(ফেসবুকের আলোচনার সূত্র ধরে এ লেখা। পাইচিংমং মারমা ‘চেতনার এনজিওকরণ’ নামে গতকাল একটি লেখা দিয়েছেন। তার এ লেখার উপর মন্তব্য হিসেবে আমার এ লেখা। মুক্তমনার পাঠকদের জন্যে এখানে পোস্ট করলাম।)

CHTBD-এর “পাহাড়ের প্রতিধ্বনি”-তে ‘চেতনার এনজিওকরণ’ (http://www.news.chtbd.net/?p=843) শিরোনামে পাইচিংমং মারমার একটি লেখা চোখে পড়ল।তিনি দাবী করেছেন তিনি কোন তাত্ত্বিক নন, বুদ্ধিজীবীও নন।তবে তার দাবী তিনি একজন “কর্মী”।জানিনা, তিনি নিজেকে কোন বর্গভুক্ত করছেন – রাজনৈতিক কর্মী নাকি সমাজকর্মী। যাহোক, “কর্মী” হিসেবে তিনি কী বলতে চেয়েছেন সেটা বুঝার চেষ্টা করেছি। তার আলোচনা থেকে মনে হয়েছে, তিনি এনজিওদের উপর ক্ষুব্ধ। কেননা, তার মতে জুম্ম সমাজে বিশেষকরে যুব সমাজে যে রাজনৈতিক বিমুখতা ও মূল্যবোধহীনতা বিরাজ করছে, অর্থাৎ ছাত্র-যুব সমাজের অংশগ্রহণে যে বড় ধরনের কোন আন্দোলন ঘটছে না, তার পেছনে এনজিওদের ভূমিকা রয়েছে। আন্দোলনে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে এনজিওরা “সমাজ মননে” অন্যরকম পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।এককথায়, তিনি বর্তমান জুম্ম সমাজের প্রেক্ষাপটে এনজিওর ভূমিকাকে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করছেন।তার এই তত্ত্ব বা অবস্থানের সপক্ষে তার লেখায় গভীর বিশ্লেষণ দেখতে পাইনি। ভাসাভাসা বা বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ইস্যূ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে লেখককে ধন্যবাদ জানাই – সমাজ ও এনজিও সংক্রান্ত আলোচনায় চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্যে।
পাহাড়ের সন্তান হিসেবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বিষয়ে কিছু অধ্যয়ন করার এবং ছোটখাটো কিছু ছোটখাটো গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুবাদে আমার যে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান হয়েছে, সে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ‘চেতনার এনজিওকরণ’ লেখকের উত্থাপিত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি।মনে পড়ছে, লেখকের সাথে এর আগেও ফেসবুকে এ ব্যাপারে বিতর্ক হয়েছিলো।

এনজিও প্রসঙ্গে লেখকের ধারনা ও কিছু উত্তরহীন প্রশ্ন

লেখাটা পড়ে মনে হয়েছে, লেখকের এনজিওর প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারনা বা prejudiced view আছে। সঙ্গতকারণে কারণে তার লেখাতে এনজিওর ‘কালো’ দিকগুলো ফুটে উঠেছে, কিন্তু ‘আলো’র ব্যাপারে কোন বক্তব্য নেই।এনজিও বিষয়ে লেখকের অবস্থান বা বক্তব্য হলো,

“…এনজিওতে চাকরী করার ফলে সমাজে একটা সমাজ মনন গড়ে উঠে যা আমাদের জুম্ম সমাজে যেখানে আমরা অস্তিত্বের লড়াইয়ে লড়ছি তার ক্ষতি হয়”।

