কৃষ্ণা-রাজকুমারী

ঈশানচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে জাতক পড়ছি কয়েকদিন ধরে। ছয় খণ্ডে তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সুপাঠ্য বলে রবিবাবু থেকে আলীসাহেব সবারই প্রশংসা লাভ করেছিল, আমারও পড়তে লাগছে চমৎকার। সাথে সাথে তাঁর টীকাগুলিও দারুণ। পড়তে পড়তে এর সপ্তম অংশ, ‘স্ত্রীবর্গ’-তে এসে আমি বেশ অবাকই হলাম। সেই প্রসঙ্গেই দু-এক-কথা বলব বলে এই শিরোনাম। কিন্তু তার আগে কাঠামো হিসাবে জাতক নিয়ে কিছু নবলব্ধ জ্ঞান ভাগ করে নিই।

(১)

গৌতম বুদ্ধের সময়কাল আনুমানিক ৫৬৩ – ৪৮৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ। কিন্তু বৌদ্ধ কাহিনীর মতে, তিনি এর আগেও বহু বার মানুষ অথবা জীবজন্তুর রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, এবং প্রত্যেকবারই পরম জ্ঞান অর্থাৎ বোধি লাভ করে বোধিসত্ত্ব হয়েছেন। সেই অতীত বুদ্ধ’দের জীবনের থেকে নেওয়া শিক্ষামূলক কাহিনী-সংগ্রহ, যেগুলো জাতিস্মর বলে গৌতম বুদ্ধ এই জীবনে শিষ্যদের শুনিয়েছেন, তার সংকলন হল জাতক

বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরেই রাজগৃহ (বর্তমান রাজগির)-তে রাজা অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি (সম্মেলন) আয়োজন করেন, যেখানে ত্রিপিটক অর্থাৎ বাণী-আচার-নিয়মাবলী ইত্যাদি একত্রিত করা হয় পালি ভাষায়। তার ১০০ বছর পরে, ৩৭০ খ্রী.পূ.র আশপাশে বৈশালীতে দ্বিতীয় সম্মেলনে এই বৌদ্ধগ্রন্থগুলি আলোচনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে বর্তমান রূপ গ্রহণ করেছিল।

কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে সম্রাট অশোক ২৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সময়ে পাটলিপুত্র (পাটনা)-য় তৃতীয় সঙ্গীতি আয়োজন করেন। তার অল্প পরেই, ২৪১ খ্রী.পূ. নাগাদ তাঁর পুত্র মহেন্দ্র সমগ্র বৌদ্ধগ্রন্থ নিয়ে সিংহলে যান এবং সিংহলী ভাষায় সেগুলোর অনুবাদ করান। পরে জাতক ইত্যাদি বহু আলোচনা-গ্রন্থের পালি মূল নষ্ট হয়ে যায়। খ্রীষ্টীয় ৫ম শতাব্দীতে মগধ থেকে বুদ্ধঘোষ গিয়ে সেগুলিতে আবার পালিতে অনুবাদ করে আনেন। এর পরে সিংহলে মূল অনুবাদগুলি নষ্ট হয়ে গেলে তারা আবার বুদ্ধঘোষের অনুবাদ থেকে সেগুলিকে সিংহলী ভাষায় ফিরে অনুবাদ করে।

বুদ্ধঘোষ বা তাঁর সমসাময়িক কেউ জাতকের কাহিনীগুলির যে অনুবাদ করেছিলেন, সেগুলির সংকলন এবং সম্পাদনা করে ৫৪৭টি কাহিনী নিয়ে ড্যানিশ গবেষক Viggo Fausböll ১৮৭২ সালে জাতকার্থবর্ণনা নামে পালি ভাষায় প্রকাশ করেন। ঈশান ঘোষের বইটি তারই অনুবাদ।

(২)

এই ইতিহাস-আলোচনার একটা উদ্দেশ্য ছিল, এই দেখানো যে জাতক-কাহিনীগুলি অতি প্রাচীন কালেই লিপিবদ্ধ হয়ে পড়ে – বুদ্ধের বলা মূল কাহিনীর সঙ্গে পরবর্তী সময়ে কিছু যোগ-বিয়োগ হয়ে থাকলেও তা খুব বেশিদিন পরে নয়। হিন্দু পুরাণগুলি যেমন অনেক সাম্প্রতিক কালেও পরিবর্তিত হয়েছে।

