ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ রায়

এটি একটি যৌথ রচনা, আমার (ফরিদ আহমেদ)  এবং অভিজিৎ এর। সেই পাঁচ বছর আগে মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে বইটা এক সাথে লিখেছিলাম আমরা। তারপর আর একসাথে কোনো কিছু লেখা হয় নি দুজনে। অনেকদিন পরে আবার আরেকটা প্রচেষ্টা নিলাম। কেমন হয়েছে জানি না। পাঠকদের কাছ থেকে আগ্রহ  এবং সাড়া মিললে দুজনে মিলে এই ধরনের কিছু লেখা লিখবার আশা আছে ভবিষ্যতে।

:line:

কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের দেশে প্রায় সব খ্যাতিমানদের একটা সময় পরে মাথায় তোলা শুরু করি আমরা। মানব থেকে প্রথমে মহামানব, পরে দেবতা বানিয়ে ফেলি তাঁদের। হয়তো নিজেরা অক্ষম বলে, দুর্বল বলে যে হীনমন্যতায় আমরা ভুগি, সেই হীনমন্যতা লুকোনোর জন্যই দেবতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে আমাদের। একটা সময় পর্যন্ত হয়তো কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু আজকের এই যুগে এসে এটাকে আর মেনে নেওয়া যায় না। সময়ের প্রয়োজনেই আজকে দরকার হয়ে পড়েছে দেবোত্বের দেয়ালকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে আসল মানুষগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা। শুধু ভাল ভাল দিক নয়, তাঁদের কোনো অন্ধকার দিক থাকলেও সেটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। এই কাজটা করা হবে কোনো প্রতিহিংসা থেকে নয়, তাঁদেরকে অবমাননা করা বা অপমান করার মানসিকতা থেকে নয়। বরং সত্যকে কঠিন এবং নির্মমভাবে তুলে ধরাটাই হবে মূল উদ্দেশ্য। রবি ঠাকুরের ভাষাতেই, সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনরে ভালবাসিলাম।

আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে- হুমায়ুন আজাদ


বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্রষ্টা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মত করে এরকম দুহাত উজাড় করে বাংলা সাহিত্যকে এত রত্নভাণ্ডার আর কেউ উপহার দিতে পারে নি। ঊনিশ শতকের এক দরিদ্র সাহিত্যের অধিকারী বাংলাকে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই জাতে তুলেছেন, সমৃদ্ধকর করে তুলেছেন। বিশ্বসভায় বাংলা সাহিত্যকে সগৌরবে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। নিরন্তর সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর মত এরকম ঐকান্তিক একাগ্রতায় সারা জীবনব্যাপী শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি আর কোনো সাহিত্যিকের দ্বারা সম্ভবপর হয় নি। না এই অঞ্চলে, না সারা বিশ্বে। সচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে জীবিকা নিয়ে তাঁকে তেমন করে ভাবতে হয় নি কখনো। ফলে, আমৃত্যু তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অফুরান সময় পেয়েছেন। আর সেই সুযোগকে পূর্ণভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর অবিরাম আগ্রহ, নিরলস প্রচেষ্টা এবং ক্লান্তিহীন লেখালেখির মাধ্যমে। সেই কৈশোর বয়স থেকে যে তরী তিনি ভাসিয়েছেন সাহিত্যের স্রোতস্বিনীতে, তার সফল সমাপন ঘটেছে মরণ সাগরের তীরে এসে।

দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে,  রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্র মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয় নি। একদল যেমন ভক্তিরসে ভরপুর হয়ে তাঁকে পুজো করে ছাড়ছে, অন্য দল তেমনি তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার বর্ষণ করে চলেছে, মূলতঃ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই দুয়ের মাঝামাঝি থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তি আলোচনা নেই বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই সমস্যাটা আজকের নয়। তিনি জীবিত থাকা অবস্থা থেকেই এটা চলে আসছে। নীরদ চৌধুরী তাঁর আত্মঘাতী বাঙালী গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্ব আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ এর ভূমিকাতে লিখেছিলেন :

তাঁহার (রবীন্দ্রনাথের) সম্বন্ধে সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা আজ পর্যন্ত হয় নাই। যাহা হইয়াছে তাহা একপক্ষে হিন্দুর মূর্তিপূজার মত, অন্য পক্ষে মুসলমানের মূর্তি ভাঙার মত। জীবিতকালে তিনি যেন হিন্দু হইয়া মুসলমানের রাজত্ব বাস করিয়াছিলেন, অর্থাৎ প্রধানত আক্রমণেরই লক্ষ্য ছিলেন। এই অবস্থার জন্য তাঁহার ব্যক্তিত্ব, মতামত ও রচনা সম্বন্ধে যেসব কথা বলা ও লেখা হইয়াছিল তাহাকে মিথ্যা নিন্দা ভিন্ন আর কিছু বলা যাইতে পারে না। আবার এই বিদ্বেষপ্রসূত নিন্দার পরিমাণ, তীব্রতা ও ইতরতা এমনই হইয়াছিল যে উহার ভারে ও ধারে বেশীর ভাগ বাঙালির কাছেই তাঁহার আসল রূপ চাপা ও কাটা পড়িয়াছিল।

অবশ্য ইহাদের প্রতিপক্ষও যে ছিল না তাহা নয়, অর্থাৎ ভক্তও তাঁহার জুটিয়াছিল। ইহারা বিদ্বেষীদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হইলেও দলে নিতান্তই অল্পসংখ্যক ছিল না। তবে ইহাদের দ্বারাও রবীন্দ্রনাথের হিত হয় নাই। ইহারাও তাঁহার যে রূপ প্রচার করিয়াছিল তাহা অন্ধ স্তাবকের প্রশস্তি ভিন্ন কিছু নয়। এমন কি এই রবীন্দ্রভক্তি এমনই বাক্যভঙ্গি ও আচরণে প্রকাশ পাইত যে, উহাকে হাস্যাস্পদ করা নিন্দাকারীদের পক্ষে খুবই সহজ হইত। ফলে, রবীন্দ্র ভক্তেরাও রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের মতই মিথ্যারই প্রচারক হইয়াছিল।

বর্তমানে অবশ্য অবস্থাটা উল্টা হইয়াছে, অর্থাৎ রবীন্দ্র নিন্দুকেরা লোপ না পাইলেও রবীন্দ্রভক্তেরাই প্রবল হইয়াছে। কিন্তু না ভক্তি না নিন্দা, কোনটাই উচ্চস্তরে উঠে নাই। এখনও রবীন্দ্রনাথের সত্যরূপ আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না।

নীরদ চৌধুরী যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন তার কী আশ্চর্য প্রতিফলন আজকের যুগে। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অগ্রগন্য। তাঁর অসীম মেধা, সীমাহীন সৃষ্টিশীলতা, শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে গ্রীবা উন্নত রাজহংসের মত সাবলীল বিচরণ অন্য সব বাঙালিদের থেকে তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। কিন্তু এই অনন্যতা তাঁকে নিশ্চয়ই দেবত্ব দেয় নি। অথচ আজকের যুগে অনেক বাঙালিই রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলেছেন। তাঁকে নিয়ে ভক্তি গদ্গদ হয়ে পূজোর আসর বসিয়েছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা, ক্ষীণতম ত্রুটি-বিচ্যুতি্র উল্লেখ তাঁদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। উন্মাতালের মত ঝাপিয়ে পড়তে চান সমালোচনাকারীর উপরে। অথচ এঁরা কখনোই বিবেচনায় নেন না যে, রবীন্দ্রনাথও রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ ছিলেন। তাঁরও অন্য আর দশটা মানুষের মতই মানবীয় সীমাবদ্ধতা ছিল। ছিল লোভ, ছিল হিংসা, ছিল ক্ষুদ্রতা, ছিল মহত্ব, ছিল ভালবাসা, ছিল প্রেম। ছিল  অনেক ধরনের প্রশংসনীয় মানবীয় গুণাবলী এবং সেই সাথে সাথে নিন্দাযোগ্য অগুণাবলীও।

এই সমস্ত অন্ধ স্তাবক এবং গুণমুগ্ধ প্রেমিক পূজারীদের কারণে রবীন্দ্রনাথের সঠিক মূল্যায়ন আজকের যুগে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল অংশকে উদ্ভাসিত করে দিতে এঁরা যেমন তৎপর, তেমনই তাঁর অন্ধকার অংশগুলোকে  অতি যত্নে আড়াল করতেও এঁদের কোনো কার্পণ্য নেই। সে কারণেই জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত সমালোচনা হয়েছে, সেগুলোকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ নীরদ চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের জীবিত থাকার সময়ে তাঁর গুণমুগ্ধ স্তাবকের তুলনায় বিরূপ সমালোচকের সংখ্যাই অনেক বেশি ছিল। প্রায় সব রবীন্দ্র গবেষকই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রবীন্দ্রনাথের আঁধার অংশগুলোকে অপসারিত করে দিয়েছেন। ধর্ম অনুসারীরা যেরকম করে তাঁদের ধর্মীয় নেতাকে মহামানব তৈরি করে তাঁর মহৎ গুণগুলোকে শুধুমাত্র উল্লেখ করে, ঠিক সেরকম করেই রবীন্দ্র ভক্তরাও রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত পুরুষ বা অবতার বানানোর আয়োজন প্রায় সুসম্পন্ন করে ফেলেছে। কেউ রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা করলেই লাঠিসোঠা হাতে হা-রে-রে-রে বলে তেড়ে এসেছেন তাঁরা। আহমদ শরীফ তাঁর রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে লিখেছেন :

তাঁর লঘু-গুরু ত্রুটি-বিচ্যুতি, মন-মননের সীমাবদ্ধতা বিমুগ্ধ-বিমূঢ় ভক্ত-অনুরক্তেরা এতো কাল চেপে রেখেছেন, অন্য কেউ উচ্চারণ করতে চাইলেও মারমুখো হয়ে উঠেছেন। প্রমাণ ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসুকে এবং ইদানীং সুশোভন সরকারকে ও সুভোঠাকুরকে গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আর পঞ্চাশের দশকে কম্যুনিস্টরাও হয়েছিল নিন্দিত রবীন্দ্র বিরোধিতার জন্যে।

এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিরুপ আলোচনা একটু বিপদজনকই বটে। তবুও কিছুটা ভরসা আছে আমাদের এই লেখার জায়গাটা মুক্তমনা বলেই। এর অধিকাংশ পাঠকই মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচেতনার এবং মুক্তমনের মানুষ। অন্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার উর্ধ্বে উঠে গুণীর কদর এঁরা যেমন করতে জানেন, ঠিক সেরকমই যে কোনো মান্যবরের মানবীয় সীমাবদ্ধতাকেও না লুকিয়ে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেও অভ্যস্ত তাঁরা। রবীন্দ্রনাথও ইন্দ্রিয়চালিত মানুষ ছিলেন। কাজেই, নানা প্রয়োজনে তাঁরও দোষগুণ নানা প্রসঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়, হবে। এতে বাধা দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।

