:: হাইপেশিয়া :: রুকসানা/আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট :: অ্যাডা :: তসলিমা নাসরিন :: হুমায়ুন আজাদ :: দালাইলামা :: সুরের রাণী মমতাজ ::

উত্তরপূর্ব তিব্বতের অ্যামডো প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম তাকট্‌সার-এর পাহাড়ে, তীব্র শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে অন্তঃস্বত্বা গৃহবধু বসে আছে তার স্বামীর শিয়রে। তিব্বতের এই অঞ্চলটাতে গত কয়েকবছর ধরে ফসল হয়না বললেই চলে। অন্য আর সব গৃহস্থের মত এই গৃহবধু আর তার স্বামীও কষ্টে-সৃষ্টে দিন পার করে দিতে থাকে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহস্বামী। চারদিকের লক্ষণ দেখে গৃহবধুর মনে দানা বাঁধতে থাকে অশুভ আশঙ্কা। একে একে মারা যাচ্ছে ঘরের মুরগী, আস্তাবলের ঘোড়া আর মাঠে বাঁধা ইয়াক। এর মাঝেই একদিন হঠাৎ ভোর রাত্রির খানিকটা আগেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে যেতে হয় তাদেরকে। তাদের ঘর আলো করে এসেছে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান। সন্তানের মুখ দেখা তাদের জন্য এবারই প্রথম নয়, এর আগে তাদের ঘরে আরো বারো জন সন্তানের জন্ম হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনকে শুধু তারা বাঁচাতে পেরেছিলো। নবজাতক জন্ম নিয়েই তারস্বরে কান্না করবে তেমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই প্রথম তাদের কোনো সন্তান জন্ম নেয়ার পর কান্না করে উঠেনি। এরকম অদ্ভুত জিনিস তিব্বতের এই সুউচ্চ পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত তাকটসার অঞ্চলের লোকজন আগে কখনো দেখেনি। সেই না হয় মেনে নেয়া গেল, কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার হলো, ছেলে জন্মের পর থেকেই তার পিতা দিনে দিনে সুস্থ হতে শুরু করেছে, প্রতিদিনই ঘরের চালে এসে বসছে দুটো কাক, কিছুক্ষণ পরেই কাকদুটো চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন যেন রুটিন করে এসে তারা দেখে যাচ্ছে সদ্যজাত এই অবাক শিশুটিকে। তাকট্‌সার অঞ্চলে কে না জানে, একমাত্র দালাই লামাদের জন্মের পরই জোড়া কাক এসে উপস্থিত হয় ঘরের চালে। সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া, দালাই লামাদের মত যার জন্মের পর ঘরের চালে জোড়া কাক এসে বসে, সেই অবাক শিশুটির পিতা নিজের এই ছেলের নাম রাখলো লামো, সুরক্ষাকারী।

          ছবিঃ তাকট্‌সারের এই বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করে লামো (ইন্টারনেট)

দালাই লামা। মঙ্গোলিয়ান দালাই আর তিব্বতীয় (ব)লামা শব্দ দুটি থেকে উৎপত্তি হয় দালাই লামা শব্দযুগলের। দালাই শব্দ এর অর্থ সমুদ্র। অন্যদিকে, (ব)লামা শব্দের অর্থ শিক্ষক। বুদ্ধধর্মের গেলুগ (ইয়েলো হ্যাট) শাখার সর্বোচ্চ শিক্ষক তথা ধর্মগুরু এই দালাই লামা। হিন্দুদের গুরু কিংবা ইহুদিদের রাবাই এর সাথে সমতূল্য। শাব্দিক অর্থ না করে, ভাবার্থে প্রকাশ করলে দালাই লামা এর অর্থ গিয়ে দাঁড়াবে বিদ্যাসাগর বা জ্ঞানসাগর গুরু, করুণার সাগরও বলা যেতে পারে । ১৫২৮ সালে মোঙ্গল শাসক আলতাই খান তিব্বতের লাসা অঞ্চলের সোনাম গিয়াৎসো কে সর্বপ্রথম দালাই লামা উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সোনাম গিয়াৎসোর পূর্ববর্তী দুইজনকে প্রথম ও দ্বিতীয় দালাই লামা ঘোষণা করা হয়। ফলে, সর্ববপ্রথম দালাই লামা উপাধি পেয়ে থাকলেও দালাই লামাদের কার্যকালক্রমে সোনাম গিয়াৎসো এর অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় তৃতীয় স্থানে।

বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে হীনযান (স্থবিরবাদ), অন্যটি মহাযান। এদের মধ্যে মহাযানপন্থীরা বোধিস্বত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাস করে। বোধিস্বত্ব(সাধু/সন্যাসী)হচ্ছেন তিনি যিনি জগতের কল্যাণার্থে বারবার জন্মগ্রহণ করেন এবং বিশ্বের সকল জীবের মুক্তিলাভের উপায় করেন। সমস্ত বোধিস্বত্বদের মাঝে সবচেয়ে বেশি পূজিত ও সমাদৃত বোধিস্বত্বের নাম অবলোকিতেশ্বর। মহাযান ধারার গেলুগ উপধারার বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে এই অবলোকিতেশ্বরই যুগে যুগে কালে কালে দালাই লামা হয়ে মানুষের রূপ ধারণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। তাই, তিব্বতের জনসাধারণ দালাই লামাকে তাদের স্থানীয় ভাষায় বলে থাকেন কুনডুন, যার অর্থ উপস্থিতি। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার কারণে দালাই লামারা ধর্মগুরু থেকে হয়ে গেছেন রাজনৈতিক গুরুও, হয়ে গেছেন তিব্বতের পার্থিব-অপার্থিব, ইহলৌকিক-পরলৌকিক, এমনকি প্রশাসনিক ক্ষমতারও সবচেয়ে বড় অধিকারী।

একজন দালাই লামার মৃত্যু হলে শুরু হয় নতুন দালাই লামা খোঁজার অভিযান। তিব্বতীয়রা বিশ্বাস করে নতুন কোনো মহাপুরুষ হয়ে ঠিকই আবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন অবলোকিতেশ্বর । তাদের কাজ শুধু খুঁজে বের করা। নতুন দালাই লামা খুঁজে পাওয়া গেলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় আশ্রমে। তারপর আশ্রমের বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্ন্যাসীরা সেখানে উপযুক্ত করে তৈরী করতে থাকেন তাদের নতুন দালাই লামাকে।

১৯৩৩ সালে ত্রয়োদশ দালাই লামার মৃত্যু হলে, শুরু হয় চতুর্দশ দালাই লামার অনুসন্ধান। বিভিন্ন গ্রুপ ভাগ হয়ে, প্রয়াত দালাই লামার ব্যবহার্য জিনিস পত্র সাথে নিয়ে, বিভিন্ন দিকে অভিযান শুরু করে। অভিযাত্রীরা সেই মানুষের সন্ধান করতে থাকে, যার মধ্যে ত্রয়োদশ দালাই লামার বৈশিষ্ট খুঁজে পাওয়া যাবে এবং সেই মানুষটা সদ্যপ্রয়াত দালাই লামার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দেখেই নিজের জিনিস বলে চিনতে পারবে। তিব্বতের লাসা অভিমুখী সেই রকম এক অভিযাত্রীদল তীব্র শীতের রাতে এসে অবস্থান নেয় তাকট্‌সার-এর পাহাড়ে অবস্থিত এক গৃহস্থের বাড়ীতে। সবে মাত্র কথা বলতে শেখা এক ছোট্ট শিশু অভিযাত্রী দলের সাথে করে নিয়ে আসা ত্রয়োদশ দালাই লামার জিনিসপত্র দেখিয়ে শুধু বলতে থাকে এটা আমার, এটা আমার। সে-বারের জন্য অভিযাত্রী দল সে-বাড়ী থেকে ফিরে গেলেও কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। আবারো ত্রয়োদশ দালাই লামার জিনিসগুলো দেখে ঠিকই ছোট্ট শিশুটি তার নিজের জিনিস বলে দাবি করতে থাকে, অন্য সবকিছুর মাঝে নিজের জিনিসটি আলাদা করে চিনতে পারে। অভিযাত্রী দলের বুঝতে বাকী থাকলো না যে, তারা পেয়ে গেছে তাদের প্রতীক্ষার চতুর্দশ দালাই লামাকে। প্রাপ্তবয়স্ক সব অভিযাত্রী মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা আর আনুগত্য দেখাতে শুরু করে অপ্রাপ্তবয়স্ক এই অবাক শিশুকে। এই সেই একই শিশু, জন্মের পর যে একটি বারের জন্যও কেঁদে উঠেনি, যার জন্মের পর জোড়া কাক এসে বসেছিলো বাড়ীর ছাদে, আদর করে বাবা যার নাম রেখেছিলো লামো।