অবশ্য কোন জাতকগুলি প্রাচীনতম, বুদ্ধেরই বলা, আর কোনগুলি পরবর্তী সংযোজন, তা বলা কঠিন। তবে লেখক ভাব ও ভাষা বিচার করে কয়েকটিকে চিহ্নিত করেছেন। জাতকের মোট সংখ্যা কটি, তা নিয়েও কিছু দ্বিমত আছে। একই গল্প নানা জাতকে ভিন্ন নাম দিয়ে লেখা হয়েছে, আবার একাধিক গল্প একই জাতকে ঢুকিয়ে সেটাকে প্রায় উপন্যাসের মত বড় করে ফেলা হয়েছে।

তিনি উপক্রমণিকায় দেখিয়েছেন, যে সমসাময়িক অনেক লোকগাথা, বেদ-উপনিষদ, এমনকি মহাভারত-রামায়ণের গল্প থেকেও উপাদান নিয়ে সেগুলিকে শিক্ষামূলক রূপ দিয়ে এই জাতকগুলি লেখা। আবার জাতকের কাহিনী থেকে নিয়ে পরে লেখা হয়েছে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ইত্যাদি।

খ্রীষ্টজন্মের আগেই বৌদ্ধ দূতেরা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলেও ধর্মপ্রচারে যেতেন। সেই সময়ের ঈশপ ইত্যাদি গ্রীক আখ্যানেও জাতকের গল্পের ছায়া পাওয়া যায়। রাজা সলোমনের গল্প, আরব্য রজনীর গল্প, বাইবেলের গল্পেও।

উনি বলছেন, বেইরুটের কাছে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে তৈরী যে বৌদ্ধস্তূপ আছে (এর রেফারেন্স আমি গুগল খুঁজে পাইনি, কেউ পেলে জানাবেন দয়া করে) তাতে নাকি নাম উল্লেখ করে করেই জাতকের গল্প খোদাই করা আছে। জাতকের প্রাচীনত্বের এটাও আরেক নিদর্শন।

(৩)

জাতকের প্রাচীনত্বের কথা এই দেখানোর জন্য দরকারি, যে এই কাহিনী বাস্তবিকই বুদ্ধের সময়ের এবং তার কয়েক শতাব্দী আগে-পরের সমাজচিত্র এবং মানসিকতা তুলে ধরে। যাঁরা নীতিনির্দেশক, তাঁদের ধ্যানধারণারও একটা আন্দাজ পাওয়া যায় এ থেকে। তা চলুন, জাতকের দর্পণে দেখি, আজ থেকে দু-আড়াই হাজার বছর আগে, যীশু বা মহম্মদেরও পূর্বে, ভারতে মহিলাদের কেমন সম্মান করা হত।

সপ্তম অংশ অর্থাৎ স্ত্রীবর্গে ৬১ থেকে ৭০ এই দশখানা জাতক আছে। এর মধ্যে কেবল প্রথম সাতটিরই মূল উপজীব্য হল রমণী। সেগুলোই এক এক করে দেখি।

প্রথমটি হল অশাতমন্ত্র-জাতক (অশাত = অমঙ্গল)। এর শুরু হচ্ছে এইভাবে, “শাস্তা জেতবনে জনৈক উৎকন্ঠিত ভিক্ষুকে … বলিলেন, ‘দেখ, রমণীরা কামপরায়ণা, অসতী, হেয়া ও নীচমনা। তুমি এইরূপ জঘন্যপ্রকৃতি নারীর জন্য কেন উৎকণ্ঠিত হইলে?’ ” আহা, বিক্ষুব্ধ চিত্তকে সৎপথে আনার জন্য কী চমৎকার ভাষণ!

