লিখেছেনঃ সাইফ জুয়েল

মহাযুগের সমপ্তি ঘন্টা বেজে গেছে। ভীষম শংকিত হৃদয়ে অশ্রুগঙ্গা প্লাবিত হয় এখন। লাভ-ক্ষতির হাল খাতাটা খুলে দেখার সময় হয়েছে এখন মানুষের যদিও লাভ-ক্ষতির বিষয়টা খুব আপেক্ষিক। দুনিয়ায় আসলে সবকিছুই আপেক্ষিক, তারপরও মানুষ এখন অনেক কিছুকেই চুড়ান্ত সত্য বলে ধরে নিয়েছে। মানুষের ভ্রান্তিময় বোধগুলোকে আজকাল খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। এইসব ভ্রান্তিময় বোধগম্যতা তৈরী হবার পেছনে একটা কার্যকারন সম্পর্কও খুঁজে পাই। কিছু নষ্ট দেহমানব নিজেদের চিন্তার বিকৃতিকে দার্শনিক চিন্তার ডিসকোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং সেইসাথে বিকৃত চিস্তাগুলোকে মানুষের বোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। বৈষম্যের এই চুড়ান্ত যুগে এরা পন্ডিত ও দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েও গেছে। বহুযুগ আগের প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্তি এখন সব সত্যকে গ্রাস করে ফেলেছে প্রায়।

পৃথিবীর সব আত্মাই অবিচ্ছিন্ন ও চুড়ান্তভাবে এক। দৃশ্যমান এই বস্তুজগত আত্মার বিভিন্ন রুপগুলোর বর্হিঃপ্রকাশ মাত্র। আত্মা বিভিন্ন রুপে নিজেই নিজেকে দেখে। প্রকৃতি কতটা না অদ্ভূত! আমাদের বহ্যিক দৃষ্টিতে যত রুপ দেখা যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হলো মানুষের দেহরুপ। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, মানুষ ছাড়া প্রানীজগত আর উদ্ভিদ জগতের আর সবাই কতনা নিবিড়ভাবে মিশে আছে প্রকৃতিতে! ভবলেই মনটা বিষাদগ্রস্থ হয়ে ওঠে। কেবল মানুষই হয়ে উঠেছে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ক্রমেক্রমে। মাঝে মাঝে মনে হয় এটা পরমাত্মার কোন খেয়াল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার ভাবি, পরমাত্মা খেয়ালে কোন কিছু করবেন না, অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত কারন আছে।

স্থান ও কালের গান্ডিতে মোড়ানো এ জগতের দৃশ্যমান কোন দেহেই পরমাত্মা তার সব গুনাবলী নিয়ে আর্বিভূত হন না, আর সে কারনেই দেহ খাঁচায় বন্ধী আত্মা দেখতে পায়না তার আসল রুপ। কিন্তু সব দেহের তুলনায় মানবদেহেই আত্মা আর্বিভূত হন তার সবচেয়ে বেশী গুনাবলী বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। তাই মানুষের চিন্তা জগতের কোন সীমা নেই।  অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে মানুষের পক্ষে সব দেখা সম্ভব। নিজেকে চেনা সম্ভব। কিন্তু মানুষ চিনতে পারেনা নিজেকে। রিপুর তারনায় মানুষ হয়ে পড়ে দেহ কেন্দ্রিক। তখন মানবাত্মার ভাবনাগুলো হয়ে পড়ে নিতান্তই দেহ কেন্দ্রিক। আত্মার প্রধান কাজই হয়ে পড়ে দেহজাত তাড়নাতে সাড়া প্রদান করা।

আমরা প্রতিনিয়ত নিজের মনের আয়নায় নিজের ছবি না দেখে অন্যের ছবি দেখি। এটা আমাদের এক ভয়ংকর আত্মপ্রতারনা। তাই নিজেকে না দেখে অন্যের দোষ-গুন বিচারেই ব্যস্ত থাকি আমরা প্রতিনিয়ত। আমাদের ভেতরের আর বাইরের মানুষটা প্রতিনিয়ত আলাদা হতে থাকে। এক সময় আমরা হয়ে পড়ি ভন্ড, আর প্রতিনিয়ত অন্যকে গালমন্দ করি ভন্ড বলে। চিন্তা, কথা ও কাজের সংগতি মানুষের মধ্যে নিজস্ব স্বচ্ছতা তৈরী করে। ভন্ডামী যে আত্ম-প্রতারনারই সামিল।