লেখকের এ বক্তব্যে মূল প্রত্যয় বা চলকগুলো হলো “এনজিও” “সমাজ মনন” আর “জুম্মদের অস্তিত্বের লড়াই”। প্রথমে, এনজিও নিয়ে আলোচনা করা যাক। বর্তমান উন্নয়ন আলোচনা ও পরিকল্পনায় “এনজিও” একটি বহু অর্থবোধক প্রত্যয় এবং বিতর্কিতও বটে। লেখক তার লেখাতে “এনজিও” বলতে কাদেরকে বুঝিয়েছেন সেটা স্পষ্ট করেননি। শাব্দিক অর্থে যেসব সংগঠন সরকারের অংশ নয়, তারাই এনজিও। সেই অর্থে যারা রাজনৈতিক সংগঠন করছে, সমিতি করে, ক্লাব করে এবং ধর্মীয় মিশন তারাও এনজিও বর্গের মধ্যে পড়ে।আবার স্থান ও কার্যপরিধিভেদে এনজিওর রকমভেদ আছে। যেমন, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও। আবার এনজিওর কার্যক্ষেত্র অনুসারেও রকমভেদ আছে। পরিবেশবাদী এনজিও, মানবাধিকার বিষয়ক এনজিও, নীতি গবেষণা ও সংলাপ বিষয়ক এনজিও (যেমন, বাংলাদেশের থিংক ট্যাক প্রতিষ্ঠান সিপিডি), সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক এনজিও ইত্যাদি।এনজিওর বিবর্তন ও ভূমিকা অনুসারেও এনজিওদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।আগে উন্নয়ন শাস্ত্রে এনজিও বলতে কোন শব্দ ছিলো না।সেই এনজিওর ধারনা কীভাবে হলো, বিকাশ কীভাবে হলো? এই শুরু থেকে বিকাশ – এই যাত্রাপথে পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিওদের অবস্থান কোথায়? উন্নয়ন ধারনা পরিবর্তনের সাথে সাথে এনজিও ভূমিকা ও ধারা বদলেছে।এনজিও বিবর্তনের পর্যায়কে কয়েকটা ধাপে ভাগ ভাগ করা যায়। শুরুতে এনজিওর ভূমিক ছিলো ত্রাণ ও কল্যাণ-এর (Relief and welfare) মধ্যে। তারপর অনেক উন্নয়ন ধারনা (development concepts) এসেছে। সমাজ উন্নয়ন (community development), তারপর টেকসই উন্নয়নের জন্যে কাঠামোতে পরিবর্তন (structural change for sustainable development), এবং সর্বশেষ জনগণ আন্দোলন (peoples movement). উদাহরণ হিসেবে বলি, ব্রাকের জন্ম ত্রাণ ও কল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে। তারপর সে ধারনা থেকে চলে গেছে সমাজ উন্নয়ন কনসেপ্টে।ব্র্যাক বা বাংলাদেশের এনজিওরা ‘জনগণ আন্দোলন’ পর্যায়ে যায় নি। এনজিওরা সমাজ বাস্তবতার বাইরে নয়। সমাজ বাস্তবতার আলোকে এনজিওর ভূমিকা নির্ধারণ হবে। তবে এনজিওতেও সবাই ভালো সেটা নয়। রাজনীতিতে যেমন ডান, বাম, মৌলবাদ ইত্যাদি আছে, ঠিক তেমনিভাবে এনজিও সেক্টরেও চোর বাটপার থেকে শুরু করে ধর্মব্যবসায়ী, সমাজকর্মী ও ধন ব্যবসায়ীরাও আছে। যেমন, বিশ্বব্যাংক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের সাথে যেসব এনজিও জড়িত ছিলো তাদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণাভুক্ত এনজিওদের ভূমিকা অনুসারে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে Beneficiaries, Mercenary, Missionary, এবং Revolutionary (Carmen Malena, 2000, IDS Bulletin Vol 31, No 3). শব্দগুলো দেখে বুঝতে পারছেন, এনজিওরা উপকারভোগী হিসেবে যেমন দায়িত্ব পালন করতে পারে, অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে হিসেবেও কাজ করতে পারে, আবার বিপ্লবী ভূমিকাও পালন করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো এসব এনজিওর পেছনে কারা? কোন উন্নয়ন দর্শনে তারা বিশ্বাস করে? এখন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন রাখতে চাইঃ জুম্মদের উন্নয়নদর্শন কী? উন্নয়নকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষে চালিত করার জন্যে আমাদের সমন্বয়কারী শক্তি বা প্রতিষ্ঠান(গুলো) কে বা কারা আছে? তাদের নেতৃত্ব যোগ্যতা কী আছে? আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব এনজিও কাজ করছে তাদেরকে কীভাবে ভাগ করেছেন? তারা কোন উন্নয়নদর্শন বা কনসেপ্টে কাজ করছে এবং তারা কোন ভূমিকা (Beneficiaries? Mercenary? Missionary? Revolutionary?)পালন করছে সে ব্যাপারে আপনার কোন সুনির্দিষ্ট গবেষণা বা মূল্যায়ন আছে কী? আরো অনেক প্রশ্ন করা যায়। এনজিও সংক্রান্ত আলোচনা করতে গেলে এসব প্রশ্নের মীমাংসা না করে “এনজিও” বর্গে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত সবাইকে একই দোষে দোষী সাব্যস্ত করেন তাহলে সেটা যুক্তিসংগত হতে পারে না।