অবাস্তব গল্পটি সংক্ষেপে এইরকম। পুরাকালে বারাণসীতে বোধিসত্ত্ব এক বিখ্যাত গুরু হিসাবে জন্মেছিলেন। এক ব্রাহ্মণসন্তান তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরে সংসারধর্ম শুরু করতে গেলে তার মা-বাবার মনে হয়, সংসার অনর্থের মূল, ছেলেকে সন্ন্যাস নেওয়াতে হবে। এবং তার মনে বৈরাগ্য জন্মাতে হবে স্ত্রীচরিত্রের দোষ দেখিয়ে। তখন তার মা তাকে বলে, ‘বাছা, তুমি অনেক বিদ্যা শিখলেও অশাতমন্ত্র নিশ্চয়ই শেখ নি। যাও, গুরুর কাছে ফিরে তা শিখে এস।’

বোধিসত্ত্ব শুনে বুঝলেন, অশাতমন্ত্র নামে বাস্তবে তো কোনো মন্ত্র নেই, নিশ্চয়ই এর মা তাকে স্ত্রীচরিত্রের দোষ শেখাতে চান। তা তখন তাঁর ১২০ বছর বয়সী বিধবা মা তাঁর কুটিরেই বাস করতেন, বৃদ্ধা জরাগ্রস্তা দৃষ্টিশক্তিহীনা মাকে তিনি নিজে হাতেই সেবাযত্ন করতেন। তখন শিষ্যকে তাঁর সেবার ভার দিলেন, আর বললেন, নিয়মিত তাঁকে সেবা করার সময় তাঁর রূপের প্রশংসা করবে। মা যা বলেন, শুনে এসে আমাকে বলবে।

“স্ত্রীজাতি এতই অসতী, হেয়া ও নীচাশয়া যে এত অধিকবয়স্কা বৃদ্ধাও কামভাবের বশবর্তী হইয়া” সেই তরুণের প্রতি ঢলে পড়লেন, এবং বললেন, যে আমিও তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছি, কিন্তু আমার ছেলে খুব কঠোর স্বভাবের, তাই তাকে আমার ভয় হয় – তুমি তাকে মেরে ফেল, তাহলেই আমাদের মিলন হবে। শিষ্য গুরুকে হত্যা করতে অস্বীকার করলে তিনি বললেন, তুমি ব্যবস্থা কর, আমি নিজে হাতেই তাকে বধ করব।

এরপর বোধিসত্ত্ব নিজের বিছানায় নিজের এক কাঠের মূর্তি শুইয়ে শিষ্যকে বললেন, সে বৃদ্ধাকে গিয়ে খবর দিল। বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতেই কুঠার হাতে গিয়ে তাতে আঘাত করলেন, কিন্তু কাঠের শব্দে বুঝতে পারলেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তখনই তাঁর মৃত্যু হল। এই ঘটনা দেখিয়ে বোধিসত্ত্ব শিষ্যকে ব্যাখ্যা করলেন, যে নারীজাতির অসতীত্বই অশাতমন্ত্র।

(৪)

এর পর আসে অন্ধভূত-জাতক। এর থীম হল, “রমণীরা নিতান্ত অরক্ষণীয়া”, এবং গল্প এইরকম – প্রাচীনকালে বোধিসত্ত্ব এক রাজা ছিলেন, এবং তাঁর পুরোহিতের সঙ্গে নিয়মিত পাশা খেলতেন। খেলার সময় একটি গান গেয়ে চাল দিতেন, এবং গানটির সত্যতা-বলে প্রতিবারই জিততেন। সেটির অংশবিশেষ:

“পাপাচার পরায়ণ জানিবে রমণীগণ,
স্বভাব তাদের এই নাহিক সংশয়;
যখনই সুবিধা পায়, কুপথে ছুটিয়া যায়,
ধর্ম্মে মতি তাহাদের কভু নাহি হয়।”

তো এই শুনে পুরোহিত প্ল্যান কষে, কখনও অন্য পুরুষ দেখে নাই এমন একটি সদ্যোজাত কন্যা এক দুঃখিনী নারীর থেকে কিনে এনে তাকে প্রতিপালন করতে লাগলেন, এবং বয়সে পড়তেই তাকে বিয়ে করলেন। এরপর থেকে রাজা ওই গানটি গাইলেই পুরোহিত বলতেন, “কেবল আমার গৃহিণী ছাড়া।” অতএব এবার থেকে তাঁরই জয় হত।

