কুড়োনো কথন-১
পৃথিবীতে কিনা জানিনা তবে বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সহজ ও সবচেয়ে মজার ভাষায় কথা বলতে পারেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার (আমার মতে)। কথাগুলো গম্ভীর না হয়ে প্রাণোচ্ছল ও কটাক্ষমূলক হয় বলে নিজে লজ্জা পাওয়ার মধ্য দিয়ে একটু নড়েচড়ে উঠি সবাই। এই যেমন গতকালকের ক্লাসে স্যার বলছিলেন,

“আমি যদি উন্নত জাতের হাস মুরগী পালন, গোখামার তৈরি, এ ধরণের কাজগুলো করতাম তাহলে এতদিনে কত টাকা যে কামিয়ে ফেলতাম। কিন্তু পড়লাম মানুষের উন্নতি নিয়ে- আলোকিত মানুষ। (হেসে) না বুঝি নিজে না পারি অন্যকে বোঝাতে।”

এই আলোকিত হওয়া নিয়ে তাই তিনি একদিন মজা করে বলছিলেন, কেন্দ্রের একটা কাজে একবার ঘুষ দিতে হয়েছিল। কাজটি যে করেছিল সে একসময় কেন্দ্রের সদস্য ছিল, তাই সে অন্যদের কাছ থেকে যা নিত তা থেকে ২৫% ডিসকাউন্ট দিল। সেটা স্মরণ করে তিনি হাসতে হাসতে বললেন,

“কে বলল আমরা আলোকিত করতে পারিনি, এই যে দেখ অন্তত ২৫% তো আলোকিত করতে পেরেছি!!!”

কি আর বলব, স্যারের বলার ধরণে লজ্জাও লাগে, হাসিও পায়!

স্যারের আফসোস তিনি যেস্থানে কেন্দ্র খুলে বসে আছেন (বাংলামটরে) সেখানে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসে কিন্তু আশেপাশে থেকে মানুষ উকি দিয়েও দেখেনি এখানে কি হয়। স্যারের এক খালার বান্ধবী থাকেন বাংলামটরে। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের নিজস্ব বহুতল ভবন উঠতে দেখে একদিন সেই বান্ধবী স্যারের খালাকে ফোনে স্যারের সম্পর্কে বললেন,

“নারে ভাল কাজই তো করত মনে হয়, আমরাই বুঝতে পারিনি। দালান তুলে ফেলেছে!”

হায়রে পাবলিক!! আস্ত দালানই এদের চোখে পড়ে, পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এমন ছোট্ট একটুকরো স্বপ্ন নয়!

গতকাল ক্লাসে বলছিলেন

“বুদ্ধিজীবীরা আবার আমাকে বুদ্ধিজীবী মনে করেনা, কারণ আমি হাসি। বিদ্যাবুদ্ধি তো আর কারো চেয়ে কম ছিলনা, শুধু ওই একটা জায়গাতে মার খেয়ে গেলাম, আমার হাসি। হাসলে পরে তুমি আর বুদ্ধিজীবী থাকতে পারবেনা। আপনি হাসেন? তারমানে তো আপনি লাইট!”

আমরা কেউ যখন খুব হাবিতং করে বলতে থাকি কেন্দ্রে এসে কি শিখলাম ইত্যাদি ইত্যাদি তখনও স্যার বলে বসেন

“এবং শিখে ঘুমিয়ে গেলাম!”

ছোট ছোট বিষয় নিয়ে চলে আমাদের বড় বড় বাড়াবাড়ি। তাই নিয়ে একদিন বললেন,

“পানি একজন বলে আরেকজন জল বলে, আসল যে জিনিস-যা আমরা পান করি, সে হাসে।”

স্যারের আশাবাদী দর্শন জ্বলজ্বল করে তার প্রতিটি কথাতে। একদিন আমরা তারাশঙ্করের “কবি”র কয়েকটি লাইন “জীবন এত ছোট কেনে এ ভুবনে ” ভেবে হাহুতাশ করে মরছিলাম তখন তিনি বাধা দিয়ে বললেন,

“আসলে জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা, হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাইনাই।”

একদিন আমি থাকবনা, একেবারে ভ্যানিশ হয়ে যাব পৃথিবী থেকে, এসব ভেবে যখন পেটের ভাত চাউল হয়ে যাচ্ছে তখন এই মানুষটা বলেন,

“থাকবেনা কিছুই, সবাই চলে যাবে। কিন্তু ওই যে আশ্চর্য মুহূর্তগুলো পাওয়া গেল, সেগুলোই জীবন।”

এরপর আবার সেই কটাক্ষভরা কথা,

“কিন্তু সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখিনা, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল সেটা আমরা মনে রাখিনা, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল তা মনে রেখে দিয়েছি।”

তার আরো কিছু কটাক্ষভরা উক্তি আছে,
“মসজিদে যায় সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষগুলো অথচ কথা বলে সবচেয়ে মূর্খটা!”

“যে যুদ্ধ করে পরিবেশের সঙ্গে সে হল বীর, যে যুদ্ধ করেনা সে হল (হাসতে হাসতে) ‘চুহা’!”

“আমাদের দেশে সবাই একটা ‘পা’ চায়, পায়ের নিচে পড়ে থাকতে চায়।”

“আমি বলি, সম্মান করতে হলে মাথা উঁচু করে কর। তুমি তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলছ। আর যে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাকে দোয়া করেই কি লাভ, দয়া করেই কি লাভ।”

একবার ক্লাসে একজন রবীন্দ্রনাথের “গোরা” নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিল, গোরার কাজকর্ম তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে, স্যার তো তাকে ধুয়ে দিলেন একেবারে,

“শক্তিমান মানুষের পরিচয় হচ্ছে বাড়াবাড়িতে। এই যে তোমার আশেপাশে এত সমস্যা, এত কিছু হচ্ছে। কই তোমার তো কোন বাড়াবাড়ি দেখিনা।”

আমরা বেশির ভাগই এই দলের, কোন বাড়াবাড়ি নাই, আবার অন্যে ‘বাড়াবাড়ি’ করলে সমালোচনা করতে, তাকে দমাতে ছাড়িনা কেউই।

উনি যদি গম্ভীর মুখে বলতেন, দেশের জন্য কাজ কর, দশের জন্য কাজ কর, ভাল কাজ কর, ভেদাভেদ ভুলে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে তার কথার মাঝে অনেক বড় বড় কিছু হাই তুলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতাম। কিন্তু এভাবে কথা বলার জন্য তো আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্ম হয়নি। খামোখা তো আর এক ছেলে কুমিল্লা থেকে ঢাকা কলেজে এসে স্যারের ক্লাস করে যেত না!