এখন, “সমাজ মনন” প্রসঙ্গে যাই। আপনার অভিযোগ এনজিওতে চাকরী করার ফলে এক ধরনের “সমাজ মনন” গড়ে উঠে এবং সেটা আমাদের অস্তিত্ব লড়াইয়ে ক্ষতিকর।কিসের ভিত্তিতে আপনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন? আর “সমাজ মনন” বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছেন? “সমাজ মনন”-এর ব্যাপারে একটু ব্যাখ্যা দিলে এনজিওর চাকরীর সাথে এর যোগসূত্রতা কী তা বুঝা যেতো। অবশ্য আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের উদাহরণ দিয়ে “সমাজ মনন” সম্পর্কে একটু বলার চেষ্টা করেছেন। আপনার উদ্ধৃতি দিচ্ছি,

“একজন ঢাবির জুম্ম সামাজিক দায়বোধ থেকে লিখতে চায় না। সে এনজিও’র incentive নিয়ে লিখতে আগ্রহী”।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের “সামাজিক দায়বোধ” কী কেবল এনজিও’র incentive দ্বারা প্রভাবিত? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এনজিওরা incentive সৃষ্টি করেছে। এই incentive-এর সাথে “সামাজিক দায়বোধ” থেকে লেখার মধ্যে সরাসরি নেতিবাচক সম্পর্কটা বুঝলাম না।এটা কার সমস্যা – এনজিওর নাকি ঐ ছাত্রের? ব্যাপারটা অনেকটা এরকম মনে হচ্ছে, “যার জন্যে করি চুরি, সে বলে চোর”। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিচ্ছিন্ন একজন ছাত্রের উদাহরণ টেনে পুরো এনজিও সমাজের ব্যাপারে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়।
এবার তৃতীয় প্রসঙ্গে যাই – “জুম্মদের অস্তিত্বের লড়াই”। এখানে বেশি বলার নেই। লেখাটা পড়ে মনে হয়েছে, লেখক এখানেও এনজিওদের দায়ী করেছেন। তার ভাষ্যমতে এত সংকটের মধ্যেও জুম্মদের অস্তিত্ব লড়াইয়ে বড় ধরনের কোন আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে উঠছে না। কারণ, ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা কাজ করছে। এর পেছনের কারণও এনজিও চাকরি। শিক্ষিত স্নাতকরা এনজিওতে ঢুকছে।এনজিওরা মেধা কিনে নিয়েছে। লেখকের ভাষায়,

“একদিকে অস্তিত্বরক্ষার জঙ্গি লড়াই যেমন গড়ে উঠছে না, অন্যদিকে শিক্ষিত অংশের মগজ কিনে নিয়ে নিয়েছে এনজিওগুলো। ফলে এসব ইস্যূতে যা হচ্ছে তা হোল গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম”।

তাত্ত্বিক ভাষায় বললে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন সেটা হলো, জুম্মদের জঙ্গি লড়াই গড়ে তোলার জন্যে ‘বিষয়গত বা বস্তুগত শর্ত’ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ‘বিষয়ীগত শর্ত’ পূরণে এনজিওরা বাধা হিসেবে কাজ করছে।কারণ, তারা আন্দোলনের প্রাণশক্তি যুব সমাজকে অন্যপথে নিয়ে যাচ্ছে। এ বক্তব্যের মধ্যে আপাত সত্যটা থাকলেও খুব বেশি বস্তুগত ভিত্তি নেই।জুম্ম সমাজ থেকে প্রতিবছর যে সংখ্যক গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে, তার কত অংশ এনজিওতে যাচ্ছে? শিক্ষিত “মগজগুলো” এনজিওতে না গেলে “জঙ্গি লড়াই”-এ সামিল হতো তার কতটুকু গ্যারান্টি ছিলো বা আছে? বরং এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে এক ধরনের দুরভিসন্ধি আছে। অর্থাৎ শিক্ষিত যুবকরা বেকার থাকলে, বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে আজকের ত্রিধাবিভক্ত জুম্ম রাজনৈতিকদলগুলো জঙ্গি লড়াই-এর নামে তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ পেতো। বাস্তবেও জেএসএস-ইউপিডিএফ রাজনীতিতে তাই দেখতে পাচ্ছি। দেখেছি, অনেক প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময়ী ছাত্র ছিলেন, যারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে, আন্দোলন করার প্রত্যয় নিয়ে উভয় দলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের স্বপ্নের বলি হলো কীভাবে? আজকে তাদের অনেকের পরিণতি কী হয়েছে তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।হতাশাগ্রস্ত হয়ে তাদের অনেকে আজ জেএসএস-এও নেই, ইউপিডিএফ-এও নেই। যাদের যোগ্যতা আছে, তারা বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে গেছে।অবশ্যই এখানে স্বীকার করতে হবে, জেএসএস-ইউপিডিএফ থেকে বের আসা যেসব যুবকদের বড় অংশ এনজিও চাকরীতে ঢুকেছে। কারণ, বর্তমান দুর্নীতির রাজ্যে সরকারী চাকরী পাওয়া কঠিন।সে যাই হোক, জুম্ম যুব সমাজে কেন রাজনীতিবিমুখতা কাজ করছে সে ব্যাপারে গবেষণা হতে পারে। তখন ধারনা পাওয়া যেতে পারে সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে। লেখকের একদেশদর্শী ব্যাখ্যার সাথে একমত নই। জোর দিয়ে এনজিওর চাকরীকে জুম্ম সমাজে রাজনীতি বিমুখতার জন্যে দায়ী করাকে যথাযথ নয় বলে মনে করি।

অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে
লেখক ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায়ের কথা এনেছেন খুব সুন্দরভাবে।অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্যের সারমর্ম হলো, এনজিওরা সাহায্য বা টাকা পয়সা দিয়ে গরীব দুঃখী মানুষকে খেয়ে পড়ে বাঁচিয়ে রাখে।এর মাধ্যমে তারা জনগণের রাজনৈতিক ক্রোধকে প্রশমিত করে রাখে। অর্থাৎ সরকার ও জনগণের মধ্যে একধরনের প্রতিরোধ দেয়াল বা buffer তৈরী করে রাখে। ফলে নিপীড়ক রাষ্ট্র বা পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে উঠে না। বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ সুবিধা বা চাকরীবাকরি পেয়ে যুব সমাজও শান্ত থাকে। অরুন্ধতী রায়ের এসব বক্তব্যে একেবারে সত্যতা নেই তা নয়। সত্যতা আছে। এখানে দেখতে হবে কে কোন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করে। অন্যভাবে বললে, কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়গুলোকে দেখেন। যেমন, পানি গ্লাসের উদাহরণ নেওয়া যায়? গ্লাসটি অর্ধেক পূর্ণ নাকি অর্ধেক খালি – কেউ প্রথমটা বলতে পারে, আবার কেউ দ্বিতীয়টা বলতে পারে। অরুন্ধতী রায় “খালি” থাকার কথাটা বলছেন।

অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য বিশ্লেষণ করতে গেলে উন্নয়ন তাত্ত্বিকদের কথাও আনতে হয়। উন্নয়ন তাত্ত্বিকরা দুই শিবিরে বিভক্ত। একদল তত্ত্ব দেয় ‘উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বের” উন্নয়ন ঘটাতে গেলে ‘আধুনিকায়নের’ পথ ধরে যেতে হবে। অর্থাৎ পশ্চিমারা যেভাবে উন্নয়নের পথে গেছে সেভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যেতে হবে। এর মানে হলো, কৃষি থেকে শিল্পায়নের দিকে যেতে হবে। এককথায়, পুঁজিবাদের পথ ধরে উন্নয়ন হবে। এদেরকে বলা হচ্ছে Modernization theorists (MT). অন্যদিকে আরো একদল প্রশ্ন করছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কীভাবে ‘আধুনিকায়নের পথ’ ধরবে? পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দারিদ্র্যে সুযোগ নিয়ে এমন নিয়মনীতি ও শর্তের জ্বালে আবদ্ধ করে রাখে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সবসময় পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। এই নির্ভরশীলতার কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সবসময় দরিদ্র অবস্থা হতে উত্তরণ হতে পারছে না। এ মতের তাত্ত্বিকদের এদেরকে বলা হচ্ছে Dependency Theorists (DT). নির্ভরশীলতার তাত্ত্বিকরা (Dependency Theorists) মার্ক্সিস্ট। তারা যুক্তি দেখান, পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিভিন্ন সাহায্য শর্তাবলীর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাজার ব্যবস্থা বা পুঁজিবাদ সম্প্রসারণ করে থাকে। রাষ্ট্র বাদেও সাহায্য দেওয়ার বিভিন্ন মাধ্যম আছে। যেমন, ব্যক্তি বা বেসরকারী খাত। বেসরকারী খাতের মধ্যে অন্যতম হলো এনজিও। অনেক পুঁজিবাদী অনেকসময় দেশ তৃতীয় বিশ্বের অনেক সরকারের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এনজিও বা বেসরকারী চ্যানেলে ফান্ড দিয়ে থাকে।সে ফান্ডের ধরনও বিভিন্ন হতে পারে – কিছু অনুদান, কিছু ঋণ, কিছু শর্তহীন আর কিছু শর্তযুক্ত। এই অবস্থান থেকে অরুন্ধতী রায়ের মত Dependency Theorists-রা এনজিওদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এনজিওরা এ জায়গায় কী ভূমিকা পালন করছে? বাজার বা পুঁজিবাদ সম্প্রসারণের জন্যে নাকি অন্য কিছু? সব সাহায্যকে আমরা কী নেতিবাচক হিসেবে দেখবো? কিংবা এনজিওর ভূমিকাকেও সবসময় নেতিবাচক দিক থেকে বিশ্লেষণ করবো?এনজিওর ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি একাডেমিকদের মধ্যেও আছে।নিচে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক অধ্যাপক David Lewis-এর “Management of Non-Government Organisations” বই থেকে একটা উদ্ধৃতি লক্ষনীয়।