কিন্তু সমস্যা হলো এরকম আরো অনেক সম্ভাব্য দালাই লামার খোঁজ তারা পেয়েছে। সর্বমোট ষোলো জন দালাই লামা থেকে প্রাথমিকভাবে তিনজনকে নির্বাচিত করা হলো, যাদের মধ্যে যাচাই-বাছাই এর পর নির্বাচিত করা হবে আসল দালাই লামাকে। এ-পর্যায়ে, ১৯৩৬ সালের ৬ই জুলাই জন্মগ্রহণ করা তিন বছর বয়সী ছোট্ট শিশু লামো ১৯৩৯ সালের ২১শে জুলাই যাত্রা শুরু করে লাসার উদ্দেশ্য, যেখানে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সুনিশ্চিত করবেন কে আসলে সত্যিকারের দালাই লামা। লাসায় আগমন পরবর্তী সমস্ত প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হবার পর, অবশেষে, ১৯৪০ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী মাত্র চার বছর বয়সে তাকট্‌সার গ্রামের ছোট্ট ছেলে লামো ভূষিত হয় চতুর্দশ দালাই লামা উপাধিতে; সাথে সাথে দেয়া হয় তার নতুন নাম- তেনজিন গিয়াৎসু। ইতিমধ্যে গ্রীষ্মকালীন বাসভবন জ্যুয়েল পার্ক ছেড়ে তেনজিন গিয়ে উঠেছেন দালাই লামাদের জন্য নির্মিত সুবিখ্যাত বাসভবন শীতকালীন প্রাসাদ পোটালা প্যালেস-এ। এই আশ্রমগুলোতে অবস্থানরত অবস্থায় ছয় বছর বয়সে শুরু হয় তেনজিনের শিক্ষা-দীক্ষার। বৌদ্ধ ধর্মীয় সমস্ত কলা কানুন লিখতে পড়তে শেখার সাথে সাথে চলে শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, কবিতা, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শনের নানা পাঠ।

          ছবিঃ দালাই লামার বাসভবন পোটালা প্যালেস (ইন্টারনেট)

দালাই লামার অনুসন্ধান করা , দালাই লামার অনুপস্থিতি কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা এবং দালাই লামাকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব যার হাতে থাকে তিনি হলেন রিজেন্ট। তেনজিনের অনুসন্ধান পরিচালনাকারী রিজেন্ট ছিলনে তিব্বতের সুবিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক রিটিং আশ্রম এর অধ্যক্ষ রিটিং রিনপচে। কিন্তু যুগে যুগে কালে যেখানেই ছিলো ক্ষমতার সুমিষ্ট সুঘ্রাণ, সেখানেই গড়ে উঠেছিলো ষড়যন্ত্রের সুবিশাল কারখানা। ওরাকল বা ভবিষ্যৎবক্তার দোহাই দিয়ে, অপরাপর সভাষদদের মতামতে, রিটিং রিনপচেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দালাই লামাকে ছেড়ে অনেক দূরে। নির্বাচিত হয় নতুন রিজেন্ট। পরবর্তীতে রিটিং রিনপচে রিজেন্ট পদের দাবী নিয়ে ফিরে আসতে চাইলে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বন্দী করা হয়। বন্দী অবস্থায় তার কপালে কি হবে সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। দালাই লামার পোটালা প্যালেসের বন্দীশালায় বিষ প্রয়োগে মারা যান রিটিং রিনপচে। মৃত্যুর পর দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসুকে জানানো হলে অবাক বিষণ্ন হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এখানে বন্দীশালাও আছে? বন্দুক গোলা বারুদও আছে? অপ্রাপ্তবয়স্ক এই ক্ষমতাধর শিশুটি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, এই ধর্ম কর্ম ছাড়াও পৃথিবীতে আরও একটা ব্যাপার আছে, অচিরেই যার নোংরা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হবে তাকেও। অপরিহার্য আর অবধারিত সেই প্রক্রিয়ার নাম- রাজনীতি

