নিউইয়র্কে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের (ইউএনএফপিআইআই) ১০ম অধিবেশনে বাংলাদেশের ১২ জন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শত শত আদিবাসী প্রতিধিনিরা যোগ দিয়েছিলেন। এই বৃহৎ আদিবাসী মিলন মেলাতে জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের ফার্ষ্ট সেক্রেটারী ইকবাল আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘জাতিসংঘের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে প্রকৃত আদিবাসীদের জন্য কাজ করা উচিত।’ (২৮ মে বিডিনিউজ টুয়েনটিফোর ডটকম) ইতোপূর্বেও জাতিসংঘের বিশেষ সভাতে সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীও আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। বাংলাদেশের আদিবাসীরা ৩রা জুন প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এবং আগামীতে জাতীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের আয়োজন করবে বলে জানা যায়। আদিবাসী নেতারা সরকারের কাছে পত্র দিয়ে এরূপ মন্তব্যের কারণ জানতে চাইবে বলেও জানান। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সাঁওতাল, উরাঁও, মুণ্ডা, মাহাতো, মাহালী, কোল, রাজোয়াড়, মুসহড়, গারো, হাজং, তুরী, ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী আমরা কে? আমাদের পরিচয় কী?

ক. আইনগতভাবে আদিবাসীত্ব: প্রজাস্বত্ব আইন জারি হয় ১৮৮৫ খ্রি.। প্রায় চল্লিশ বছর পর এই আইনে সপ্তম অধ্যায়ের সপ্তম ‘ক’ অধ্যায় নামে সংযোজিত হয়; এই সংযোজিত অধ্যায়ে আদিবাসীদের সম্পত্তি হস্তান্তর করার বিষয় সম্পর্কে নিয়ম-নীতি লিপিবদ্ধ হয়। এই অধ্যায়ের শিরোনাম ছিলো ‘Restriction on alienation of Land by Aboriginals’। বর্তমানে ষ্টেট এ্যাকুইজিশান এ্যাণ্ড টেন্যান্সী এ্যাক্টের শিারোনামও ঐ একই। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে সপ্তম ‘ক’ অধ্যায়টি সংযোজিত করা হয় ১৯১৮ খ্রি. ২নং বঙ্গীয় আইন (ইবহম অপঃ ওও ড়ভ ১৯১৮) দ্বারা। সপ্তম ‘ক’ অধ্যায়টি ১৯১৮ খ্রি. সংযোজিত হলেও বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার সাঁওতালদের ক্ষেত্রে আইনটি মূলত ১৯১৬ খ্রি. থেকে কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ ঐ জেলাসমূহের সাঁওতালগণ যদি ১৯১৬ খ্রি. নভেম্বর মাসের প্রথম তারিখে বা তারপর কোনো দলিল সম্পাদন পূর্বক কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করে থাকে তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। অন্যান্য আদিবাসীগণের ক্ষেত্রে সরকারি প্রজ্ঞাপন মারফর সপ্তম ‘ক’ অধ্যায়ের বিধানসমূহ কার্যকর করার এক বৎসর পূর্ব হতে ঐ আদিবাসীগণ দ্বারা সম্পত্তি হস্তান্তর দলিলের উপর কার্যকর করা হয়েছে। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকর ছিলো। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের স্থলে ষ্টেট এ্যাকুইজিশন এ্যাণ্ড টেন্যান্সী এ্যাক্ট ১৯৫০ খ্রি. প্রণীত হয় এবং তা ১৯৫১ খ্রি. কার্যকর করা হয়। আদিবাসীদের জন্য বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সপ্তম ‘ক’ অধ্যায়ে যে বিধানাবলী সন্নিবেশিত করা হয়েছিলো তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ষ্টেট এ্যাকুইজিশন এ্যাণ্ড টেন্যান্সী এ্যাক্টের ৯৭ নং ধারায় অক্ষুন্ন রাখা হয়। ষ্টেট এ্যাকুইজিশন এ্যাণ্ড টেন্যান্সী এ্যাক্টের ৯৭ নং ধারা আদিবাসীগণ কর্তৃক সম্পত্তি হস্তান্তর এর উপর নিধি-নিষেধ বহাল রাখা হয়। ৯৭ নং ধারা অনুযায়ী আদিবাসীগণ হলেন- সাঁওতাল, বানিয়া, ভূইয়া, ভূমিজী, ডালু, গারো, গন্দ, হাদি, হাজং, হো, খারিয়া, খারওয়ার, কোচ (ঢাকা বিভাগ), কোরা, মগ (বরিশাল জেলা), মাল ও সুরিয়া পাহাড়িয়া, মেচ, মুণ্ডা, মুণ্ডাই, ওরাঁও এবং তুরী।

রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে আপনারা আমাদেরকেই আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছেন –
১. তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৩ খ্রি. আদিবাসী বর্ষ উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে বলেছেন, ‘শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে আদিবাসী জনগণ নানামুখী শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। শাসক শ্রেণীর দীর্ঘদিনের সীমাহীন উপেক্ষা আর অবহেলার ফলে তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিও আজ বিলুপ্তির পথে। …বাংলাদেশেও কখনও কখনও বনায়নের নামে, সবুজ বিপ্লবের নামে, প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ, নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত। আজও কোথাও কোথাও আদিবাসীদের অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হয়। বেঁচে থাকার যে নূন্যতম মৌলিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। অন্ন, বস্ত্র, বাস্স্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং কর্মসংস্থানের নূন্যতম সুযোগটুকু থেকে তাদের উপেক্ষিত জীবন কাটাতে হয়। মানবিক জীবন যাপন, সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ, মেধা ও শ্রমশক্তি নিয়োগের অধিকার থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। দেশ ও জাতীয় উন্নয়নে তাদের অবদান অবশ্যই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। এই দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে’।

১.১ ২০০৯ খ্রি. আদিবাসী দিবস-এর বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘…নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে আদিবাসী জনগণ যাতে সবার মতো সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা আমাদের কতর্ব্য। …জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ণেও আমরা একযোগে কাজ করতে চাই।’

১.২ ২০০৮ খ্রি. নির্বাচনের পূর্বে জাতির উদ্দেশ্যে নির্বাচনী ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস ও বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ঘটনো হবে। ভূমির উপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। এবং তারা তাদের আচার আচরণ সংস্কৃতি ধর্ম যাতে সহজভাবে পালন করতে পারে সে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হবে’ (সংবাদ ২৯.১২.২০০৮)।

২. ২০০৩ খ্রি. তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আদিবাসী দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল আদিবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আদিবাসী। আদিবাসীরাও আজ সকলের মতোই সমান মর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশের নাগরিক। মুক্তিযুদ্ধে যেমন দেশগঠনেও তেমনি আদিবাসীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আদিবাসীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে আমরা বিভিন্নমূখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছি। আদিবাসীদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি। এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় সম্পদ। আমি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে আমাদের আদিবাসী জনগণের কল্যাণ ও সাফল্য কামনা করি।’
৩. বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি সংসদ রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকা ও ঐতিহ্যগত ভূমি ও বন অধিকার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসায় বাংলাদেশের আদিবাসীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে’ (সংবাদ ২৩. ৭. ২০১০)। অন্য জায়গায় বলেছেন,‘সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলেই তারা এর মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে’ (সংবাদ ১০.৮.২০০৯)।

৪. বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি সাংসদ হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, ‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে জাতীয় সংসদ বিশেষ উদ্যোগ নেবেন’ (প্রথম আলো ৯.৮.২০০৯)।

৫. সাম্যবাদী দলের নেতা ও শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, ‘আদিবাসীদের অধিকার সাংবিধানিকভাবে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হবে’ (প্রথম আলো ১০.৮.২০০৯)।

