ডিজিটালাইজেশানের এই অবধারিত যুগে বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতি এবং জীবন-যাপন, সবকিছুর ডিজিটাল হয়ে যাবার খবর হাওয়ায় ভাসছে। বাংলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটি বলতে দাঁত ভেঙ্গে গেলেও, ইংরেজী ডিজিটাল শব্দটি বলা খুব সহজ বিধায় পাড়ার ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখা সাংসদ থেকে শুরু করে পেট-মোটা পুলিশ অফিসার সবাই মিলে একযোগে ডিজিটাল বলতে বলতে বাংলার আকাশ-বাতাস পর্যন্ত ডিজিটালাইজড্‌ করে তুলেছেন।

তবে বাংলাদেশ ডিজিটাল হলাম হলাম করতে করতেই বিশ্বে শুরু হয়ে গেছে ডিজিটাল আক্রমণ। ভারত আর চীন থেকে যে পরিমাণ তথ্য প্রযুক্তিবিদ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছে, তার ধারে কাছেও নেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই এখন জানেন যে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ গোলাবারুদে হবে-না, ঢাল-তলোয়ারের যুগতো অনেক আগেই শেষ; ভবিষ্যতের যুদ্ধ হবে ডিজিটাল যুদ্ধ, সে–যুদ্ধের যোদ্ধারাও হবেন ডিজিটাল যোদ্ধা।

হ্যাকিং কিংবা সাইবার আক্রমণের সাথে সবাই কম বেশি পরিচিত, অন্ততপক্ষে শুনেছেন হয়তো। প্রয়োজনীয় সংখ্যক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তৈরী করতে না পারলে, ভবিষ্যতের বড় ধরণের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত আর চীনের সাথে এই যুদ্ধ কি করে মোকাবেলা করবে যুক্তরাষ্ট্র? বস্তুতঃ আমেরিকার বহু বড় বড় ডিজিটাল কারখানা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চায়নিজ আর ইন্ডিয়ানরা। চাকুরী না হয় আমেরিকাতেই করলো, কিন্তু যুদ্ধ যখন শুরু হবে তখনতো এই যোদ্ধারা আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধ করবে না, করবে তাদের নিজ দেশের পক্ষে। সেই ভবিষ্যত ভাবনা থেকে পুরো আমেরিকায় শুরু হয়েছে, সিকিরিটি এবং হ্যাকিংয়ের উপর নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম। উদ্দেশ্যটা আরেকটু ভালো করে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে। ইউএস সাইবার চ্যালেঞ্জ নামের এই কার্যক্রমের ডিরেক্টর ক্যারেন ইভান্স। ব্যাক্তিগতভাবে তার সাথে আমার দুবার কথা হয়েছে। কথা বলতে বলতে খুবই হালকা মেজাজে কিছু রসিকতা করে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। তারপর যখন দেখি এফবিআই, এনএসএ’র শীর্ষস্থানীয় ব্যাক্তিরা তাকে দেখে চুপসে যাচ্ছেন তখন আমার টনক নড়ে। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলাম। এই ভদ্রমহিলার প্রোফাইল উল্লেখ করতে গেলে এক পৃষ্ঠায় শেষ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এর অফিসে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করেন। ক্যারেন ইভান্স এর দেয়া সাক্ষাতকারে তার কণ্ঠেই সাইবার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে পারবেন নীচের এই ভিডিওটি দেখে।

      ভিডিওঃ সাইবার চ্যালেঞ্জ, ক্যারেন ইভান্স এর মুখে শুনুন

আমার সাথে ক্যারেন এর দেখা হয়, অগাস্ট এর প্রথম দিকে, ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া সাইবার ক্যাম্পএ। সমস্ত ইউএসএ জুড়ে অনলাইন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শীর্ষে অবস্থানকারী প্রতিযোগীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে। ক্যাম্পে নাম করা কিছু সিকিউরিটি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সপ্তাহব্যাপী সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ক ট্রেনিং দেবেন, হ্যাকিং এবং এর কায়দা-কানুন সম্পর্কে অবহিত করবেন, যাতে করে প্রতিযোগীরা পরবর্তীতে আরও দক্ষ সাইবার যোদ্ধা হয়ে তৈরী হতে পারে। সপ্তাহব্যাপী ক্যাম্পের সম্ভাব্য সব খরচ তারাই বহন করবেন। অনলাইন প্রতিযোগিতায় আমার স্থান প্রথম দিকেই ছিলো, কিন্তু সমস্যা হলো আমি এদেশের নাগরিক না। আমেরিকানরাতো আর নিজের পয়সায় অন্য দেশীয়দের প্রশিক্ষণ দেয়াবে না। কারণে অকারণে কখনো সেটা দিয়ে থাকলেও আগেতো তাদের নিজের নাগরিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শেষ করাবে, তার পরেইতো অন্যদের নাম আসবে। প্রতিযোগিতার সময় স্পষ্ট উল্লেখ ছিলো, প্রতিযোগিতায় সবাই অংশগ্রহন করতে পারবে, কিন্তু শুধু আমেরিকার নাগরিকদের জন্য ক্যাম্প-এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। কিছু দিনের মধ্যে দেখি ক্যারেন আমাকে মেইল করা জানালো, সপ্তাহব্যাপী ক্যাম্প-এর জন্য আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে, আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত কি-না? হায়! কাকে সে কি বলে, আমি এমন এক জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি যারা ফ্রি পেলে আলকাতরাও খায়। আলকাতরাতো নয়ই, সে জিজ্ঞেস করছে আমি মিল্ক চকলেট খেতে রাজি আছি কি-না। কিন্তু আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না, আমাকে যেতে বলে কেনো। আমিতো এখানকার সিটিজেন না, এরা কি আমাকে সিটিজেনশিপ দিয়ে দিলো না-কি।

