বেশ কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস “চাকমা উপন্যাস চাই” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর ওই প্রবন্ধটি সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত মহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ঢাকার লেদার কলেজের এক ছাত্র তো অতিউৎসাহী হয়ে ও “প্রথম চাকমা উপন্যাস লেখক” হবেন এই উচ্চাশায় “ফেবো” নামে একটা চাকমা উপন্যাস তো নয় “অপন্যাস” লিখেছিলেন। আর সেই “অপন্যাসের” গুণাগুণ বিচার না করে একটি পত্রিকায় রিপোর্টও ছাপা হয়েছিল। লিটল ম্যাগে যার কেবল দু’একটি ভুলে-ভরা ছড়া ছাপা হয়েছে, যার তখনো “নাগ চিবিলে দুধ নিগিলে” (চাকমা প্রবাদ, নাক টিপলে দুধ বের হয় অর্থাৎ কচি খোকা), সে কিনা উপন্যাস লেখতে উদ্যোগী হয়! উপন্যাস লেখা কি এত সহজ? তবে, সাহিত্য-যশ আকাক্সক্ষী ওই বেরসিক ছাত্রটির দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়। অবশ্য, পরে শুনেছি উনি সাহিত্যের পাটতাড়ি গুটিয়ে এক কোম্পানিতে চাকুরী নিয়েছেন।

যাই হোক, আমার উদ্দেশ্য আসলে চাকমা উপন্যাস বা অপন্যাসের আলোচনা নয়। প্রশান্ত ত্রিপুরার মতো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধের সমালোচনাও আমি করতে যাচ্ছি না। সে ধরনের যোগ্যতা কিংবা হিম্মত আমার কোনটাই নেই। আমি কেবল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওই প্রবন্ধের শিরোনাম ধার করে বলতে চাই “একজন বাঙালি লেনিন চাই”। অনেকে হয়তো ভ্রু কুঁচকে বলবেন, “কেন?”

এই “কেন”-এর উত্তর পাবার অধিকার আপনাদের অবশ্যই আছে এবং আমিও আপনাদেরকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। যার অধিকার তাকে দেওয়া ভালো, নচেৎ এদেশে কী হয় তা সবার জানা।

পৃথিবীতে নতুন এক বুদ্ধের আবির্ভাব কামনা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা লিখেছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে পড়া। কবিতার শিরোনাম পর্যন্ত এখন আর মনে নেই। (কেউ মনে করিয়ে দিলে খুশী হবো) তবে একটি চরণ এখনো স্পষ্টভাবে মনে আছে। তিনি লিখেছেন:

“নতুন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী, কর ত্রাণ মহাপ্রাণ, আন অমৃত বাণী।”

উদ্ধৃতি ভুল হলে আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। কবি বলতে চেয়েছেন পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল নতুন এক বুদ্ধের জন্মের জন্য কাতর হয়ে আছে। আমিও মনে করি, বাংলাদেশে মুক্তির জন্য আজ শোষিত বঞ্চিত কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ও অধিকারহারা ভাগ্যবিড়ম্বিত নিষ্পেষিত জাতিসত্তাগুলো ছটফট করছে। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা আজ বন্দী।

রুশ সাম্রাজ্যেও এক সময় অরুশীয় জাতিগুলোর উপর চলেছিল জার সরকারের নিষ্ঠুর দমন পীড়ন। বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশ ছিল অরুশীয় জাতিভুক্ত। অনেক সংখ্যালঘু জাতি ছিল সুসভ্য এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে রুশীয়দের চাইতেও এগিয়ে। জার সরকার এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতিকে উস্কে দিয়ে সব সময় দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতো ও এভাবে তার শাসন শোষণ বজায় রাখতো। শ্রমিক ও কৃষকের ওপরও চলেছিল অমানুষিক শোষণ নির্যাতন। মহান বিপ্লবী মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টিই দুনিয়া কাঁপানো ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে নিপীড়িত জাতি ও শ্রমিক কৃষকদের মুক্ত করেছিল।

আজ বাংলাদেশেও নিপীড়িত জাতি ও শ্রেণীর মুক্তির জন্য একজন লেনিনের বড়ই প্রয়োজন। বাঙালি জাতি বহু প্রতিভাবান মনিষীর জন্ম দিয়েছে। মহান পুরুষ অতীশ দীপংকর, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এই বাংলারই সন্তান। বাঙালি জাতি কি পারবে একজন লেনিনের জন্ম দিতে? বাঙালি জাতি কী পারবে এদেশের নিপীড়িত জাতিগুলোকে মুক্তি দিতে?