এই দেখে রাজা (তিনি কিন্তু বোধিসত্ত্ব, খেয়াল রাখবেন, তাও প্রত্যেকবারই এই কাজ করান) এক ধূর্তকে টাকা দিয়ে বললেন এই নারীর চরিত্রনাশ করতে। সে ওই বাড়ির এক দাসীর মন ভিজিয়ে তার মাথার ফুলের ঝুড়িতে লুকিয়ে (!) ওই বাসায় ঢুকে পুরোহিতের স্ত্রীর সঙ্গে প্রমোদে লিপ্ত হল। পরে ছল করে ব্রাহ্মণের চোখ বেঁধে দুজনে তাঁকে প্রচুর পেটাল।

এরপর তিনি প্রাসাদে পাশা খেলতে গিয়ে ওই কথা বলেও হেরে গেলেন। তখন রাজা তাঁকে জ্ঞানদান করে বললেন, তোমার বউয়েরও চরিত্রটি গেছে। (নিজেই একাজ করিয়েছেন সেটা হয়ত চেপে গেলেন।)

পুরোহিত যখন বাসায় ফিরে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন সে প্ল্যান অনুযায়ী দাবি করল, আমি সতী, আসুন সবার সামনে অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছি। আর সেই লোক ভিড়ে লুকিয়ে ছিল, দৌড়ে এসে মহিলার হাত ধরে বলল, না না, এই পুরোহিতের মাথা খারাপ, আপনি এমন করবেন না। তখন বউ এই অজুহাত দেখিয়ে বলল, এর আগে কোনো পরপুরুষ আমায় ছোঁয় নি, কিন্তু এই যে এখন আমার হাত ধরে ফেলল, আমি তো আর অগ্নিপরীক্ষা দিতে পারব না। তবুও আপনার সন্দেহ মিথ্যা।

তখন এতে না ভুলে ব্রাহ্মণ তাকে বাড়ী থেকে দূর করে দিলেন।

(৫)

এর পরের তক্ক-জাতক এর মরাল হল, “স্ত্রীজাতি অকৃতজ্ঞ ও মিত্রদ্রোহী”। তার গল্প –

বারাণসীতে এক ব্যবসায়ীর এক বদমেজাজি মেয়ে ছিল, নাম দুষ্টকুমারী। সে তার দাসীদের খুব অত্যাচার করত। তাই একদিন গঙ্গায় নৌকা করে বেড়াবার সময় দারুণ ঝড় উঠলে দাসীরা তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ফিরে এসে বলে, কুমারী ডুবে গেছেন।

এদিকে বোধিসত্ত্ব নদীতীরে কুটির বানিয়ে তপস্যা করতেন, তিনি মেয়ের চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করে আনলেন। মেয়েটি তাঁকে দেখে ভাবল, “প্রণয়পাশে আবদ্ধ করিয়া এই তপস্বীর চরিত্রভ্রংশ ঘটাইতে হইবে।” তার প্রেম-ছলনায় ভুলে তিনি সত্যিই সাধনা ছেড়েছুড়ে তাকে বিয়ে করে এক গ্রামে গিয়ে বসত করলেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর অনুপস্থিতিতে গ্রামে ডাকাত পড়ল, ডাকাতসর্দার মেয়েটিকে লুঠ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করল।

কুমারী ভাবল, আমি এখানে খুবই সুখে আছি, কিন্তু আমার আগের স্বামী আমায় খুঁজতে এখানে চলে এলে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা। তাই তাঁকে এখানে আনিয়ে খুন করাতে হবে। সে একজনকে দিয়ে খবর পাঠাল, বোধিসত্ত্ব সেখানে এলে তাঁকে খাইয়েদাইয়ে লুকিয়ে রাখল, বলল আমরা রাত্রে পালাব। এদিকে সন্ধ্যায় ডাকাতসর্দার এলে সে তাঁকে ধরিয়ে দিল, অনেক মেরেধরে সর্দার তাঁকে ঝুলিয়ে রাখল।