রবীন্দ্রনাথ যে দোষেগুণে মিলিয়ে আমাদের মতো এক রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন তার প্রমাণ আছে তাঁর নিজের জীবনেই। তাঁর ভক্তদের মত রবীন্দ্রনাথ নিজেও নিজের বিরূপ সমালোচনা সইতে পারতেন না। সমালোচনায় উদ্বেলিত হয়ে, উৎকণ্ঠিত হয়ে তা খণ্ডনের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তেন তিনি। তাঁর হয়ে কেউ প্রতিবাদ করুক, সেই আশায় বসে থাকতেন তিনি। সেরকম কাউকে পাওয়া না গেলে নিজেই ছদ্ম কোনো নাম নিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিকারে নেমে পড়তেন। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ বলেন :

রবীন্দ্রনাথ বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না, প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া না গেলে বেনামে লিখে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতেন। রবীন্দ্রানুরাগী ও রবীন্দ্রস্নেহভাজন অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ত্রুটি-নিন্দা-কলঙ্কের সাক্ষ্য প্রমাণ সতর্ক প্রয়াসে অপসারিত বা বিনষ্ট করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সুশোভন সরকার তাঁর প্রণাম-প্রীতিরূপ দুর্বলতার কথা বলে গেছেন। তাঁর সেজো ভাইয়ের পৌত্র সুভোঠাকুর [সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর] জমিদার পরিচালনায় তাঁর স্বার্থবুদ্ধির কথা বর্ণনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতার নায়ক অমিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন যে, কবি মাত্রেরই পাঁচ বছরের জন্য কবিত্ব করা উচিত। তা না হলে শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি দিকে ব্যূহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে। তাদের লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার ‘রিসীভর্স্ অফ স্টোল্‌ন্‌ প্রপার্টি’। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ঈর্ষণীয় রকমের দীর্ঘায়ু ছিলেন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি অসংখ্য সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর ধারে কাছেও কেউ নেই। তাঁর সমতুল্য সৃষ্টি বিশ্বের অন্য কোনো সাহিত্যে আর কেউ করেছে কি না বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই বিপুল সৃষ্টিতে কতখানি তিনি তাঁর নিজের লেখা থেকেই নকল করে লিখেছেন, সেটা রবীন্দ্র গবেষকরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে, যেখানে কবি সাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই প্রতিষ্ঠা আসে জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে, তারপর তাঁদের জীবনে মোটামুটি বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু লিখে গিয়েছেন অকাতর। শুধু লিখে গিয়েছেন বললে ভুল হবে, উৎকর্ষের দিক দিয়ে এই শেষের বছরগুলো বরং ছাড়িয়ে গিয়েছে আগের রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে নীরদ চৌধুরী লিখেছেনঃ

ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, ব্রাউনিং কেহই পরবর্তী জীবনে আগের রচনার তুলনায় উৎকৃষ্টতর কবিতা লেখেন নাই –ইঁহাদের কবিকীর্তি চল্লিশ বৎসরের আগে রচিত কাব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ও হুগো শেষ জীবনে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা আগের জীবনে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার সমানতো বটেই, কোনো কোনো রচনায় উচ্চতর।

আহমদ শরীফও একই ধরণের মতামত দিয়েছেন। তবে এই বিভাজনকে তিনি চল্লিশ বছরের আগে আর পরে করেন নি। বরং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়টাকে বিভাজন রেখা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। আহমদ শরীফের মতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগের রবীন্দ্রনাথের কাঁচা লেখা প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে নোবেল প্রাপ্তির পরের সময়ে। তাঁর ভাষাতেইঃ

নোবেল পুরস্কারের মান রক্ষার খাতিরেই রবীন্দ্রনাথকে বৈশ্বিক ও বিশ্বমানবিক চিন্তা-চেতনার অনুশীলন করতে হয়েছে। তাঁর দীর্ঘায়ু তাঁকে এ সুযোগ-সৌভাগ্য দিয়েছে। পুরস্কার প্রাপ্তির পরে তিনি সুদীর্ঘ আটাশ বছর বেঁচে ছিলেন, তার আগে বাল্য-কৈশোরের যৌবনের মধ্যবয়সের জীবনদেবতা চালিত কাঁচা-পাকা লেখায় ঊনিশ শতক ও এ শতকের এক দশক কেটেছে বটে, প্রায় সমসংখ্যক বছরব্যাপী, কিন্তু পরিচ্ছন্ন ও পরিপক্ক জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন এবং মনীষা ও নৈপুণ্য নিয়ে বিশ্ববোধ অন্তরে জাগ্রত রেখে লিখেছেন জীবনের স্বর্ণযুগে আটাশ বছর ধরে। বলতে গেলে পুরস্কার পূর্বকালের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঊনিশ শতকী কবি আর পুরস্কার উত্তরকালের রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ শতকের মনীষা মানুষ।

তবে এই রকম বিপুল বিক্রমে লিখে গেছেন বলে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে তিনি কাউকে অনুসরণ করেন নি, অনুকরণ করে নি, বা নকল করেন নি কখনো। কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের জীবনের কোনো না অংশে কারো না কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন। এতে দোষের কিছু নেই। দোষ হয় তখনই, যখন কেউ অন্যের সৃষ্টিকে সচেতনভাবে নিজের নামে চালাতে চায়। রবীন্দ্রনাথের নামে এই ধরনের অভিযোগ তেমন একটা আসে নি। এর মানে অবশ্য এই না যে তিনি কুম্ভিলকতার দোষ (plagiarism) থেকে মুক্ত।  আমাদের মত অর্বাচীন লেখকদের চোখে তো বটেই, বহু বিদগ্ধ গবেষকদের চোখেও সেগুলো পড়েছে। কিন্তু ধর্মপ্রচারকদের অনুসারীদের মতোই অধিকাংশই কেবল ‘ঠাকুর পুজো’ আর ‘নিভৃত প্রাণের দেবতার’ স্তব করে গেছেন অহর্নিশি, আর কঠিন, নির্জলা এবং রূঢ় সত্যগুলোকে আড়াল করে ঠেলে দিয়েছেন কৃষ্ণগহ্বরের গহীন আধাঁরে।  হ্যা, স্তাবক দলের মোহনীয় পরিবেশনায় আমরা রবীন্দ্রাকাশে এতোদিন কেবল চাঁদের একটি পিঠই দেখে এসেছি। আজ আমরা মুক্তমনা লেখকেরা চাঁদের উলটো পিঠটাও দেখতে আগ্রহী।  তাই, এই প্রবন্ধে আমরা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কুয়াশার কালো চাঁদর সরানোর সংকল্প করেছি। তবে, তার আগে এটুকু বলে নিতে চাই যে, রবীন্দ্র বিদ্বেষ থেকে এই প্রবন্ধটি লেখা হয় নি। বরং আমাদের মধ্যে অনেকের মধ্যেই অহেতুক যে পূজো করার বাতিক আছে, সেই পূজারীদের রবি ঠাকুরের মুর্তি গড়ে আড়ম্বরপূর্ণ পূজোতে বাগড়া দেওয়াটা এখানে মূল উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে চাই নির্লিপ্ত এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে, পূজারীদের প্রেমকাতরতাময় কিংবা বিদ্বেষীদের বিষ মাখানো বিষাক্ত দৃষ্টিতে নয়।


রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন সে কথা কারো অজানা নয়। বাংলার সেরা বিজ্ঞানী জগদীশ্চন্দ্র বসু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নীরদ চৌধুরীর আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ থেকে জানা যায় এই ঘনিষ্ঠতা এমনই পর্যায়ের ছিল যে, জগদীশ বসু প্রায়শই রবি ঠাকুরের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে এসে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথেও সাক্ষাৎ করে গিয়েছেন। এর সবকিছুই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালবাসার প্রমাণ হিসাবে আমরা নিতে পারি। কিন্তু, এতেও যাঁরা সন্তুষ্ট হবেন না বলে মনে হয়, তাঁদের কারণেই হয়তো বিজ্ঞানের উপর চমৎকার এবং অত্যন্ত উন্নত মানের একটা বই লিখে গিয়েছেন তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে। ছিয়াত্তর বছর বয়সে লেখা একশ পনের পৃষ্ঠার সেই বইটির নাম ছিল বিশ্বপরিচয়। তিনি যে বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে তাঁর যে লোভের অন্ত ছিল না, সেটা আমরা এই বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকেও জানতে পারি। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। সেই উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন :

আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত [ ঘোষ ] মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ বলে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা নয় এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার পরে বয়স তখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙ-কানা থাকে আমি তেমনি তারিখ-কানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো) পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।

তার পরে বয়স আরো বেড়ে উঠল। ইংরেজি ভাষা অনেকখানি আন্দাজে বোঝবার মতো বুদ্ধি তখন আমার খুলেছে। সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই যেখানে যত পেয়েছি পড়তে ছাড়ি নি। মাঝে মাঝে গাণিতিক দুর্গমতায় পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে, তার কৃচ্ছ্রতার উপর দিয়ে মনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছি। তার থেকে একটা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে, জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার পথে সবই যে আমরা বুঝি তাও নয় আর সবই সুস্পষ্ট না বুঝলে আমাদের পথ এগোয় না এ কথাও বলা চলে না। জলস্থল-বিভাগের মতোই আমরা যা বুঝি তার চেয়ে না বুঝি অনেক বেশি, তবুও চলে যাচ্ছে এবং আনন্দ পাচ্ছি। কতক পরিমাণে না-বোঝাটাও আমাদের এগোবার দিকে ঠেলে দেয়। যখন ক্লাসে পড়াতুম এই কথাটা আমার মনে ছিল। আমি অনেক সময়েই বড়োবয়সের পাঠ্যসাহিত্য ছেলেবয়সের ছাত্রদের কাছে ধরেছি। কতটা বুঝেছে তার সম্পূর্ণ হিসাব নিই নি, হিসাবের বাইরেও তারা একরকম করে অনেকখানি বোঝে যা মোটে অপথ্য নয়। এই বোধটা পরীক্ষকের পেনসিলমার্কার অধিকারগম্য নয় কিন্তু এর যথেষ্ট মূল্য আছে। অন্তত আমার জীবনে এইরকম পড়ে-পাওয়া জিনিস বাদ দিলে অনেকখানিই বাদ পড়বে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলুম। এই বিষয়ের বই তখন কম বের হয় নি। স্যার রবর্ট বল-এর বড়ো বইটা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দের অনুসরণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নিউকো‌ম্ব্স, ফ্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি – গলাধঃকরণ করেছি শাঁসসুদ্ধ বীজসুদ্ধ। তার পরে এক সময়ে সাহস করে ধরেছিলুম প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্সলির এক সেট প্রবন্ধমালা। জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান কেবলই এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করেছে। তাকে পাকা শিক্ষা বলে না, অর্থাৎ তাতে পাণ্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনি নেই। কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক পরিমাণে রক্ষা করেছে। অথচ কবিত্বের এলাকায় কল্পনার মহলে বিশেষ যে লোকসান ঘটিয়েছে সে তো অনুভব করি নে।