“Indeed NGOs appeal to all sides of the political spectrum. For liberals, NGOs help to balance between state and business interest and prevent abuses of the power these sectors hold. For neo-liberals, NGOs are part of the private sector and provide vehicles for increasing market roles and advancing the course of privatization through private ‘not-for-profit’ action. Finally, for the left, NGOs promise a ‘new politics’, which offers the chance of social transformation, but presents an alternative to earlier radical strategies for capturing state power and centralization” (Clark 1998 in David, 2001, page 40).

(রাজনৈতিক অঙ্গনে সব মহলের কাছে অবশ্যই এনজিওদের উপযোগিতা আছে। উদারনৈতিকরা মনে করে, এনজিওরা রাষ্ট্র ও ব্যবসায়িক স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে সহায়তা করে। নয়া-উদারনৈতিকদের কাছে, এনজিওরা ‘অলাভজনক’ কাজের মাধ্যমে বাজার ও ব্যক্তিখাতকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। আর বামদের কাছে, এনজিওরা ‘নতুন রাজনীতির’ সম্ভাবনা সূচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সুযোগ আছে, তবে তা অবশ্যই পূর্বের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ও কেন্দ্রীকরণের কট্টর কৌশলের বিকল্প হিসেবে।)

এখানে লক্ষ্য করুণ, এখন কোন চশমা পরে এনজিওকে ব্যাখ্যা করবেন।অরুন্ধতী রায় বাম আদর্শের লোক। তিনি প্রথম দু’টো বিকল্প গ্রহণ করবেন না। বামদের জন্যে যে বিকল্প আছে, সেটা বিশ্বাস করেন কী না জানি না। পাইচিং মং মারমা বা অন্য যারা পাহাড়ে ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতি করেন বলে দাবী করেন, তারাও এনজিওর মাধ্যমেও তৃণমূল পর্যায়ে সমাজ পরিবর্তনে কাজ করা যায় সেটা বিশ্বাস করেন কী না? যদি না করেন, তাহলে নিজেদের কোন বিকল্প প্রস্তাব আছে কী?

পার্বত্য চট্টগ্রামে এনজিও নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের এলার্জি দেখেছি। এনজিও ব্যাপারে জেএসএস-ইউপিডিএফ উভয় দলই সন্দেহবাদী। তবে তাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় জুম্ম সমাজেও এনজিওর ভূমিকা থাকবে। এখানেও অবশ্যই বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ প্রয়োজন। খন্ডিত আলোচনা নয়, সেক্টরভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ে সামগ্রিক আলোচনা পর্যালোচনা ও গবেষণা প্রয়োজন।সেটা করতে গেলে অবশ্যই আগে থেকে prejudiced view থাকা উচিত নয়। না হলে পুরো সত্য উদঘাটনে সহায়ক হবে না।

ধন্যবাদ পাইচিং মং মারমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এখানে আনার জন্যে।

অডঙ চাকমা, ২১ জুলাই ২০১১