১৯৫০ সালের ৭ই অক্টোবর, ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে তিব্বত আক্রমণ করে চীনের কমিউনিস্ট সরকার। আর তখনি, তুলনামূলকভাবে নিরীহ, শান্তিকামী তিব্বতের মানুষের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হয়ে, সকলের অনুরোধে, মাত্র ১৫ বছর বয়সী তেনজিন গিয়াৎসু তিব্বত সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তিব্বতের খাম্পা গেরিলা যোদ্ধা আর চীনা আগ্রাসনকারীদের মধ্যে। মার্কিন সংস্থা সিআইএ তিব্বতীয় গেরিলাদের সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত চীনা বাহিনী প্রতিরোধ দেখে সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় আড়াই লাখে পরিণত করে। তিব্বতীয়দের জন্য এই সুবিশাল, অত্যাধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অসম্ভব। অবশেষে, সভাষদদের পরামর্শে ১৯৫১ সালের জানুয়ারীতে দালাই লামা সদলবলে স্থানান্তরিত হন সিকিম অঞ্চলে।

সিকিম থেকেই দালাই লামা তার উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং চীনের মাও সেতুং সরকারের সাথে শান্তি আলোচনার চেষ্টা করে যান। আলোচনা ফলপ্রসূ করার প্রয়াসে মাসের পর মাস অবস্থান করেন পিকিং-এ, কিন্তু একপেশে কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও এর কাছ থেকে কোনো সন্তোষজনক সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হন। এর মাঝে পঁচিশ বছরে বয়সে, ১৯৫৯ সালে দালাই লামা তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধ্যায় শেষ করেন, বৌদ্ধ দর্শনের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার মধ্য দিয়ে। সে একই বছরে তিব্বতের লাসায় শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। স্বাধীন তিব্বতের দাবীতে চীনা বাহিনীকে তাদের ভূমি ছেড়ে চলে যেতে বলে তিব্বতীয়রা। আর তখনি জন্ম হয় তিব্বতের ইতিহাসে জঘন্যতম কালো এক অধ্যায়ের। হাজার হাজার তিব্বতীয়কে নির্বিচারে হত্যার মধ্য দিয়ে চীনা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেয় তিব্বতের।

      ছবিঃ চতুর্দশ দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসু (সাম্প্রতিক কালের ছবি, ইন্টারনেট)

দালাই লামার বুঝতে বাকী থাকলো না যে, এরপর আর তিব্বতের মাটিতে চীনা সরকার তাকে কখনোই শান্তিতে থাকতে দিবে না। তার গন্তব্য হবে জেলখানার ক্ষুদ্র কামরা অথবা মৃত্যু। কিন্তু তার মৃত্যু হলে কি হবে তার অনুসারীদের, কি হবে তিব্বতীয়দের, একদিন যারা অনেক আস্থা আর বিশ্বাসের সাথে তার উপর তুলে দিয়েছিলো নিজেদের শাসনভার। অতএব, চীন সরকারের রোষানল থেকে বাঁচার তাগিদে দালাই লামা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হোন প্রতিবেশি দেশ ভারতে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মতাদর্শ প্রচারের উপর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ১৯৬০ সালের শেষের দিকে ভারত সরকার তার ভ্রমন এবং মতাদর্শ প্রচারের উপর বাধ্যবাধকতা তুলে নেন।