আমাদের রিপুতাড়িত অনুভূতিগুলোর বিপরিতে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতি হলো ভালবাসা। পরমাত্মার সবচেয়ে মহৎ গুনের বর্হিঃপ্রকাশ ঘটায় মানুষ ভালবাসার মাধ্যমে। তিনি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছেন আর চুড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছেন মানুষের মাঝে। মানুষই পারে ভালবাসা দিয়ে রিপুতাড়িত সব ভ্রান্তিকে অতিক্রম করতে। ভালবাসা শুধু স্বজন বা বন্ধুকুলে সীমাবদ্ধ না রেখে অবিচ্ছিন্ন আত্মা বা প্রকৃতির প্রতি জাগিয়ে তুলতে পারলেই সব মন্দকে পরাজিত করা যায়। আত্মার অবিচ্ছিন্নতার ধারনা যার আছে সে কখনও কোন মানুষকে নিজ স্বত্ত্বা বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারেনা। দেহের ভোগে বিলিন আত্মাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ ভাবে নিজেকেই শুধু ভালোবাসে। পরমাত্মা এক সমন্মিত একক রুপ, যেখানে প্রতিটি আত্মাই এক পরম এককে বিলীন আর একাকার। মানুষকে ভালবাসাই ঈশ্বরকে ভালবাসা। যে মানুষকে ভালবাসতে শেখে সেই পৌছাঁতে পারে নিজ প্রেম আর ব্যক্তি প্রেমের উর্ধে।

ঈশ্বর নিজেকে স্থান ও কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ করে মানবরুপে আর্বিভূত হয়েছেন কেননা পরমাত্মা দেখতে চান ভালবাসা দিয়ে দেহজাত সব তাড়নাকে পরাজিত করা সম্ভব কিনা। ভালবাসা দিয়ে সাধন সিদ্ধ হয় যার, সে আত্মা লীন হয় পরমে। আর ব্যর্থ আত্মা ফিরে আসে বার বার মানব দেহে যতবার না মানব সাধন সিদ্ধ হয়। যে সত্য জানে সে নিজেকে খুঁজে পায়। মানবসাধন সেদিই হবে সিদ্ধ যেদিন ভালবাসার আলোয় দেহ আর মন হবে একই স্বত্ত্বা।

