতি আজ মেধাশুন্য হতে চলেছে, নিরবে জুম্ম জাতির প্রাণ বিনাশ হতে চলেছে সে ব্যাপারে জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ-এর কোন হুঁশ নেই। কোন প্রতিবাদ নেই। নিরব নি:শব্দে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যত মেধাহীন শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেটার জবাব কে দেবে? নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এসব আদর্শহীন ও মেধাহীন শিক্ষকদের বলির পাঠা হবে গ্রামের শিশুরাই বেশি। অথচ এখানে পাহাড়ী রাজনৈতিক দলগুলো কোন ভূমিকা রাখছে না। তারা নীরব। তাদের এ নীরবতা দেখে প্রশ্ন জাগে, তাহলে জেএসএস-ইউপিডিএফ কাদের জন্যে রাজনীতি করে? পয়সাওয়ালাদের জন্যে নাকি গরীব দু:খি মানুষের জন্যে? গ্রামের শিশুদের জন্যে তাদের কী কোন ভাবনা নেই? নিরবে নি:শব্দে সেসব শিশুদের বোকা বানানোর পাঁয়তারা চলছে, তাদের এ ব্যাপারে কোন ভূমিকা কী নেই?

এসব প্রশ্ন দেখে জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ-এর নেতারা হয়তো বেজার হতে পারেন। হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এখানে কেন তাদের প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে?এ প্রসঙ্গে হরি দা’র একটি লেখার উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে হয়। তিনি তার একটি লেখাতে, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবুল মনসুরের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এ কে ফজলুল হকের কথা তুলে ধরেছিলেন-

“মানুষ আমড়া গাছে ঢিল মারে, ঝাউ গাছে মারে না। কেননা, আমড়া গাছে ফল ধরে, ঝাউগাছে ধরে না।”

এই কথার সুরের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, আওয়ামীলীগ ও বিএনপি যদি পাহাড়ী জুম্মজনগণের আশা-আকাংখা পুরন করতে পারতো, তাহলে আলাদা করে জেএসএস নামক রাজনৈতিক দল গঠনেরও প্রয়োজন ছিলো না (ইউপিডিএফও প্রয়োজন ছিলো না)। আওয়ামীলীগ-বিএনপির কাছে ফল পাওয়া যায় না বলেই তো পাহাড়ী জনগণ জেএসএস–ইউপিডিএফ-এর কাছে ঢিল মারে। এখানে অবশ্যই জেএসএস-এর ভূমিকা বেশি থাকা প্রয়োজন। কেননা, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল হিসেবে জেএসএস-এর এখানে দায়বদ্ধতা আছে। সাধারণ জনগণ তো ঘুষ দিয়ে চাকরী নেওয়ার জন্যে জেলাপরিষদ চায়নি, মেধাহীন আদর্শহীন লোকদের হাতে নিজেদের শিশুদের ভবিষ্যত সঁপে দেওয়ার জন্যে চুক্তি চায় নি।

লেখা শেষ করার আগে বৃদ্ধা মহিলার “পাঙেইম্যূঅ কয় পারা” উক্তিটা জেএসএস ও ইউপিডিএফ নেতাদের আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কেবল ঐ বৃদ্ধা সন্তু লারমাকে ভাত রান্না করে খাওয়াইনি। ঐ বৃদ্ধার মত অজস্র নারী শান্তিবাহিনী যোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়াইয়েছিলো। এখনো খাওয়াইয়ে যাচ্ছে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর অজস্র নেতাকর্মীদের। সাধারণ মানুষ এখনো ধান-চাল, অর্থ ও শ্রম দিয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফ-জেএসএস (এমএন লারমা)- এই তিন দলকে লালন পালন করে যাচ্ছে। বিনিময়ে তারা জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর কাছে কিছুও চায়নি। তাদের চাওয়া-পাওয়াও বেশি নেই। খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারলেই তারা খুশি।ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারলেই খুশি। কিন্তু তাদের শিশুদের লেখাপড়ার জন্যে কী উপযুক্ত শিক্ষক দেওয়া হচ্ছে? শিশুদের পড়ানোর জন্যে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগদানে জেলাপরিষদকে বাধ্য করতে জেএসএস (সন্তু লারমা), ইউপিডিএফ-ও জেএসএস (এমএন লারমা) কোন ভূমিকা পালন করছে? যদি ভূমিকা পালন না করে থাকে তাহলে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর কোন দরকার আছে কী? ঐ বৃদ্ধার মত সাধারণ মানুষরা কী কেবল “পাঙেইম্যূঅ কয় পারা” বলে বলে থাকবে অনন্তকাল ধরে?

অডঙ চাকমা, ২৪ আগস্ট ২০১১
……………………………………….
পাদটীকা
*উন্ধুরো নাগত্তুন চাজ হুবোনা (ইঁদুরের নাক থেকে মাংস বের করে আনা) – এটি একটি চাকমা বাগধারা। এর অর্থ হলো খুব টানাপোড়নের মধ্যে বসবাস করা। বাংলায় নুন আনতে পান্থা ফুরায়-এর সাথে তুলনা করা যায়।

**পাঙেই মুঅ’র আক্ষরিক মানে হলো নৌকার বৈঠার মত মুখওয়ালা। বাস্তবে ঐরকম মুখওয়ালা কোন লোক ছিলো কী না জানা নেই। চাকমারা কাউকে বেশি করে আপ্যায়ন করে খাওয়াতে পারলে খুশী হয়। সেই আপ্যায়নের কথা স্মরণ করতেও খুশী হয়। কিন্তু সে আপ্যায়নের কথা স্মরণ করতে গিয়ে “পাঙেই মুঅ কয় পারা” বলে একটা বাক্য বলে থাকে। এটা একটা অর্থহীন বাক্য হলেও এ কথার একটা তাৎপর্য আছে।সেটা হলো, যা আপ্যায়ন করা হয়েছিলো, সেটা নিজের ভান্ডারে ধনসম্পদ ছিলো বলে সম্ভব হয়েছিলো। সেই আপ্যায়নের কথা স্মরণ করে যাতে মনের মধ্যে দুঃখ না আসে এবং নিজের ধন দৌলতে যাতে কখনো ঘাটতি না হয় বরং তা দিন দিন বাড়তে থাকুক এরকম বোঝাতে “পাঙেই মুঅ’ কয় পারা” বাক্যটি ব্যবহার করা হয়।