যা খুশি তা-ই হোক আমি ঠিকই সময়মতো গিয়ে উপস্থিত হয়ে গেলাম ক্যাম্পে। পুরো সফরে আমার সাথে ছিলো কলকাতার তথাগত। তথাগত যে কারো নাম হতে পারে সেটা তথাগত নিজেও বিশ্বাস করতে চায় না। এখানকার যে লোকটা সবচেয়ে সুন্দর করে তার নাম বলতে পারে, সে তাকে ডাকে টটাগোটা। আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত হোটেলে সে-দিনের মত থেকে পরের দিন চলে গেলাম স্থানীয় একটি কলেজে, যেখানে সপ্তাহব্যাপী ক্যাম্পের পুরো প্রশিক্ষণ চলবে। সেখানে গিয়েতো আমাদের চোখ কপালে উঠে গেলো। চারিদিকে শুধু অ্যামেরিকান আর অ্যামেরিকান। সমস্ত আমেরিকার যেখানেই যাই না কেন, সব জায়গায় চায়নিজ আর ইন্ডিয়ানদের আধিপত্য। এখানে পঞ্চাশ এর উপরে মানুষ, কিন্তু একজনও চায়নিজ বা ইন্ডিয়ান নেই। তাহলে আমরা দুই বাঙ্গাল কি করে এদের ভিতর ঢুকে গেলাম? এতো দেখি কমেডি অব এররস্‌। অবশেষে এই বলে সান্ত্বনা পেলাম যে, যা হবার হয়েছে, কম্পিটিশান করেইতো এসেছি, গায়ের রঙ দেখেতো আর নির্বাচিত করেনি নিশ্চয়।

যথাসময়ে শুরু হলো প্রোগ্রাম। প্রথমেই এফবিআই প্রধান এর রেকর্ড করে পাঠানো বক্তব্য শোনানো হলো। শুনতেই দেখি মহা বিপদ। শুরু করলো প্রিয় আমেরিকান জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে, আমেরিকার জন্য এই হ্যাকার সম্প্রদায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলার মধ্য দিয়ে। তারপর ঘুরে ফিরে একটা কথাই বলে গেলো, কি করে তাদের নিজের জাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, আউটসাইড অ্যাটাক্ থেকে কি করে তাদের ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা করতে হবে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে যেখানে কোনো আইন কানুন প্র্যাকটিস্ হয় না। শুনেই আমি একটু নড়ে-চড়ে বসি, ব্যাটা বলে কি? বলবি তো বলবি, তা তৃতীয় বিশ্বের এই আমাকে ডেকে আনলি কেন? খুশির বিষয় হচ্ছে এখানে মানুষজন কথা কম বলে, কাজ বেশি করে। বলতে গেলে দশ মিনিটের মধ্যেই কর্তাব্যক্তিদের তৃতীয়-চতুর্থ বিশ্বজাতীয় সব কথা-বার্তা শেষ হয়ে গেলো।

