– সাকি (হেক্টর হিউ মানরো)

রূপান্তর : শুভ্র

“খালা যতক্ষণ নীচে না আসছেন মিঃ নাটল ততক্ষণ না হয় আমার সঙ্গেই গল্প করুন”, পাকা মহিলার মত ভারিক্কি ভঙ্গীতে যে একথা গুলো বললো তার বয়স খুব বেশি হলে পনের।

ফ্র্যামটন নাট্ল অতএব প্রস্তুত হলো খালার পরিবর্তে ভাগ্নির সাথেই দস্তুর মত সৌজন্য আলাপচারিতা আরম্ভ করতে। মিঃ নাটল যে খুব আলাপ পটু লোক তা নয়; তাছাড়া যে স্নায়বিক অসুখ থেকে সবে সে সেরে উঠছে, এই গ্রামীণ পরিবেশে যে জন্য বিশেষ করে তার আসা, তা প্রথমে ভাগ্নি পরে খালা এভাবে একের পর এক অপরিচিত লোকের সামনে পড়তে থাকলে তার স্নায়ুর অবস্থার যে খুব উপকার কিছু হবে সে ব্যাপারেও তার সন্দেহ দেখা দিল।

“আমি জানি ওই গ্রামে গিয়ে কি হবে,” ব্যাগের ভেতর কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে মিঃ নাটলের বোন বলেছিল, “তুমি ওখানে গিয়ে পড়বে নতুন লোকের মধ্যে, কারো সাথে হয়তো কথাই বলবেনা। শেষে একা থাকতে থাকতে আবার অসুখে পড়বে। আমি ওখানকার অনেককেই চিনি, তোমার কথা লিখে ওদেরকে চিঠিও দিচ্ছি তোমার হাতে। ওদের মধ্যে কয়েকজনতো দারুন চমৎকার মানুষ।”

ফ্র্যামটনের চিন্তা হলো এই মিসেস স্যাপলটন, যে কিনা পিচ্চি মেয়েটির খালা, সেওকি এই দারুন চমৎকার মানুষের তালিকায় পড়ছে কিনা।

অনেকক্ষণ কোন কথা হচ্ছেনা অনুভব করে বেশ দায়িত্ব নিয়ে মেয়েটি নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো “আমাদের এখানে কাকে কাকে চেনেন আপনি?”

“একজনকেও না,” বললো ফ্র্যামটন “আমার বোন একসময় থাকতো এই গ্রামে, সে চার বছর আগের কথা। ওইতো এই চিঠিগুলো দিয়েছে যাতে এখানকার লোকজনের সাথে আলাপ হয়ে যায়।” শেষ বাক্যে উৎসাহের চেয়ে ফ্র্যামটনের কণ্ঠে আক্ষেপের সুরটাই যেন স্পষ্ট শোনা গেল। বোঝাই যায় নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গটা তার জন্য বিশেষ উপাদেয় বোধ হচ্ছেনা।

“তাহলেতো আপনি খালার সম্পর্কে কিছুই জানেননা?” ভুরু কুঁচকে বলে উঠলো মেয়েটি।

“শুধু নাম আর ঠিকানা এই পর্যন্ত”, কবুল করলো ফ্র্যামটন। সত্যিইতো মিসেস স্যাপলটন সধবা না বিধবা তার কিছুই সে জানেনা। কিন্তু এই ড্রইংরুমের সজ্জ্বার ভেতরে কোথায় যেন একটু পুরুষালী ছোঁয়া আছে, যা থেকে মনে হয় এখানে পুরুষও বাস করে কিংবা হয়তো বাস করতো একসময়।

“খালার জীবনের দুর্ঘটনাটা ঘটে তিন বছর আগে,” মেয়েটি বলে, “ বোধ হয় আপনার বোনের চলে যাবার পরের বছরই হবে সেটা।”

“দুর্ঘটনা?” খানিকটা যেন চমকেই উঠলো ফ্র্যামটন। এই শান্ত গ্রামীণ পরিবেশে দুর্ঘটনা ব্যাপারটাই যেন বেমানান।

“আচ্ছা আপনার মনে হয়নি অক্টোবরের এই সময়েও ওপাশের ফ্রেঞ্চউইণ্ডোটা কেন খোলা।” লনের দিকটার ফ্রেঞ্চউইণ্ডোটার দিকে নির্দেশ করে মেয়েটা বলে। ফ্রেঞ্চউইণ্ডো নামে জানালা হলেও আসলে কাঁচের দরজা বিশেষ যা দিয়ে লনের বাগান থেকে কেউ চাইলেই সরাসরি ড্রইংরুমে এসে ঢুকতে পারে।

“ওহ্ তাইতো, কিন্তু শীতও তো এমন বেশি পড়েনি”, বললো ফ্র্যামটন, “কিন্তু জানালাটার সাথে দুর্ঘটনাটার সম্পর্ক কি?”