কাজেই, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান প্রেম নিয়ে আর কোনো সন্দেহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের প্রতি প্রেমের কারণে বিশ্বপরিচয় লেখার আগে বেশ কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধও তিনি লিখেছিলেন। যদিও সেগুলোর মান ছিল শিশুতোষ পর্যায়ের। সেই প্রবন্ধগুলো আসলেই যে শিশুতোষ ছিল তার উদাহরণ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ লিখিত একটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধকে এখানে তুলে দিচ্ছি।

মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব

পৌরুষ সম্বন্ধে স্ত্রী-মাকড়সার সহিত পুরুষ-মাকড়সার তুলনাই হয় না। প্রথমত, আয়তনে মাকড়সার অপেক্ষা মাকড়সিকা ঢের বড়ো, তার পর তাহার ক্ষমতাও ঢের বেশি। স্বামীর উপর উপদ্রবের সীমা নাই, তাহাকে মারিয়া কাটিয়া অস্থির করিয়া দেয়। এমন-কি, অনেক সময় তাহাকে মারিয়া ফেলিয়া খাইয়া ফেলে; এরূপ সম্পূর্ণ দাম্পত্য একীকরণের দৃষ্টান্ত উচ্চশ্রেণীর জীবসমাজে আছে কি না সন্দেহ।

না, এটি কোন আনাড়ি স্কুল ছাত্রের শুরু করা এবং পথিমধ্যে হাল ছেড়ে দেয়া কোন প্রবন্ধের একাংশ নয়। এটি পরিণত বয়সে লেখা তাঁর একটি পুরো প্রবন্ধই। অবাক লাগছে? বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। বিশ্বপরিচয় বাদ দিলে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি যে সকল প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলো এই মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব ধরণের। এই প্রবন্ধটি নিয়ে মুক্তমনায় একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, এই প্রবন্ধটি যদি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মুক্তমনায় পাঠাতেন প্রকাশের জন্য সেক্ষেত্রে মুক্তমনার মডারেটররা এটাকে প্রকাশ করতেন কি না? এর উত্তরে আদিল মাহমুদ বলেছিলেন যে, “প্রকাশ করতেন। তবে বিজ্ঞান বিভাগে নয়, রম্য বিজ্ঞান বিভাগে”।

তো এই রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়েই শেষ বয়সে বেরিয়ে এসেছিল বিশ্বপরিচয়ের মত সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানের উন্নত একখানা বই। এতেও কোনো সমস্যা ছিল না, বরং আমাদের জন্য তা সৌভাগ্যেরই বিষয়। এর মধ্যে তিনি হয়তো বিজ্ঞানের উপরে আরো পড়াশোনা করেছেন, নিজের উৎকর্ষতা বাড়িয়ে নিয়েছেন, নিজেকে সমৃদ্ধতর করেছেন। তাঁর মানের একজন ব্যক্তি তা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ কিছু কথা বলেছিলেন, যা অনেকটা ছন্দপতনের মতই ছিল। যদিও তিনি আন্তরিক অকপটতায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছিল ভয়ংকর এক সত্য। সেই ভয়ংকর সত্যকে জানার আগে আসুন দেখি রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন। উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে এসে তিনি এই গ্রন্থটি লেখার কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেনঃ

শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এম. এসসি. তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-অধ্যাপক। বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তাছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি সাহায্যও পেয়েছি।

এখানেই এসেই মূলত খটকাটা শুরু হয়। যে বই লেখার ভার পড়েছিল প্রমথনাথের উপরে সেই বই লেখার ভার হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে গিয়ে পড়লো কেন? তাছাড়া কথা হচ্ছে, প্রমথনাথ ঠিক কতখানি শুরু করেছিলেন? যতটুকু শুরু করেছিলেন তাতে করে সহলেখক হিসাবে তাঁর নাম আসাটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কি না?  এটি অনুসন্ধান করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে চরম এবং ভয়ংকর সত্যটা; যে সত্যটাকে দীর্ঘকাল গোপন করে রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ইমেজকে তাঁরই পরনের সাদা আলখাল্লার মত পুতপবিত্র রাখার বাসনায়।

মূল ঘটনায় যাবার আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি শুরুর ইতিবৃত্তটুকু একটু জেনে নেয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের এক সময় ইচ্ছে হয়েছিলো পশ্চিমের ‘হোম ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি’র অনুকরণে ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ তৈরির – যেটি জনপ্রিয় ভাষায় বিজ্ঞানকে সর্বসাধারণের কাছে পোঁছিয়ে দেবে। কাজেই ভাষা হতে হবে যথাসম্ভব সহজ সরল, পাণ্ডিত্যবিবর্জিত। তিনি ভেবেছিলেন মহাবিশ্বের সাথে সাধারণ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য একটা বই লেখা হবে, এবং বইটির ভার তিনি দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়া তরুণ অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর।

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন [প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক’ ৪র্থ খণ্ড, বিশ্বভারতী,১৪০১, পৃ ৯৬]-

‘আমাদের আলোচ্যপর্বে  রবীন্দ্রনাথকে আর-একটি বিষয়ে আলোচনা করিতে দেখিতেছি, সেটি হইতেছে লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে। পাঠকদের স্মরণে আছে বহু বৎসর পূর্বে Home University Libraryর অনুরূপ গ্রন্থমালা বাংলাভাষায় প্রকাশনের কথা কবির মনে আসিয়াছিল। এতকাল পরে বিশ্বভারতী প্রকাশন-বিভাগের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের উদ্যোগে লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা প্রকাশের পরিকল্পনা গৃহীত হইল। কবির মতে, ‘সাধারণজ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকার আরম্ভ হইবে বিজ্ঞানচর্চায়। তদুদ্দেশে কবির ইচ্ছা যে, এই লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার প্রথম গ্রন্থ হইবে বিশ্বপরিচয়। কবি বলেন, ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার। … জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য (pedantry) যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি।  এই প্রথম গ্রন্থখানি লিখিবার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর। প্রমথনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, সত্যেন বসুর প্রিয় শিষ্য, শিক্ষাভবনে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।’

তরুণ শিক্ষক প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে চাকরী পেয়েছিলেন সত্যেন বোস এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সুপারিশে। তিনি বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বাংলায় খুব বেশি দখল ছিল না, (অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ের নন বলে তিনি মনে করতেন)। । রবীন্দ্রনাথ প্রমথবাবুকে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস জিনসের একটা বই – ‘থ্রু স্পেস অ্যান্ড টাইম’ পড়তে দিয়েছিলেন। জেমস জিন্স খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে কিছু সুনাম তাঁর ছিল। ফলে, তার বই থেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই কিভাবে লিখতে হয় তার একটা রসদ পাবেন প্রমথবাবু – সেরকম একটা ধারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই, রবীন্দ্রনাথ যখন প্রমথবাবুকে বই লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন (তখন কি তিনি কস্মিনকালেও জানতেন, তার এই রসদ রবিবাবু পুরোটাই নিজের বইয়ের কাজে ব্যবহার করবেন) যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন। কী রকম উচ্ছ্বাস তার হয়েছিল, তা প্রমথবাবুর ভাস্য থেকেই শোনা যাক –

‘সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ। সে এক বিপর্যয় কান্ড। কোনদিন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ বাংলা রচনায় হাত দেইনি, দু একটা ছোটখাট রচনা যা লিখেছি তা ছিলো ইংরেজীতে। তাই এই অনভ্যস্ত পথে প্রতিপদে কেবল হোঁচট খেতে হল। এগোন আর হচ্ছিলো না। নিজের লেখা নিজেরই এত খারাপ লাগতে লাগল যে, দু এক পাতা লিখেই তা ছিঁড়ে ফেলতাম। ফলে ছিন্ন কাগজের পাতায় ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উঠল। খাতাখানাও সম্বল হারিয়ে ক্রমশঃ শীর্ণকায় হয়ে উঠল। অবশ্য এতে একজন খুব খুশি হলেন, উনুন ধরাবার কাজে অনায়াসলব্ধ এই ছিন্নপত্রগুলো আমার স্ত্রী যথাযথ সদ্গতি করে চললেন।

এই উদ্ধৃতিটি আছে প্রমথনাথ সেনগুপ্তের আনন্দরূপম বইয়ে, যা বাসুমতি, কলকাতা থেকে একসময় প্রকাশিত হয়েছিল (এখন বইটি দুর্লভ, খুঁজলেও পাওয়া যায় না)। বইয়ের এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় লেখক বাংলা নিয়ে অতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু এটি অন্ততঃ ভেবেছিলেন বইটি তাঁরই হবে।

এ সময় পাঠভবনের অধ্যাপক তনয়বাবু (তননেন্দ্রনাথ ঘোষ, পাঠভবনের অধ্যাপক) এসে বললেন –

এভাবে তো হবে না, আপনি যা পারেন লিখুন। তবে তথ্যের দিক থেকে যেন হাল্কা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের বিচারে যে ভাষা সাধারণতঃ ভালো বলে আখ্যা পায়, গুরুদেবের হাতে পড়লে তার খোল-নলচে বদলে গিয়ে এক নতুন ভাষা প্রকাশ পায়। কাজেই বৈজ্ঞানিক তথ্য পর পর সাজিয়ে দিন, ভাষার ভার গুরুদেব নেবেন। গুরুদেব সেই ভাষা দেখে পরবর্তী পর্যায়ে লিখতে শুরু করবেন।’

পাঠক, বুঝতেই পারছেন, কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কেবল ভাষার মাধুর্য বাড়িয়ে প্রমথনাথের মূল তথ্যগুলো হাতিয়ে নেবার পায়তারা চলছে। কিন্তু তারপরেও বই লেখার এ পদ্ধতি ঠিক হবার পরেও হতভাগ্য প্রমথবাবু কিন্তু ভাবছেন বইটা তাঁরই হবে। তিনি বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন – ‘বিশ্বরচনা’। তাই তিনি লিখলেন –

‘ওদের উপদেশ মেনে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল। বইটার নামকরণ করলাম “বিশ্বরচনা” । ধীরে ধীরে কাজ এগুতে লাগল। ‘পরমাণুলোক’ দিয়ে শুরু হল বইয়ের প্রথম অধ্যায়, এটা শেষ করে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’

প্রথম অধ্যায় লেখা শেষ করে প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন,

“রচনাটি আমার কাছে রেখে যাও, কাল ফেরৎ পাবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটাতে হলে ভাষাটা কীরকম হবে, তাই শুধু দেখিয়ে দেব”।

শুধু পরমাণুলোক নয়, এর পর নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার সব অধ্যায়ই লিখেছেন প্রমথবাবু। আর রবীন্দ্রনাথ খোল নলচে বদলে দিয়েছেন। সেই সংশোধন করা পাণ্ডুলিপিগুলো প্রমথনাথ অবশ্য আনন্দরূপম বইয়ে ছাপিয়েছিলেন কিছু কিছু ।
প্রমথবাবু পুরো বইটি এবং তার উপসংহার শেষ করার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেন বইটার নাম “বিশ্বপরিচয়” হবে।  কিন্তু প্রমথনাথকে ঘূর্ণাক্ষরেও তিনি জানতে দেননি একথা। বরং ভিন্ন একধরণের নাটকের অবতারণা করলেন ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে নিয়ে এসে। নাটক বলছি কেন সেটা পাঠকেরা শুনেই বুঝতে পারবেন আশা করছি।