সারারাত তিনি “অহো! কি নিষ্ঠুরা, কি অকৃতজ্ঞা, …” বলে আর্তনাদ করতে লাগলেন। সেই শুনে সকালে সর্দার ভাবল, এ লোক “মাগো বাবাগো” না বলে এইসব বলে কেন? ঘটনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি সব শোনালেন। তাতে সেও নারীজাতির সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে কুমারীকে দুটুকরো করে ফেলল, আর বোধিসত্ত্বের সাথে মিলে তপস্যা করতে চলে গেল।

(৬)

পরেরটি হল দুরাজান (দুর্জ্ঞেয়)-জাতক। এই ছোট্ট গল্পটার বক্তব্য হল, “রমণীরা যেদিন দুষ্কার্য্য করে সেদিন স্বামীর অনুবর্ত্তন করে, দাসীর ন্যায় বিনীত হইয়া চলে; কিন্তু যেদিন দুষ্কার্য্য করে না, সেদিন তাহারা মদোদ্ধতা হইয়া স্বামীকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।” এর মধ্যে একটি কবিতা আছে –

“ভাল যদি বাসে নারী, হইও না হৃষ্ট তায়;
যদি ভাল নাহি বাসে, তাতেই কি আসে যায়?
নারীর চরিত্র বুঝে হেন সাধ্য আছে কার?
বারিমাঝে চলে মাছ, কে দেখিবে পথ তার?”

তার পরের ছোট গল্পটি হল অনভিরতি-জাতক। এর বক্তব্য এর কবিতাটিতেই স্পষ্ট –

“নদী, রাজপথ, পানের আগার উৎস, সভাস্থল আর,
এই পঞ্চস্থানে অবাধে সকলে ভুঞ্জে সম অধিকার।
তেমনি রমণী ভোগ্যা সকলের, কুপথে তাহার মন;
চরিত্রস্খলন দেখিলে তাহার, রোধে না পণ্ডিত জন।”

তার পরে মৃদুলক্ষণা-জাতক। এটিতে কামভাব-সম্পর্কে বলা হয়েছে।
বোধিসত্ত্ব তপস্বী হিসাবে এক রাজার কাছে ভিক্ষা করতে এলে রাজা রাণীকে তাঁর পরিচর্যার ভার দেন। কিন্তু মৃদুলক্ষণা নামের ওই রাণীকে দেখে তাঁর মধ্যে কামভাবের উদয় হয়। এই শুনের রাজা তাঁকে রাণীকেই দান করে দেন। কিন্তু এরপর রাণীর কথায় তিনি রাজার থেকে পরপর বাসগৃহ, শয্যা, সজ্জা ইত্যাদি চেয়ে আনতে লাগলেন। অবশেষে সেই বিছানার রাণীর সঙ্গে শুলে’পর তিনি যখন বোধিসত্ত্বের দাড়ি ধরে টেনে “তুমি না শ্রমণ?” বলে প্রশ্ন করেন, তখন তাঁর চৈতন্য হয়, তিনি মহিলাদের অনন্ত চাহিদার কথা ভেবে রাণীকে ফিরিয়ে দিয়ে আবার হিমালয়ে ফিরে যান।

(৭)

উৎসঙ্গ-জাতক গল্পটা বরং অন্যরকম লেগেছে। এর প্রথম অংশে বলা হচ্ছে, “স্বামীই নারীদিগের প্রকৃত আচ্ছাদন।” –

“নগ্না জলহীনা নদী, নগ্ন অরাজক দেশ,
বিধবা রমণী নগ্না, কি বলিব তাহার ক্লেশ?”

কিন্তু গল্পটার মরাল একটু আলাদা। বোধিসত্ত্ব যখন কোশল রাজ্যের রাজা, তখন এই নারীর অনুপস্থিতিতে তার স্বামী-পুত্র-ভ্রাতাকে রাজপেয়াদারা চোর ভেবে ধরে নিয়ে আসে। তখন সেই মহিলা রাজার কাছে গিয়ে “আমায় আচ্ছাদন দাও” বলে কান্নাকাটি করে। রাজার আদেশে যখন লোকে তাকে একটি কাপড় দিতে যায়, তখন সে ওই কবিতাটি বলে এবং ব্যাখ্যা করে, যা শুনে রাজা খুব প্রসন্ন হন।

