জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রসঙ্গে
সম্প্রতি সরকার থেকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ এর (National Women Policy-2011) যে প্রস্তাবনা প্রকাশ করা হয়েছে তার বিপক্ষে কোন কোন ধর্মীয় সংগঠন থেকে পত্র-পত্রিকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে দেখলাম আমরা। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া বাস্তবে এতোটাই উগ্র রূপ নিতে গেলো যে, এই প্রস্তাবিত নারী নীতির সাথে প্রচলিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতময় প্রোপটটি আসলে কোথায়, সচেতন নাগরিক হিসেবে তা খুঁজে দেখার কৌতুহল এড়ানোর উপায় নেই।


.
নারী নীতি ২০১১ এর ‘পটভূমি’তে বলা হয়েছে-

‘নারী যুগ যুগ ধরে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোড়ামী, সামাজিক কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে তাকে সর্বদা রাখা হয়েছে অবদমিত। গৃহস্থালী কাজে ব্যয়িত নারীর মেধা ও শ্রমকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন “তোমাদের কন্যাগুলিকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্নের সংস্থান করুক”। তার এ আহ্বানে নারীর অধিকার অর্জনের পন্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।…’

খুবই সুন্দর কথা। তাই মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ বিষয়ক পুরো চব্বিশ পৃষ্ঠার পিডিএফ ফাইলটিতে এমন কিছু খোঁজার চেষ্টা করা হলো যেখানে তথাকথিত ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠির দৃষ্টিতে সমাজের অহিতকর কোন উপাদান উদ্ধার করা যায় কিনা। সমস্যা হলো দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। ব্যক্তি আমি যাকে অত্যন্ত হিতকর ভাবছি, অন্য কেউ হয়তো ভিন্ন ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যস্ততার কারণে তাকেই অহিতকর মনে করছেন। তাছাড়া অন্য যে কোন নারী নীতির মতোই এখানেও সুন্দর সুন্দর কথাসর্বস্ব বক্তব্যের কোন কমতিও চোখে পড়ে নি। হয়তো আরো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বা বক্তব্য রয়ে যেতে পারে, তবু সম্ভাব্য নমুনা হিসেবে এ থেকে ক্রমিক অবস্থানসহ খুব সংক্ষেপে কিছু বক্তব্য চিহ্নিত করা গেলে তা নিম্নরূপ দাঁড়ায়-

১৬.১ বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৬.৮ নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা।
১৬.১১ নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য দূর করা।
১৬.১২ রাজনীতি, প্রশাসন ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রিড়া এবং পারিবারিক জীবনের সর্বত্র নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৭.১ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার সকল ক্ষেত্রে, যেমন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ যে সমঅধিকারী, তার স্বীকৃতি স্বরূপ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা।
১৭.২ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (CEDAW) এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৭.৩ নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করা।
১৭.৫ রাষ্ট্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
১৭.৬ বৈষম্যমূলক কোন আইন প্রণয়ন না করা বা বৈষম্যমূলক কোন সামাজিক প্রথার উন্মেষ ঘটতে না দেয়া।
১৮.৪ কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ দূরীকরণ এবং পরিবারসহ সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা।
২৩.৭ নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরী, শ্রম বাজারে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা।

.
ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক চমৎকার কথামালা জুড়ে দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত নারী নীতিমালাটির পরতে পরতে। কিন্তু এই পোড়ার দেশে এরকম সুন্দর সুন্দর কথা তো আর কম শুনিনি আমরা। নীতিমালার সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যে এরকম সুন্দর ও মায়াবী কথামালা যে বলতে হয় তা বোধকরি আমাদের অভ্যস্ততায় গা-সওয়া হয়ে গেছে বলেই আমরা এটাও বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবার নয়। অন্তত যতদিন না আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাটার কোন পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন এসব যে কথার কথা হয়েই থাকবে তা আমাদের ধর্মগুরুরাও ভালো করে জানেন বলেই এ নিয়ে খুব একটা গা করেন না হয়তো। নইলে এই নীতি বয়ানগুলোর প্রায় সবকটিই যে প্রচলিত অনড় ও প্রাচীন ধর্মীয় অনুশাসনের বিশুদ্ধতার সাথে পুরোমাত্রায় সাংঘর্ষিক তা কি আর বলতে হয় ? এগুলোর একটু এদিক-ওদিক করেই আগের নারী নীতিমালায়ও তা অন্তর্ভুক্ত ছিলো বৈ কি। কিন্তু হঠাৎ করে নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ নিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠিটির এমন সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রত্যতায় খটকা লাগে, সত্যি কি এখানে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা তাঁদের পক্ষে এখন আর সহ্য করা অসমীচীন মনে হচ্ছে ? আবারো ভালো করে চোখ বুলিয়ে সম্ভাব্য আরেকটা পয়েন্ট পেলাম এরকম-