৬. চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে (এপ্রিল ৯, ২০০৭) রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সফর করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নীলগিরি ও আদিবাসী ম্রো এম্পুপাড়া। আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘পার্বত্য চট্ট্গ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা দেয়া হবে।’

. সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এ বছরের প্রথম দিকে আদিবাসী অধ্যুাষিত বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকা পরিদর্শনকালে আদিবাসীদের সাথে মতবিনিময় করেছেন এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানে তার দলের কোনো আপত্তি নেই বলে উল্লেখ করেছেন।
.
সাংগাঠনিকভাবে বা সংগঠন থেকে গৃহীত হয়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের বিষয় উল্লেখ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন –

১. আওয়ামী লীগ ২০০১ খ্রি. ‘পশ্চাৎপদ অঞ্চল ও অনুন্নত সম্প্রদায়’ শিরোনামে উল্লেখ করেছিলেন- ক. ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ১৯৭৫ সালের পর আমাদের সংবিধানে পরিপন্থী বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ইতিমধ্যে তার অবসান ঘটিয়েছে। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন ও অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলসহ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তার ফলে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বজনীন মানবাধিকার। ভবিষ্যতে এই অর্জনসমূহকে আরও সংহত ও বিকশিত করা হবে। খ. দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সুষম বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পশ্চাৎপদ অঞ্চলসমূহের উন্নয়ন এবং উপজাতি, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অগ্রগতির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। জাতিগত সংখ্যালঘুসহ দেশের সকল নাগরিকের ধর্মীয় আচারবিধি পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। দেশের সকল নৃ-জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে বিশেষ যত্ন নেয়া হবে।
১.ক. আওয়ামী লীগ-এর ২০০৮ খ্রি. নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ সম্ভ্রম, মানমর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গস্খহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকুরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অব্জলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।’

৩. জাতীয় পার্টি (এ) ২০০১ খ্রি. এর নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিলো ‘আদিবাসী’ শিরোনাম দিয়ে। ‘আদিবাসী জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে।

৪. ১১ দল ২০০১ খ্রি. এর নির্বাচনী ইশতেহারে ‘সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও আদিবাসী সমাজ’ ক্যাপসান দিয়ে বলেছিলো- ‘সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর স্বকীয়তার পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।

৪ ক. বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির ২০০৮ খ্রি. নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়- ক. সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর স্বকীয়তার পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর প্রদান এবং সেই অনুসারে দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গ. সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বার্থ রক্ষা, অধিকার নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহায়তা প্রদান এবং বিকাশের জন্য এ সকল জাতিসত্তার মানুষদের প্রতিনিধিত্ব সংবলিত পৃথক প্রশাসনিক বিভাগ ও আদিবাসী কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষা, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রাখা। ঘ. ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চুক্তি’র পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গঠিত ‘ভূমি কমিশন’ সঠিকভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বাস্তুভিটা ও ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। ঙ. জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সমাজ অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য জীববৈচিত্র্য বিনাশকারী সব ধরনের তৎপরতার অবিলম্বে বন্ধ করা। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি ও বনের ওপর আদিবাসীদের অধিকার ও অংশীদায়িত্ব নিশ্চিত করতে ভূমি কমিশন গঠন করা। ইকোপার্ক, পর্যটন কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলার সময় আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন, আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাকে বিপন্নকরণ, বাস্তুচ্যুতকরণ ইত্যাদি বন্ধ করা। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জনগণের অস্তিত্ব, পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবিকাকে বিপন্ন করে- এমন ধরনের তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করা। যে কোনো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আগে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। চ. আলফ্রেড সরেন, পীরেন স্লাল, সত্যবান হাজং, চলেশ রিছিল হত্যাকাণ্ডসহ আদিবাসীদের ওপর হত্যা, অত্যাচার, উৎপীড়নের ঘটনার বিচার করা। সমতল ভূমির সাঁওতাল, গারো, হাজং, ওরাঁওসহ সকল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে একটি ‘ভূমি কমিশন’ গঠন করা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার খাস জমি বণ্টনে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া। এ বিষয়ে ১৯৫০ সালের ভূমিস্বত্ব আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

. জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ২০০১ খ্রি. এর নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিলো- ক. মানবাধিকার কমিশন গঠন করে জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহের ওপর রাষ্ট্র, সরকার কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনধিকার হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। খ. নারী সমাজ, সংখ্যালঘু, আদিবাসীসহ সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সকল বৈষম্যমূলক আইন, পদ্ধতি, প্রথা ও আচরণ বিলুপ্ত করা হবে। গ. রাষ্ট্র সরকার ও প্রশাসন সকল জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে এবং বৈষম্যমূলক কর্মপদ্ধতি বিলুপ্ত করা হবে।
.
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে আদিবাসীদের সম্পৃক্তকরণে চলমান কার্যক্রম

১. জাতীয় সংসদে আদিবাসী বিষয়ক ককাস গঠন করা হয়েছে।
২. ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে আদিবাসীদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ। সমতলের আদিবাসী গারোদের জন্য ১৪০ কোটি এবং বাকি সমতলের ৩০টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠীর ২৫ লাখ আদিবাসীদের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ (ইত্তেফাক ৩.৮.২০১০)।
৩. পিআরএসপি-তে আদিবাসী কথা এবং আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪. শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৫. সাফ গেমস এবং বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের উপস্থিতি এবং আদিবাসী সংস্কৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে।
৬. মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় সাংসদবর্গ, মন্ত্রীবর্গ, স্পিকার আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
৭. মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নারী, আদিবাসীদের জন্য বিশেষ বিসিএসের পরিকল্পনা করছে সরকার। জাতীয় সংসদে সাধনা হালদারের প্রশ্নের জবাবে সংসদকাজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ কথা জানান। (প্রথম আলো ৪.৩.২০১১)।
৮. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আদিবাসী ছাত্রছাত্রীর পাস নম্বর কমিয়ে মোট নম্বরের ৩৫ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি (প্রথম আলো ২.৩.২০১১)
৯. সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি আলাদা ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে (প্রথম আলো ৩১.৩.২০১১)।

আমরা মনে করি আদিবাসীদের নির্ধারণে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি স্মরণ রাখা দরকার। একটি জনগোষ্ঠী ১৯৪৭ খ্রি. দেশ বিভাগকালে যে জায়গায় ছিলেন, স্বাধীনত্তোর বাংলাদেশেও সেখানেই আছেন। রাজনৈতিক মানচিত্র দিয়ে আদিবাসীত্ব বিচার্য নয়। বাংলাদেশের আদিবাসী বলতে তাই বুঝতে হবে অবিভক্ত বাংলার আদিবাসীদের, আর অবিভক্ত বাংলা বলতে বুঝতে হবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনপর্ব বাংলাকে যার অর্ন্তভুক্ত ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম ও ত্রিপুরা। পশ্চিম বাংলা ও বিহারের কিয়দংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে ঝাড়খণ্ড; আর আসাম বিন্যস্থ হয়েছে বহু পরিচয়ে যার সাথে ত্রিপুরা যুক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে ‘সেভেন সিস্টারস’ (অরুণাচল, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ড, মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা প্রদেশ মিলিয়ে)। যেহেতু এ সবগুলির সাথেই রয়েছে বাংলার ঐতিহাসিক ভৌগোলিক সর্ম্পক, তাই বাংলাদেশের আদিবাসীদের পর্যালোচনায় এতদঞ্চলের আদিবাসীদের সংগ্রহিত করতে হবে। সরকারের একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তার এহেন বক্তব্য সত্যিই এদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের ব্যাথিত করেছে, সংক্ষুব্ধ করেছে। আদিবাসীদের আইনগত অবস্থান, রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করেই বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে কী না মন্তব্য করলে আমরা সুখী হতাম।