পরমাত্মা যে মানুষের মধ্যেই থাকেন এটা কিন্তু আনেক সুপ্রাচীন বিশ্বাস। অন্তত ধর্ম গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা যেসব কিংবদন্তী পাই তা থেকে বিষয়টা বোঝা যায়। ধর্ম তো আর আসমান থেকে কাহিনী বের করে আনে নাই! প্রচলিত বিশ্বাসগুলোকে আর দর্শনকে সংকলিত কার হয়েছে ধর্মগ্রন্থে। আমরা যদি আদি মানবের প্রচলিত কিংবদন্তিটির দিকে আলোকপাত করি তাহলে দেখি: জ্বীন জাতিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আদি মানবকে সেজদা করতে, কিন্তু জ্বীনের বাদশা মাটির মানুষকে সেজদা করতে সম্মত হয়নি। তাই সে হয়েছে শয়তান। এই কিংবদন্তীকে ধর্ম দিয়েছে ভূল ব্যাখ্যা। দেখিয়েছে, ইবলিশ সৃষ্টিকর্তার প্রিয় সৃষ্টিকে সেজদা না দেয়াতে শয়তান হয়ে গেছে । এতটুকু পর্বন্ত দার্শনিক বোধগম্যতাই হয়ত ছিল ধর্ম গঠনকারীদের। এরা ঈশ্বর আর মানুষ পৃথক স্বত্ত্বা, এই প্রচলিত ধারনাকে প্রতিষ্ঠিক করেছে। কিন্তু আমরা যদি কিংবদন্তীকে প্রাচীন কোন সমাজের বিশ্বাসকে বিশ্লেষনের একটা মাধ্যম হিসেবে ধরি তাহলে এই কিংবদন্তীটিকে অন্যভাবে বিশ্লেষনের সুযোগ আছে। যদিও বলা যেতে পারে কিংবদন্তী কোন ইতিহাস নয়, ইতিহাস বিশ্লেষনের উপাদান মাত্র। অতীতের কোন বিশ্বাস বা ঘটনা মুখে মুখে কালে কালে পরিবর্তিত রুপ ধারন করে এক সময় কিংবদন্তী হয়ে ওঠে। এই কিংবদন্তীগুলোর কোনটি কোথায় হয়ত লিপিবদ্ধ হয়ে এক সময় স্থির হয় আবার কোনটি কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। যাহাক, মূল জায়গায় ফিরে আসি। আদি মানবের কিংবদন্তিটি থেকে কি এই ধারনা করা যায়না যে প্রাচীন মানুষ তার উচ্চতা সম্পর্কে জানতো?  তারা জানতো পরমাত্মা মানুষের মধ্যেই থাকেন আর তাই মানুষের পক্ষে মন্দের কাছে মাথা নিচু করা সম্ভব না। আর মন্দই হলো শয়তান। অন্তত আমার কাছে এই কিংবদন্তীটি প্রাচীন সমাজের এমন বিশ্বাসেরই ইঙ্গিত  দেয়। ধর্মগ্রন্থের সুবাদে প্রাপ্ত আদিপিতা আদমের কিংবদন্তি থেকে সরলভাবে অন্তত এতটুকু বোঝা যায় যে, প্রচীন মানুষ আর নিজস্ব স্বত্ত্বার খোঁজ ঠিকই জানতো এবং এ জ্ঞানের বিশ্বজনিনতা ছিল।

ধর্মের পরমের ব্যাখ্যাগুলোকে আমার কাছে অনেক বেশী রাজনৈতিক বলে মনে হয়। এখানে ধর্মপ্রনেতারা সামাজিক নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার জন্য ঈশ্বরকে মানুষের কাছে ভয়ংকর রুপে উপস্থাপন করেছেন। যে ঈশ্বরের গুন হলো ভালবাসা দিয়ে জগতের সব দ্বাদ্ধিকতার আবসান ঘটানো, তিনি এতটা ভয়ংকর নন যে তিনি অগ্নি নরকে মানুষকে নিক্ষেপ করে প্রকারান্তরে নিজেকে শাস্তি দেবেন। কারন মানুষ কোন বিচ্ছিন্ন স্বত্ত্বা না। মানুষ ঈশ্বরের রুপ। এই রুপ ব্যক্তিকেন্দ্রীক বিচ্ছিন্ন মানুষে বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। মানুষের কাজ হচ্ছে আত্মার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের পরম রুপ সাধন করে নিজেকে চিনে নেয়া।

ভাল আর মন্দ হলো জগতের আর সব দ্বান্দিক বিষয়ের মতই প্রতিনিয়ত চলমান। মূর্ত আর বিমূর্ত সব কিছুই কিন্তু  জগতে দ্বান্দিক জোড়ায় বিদ্যমান। দ্বন্দের মাধ্যমে কি তিনি কোন মিমাংসায় পেীছাঁতে চান?  ভাল আর মন্দের  দ্বাদ্ধিকতা জগতের নিয়ম। শয়তান ঈশ্বরেরই তৈরী ভ্রন্তি। এ মোহনীয় ভ্রান্তিকে সত্যের বিপরিতে তিনি দাঁড় করিয়ে সত্যের মহানুভবতাকে উদযাপন করেন। সত্য আর মিথ্যা যদি পাশাপশি না থাকে তাহলে সত্যের সৌন্দর্য আর গুরুত্ব তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। তাই এ জগতে সত্যের পাশাপাশি থাকে মিথ্যা, সুন্দরের পাশাপাশি কদর্য, শুভর পাশেই থাকে অশুভ, ভালোর সাথে মন্দ। মানব জনম তারই সার্থক হয় যে খুঁজে নিতে পারে সত্যকে। সত্য হলো জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ভালবাসা আর মানবিকতা।