ডঃ সেন হঠাৎ ওকে (প্রমথ বাবুকে) বললেন,

বিশ্বপরিচয় নিয়ে আপনি যে পরিশ্রম করেছেন তাতে বইটার যুক্তগ্রন্থকার হওয়া উচিৎ – রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ

‘গুরুদেব’ সাথে সাথে বললেন,

সে কীরে, বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে। আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথেরই হওয়া উচিৎ। তবে আমার নামের সাথে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চান, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে।

নিঃসন্দেহে এটা প্রমথবাবুর জন্য বড় রকমের ধাক্কা ছিল। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন তার নামেই বইটা হবে। বইয়ের সব তথ্য যে তাঁরই যোগাড় করা! তারপরেও রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভাষার সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন, সেহেতু যুক্তগ্রন্থকার হলেও খুব বেশি হারাবার নেই বলেই ভেবেছিলেন হয়তো। সেই বিহবল অবস্থা ধরা পড়ে প্রমথবাবুর লেখায় –

তারপর পান্ডুলিপি নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন, তারপর ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ডক্টর সেন বললেন যে, সম্ভব হলে ঐ গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যেই যেন ‘পৃথ্বী-পরিচয়’ বইটা আমি শেষ করি। ওর কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটার লেখকের নাম নিয়ে কোথায় যেন একটা সংশয় জেগেছে, অবশ্য এ ব্যাপারে ওঁকে খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞেস করাও সম্ভব নয়।’

এর বেশ কিছুদিন পর নাটকের আসল যবনিকাপাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করলেন প্রমথবাবুকে জানাবেন ব্যাপারটা যে, নিজেই বইয়ের লেখক হতে চান, প্রমথবাবুকে বাদ দিয়ে। কীভাবে সেটা প্রমথবাবুর মুখেই শোনা যাক –

গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যার সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়নে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহনবাবু ও শাস্ত্রীমশায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, “দেখো, বিশ্বপরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না। ” একটু থেকে বললেন, “অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তা ছাড়া বিজ্ঞানের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষপর্যন্ত এই অধ্যবসায়ীর সাহসে কুলাতো না। তুমি ক্ষুন্ন হয়ো না।

এই হচ্ছে বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত। রবীন্দ্রনাথের বিশাল পরিচিত এবং ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু প্রমথনাথ ক্ষুন্ন হয়েছিলেন কি না জানা নেই আমাদের। তবে, এই ঘটনা জেনে আমরা যে ভয়ংকর রকমের ক্ষুব্ধ, ক্ষুন্ন এবং ক্ষীপ্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। রবীন্দ্রনাথের মত একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব তাঁরই অধীনস্থ সামান্য একজন শিক্ষকের সাথে এরকম প্রতারণা করবেন, তাঁর লেখা বইকে নিজের নামে ছাপিয়ে দেবেন কোনো ধরনের চক্ষুলজ্জার ধার না ধেরে, সেটা মেনে নেওয়াটা আসলেই কষ্টকর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ‘রাহাজানির’ (হ্যা, এটি আমাদের চোখে রাহাজানিই, ছোটখাট ‘জোচ্চুরি’ নয়) ঘটনার পুরো বিবরণ আছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের লেখা ‘রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান’ [ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০০০] বইয়ে।  দীপঙ্কর চট্টোপাধায় পেশায় পদার্থবিদ, দাপটের সাথে এক সময় অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৮ -৬১), এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরেও তিনি রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরুতে পারেননি, বরং  ‘দেশ পত্রিকার’ অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রস্তাবকদের একজন ছিলেন তিনি। যথারীতি আর সব সমসাময়িক রাবীন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের মতোই রবিঠাকুরকে মাথায় তুলে নেচেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ কত বড় বিজ্ঞানমনস্ক, কত পরিশীলিত ছিলো তার জ্ঞান, কত আধুনিক ছিলো তার দৃষ্টিভঙ্গি,  সে সময়কার কত বড় বড় বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচিত হবার জন্যে পাগল হয়ে বসেছিলো – তা নিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে লিখে গেছেন পাতার পর পাতা। এমনকি আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আইনস্টাইনের চেয়ে রবীন্দ্রনাথই যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্রে বেশি সঠিক ছিলেন সেটাও আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন।  অবশ্য এ ক্ষেত্রে দীপঙ্কর বাবুকে একলা দোষ দেয়া যায় না। যুগটাই রবীন্দ্রবন্দনার, রবিঠাকুরের মিছে ভাবমূর্তি গড়ে চোখ মুদে স্তব করার।  মডারেট শিক্ষিত ইসলামিস্টরা যেমন কোরাণের মধ্যে বিগব্যাং থেকে শুরু করে সমাজ এবং অর্থনীতির যাবতীয় সূত্র খুঁজে পান, ঠিক তেমনি মডারেট শিক্ষিত রবীন্দ্রস্তাবকেরাও সেই কাজটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অতীব নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছেন, ভারত এবং বাংলাদেশ – দু জায়গাতেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, কৃষি, সমাজতন্ত্র, কোয়ান্টাম ফিজিক্স – এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের নিত্য নতুন অবদান আবিস্কৃত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সমজ-সভ্যতা ধন্য হচ্ছে না তার স্তাবককূলের হাতে পড়ে।  ‘সমাজতন্ত্র কেন কাজ করেনি?’ – রবীন্দ্রনাথ নাকি সেই বিশের দশকেই রাশিয়ার চিঠিতে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত উত্থাপন করে আমাদের জানিয়ে গিয়েছিলেন – একদিন সমাজতন্ত্র ভেঙ্গে পড়বে। আইনস্টাইনের মতো জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ নাকি ভৌত বাস্তবতার প্রকৃতি আরো ভাল বুঝতেন, আর তার ইঙ্গিত নাকি দিয়ে গেছেন শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের ‘আমি’ কবিতায়  ‘আমারি চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’ চরণের মাধ্যমে। শুধু সমাজতন্ত্র কিংবা পদার্থবিজ্ঞান নয়,  পত্রপত্রিকার রবীন্দ্রভক্ত বুদ্ধিজীবীদের কলাম থেকে আমরা আজ শুনছি – আধুনিক ক্ষুদ্র ঋণের আবিস্কারকও নাকি রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি কৃষিকর্মকাণ্ড, সমবায় প্রচেষ্টা, নারীশিক্ষা সবকিছুরই আদি অকৃত্রিম অগ্রদূত রবিঠাকুর। আজকের জামানায় রবীন্দ্রনাথ আবির্ভূত হয়েছেন যেন নতুন এক পয়গম্বর হিসেবে। কাজেই দীপঙ্কর চট্টোপাধায় নতুন কিছু করেননি, বহমান বাতাসেই নিজ নৌকার পাল তুলে দিয়েছেন, নিজেকে ভাসিয়েছেন গড্ডালিকা প্রবাহে। বিনিময়ে পেয়েছেন দেশ পত্রিকায় লেখার এবং আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই বের করার দারুণ সুযোগ। বাংলাদেশের নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী শমশের আলীরা যেমন ‘কোরানিক বিজ্ঞান’ থেকে বেরুতে পারেন না, কোরানের প্রাচীন আয়াতের মধ্যে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্বেষণ করেন,  ঠিক তেমনি দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের মতো রবীন্দ্র স্তাবকেরা ধর্মগুরুর মতোই রবীন্দ্রনাথকে জ্ঞান করেন, তাকে সঠিক মনে করেন, আর রবীন্দ্র রচনাবলীর মধ্যে সন্ধান করেন আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের। তারপরেও তার গুরুজির এভাবে রাহাজানি করে মেধাসত্ত্ব মেরে দেয়ার এই লজ্জা দীপঙ্করবাবুও লুকাতে পারেন নাই। যেমন দীপঙ্কর মশাই বলছেন –

কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে। গোড়া থেকেই প্রমথনাথের মনে কবি একটা প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। প্রথমে তো বলেছিলেন বইটা প্রমথবাবুকেই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন, বিশেষ করে ভাষার ব্যাপারে। এটা বলা কতদূর সঙ্গত হয়েছিল সেটাই প্রশ্ন।

তারপরেই আবার পূজারী রবীন্দ্রনাথের সাফাই গেয়েছেন এই বলে –

রবীন্দ্রনাথের একটা মজার ব্যাপার ছিল। অনেককেই তিনি গল্পের প্লট দিতেন, গল্প লিখিয়ে নিতেন। অনেক কবিযশঃপ্রার্থীর কবিতা সংশোধন করে দিতেন। এসব তিনি করেছেন খ্যাতির চূড়ায় বসেও। অত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এসব কী করে করতেন কে জানে!

প্রিয় পাঠক, উক্তিটা শুনে সেই ব্যাঙ-এর গল্পের কথা মনে পড়ছে না? ছেলেপিলেরা পুকুর পাড়ে বসে ব্যাঙদের উপর ঢিল ছুঁড়তো। ছেলেদের জন্য নির্দোষ ঢিল ছোঁড়া – যেটা তাদের কাছে স্রেফ মজার ব্যাপার ছিলো, সেটাই কিন্তু ছিলো ব্যাঙদের জন্য মরণের কারণ। বুঝতে কী এটি খুব বেশি সমস্যা – রবীন্দ্রনাথ একে তাকে দিয়ে যেটা “মজার ব্যাপার”  মনে করে লিখিয়ে নিতেন, আর তারপর নিজের নামে চালিয়ে দিতেন – সেটা প্রমথনাথের মত নবীন লেখকদের জন্য হয়েছিলো সর্বনাশের কারণ?

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের দীপঙ্ককর চট্টোপাধ্যায় – যারাই রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই কলঙ্কিত অধ্যায়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন, তারাই কিছুটা হলেও লজ্জিত হয়েছেন, কিন্তু তারপরেও ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ থেকে তাদের মোহমুক্তি ঘটেনি। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, প্রমথনাথের ভাষার চেয়ে রবীন্দনাথের ভাষা ছিলো অতুলনীয়, খোলনলচে বদলানোর পর লেখাটা এতোটাই বদলে গেছে যে সেটা প্রমথনাথের বই হবার যোগ্যই ছিলো না। তাই তাকে লেখকের পদ থেকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সঠিক কাজই করেছেন। যুক্তি বটে! তাদের কথা মানা যেত, যদি বইয়ের কাজটি রবীন্দ্রনাথই প্রথম থেকে শুরু করতেন, পাণ্ডুলিপিটি নিজে লিখতেন, এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য প্রমথনাথের সাথে কেবল আলোচনা করে ভুলচুক থাকলে সেটা শুধরে নিতেন, অথবা তাকে দিয়ে রিভিউ করাতেন। তা রবীন্দ্রনাথ করেনিনি। বরং পুরো বইটি লিখিয়েছেন প্রমথনাথকে দিয়েই। একটি দুইটি অধ্যায় নয় – পুরো গ্রন্থের সবগুলো অধ্যায় – পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভুলোক, এমনকি উপসংহার পর্যন্ত তাকে দিয়ে লিখেছেন। কিন্তু মূল গ্রন্থাকার হিসেবে প্রমথনাথকে কৃতিত্ব দেয়া দূরের কথা – সহগ্রন্থকার হিসেবেও তাকে ঠাঁই দেননি ‘ঋষিপ্রতিম’ রবীন্দ্রনাথ, কেবল ভূমিকায় একটি বাক্যে তার নামের উল্লেখ করে দায় সেড়েছেন।    একে রাহাজানি ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?