“তিন বছর আগে এই দিনেই ওই ফ্রেঞ্চউইণ্ডো দিয়ে আমার খালু আর দুই মামা শিকারে বেরিয়ে ছিল। ওরা আর ফিরে আসেনি। পাখি শিকারের জলা-জংলা জায়গাটা বছরের এ সময় পরিণত হয় ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপে। বৃষ্টিবাদলে এখানে ওখানে দেখাদেয় চোরাবালি আর আঠালো কাদা, একটু অসাবধানে পা ফেললেই বিপদ। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটা হলো ওদের তিনজনের কারো দেহই ওখান থেকে তোলা যায়নি।” মেয়েটির কণ্ঠস্বরে আর একটু আগের সেই পাকামো ভাবটা নেই।

“সেই থেকেই খালার মনে হয় ওরা আবার একদিন এই ফ্রেঞ্চউইণ্ডো দিয়েই ফিরে আসবে। ওরা আর ওদের সাথি সেই বাদামী রঙের স্প্যানিয়েলটাও। কুকুরটাও ওদের সঙ্গেই চোরবালিতে তলিয়ে গিয়েছিল। ওরা সব সময় শিকার শেষে এই ফ্রেঞ্চউইণ্ডোটা দিয়েই ঘরে এসে ঢুকতো, তাই খালাও বছরের এই সময়টায় জানালাটা সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা রাখে। খালা আমাকে কতবার যে বলেছে সেই দিন ওদের শিকারে বেরিয়ে যাবার ঘটনাটা; খালুর কাঁধে ঝোলানো সাদা রঙের রেইনকোটটার কথা, কিংবা তার ছোটভাই রনি খালাকে ক্ষ্যাপাতে কেমন কর্কশ স্বরে গান ধরতো এই সব।

“জানেন মাঝে মাঝে এরকম বিষন্ন সন্ধ্যায় আমারও মনে হয় এই বুঝি ওরা ফ্রেঞ্চউইণ্ডোটা ঠেলে ঢুকলো।” মেয়েটি একটু যেন শিউরে উঠলো। ঠিক সেই সময়ই মিসেস স্যাপলটন দেরীর জন্য ক্ষমা চাইতে চাইতে ঘরে এসে ঢুকলেন।

“যাক ভেরার সঙ্গে গল্প করছিলেন তাহলে ” বললেন মিসেস স্যাপলটন।

“হ্যাঁ, এইতো একটু…, চমৎকার মেয়ে” উত্তর দিল ফ্র্যামটন।

“আশা করি খোলা জানালাটার জন্য কিছু মনে করবেননা”, মিসেস স্যাপলটন বলে উঠলেন, “ আমার স্বামী আর ভাইরা শিকারে বেরিয়েছে। ওরা শিকার সেরে এদিক দিয়েই সাধারনত ঢোকে। জলার কাদা সারা শরীরে নিয়ে এসে আমার কর্পেটের যাচ্ছে তাই অবস্থা করে। আপনারা ছেলেরা এরকমই।”

মহিলা তারপর থেকেই শিকার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। শিকারের পাখী কেমন কমে আসছে। এবার শীতে তেমন বুনো হাঁস দেখা যাবে কিনা, ইত্যাদি। ফ্র্যামটনের কাছে গোটা ব্যাপারটাই যেন অসহনীয় বিভৎস হয়ে উঠছে। সে প্রাণ পনে চেষ্টা করতে লাগলো আলাপের বিষয়টা তার শারিরীক অসুস্থতার দিকে ঘোরাতে। কিন্তু নতুন বিষয়টা মনে হলোনা মহিলাকে বিশেষ আকর্ষণ করছে, তিনি মাঝে মাঝেই আড় চোখে ফ্রেঞ্চউইণ্ডোটার দিকে চাইছেন। কখনও ঘাড় উঁচু করে বাইরের লনটাও দেখছেন। এটা ফ্র্যামটনের সুনিশ্চিত দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে সে এত দিন থাকতে এই শোকাবহ দুর্ঘটনার দিনটিতেই এখানে এসে পড়েছে।