২৫.২ উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।

.
ঠিক মনে করতে পারছি না আগের কোন নারী উন্নয়ন নীতিতে ‘উত্তরাধিকার’ শব্দটি এভাবে ব্যবহৃত কিংবা এরকম কোন বাক্য উদ্ধৃত হয়েছিলো কি না। কর্মস্থলে বা আশেপাশের অনেকের মুখে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কথিত বক্তব্যের মতোই আশ্চর্যজনকভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ম বিরোধী আইন তৈরির সম্ভাব্য আশঙ্কার প্রতিধ্বনি শুনে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি আদৌ কি সেরকম কিছু রয়েছে ? তাঁদের আশঙ্কার কারণটাও বুঝার বাকি থাকে না যে, হয়তো নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপ করে নারীকে সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো কোন আইন এ সরকার তৈরি করে ফেলতে পারে বলে সমূহ আশঙ্কায় এরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু উপরিউক্ত উদ্ধৃতিতে এরকম কিছু মনে হলো না বা নারী নীতির কোথাও সেরকম কোন আলামতও চোখে পড়লো না। এদিকে সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদের বক্তব্যেও এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, প্রচলিত ধর্মীয় বিধান বা আইন ভঙ্গ হয় সেরকম কোন বিষয় এখানে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। আর তা যে হওয়া সম্ভবও নয় এটা দুয়ে দুয়ে চারের মতোই পরিষ্কার। সব মিলিয়ে কেমন একটা তালগোল পাকানো অবস্থা যেন। কিন্তু কেন এমন মনে হচ্ছে ? এখানেই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক মনস্তত্ত্ব, ধর্মীয় কাঠামোয় পুরুষের আধিপত্যবাদী লিঙ্গবৈষম্য এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণকামিতার মূল সুরটি প্রকটভাবে ফোটে ওঠে।
.
ধর্মীয় রীতি-নীতি এড়িয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আসলে কতটুকু ?
এই যে নারী নীতি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে এতো হল্লা, বর্তমান ধর্মীয় বাস্তবতায় এখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন কিছু কি করার আছে আদৌ ? অর্থাৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতা কতটুকু, এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই বুঝে নিতে হয় ধর্ম কী এবং রাষ্ট্রই বা কী, এতদবিষয়ক নানা প্রশ্ন ও সিদ্ধান্তগুলো। সভ্যতার সেই উন্মেষকাল থেকেই দার্শনিক ও সমাজ-রাষ্ট্রনীতিকরা এর উত্তর খুঁজেছেন বৈ কি। সে মোতাবেক যদি আমরা ধরে নেই যে রাষ্ট্রের প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে এর একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠি থাকবে, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য স্বীকৃত ও বিধিবদ্ধ একটা সংবিধান থাকবে, আর এই জনগোষ্ঠির অনুকুলে সংবিধানের আলোকে কতকগুলো নিয়ম-নীতি থাকবে যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে, তাহলে এই প্রতিফলনের মধ্যেই রাষ্ট্রের প্রকৃত শক্তিটা নিহিত থাকে বলা যায়। অতএব অন্যান্য অনেক জাতিগোষ্ঠির মতোই আমাদেরও একটা রাষ্ট্র রয়েছে ঠিক, এর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রয়েছে এবং চমৎকার একটি সংবিধানও রয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ধর্মভিত্তিকতার নিগড় ভেঙে রাষ্ট্রের সামগ্রিক জনগোষ্ঠির প্রতিটি নাগরিকের জন্য এক ও অভিন্ন মানবিক অধিকার ও জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় আদৌ কি সম্ভব ?
.