রবীন্দ্রনাথের মত অতুলনীয় সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে খুব কম সাহিত্যিকই জন্মেছেন। তাঁর রচনাসমূহ নিয়ে ভক্তদের মাতামাতি, উচ্চ প্রশংসা, জীবনের সর্ব আবেগের প্রকাশ রয়েছে রবীন্দ্রনাথে বা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালিত্ব অসম্পূর্ণ ইত্যাদি উচ্ছ্বাসভরা কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবে, তাঁর গান নিয়ে যা হয় সেটাকে ঠিক মাতামাতি শব্দটা দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের গানকে একরকম প্রার্থনা সংগীত বানিয়ে ফেলেছেন তাঁর পূজারীর দল। যে ভাবগম্ভীর পবিত্রতা নিয়ে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করা হয় বা শোনা হয়, তা দেখলেই যে কেউই একে পূজোর আচার আচরণ ভেবে ভুল করে বসে থাকতে পারেন। ভেবে বসে থাকতে পারেন যে, একদল পূজারী গভীর ভক্তিভরে তাঁদের কোনো প্রাণপ্রিয় দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য পরিবেশন করে চলেছেন। এর পূজারীর দল রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া পৃথিবীতে যে অন্য কোনো সংগীত থাকতে পারে, আর সেগুলো যে এর থেকেও ভাল হতে পারে সেটা কোনোভাবে মেনে নিতে রাজী নন। অনেকেই  খুব ‘গৌরবের সাথে’ এবং নির্দ্বিধায় বলে দেন যে, রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া অন্য কোনো সংগীতই শোনেন না। বাংলা গান শোনার ক্ষেত্রে কিছু বাঙালির এই একপেশে আচরণ সম্পর্কে কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়) তাঁর লিখিত বই কোন পথে গেল গান-তে বলেছেনঃ

বাংলা গান শোনা আমাদের সমাজে বরাবরই একপেশে। ফলে, কালক্রমে কিছু জনপ্রিয় গায়ক গায়িকা ও তাঁদের স্মৃতি ঘিরেই আমাদের গানপ্রেম আবর্তিত। সেই সঙ্গে ‘আমি বাপু রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া কিছু শুনি না’, ‘আমি বাবা রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তর বাইরে কিছু মানতে রাজি নই’,…. গোছের বেরসিক, একদেশদর্শী, সুরবধির মানসিকতার শুধু বহির্প্রকাশই নয়, সগর্ব উচ্চারণ।

ভক্তি এবং ভাবে গদগদ ভক্তদের এক্ষেত্রে অবশ্য এককভাবে দোষ দেওয়াটাও অনুচিত। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বিরল ব্যক্তিত্ব, যাঁর দুটো গান দুটো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তাঁর গান সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা ছিল। তাঁর অন্য কোনো সাহিত্যকর্ম দীর্ঘস্থায়ী না হলেও গান যে হবে সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। তাইতো তিনি বলেছিলেন, “জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি না। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবু বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না, যুগ বদলায়, তার সঙ্গে তো সবকিছু বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালীরা, শোকে দুঃখে সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে। [লেখক সমাবেশ, ৫ম বর্ষ সংখ্যা – ১৩, প্রথম পক্ষ মে ১৯৮৫, পরেশ ধর – উদ্ধৃত]

রবীন্দ্রনাথের কথা আপাত সত্য। তবে, আজীবনের জন্য সত্য নয়। কোনো জিনিসই চিরস্থায়ী হয় না, তা সে সেই সময়ের জন্য যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন। এর জ্বলন্ত প্রমাণ মধুসুদন। এরকম একজন অসাধারণ মেধাবী কবি এখন শুধু টিকে আছেন পাঠ্য বইয়ে। কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে নেয়। রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রাচীন কবি হবেন, তাঁর অধিকাংশ রচনা মূল্য হারাবে- রবীন্দ্র-মহিমাও হবে ম্লান থেকে ম্লানতর।  তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্পের অনেক কিছুতেই ‘সেকেলের ছাপ’ লেগে গেছে ইতোমধ্যেই,  এমনকি বহু আধুনিক মেধাবী কবিদের কবিতা কিংবা গীতিকারদের গান রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে, কখনো বা উৎরে গেছে রবীন্দ্র সংগীতকে পিছনে ফেলে দিয়ে।

সমস্যা হচ্ছে যে রবিন্দ্রভক্তরা এই কথাটা মানতে রাজি নন। এই পরিস্থিতিটাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নন। ফলে, বিভিন্ন নিষেধ জারি করে রবীন্দ্রনাথের গানকে বিশুদ্ধ রাখার, আজীবন টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।

দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন কিশোরগঞ্জের মানুষ। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। সে কারণে হিন্দুরা তাঁদেরকে ম্লেছ বলে অভিহিত করতো। স্কুলে তিনি যে বেঞ্চে বসতেন সেই বেঞ্চে অন্য কোনো হিন্দু ছেলে বসতো না। গ্রামের কয়েকজন মুসলমান রাখাল ছিল তাঁর বন্ধু। অসাধারণ দরাজ গলা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে প্রার্থনা সংগীত গাইতে গাইতেই রবীন্দ্র সংগীত শিখেছেন তিনি। এই দেবব্রত বিশ্বাসকে রীতিমত জ্বালিয়ে মেরেছিল ‘রবীন্দ্রভারতী মিউজিক বোর্ড’। রবীন্দ্রনাথের গানের কপিরাইট তাঁদের হাতে ছিল। ফলে, রবীন্দ্র সঙ্গিতের যে কোনো রেকর্ডকেই বিশ্বভারতীর অনুমোদন নিতে হতো বাজারজাত করার আগে। রবীন্দ্রভারতী একাধিকবার দেবব্রত বিশ্বাসের গানকে অনুমোদন দেয় নি বিচ্যুতি এবং অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের অজুহাত তুলে। এর ফলে, হতাশ হয়ে ১৯৭০ সালের পরে তিনি আর কোনো রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করান নি। কেনো তাঁর গাওয়া গানকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে একবার তাঁদের চিঠির সাথে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে কী কী ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে তার একটা তালিকা দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই তালিকাটা এরকম।

রবীন্দ্রসংগীতের উপযোগী যন্ত্রঃ

১। (ক) এস্রাজ, বাঁশী, সেতার, সারেঙ্গী, তানপুরা, বেহালা, দোতারা, একতারা, বাসবেহালা বা অর্গান।
(খ) পাখোয়াজ, বাঁয়াতবলা, খোল, ঢোল ও মন্দিরা।

২। প্রতি গানের মূল আবেগটির প্রতি লক্ষ্য রেখে অনুকূল আবহসংগীত যন্ত্রে রচনা করে, আরম্ভে এবং যেখানে গায়কের কণ্ঠের বিশ্রাম প্রয়োজন, সেখানে তা প্রয়োগ করতে হবে।

৩। যে কটি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, গানের সঙ্গে তার সব কটিকেই বাজান যেতে পারে কিন্তু কোন যন্ত্রটি কিভাবে আবহ সংগীতে বাজবে সংগীত রচয়িতাকে তা স্থির করতে হবে গানের প্রতি ছত্রের ভাবটির প্রতি লক্ষ্য রেখে।

৪। আবহ সংগীত গায়কের গলার শব্দকে ছাড়িয়ে যাবে না কখনো। কণ্ঠের বিশ্রামের সময় বা গান আরম্ভের পূর্বে যখন যন্ত্রে আবহসংগীত বাজবে তখনও এই দিকটার প্রতি বাজিয়েরা যেন বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখেন।

৫। তালযন্ত্রের সঙ্গতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তালের ছন্দ বা বোল যেন কথার ছন্দ ও লয়ের বিপরীত না হয়। অর্থাৎ দ্রুত ছন্দের গানে যেমন দ্রুত লয়ের ঠেকার প্রয়োজন ঢিমালয়ের গানে তেমনি ঢিমালয়ের ঠেকার প্রয়োজনকে মানতেই হবে।

৬। কথার উপরে ঝোঁক দিয়ে অনেক গান গাইতে হয়। এই সব গানের সঙ্গে সঙ্গতের সময় তালবাদ্যেও কথার ছন্দের অনুকূল ঝোঁক প্রকাশ পাওয়া দরকার। তাতে গানের ভাবের সঙ্গে কথার ভাবের সঙ্গতি থাকে।

রবীন্দ্রভারতীয় মিউজিক বোর্ডের এই সব হাস্যকর নিয়মকানুনকে মানতে পারেন নি দেবব্রত বিশ্বাস। সে কারণে সিদ্ধান্ত নেন যে, রবীন্দ্রসংগীত আর রেকর্ড করবেন না। রবীন্দ্রপূজারী এবং রবীন্দ্র শুদ্ধবাদীদের এই বাদ্যযন্ত্রের নিয়মাবলী যে কতটা হাস্যকর যে বিষয়টা দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর আত্মজীবনী ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত এ এভাবে তুলে ধরেছেন-

রেকর্ডে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় উপর্যুক্ত নির্দেশগুলি কে বা কারা দিয়েছেন আমি জানি না। তবে বেশ সহজেই বোঝা যায় যে, যিনি বা যাঁরা ওই নির্দেশগুলি জারী করেছেন তাঁর বা তাঁদের রেকর্ডিঙের ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই। উপরে উল্লিখিত ৪নং নির্দেশটি পড়লে মনে হবে রেকর্ড করার সময় যাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজান, আবহসংগীত বাজাবার সময় বাজিয়েদের ওপরেই সমস্ত দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। উপর্যুক্ত নিয়ামকরা জানেন না যে এই ব্যাপারে বাদ্যযন্ত্রীদের কোনো দায়িত্বই নেই। রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার তাঁর ঘরে বসে রেকর্ডিং যন্ত্রের নানা ধরনের চাবিকাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কণ্ঠের এবং বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজগুলি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং প্রয়োজন হলে ইঞ্জিনিয়ার ইশারা করে অথবা নিজে এসে নির্দেশ দিয়ে যান। ৫নং নির্দেশটিতে তালযন্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা পড়ে মনে হবে সেগুলি খুব বিশেষ চিন্তাপ্রসূত নয়। তালযন্ত্র বিশেষ করে তবলা বাজাবার ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল এবং খুব সূক্ষ্ণ অনুভূতির ব্যাপার। তাই হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানী যখন এই চিঠিগুলি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তখন ভেবেছিলাম এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য বা করাই ভাল। তাছাড়া রবীন্দ্রসংগীত আর রেকর্ড করবো না বলেই স্থির করেছিলাম।