তখন তিনি বলেন, এই তিনজনের একজনের প্রাণ ভিক্ষা দিতে পারি, কাকে তা তুমি বেছে নাও। সে তখন বলে, স্বামী গেলে আবার স্বামী পাব, সন্তানও আবার হবে, কিন্তু আমার বাবা-মা মারা গেছেন, তাই ভাই গেলে তো ভাই আর পাব না। আপনি ওকেই মুক্তি দিন। এই থিয়োরিতে চমৎকৃত হয়ে রাজা তিনজনকেই মুক্তি দেন।

তা, লজিকটা কিন্তু সত্যিই বেশ – সেলফিশ জিন থিয়োরিও কিন্তু ভাবলে পর এমনই কিছু বলবে!

(৮)

গল্পগুলো পড়ে আমি যা বুঝলাম, তা এই স্ত্রীবর্গের শুরুতে ঈশান ঘোষও বলছেন, “এই সকল উপাখ্যানে নারীজাতির প্রতি উৎকট ঘৃণা প্রদর্শিত হইয়াছে। কামিনী ও কাঞ্চনের অপকারিশক্তি সম্বন্ধে পরষ্পর বিবদমান ধর্ম্মমতেরও ঐক্য দেখা যায় বটে, কিন্তু তাহা বলিয়া অন্য কোন শাস্ত্রকার সমগ্র নারী সমাজকে এত ঘৃণার্হ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন নাই।”

এর পর খানিক অ্যাপলোজিস্ট ভাবে তিনি বলেছেন, পরের দিকে বুদ্ধদেব কিন্তু নারীজাতির প্রতি অনেক উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। ভিক্ষুণী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা, অনেক উপাসিকাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই সে নিয়েও একটু খোঁজ করতে হল।

গৌতম বুদ্ধের মাসী, বিমাতা এবং ধাত্রী, মহাপ্রজাপতি গৌতমী যখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, তখন বুদ্ধ প্রথমে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ মহিলারা বিদ্যাবুদ্ধিতে পুরুষদের সমতুল্য নয়, তারা সংঘে এসে পড়লে শৃঙ্খলার সমস্যা ঘটবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু পরে যখন একবার বুদ্ধ বৈশালীকে অবস্থান করছিলেন, তখন গৌতমী আরো অনেক নারীদের সঙ্গে সেখানে গিয়ে আবারও সেই অনুরোধ করেন। এবার প্রিয় শিষ্য আনন্দের উপরোধে বুদ্ধ সম্মত হন তাঁদের গ্রহণ করতে। (কারণ আনন্দের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা অস্বীকার করেন নি, যে নারীরাও নির্বাণ লাভ করতে পারে।) অতএব এই সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাও খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন নি তিনি।

তাই ভিক্ষুণীদের জন্য আরো বেশি নিয়মের ব্যবস্থা করা হয়েছে এই ধর্মে। (এ নিয়ে মতভেদ আছে, যে নিয়মগুলি বুদ্ধেরই বানানো, নাকি পরবর্তীকালের।) ভিক্ষুদের জন্য বিনয়পিটকে চারটি ‘বিনয়’ বা নিয়ম আছে, যাতে বলা হয়েছে কী কী অন্যায় কাজ করলে তাদের সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কার করা হবে – যৌনাচার, চুরি, হত্যা, মিথ্যা অহঙ্কার।

ভিক্ষুণীদের জন্য কিন্তু আছে উপরি আরো চারটি –

কোনো কামাতুর পুরুষকে তাঁর কাছে আসবার বা স্পর্শ করবার অনুমতি দিলে,
কোনো কামাতুর পুরুষ তাঁদের অঙ্গ স্পর্শ বা মর্দন করলে,
দলের কোনো ভিক্ষুণী অন্যায় আচরণ করলে অন্য কেউ সে সংবাদ গোপন রাখলে,
কোনো নির্বাসিত ভিক্ষুর সঙ্গ নিতে কোনো ভিক্ষুণী আগ্রহী হলে,