“ডাক্তার কিন্তু আমাকে পূর্ণ বিশ্রামের হুকুম দিয়েছেন, যে কোন মানসিক চাপ, উত্তেজনা এসব থেকে আমাকে বার বার দূরে থাকতে বলে দিয়েছেন,”  ফ্র্যামটন এমন ভাবে মরীয়া হয়ে বকে চলেছে যেন এই সদ্য পরিচিত লোকগুলোর কাছে তার অসুস্থতার বিষয়টা সত্যি একটা চমৎকার বিষয়।

“খাবারের ব্যাপারে কিন্তু ডাক্তাররা মোটেই একমত হতে পারেননি।”

“তাই নাকি,” একটা হাই চেপে মিসেস স্যাপলটন মেকী আগ্রহ দেখিয়ে বললেন। তারপরই তাঁর চোখমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ফ্র্যামটনের কথায় যে নয় তা স্পষ্ট।

“এই যে শেষ পর্যন্ত ওরা আসছে,” একটু চেঁচিয়েই উঠলেন তিনি, “যা হোক একেবারে চায়ের সময়ই আসলো তাহলে, দেখুন না একবার ওদের দিকে কাদা মেখে কি ভুতের চেহারাই না হয়েছে সবার।”

ফ্র্যামটন যেন বরফের মত জমে গেল তারপর ঝট করে সে পিচ্চি মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জানালাটির দিকে, তার বিস্ফোরিত দু’চোখে নিখাদ আতঙ্ক। শিরদাঁড়ায় একটা শীতল নাম না জানা অনুভূতি নিয়ে ফ্র্যামটন ঘুরে বসলো দৃশ্যটা দেখার জন্য।

সন্ধ্যার ঘন হয়ে আসা অন্ধকারের মধ্যে তিনটা ছায়ামূর্তিকে এদিকে হেঁটে আসতে দেখা গেল, তাদের বগলে শিকারের বন্দুকগুলো চেপে ধরা। একজনের ঘাড় থেকে ঝুলছে একটা সাদা রেইনকোট। একটা বাদামী রঙের কুকুর নিস্তেজের মত সঙ্গে সঙ্গে আসছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ওদের একজন হেড়ে কর্কশ গলায় গান ধরলো।

ফ্র্যামটন বিদ্যুত গতিতে নিজের ছড়ি আর টুপিটা তুলে নিয়েই উর্ধ্ব শ্বাসে ছুটলো সামনের দরজার দিকে। নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে প্রায় উড়ে লোহার গেট তারপর একবারে রাস্তায়। রাস্তায় উঠেই এমন পাগলের মত ছুটলো যে বিপরীত দিক থেকে আসা এক সাইকেল আরোহীকে রীতিমত পাশের একটা ঝোপে সাইকেল নিয়ে গড়িয়ে পড়ে দুর্ঘটনা এড়াতে হলো।

“এই যে আমরা এসে পড়েছি,” ফ্রেঞ্চউইণ্ডো দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সাদা রেইনকোট কাঁধে ঝোলানো লোকটি বললো, “আমাদের পায়ে অবশ্য কাদা কিন্তু চিন্তার কিছু নেই সবই শুকনো কাদা। আচ্ছা ওটা কে পাগলের মত ছুটে বেরিয়ে গেল?”

“আর বলোনা, সে এক অদ্ভুত মানুষ, মিঃ নাটল” জবাব দিলেন মিসেস স্যাপলটন, “সেই তখন থেকে নিজের অসুখ নিয়ে একটানা বকেই চললেন তারপর বলা নেই কওয়া নেই হুট করে লাফিয়ে উঠে কোন রকম বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই এমন ভাবে ছুটে বেরিয়ে গেল যেন ভুত দেখেছে।”

“আমার মনে হয় কুকুরটার জন্য” বলে উঠলো মিসেস স্যাপলটনের ভাগ্নি, “উনি আমাকে বলছিলেন কিভাবে ভারতে একবার গঙ্গার ধারের একপাল নেড়ী কুকুর উনাকে তাড়া করে গোরস্থান পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। একট খোঁড়া কবরে বসে তাকে সারাটা রাত কাটাতে হয়। কবরটার চারপাশে হিংস্র কুকুরগুলো দাঁত বের করে গর্জন করছিল সারা রাত। সেই থেকেই কুকুর দেখলেই লোকটার আতঙ্ক।”

অত্যন্ত অল্প সময়ের নোটিশে গল্প বানিয়ে ফেলতে মেয়েটির জুড়ি মেলা ভার।