এখনো আমরা ভেবে কূল পাচ্ছি না, আমাদেরকে ডাকার কি কারণ থাকতে পারে। অবশেষে, আমরা দুই বাঙ্গাল- এক বাংলাদেশীয় বাঙ্গাল, আরেক পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙ্গালকে কেন একান্তই আমেরিকানদের জন্য করা একটি ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানো হলো, সে ব্যাপারে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম। কোনো এক বইতে পড়েছিলাম, আধুনিক সভ্যতা কতদূর চলে গেছে সেটা বুঝানোর এবং দেখানোর জন্য, সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো এক জংলী আদিবাসী গোত্র থেকে তিন জন মানুষকে প্লেনে করে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শহর-বন্দর-সভ্যতা ঘুরিয়ে দেখিয়ে তারপর গহীন অরণ্যে তাদের আদিনিবাসে ছেড়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিলো, তারা গিয়ে তাদের গোত্রের অন্য সবাইকে বলে বুঝাবে কি দেখে এসেছে, পৃথিবী কতদূর এগিয়ে গেছে, আর তারা এখনো কত পিছনে কোথায় পড়ে আছে। হওয়ার মধ্যে যা হয়েছিলো, দুই দিন পর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া নদীতে তাদের তিনজনের লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। বাইরের পৃথিবীতে গিয়ে অপবিত্র হয়ে আসার কারণে নিজ গোত্রীয় লোকরাই তাদের হত্যা করেছিলো। আমরা নিশ্চিত হয়ে গেলাম ডিজিটাল প্রযুক্তি কতদূর কোথায় এগিয়ে গেছে সেটা বুঝানোর জন্য আমাদেরকে ধরে আনা হয়েছে। নিজেকে বনমানুষ বলে মনে হতে লাগলো। তবে, বনমানুষ হওয়ার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। মন মানুষ আর বন মানুষ সবাই সে একই মানুষ।

কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই, আমরা আমাদের মতো কিছু ইউরোপিয়ান বনমানুষ পেয়ে গেলাম, যারা আমাদের মত এখানকার নাগরিক নয়। তবে, সবচেয়ে বড় যে আবিষ্কার, খাবার টেবিলে বসে দেখি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আমাদের মতোই এক বাদামি চামড়ার বনমানুষ। মনে মনে বলছিলাম, নিজ দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, ভার্জিনিয়ার এই গহীণ জঙ্গলের ভিতর তুমি কে হে মহাপুরুষ, যার গাত্রবর্ণ আমারই বর্ণের কাছাকাছি। পরিচয় জানালো। পরিচিত হতেই দেখি, হায় খোদা! জীবনে কোনো দিন বিশ্বাস করিনি গুরুজনদের, তাদের কথাকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দিয়েছি। যুগে যুগে কালে তারা এক বিশেষ অঞ্চলের মানুষের কথা বলেছেন, চাঁদের দেশে গেলেও না-কি পাওয়া যায় তাদেরকে। বিশেষ অঞ্চল বলাতে বুঝতে কি কষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা তাহলে বিশেষ জেলা বলা-ই ভালো। চাঁদের দেশে গেলেও না-কি পাওয়া যায় এই জেলার মানুষদেরকে। এবার হয়তো ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে, ভারতীয় উপমাহাদেশতো দূরে থাক, গোটা এশিয়া মহাদেশের একটা মানুষও যেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানেও পেয়ে গেলাম আশরাফুল মাখলুকাত, সন্মানিত এক নোয়াখালিবাসীকে, আমার নিজ জেলারই কোনো এক সাধুপুরুষ।

“তারপর” ‘আমাদের’ আর পায় কে, কার বাড়ীতে কি রান্না হয় সেটার খবরও নিয়ে ফেললাম। পঞ্চাশ জেনারেশান মিলালে না-কি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টও বাংলাদেশের আক্কাস আলীর আত্মীয় হয়ে যায়। আমরাও অমুক চেয়ারম্যানের প্রথম শ্বশুরের পরের ঘরের আগের সন্তান জাতীয় সম্পর্ক খুঁজে খুঁজে, দুজন যে খুব কাছের মানুষ সেটা বের করে ফেললাম। কারণ আমরা জানতাম, নোয়াখালীতে সবাই সবার আত্মীয়। ওর নামটাইতো এখনো বলা হলোনা- সারোয়ার। এ নামতো আমার কাছে সহজ, অন্যদের কাছে যে কি হবে, সেটা নিয়েই ভাবছিলাম। বলেই রাখি, আমার ‘mainul’ নামখানাও এদের কাছে এতই কঠিন যে, আমার এক প্রফেসর আমার কাছে ই-মেইল পাঠান ‘Dear Manual’ লিখে। মইনুল হয়ে গেলাম ম্যানুয়েল। অতএব, নামকরণের চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী সারোয়ারও কিছু একটা হয়ে যাবে, সে অপেক্ষাতেই আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারোয়ার ক্যাম্পের একজনের সাথে পরিচিত হতে না হতেই অভিনন্দন জানিয়ে সে বলে উঠলো, ওহহ্‌! স্টার ওয়ার। নাইস্‌ নেইম।

লিঙ্কঃ হ্যাকার্স ক্যাম্প (দ্বিতীয়ার্ধ)

(চলবে…)

মইনুল রাজু
[email protected]