এটা একটা শাশ্বত প্রশ্ন বটে, যে কোন রাষ্ট্রের জন্যেই তা প্রযোজ্য। কারণ রাষ্ট্রের এই সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠিও কোন অভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসে একাত্ম নয়। যে বিশ্বাসের মধ্যেই প্রোথিত আছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন জীবন-সংস্কৃতি, লৈঙ্গিক অবস্থান, সম্পদ ও সম্পত্তির বন্টন ও ভোগের উত্তরাধিকার এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিতগুলো। এই বিশ্বাসই যেখানে নির্ধারণ করে দেয় নারী ও পুরুষের প্রকৃত ভূমিকা, প্রভাব ও আপেক্ষিক ক্ষমতা, সেখানে রাষ্ট্রের অবস্থান আসলে কোথায় ? এক বিশ্বাসের বর্ণবাদী কোপে যেখানে পুরুষগুলো নিজেরাই হয়ে যায় পরস্পর অনাত্মীয়, অন্য বিশ্বাসে আরেকজন ব্যক্তি মুক্তচিন্তার কারণে হয়ে যায় হননযোগ্য মুরতাদ। এক বিশ্বাসে যেখানে একজন নারীজন্মের অপরাধে হয়ে যায় যত্রতত্র স্থিতিহীন উন্মূল সত্তা, অন্য বিশ্বাসে সেখানে আরেক নারী আটকে যায় আমৃত্যু ক্রীতদাস্যের অবিচ্ছেদ্য শৃঙ্খলে। ফলে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসন দূরের কথা, ভিন্নধর্মীয় দু’জন নারীর মধ্যকার অধিকার-বৈষম্য রোধ করাই তো রাষ্ট্রের জন্য সুদূর পরাহত ব্যাপার। অতএব একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা নামের সুদৃশ্য কোন আবরণ দিয়ে নাগরিক বহিরঙ্গের পরিচ্ছদটাকে নানারূপে রঙিন করা যেতে পারে হয়তো, কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস নামের মায়াবী বেড়িটাকে ভাঙতে না পারলে পোশাকের আড়ালে ঢেকে রাখা মানব শরীরের অনপনেয় ক্ষতগুলো সারানো যাবে না কিছুতেই। কেননা বর্তমান বিশ্বে এমন কোন সভ্যতার উন্মেষ এখনো ঘটেনি যেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ উৎসব উদযাপন তথা প্রাত্যহিক জীবনাচরণের একান্ত খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলো কোন না কোন ধর্মীয় কাঠামো বা অনুশাসনের বাইরে সংঘটিত হবার নিরপেক্ষ কোন সুযোগ পেয়েছে আদৌ। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, গোষ্ঠির সাথে গোষ্ঠির, সমাজের সাথে সমাজের ইত্যাদি পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতগুলো এখনো ধর্মকেন্দ্রিকতার বাইরে একচুলও ভূমিকা রাখতে পারে নি বলেই মনে হয়। এমন কি মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যক্তি বা সামাজিক পরিচয়ের অন্তঃস্থ চলকগুলোও নিরেট ধর্মীয় পরিচয়েই মোড়ানো। একেবারে বহিরঙ্গের পরিচ্ছদে যে যেই রঙের আঁচড়ই লাগাই না কেন, এই আলগা পোশাকের ভেতরের নিজস্ব যত্নশীল শরীরটা আসলেই কোন না কোন ধর্মীয় ছকের একান্তই অনুগত বাধক হয়ে আছে। মানব সভ্যতার সামাজিক শরীরে নারীর প্রতি বৈষম্য নামক দুষ্ট ক্ষতটির উৎসমূলটা সেখানেই।
.
ধর্ম ও রাষ্ট্র
আরোপিত ধর্মীয় অনুশাসন আর বৈষম্যহীন রাষ্ট্রীয় বিধান আসলে দুটো স্বতন্ত্র সত্তা। এবং মানব সভ্যতার উৎকর্ষ অর্জন ও তার নাগরিকদের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা যেকোন বিশ্বাসের উর্ধ্বে রেখে সর্বেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সমতা আনয়নের লক্ষ্যে যে কোন কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মানবিক আইনই সর্বোচ্চ কার্যকর ক্ষমতাসম্পন্ন হবার কথা থাকলেও বাস্তবে তা সম্পূর্ণই বিপরীত অবস্থায় রয়েছে। কিংবা ওই কল্যাণকামী রাষ্ট্রই এখানে অনুপস্থিত। ধর্মীয় অনুশাসনই মূলত সর্বব্যাপ্ত হয়ে গিলে রেখেছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাগুলোকে। ফলে