এই বিশুদ্ধবাদীরা কিছু জানুক বা না জানুক, একটা জিনিস খুব ভাল করেই তাঁরা জানে। তা হচ্ছে যে, কেমন করে তাঁদের দেবতাতুল্য মহামানবের ঐশ্বর্য এবং সম্পদকে অবিকৃত এবং অক্ষুন্ন রাখা যায়। তাতে করে দেবব্রত বিশ্বাসের মত দুইচারজন রবীন্দ্রসংগীত না গাইলেও কিছু এসে যায় না তাঁদের।

কয়েক বছর আগে ব্যাণ্ড সংগীত শিল্পী মাকসুদ আধুনিক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে রবীন্দ্রনাথের একটা গান “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়” এই গানটি নিজস্ব ঢং এ ফিউশন বানিয়ে গেয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রপুজারীরা, যারা রবীন্দ্রনাথকে নশ্বর মানব থেকে অবিনশ্বর ঈশ্বরে উপনীত করে ফেলেছেন, তাঁরা রবীন্দ্র সংগীতের জাত গেল, জাত গেল বলে শোরগোল তুলেছিলেন। কোরানের আয়াতের সামান্য বিচ্যুতি যেমন মোল্লাদের সহ্য হয় না, নারী নীতির বিরুদ্ধে হুঙ্কার পেড়ে রাস্তায় নামেন আমিনী গং, ঠিক একই রকমভাবে আমাদের দেশের রবীন্দ্রমোল্লারা  রাস্তায় নেমেছিলেন ‘পবিত্র রবীন্দ্র সঙ্গীতের’ শুদ্ধতা রক্ষার জন্য। শুদ্ধবাদীদের মধ্য থেকে ওয়াহিদুল হক পত্রিকায় কলম ধরেছিলেন মাকসুদের পিণ্ডি চটকানোর জন্য। অথচ গান নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, গানকে ভেঙেচুরে সাজানো বহমান সংস্কৃতিরই অংশ। পশ্চিমা বিশ্বে রক এণ্ড রোল,  রেগে, ব্লুজ, জ্যাজ, কান্ট্রি মিউজিক নিয়ে নিরন্তর ভাঙ্গাচোরা চলে। এলভিস প্রিসলী কিংবা চাক বেরি একসময় যে ঢং এ রক এন্ড রোল সংগীত পরিবেশন করতেন, আজকের শিল্পীরা সেভাবে সংগীত পরিবেশন করেন না। তারা বরং পুরোন গানগুলোকে নিজদের মতো করে ঢেলে সাজান, প্রয়োগ ঘটান নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্রের, কখনো নতুন তাল এবং ছন্দেরও। এতে করে কারো জাত যায় না, কারো মাথায় আকাশও ভেঙে পড়ে না। কিন্তু  বাংলাদেশের রবীন্দ্র-মোল্লারা রবীন্দ্রনাথকে রাখতে চান সমস্ত গবেষণা এবং কাটাছেড়ার উর্ধ্বে। বেদ পাঠ করার অপরাধে মহাত্মা রাম যেমন একসময় শিরোচ্ছেদ করেছিলেন নীচু জাতের শম্বুকের তার তথাকথিত ‘রাম রাজ্যে’, ঠিক তেমনি  সমস্ত রবীন্দ্রপূজারীরা শিরোচ্ছেদ করার ফতোয়া দিতে চান কারো মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতের সামান্যতম বিচ্যুতি লক্ষ্য করলে। রবীন্দ্রনাথকে যেন রাখতে হবে মাথার পরে একেবারে দেবতার আসনে বসিয়ে, দিবানিশি কেবল পায়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে,  আর করজোড়ে স্তব করে। মাকসুদের ফিউশন করার প্রচেষ্টাটি ভাল ফলাফল বয়ে এনেছিলো নাকি খারাপ, সেটি আমাদের প্রশ্ন নয়, তাকে সমালোচিত হতে হয়েছিলো রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কোন রকম নাড়াচাড়া করার চেষ্টার কারণেই। মাকসুদও থেমে থাকেন নি। এর পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন তিনিও কলাম লিখে। মাকসুদ বলেছিলেন, ‌’এদেশ আগে রবীন্দ্রনাথকে বুঝুক তারপর তর্ক করবো। এদেশে এখনো রবীন্দ্র সংগীত মানেই হারমোনিয়াম ধরে প্যা প্যা….  অথচ অবাক বিষয় শান্তিনিকেতনে হারমনিয়াম ঢুকতে পারেনা।’ সচেতন পাঠক হয়তো খেয়াল করেছেন যে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের দেওয়া ‘রবীন্দ্রসংগীতের উপযোগী’ বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় আসলেই হারমোনিয়াম নেই, সেক্ষেত্রে গিটার, কি-বোর্ড, স্যাক্সোফোনের অনুপ্রবেশ তো দূর অস্ত!।

রবীন্দ্রনাথ বাইশ শ’-র উপরে গান লিখেছেন। বাঙালিরা গভীর ভক্তিভরে, সশ্রদ্ধ চিত্তে এগুলোকে শুনে থাকে, গেয়ে থাকে। এর ভাবসম্পদকে আবিষ্কার করা চেষ্টা করে। পরম পূজনীয় ভেবে এর বিশুদ্ধতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু এরাই জানে না যে, রবীন্দ্রনাথের এই বাইশ শ’ গানের অনেকগুলোই বিশুদ্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথের মৌলিক গান নয়। অন্য কোনো গানের সুর থেকে সরাসরি নকল করা বা সেগুলোকে ভেঙে চুরে রবীন্দ্রনাথ নিজের মত করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান আছে বিদেশী সুর থেকে নেয়া, অনেক গান আছে লোকসংগীত থেকে নেয়া, অনেক গান আছে বাউল সুর থেকে নেয়া। নীচে একটা বিদেশী গান দিচ্ছি। একটা খুব জনপ্রিয় রবীন্দ্র গানের সুর নেয়া হয়েছে এই গানটা থেকে। যাঁরা রবীন্দ্র সংগীত শোনেন, খুব বেশি দেরি হবে না তাঁদের সুরটাকে সনাক্ত করতে। যাঁরা পারবেন না তাঁদের জন্য রবীন্দ্রনাথের গানটাও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার নীচেই।

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

গান -Ye banks and braes (স্কটল্যান্ডের ফোক গান)

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

গান -ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে

ইউটিউবেও আছে গান দুটি। শোনা যাক, আর দেখা যাক –

httpv://www.youtube.com/watch?v=OzWsxv0Uae8
Ye banks and braes

httpv://www.youtube.com/watch?v=y57FdECaQss
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে

পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত সাহিত্যিক বা সংগীত স্রষ্টাই অন্যের সৃষ্টি দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। এতে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ভক্তদের ভাষায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে, হুবহু অন্যের সৃষ্টিকে নকল করা অর্থাৎ সরাসরি কুম্ভিলকতা বা চৌর্যবৃত্তি কীভাবে ‘অনুপ্ররেরণা যোগ্য’ হয় সেটা অবশ্য আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত “অনুপ্রাণিত” গানকে ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের একটা তালিকা করেছিলেন। সেখানে তিনি ২৩৪টি ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। ইন্দিরা দেবীর বক্তব্যকে যদি সত্যি বলে ধরে নেই, তাহলেও দেখা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের এক দশমাংশেরও বেশি অন্যের সৃষ্ট সুর থেকে “অনুপ্রাণিত”। যে রবীন্দ্রনাথে নিজেই অন্যদের সুরকে ভেঙেচুরে বা অবিকলভাবে নকল করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথের অনুসারীদের তাঁর গানকে অবিকৃত রাখা বা বিধিনিষধের বেড়াজাল দিয়ে বিশুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা যে অনুচিত এবং অভব্য কাজ, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

রবীন্দ্রনাথ এই রকম অনুপ্রাণিত হতে গিয়ে বহু দেশি-বিদেশি সুরস্রষ্টার সৃষ্ট সম্পদকে নিজে ব্যবহার করেছেন। হিন্দি ছবির কিছু নির্লজ্জ সুরকারেরা যেমন অন্যের সুর বেমালুম ‘আত্মীকরণ’ করেন (প্রীতম যেমন মেরে দিয়েছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের সুর), ব্যাপারটা সেরকমেরই। এঁরা বিগত হয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের অন্যায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে এই অনুপ্রাণিত হওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে আসুন একটা গান শুনি। এই গানটির সুরকে সনাক্ত করতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কোনো মানুষেরই বিন্দুমাত্র সমস্যা হবার কথা নয়। কারণ, এই সুরটা আমরা অহরহ শুনি, গভীর আবেগে এই সুরের গাওয়া গানটার সাথে গলা মেলাই।

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

গান -আমি কোথায় পাবো তারে

এবার আসুন মূল গানটা শুনি, বহুবার শোনা এবং গীত গান এটি।

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

গান -আমার সোনার বাংলা

অবাক হচ্ছেন, বিস্মিত হচ্ছেন, তাই না? ভাবছেন কার এত বড় দুঃসাহস যে, এরকম করে অবিকল রবীন্দ্রনাথের গানের সুরটাকে, আমাদের জাতীয় সংগীতটাকে নকল করেছে। কিন্তু আপনাদের এই অবাক এবং বিস্ময়ের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যাবে যখন জানবেন যে আমি কোথায় পাবো তারে এই গান রচিত এবং সুর করা হয়েছিল আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত এবং সুর করার অনেক আগে। চাপাবাজি নয়, মিথ্যাচার নয়, সত্যের অপলাপ নয়। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আমি কোথায় পাবো তারে গানটির রচয়িতা এবং সুরকার একজন হতদরিদ্র ডাক পিওন। গগন হরকরা তাঁর নাম। লালনের সমসাময়িক, কুষ্টিয়ার এক বাউল তিনি। কীভাবে গগন হরকরার সুরকে নিজের নামিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালিয়ে দিয়েছিলেন, আসুন সে বিষয়টা দেখি আমরা।

রবীন্দ্রনাথদের পৈত্রিক জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী দেখাশোনার জন্য এখানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চারপুরুষ ধরে তাঁদের জমিদারীর প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছেন জোড়াসাকোর এই ঠাকুর পরিবারটি। তিনিও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কবি হিসাবে তিনি যত রোমান্টিকই হোন না কেন, বৈষয়িক বিষয়ে তাঁর স্বার্থবুদ্ধি ছিল একেবারে টনটনে।  ১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন [শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭]।  নতুন জমিদারী ক্রয় করেছিলেন [মার্টিন কোম্পানী থেকে নদীয়ার ডেব্রাকোল ক্রয়]। করবৃদ্ধির ও বলপ্রয়োগে কর আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তাও তিনি সাফল্যের সঙ্গে দমন করেন। বিশশতকের বিশ দশকে প্রজাপীড়ক শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজার বিদ্রোহ এ সূত্রে উল্লেখ। [অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ শারদীয়া, ১৩৮২।]

তাঁর এই বুর্জোয়া, শোষণপ্রিয় মানসিকতার ছাপ পড়েছে তাঁর লেখালেখিতেও। রবীন্দ্রনাথের সীমাহীন রচনাতে সাধারণ মানুষ প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। সামান্য যেটুকু এসেছে, সেটা নিজেকে গরীবের পক্ষের লোক হিসাবে প্রমাণের তাগিদ থেকেই এসেছে, আন্তরিকতা থেকে নয়। আজীবন শোষক হয়ে শোষিতের পক্ষে কলম ধরাটা একটু কষ্টকরই বটে। আহমদ শরীফ তাঁর ‘রবীন্দ্র সাহিত্য ও গণমানব’ প্রবন্ধে লিখেছেনঃ