তাঁদের ধর্ম থেকে পতন হবে।

অতএব কাম-সংক্রান্ত ফ্যাসাদ আসতে পারে অনুমান করেই তাদের আরও কঠোর শাসনে বেঁধে ফেলতে হবে, কারণ নারীই কামভাব ইত্যাদি পাপের মূলে।

(৯)

তাহলে বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গী, ধর্মের অনুশাসন, এবং আখ্যানগ্রন্থ থেকে সে সময়ের বৌদ্ধ ধর্মে এবং সমাজে মহিলাদের কেমন ‘সম্মানের’ চোখে দেখা হত তা ভালই বোঝা যাচ্ছে। তবে এখনকার বুদ্ধ-অনুগামীদের সমাজে অবশ্য মহিলাদের বিরুদ্ধে বায়াস বা ভায়োলেন্স তেমন দেখা যায় না বলেই আমার ধারণা। তার একটা কারণ হয়ত হতে পারে বহু অতিরিক্ত আখ্যান-আড়ম্বর-পূজা-নিয়মনীতি-সম্বলিত মহাযান মতের উদ্ভব। যাহোক, অহিংস, ‘নরম’ বৌদ্ধমতের মধ্যে এরকম একটা কড়া শভিনিস্টিক মনোভাব দেখে আমি বেশ অবাকই হয়েছি। তবে সেসময়ের সমাজে তো মহিলাদের সম্পর্কে বিশাল সম্মানের আবহ কিছু ছিল না, তাই ওরকম হওয়াটাই হয়ত আসলে স্বাভাবিক।

(১০-সংযোগ)

এই কথাটা আমার মনে এলেও আগে লেখা হয়নি – কেউ বলতেই পারেন, জাতকে কি আর ভালো মহিলাদের কথা নেই? তা আছে, ওই উৎসঙ্গ-জাতকই যেমন। বা গ্রাম্যবালিকা সুজাতা, যে বুদ্ধের প্রাণ না বাঁচালে এই ধর্মটাই থাকত না। তবে, মহিলাদের প্রধান মর্যাদা দিয়ে কোনো জাতক লেখা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না, ঈশানচন্দ্রও এমন কিছু উল্লেখ করতে পারেন নি। তা ছাড়া, সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই যে, কোনো গল্পে একজন ভালো মহিলা থাকলেও কিন্তু সেটাকে বিস্তার/জেনারেলাইজ করে “রমণীরা নিতান্ত দয়াশীলা, গুণবতী” এরকম কিছু কখনই বলা হয় নি, উল্টোটা বহুবার করা হলেও।

(১১)

লেখার পর, প্রায় আফটার’থট হিসাবেই (এর জুতসই বাংলা কী হবে?) মনে হল, যে প্রাচীন হিন্দু সমাজে (বা অন্যত্রও) স্ত্রী নেহাত বন্ধ্যা বা অসতী না হলে তাকে পরিত্যাগ করা বড় নিন্দনীয় কাজ। অথচ এটাই একমাত্র পরিস্থিতি যেখানে পতিব্রতা স্ত্রী, নাবালক সন্তান, বৃদ্ধ পিতামাতা-কে ফেলে গটগটিয়ে চলে যাওয়া বরং প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হয় – যখন কেউ পরিবার-সমাজ ত্যাগ করে ‘সত্যের’ সন্ধানে সুদূর বনে বা আশ্রমে তপস্যা করতে যায়। কী অদ্ভুত মিম!

আর এই মিমের বশবর্তী হলে যেহেতু প্রজননের পথ একেবারে সংযমের তালাচাবি এঁটে বন্ধ করে দিতে হয়, তাই এটা কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের ঠিক বিপরীতপন্থী! অথচ কি দ্রুত এই দর্শন সারা দুনিয়ার মানুষের মনে বসত করে নিয়েছে!

——————————————————

**** শুরুর ছবিটি অজন্তা’র প্রথম গুহা-বিহারে কৃষ্ণা-রাজকুমারীর চিত্র।

কিছু লিঙ্ক:
Women in Buddhism
Vinaya – Monks And Women, Nuns And Men
Damming the Dhamma: Problems with Bhikkhunīs in the Pali Vinaya
Can There Be Buddhist Gender Equality?