এরপর শুরু হয় দালাই লামার প্রচার। বিশ্বের দরবারে তিনি তুলে ধরেন তিব্বতীয়দের দাবী-দাওয়ার কথা। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান চান। তার প্রচারণার কল্যাণে সমস্ত বিশ্ববাসী পরিচিত হোন মহান বৌদ্ধ ধর্মের অনন্য অসাধারণ দর্শনের সাথে। নিরীহ শান্তিকামী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ সমাদৃত হতে থাকেন সর্বত্র। তাদের সহজ সরল জীবন যাপন, রীতি-নীতি মনোযোগ আকর্ষণ করে সমস্ত বিশ্বের। অহিংস উপায়ে সমস্যা সমাধানের জন্য নিরলস আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৯ সালে দালাই লামা অর্জন করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। দালাই লামা ঘোষণা করেন, কখনো যদি তিব্বতীয়রা চীনের বিরুদ্ধে সংঘাতময় প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টাও করে, তাহলেও তিনি তার পদ ত্যাগ করবেন। তার মতে, প্রতিরোধ অবশ্যই চলবে, তবে সেটা সংঘাতের মধ্য দিয়ে নয়।

      ছবিঃ জুলাই ১৭, ২০১১ যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে দালাই লামার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আগ্রহীদের দীর্ঘ লাইন

          ছবিঃ দীর্ঘ সে-লাইন ছাড়িয়ে গেছে মাইলেরও বেশি দূর

          ছবিঃ চাইনিজ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে

নির্বাসনে আসার পর থেকে দালাই লামার জীবনের একটাই স্বপ্ন- স্বাধীন তিব্বতের মাটিতে ফিরে যাওয়া। তার ভাষ্য অনুযায়ী, চীনারা যদি তিব্বতের মাটি ছেড়ে না যায়, তাহলে পরবর্তী দালাই লামা এমন এক স্থানে জন্ম নেবে যেখানে চীন সরকারের কোনো প্রভাব থাকবে না। তবে ২০০১ সাল তিব্বতের ইতিহাসে যুক্ত হয় একটি অনন্য মাইলফলক। এবছর প্রথমবারের মত জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হোন তাদের উচ্চপদস্থ মন্ত্রী। তিব্বত এগিয়ে যায় গণতন্ত্রের পথে। সম্প্রতি ২০১১ সালের ২৯ শে মে দালাই লামা তিব্বতের সংবিধান সংশোধন করে ঘোষণা করেন, ভবিষ্যতে তিনি তিব্বতের আধ্যাত্মিক প্রধান হয়েই থাকবেন, অন্য সব রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে চলে যাবে, যাতে করে একটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক তিব্বতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৪২ সালে দায়িত্ব নেয়া ৫ম দালাই লামা থেকে শুরু করে ৩৬৯ বছরে ইতিহাসে এই প্রথম নিয়মের পরিবর্তন হতে চললো। এতদিন ধরে দালাই লামারা আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক উভয় ধরনের ক্ষমতার প্রধান অধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অনেক প্রভাবশালী মহানায়কের আবির্ভাব ঘটেছে। সে-সব আজ শুধুই ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে আমরা ভেবে যাই, কেমন ছিলো তাদের জীবন, কেমন ছিলো তাদের জীবন ব্যবস্থা। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন পরে আসবে, আগেতো জানতে চাই সেই সমস্ত মহানায়কদের। মনে মনে ভাবি, একবার যদি তাদের সেই সময়ে ফিরে যেতে পারতাম, বসবাস করতে পারতাম সেই সমাজের অংশ হয়ে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, আমাদের সময়ে, এই আধুনিক সমাজেই, আমাদের মাঝেই আছেন জীবন্ত মহানায়ক- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।

মুভি রেফারেন্সঃ কুনদুন
দালাই লামার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট

মইনুল রাজু
[email protected]