এখানে প্রকৃতপক্ষে কোন মানুষ থাকে না বা মানবাধিকারের অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবেই অনুপস্থিত এখানে। যা থাকে তা হলো বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ধর্মীয় পরিচয়বাহী মানব সদৃশ তথাকথিত শ্রেষ্ঠ প্রাণীদের যদৃচ্ছ পদচারণা। একে কি মুক্ত মানুষের স্বাধীন বাসযোগ্য পরিপূর্ণ মানবসভ্যতা বলা যায় ? ধর্মকে স্বাধীনভাবে মানা বা না-মানার অধিকার যেখানে বলবৎ থাকে সেটাই তো প্রকৃত মানব-রাষ্ট্র বা সভ্যতা। মূলত সেটাই প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবার কথা। কারণ সেখানে ধর্ম মানা বা না-মানার উপর নাগরিক মানুষের অধিকার ও উত্তরাধিকার চিহ্নিত হয় না। ওই রাষ্ট্রের নাগরিকের পরিচয় সেখানে নারী বা পুরুষ হিসেবে নয় কিংবা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, বাঙালি, অবাঙালি, গারো, চাকমা, উচ্চ বর্ণ বা নিম্ন বর্ণ ইত্যাদি কোন কিছু নয়। তার একমাত্র পরিচয় সে মানুষ এবং রাষ্ট্রের পুর্ণাঙ্গ নাগরিক। অতএব তার নাগরিক অধিকারের সমতা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্রই। আর এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলেই ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে অন্যান্য সকল নাগরিক অধিকারের মতোই তাদের পারিবারিক সম্পদ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার অভিন্ন সমতাও নির্ধারণ করে দেবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেখানে নাগরিক যোগ্যতা কোন ধর্ম বা জন্মকারণে চিহ্নিত হবে না, কর্মই মূখ্য। যেহেতু এ ব্যবস্থায় নারীও একজন মানুষ, তাই এখানে বৈষম্য রোধ করার জন্যে এখনকার মতো কোন অমূলক ও অপমানজনক নারী নীতি প্রণয়নেরও প্রয়োজন হবে না আর।
.
খুব সংগত কারণে এবার প্রশ্ন আসে, তাহলে কিভাবে আমরা এই ব্যবস্থাটাকে নিশ্চিত করতে পারি ? এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে একটা উত্তর তৈরি হয়ে যাবার কথা। আর যা-ই করতে চাই না কেন, প্রথমেই চেষ্টা হবে ধর্মীয় ব্যবস্থা নামের অসভ্য বেড়িটাকে আমাদের সভ্য শরীর ও মন থেকে খুলে নিয়ে কেবল একটা ঐচ্ছিক বা ভিন্নলৌকিক বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে একপাশে সরিয়ে রাখা। কারণ এই চিন্তাচ্ছন্ন ব্যবস্থাটার যেদিন জন্ম হয়েছে সেদিন থেকেই মানুষ আর মানুষ থাকে নি। ধন সম্পদ ভোগ লিপ্সার নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেন্দ্রিকতায় ধর্মীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চতুরতায় গোটা সমাজটা বিভক্ত হয়ে গেছে আরো অনেক বিভক্তির মতোই অমানবিক পুরুষ আর মানবেতর নারীতে। অপ্রতিরোধ্য পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের নির্লজ্জ হাতিয়ার হয়ে এই ধর্মীয় ব্যবস্থায় প্রভু-ভৃত্যের এক অন্ধকার সম্পর্কের বলি হয়ে গেছে স্বাধীন মানব-সত্তা। নির্জলা মিথ্যা আর যুক্তিহীন কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা এক নিষ্ঠুর অমানবিক প্রতারণার নামই যে প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব তা বুঝতে হলে আমাদের চিন্তাটাকে অবাধ ও মুক্ত করে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। তাহলেই কান টানলে মাথা আসার মতোই বাকি পরিবর্তনগুলো মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস। আমরা কি অন্তত একটিবার সক্রিয়ভাবেই সে চেষ্টা করতে পারি না, কী আছে এই ধর্মতত্ত্বের পেছনে তা খুঁজে দেখতে ?

(মে,২০১১)