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের গভীরে প্রোথিত সামন্ত-বেণে-বুর্জোয়াচেতনা ও স্বার্থবোধ শেষাবধি পরিহার করতে সমর্থ হননি। একজন কারখানা মালিক যেমন তার শ্রমিকদের দাবি আদায়ের মিছিলে সামিল হতে পারে না, সামন্ত বেণে-বুর্জোয়া-জমিদার রবীন্দ্রনাথও তেমনি পারেননি দুস্থ-দুঃখী-চাষী-মজুরের শোষণ-পীড়ণ জর্জরিত জীবনের আলেখ্য আঁকতে। এ হচ্ছে শ্রেণীক ও ব্যক্তিক স্বার্থ চেতনার বন্ধন। নইলে যে রবীন্দ্রনাথ প্রমত্তা পদ্মায় জেলে-মাঝিকে ডুবে মরতে দেখেছেন, পদ্মার যমুনার তীর ভাঙনে হাজার হাজার গরিব চাষী-মজুরকে নিঃস্ব হতে উদ্বাস্তু হতে দেখেছেন, দেখেছেন স্বচ্ছল চাষীকে সপরিবারে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে, প্রত্যক্ষ করেছেন দুর্ভিক্ষে অনাহারে-অপুষ্টিতে-তুচ্ছ রোগে ভুগে ভুগে অকালে অপমৃত্যু কবলিত হতে হাজার হাজার নিঃস্ব-নিরন্ন-নিরক্ষর-নির্বিরোধ মানুষকে। আরো দেখেছেন তাঁরই হুকুমে বা সম্মতিতে তাঁরই গোমস্তাদের খাজনার দায়ে তাঁরই গরিব প্রজার ঘটি-বাটি ক্রোক করতে, প্রজাকে ভিটে-ছাড়া করতে, বারবার দেখেছেন ঝড়-খরা-বন্যা তাড়িতি মানুষের চরম দুঃখ-দুর্দশা ও অপমৃত্যু – সেই রবীন্দ্রনাথের বিপুল-বিচিত্র রচনায় এদের নাম-নিশানা মাত্র নেই কেন! বোঝা গেল, শোষক তিনি যত বড়ো মহাপুরুষই হোন, শোষিতের পক্ষে লড়াই দূরে থাক, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও অনীহ।

শুধু সহানুভূতি প্রকাশে অনিচ্ছুকই নয়, নিজেদের শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন তিনি। ফলে, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। জমিদারী প্রথা যে প্রজা মঙ্গলের জন্য উত্তম সেটাকেই বিশ্বাস করতেন তিনি। সেকারণেই বলেছেন, “জমিদারী উঠে গেলে গাঁয়ের লোকেরা জমি নিয়ে লাঠালাঠি কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে। [প্রমথ চোধুরী – রায়তের কথা]

রবীন্দ্রনাথের প্রজা পীড়নের কাহিনি কিছুটা জানা যায় আহমদ শরীফের রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ন সম্পর্কে জানার জন্য তিনি তাঁর ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে চিঠি লিখে তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। আহমদ শরীফের চিঠির উত্তরে আবুল আহসান চৌধুরী এ বিষয়ে নানা তথ্য দিয়ে একটা পত্র লেখেন। আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধের তথ্য নির্দেশ অংশে সেই চিঠিটা হুবহু প্রকাশ করেছিলেন। সেই চিঠিটা এরকমঃ

শ্রদ্ধাভাজনেষু

স্যার, সালাম জানবেন। অসুস্থতার জন্যে আপনার চিঠির জবাব দিতে কয়েকদিন দেরী হলো। অনুগ্রহ করে মাফ করবেন আমাকে।

ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকার কোন বর্ষ কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমার সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে গ্রামবার্তার যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। প্রজাপীড়নের এই সংবাদ-সূত্রটি পাওয়া যায় কাঙাল-শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র একটি প্রবন্ধে। কাঙালের মৃত্যুর পর অক্ষয় কুমারের এই প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে মৈত্রেয়বাবু কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র পরিচালনায় সততা ও সাহসের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রজাপীড়নের সংবাদ ‘গ্রামবার্তায়’ প্রকাশের উল্লেখ করেন। ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার সম্পর্কে হরিনাথ নিজে অক্ষয়কুমারকে যে পত্র লেখেন, তিনি এই প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করে দেন। এই প্রবন্ধ প্রকাশের ফলে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ রুষ্ট ও অপ্রসন্ন হন এবং তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়কে বলে অক্ষয়কুমারের ‘রানী ভবানী’ গ্রন্থপ্রকাশের অর্থ-সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করান। কাঙাল-পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদার সূত্রে জানা যায়, ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ-প্রকাশের অপরাধে (?) তাঁরা লাঠিয়াল-গুণ্ডা লাগিয়ে কাঙালকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এইসব ঘটনা ঠাকুর জমিদারীর ইতিহাসের দুঃখজনক কালো অধ্যায়।

এ ছাড়া অন্যত্র যেমন মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায়, ঠাকুর-জমিদাররা যে প্রজাসাধারণের দুঃখ-কষ্ট মোচনে তেমন তৎপর ও মনোযোগী ছিলেন না তার ইঙ্গিত আছে। ঠাকুরবাবুরা তাঁদের জমিদারী এলাকায় গো-কোরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এই নির্দেশ অমান্যকারীদের নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। শিলাইদহ ঠাকুর-জমিদারীর এই ভূস্বামী-স্বার্থরক্ষার কৌশল-ব্যবস্থা ও প্রজাপীড়নের ঐতিহ্য চারপুরুষের, দ্বারকানাথ থেকে সুরেন্দ্রনাথ পর্যন্ত। কাঙাল হরিনাথের দিনলিপিতেও এর ইঙ্গিত মেলে।

শিলাইদহ জমিদারীতে রবীন্দ্রনাথের আমলেও কিছু অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। চরের মুসলমান প্রজাদের ঢিঢ করবার জন্যে নমঃশুদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্রদায়িক-বুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। এ-ছাড়া পুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরীক্ষামূলক শখের কৃষি-খামারের প্রয়োজনে গরীব মুসলমান চাষীর ভিটেমাটি দখল করে তার পরিবর্তে তাকে চরের জমি বরাদ্দের মহানুভবতাও রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শন করেছিলেন। এ-সব কথা ও কাহিনী উক্ত জীবনীকারদের যত্ন ও সৌজন্যে চাপা পড়ে গেছে। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে গেলে অনেককেই হয়তো সাম্প্রদায়িক বা রবীন্দ্র-বিদ্বেষী শিরোপা, নয়তো সুভো ঠাকুরের (বিস্মৃতিচারণার প্রতিক্রিয়া দ্রষ্টব্য) মতো ধিক্কার ও তিরস্কার অর্জন করতে হবে।

ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের বিষয়ে আমি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের জীবনের নিপুণ ভাষ্যকার শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারীকে (তিনি নিজে শিলাইদহবাসী ও ঠাকুর-এস্টেটের কর্মচারী ছিলেন এবং এই বিষয়গুলো জানতেন) চিঠিপত্রে নানা প্রশ্ন করে ছিলাম। তিনি এ-সব জিজ্ঞাসার জবাব এড়িয়ে ও অস্বীকার করে এই ধরণের কৌতুহলকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী বলে অভিহিত করেছিলেন।

উপরি-বর্ণিত বিষয়গুলোর কিছু কিছু তথ্য আমার সংগ্রহে আছে। আপনার প্রয়োজন হলে সেগুলো পাঠাতে পারি। আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। এই বিষয়ে আপনি কোন প্রবন্ধ লিখেছেন কী না জানিয়ে বাধিত করবেন। আমার গবেষণার কাজ (‘মীর মশাররফ হোসেনের শিল্পকর্ম ও সমাজচিন্তা’) চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছরের মধ্যে থিসিস জমা দেবো এমন আশা আছে। আমার লেখার কাজে আপনার প্রশ্রয় ও প্রেরণার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আপনার জবার প্রত্যাশায় রইলাম। আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে শেষ করি।

স্নেহসিক্ত,

আবুল আহসান চৌধুরী

এই শিলাইদহ, শাহজাদপুরে জমিদারী দেখাশোনা করতে গিয়েই বাউলদের সংস্পর্শে আসেন রবীন্দ্রনাথ। বাউলদের গান শুনে সেগুলোর ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি।  শুধু মুগ্ধই নন, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল গানের সুর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাঁর নিজের ভাষাতেই :

আমার লেখা যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন বাউল-পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। (শান্তিদেব ঘোষ- রবীন্দ্রসংগীত)

এখানেই গগন হরকরার সাথে পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের। গগন হরকরার জন্ম শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রামে। কাজ করতেন ডাক বিভাগে ডাক হরকরা হিসাবে। তিনি একজন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই গগন হরকরাকে কাছারিতে ডেকে নিয়ে আসতেন গান শোনার জন্য। গগন হরকরাও সানন্দে গান শুনিয়ে যেতেন তাঁদের জমিদারবাবুকে। গ্রামের এই সহজ সরল বাউল তখনও ভাবেন নি জমিদারবাবুর মনের মধ্যে কী রয়েছে। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গানটার অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখেন আমার সোনার বাংলা বলে। এই অবিশ্বাস্য কথাটা যাঁদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাঁদের জন্য গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারের গীতি কবিতাটা এখানে তুলে দিচ্ছি, সেই সাথে আমার সোনার বাংলার গীতিও। আপনারা মিলিয়ে দেখতে পারেন।

আমি কোথায় পাব তারে

আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে –
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে –
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত

আমার সোনার বাংলা
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে–
(মরি হায়, হায় রে)
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে,
(আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি।।
কী শোভা, কী ছায়া গো,
কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।।
মা তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে
সুধার মতো–
(মরি হায়, হায় রে)
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি।।

শুধু এই গানের কাঠামো অনুসরণে কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হন নি তিনি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আমার সোনার বাংলাতে হুবহু গগন হরকরার সৃষ্ট সুর বসিয়ে দেন। আমাদের জানামতে গগন হরকরা সেই সময় জীবিত থাকার পরেও তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বা তাঁকে জানানোর প্রয়োজনটুকুও তিনি বোধ করেন নি। এ যেন তাঁর নিজের লিখিত দুই বিঘা জমির সেই জমিদারের মত। রাজা হয়েও ‘যার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। এত বড় একজন কবি এবং সংগীতকার হয়েও গ্রামের একজন দরিদ্র ব্যক্তির মেধাপ্রসূত সম্পদকে চুরি করতে তাঁর বিন্দুমাত্রও বাধে নি। যোগাযোগের অপ্রতুলতা এবং এখনকার মত তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেই সময়ে না থাকার কারণে কারো পক্ষেই এত বড় একটা চুরি ধরা সম্ভবপর হয় নি। পরে যখন বিষয়টা জানা গেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়ে গিয়েছেন মহাকাশস্পর্শী এক মহীরুহে। তাঁর বিশাল এক স্তাবকবাহিনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই স্তাবকবাহিনী তাঁদের পূজনীয় ঠাকুরকে বাঁচানোর জন্য গালভরা এক শব্দ ‘অনুপ্রেরণা’কে বেছে নিয়েছেন, ভাঙা গানের ভরাট ঢালের আড়ালে অত্যন্ত সুকৌশলে নিয়ে গিয়েছেন শতাব্দীর সেরা চৌর্যবৃত্তিকে।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের অনেক কিছুই মৌলিক নয়, বরং বলা যায় বিদেশী সাহিত্যের ছায়া-অবলম্বনে লেখা । যেমন, গবেষক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস তার লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের রহস্য গল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ’  নামের একটি বইয়ে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের চারটি অতি পরিচিত গল্প  -যেমন মহামায়া, গুপ্তধন, নিশীথে, এবং সম্পত্তি সমর্পণ – বিখ্যাত মার্কিন রহস্য গল্পলেখক এডগার অ্যালান পো’র সে সময়কার চারটি গল্প থেকে ‘অনুপ্রাণিত’। ফরাসি লেখক তেওফিল গতিয়ের লেখা­ Le Pied de Mome (১৮৬৬) গল্পের প্রভাব আছে তার বিখ্যাত গল্প ক্ষুধিত পাষাণের ওপর; আর রক্তকরবীর ওপর আছে সুইডিশ নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গের ‘A Dream Play’-এর ছাপ  [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : তত্ত্ব ও তথ্য, অনুষ্টুপ, ১৯৮৯]। কিন্তু এগুলোর ক্ষেত্রে  কেবল ‘বিদেশী গল্পের ছায়া’ থাকায় সরাসরি প্লেইজারিজমের  অভিযোগ থেকে না হয় তাকে অব্যাহতি দেয়া যায়, কিন্তু হতদরিদ্র গগন হরকরার সাথে জমিদারবাবু যা করেছিলেন তার কোন তুলনা নেই।  ২০০৬ সালে বিবিসি সর্বকালের সেরা বাংলা গান কোনটি তাঁর একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে বিপুল ভোট পেয়ে সেরা গান হয়েছিল আমার সোনার বাংলা। অথচ কী আশ্চর্য! সর্বকালের সেরা গানের সুরস্রষ্টা গগন হরকরাকে আমরা চিনি-ই না, চিনি একজন  কুম্ভিলক রবীন্দ্রনাথকে। এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে। এই গানটা আবার আমাদের জাতীয় সংগীতও। শত শত বছর ধরে এটা গাওয়া হবে, অনাগত দিনের বাংলাদেশিরা সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে রবীন্দ্রনাথ নামের একজন মহান কবি এবং সংগীতকারকে, এরকম একটি অসাধারণ শ্রুতিমধুর গানকে সৃষ্টি করার জন্য। এর পিছনের বঞ্চনার ইতিহাস, চুরির ইতিহাস ঢাকা পড়ে যাবে অন্ধ পূজারীদের পরম মিথ্যায় এবং রবির কিরণের তীব্র কষাঘাতে।  বেচারা গগন হরকরা। তাঁর সৃষ্ট সম্পদ অন্যে চুরি করেছে বলে যে হতাশামাখানো দীর্ঘশ্বাসটুকু ফেলবেন, তাঁর সুযোগও নেই। জানতেই পারেন নি যে, নিজের অজান্তেই সর্বকালের সেরা বাংলা গানের সুর সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন তিনি। আর সেই অনন্য সুরটাকে নির্দ্বিধায় মেরে দিয়েছিল, তাঁর গানের কথাকে অনুকরণ করে কবিতা লিখেছিল, তাঁদেরই গানপাগলা জোড়াসাঁকোর জমিদারবাবু ছোটো ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় সত্তর বছর আগে। তাঁকে নিয়ে যে অনন্ত আবেগ তৈরি হয়েছিল, সেই আবেগকে অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট সময় এটি। তারপরেও সেই আবেগ যায় নি। তবে, একেবারে না গেলেও কমে আসছে ঠিকই। দ্রুতগতিতে না হলেও তাঁর ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এমন একদিন আসবে যখন তাঁর ভক্ত, স্তাবক বলতে কেউ-ই থাকবে না। তখন নতুন প্রজন্মের মানুষ নতুনভাবে রবীন্দ্র মূল্যায়ন করতে পারবে। সেই মূল্যায়ন হবে নিরপেক্ষ। ভাল মন্দ কোনো ধরনের তথ্যকেই চেপে রাখবে না নতুন মানুষেরা। অনাসক্ত এবং অভ্রভেদী নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করবে সবকিছুকে। কোনো তথ্যকেই আবেগের রসে রসসিক্ত করে বিকৃত করার চেষ্টা করবে না তারা। সেই দিন শুধু আমাদের জন্যই নয়, রবীন্দ্রনাথের জন্যও শুভ হব্‌ মঙ্গলময় হবে। আসল রবি ঠাকুরকে চেনা হবে তখন। সম্মানিত করা হবে প্রকৃত মানুষটিকে, তাঁর সঠিক সৃষ্টিকে।

পশ্চিমা বিশ্বে অ্যারিস্টটলেরও একসময় এরকমই অনেকটা দেবতার আসন ছিলো। তাঁর চিন্তা ভাবনা, দর্শন নীতি সব কিছুকেই মানুষ বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে নিতো। সমাজে তার প্রতিপত্তি ছিলো বিশাল, অনুরাগীর সংখ্যাও ছিলো বিপুল। তার বাণী সমাজে গৃহীত হতো অনেকটা যেন ‘ঈশ্বরের বাণী’র মতোই। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে চারটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে, মাটি, বায়ু, আগুন এবং পানি দিয়ে, অতএব সেটাই ঠিক।  অ্যারিস্টটল ভেবেছিলেন, সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে ঘরে। অতএব সেটাই হতে হবে ঠিক।  অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ভারী বস্তু আর হাল্কা বস্তু উপর থেকে ছেড়ে দিলে সব সময় ভারী বস্তুই নীচে পড়বে। অতএব সেটাকেই ঠিক হতে হবে।  ঠিক ঠিক ঠিক!

কিন্তু জামানা বদলায়। দেবতারও পতন হয়। বিশেষতঃ গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীদের হাত ধরে পর্যবেক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে পারলো অ্যারিস্টটলের অনেক কথাই আসলে ভ্রান্ত। তার চিন্তা চেতনা পশ্চাৎগামী, তার বহু ভাবনা অবৈজ্ঞানিক শুধু নয় রীতিমত হাস্যকর। আসলে জ্ঞান বিজ্ঞান যত এগিয়েছে ততই কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে প্লেটো এবং এরিস্টটলের ভুতকে ঘার থেকে নামিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়েছিলো। বার্ট্রান্ড রাসেল তার হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘Almost every serious intellectual advance has had to begin with an attack on some Aristotelian doctrine; in logic, this is still true at the present day”। অর্থাৎ, সহজভাবে বললে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস আসলে এরিস্টটলকে হটানোরই ইতিহাস। সমালোচকেরা চাঁছাছোলা ভাবেই বলেছিলেন – ‘এরিস্টটল আসলে যা শিখিয়েছিলেন, তা সবই ছিলো ভুল’। এ ধরণের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতেও দ্বিধান্বিত হননি পাশ্চাত্যের সমালোচকরা এরিস্টটলকে নিয়ে। অ্যারিস্টটলের মতো ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন বলেই সভ্যতা এগুতে পেরেছে।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও এটি করা দরকার। আমাদের এগোনোর স্বার্থেই এটি দরকার। সেজন্যই মুক্তমনা লেখকদের সংকলন ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’র  (চারদিক, ২০০৮) ভূমিকার একটি অংশে লেখা হয়েছিলো –

‘চিন্তার দাসত্ব’-এর ক্ষেত্রে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় বড় নামগুলো তৈরী করেছে ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রহ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।

হ্যা, বল্গাহীন আবেগে আর লাগাতার রবীন্দ্র স্তবে গা ভাসিয়ে দিয়ে আত্মহারা না হয়ে বরং রবীন্দ্রনাথের পুরোটুকু জানাটাই বেশি জরুরি। তার ভুলগুলো জানাটা, জানানোটা, স্পষ্ট সমালোচনা করাটা তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ে। যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নারীস্বাধীনতার অগ্রদূত, তাদের দেখানো দরকার নারীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কুৎসিৎতম একটি প্রবন্ধ ‘রমা বাঈ এর বক্তৃতা উপলক্ষে’ শিরোনামে, যেখানে তিনি প্রকৃতির দোহাই পেড়ে নারীদের ঘরে অবরুদ্ধে রাখতে চেয়েছেন, আর ভদ্র ভাষায় ওয়ার্কিং ওম্যানদের গালাগালি করেছেন। যারা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দারুণ বিজ্ঞানমনস্ক, আইনস্টাইনের চেয়েও বিজ্ঞান ভাল বুঝতেন, তাদের দেখানো দরকার রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে কীভাবে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করেছেন, কিভাবে হোমিওপ্যাথির মত অপবিজ্ঞানকে শুধু বিশ্বাসই করেননি, নিজেও হাতুরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে প্রমথনাথ কিংবা গগন হরকরার মেধাসত্ত্ব লোপাট করেছেন, অনুভব করেননি কোন বিবেকের দংশন। এ ব্যাপারগুলো জানা দরকার। আমরা মনে করি, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি হওয়া অর্ধসত্য এবং অতিকথন নয়, পুরো সত্যটি জানলেই ভক্তদের তৈরি কৃত্রিম প্রাসাদ ছেড়ে তিনি ফিরে আসবেন তাঁর নিজস্ব আলয়ে। সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবেন তিনি সেদিন। আহমদ শরীফকে দিয়ে শেষ করি এই প্রবন্ধ-

রবীন্দ্রনাথসম্পৃক্ত আবেগের কাল অপগত। এখনো যাঁরা আবেগে, ভক্তিতে, শ্রদ্ধায় কিংবা গৌরবে গর্বে অভিভূত, রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বৈষ্ণবসূলভ আবেগে-ভক্তিতে বিগলিত হন, রবীন্দ্রত্রুটি কেউ উচ্চারণ করলেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তাদের মন-বুদ্ধি, রুচি-চিন্তা-চেতনা-বিবেক-বিবেচনার পরিপক্কতায় আস্থা রাখা সম্ভব হয় না। আজ আত্মকল্যাণেই, আত্মবিকাশের ও প্রগতির প্রয়োজনেই ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও অনাসক্ত মন নিয়ে যুক্তি-বুদ্ধি-চিন্তা-চেতনা প্রয়োগে সমাজ-সদস্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মন-মেজাজ, সামাজিক-নৈতিক কর্ম ও আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার চালিত রুচি ও স্বভাব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যোগে জানতে ও বুঝতে হবে। (রবীন্দ্র সাহিত্য ও গণমানব)

:line:
প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক :
Tagore without Illusion -Mukto-Mona Archive